Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

মাতা আগমেশ্বরীর সূচনা ও কিছু রীতি নীতি – একটি বিশেষ পর্যালোচনা।

মাতা আগমেশ্বরীর সূচনা করেছিলেন পন্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নবদ্বীপের বাসিন্দা। তিনি তন্ত্রসার গ্রন্থ রচনা করেছিলেন অর্থাৎ তান্ত্রিকের নির্দিষ্ট পূজা বিধি। তিনি ধ্যানযোগে তাঁর আরাধ্যা দেবীর মূর্তি দেখেছিলেন। সেই মূর্তিকেই তিনি মাতা আগমেশ্বরীর  মধ্যে চিত্রিত করেছিলেন। যখন তিনি ধ্যান করছিলেন সেই সময় তিনি ধ্যানের মধ্য দিয়ে দেবীর আদেশে জানতে পারেন যে আগামীকাল প্রত্যুষে তুই যাকে দেখতে পাবি সেই তোর আরাধ্যা দেবী। সেই অনুযায়ী তিনি ঘুম থেকে উঠে চোখ মেরে দেখেন কালো এক কন্যা একহাতে গোবর নিয়ে অন্য হাতে ঘুটে দিচ্ছে দেওয়ালে। উনাকে দেখে উনি লজ্জায় জিভ কেটে ফেললেন। কৃষ্ণানন্দের মনে হল উনি হচ্ছেন তার আরাধ্যা দেবী কালী। উনি পড়ে সেই দেবীর মূর্তি গঙ্গা মৃত্তিকা এনে নির্মাণ করলেন এবং নির্মাণ করে পুজো করার সেই রাতেই তিনি তাকে বিসর্জন দিয়ে দিলেন। সেই থেকে প্রথম দক্ষিণা কালীর সৃষ্টি হল মূর্তি গড়িয়ে। পরবর্তীকালে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশের প্রপুত্র সার্বভৌম আগমবাগীশ তিনি শান্তিপুরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সার্বভৌম হলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশের প্রপুত্র। তাঁরা শাক্ত ছিলেন। কিন্তু শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের পুত্র মথুরেশ গোস্বামী চেয়েছিলেন তদানীন্তনকালে শক্ত এবং বৈষ্ণবের মধ্যে বিরোধ টা দূর করতে। তাই তিনি তার মেয়ের বিয়ে দেন সার্বভৌম আগমবাগিসশের সঙ্গে। কিন্তু তদানীন্তন শাক্ত সমাজে এই বিয়েটা ভালোভাবে মেনে নেননি। মেনে না নেওয়ার ফলে তাদের সংসারে নানা সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। পরে তিনি মেয়ে জামাইকে নবদ্বীপ থেকে নিয়ে আসেন শান্তিপুরে। শান্তিপুরের বড় গোস্বামী পরিবার যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে শক্তির উপাসনা করেন না সেহেতু মধুরেশ গোস্বামী সেই সময় তার বাড়ির কাছেই পূর্ব দিকে একটি পঞ্চমুন্ডির আসন স্থাপন করেন। সেখানেই সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন সার্বভৌম আগমবাগীশ। তিনিও সাধনায় অনুরূপভাবে মূর্তি দেখলেন এবং শান্তিপুরে আগমেশ্বরীর প্রতিষ্ঠা করলেন। এখানে সার্বভৌমের নিয়মানুযায়ী একদিনে মূর্তি তৈরি করা হতো কিন্তু এখন যেহেতু মূর্তি অনেক বড় সেই কারণেই কৃষ্ণপক্ষ পরার পর মূর্তির কাজ শুরু হয়। ৮-১০ দিনের মধ্যে মায়ের মূর্তি তৈরি হয়। এবং পুজোর দিন মৃৎশিল্পী সুবীর পাল চক্ষুদান করে নিচে নেমে আসেন তারপরই পুজো শুরু হয়। সেই রীতি এখনো আছে এবং পুজো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘট বিসর্জন হয়ে যায়। পরে মূর্তি নিরঞ্জন হয়। শান্তিপুর তথা বাংলার  বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ করতে। দেবীকে নানান ধরনের স্বর্ণালংকার টাকা-পয়সা মিষ্টি বাতাসা ভক্তরা দিয়ে যান। আনুমানিক ১০-১২ লক্ষ টাকার প্রতিবছর খরচ হয় এই পুজোয়। এই টাকাটা পুরোটাই ভক্তদের প্রদেয় দান। জোর করে কারো কাছ থেকে পুজোর চাঁদা নেওয়া হয় না। পুজো কমিটির অফিসে এসে ভক্তরা তাদের সাধ্যমত চাঁদা দিয়ে যান। করোনা বিধি কাটিয়ে উঠে এ বছর ১৪ কুইন্টাল পুষ্পান্ন ভক্তদের বিলি করা হচ্ছে।
মন্দিরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিনয় অধিকারী জানান, আমি দীর্ঘ ৪০ থেকে ৪৫ বছর মার মন্দির দেখাশোনা করি। করোনা আবহে দু বছর ভোগ হয়নি। এ বছর নতুন করে আবার ভোগ চালু হচ্ছে। করোণা আবহে দু বছর পুষ্পান্ন বাদ দিলে প্রতিবছরই ৮ থেকে ৯ হাজার সড়া করা হয়। এই ভোগ সবাইকে বিতরণ করা হয়।
শান্তিপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে পুজো পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা মন্ডলী আছে। মূলত বড় গোস্বামী বাড়ির উত্তর পুরুষ এই পুজোর পরিচালনার দায়িত্বে। তাদের মাথার উপর শান্তি পুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি এই পুজো পরিচালনা করে। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ দক্ষিণা কালীর যে ধান রীতি রচনা করেছিলেন সেই ধ্যানীতিতে বলা হয় মার কর্ণের পাশ দিয়ে দুটি শব শিশু ভয়ানক রূপে বিরাজ করছে। আগে কঢড়ি বর্গার বাড়ির মতন মন্দিরটা ছিল। বর্তমানে ২৫- ৩০ বছর এই মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। আগে এই মন্দিরটি ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছিল।মানুষের বসবাসের উপযোগী ছিল না। বড় গোস্বামী বাড়ির শশুরকুল এই পুজোর পরিচালনা করে। আগে মশালের আলো দিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন হত। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রশাসনের নির্দেশে তারা মশাল বন্ধ করে দেয়।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *