Categories
প্রবন্ধ

অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য : ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী।

ভূমিকা—

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘাট্লে দেখা যাবে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন আমাদের দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য। কিন্তু এখনো অনেকেই জানে না অনেকের নাম। কত শহীদ এর আত্মত্যাগের ঘটনা রয়ে গেছে অন্তরালে।  এখন আমরা জানব  ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য  সম্পর্কে কিছু কথা।

বিপ্লবী জীবন—-

এবার আমরা জানব অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য’র বিপ্লব জীবনের কর্মকান্ড নিয়ে কিথা। আমরা সকলেই জানি  আলিপুর বোমা মামলার সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা।

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

আলিপুর বোমা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিগণ—

৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ মুজাফফরপুর, বিহারে রাত সাড়ে আটটায় ইওরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে তিনজনকে হত্যা করেন ক্ষুদিরাম বসু। সেই ঘটনার পর আলিপুর বোমা মামলা শুরু হয়। ১৯০৯ সালের ৬ মে আলিপুর বোমা মামলার রায় দেয়া হয়। রায়ে বিচারক বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বিভূতিভূষণ সরকার, বীরেন্দ্র সেন, সুধীর ঘোষ, ইন্দ্রনাথ নন্দী, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়ের, দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। পরেশ মৌলিক, শিশির ঘোষ, নিরাপদ রায় ১০ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড, অশোক নন্দী, বালকৃষ্ণ হরিকোণে, শিশির কুমার সেন ৭ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড এবংকৃষ্ণ জীবন সান্যাল ১ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন। আপিলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড রহিত হয় এবং তার বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান এবং অনেকের সাজা হ্রাস করা হয়।

স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ—–

কলকাতার ৩২ নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে একটি বোমা তৈরির স্থান ছিলো। সেই মুরারিপুকুরের ঘটনায় আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯০৯ সনের মে মাসে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরে দণ্ডাদেশ হ্রাস পাওয়ায় ১৯১৫ সনের মে মাসে মুক্তি পান। ১৯২০ সনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন ও নারায়ণ পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।

রচিত গ্রন্থ—-

এছাড়াও বিজলী, আত্মশক্তি ও ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার সংগেও যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ হচ্ছে রণসজ্জায় জার্মানি, স্বরাজসাধনা, মুক্তিসাধনা, জার্মানি প্রবাসীপত্র, ইউরোপে ভারতীয় বিপ্লবের সাধনা প্রভৃতি।

মৃত্যু—-

১০ মে, ১৯৬২ সালে মহান এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রয়াণ ঘটে।

।।তথ্য ঋণ: উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবপেজ।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

“মিলেট” হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্য-শস্য — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায়।

