ব্যস্তভাবে চ্যানেল বদলাচ্ছিল সুব্রত। আজ আইপিএলের একটা ভালো ম্যাচ আছে। সুব্রত ক্রিকেটের অন্ধ ভক্ত। বলা যায় ক্রিকেট পাগল। আজ এমনিতে অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছিল তখনই টিভিটা খুলে বসে। কিন্তু অর্পিতা বাড়ি থাকলে সেটা সম্ভব নয়। অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে আগে ফ্রেশ হওয়া চাই। তারপর অন্য কাজ। আর তা করতে গিয়ে ইতিমধ্যে খেলা শুরু হয়ে গেছে।
চ্যানেল বদলাতে বদলাতে সহসা একটা খবরে থমকে যায় সুব্রত। ব্যাক করে আগের চ্যানেলটায় ফিরে আসে। সেখানে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেখাচ্ছে মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর খবর। খবরটা দেখে অর্পিতাকে হাঁক দেয় সুব্রত, ‘অর্পিতা একবার এঘরে এসো।’
রান্নাঘর থেকে অর্পিতা বলে, ‘আমার এখন অনেক কাজ। যাওয়া সম্ভব নয়। যা বলার ওখান থেকে বলো।’
‘আরে এস না।’
‘কেন?’
‘টিভিতে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে।’
কথাটা শেষ হয়েছে কী হয়নি, অর্পিতা ছুটে এ-ঘরে চলে আসে। শোফায় বসে চোখ রাখে খবরে। একই লেখা বার বার করে পর্দায় দেখাচ্ছিল। তবুও চোখ সরায় না অর্পিতা। একটু পরে বিজ্ঞাপন শুরু হতেই সুব্রত টিভিটা বন্ধ করে দেয়। খেলা দেখার আর তেমন আগ্রহ পায় না।
‘চারদিন পর মাধ্যমিকের রেজাল্ট। শুনেই তো আমার বুক কাঁপছে।’ উত্তেজনামাখা সুরে বলে অর্পিতা।
‘তোমার বুক কাঁপার কী হল! এত টেনশন করো না। দেখো, সায়ন ভালো রেজাল্টই করবে।’
‘সে আমি জানি। তবুও…।’
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুব্রত বলে, ‘টেনশন করো না। বরং এক কাজ করো। সায়নকে একবার ফোন করো। ও হয়তো খবরটা জানে না। ওকে বলো কাল বা পরশুর যেন মাসিবাড়ি থেকে ফিরে আসে।’
‘ঠিক বলেছ।’ অর্পিতা যাবে বলে সবে ঘুরেছে এমন সময় তার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘মনে হয় সায়নের ফোন। ও বোধহয় খবরটা জেনে গেছে।’
কিন্তু মোবাইলটা হাতে নিয়ে অর্পিতা একটু হতাশ হয়। দেখে অজানা নম্বর। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে এক বয়স্কা মহিলার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘অপু বলছিস?’
চমকে ওঠে অর্পিতা। ‘অপু…! এ নামে তো…!’ ভাবনাগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। কিছু জবাব দিতে পারে না। ওপাশ থেকে আবারও কাঁপা কাঁপা সুর ভেসে আসে, ‘অপু, আমি তোর মা বলছিরে।’
‘মা!’ আবারও একবার জোর চমক খায় অর্পিতা। মা তাকে ফোন করেছে, যেন বিশ্বাস হয় না। দীর্ঘ্য প্রায় কুড়ি বছর পর মা তাকে ফোন করেছে। ব্যাপারটা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করে। মনটা আবেগে ভেসে যেতে চায়। কিন্তু সেই আবেগে ভাগ বসায় পুঞ্জীভূত অভিমান। নিজেকে সামলে নেয় সে। একবার ভাবে কোনো কথা বলবে না। ফোনটা কেটে দেবে। পরমুহূর্তে ভাবে, মায়ের তো কোনো দোষ নেই। মা তো অসহায়। একজন মানুষের অন্ধ বিশ্বাস আর জেদের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে। তাই সিদ্ধান্ত বদলায়। তবে আবেগ দমন করে, সংযত গলায় বলে, ‘তুমি আমার নম্বর পেলে কী করে?’
‘সে কথা পরে বলব। তোকে একটা কথা বলব।’ বলেও কিন্তু সহসা কিছু বলতে পারেন না। আমতা আমতা করতে থাকেন। অর্পিতার কিছুটা হতভম্ভ অবস্থা। পাশাপাশি অদ্ভুত কিছু শব্দ তাকে কৌতূহলী করে তোলে। নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? তোমার আশেপাশে কীসব শব্দ শোনা যাচ্ছে! তুমি এখন কোথায়?’
‘নার্সিংহোমে।’
‘নার্সিংহোমে!’ চমকে ওঠে অর্পিতা। উদ্বেগমাখা সুরে বলে, ‘তুমি নার্সিংহোমে কেন? কী হয়েছে তোমার?’
ইতস্তত করে মহিলা জবাব দেন, ‘আমার কিছু হয়নি। তোর বাবা খুব অসুস্থ।’
কথাটা শুনে সহসা বুকে একটা ধাক্কা অনুভব করে অর্পিতা। কিন্তু পরমুহূর্তে সে গম্ভীর হয়ে যায়। কোনো জবাব দেয় না সে। এদিকে তাকে একবারে চুপ করে যেতে দেখে তার মা উদ্বেগ আর উত্তেজনামাখা সুরে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করতে থাকে। অর্পিতা গম্ভীর সুরে বলে, ‘শুনছি, বলো।’
‘শোন না, তোর বাবা খুব অসুস্থ।’
‘তা আমি কী করব?’
অর্পিতার কঠোর জবাবে তার মা একটু যেন হতচকিত হয়ে যান। একটু থেমে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে চলেন, ‘আজ বিকেলে তোর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পাড়ার কয়েকজন গাড়ি করে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়ে গেছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না। তোর দাদারা কেউ এখানে নেই। এদিকে ডাক্তার বলেছে ভালোই টাকা-পয়সা লাগবে। আমার কাছে বিশেষ কিছু নেই। আমি একা মেয়েমানুষ, কী করব ভেবে পাচ্ছি না। অপু, একটিবার আসবিরে মা?’
মায়ের কথার সহসা কোনো জবাব দিতে পারে না অর্পিতা। বাবার অসুস্থতা তার মনেক একটু নাড়িয়ে দেয় ঠিকই, তবে তা সাময়িক। মনকে শক্ত করে ফেলতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু মায়ের করুণ আর্তি আর কান্না তার বুকে আলোড়ন তোলে। পরমুহূর্তে তার অভিমানী মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে, সে কেন ওদের কথা ভাবতে যাবে! সে তো ওদের কেউ নয়! কিছুই জবাব দেয় না অর্পিতা। বৃদ্ধা বেশ কয়েকবার একই আর্জি জানানোর পর কোনো জবাব না পেয়ে হতাশায় ফোনটা কেটে দেন! শোফায় ধপাস করে বসে পড়ে অর্পিতা।
মোবাইলের কথোপকথন শুনে সুব্রত আন্দাজ করতে পেরেছিল খারাপ কিছু একটু ঘটেছে। অর্পিতা ফোনটা কাটতেই সুব্রত জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে? কে অসুস্থ?’
অর্পিতা সুব্রতকে বলে কী ঘটেছে। সব শুনে সুব্রত বলে, ‘তোমার এক্ষুনি নার্সিংহোমে যাওয়া উচিৎ।’
সুব্রতর দিকে অবাক চোখে তাকায় অর্পিতা। অবিশ্বাসমাখা সুরে বলে, ‘তুমি বলছ এ-কথা! আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। তোমার নিজের কথা কি তুমি ভুলে গেছ? রাস্তার কুকুরের চেয়েও তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল! মনে নেই?’
প্রসঙ্গটা গায়ে না মেখে সুব্রত বলে, ‘শোনো, একটা লোক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। এখন ওসব কথা ভাবতে আছে! হাজার হোক উনি তোমার বাবা।’
‘বাবা!’ সুব্রতর কথাটা শেষ হওয়ামাত্র ফুঁসে ওঠে অর্পিতা, ‘কে বাবা? উনি আমার বাবা নন। সেই সম্পর্ক উনি অনেক আগে মুছে দিয়েছেন।’
শান্ত সুরে সুব্রত বলে, ‘উনি যাই বলে থাকুন বা করে থাকুন, এটা তো অস্বীকার করতে পারো না যে উনি তোমার বাবা, তোমার জন্মদাতা?’
‘যে বাবার কাছে তার কন্যা মৃত, যে বাবা গত কুড়ি বছরে আমার সঙ্গে দেখা করা দূরে থাক, কথাও বলেনি, তাকে আমি কী করে বাবা বলে স্বীকার করে নেব!’
‘এসব তোমার রাগের কথা।’
‘না, রাগের কথা নয়। আমি যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করে কথাগুলো বলছি। আমি কিছু ভুলে যাইনি। কুড়িটা বছর ধরে আমি যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। অতীতটা আমি ভুলব কী করে!’
‘আমি সব জানি। কিন্তু মেয়ে হিসেবে তোমার ওনার পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
‘মেয়ে হলে নিশ্চয়ই পাশে দাঁড়াতাম। কিন্তু ওর কাছে আমি মৃত।’
‘শোনো…।’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আগের সুরেই অর্পিতা বলে চলে, ‘কোনো দোষ না করেও একটা লোকের মিথ্যা জাতপাতের অহংকার আর জেদের জন্য এত বছর আমি যন্ত্রণার জীবন কাটাচ্ছি। এতদিনে উনি তো আমাদের ওপর কোনো কর্তব্য করেননি। আজ তুমি আমাকে কর্তব্য পালন করতে বলছ?’
জেগে ওঠা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো লাভা উদগীরন করতে থাকে অর্পিতা। তাকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে সুব্রত বলে, ‘তোমার বাবার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের কথা ভাবো। উনি তো কোনো দোষ করেননি? অন্তত তোমার মায়ের কথাটা একটু গভীরভাবে ভাবো। কতটা অসহায় উনি। তোমার বিপর্যস্ত অবস্থায় অন্তত আমি তোমার পাশে ছিলাম। কিন্তু আজ তোমার মায়ের পাশে কেউ নেই। ভাবো, এই বৃদ্ধ বয়সে কতটা বিপর্যস্ত অবস্থা তার! এই সময় তুমি-আমি যদি ওর পাশে না দাঁড়াই তাহলে উনি আর কার কাছে যাবেন?’
মায়ের কথায় মনটা কিছুটা নরম হয় অর্পিতার। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে মায়ের অসহায় কান্না আর করুণ আর্তি। বুকের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয় তার। কর্তব্য সম্পাদন আর আত্মমর্যাদার দ্বন্দ্বে একটা টানাপোড়েন শুরু হয় অর্পিতার মধ্যে। সে ভেবে পায় না কী করবে।
২.
কলেজে পড়ার সময় থেকেই একে-অপরকে ভালোবাসত অর্পিতা আর সুব্রত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বাড়িতে তাদের সম্পর্কের কথা বলতে পারেনি অর্পিতা। এদিকে বাড়িতে তার বিয়ের আলোচনা চলতে থাকে। চাকুরির দোহাই দিয়ে সে আটকে রাখে। অর্পিতা অপেক্ষা করছিল তাদের দুজনের কেউ একজন চাকুরি পেলে সে বাড়িতে তাদের কথা জানাবে। তার রেজাল্ট ভালো কিন্তু কিছুতেই চাকুরি জুটছিল না। ফলে বিয়ের চাপ বাড়ছিল। অবস্থা যখন প্রায় হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সুব্রত একটা ভালো চাকুরি পেয়ে যায়। তখন অর্পিতা বাড়িতে জানায় তাদের সম্পর্কের কথা। কিন্তু বাড়িতে কেউ তাদের সম্পর্ক মেনে নেয় না। কারণটা তেমন কিছু না। অর্পিতারা ব্রাহ্মণ আর সুব্রত সিডিউল কাস্ট। অর্পিতার বাবা শিক্ষিত হলেও প্রাচীনপন্থী। তিনি কোনোমতেই এ-সম্পর্ক মেনে নেন না। অর্পিতা আশা করছিল তার দাদারা অন্তত ব্যাপারটা বুঝবে। কিন্তু সে অবাক হয়ে যায় দেখে যে, উচ্চ-শিক্ষায় শিক্ষিত দুই দাদাও বাবার সুরে সুর মেলায়। একমাত্র তার মা কিছুটা তার পক্ষে ছিল। কিন্তু বাবার প্রতাপের কাছে মা কোনোদিনই মুখ ফুটে নিজের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারেনি। বললেও বাবার না কে কখনও হ্যাঁ করতে পারেনি।
অর্পিতা বোঝায়, আজকালকার দিনে জাত-পাত নিয়ে ভাবনাটাই অবান্তর। সুব্রত সবদিক দিয়ে একজন আদর্শ পুরুষ। যেমন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তেমনি মানুষ হিসেবেও সে উন্নত মনের। তার থেকেও বড়ো কথা, তারা একে আপরকে ভালোবাসে। কিন্তু অনেক বুঝিয়েও সে বাবা-দাদাদের রাজি করাতে পারে না। বাবা সরাসরি বলে দেয়, ওই ছেলেকে বিয়ে করলে তিনি তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।
ছোটোবেলা থেকে বাবার কখনও অবাধ্য হয়নি অর্পিতা। কিন্তু সেদিন বাবার অন্যায় জেদকে মেনে নিতে পারেনি। সে শিক্ষিতা। নিজের জীবন নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তা আছে। সে যদি খারাপ কিছু করত, বাড়ির লোকেদের সম্মান হানিকর কিছু করত, তাহলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু মিথ্যা জাতপাতের অহংকারের আর অন্ধবিশ্বাসের কাছে নিজের ভালোবাসা আর আত্মমর্যাদাকে বলি দিতে চায়নি। বাধ্য হয়ে বাড়ির অমতে তারা রেজিস্ট্রি করে।
রেজিস্ট্রি করার পর বাড়িতে গিয়েছিল অর্পিতা। সুব্রতকে নিয়েই। কিন্তু বাবা তার মুখ দর্শন করেনি। পিছু ফিরে কঠোর কন্ঠে বলে দিয়েছিল, ‘আজ থেকে আর কোনোদিন এ-বাড়িতে পা রাখেব না তুমি। আমি তোমায় ত্যাজ্য করলাম। আজ থেকে মনে করব, আমার মেয়ে মরে গেছে।’
সেদিন অনেক কান্নাকাটি করেছিল অর্পিতা, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। কষ্ট, যন্ত্রণা আর একরাশ অপমান নিয়ে ফিরে এসেছিল সে। কিন্তু মন মানেনি। হাজার হোক তার বাবা। বার বার ফোন করলেও বাবা ফোন কেটে দিত। তবে একদিন কথা বলেছিল। কিন্তু তা সুখকর ছিল না। বাবা বলেছিল, ‘ঠিক আছে, আমি সব ভুলে যেতে পারি। তোমাকেও স্বীকার করতে পারি। তবে তোমাকে ওই ছেলেকে ছেড়ে ফিরে আসতে হবে।’
বাবার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিল অর্পিতা। মনের ঝড় সামলে অনেক কষ্টে বলেছিল, ‘সরি বাবা, তোমার শর্ত মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন তোমায় বিরক্ত করব না। তোমার মনে আমি মৃত হয়েই বেঁচে থাকব।’
সুব্রত বুঝত অর্পিতার যন্ত্রণার কথা। তাকে না জানিয়ে একিদন সে তার বাবার সঙ্গে দেখা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। চরম অপমান করে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল অর্পিতার বাবা।
তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। অনেক কিছু ঘটে গেছে এই কয়েক বছরে। অর্পিতা এসএসসি দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে। একসময় সংসারে আসে সায়ন। দেখতে দেখতে সে এবার মাধ্যমিক দিয়ে দিয়েছে। সামনে তার রেজাল্ট। এখন তাদের যতকিছু স্বপ্ন ছেলেকে ঘিরে।
যোগাযোগ না থাকলেও বাবারবাড়ির বেশ কিছু খবর তার কানে আসে। অর্পিতার বড়দা বিদেশে পাকাপাকি আস্তানা গেড়েছে। ছোড়দা মুম্বইতে। প্রথম প্রথম তারা বাড়ি আসত। এখন আর আসে না। বাবা-মায়ের তেমন করে খোঁজখবরও নেয় না। সবথেকে আশ্চর্যের অর্পিতার সঙ্গেও তারা একবারও যোগাযোগ করেনি। অর্পিতার বাবা বেশ কয়েক বছর আগে রিটায়ার্ড করেছেন। প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। যা উপার্জন করেছেন সংসার চালাতে আর ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে খরচ করেছেন। সঞ্চয় দূরে থাক, উল্টে ধারও করতে হয়েছে তাকে। এখন সেই ছেলেরাই পর হয়ে গেছে। নিজের সামান্য পেনশনই ভরসা। বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রী এটা-ওটা অসুস্থতা নিত্যসঙ্গী। কোনোরকমে জীবন কাটছিল তাদের। কিন্তু এতসবের মাঝেও নিজের জেদ আর মিথ্যা জাতপাতের দম্ভ থেকে একচুলও নড়েননি অর্পিতার বাবা।
৩.
তিনদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর জ্ঞান ফেরে অর্পিতার বাবার। তবে ডান হাত প্যারালাইজড হয়ে গেছে, সঙ্গে মুখের ডানদিকটাও বেঁকে গেছে। দিন সাতেক নার্সিংহোমে কাটানোর পর তিনি বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে শরীর খুব দুর্বল। নিজে থেকে চলাফেরার ক্ষমতা নেই। নিয়মিত ঔষধ ছাড়া ফিজিওথেরাপি চলছে। ডাক্তার বলেছে প্যারালাইজড অংশের কিছুটা উন্নতি হলেও হতে পারে। মায়ের বয়স হয়েছে। বাড়িতে বাবার দেখাশোনো করার জন্য একজন নার্স ঠিক করে দিয়েছে অর্পিতা।
এই কদিনে বিস্তর টাকা খরচ হয়েছে এবং সেটা করেছে অর্পিতা আর সুব্রত। সুব্রতর বোঝানোয় অর্পিতা শেষমেষ বোঝে, নার্সিংহোমে আসে। অর্থের কথা ভাবেনি। বাবাকে সারানোর জন্য যা যা করা দরকার বাকি রাখেনি। তার গুণী দাদারা কেউ আসেনি। না, অর্পিতা তাদের ফোন করেনি। মা যোগাযোগ করেছিল। বড়ছেলে জানিয়ে দিয়েছে তার পক্ষে বিদেশ থেকে আসা এখনই সম্ভব নয়। ছোটছেলে বাবার অ্যাকাউন্টে হাজার পঁচিশ টাকা পাঠিয়ে দায় সেরেছে। তারও নাকি আসার সময় নেই। ছোড়দার টাকা অবশ্য তোলেনি অর্পিতা। যা খরচ হয়েছে সে আর সুব্রত মিলে করেছে। তবে এতকিছু করলেও মন থেকে ক্ষতের চিহ্নটা মুছে ফেলতে পারেনি।
হাসপাতালে পৌঁছে মাকে দিয়ে সে একটা শর্ত করিয়ে নিয়েছিল, তারা যে বাবাকে সারিয়ে তোলার জন্য এই খরচাপত্র করেছে তা যেন বাবাকে কোনোদিন না বলে। এমনকি তারা যে হাসপাতালে এসেছিল এই ব্যাপারটাও বাবার কাছে গোপন রাখতে বলে। তা না করলে সে আসবে না বলে জানায়। মন না চাইলেও অর্পিতার মা সে শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়।
৪.
