অনেক অনেকবছর আগে প্রায় চল্লিশ বছর তো হবেই ।তখন লাহুল স্পিতি উপত্যকা আমাদের কাছে একটা রহস্যময় অচেনা জগতের মতো ছিল।তবু ভবঘুরে মন আর পায়ের তলায় সরষে ।তাই বছরের কোনও না কোনও সময়ে হিমালয়ের ডাক কানে এসে পৌঁছতো আর আমরা ছয়জনের যে দলটি লোটা কম্বল নিয়ে সব সময় রেডি থাকতাম বেরিয়ে পড়তাম।সেই বছর ত্রিলোকনাথ যেন আমাদের ডাক পাঠালেন।ব্যাস আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।সেপ্টেম্বর মাস এমনিতেই বাতাসে শারদীয়ার সুর
আমরা চললাম মানালির উদ্দেশ্যে ।ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে।সেই সময়ের মানালি যেন কুমারী সুন্দরী।কী তার রূপ সবুজে শ্যামলে পাহাড়ে নদীতে যেন রূপসী অপ্সরা।আর তেমন পথঘাট সেইরকম সুন্দর ওখানকার লোকজন ।চোখফেরানো যায় না এমন সব রমণীয় রমণীদের পথে ঘাটে দেখি আর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।আমাদের একসঙ্গী সবে কলেজে ঢুকেছে তার চোখে ঘোর ।ওকে নিয়ে কি মজাটাই করেছি আমরা দুই সখী স্বপ্না আর আমি।বিপাশার কলকল ধ্বনি প্রথম দিনেই আমাদের মন জয় করে নিল।কীভীষন ভালো লাগায় মন ভরে গেল যেন।প্রাথমিক কিছু রসদ কেনাকাটা করা হল।চাল ডাল ফল সব্জি ইত্যাদি এটা আমাদের পাহাড়ি পথে সবসময়ই মজুত রাখা হয়।অভ্যাস অনেক রকম অভিজ্ঞ।তা থেকে বুঝেছি এটা সঙ্গে থাকলে রাস্তাতেও দিন কাটানো যায় ।পাহাড়ের রাস্তা বড়ই খতরনক ।মানালী থেকে বাস ছাড়লো সকাল আটটায় ।বিপাশাকে বাঁয়ে রেখে যাত্রা শুরু ।পাহাড়ি পথে পাক খেতে খেতে বাস এগিয়ে চলে।উৎসুক মন কখন রোটাংপাস দেখবো।ভয়ংকর রোটাং হিমশীতল রোটাং।কিন্তু রোটাংপাস এ পৌঁছে মন ভরলো না।রিক্ত রুক্ষ কঠোর কেমন যেন সর্বস্ব হারা রূপ ।রোটাংপাস থেকে অনেকটা পথ নেমে প্রায় বারোটার সময় এসে পৌঁছলাম চন্দ্র নদীর তীরে খোকসারে।এখানে হিমালয় যেন গৈরিক সন্ন্যাসী ।ভাবগম্ভীর প্রশান্তিময় মৌন গিরিরাজ।
খোকসার থেকে রাস্তা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে ।একটি চন্দ্র নদীর উৎস অভিমুখে অন্য টি আমরা যে পথে যাবো ত্রিলোকনাথ এর দিকে যে পথে আমরা যাবো।
খোকসারের প্রণাম জনপদ শিশু।শিশু নামের বিশেষত্ব ছড়ানো আছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ।কোন্ অদৃশ্য নিপুন হাতে রোপিত অজস্র শিশুগাছের শ্যামল বনানী ।বাস রাস্তার নীচে র দিকে অনেক বর্ধিষ্ণু পাহাড়ি গ্রাম ।ক্ষেতে ক্ষেতে সর্বত্র ই ফসল তোলার সাড়া ।আসন্ন শীতের জন্য এই তোড়জোড় ।শীত এদের কাছে বিভীষিকা ।তাই চাষবাস পশুপালন শীতের আগেই সঞ্চয় করার অভ্যাস বা রীতি নিয়ম সবকিছু ।ছোট ছোট অনেক জনপদ পেরিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছলাম তান্ডি তে।