বয়স মাত্র আঠারো। কোলে চার মাসের শিশু সন্তান। সদ্য বিধবা মেয়েটির চারপাশে একরাশ অন্ধকার। নিজ ঘরে অনেকটা পরগাছার মতো জীবন। উঠতে বসতে গঞ্জনা, আপবাদ। একে তো স্বামী হারানোর বেদনা, অন্যদিকে চারপাশের অসহনীয় পরিবেশ। তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া মেয়েটি তখন আকুল ভাবে খুঁজছে মুক্তির পথ। আর মৃত্যুর থেকে মুক্তির সহজ উপায় আর কী হতে পারে! কিন্তু মৃত্যুতেই কি মুক্তি নাকি হেরে যাওয়া? মেয়েটি ভাবে কেন সে হেরে যাবে জীবনের কাছে? তার দোষ কোথায়? ওই ছোট্ট শিশুটিরও দোষ কোথায়? তাহলে মুক্তি কোথায়? মেয়েটি ভাবে। বুঝতে পারে পরাধীনতার জীবন মুক্ত হয়ে যদি সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে মুক্তি সমম্ভ। আর তার জন্য চাই লেখাপড়া। কিন্তু মেয়েদের লেখাপড়া করার পথটাও সুগম নয়। তারপরে সে বিধবা। কিন্তু পিছিয়ে গেলে চলবে না। মেয়েটি নিজেকে বোঝায় হেরে যাওয়া চলবে না। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। নিজের জন্য বাঁচবে। বাঁচবে তার মেয়ের জন্য। শুরু হয় তার জীবনের নতুন লড়াই, নতুন অধ্যায়। সাফল্যের বরমাল্য গলায় পরে নতুন নজির সৃষ্টি করে হয়েছিলেন দেশের প্রথম মহিলা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অসামান্যা এই নারী হলেন আয়ালাসোমায়াজুলা ললিতা।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট চেন্নাইয়ের এক মধ্যবিত্ত তেলেগু পরিবারে ললিতার জন্ম। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বাবা পাপ্পু সুব্বারাও ছিলেন গুইন্ডির কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক। ছেলেমেয়ে উভয়ের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সচেতন। তার সব ছেলেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন।
সেকেন্ডারি স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট পাওয়ার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় ললিতার। তৎকালীন সামাজিক নিয়ম মেনে মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিয়ে যায় ললিতার। ১৯৩৭-এ তাঁর মেয়ের জন্ম হয়। মেয়ের বয়স যখন মাত্র চার মাস তখন তার স্বামী মারা যায়। অষ্টাদশী বিধবা ললিতার জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ছেলের অকাল মৃত্যুর জন্য শাশুড়ি ললিতাকে নানারকম কথা শোনাতেন। তাঁকে অপয়া বলে গালিগালাজ করতেন। জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ললিতা ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প নেন।
শুরু হয় ললিতার জীবনের নতুন অধ্যায়। কুইন মেরি কলেজ থেকে তিনি ইন্টার মিডিয়েট পাশ করেন প্রথম বিভাগে। সিদ্ধান্ত নেন বাবা-ভাইদের মতো ইঞ্জিনিয়ার হবেন। সেই সময় একজন মেয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্তটি বেশ অভিনব ও সাহসের। তবে বাবা তাঁর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন।
যাই হোক, ইঞ্জিনিয়ারিং তো পড়বেন কিন্তু কোথায়? তখন গুইন্ডির কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মেয়েদের পড়ার সুযোগ ছিল না। পরিত্রাতা হয়ে এগিয়ে এলেন বাবা। তিনি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল এবং পাবলিক ইনস্ট্রাকশান ডিরেক্টরকে মেয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যাপারটা বলেন এবং বুঝিয়ে তাদের মত আদায় করেন। কলেজের ইতিহাসে তৈরি হয় এক নতুন অধ্যায়। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন ললিতা।
কলেজের অসংখ্য ছেলের মধ্যে একমাত্র মেয়ে হয়ে প্রথম প্রথম বেশ অস্বস্তি ও অসুবিধার মধ্যে পড়েন ললিতা। ধীরে ধীরে তিনি সব অসুবিধা কাটিয়ে ওঠেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্য আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থা করেন। ললিতার একাকীত্বের ব্যাপারটা কলেজ কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা ভাবেন যদি আরও মেয়েকে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে এই সমস্যা দূর হবে। সেই মতো পরের বছর তাঁরা মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যাপারে বিজ্ঞাপন দেন। সেই বিজ্ঞাপন দেখে দুজন মহিলা ভর্তি হন, পি-কে থ্রেশিয়া ও লীলাম্মা কোশি জর্জ। তাদের বিষয় ছিল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং।
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন ললিতা। স্থাপন করেন এক নতুন নজির। তিনি হলেন ভারতের প্রথম মহিলা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর তিনি জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে এক বছর শিক্ষানবিশীর কাজ করেন প্রাকটিক্যাল ট্রেনিং-এর জন্য। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেন্ট্রাল স্টান্ডার্ড অর্গানাইজেশনে সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। পোস্টিং হয় সিমলাতে। এখানে তিনি দু-বছরের কিছু বেশি সময় কাজ করেন। ১৯৪৬-এর ডিসেম্বর মাসে তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন।
ললিতার বাবা পাপ্পু সুব্বারাও কিছু গবেষণার কাজ করছিলেন। বাবার অনুরোধে চাকরি ছেড়ে ললিতা সেই গবেষণার কাজে যোগ দেন। কিন্তু ন-মাস পর তিনি এই কাজও ছেড়ে দেন। এরপর তিনি কলকাতায় অ্যাসোসিয়েটেড ইলেকট্রিক্যাল ইনডাস্ট্রিজে যোগ দেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ও সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন তিনি। এখানে তিনি বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারতের বৃহত্তম ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধের বৈদ্যুতিক জেনারেটর নিয়ে কাজ। তিরিশ বছরের বেশি এখানে কাজ করেছেন তিনি।
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের কাউন্সিল অব দ্য ইনস্টিটিউশন অহ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারস তাকে অ্যাসোশিয়েট সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এখানকার পূর্ণ সময়ের সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৬৪-এর জুন মাসে নিউইয়র্কে আয়োজিত প্রথম ইন্টারন্যাশন্যাল কনফারেন্স অব ওমেন ইঞ্জিনিয়ারস অ্যান্ড সাইন্টিস্টস-এ তিনি আমন্ত্রণ পান। নিজের ব্যবস্থাপনায় তিনি এই কনফারেন্সে যোগ দেন। এখান থেকে ফিরে আসার পর বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। নিজের বক্তব্যে তিনি মেয়েদের পড়াশোনা ও কাজে যোগাদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে নিজের মন্তব্য প্রকাশ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনের ওমেন ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটির স্থায়ী সদস্য হন।
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর ব্রেন অ্যানিউরিজমে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ষাট বছর বয়সে মারা যান ললিতা।
পরাধীন ভারতবর্ষে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ দেওয়া হত না, তাদের পড়াশোনা করার বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা করার নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এক বিধবা মেয়ের হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি কেবল অনন্য নজির স্থাপনই করেননি, আগামী প্রজন্মের মহিলাদের কাছে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করেছিলেন।
Categories