সূচনা– ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফেরার পথে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত পৌঁছেও গেছিল তাঁদের মহাকাশযান। আর কয়েক মিনিটেই হয়তো ছুঁয়ে ফেলতেন পৃথিবীর মাটি। তখনই টেক্সাসের উপরে টুকরো টুকরো হয়ে যায় গোটা মহাকাশযান। কলম্বিয়া নভোযান বিপর্যয়ে যে সাতজন মহাকাশচারী এবং ক্রু মৃত্যুবরণ করেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। পৃথিবীতে অবতরণ করতে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে এই নভোখেয়াযানটি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল।
প্রাথমিক জীবন—
কল্পনা চাওলা ১৪৬৮খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কারনালে বসবাসকারী এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কল্পনা তার মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপন করেন ঠাকুর বালনিকেতন সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল, কারনাল থেকে। এর পরে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চণ্ডীগড়ের পাঞ্জাব প্রকৌশল কলেজ থেকে মহাকাশ প্রকৌশলের ওপর স্নাতকের পাঠ সম্পন্ন করেন। উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটন থেকে একই মহাকাশ প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপ্ত করেন ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তীতে কল্পনা ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো অ্যাট বউল্ডের থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত হন।
আরও চার বছর পরে, ১৯৮৮ সালে নাসায় যোগ দেন।কয়েক বছরেই স্বীকৃত পাইলট হয়ে ওঠেন কল্পনা। পরে নাসা রিসার্চ সেন্টারে ওভারসেট মেথডসের ভাইস প্রেসিডেন্টও হন। বাণিজ্যিক উড়ান চালানোর অনুমোদন ছিল তাঁর। সামুদ্রিক বিমান এবং মাল্টি-ইঞ্জিনের প্লেন চালানোরও লাইসেন্স ছিল তাঁর। পরে ফ্লাইট ইনস্ট্রাকটরও হয়েছিলেন তিনি।
এর মধ্যেই বিয়ে করেন মার্কিন লেখক জাঁ-পিয়ের হ্যারিসনকে। সে সুবাধে ১৯৯১ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পেলে নাসার অ্যাস্ট্রোনট কোরের সদস্য স্বীকৃতি পান কল্পনা।
কর্ম জীবন—
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কল্পনা নাসাতে তার কর্মজীবন শুরুর পর
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর পাড়ি দেন প্রথম মহাকাশ অভিযানে। মহাকাশযান কলম্বিয়া এসটিএস ৮৭-তে মিশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ৩৭২ ঘণ্টা মহাকাশে কাটান তিনি। পৃথিবীর কক্ষপথে ২৫২ বার পরিক্রমা করেন। ১০০ লক্ষ মাইলেরও বেশি ভ্রমণ করেন মহাকাশে। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
২০০০ সালে কলম্বিয়া এসটিএস ১০৭-এর মহাকাশ অভিযানে ফের মহাকাশে যাওয়ার সুযোগ পান কল্পনা। নানা কারণে পিছিয়ে যাওয়ায় শেষমেশ ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মহাকাশযাত্রা করেন কল্পনারা। তিনি ছাড়াও আরও ছয় মহাকাশচারী ছিলেন ওই অভিযানে।
মৃত্যু—-
পৃথিবীর মাটি ছুঁতে বাকি ছিল মাত্র কয়েক মিনিট। তখনই মুহূর্তের বিস্ফোরণে ছাই হয়ে যায় মহাকাশযান। আর তার ভিতরেই অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে শেষ হয়ে যান ভারতের প্রথম মহিলা মহাকাশচারী কল্পনা চাওলা। সারা পৃথিবী তাঁকে এই নামে চিনলেও, তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের আদরের মন্টো। মাত্র ৪২ বছরে শেষ হয়ে যায় তাঁর জীবন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি মহাকাশ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় কলম্বিয়া স্পেস সাটলটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় এক দুর্ঘটনার ফলে সাত জন ক্রুসহ বিধ্বস্ত হয় এবং কল্পনা সহ সকলে মারা যান।
শেষ ইচ্ছে—
ইন্দো-মার্কিন এই সাহসিনীর শেষ ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর পর তাঁর দেহভস্ম যেন হিমালয়ের বুকে বা জিওন ন্যাশনাল পার্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মেয়ের ইচ্ছে পূর্ণ করেছিলেন বাবা।কল্পনা চাওলার দেহাবশেষ তাঁর ইচ্ছানুসারে উটাহের জাতীয় উদ্যানে দাহ করা হয়েছিল ও অস্থিভষ্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সম্মাননা—-
তাঁর সম্মানে, ২০০২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতে প্রবর্তিত মেট-স্যাট সিরিজের প্রথম উপগ্রহ মেটস্যাট -১ নামকরণ করা হয়েছিল কল্পনা -১।
তাঁর সম্মানে ভারত ও আমেরিকার বেশ কয়েকটি বৃত্তি, রাস্তা, বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয়েছে।
উপসংহার—
সৌরজগতের নাগরিক হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়া কল্পনার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল ভারত জুড়ে। আজও ভারতের মহাকাশ চর্চায় তাঁর অবদান ভোলেননি কেউ।
সংক্ষেপে জেনে নিন কল্পনা চাওলা সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য।
১) কল্পনার জন্ম হয় ১৯৬২ সালের ১৭ মার্চ হরিয়ানার কার্নালে।
২) কল্পনা চাওলা বি টেক পাশ করেন পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। কোনওদিন তিনি ক্লাশে সর্বোচ্চ নম্বর পাননি। কিন্তু বরাবর থাকতেন প্রথম পাঁচে।
৩) ১৯৮২ তে তিনি চলে যান আমেরিকায়। টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন।
৪) কল্পনার বাবা-মা তাঁর নাম দিয়েছিলেন মন্টো। কিন্তু তিনি মন্টো নামটা নিজের ডাক নামই বানিয়ে ফেলেন।
৫) ১৯৮৩ সালে বিয়ে করেন কল্পনা। তাঁর বরের নাম জিন পিয়েরে হ্যারিসন।
৬) কল্পনা চাওলা পছন্দ করতেন, কবিতা, নাচ, এবং সাইকেল চালাতে।
৭) তাঁর স্বপ্নই ছিল মহাকাশে যাওয়ার। সেই অনুযায়ী তিনি ধাপে ধাপে পড়াশোনা করতে থাকেন।
৮) নাসা রিসার্চ সেন্টারে তিনি ওভারেস্ট মেথডের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
৯) কল্পনা চাওলার কমার্শিয়াল ফ্লাইট চালানোর লাইসেন্সও ছিল।
১০) ১৯৯১ সালে কল্পনা চাওলা আমেরিকার নাগরিকত্ব পান।
১১) নাসা স্পেস ফ্লাইট মেডেল পান তিনি।
১২) ২০০৩ সালের আজকের দিনেই তিনি কলম্বিয়া স্পেস শাটল ধ্বংসের সময় মারা যান।
১৩) কল্পনা বিশ্বাস করতেন না তিনি কোনও দেশের নাগরিক। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি সৌরজগতের নাগরিক।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।