কীভাবে অনুষ্ঠানটা করবে তা নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারছিল না সুব্রত আর অর্পিতা। সুব্রত চায় বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে। ওদিকে অর্পিতার একদমই ইচ্ছা নয় বাড়িতে ঝামেলা বাড়াতে। আর সেটা নিয়েই দুজনের মধ্যে মতিবিরোধ হচ্ছিল।
পার্টিটা সায়নের রেজাল্ট উপলক্ষ্যে। মাধ্যমিকে অসাধারণ রেজাল্ট করেছে সে। জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। বাবার অসুস্থতার সময়েই রেজাল্ট বেরিয়েছিল। বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ছেলের রেজাল্টের আনন্দটা উপভোগ করার সুযোগ ছিল না। এদিকে সুব্রতর অফিসের কলিগ, অর্পিতার স্কুলের কলিগরা ধরেছিল ছেলের এতো ভালো রেজাল্টের পর একটা পার্টি দিতে। ব্যাপারটা তাদেরও মাথায় ছিল। ছেলের রেজাল্ট সেলিব্রেট করার ইচ্ছে ছিল তাদের। কিন্তু সেসব নিয়ে তখন ভাবার সময় পায়নি। আজ রবিবার। দুজনের ছুটি। সায়নও পড়তে গেছে। ওদিকে বাবার অসুস্থতার ঝামেলাটাও কমেছে। তাই দুজনে বসেছে পার্টিটা কীভাবে করা যায় সেই আলোচনায়।
অর্পিতার বাবার আসুস্থতার পর প্রায় দিন কুড়ি কেটে গেছে। তার বাবা এখন আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ। একটু-আধটু চলাফেরাও করতে পারে। তবে ডান হাত আর মুখের ব্যাপারটার কোনো উন্নতি হয়নি প্রায়। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চলছে। এসব খবর তার মা ফোন করে জানিয়েছে। তবে বাবার ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামায়নি অর্পিতা। সে নিয়ে মাথাব্যাথাও আর নেই। কেবলমাত্র মায়ের কথা ভেবে সে এতকিছু করেছে। এ নিয়ে আর বেশি ভাবতেও চায় না।
সহসা তাদের কথাবার্তার মাঝে অর্পিতার মোবাইল বেজে ওঠে। এসময় ফোন আসায় একটু বিরক্ত হয় অর্পিতা। তবুও কলটা ধরতে হয়। সবুজ বাটন টিপে ‘হ্যালো’ বলে ফোনটা কানে চেপে ধরে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব নেই। আরও দুবার ‘হ্যালো’ বলার পরও যখন ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না তখন অর্পিতা বেশ বিরক্তির সুরে বলে, ‘কে বলছেন? কথা বলছেন না কেন? কিছু বলার থাকলে বলুন না হলে ফোনটা কেটে দিন।’
তবুও কোনো জবাব আসে না। মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে অর্পিতা প্রায় লাইনটা কেটে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় ওপাশ থেকে একটা ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘অপু…!’
একটু চমকে ওঠে অর্পিতা। তার সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। কন্ঠস্বর মহিলার নয়। তাহলে…! কিন্তু আবেগ সংযত করতে বেশি সময় লাগে না তার। তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে সে।
ওপাশ থেকে ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসে। ‘অপু, আমি বাবা বলছি।’
অর্পিতা কোনো জবাব দেয় না। তার চোখ-মুখ আরও দৃঢ় হয়। অর্পিতার বাবা ক্ষীণ কন্ঠে বলে চলেন, ‘অপু, আমি সব জেনে গেছি। তোর মা তোকে কথা দিয়েছিল। কিন্তু ওর কোনো দোষ নেই। আমার জেদে বাধ্য হয়েছে সত্যিটা বলতে।’
অর্পিতা কঠিন সুরে বলে, ‘এসব কথা ছেড়ে কীজন্য ফোন করেছ সেটা তাড়াতাড়ি বলো। আমার অনেক কাজ আছে।’
‘জানি, তুই আমার ওপর রেগে আছিস। সেটা স্বাভাবিকও। তবুও না ফোন করে পারলাম না।’
‘না করলেই পারতে। তাহলে আমি বেশি খুশি হতাম। তুমি যদি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাও, তাহলে ভুল করছ। ওসব কথা আমি শুনতে চাই না।’
‘না না, সেজন্য ফোন করিনি।’
‘তাহলে…!’
‘একটা অনুরোধ ছিল। রাখবি?’
‘অনুরোধ! কী অনুরোধ?’
‘একবার তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।’
‘আমাকে দেখতে চাও!’ অর্পিতার গলায় কিছুটা ব্যঙ্গের সুর! ‘তুমি কী করে ভাবলে তুমি ডাকলেই আমি চলে যাবো’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘না না, তোকে আসতে বলছি না। আমি একবার তোর বাড়ি যেতে চাই।’
‘অসম্ভব।’ প্রতিবাদের সুরে বলে ওঠে অর্পিতা। ‘সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার বাড়িতে তুমি আসতে চাইছো কেন? কী দরকার তোমার আমার কাছে?’
‘তোদের প্রতি অনেক অন্যায় করেছি, অবিচার করেছি। একবার তোর মুখোমুখি হয়ে মাফ চাইতে চাই।’
‘আজ এত বছর পর তোমার মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর আন্যায় করেছ, অবিচার করেছ! হঠাৎ তোমার এমন মনে হল কেন? মনে রেখ তোমার চোখে আমি মৃত। আর যে কারণে আজ বেঁচে থেকেও আমি তোমার চোখে মৃত, সেই অবস্থার কোনো হেরফের ঘটনি। তাহলে তোমার এমন মনে হওয়ার তো কারণ নেই।’
অর্পিতার বাবা কোনো জবাব দিতে পারেন না। অর্পিতা কঠিন সুরে বলে চলে, ‘এই দীর্ঘ্য কুড়ি বছরে কিন্তু তোমার মনে হয়নি তুমি অন্যায় করেছ। আমিও বলছি না তুমি অন্যায় করেছো। তোমার দৃষ্টিভঙ্গীতে তুমি ঠিক। আমার ভাবনায় আমি। আর আমাদের মতবিরোধের কারণের কোনো পরিবর্তন যখন ঘটেনি তখন আর ভুল বোঝাবুঝির প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?’
একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যায় অর্পিতা। বৃদ্ধ ক্ষীণ সুরে আমতা আমতা করে বলেন, ‘তোর কথার কোনো জবাব নেই আমার কাছে। আমি যে ব্যবহার করেছি তাতে এসব কথা বলা তোর ন্যায়সঙ্গত। তোর রাগ করাটা স্বাভাবিক।’
‘রাগ!’ ফুঁসে ওঠে অর্পিতা, ‘আমি রাগের কথা বলছি না। রাগ-আবেগ সরিয়ে আমি যুক্তিপূর্ণভাবে কথা বলছি। বলতে পারো কোন যুক্তিতে একটা মরা মানুষ তোমার সামনে জীবন্ত হয়ে ফিরে আসবে!’
বৃদ্ধ কোনো জবাব দেয় না। অর্পিতা বলে চলে, ‘এতিদন তোমার মনে হয়নি তুমি ভুল করেছ। এতদিনে তুমি আমাদের কোনো খোঁজখবর নাওনি। আজ আমার জন্য হঠাৎ আবেগে তোমার প্রাণ কেঁদে উঠছে কেন? আমি টাকা খরচ করে তোমাকে সারিয়ে তুলেছি বলে? তুমি কি ভাবো আমি অর্থ দিয়ে সম্পর্ক কিনতে গিয়েছিলাম?’
