Categories
গল্প প্রবন্ধ

ভাদু উৎসব, একটি বিশেষ পর্যালোচনা : দিলীপ রায়।

আমরা জানি,  বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ । আর এই তেরো পার্বণের অন্যতম পার্বণ হচ্ছে  ভাদু উৎসব । ভাদু হল ভাদ্র মাসের উৎসব । পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর এই জেলাগুলিতেই প্রধানত এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । তবে ইদানীং রাজ্যের অন্যান্য জেলায়ও এই অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি দেখা যায় । যেমন মুর্শিদাবাদ জেলায় সালার শহরের কাছে ঝামটপুরে ভাদু উৎসব দেখা যায় । বিশেষ করে ভাদ্র মাসের শেষদিন বড় উৎসব যেটা মেলার আকার নেয় । এই অনুষ্ঠানকে অন্য কথায় মেয়েলি ব্রত বলা যেতে পারে   ।  অনেকে মনে করেন  ভাদ্র মাস থেকেই ‘ভাদু ‘ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে । আবার অনেকে মনে করেন,  ভাদু মানে  লক্ষ্মী । বিভিন্ন মাসে লক্ষ্মী বিভিন্ন রূপে যেহেতু  পুজিত হন, তাই ভাদ্রমাসেও ভাদু উৎসবের মাধ্যমে লক্ষ্মীদেবী  পুজিত হন । তবে এই উৎসবের অনেক মতান্তর রয়েছে । পুরুলিয়া  জেলার কাশীপুর রাজপরিবারের  ভাদু বা ভদ্রেশ্বরী নামক এক রাজকন্যার কাহিনী থেকে এর উদ্ভব । শোনা যায়, কাশীপুর রাজের কন্যা ভাদুর এক রাজকুমারের সাথে বিয়ে ঠিক হয় । কিন্তু বিয়ের দিন বর বেশে বিয়ে করতে আসার সময় তিনি মারা যান । এরপরই ভাদু মৃত্যুবরণ করে । ভাদু উৎসব নিয়ে মানভূম অঞ্চলে বেশ কিছু লোককাহিনী প্রচলিত । আবার আরও একটি জনশ্রুতি, পঞ্চকোট রাজ পরিবারের নীলমণি সিংদেও’এর  তৃতীয়া কন্যা ভদ্রাবতী বিবাহ স্থির হওয়ার পর তার ভাবী স্বামীর অকালমৃত্যু হলে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন, এই কাহিনী মানভূম অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচারিত ।

 

 

বিয়ে করতে আসার সময় ভদ্রাবতীর হবু স্বামী ও তার বরযাত্রী ডাকাতদলের হাতে খুন হলে ভদ্রাবতী চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন বলে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার পুরুলিয়া গ্রন্থে প্রকাশিত হয় । ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীলমণি সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন ।  অনেকেই তার সাথে কৃষ্ণভক্তি পরায়ণা মীরার মিল খুঁজে পান । তবে রাজকন্যা ভাদুকে নিয়ে অনেক মতান্তর রয়েছে । রাজকন্যার স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশে ভাদু উৎসব  প্রচলিত  । এমনকি ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীল সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন ।
ভাদু উৎসব কৃষি প্রধান উৎসবও বটে । মাঠজুড়ে তখন  নতুন ধান রোপণ করা হয় । তবে এই উৎসবের অন্যতম বিষয় হল এই পুজোয় কোনো মন্ত্রের প্রয়োজন নেই  । ভাদু উৎসবে পূজারীরা ভদ্রেশ্বরীর একটি মূর্তি তৈরি করে এবং সারা মাস ধরে তার সম্মুখে নৃত্যগীত পরিবেশন করে । ভদ্রেশ্বরী কখনও কন্যা আবার কখনও জননীরূপেও পুজিত  হন । পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা গ্রামের কোন বাড়ীর কুলুঙ্গী  পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন । আগে ভাদুর কোনো মূর্ত রূপ ছিল না ।  একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে তারা সমবেত কন্ঠে ভাদু গীত গেয়ে থাকেন । পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকমের মূর্তির প্রচলন হয়েছে ।  ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদুর মূর্তি ঘরে নিয়ে আসা হয় । শোনা যায়, মূর্তিগুলি সাধারণত হংস বা  ময়ূর বাহিনী বা পদ্মের ওপর উপবিষ্টা মূর্তির গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুল, গলায় পদ্মের মালা ও হাতের তলায় আলপনা থাকে । কখনো মূর্তির কোলে কৃষ্ণ বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি থাকে ।  ভাদ্র সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রিতে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়ে থাকে । মাইক বাজিয়ে গান শুনে খাবার তৈয়ারী করে নিজেদের মতো করে জাগরণের রাত পাড়ার ছেলেরা সমবেতভাবে অতিবাহিত করে । এর মাধ্যমে সামাজিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ উন্মেষ হয় । যা সমাজ থেকে বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে ।  এই লৌকিক ও সামাজিক উৎসব সমাজে বেঁচে থাক । সমাজে টুসু, ঝুমুর, ভাদু গানের কদর বাড়ুক  । সুতরাং ভাদু জাগরণের আরও ব্যাপ্তি ঘটুক ।   এই রাত্রে রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘর তৈরী করে এই মূর্তি স্থাপন করে তার সামনে মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখা হয় । এরপর রাত্রিতে ভাদু গীত গাওয়া হয় । কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা গ্রামের প্রতিটি মঞ্চে গেলে তাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ও  তারা এই সব মঞ্চে ভাদু গীত পরিবেশন করে থাকেন ।

 

‘ভাদু ভাসান’ পর্ব অত্যন্ত বিষাদময় । ভাদ্র-সংক্রান্তিতে উপাসকরা মূর্তিসহ নদীর তীরে সমবেত হয়ে মূর্তি বিসর্জন দেন । এই উৎসবের অন্যতম লোকসংস্কৃতি হল ভাদু গান । সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানভূমের লোকসংস্কৃতি পুরুলিয়ার ভাদুগানেও পরিবর্তন হয়েছে । এই উৎসব উপলক্ষে মিষ্টির দোকানগুলিতে নানা রকমের মিষ্টি তৈরী ও  বিক্রি হয় ।
টুসু ও ঝুমুর গানের বিপরীতে ভাদু গানগুলিতে প্রেম এবং রাজনীতি সর্বতোভাবে বর্জিত । সাধারণতঃ গৃহনারীদের জীবনের কাহিনী এই গানগুলির মূল উপজীব্য । পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয় । বর্তমানে সচেতনামূলক ভাদু গান পরিবেশিত হচ্ছে ।
ভাদু উৎসবের উৎপত্তি নিয়ে বহু মতান্তর রয়েছে । কবে থেকে এবং কীভাবে এই অনুষ্ঠান শুরু তার সঠিক তথ্য আজও  অজানা  । পরিশেষে  ভাদু দেবীর কাছে  প্রার্থনা,  চাষের   জমি ফসলে   ভরে  উঠুক ও  মানুষের মধ্যে শান্তি বিরাজ করুক ।

 

(তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *