দুলি সমীরনকে চেপে ধরলো । যেভাবে হোক তাকে বিয়ে করতে হবে । নতুবা দুলির বাবা চৌরিগাছার নিতাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন । সমীরন ছাড়া অন্য নিতাই, বেতাই, খেতাই, কেতাই, কাউকে দুলির পছন্দ না । সমীরনকে দুলির সাফ কথা, “এখনি তাকে বিয়ে করতে হবে ।“ সমীরন পড়ে গেলো মহা ফাঁপরে । দুলিকে অন্তর দিয়ে ভালবাসে এটা ঠিক, কিন্তু এই মুহূর্তে দুলিকে বিয়ে করা সমীরনের ভাবনার বাইরে । স্বাভাবিকভাবে সমীরন পড়লো দুশ্চিন্তায় । কী করবে, সিদ্ধান্তে দোদুল্যমান ?
তাদের ভালবাসা, হাই স্কুল থেকে । অনেকদিন এমন হয়েছে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুজনে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে ঠিক স্কুল ছুটির সময় বাড়ি ফিরেছে । কেউ কিচ্ছুটি টের পায়নি । একমাত্র জানতো যুথিকা । যুথিকা দুলির কাছের বান্ধবী । সমীরন ও দুলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যুথিকা জানলেও, ঘুণাক্ষরে কখনই তাদের বাড়িতে জানিয়ে দিতো না । অন্যদিকে দুলির মা-বাবা শুধুমাত্র জানতেন, যুথিকার সাথে দুলির প্রগাঢ় বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের ।
বিয়ের সম্বন্ধটা দুলির বাবার মতে, রাজযোটক । নিতাই নিজের গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক । বাবার একমাত্র ছেলে । নিতাইয়ের কোনো বোন নেই । নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার । তা ছাড়া চাষের জমি জায়গা যথেষ্ট । গাঁয়ে সচ্ছল পরিবার । হালের বলদ ছাড়া গাই গরু তিনটে । দুধ কিনে খেতে হয় না । বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন রকমের ফলের গাছে । আম, জাম, কাঠাল, লিচু, পেয়ারা, ছাড়া নারিকেল, পাতিলেবু, জামরুল, ইত্যাদি ফলের গাছ । তাই দুলির বাবা এই বিয়ের সম্বন্ধটা কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাইছেন না । দুলির টালবাহানা লক্ষ করে দুলির বাবা ঝুঁকি নিলেন না । সেই কারণে, দুলির প্রিয় বন্ধু যুথিকাকে বাড়িতে ডাকলেন এবং দুলিকে বিয়েতে রাজী করাতে বললেন ।
সমীরন দুশ্চিন্তায় ছটফট ! সদ্য তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী । দুলি বি-এ পাশ । অথচ কেউ চাকরি পাওয়ার মতো অবস্থায় নেই । চাকরি না পেয়ে বিয়ে করলে সমীরনের বাবা তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন । সমীরনের বাবা রাশভারি মানুষ । একদম ধানাই পানাই পছন্দ করেন না । তাঁর মোদ্দা কথা, “চাকরি পেলেই তবে বিয়ে !” ভীষণ দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন সমীরন ।
বিয়ে করার ব্যাপারে সমীরনের অযথা ঢিলেমি অবলোকন করে দুলি ভীষণ উতলা হয়ে উঠলো । দুলি সর্বদা চনমনে । যার জন্য দুলির ঢাকঢাক গুড়গুড় একদম নাপসন্দ । দুলির নিজের উপর অগাধ আস্থা । তার আত্নবিশ্বাস ষোলোআনা । যার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে দুলি এক-মিনিটও সময় নষ্ট করে না ।
( ২ )
তাই সমীরনকে ডাকলো দুলি ।
হঠাৎ জরুরি তলব ?
“আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবলে ?” দুলি সোজাকথা সোজাভাবে সরাসরি সমীরনকে জিজ্ঞাসা করলো ?
“কয়েকটা দিন সময় দাও ?” সমীরনের কন্ঠে শৈথিল্যের সুর ।
তোমার সময় চাওয়ার অজুহাত আমার ভাল লাগছে না । তোমার অযথা ঢিলেমির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না ! তুমি আমাকে ভালবাসো, আমি তোমাকে ভালবাসি । এটাই যথেষ্ট ! সুতরাং বিয়েতে তোমার গড়িমসি কেন ?
“কিন্তু বিয়ের পরে পেট্ চলবে কী করে ?” উদ্বিগ্ন মুখে সমীরন দুলির দিকে তাকিয়ে বললো ।
সেই চিন্তায় বসে থাকলে তোমার দুলি হাত-ছাড়া হয়ে যাবে । বেপাড়ার নিতাই এসে দুলিকে বিয়ে করে পালাবে । তখন বুঝবে মজা ! গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ।
“তাই বলে বিয়ের পরে তোমাকে নিয়ে ভিক্ষা করবো ?”
মহা আহাম্মকের পাল্লায় পড়লাম ! এতই যখন ভীতু কার্তিক, তাহলে উপার্জনের ভাবনা আমার উপর ছেড়ে দাও ?
সমীরন মৃদু হেসে বলল, “তুমি আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবে !”
সবাই জানে, বিয়ে করাটাই ফাঁসিকাঠে ঝোলার ন্যায় । দায়িত্বের বোঝা কাঁধে চাপে । তুমি কী সেটা বোঝো না, নাকি ‘না-বোঝার’ ভান করো ?
( ৩ )
তারপর নিতাইয়ের সাথে দুলির বিয়ের কথা পাকা । বিয়ের দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে । দুলি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তার বাবা একরোখা । মেয়ের বিয়ে তিনি নিতাইয়ের সঙ্গে দেবেন । দুলির নিষেধ করার পেছনে যুক্তি ছিলো যথেষ্ট । কেননা সে চেয়েছিলো এম-এ পাশ করার পর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! বাবা তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে অটল ।
তারপর সমীরনের ঢিলেঢালা মনোভাব অবলোকন করে সাহসী দুলি বিয়ের আগের রাত্রে বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা সমীরনের শোওয়ার ঘরে !
দুলিকে অতো রাত্রিতে নিজের ঘরে দেখে সমীরন ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা ! আতঙ্কে দিশেহারা । সমীরন ভাবছে, বাড়িতে কেউ দুলিকে তার ঘরে দেখলে বিপদের শেষ নেই । সমীরনের বাবা কোনোরকমে জানতে পারলে তাকে আস্ত রাখবেন না । ভীষণ কড়া মেজাজের মানুষ ।
দুলি আর সাতপাঁচ না ভেবে সমীরনের ডান হাত ধরে বললো, “চলো ।“
“কোথায় ?” তখনও সমীরন কিংকর্তব্যবুমূঢ় । সিদ্ধান্তে দিশাহারা !
‘কোথায় যাবো জানা নেই, তবুও আমার সঙ্গে চলো । তোমার মুরোদ আমার বোঝা হয়ে গেছে । তুমি একটা ভীতু ক্যাবলা-কার্তিক ! সুতরাং সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে । আমার উপর ভরসা রাখো ।
“বলবে তো, কোথায় গিয়ে উঠবো ?” সমীরনের ভয়ার্ত কন্ঠ !
“জাহান্নামে … ?” রাগের সুরে ধমক দিলো সমীরনকে । তাকে কথা বলার সুযোগ দিলো না । সমীরনের ডান হাতটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে দুলি বললো, “ চোখ বুজে আমার সাথে চলো ।“
দুলির জেদে ঐ রাত্রিতে দুজন অজানা পথে পাড়ি দিলো । সমীরন তখনও সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্থ ! দুলির তাড়নায় বাড়ি থাকে বের হয়ে দূরপাল্লার বাসে উঠে বসলো । ভোর বেলায় দুজনে, পলাশীতে ।
( ৪ )
অজানা, অচেনা জায়গা । গাঁয়ে গঞ্জের মাঝখানে পলাশী শহর ।
অগত্যা তারা পলাশী রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে আশ্রয় নিলো ।
সমীরনের শরীর কূঁড়েমিতে ভরা । কাজে কর্মে ঢিলা । গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপারেই তার আঁটোসাঁটো মনোভাব নেই । বড় বড় কথা, অথচ কথার বাস্তবায়নে অপারগ । তাই দুলি নিজেই নিজেদের বেঁচে থাকার পথ ভাবতে লাগলো, অতঃপর কী করা যায় ?
হাতে মাত্র জমানো কয়েকটা টাকা ।
সমীরনের উপর ভরসা না করে দুলি পলাশী স্টেশনের ১নম্বর প্লাটফর্মে আটার রুটি ও তরকারির দোকান খুললো । স্বল্প পুঁজিতে দোকানের শুভযাত্রা । মাথার উপর বড় ছাতা টাঙিয়ে তাদের দোকানের শুভারম্ভ । নিমেষেই, বলা চলে, এক সপ্তাহের মধ্যে দোকানের হালহকিকৎ চাঙা ! দোকানের জনপ্রিয়তা দেখে সমীরন অবাক ! তাই অবাক বিস্ময়ে দুলিকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো, “তোমার এতটা আত্নবিশ্বাসের রহস্য কী ?”
সবটাই মা । মা আমাদের শিখিয়েছেন, “আত্ননির্ভরতা মানুষকে কীভাবে বাঁচতে শেখায় ! আত্নবিশ্বাস কতো বড় পথ চলার খুঁটি ।“
———–০———-
Categories