এত কঠিন কথা অর্পিতা বলবে বৃদ্ধ ভাবতে পারেননি। কিছু বলতে পারেন না তিনি। অর্পিতা বলে চলে, ‘তুমি যদি তাই ভাবো, তাহলে ভুল করছ। আমি অর্থের বিনিময়ে সম্পর্ক গড়তে যাইনি। অর্থের দম্ভও দেখাতে চাইনি, তোমার ওপর করুণা দেখানোরও কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আরও স্পষ্ট করে বলি তোমার প্রতি কর্তব্যবোধেও আমি এসব করিনি।’
একটু থামে অর্পিতা। নিজের মধ্যেকার যন্ত্রণার ঝঞ্ঝাটাকে একটু সামলে নিয়ে বলে, ‘সত্যি বলতে কী কর্তব্যবোধের প্রশ্নই আসে না। যে মরে গেছে সে কী করে কর্তব্য করবে? আমি তা করতেও চাইনি। আমি যা করেছি তা শুধু একটা অসহায় নারীর কথা ভেবে। মায়ের চোখের জল, মাথার সিঁদূর আর ভালোবাসার কাছে নিজেকে পাষাণ রাখতে পারিনি।’
একটু থামে অর্পিতা। ফোনের ওপাশে কোনো কথা নেই। তবে নীরব অশ্রুপাতের শব্দ শুনেত পায় অর্পিতা। তাতে তার মন গলে না। আগের মেজাজে বলে চলে, ‘একটা কথা ভেবে দেখো, জীবনের প্রায় সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া এক মহিলা সিথির সিঁদূর আর ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে সেদিন পাগলের মতো কান্নাকাটি করেছিল। আর সদ্য বিয়ে করা আমাকে তুমি বলেছিলে সেই সিঁদূর আর ভালোবাসাকে বলি দিতে। ভালোবাসা কী তা তুমি কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করো না, আজও বোঝো না।’
আর বৃদ্ধ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কান্নাভেজা সুরে বলেন, ‘আমি বিরাট ভুল করেছি মা। আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি অনুতপ্ত। আমাকে একটিবার তোর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দে।’
‘না, আমি তা মোটেও চাই না। ভুল যদি তুমি সত্যি বুঝতে পারতে সেটা তোমার অনেক আগে বোঝা উচিত ছিল। তা তুমি পারোনি। এখন যেটাকে তুমি ভুল বুঝতে পারা বলছে, সেটা আসলে তোমার অসহায়ত্ব, একাকীত্ব আর দুর্বলতা। তোমার ছেলেরা এখন যদি তোমার পাশে থাকত তাহলে হয়ত এই ভুল বোঝার উপলব্ধি তোমার মধ্যে আসত না। আমার কথা খারাপ লাগতে পারে, তবে এটাই সত্যি।’
অর্পিতা চুপ করে। বৃদ্ধ ক্ষীণ সুরে বলেন, ‘একটিবার কি মুখোমুখি হতে পারি না?’
‘না। যেমন আছি সেটাই ভালো। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে শিখে গেছি। আর, এতিদন তোমার চোখে মৃত হয়ে যখন বেঁচে থাকতে পেরেছি, ভবিষ্যতেও তা পারব। তাই বলছি, মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা মন থেকে সরিয়ে দাও। তাতে তোমারও জেদ বজায় থাকবে। আমাকেও হেরে যেতে হবে না।’
ওপাশের কন্ঠস্বর চূপ। শুধু নীরব কান্নার সুর ভেসে আসে। অর্পিতা নিজেকে সংযত করে শান্ত কন্ঠে বলে, ‘নিজের শরীরের খেয়াল রেখো। আর কোনোদিন আমাকে ফোন করো না। তাহলে আমিও ভালো থাকব।’
লাইনটা কেটে দেয় অর্পিতা। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার দুচোখ দিয়ে বন্যার স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়ে। হতবাক সুব্রত কী বলবে ভেবে পায় না।