এখানে ভাগা নদী মিলিত হয়েছে চন্দ্র নাম হয়েছে চন্দ্রভাগা।নদীর জল ঘন নীল ।পুরো রাস্তা টাই কাঁচা তান্ডি থেকে।সংকীর্ণ এবড়োখেবড়ো পথ তার মধ্যে ই বড়বড় লরি চলাচল করছে।বেশ ভয়ে ভয়ে এই রাস্তা পার হয়েছি ।থিরোট হুয়ে কীর্তিং প্রায় পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম ।রাস্তার ওপরেই লোকালয় ।জায়গা টি বেশ জনবহুল ।সামনেই চা আর পকৌড়ার দোকান।গোবিন্দ চেঁচিয়ে উঠল ফুলকাকা সামনেই চা আর পাকৌড়া নামুন নামুন ।আমরা সবাই হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নামলাম। উফ্ একটানা বাসের গোঁ গোঁ আওয়াজ মাথা যেন কাজ করছে না ।মুক্ত হাওয়ায় চা টা খেয়ে বেশ ভালো লাগছে।এমন সময় মি ঠাকুর নামে এক ভদ্রলোক পাশেই তার বাড়ি আমাদের ডাকলেন নিজের হাতে আপেল পাড়ার জন্য ।কী অপূর্ব তার বাগান।ওইটুকু সময়ের মধ্যে তাঁর বাড়ি বাগান ঘুরে এত্তো আপেল নিয়ে বাসে উঠলাম ।কি খুশী ওনার চোখে মুখে ।এরকম আন্তরিক মধুর ব্যবহার আমাদের চিরদিন মনে থাকবে।চলার পথে এগুলো ই পাথেয় ।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ধূলিধূসরিত আমরা এসে হাজির হলাম চন্দ্র ভাগা উপত্যকার উদয়পুরে।রাস্তার ওপরেই পি ডব্লিউ ডির সুন্দর সাজানো বাংলো।জায়গাটা যেমন সুন্দর তেমনি নির্জন ।সামনেই চন্দ্র ভাগা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে ।মনোরম এই পরিবেশ আমাদের সব ক্লান্তি কোথায় মিলিয়ে গেল।স্বপ্না কি সুন্দর করে গাইল -পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে ।সব অবসাদ মুহূর্তে মুছে গেল ।
পরের দিন সকালে ত্রিলোকনাথ দর্শন ।উদয়পুর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার ।ভোরের পাহাড় যে কি স্নিগ্ধ হয় মনে যেন কি শাস্তি আসে।চন্দ্রভাগার উপর সেতু পার হয়ে শুরু পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথ।সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মনে হল যেন তুষার শৃঙ্গের মুকুট পরে চন্দ্রভাগা উপত্যকা যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য মেলে ধরেছে।একটা সরু নালার পাশ দিয়ে খুব পিচ্ছিল ভাঙাচোরা পথ।মাঝে মাঝে চড়াই ভেঙে দু তিনটে ছোট ছোট পাহাড় পেরিয়ে হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত ত্রিলোকনাথ মন্দির ।জায়গাটির নাম ত্রিলোকনাথ ।পাহাড়ের মাথায় জনবসতির একপাশে দেবালয় ।এখানে দেবতা রুদ্ধ দ্বারে বসে নেই একান্ত আপনজনের মতো সকলের সাথে মিশে রয়েছেন।মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা হল এখানকার অধিবাসীদের সাথে।পরদেশি দেখে সবাই ভীড় করে এলো।কি হাসিখুশি সহজ সরল মানুষ গুলি মন্দিরের সামনেরঅংশটি ভেঙে গেছে।তিব্বতি ধাঁচের মন্দির ।ভাঙা অংশ টি পেরিয়ে আমরা জুতো মোজা খুলে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম ।অসংখ্য প্রদীপের আলোয় মন্দির আলোকিত ।মৌণ মন্দির অভ্যন্তরে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত কয়েক জন পাহাড়ি মেয়ে।এখানে সকলেই বৌদ্ধধর্মালম্বী।বুদ্ধকে স্মরণ করেই ত্রিলোকনাথ দেবের পুজো নিবেদিত হয়।ত্রিলোকনাথের মাহাত্ম্য এবং কিংবদন্তী অনেক আছে।এই মুর্তিটি অনেকবার চুরি করার চেষ্টা করা হয়েছে ।একবার কুলুর রাজা সেনা পাঠিয়ে বিগ্রহ তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু কিছুতেই পারেন নি।এখনও নাকি মুর্তিটির ডান পায়ের নীচে তরোয়ালের দাগ দেখা যায় ।আমরা পুজো দেওয়ার জন্য পুরোহিতের খোঁজ করতে জানলাম উনি বাইরে আছেন ।পুরোহিতের ছেলে আমাদের পুজো নেবে।অর্ঘ্য তো সামান্য ।কিছু ধূপের বান্ডিল আর নতুন কাপড়ের টুকরো।ভগবান বুদ্ধের চরণে এই সামান্য ডালি নিবেদন করে ডক্তিভরে সবাই প্রণাম করলাম ।তারপর পুরোহিতের কানে কানে আমাদের মনোবাঞ্ছা জানালাম ।আমরা এক বিখ্যাত হিমালয়প্রেমীর কাছে যা জেনেছিলাম ।পুরোহিত একবার চকিতে চারিদিক দেখে নিল।মন্দির পুরো ফাঁকা ।ইসারায় আমাদের একদম বিগ্রহের সামনে নিয়ে গেল।অজস্র পাথর মনি মুক্তোর মালা তুলে উন্মোচন করলো পুরো মুর্তিখানি।কোথায় গেল সেই সৌম্য শান্ত বুদ্ধ এ যে ভুবন ভোলানো নৃত্যরত নটরাজ! এমন সৌম্য রূপের সঙ্গে সংহার রূপের মিলন ।আমরা বিমোহিত হতবাক।প্রতিটি আঙুলের মুদ্রা আর ভঙ্গিমা এতো ছন্দময় এতো প্রাণবন্ত যেন স্বয়ং নটরাজ নৃত্যরত বালকের মতো আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন ।ধন্য আমরা।ধন্য আমাদের ত্রিলোকনাথ দর্শন ।জয় ত্রিলোকনাথ ।তুমি আছ বিশ্বনাথ অসীম রহস্য মাঝে।
একরাশ আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম উদয়পুর ।বেলা একটা নাগাদ ।চাল ডাল সামনের চায়ের দোকানে দিয়ে সুন্দর খিচুড়ি আর ওখানকার সুস্বাদু আলু ভাজি আমাদের দুর্দান্ত লাঞ্চ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ এখানকার লোকজনদের সঙ্গে গল্প গুজব করে বিশ্রাম নিতে গেলাম বাংলোর ভিতর ।
পরের দিন ভোরে মানালি ফেরা।সবাই খুব হৈ হৈ করে দিনটা কাটালাম।তখনও বুঝি নি এই অপূর্ব চাঁদের আলো এই উচ্ছল সন্ধ্যা গানে গানে মুখরিত রাত্রি ঢেকে যাবে কালোমেঘে।মাঝ রাতে শুনি বাইরে তান্ডবলীলা ।এমনিতেই এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা হঠাৎ যেন দশগুণ বেড়ে গেল।সারারাত কম্বলের তলায় ঠকঠক করে কেঁপেছি আর ফেরার কথা ভেবে আকুল হয়েছি ।ভোরবেলায় উঠে দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।