Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও কামাখ্যা তীর্থক্ষেত্র : স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।
অর্থ:-যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা, তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার। তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
ভারতভূমিতে জন্মলাভ করে আমাদের এই সুদুর্লভ মনুষ্য জীবন লাভ। পুণ্যভূমি,পবিত্রভূমি, তপোভূমি আমাদের এই ভারতবর্ষ। শক্তিপীঠ, জ্যোতির্লিঙ্গ, শিবালয়, দেবালয় পবিত্র তীর্থক্ষেত্র বিরাজমান সৌন্দর্যময় আমাদের এই আধ্যাত্মিক দেশ ভারত ভূমিতে। যেমন, আমাদের ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম হল অসমের রাজধানী গুয়াহাটির পশ্চিমাংশে অবস্থিত নীলাচল পাহাড়ে দেবী কামাখ্যার মন্দির। এটি একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির। ভক্তদের কাছে, তান্ত্রিকদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থল। দেবী মহামায়া এই মন্দিরে কামাখ্যারূপে বিরাজমান। কামাখ্যা তীর্থক্ষেত্র একটি শক্তিপীঠ ও তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্র। কথিত আছে, এখানে সতীর দেহত্যাগের পর ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে যোনি ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তন্ত্র সাধকদের কাছে এই মন্দির অন্যতম প্রাচীন একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। কামাখ্যা মন্দিরটি ৭ম শতাব্দীতে রাজা ভগদত্ত শশাঙ্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভক্তদের কাছে কামাখ্যা দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। তাঁদের বিশ্বাস দেবীর কাছে মানত করলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। আর মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে এখানে কন্যা পূজা করা হয়। এছাড়াও পশু বলিরও চল রয়েছে এখানে। তবে হ্যাঁ, স্ত্রী পশু বলি দেওয়া হয় না। এবং ৪টি আদি শক্তি পীঠগুলোর মধ্যে, কামাখ্যা মন্দিরটি বিশেষ একটি শক্তিপীঠ।

পুরাণ অনুসারে, প্রজাপতি ব্রহ্মার পুত্র ছিলেন দক্ষ।রাজা দক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মহাদেবকে বিয়ে করেছিলেন তাঁর কন্যা সতী। মহাদেবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজা দক্ষ বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যজ্ঞে সতী কিংবা মহাদেব কাউকেই আমন্ত্রণ জানাননি দক্ষ। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী বাবার আয়োজিত যজ্ঞানুষ্ঠানে যান। সেখানে দক্ষ মহাদেবকে অপমান করেন। স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করেন। শোকাহত মহাদেব দক্ষর যজ্ঞ ভণ্ডুল করেন এবং দেবী সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। তাঁর তাণ্ডব বন্ধ করতে অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে ভগবান বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং সেই পবিত্র পীঠস্থানগুলি, শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ নামে পরিচিতি হয়। কামাখ্যা সেই ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম একটি শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ।

কামাখ্যা ৫১টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটি এবং ৪টি আদি শক্তি পীঠগুলোর মধ্যে কামাখ্যা মন্দিরটি বিশেষ একটি শক্তিপীঠ। কারণ, দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি এখানে পড়েছিল এবং এইভাবে দেবী কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বা ‘রক্তক্ষরাদেবী’ বলা হয়। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলোতে দশমহাবিদ্যাসহ মহাকালী, তারা, ষোড়শী বা ললিতাম্বা ত্রিপুরসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী বা জগদ্ধাত্রী, কামাখ্যা, শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী বা তপস্যাচারিণী, মঙ্গলচণ্ডী, কুষ্মাণ্ডা, মহাগৌরী, চামুণ্ডা, কৌশিকী, দাক্ষায়ণী-সতী, চন্দ্রঘন্টা, স্কন্দমাতা, কালরাত্রি, কাত্যায়নী, সিদ্ধিদাত্রী, শাকম্ভরী, হৈমবতী, শীতলা, সংকটনাশিনী, বনচণ্ডী, দেবী দুর্গা, মহাভৈরবী, ধূমাবতী, ছিন্নমস্তা, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও দেবী কমলা – এই ত্রিশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে।

অসমের বিখ্যাত কামাখ্যা মন্দিরের অনন্য ইতিহাস হল, বারাণসীর বৈদিক ঋষি বাৎস্যায়ন খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে নেপালের রাজার দ্বারস্থ হয়ে উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলিকে হিন্দুধর্মে সংগঠিত ও তাদের নরবলি প্রথার গ্রহণযোগ্য বিকল্প চালু করার জন্য অনুরোধ করেন। বাৎস্যায়নের মতে, পূর্ব হিমালয়ের গারো পাহাড়ে তারা দেবীর তান্ত্রিক পূজা প্রচলিত ছিল। সেখানে আদিবাসীরা দেবীর যোনিকে ‘কামাকি’ নামে পূজা করত। ব্রাহ্মণ্যযুগে কালিকাপুরাণে সব দেবীকেই মহাশক্তির অংশ বলা হয়েছে। সেই হিসেবে, কামাক্ষ্যাও মহাশক্তির অংশ হিসেবে পূজিত হন।

দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করা হয় অসমের কামাখ্যা মন্দির সংলগ্ন এলাকায়। পুরাণ অনুসারে, আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মাতা ঋতুমতী হয়। এই সময়টিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। আর এই উপলক্ষে বিশাল এক মেলার আয়োজন করা হয় সেখানে। অম্বুবাচীর দিন থেকে মোট তিনদিন দেবী কামাক্ষ্যার মন্দির বন্ধ থাকে। সেই তিনদিন কোনও মাঙ্গলিক কাজ করা যায় না। দেবী দর্শনও নিষিদ্ধ থাকে। চতুর্থ দিন দেবীর স্নান এবং পূজা সম্পূর্ণ হওয়ার পর মন্দিরে দেবী মূর্তি দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়।

সেই অম্বুবাচী মেলার উপলক্ষে সেখানে উপস্থিত হন লক্ষ লক্ষ ভক্ত। অবাক করা এই ঘটনার সাক্ষী হতে ভিড় জমান দেশি বিদেশি পর্যটকরা। কামাক্ষ্যা মন্দিরের চারদিকে চলে নাম সংকীর্তন। অম্বুবাচীর শেষ দিন ভক্তদের রক্তবস্ত্র উপহার দেওয়া হয়। দেবী পীঠের সেই রক্তবস্ত্র ধারণ করলে মনোকামনা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস করেন ভক্তরা। অম্বুবাচীর মেলা আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত। শক্তিপীঠকে কেন্দ্র করে যে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয় সেটিও দেখবার মতো। শাক্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে, কামাখ্যা মন্দিরটি তান্ত্রিক হিন্দু এবং শাক্ত সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিখ্যাত স্থান ও শক্তিপীঠ। দেবী কামাখ্যার শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক… এই প্রার্থনা করি…!
স্বামী আত্মভোলানন্দ(পরিব্রাজক)

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *