Categories
নারী কথা প্রবন্ধ রিভিউ

আজ কৌশিকী অমাবস্যা, জানুন কেন পালন করা হয় এই বিশেষ তিথি।

শাস্ত্র অনুযায়ী কৌশিকী অমাবস্যার গুরুত্ব অন্যান্য অমাবস্যার থেকে একটু আলাদা হয়। এই বিশেষ তিথিতে তারাপীঠ মন্দিরে পুজো করা হয় নিষ্ঠা ভরে। কৌশিকী অমাবস্যার অর্থ হল তারা নিশি। এই তিথি তন্ত্র সাধনার এক বিশেষ রাত। অমাবস্যার এই বিশেষ তিথিতে সাধক বামা ক্ষ্যাপা তারাপীঠের মহাশ্মশানের শিমূল গাছের তলায় মা তারার আরাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। মনে করা হয়, বিশেষ এই তিথিতে তারাপীঠে তারা মায়ের পুজো করলে সকল মনের ইচ্ছে পূরণ হয়। এই কারনেই কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে হাজার হাজার পূণ্যার্থী আসেন মায়ের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য। এদিন তারাপীঠের শ্মশান এক অন্য রূপ নেয়।
আবার আজকের এই দিনে দশ মহাবিদ্যার অন্যতম দেবী তারা আজ বামদেবের সন্মুখে আবির্ভূত হন।

 

বামদেব পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে আজকের দিনেই সিদ্ধিলাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম জেলায় অবস্থিত তারাপীঠ এ আজ এই উপলক্ষ্যে বিশাল উৎসব  হয়, তারা দেবীকে বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্গত বজ্রযানে নীলসরস্বতীও বলা হয়। লোকে বিশ্বাস করে এই তিথিতে ভাত খেতে নেই।

 

কৌশিকী অমাবস্যা, অন্য সব অমাবস্যার থেকে একটু আলাদা, কারণ তন্ত্র মতে ও শাস্ত্র মতে ভাদ্র মাসের এই তিথিটি একটু বিশেষ। অনেক কঠিন ও গুপ্ত সাধনা এই দিনে করলে আশাতীত ফল মেলে। সাধক কুলকুণ্ডলিনী চক্রকে জয় করে। বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রে এই দিনের এক বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। তন্ত্র মতে এই রাতকে ‘তারা রাত্রি’ও বলা হয়৷ এক বিশেষ মুহূর্তে স্বর্গ ও নরক দুইয়ের দরজা মুহূর্তের জন্য খোলে ও সাধক নিজের ইচ্ছা মতো ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক শক্তি সাধনার মধ্যে আত্মস্থ করেন ও সিদ্ধি লাভ করেন৷
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত মহা সরস্বতী দেবীর কাহিনীতে বলা আছে, পুরাকালে একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ কঠিন সাধনা করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলে চতুরানন তাঁদের বর দেন, কোনও পুরুষ তাঁদের বধ করতে পারবেন না৷ শুধু কোনও অ-যোনি সম্ভূত নারী তাঁদের বধ করতে পারবেন। অর্থাৎ এমন এক নারী, যিনি মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেননি, তাঁর হাতেই এই দুই অসুর ভাই-এর মৃত্যু হবে। পৃথিবীতে এমন নারী কোথায়? আদ্যা শক্তি মহামায়াও মেনকা রানির গর্ভে জন্ম নিয়েছেন, তাই তিনিও ওঁদের নাশ করতে পারবেন না। তা হলে উপায়?
পূর্ব জন্মে পার্বতী যখন সতী রূপে দক্ষ যজ্ঞ স্থলে আত্মাহুতি দেন, তার কারণে এই জন্মে ওঁর গাত্র বর্ণ কালো মেঘের মতো। তাই ভোলানাথ তাঁকে কালিকা ডাকতেন। একদিন দানব ভাইদের দ্বারা পীড়িত ক্লান্ত দেবতারা যখন কৈলাশে আশ্রয় নিলেন, শিব সব দেবতাদের সামনেই পার্বতীকে বললেন, “কালিকা তুমি ওদের উদ্ধার করো।” সবার সামনে ‘কালী’ বলে ডাকায় পার্বতী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, অপমানিত ও ক্রোধিত মনে মানস সরোবরের ধারে কঠিন তপস্যা করলেন।তপস্যান্তে শীতল মানস সরোবরের জলে স্নান করে নিজের দেহের সব কালো পরিত্যাগ করলেন ও পূর্ণিমার চাঁদের মতো গাত্র বর্ণ ধারণ করলেন। ওই কালো কোশিকাগুলি থেকে এক অপূর্ব সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ দেবীর সৃষ্টি হয়। ইনি দেবী কৌশিকী। আজ সেই তিথি, যে দিন এই দেবীর উৎপত্তি হয় এবং তিনি শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন। তাই এই অমাবস্যার নাম কৌশিকী অমাবস্যা। আবার আজকের এই দিনে দশ মহাবিদ্যার দ্বিতীয়া স্তরের অন্যতম দেবী তারা মর্ত ধামে আবির্ভূত হন। বীরভুম জেলায় অবস্থিত তারাপীঠে এই উপলক্ষে বিশাল উত্‍সব হয়।
বলা হয়, এই অমাবস্যা তিথিতে ক্ষণিকের জন্য খুলে যায় স্বর্গ এবং নরক এই দুইয়েরই দ্বার। আর আমাদের জন্য তার যে কোনও একটি নির্দিষ্ট হয় কর্মফলের উপরে ভিত্তি করে, বিশেষত এই অমাবস্যা তিথিতে আমরা কী করেছি, তার উপরে ভিত্তি করে। দেবী তারা অল্পতুষ্টা, কিন্তু মহাঋষি বশিষ্ঠকে রীতিমতো নিয়ম মেনে তাঁকে সাধনা করতে হয়েছিল তারাপীঠে, তবেই আবির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী। তাই এই কৌশিকী অমাবস্যায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কী কী করা উচিত আর কী একেবারেই পরিহার করা উচিত, জেনে রাখা জরুরি।

শুচিতা

যে কোনও সাধনারই মূল কথা হল শুচিতা- শুধু নিজের নয়, একই সঙ্গে স্থানেরও। তাই এই দিন যেমন নিজেকে, তেমনই পরিষ্কার রাখতে হবে ঘরবাড়ি। সকালে উঠে ঘর ধুয়ে-মুছে স্নান করে নিতে পারলে ভাল, না হলে দিনের যে কোনও সময়েই তা করে নেওয়া যায়। এর পরেই শুরু হবে আরাধনা।

সিঁদুর, জবা

মহাতিথির পূজায় কিন্তু মহা আড়ম্বরের প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র সিঁদুর আর জবাফুল দেবীর পায়ে অর্পণ করলেই হল। চাইলে ওম তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা বীজমন্ত্র জপ করা যায়।

আহারে সংযম

তন্ত্রের মূল ভিত্তি পঞ্চ ম-কার। সেই রীতি মেনে মায়ের ভোগে তারাপীঠে অবশ্যই দেওয়া হবে মৎস্যভোগ, নিবেদন করা হবে মদ। কিন্তু তন্ত্রে এর রয়েছে দার্শনিক গুরুত্ব। তাই দেবীকে দেওয়া হচ্ছে বলেই আমরা কিন্তু এদিন মাছ বা আমিষ, মদ কোনওটাই গ্রহণ করতে পারব না। উপবাসে থাকতে পারলে ভাল, না হলে নিরামিষ আহারে সংযম পালন করতে হবে।
কৌশিকী অমাবস্যায় ভুলেও আমিষ ভোজন করতে বারণ করা হয়। শাস্ত্র মতে, এই দিনে আমিষ ভোজন করলে শরীরে নেগেটিভ এনার্জি বেড়ে যায়। এ দিন আমিষ ভোজন করলে চর্মরোগ এবং পেট-পাকস্থলী সম্পর্কিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, এমনটাই শাস্ত্রে বর্ণিত রয়েছে।

শারীরিক সংযম

পঞ্চ ম-কারের অন্যতম হল মৈথুন। কিন্তু গৃহস্থ যেহেতু তন্ত্রমতে আরাধনা করেন না, তাই এই তিথিতে শারীরিক সংযমে নিজেকে বাঁধতে হবে। মৈথুনে লিপ্ত হওয়া যাবে না। দৈবাৎ লিপ্ত হলে তা জীবনে বিড়ম্বনা ডেকে আনবে, গর্ভে সন্তান এলে তার জীবনও হয়ে উঠবে অশুভ।

দূরে যাত্রা নয়—

গর্ভবতী মহিলাদের এদিন বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। কারণ এই নেগেটিভ এনার্জির প্রভাব গর্ভস্থ সন্তানের উপর পড়তে পারে। গেলে সঙ্গে রাখতে হবে তুলসিপাতা।

দীপদান–

দীপাবলি অমাবস্যার মতো কৌশিকী অমাবস্যাতেও দীপদানের রীতি আছে। এক্ষেত্রে দুটি তিলের তেলের প্রদীপ সন্ধ্যায় রাখতে হয় বাড়ির দরজার দুই পাশে, তা অশুভ শক্তিকে গৃহে প্রবেশে বাধা দেয়।

গোপন আচার—

বলা হয়, একটি জলশূন্য নারকেল নিয়ে, তাতে একটি ফুটো করে, সেই ফুটোর মধ্যে দিয়ে নারকেলে চিনি ভরে, ফুটো উপরের দিকে রেখে নারকেলটা যদি বাড়ি থেকে কিছু দূরে পুঁতে দেওয়া যায়, তবে জীবন থেকে সব বাধা দূর হয়। অসুবিধা হল- এই আচার পালন করতে হবে গোপনে, কেউ দেখে ফেলে লাভ হবে না।

দুধদান—

দীপদানের মতোই কৌশিকী অমাবস্যায় যদি কোনও কুয়ো বা গর্তে এক চামচ দুধ নিবেদন করা যায়, তবে তা জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে।

তন্ত্র শাস্ত্রের ব্যাখা অনুযায়ী, এই তিথিতে মা তারার পুজো দিয়ে দ্বারকা নদীতে স্নান করলে শত জন্মের পুন্যলাভ হয়। আর এই কারণেই তারাপীঠে এই তিথিতে আয়োজন করা হয় বিশেষ পুজোর।

 

এই কৌশিকী অমাবস্যার দিন তান্ত্রিকরা তন্ত্র সাধনার জন্য বেছে নেন। এই সাধনা চলে গোটা রাত জুড়ে। তবে অনেকেই বলেন কৌশিকী অমাবস্যা নাকি ভীষণ জাগ্রত। এই দিনেই নাকি কিছুক্ষণের জন্য খুলে যায় স্বর্গের দরজা। এই নিয়েও রয়েছে অনেক কাহিনি।তন্ত্রের মাধ্যমেই সিদ্ধিলাভের আসায়  সারা রাত ধরে শ্মশানে তন্ত্র সাধনাতে মগ্ন হন সাধকরা। সারা রাত ধরে শ্মশানে চলা সাধনা ফলদায়ী হয়।  অনেকে বলেন শ্মশানের মধ্যে একটি হল মণিকর্ণিকা ঘাট। বিভিন্ন কারণের জন্যই কৌশিকী অমাবস্যার দিনটি আলাদা বলে ধরা হয়। এবং তারাপীঠের এই শ্মশানকেই বলা হয় মহাশ্মশান।

।। তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *