ঘুরতে কে না ভালোবাসে। বিশেষ করে বাঙালিরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেশায়। কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র আবার কেউ প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান ভালোবাসে ভ্রমণ করতে। প্রকৃতি কত কিছুই না আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। কতটুকুই বা আমরা দেখেছি। এ বিশাল পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই দেখিনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আজ গোটা পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়় এলেও প্রকৃতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা এ এক আলাদা রোমাঞ্চ, আলাদা অনুভূতি যার রেষ হৃদয়ের মনিকোঠায় থেকে যায় চিরকাল।। তাইতো আজও মানুষ বেরিয়ে পড়়ে প্রকৃতির কে গায়ে মেখে রোমাঞ্চিত হওয়ার নেশায়। কেউ চায় বিদেশে ভ্রমণে, আবার কেউ চায় দেশের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণে। এমনি এক ভ্রমণ এর জায়গা হলো হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত চন্দননগর। এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ রাখতে বাধ্য।চন্দননগর , এটির পূর্ব নাম চন্দেরনাগর এবং ফরাসি নাম চন্দ্রনাগর দ্বারাও পরিচিতভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার একটি শহর। এটি চন্দননগর মহকুমার সদর দফতর এবং এটি কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ) দ্বারা আচ্ছাদিত এলাকার একটি অংশ। হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই শহরটি ফরাসি ভারতের পাঁচটি জনবসতির মধ্যে একটি ছিল । ঔপনিবেশিক বাংলোগুলিতে ইন্দো-ফরাসি স্থাপত্য দেখা যায়, যার বেশিরভাগই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।।
এই নিবন্ধে আপনি চন্দননগরের নিম্নলিখিত তিনটি জনপ্রিয় ভ্রমণ স্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন—
(ক) চন্দননগর স্ট্র্যান্ড।
(খ) চন্দননগর মিউজিয়াম।
(খ) পাতাল বাড়ি।
আসুন এই স্থানগুলির প্রতিটি বিস্তারিতভাবে দেখি…
(ক) চন্দননগর স্ট্র্যান্ড—–
চন্দননগর স্ট্র্যান্ড হল চন্দন নগরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সুন্দর ভ্রমণের পথ। চন্দননগর একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও অনেক উন্নত। এই দৌড় ঝাপ ভরা জীবনে একবেলার ছুটি কাটানোর জন্য চলে আসুন চন্দননগর স্ট্যান্ড ঘাটে। পরিবার পরিজনের সঙ্গে বিকেলের আমেজ উপভোগ করার একটি আদর্শ জায়গা এটি।সুন্দর সারির গাছ এবং আলো দ্বারা সারিবদ্ধ দর্শনীয় গঙ্গা নদী, স্ট্র্যান্ডের আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্র। সন্ধ্যার সময় পরিবেশটি শান্তিপূর্ণ থাকে, কারণ চারিদিক আলোকিত হয় এবং হালকা বাতাস বয়ে যায় যা জায়গাটিকে আরও ঐশ্বরিক করে তোলে।চন্দননগর স্ট্র্যান্ড পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর অলঙ্কৃত নদীপথ হিসাবে স্বীকৃত। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী এলাকায় অসংখ্য রেস্টুরেন্ট রয়েছে।হাওড়া থেকে চন্দননগর যাওয়ার যে কোনো ট্রেনে উঠতে হবে। নামতে হবে চন্দননগর স্টেশনে। স্টেশন থেকে অটো অথবা টোটোর মাধ্যমে আপনি পৌঁছাতে পারেন এই ঘাটে। উনবিংশ শতকের চন্দননগরের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী দুর্গাচরণ রক্ষিত। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ফ্রান্সের ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’ সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন । তাঁর নামেই এই ফলক । তাই একদিনের ছুটি কাটানোর জন্য বেশি দেরি না করে চলে আসুন চন্দননগর স্ট্যান্ড ঘাটে।
(খ) চন্দননগর মিউজিয়াম–
হুগলি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৭ কিমি দূরে চন্দননগর মিউজিয়াম হল পশ্চিমবঙ্গের হুগলির চন্দননগর শহরতলিতে অবস্থিত একটি পুরাতন জাদুঘর। ডুপ্লেক্স প্যালেস নামেও পরিচিত, এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম যাদুঘরগুলির মধ্যে একটি এবং হুগলিতে দেখার জন্য সেরা জায়গাগুলির মধ্যে একটি।
চন্দননগর জাদুঘর বা ইনস্টিটিউট ডি চন্দননগর ডুপ্লেক্স হাউসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, চন্দননগর প্রদেশের ফরাসি গভর্নরের পূর্ববর্তী সরকারি বাসভবন। ১৯৫১ সালে চন্দননগরের বন্ধের চুক্তির অনুসরণে, ১৯৫২ সালে ভারত সরকার বিদেশ মন্ত্রকের অধীনে ‘মিউজিয়াম অ্যান্ড আর্ট গ্যালারি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। এটি ২৫০ বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করে এবং উভয় দেশের যৌথ ঐতিহ্যের প্রতীক।
জাদুঘরটি প্রাচীনকালের উপঢৌকন, হরিহর সেট, ‘ফ্রি সিটি অফ চন্দননগর’-এর প্রথম রাষ্ট্রপতি, একজন সমাজ সংস্কারক এবং জনহিতৈষী-এর উপহার থেকে একটি মূল সংগ্রহ নিয়ে স্থাপন করা হয়েছিল। তিনি ১৯৩৪ সালে ফরাসি সরকার কর্তৃক শেভালিয়ার দে লা লিজিওন ডি’অনারে পুরস্কৃত হন। এটি বিরল ফরাসি প্রাচীন জিনিসের একটি সংগ্রহের গর্ব করে, যেমন অ্যাংলো-ফরাসি যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান (জনপ্রিয়ভাবে কর্নাটিক যুদ্ধ নামে পরিচিত), ফরাসি গভর্নর-জেনারেলদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এবং কাঠের তৈরি জিনিসপত্র, যা বিশ্বের অন্য যেকোন স্থানে খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রদর্শনীর মধ্যে রয়েছে ডুপ্লেক্সের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন তার একটি মার্বেল আবক্ষ, এবং চন্দননগরের ফরাসি ঔপনিবেশিক ও স্থানীয় ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ।
এছাড়াও, যাদুঘরটি প্রবেশদ্বারের ঠিক পাশে অবস্থিত মারিয়ানের (ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীক) একটি সুন্দর বাগান এবং একটি মূর্তি রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। এছাড়াও, জাদুঘর এবং ইনস্টিটিউট নিয়মিত ফরাসি ক্লাস অফার করে।
পশ্চিমবঙ্গের সেরা এবং প্রাচীনতম যাদুঘরগুলির মধ্যে একটি হল চন্দননগর মিউজিয়াম। অতএব, আপনি যদি ফরাসি ঔপনিবেশিক নিয়মের ইতিহাসে আগ্রহী হন তবে এই যাদুঘরটি দেখার মতো স্থান।
(গ) পাতাল বাড়ি—
পাতাল বাড়ি চন্দননগরের স্থাপত্য এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের একটি অত্যাশ্চর্য চিত্র। ভবনটি সেই আগের দিনের মানুষের স্থাপত্যের জ্ঞান এবং নান্দনিক বোধের অগ্রগতির আরেকটি সুন্দর উদাহরণ। এর নিচতলা গঙ্গা নদীতে নিমজ্জিত। মহান সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর চন্দননগর সফরের সময় এই বাড়িতেই থাকতেন।
নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই জায়গাটি পরিদর্শন করেন এবং ভবনটির অনেক প্রশংসা করেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে স্থানটি তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাকে প্রসারিত করেছে। তিনি তাঁর বহু বিখ্যাত উপন্যাসে পাতাল-বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। বাড়িটির মালিক ছিল পাশের বাঁশবেড়িয়ার শাসক পরিবারের। এই রহস্যময় সুন্দর জায়গাটি চন্দননগরের একটি প্রাচীন মনোমুগ্ধকর স্থান যা আপনাকে অবশ্যই দেখতে হবে।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।