আর উত্তুরে হাওয়া যেন সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে।একরাতের মধ্যে সামনের পাহাড় গুলো মুহূর্তে বরফে ঢেকে গেছে।বাস আসতেই উঠে বসলাম ।সব যাত্রীদের মুখে এক কথা এভাবে বরফ পড়তে থাকলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে ।রাহুল ও মানালির একমাত্র সংযোগ স্থল রোটাংপাস যদি বন্ধ হয়ে যায় আমরা এখানেই বন্দী হয়ে যাবো।বাস একটু একটু করে যায় আর থেমে যায় ।জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার বলে ডিজেল ফাঁস গিয়া।প্রচন্ড ঠান্ডাতে ডিজেল জমে যাচ্ছে । বাসের মধ্যে সবাই চুপচাপ বসে আছি।এত দুর্ভাবনার মধ্যে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সব ভুলে গেলাম ।কি হবে কি হতে পারে সব ভাবনা ভুলে দেখতে থাকি আকাশ থেকে ঝরে পড়া যেন মুঠো মুঠো শ্বেত টগরের পাপড়ির মতো তুষার বৃষ্টি ।আর চারিদিক সাদায় সাদা।ডিজেল ফাঁসতে ফাঁসতে অবশেষে বিকেল বেলা খোকসার এসে পৌঁছলাম ।চারিদিক অন্ধকার ।এরকম দুর্যোগে কোনও গাড়ি আর যেতে চাইছে না।সব লরি বাস বন্ধ ।আজ এখানেই রাত্রি বাস।স্থানীয় লোকজন বলছে এরকম আবহাওয়া চলতে থাকলে রোটাংপাস বন্ধ হয়ে যাবে।ছ দিন কি ছ মাস কেউ বলতে পারবে না।উৎকন্ঠিত চিত্তে পি ডব্লিউ ডির রেস্ট হাউসে রাত কাটানোর জন্য হাজির হলাম ।সেদিনের মতো পোড়া আলু আর পোড়া রুটি ডিনারের জন্য চায়ের দোকানে পাওয়া গেল।এরপরে কি হবে জানা নেই।এর মধ্যে ই মলয় বললো কি আর হবে দিদি তোর মেয়েটা বড় হয়ে যাবে আর কাকীমার তোমার ছেলে এক ক্লাস এগিয়ে যাবে ।আর যত দিন কাফ সিরাপ আছে রুটি দিয়ে গুড়ের মত খেয়ে নেব।কি চিন্তা আমাদের ।উফ্ কি ছেলে রে বাবা ।আমরা একমনে বাবা ত্রিলোকনাথ কে ডেকে যাচ্ছি আর প্রার্থনা করছি রক্ষা করো বাবা।রাত্রি নটার পর ঝড়ের বেগ একটু কমে গেল।বৃষ্টির আওয়াজ ও যেন কমেছে মনে হল।একটু রাতে হঠাৎ যেন কাঁচের জানালার ফাঁকে এক ঝলক আলো এসে পড়লো ।হৈ হৈ করে বারান্দায় বেরিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় তুষারাবৃত হিমালয় স্নান করছে।অবর্ণনীয় সেই আলো সেই সৌন্দর্য ।আলোর ঝর্ণা ধারায় আনন্দে চোখে জল এসে গেল।মলয় আনন্দের চোটে গান গাওয়া শুরু করল–প্রেমের জোয়ারে ভাসাব দোঁহারে বাঁধন খুলে দাও দাও দাও যতো হাসি আর বলি ওরে এ যে শ্যামার গান প্রেমের গান কে কার কথা শোনে হাসতে হাসতে আমরা বাঁধন খোলার আনন্দে ভেসে গেলাম ।পরদিন বেলা দশটা নাগাদ বাস ছাড়লো।বরফ কেটে কেটে মন্থর গতিতে সন্ধ্যা সাতটায় রোটাং পাসের ভয়ানক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যেন মানালি এসে গেলাম ।একশ আশি কিলোমিটার শুধু সাদা দেখে দেখে সবুজের ছোঁয়ায় মন ভরে গেলো।জয় ত্রিলোকনাথ ।