প্রথমেই আমাদের জানা দরকার “মিলেট” কী ? জোয়ার, বাজরা, রাগি, ইত্যাদি কয়েকটি ক্ষুদ্র দানাশস্যকে একত্রে মিলেট বলে । পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশী মিলেট উৎপন্ন হয় । সাধারণত দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের গরীব অধিবাসীরা খাদ্যশস্য হিসেবে এই ফসলগুলি বেশী ব্যবহার করে । মিলেট শস্য বেশী পরিমানে লক্ষ্য করা যায় মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে ।
এটা ঘটনা — কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রগুলি যেমন দুগ্ধ, পশুপালন, মৎস্য, হাঁস-মুরগি, রেশম চাষ, ইত্যাদি ভারতীয় অর্থনীতির স্তম্ভ ! কৃষি যেমন অর্থনীতির স্তম্ভ তেমনি স্বাস্থ্য হলো সমৃদ্ধ সমাজের এক অপরিহার্য অঙ্গ । স্বাস্থ্য সম্বন্ধে মানুষ কম-বেশী ওয়াকিবহাল । তাই স্বাস্থ্য দেখ-ভালের নিরিখে মিলেট খাদ্য-শস্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রেক্ষাপটে মিলেট দানাশস্যকে বলা চলে অধিক পুষ্টিকর ।
সেই কথা মাথায় রেখে ও মিলেট শস্যের উপকারিতার কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা ২০২৩ সালকে “আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ” হিসেবে ঘোষণা করেছে । সকলের ধারণা, কৃষি ও খাদ্য বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে মিলেট বড় ভূমিকা নিতে পারে । মিলেটের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার অতীতে খুব শোনা যায় । মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর পছন্দ করতেন “লাজিজা” –এক ধরনের মটর মিশ্রিত মিলেটের খিচুড়ি । শোনা যায় এর প্রচলন ছিল গুজরাটে । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে নানান ধরনের মিলেট ভেজানো কিংবা সেদ্ধ করে নেওয়ার পর তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ পাওয়া যায় ।
জীবিকা ও কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এমনকি বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টিগত চাহিদা মেটাতে মিলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাশস্য । তাই শস্যটির চাহিদা ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ঘোষিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ, ২০২৩ । যার জন্য ভারত সরকার জোয়ার, বাজরা, রাগি ইত্যাদি শস্যের ফলন বাড়াতে ও স্বাস্থ্যে এদের উপকারিতা বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে । ইতিমধ্যে এই দানাশস্যে পুষ্টির অনুপাত বেশী থাকার জন্য “পুষ্টিকর দানাশস্য” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । অন্যদিকে সরকারের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক অঙ্গনওয়াড়ি পরিষেবার পরিপুরক পুষ্টি কর্মসূচিতে খাবারের পুষ্টিগত মান বাড়াতে জোয়ার, বাজরার কথা উল্লেখ করেছে । শোনা যায় ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, চন্ডিগড়, ইত্যাদি রাজ্য ও কেন্দ্রিয় শাসিত অঞ্চলে পরিপুরক পুষ্টিতে জোয়ার-বাজরা ঠাঁই পাচ্ছে ।
মিলেট হলো এক ধরনের দানাশস্য যেগুলির বীজ ছোট এবং যেগুলিকে সহজে চাষ করা যায় । এগুলি চাষের জন্য বাইরে থেকে দামী রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি ক্রয় করতে হয় না । মিলেট পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং এগুলি খাদ্য ও জীবিকার নিরাপত্তা বজায় রাখে । মিলেট চাষের দু-রকমের উপযোগিতা রয়েছে । মিলেট চাষ করলে মানুষের জন্য খাদ্যশস্য এবং সেইসঙ্গে গবাদি পশুর জন্য খড়ও পাওয়া যায় । আবার কিছু অঞ্চলে মিলেটই মানুষের প্রধান খাদ্য । মিলেটের ফসল – বৈচিত্র ও চাষব্যবস্থা সেই ফসলগুলির বাস্তুতন্ত্রের কৃষিবৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করে । কেদো মিলেটও অত্যন্ত পুষ্টিকর । এর মধ্যে গ্লুটেন নেই, এটা সহজপাচ্য, সেইসঙ্গে এটি ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এবং ডায়েটারি ফাইবার সমৃদ্ধ । পোলাও, খিচুড়ি, উপমা, পরোটা, দোসা ও চাপাটি তৈরীতে শস্য হিসাবে মিলেট ব্যবহার করা যায় । মিলেট থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরী করা যায় যেমন মাল্টিগ্রেন পাস্তা, মাল্টিগ্রেন সুইট মিক্স, মাফিন, পুষ্টিকর মিলেট আটা, রাগি ফ্লেক্স, রাগি পাপড়, পাউরুটি, কুকিজ, রাগি স্নাক্স, ফ্লেকড জোয়ার, মিলেটের আটা, ইত্যাদি ।
( ২ )
এবার আসছি মিলেট শস্য মানুষের কী উপকারে আসতে পারে । প্রথমত এটি একটি বিকল্প প্রধান খাদ্য হয়ে উঠতে পারে । মিলেটে কার্বোহাইড্রেট-ফাইবার অনুপাত কম থাকার কারণে, জীবনযাত্রাগত বিভিন্ন রোগের মোকাবিলায় এটা কাজে আসে । মিলেট হলো “পুষ্টির পরিপূরক” যাতে রয়েছে ফাইটোকেমিক্যাল এবং অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট, যা সুস্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার চিকিৎসায় বিশেষ কার্যকর । গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্য তথা পুষ্টির উপর মিলেটভিত্তিক খাদ্যের একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে । গর্ভবতী মহিলাদের খাদ্যতালিকায় পরিপূরক খাদ্য হিসাবে মিলেট-ভিত্তিক খাদ্যকে যাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেই দিকে ধ্যান দেওয়া সময়োপযোগী । কারণ গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মায়েদের জন্য মিলেটভিত্তিক পরিপূরক খাদ্যদ্রব্যগুলি খুবই পুষ্টিকর । আমরা জানি, খাদ্য-তালিকায় ফাইবার থাকা বিশেষ প্রয়োজন । এই ফাইবার গ্লোকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । মিলেট, লিউসিনের একটি চমৎকার উৎস, এটা ধীরে ধীরে কার্বোহাড্রেট (এবং খনিজ পদার্থ) হজম করায়, যা পোস্ট-প্রান্ডিয়াল গ্লুকোজের মাত্রার আকস্মিক বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে । ফলে এটি ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য একটি পুষ্টিকর খাবার । চাল ও গমের মতো অধিক পরিচিত খাদ্যশস্যের তুলনায় মিলেটে অধিক পুষ্টিকর খাদ্যগুণ রয়েছে । মিলেট ক্যালশিয়াম, আয়রন এবং ফাইবারে ভরপুর যা একটি শিশুর বেড়ে উঠতে সাহায্য করে । আশার কথা, ছোটদের খাবারে মিলেটের ব্যবহারও ক্রমশ বাড়ছে ।
জোয়ার-বাজরা পুষ্টির এক ভাঁড়ার বলে সুবিদিত । দেশে অপুষ্টিকর সমস্যা ঘোচানোর জন্য ইদানীং জোয়ার-বাজরা খাওয়ার প্রচলনের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে । এটা ঘটনা, আজকালকার মানুষ বেশি স্বাস্থ্য সচেতন । যার জন্য পুষ্টিকর জোয়ার-বাজরার ব্যবহার ক্রমবর্ধমান । এককালে “গরীব মানুষের খাদ্যশস্য” বলে পরিচিত জোয়ার-বাজরার দাম ছিল খুব কম । তা ছাড়া চাল, ডাল, গম উৎপাদনে অধিক গুরুত্ব আরোপ হওয়ায় দানাশস্যের উৎপাদনও কম ছিল । কিন্তু বর্তমানে দানাশস্যের ব্যবহারও ক্রমশ বাড়ছে । চাহিদাও ঊর্ধ্বমুখি । তামিলনাড়ুতে দানাশস্য ব্যবহার করে তৈরী হচ্ছে দোসা, পোঙ্গল, রাভা দোসা, প্রভূতি । সাধারণত চাল থেকে দোসা তৈরী হয় । তবে দানাশস্য চাল ও গমের চেয়ে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন । রুটি পরোটার ক্ষেত্রে আটা বা ময়দার বদলে মিলেটের পরোটা অনেক পুষ্টিকর । মিলেটের খাওয়ায় অনেক উপকার । মিলেটে প্রচুর ফাইবার থাকায় এটা ডায়াবিটিকদের জন্য ভীষণ উপকারী । এতে প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিওক্সিডেন্টস রয়েছে । তাই এটাও কিন্তু ক্যানসারের মতো মারণ রোগ প্রতিরোধ করতে পারে ।
( ৩ )
বাংলাদেশেও মিলেটের চাষ দেখা যায় । বাংলাদেশের জীবনধারায় খাদ্য হিসেবে মিলেটের ব্যবহার নাকি খুব প্রাচীন কাল থেকে । সেই দেশের মানুষের খাদ্যাভাস বা নানান প্রথার সঙ্গে এই দানাশস্যের অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়েছে । তবে সেই দেশে ধান, গম ও ভুট্টার পরে চার নম্বরে স্থান দেওয়া হয়েছে মিলেট চাষকে । বাংলাদেশে মিলেটকে জোয়ার, বাজরা ছাড়াও চিনা বা কাউন বলে । মিলেটকে বাংলাদেশে জোয়ার বা সরগাম (Jower or Sorghum) , যব (Oat), চিনা (Proso millet), কাউন (Foxtail millet), ইত্যাদি নামে মানুষে জানে । বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সরগামের অপর নাম জোয়ার জানে । শুষ্ক এলাকার জন্য মানুষ ও পশুপাখির খাদ্য হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ । চিনা সাধারণত গরুর ঘাসের জন্য ব্যবহৃত হয় । যদিও বাংলাদেশের চিনার চাষ প্রাচীন কাল থেকে । বিশেষ করে পাবনা, টাঙাইল, জামালপুর, ফরিদপুর, জেলায় বেশী চাষ হয় । কাউন চাষ তুলনামূলক কম । কাউনের জাউ বা খিচুড়ি খুব জনপ্রিয় । তা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে চাউনের ভাতও খেতে দেখা যায় ।
সবশেষে যেটা আমাদের জীবনধারা ও খাদ্যাভাস নিয়ে ভাববার বিষয়, সেটা হচ্ছে প্রয়োজনে জীবনধারা ও খাদ্যাভাস পর্যালোচনা করে তার পরিমার্জন করাটাও স্বাস্থ্যের নিরিখে অত্যন্ত জরুরি, বলা চলে সময়োপযোগী । সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে সক্ষম, পুষ্টিগুণসম্পন্ন, জল সাশ্রয়ী এই ফসলকে আরও উৎপাদনমুখি করে তুলতে উদ্যোগী হওয়া বাঞ্ছনীয় । যাতে মানুষ এই দানাশস্যের পুষ্টির সুফল অধিকমাত্রায় পেতে পারে । আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষকে মাথায় রেখে দেশের সুশীল নাগরিক সমাজ জোয়ার-বাজরা-রাগি ইত্যাদি শস্যের প্রতি নজর দিলে দানাশস্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে আবার ঘরে ঘরে মানুষের পাতে ফিরে আসবে । (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত ও যোজনা-০১/২০২৩)
———০———–
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক (ভারত)

Share This
Categories
প্রবন্ধ

মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী উৎপল দত্ত চিরকাল শােষিত বঞ্চিত মানুষের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেছেন তার নাটক ও নাট্য প্রযােজনার মধ্য দিয়ে!

ভূমিকা—-

উৎপল দত্ত একজন ভারতীয় অভিনেতা, পরিচালক এবং লেখক-নাট্যকার ছিলেন।  তিনি মূলত বাংলা থিয়েটারের একজন অভিনেতা ছিলেন, যেখানে তিনি আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারে একজন অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন, যখন তিনি ১৯৪৯ সালে “লিটল থিয়েটার গ্রুপ” প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলটি অনেক ইংরেজি, শেক্সপিয়র এবং ব্রেখ্টের নাটক রচনা করেছিল, যা বর্তমানে থিয়েটার নামে পরিচিত।  “এপিক থিয়েটার” সময়কাল, এটি অত্যন্ত রাজনৈতিক এবং উগ্র থিয়েটারে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করার আগে।  তাঁর নাটকগুলি তাঁর মার্কসবাদী মতাদর্শের প্রকাশের জন্য একটি উপযুক্ত বাহন হয়ে ওঠে, যা কল্লোল (১৯৬৫), মানুষের অধিকার, লৌহা মনোব (১৯৬৪), টিনার টোলোয়ার এবং মহা-বিদ্রোহার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক নাটকগুলিতে দৃশ্যমান।  এছাড়াও তিনি ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে ১০০ টিরও বেশি বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং মৃণাল সেনের ভুবন শোম (১৯৬৯), সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক (১৯৯১),  চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সর্বাধিক পরিচিত।   এবং হৃষিকেশ মুখার্জির হিন্দি কমেডি যেমন গোল মাল (১৯৭৯) এবং রং বিরাঙ্গি (১৯৮৩)।  তিনি তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে ১৯৯৩ সালে দূরদর্শনে ব্যোমকেশ বক্সীর (টিভি সিরিজ) সীমান্ত হীরার পর্বে একজন ভাস্কর স্যার দিগিন্দ্র নারায়ণের ভূমিকাও করেছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং তিনটি ফিল্মফেয়ার সেরা কমেডিয়ান পুরস্কার পান।  ১৯৯০ সালে, ভারতের ন্যাশনাল একাডেমি অফ মিউজিক, ড্যান্স অ্যান্ড থিয়েটার সঙ্গীত নাটক আকাদেমি তাকে তার সর্বোচ্চ পুরস্কার, থিয়েটারে আজীবন অবদানের জন্য সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ প্রদান করে।

 

প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা—-

 

উৎপল দত্ত বাংলা গণনাট্য আন্দোলনের সময়ে বিশিষ্ট অভিনেতা এবং নাট্যকার। উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর পিতা গিরিজারঞ্জন দত্ত।  তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন।

 

ব্যক্তিগত জীবন–

 

১৯৬০ সালে, দত্ত থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শোভা সেনকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র মেয়ে, বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড অ্যাসথেটিক্স, নয়া দিল্লিতে থিয়েটার এবং পারফরম্যান্স স্টাডিজের একজন অধ্যাপক।

 

কর্মজীবন—

 

গণনাট্য আন্দোলন ছিল মূলত রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন, মার্ক্সবাদ থেকে প্রণীত এক ধারা যেখানে মঞ্চ হয়ে ওঠে প্রতিবাদের মাধ্যম তিনি মঞ্চের কারিগর ,বাংলা মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তিনি শেক্সপিয়ার আন্তর্জাতিক থিয়েটার কোম্পানির সাথে ভ্রমণ করেছেন বেশ কয়েকবার। তাকে গ্রূপ থিয়েটার অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসাবে গন্য করা হয়। কৌতুক অভিনেতা হিসাবেও তার খ্যাতি রয়েছে।

তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র গুড্ডি, গোলমাল, শওকিন ও রং বিরঙ্গিতে (১৯৮৩) -তে অভিনয় করেছেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। মননশীল ছবি ছাড়াও অজস্র বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী। উৎপল দত্তের বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে টিনের তলোয়ার, মানুষের অধিকার ইত্যাদি। তার নাটক গুলি কে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। পূর্ণাঙ্গ নাটক, পথ নাটিকা, যাত্রাপালা।

 

উৎপল দত্ত রচিত নাটকের তালিকা—

 

বাংলা রাজনৈতিক নাটকের ইতিহাস সুপ্রাচীন। নীলদর্পণ থেকেই এই রাজনৈতিক নাটকের সূচনা। কিন্তু উৎপল দত্তকে বলতে হয় অবিমিশ্র রাজনৈতিক নাট্যকার। তাঁর সমস্ত নাটকের মধ্যেই থাকে সচেতন উদ্দেশ্য। পূর্ণাঙ্গ, একাঙ্ক, পথনাটক ইত্যাদি মিলে উৎপল দত্তের নাটকের সংখ্যা প্রায় সন্তরটি। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও নাটকগুলি বিচিত্র, কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বত্রই সেখানে অতন্দ্র থেকেছে। মৌলিক এই নাটকগুলি ছাড়াও আছে অসংখ্য অনুবাদ নাটক। আরাে উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে উৎপল দত্ত কখনও শিল্পসৃষ্টির অজুহাতে বা শাসক শক্তির কোপদৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনাে অস্পষ্টতা বা অবরণের আশ্রয় নেন নি। তার বক্তব্য স্পষ্ট, সুবােধ্য এবং অকুতােভয়।

 

লাল দূর্গ, বণিকের মাণদন্ড,  এংকোর (অনুবাদ গল্প), দিল্লী চলো, ছায়ানট(১৯৫৮), অঙ্গার(১৯৫৯), ফেরারী ফৌজ(১৯৬১), ঘুম নেই (১৯৬১), মে দিবস (১৯৬১), দ্বীপ (১৯৬১), স্পেশাল ট্রেন (১৯৬১), নীলকন্ঠ(১৯৬১), ভি.আই.পি (১৯৬২), মেঘ (১৯৬৩), রাতের অতিথি (১৯৬৩), সমাজতান্ত্রিক চাল (১৯৬৫), কল্লোল(১৯৬৫), হিম্মৎবাই (১৯৬৬), রাইফেল (১৯৬৮), মানুষের অধিকার (১৯৬৮), জালিয়ানওয়ালাবাগ (১৯৬৯), মাও-সে-তুং (১৯৭১), পালা-সন্ন্যাসীর তরবারি (১৯৭২), বৈশাখী মেঘ (১৯৭৩), দুঃস্বপ্নের নগরী(১৯৭৪), এবার রাজার পালা, স্তালিন-১৯৩৪, তিতুমির, বাংলা ছাড়ো, দাঁড়াও পথিকবর, কৃপান, শৃঙ্খলছাড়া, মীরকাসিম, মহাচীনের পথে, আজকের শাজাহান, অগ্নিশয্যা, দৈনিক বাজার পত্রিকা, নীল সাদা লাল, একলা চলো রে, ক্রুশবিদ্ধ কুবা, নীলরক্ত, লৌহমানব, যুদ্ধং দেহি, লেনিনের ডাক, চাঁদির কৌটো, রক্তাক্ত ইন্দোনেশিয়া, মৃত্যুর অতীত, ঠিকানা, টিনের তলোয়ার, ব্যারিকেড, মহাবিদ্রোহ, মুক্তিদীক্ষা, সূর্যশিকার, কাকদ্বীপের এক মা, ইতিহাসের কাঠগড়ায়, কঙ্গোর কারাগারে, সভ্যনামিক, নয়াজমানা, লেনিন কোথায়, সীমান্ত, পুরুষোত্তম, শৃঙ্খল ঝঙ্কার, জনতার আফিম, পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস, মধুচক্র, প্রফেসর মামালক, শোনরে মালিক, সমাধান, অজেয় ভিয়েতনাম, তীর।

 

পুরষ্কার এবং স্বীকৃতি—-

 

থিয়েটারে আজীবন অবদানের জন্য ১৯৯০ সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ

শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – জিতেছেন
১৯৭০ ভুবন শোম – ভুবন শোম

ফিল্মফেয়ার সেরা কমেডিয়ান পুরস্কার – জিতেছে
১৯৮০ গোল মাল – ভবানী শঙ্কর
১৯৮২ নরম গরম – ভবানী শঙ্কর
১৯৮৪ রং বিরঙ্গি – পুলিশ ইন্সপেক্টর ধুরন্ধর ভাতাওদেকর

বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড: সেরা অভিনেতার পুরস্কার- জিতেছেন
১৯৯৩ আগন্তুক – মনোমোহন মিত্র

ফিল্মফেয়ার সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার – মনোনীত৷
১৯৭৫ অমানুষ – মহিম ঘোষাল
১৯৮০ গোল মাল – ভবানী শঙ্কর
১৯৮৬ সাহেব – বদ্রী প্রসাদ শর্মা

 

 

মৃত্যু—–

 

১৯৯৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া।।

 

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

ফাগুরঙ্গে মাতল নাগর-নাগরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীশ্যামনাগর আজ নাগরিমণি শ্রীরাধাকে নিয়ে হোরীরঙ্গে মেতেছেন। ব্রজগোপিনীরা সে রঙ্গলীলায় অনুঘটক । রাধারমণ রমণীমনচোরা রাসবিহারী নওলকিশোর কানু, ফাগুয়া অঙ্গে মেখে ও মাখাতে মহানায়ক হয়েছেন । ব্রজসুন্দরীগণ তাঁকে মন্ডলী-মন্ডলী করে চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছেন আর মধ্যখানে মনমোহনিয়া মুরলীমনোহর আজ সেই ব্রজরামাদের মনোভাব বুঝে ভরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের ঘনপরিরম্ভনে,চুম্বনে, সোহাগের পরশে-হরষে।

নটন বিভঙ্গে ফাগুরঙ্গে মাতল
নাগর অভিনব নাগরি সঙ্গ।
ঋতুপতি রীত চীত উমতায়ল
হেরি নবীন বৃন্দাবন রঙ্গ ৷৷
ফাগুয়া খেলত নওল কিশোর।
রাধারমণ রমণীমনচোর ।। ধ্রু॥
সুন্দরিবৃন্দ- করে কর মণ্ডিত
মণ্ডলি মণ্ডলি মাঝহি মাঝ ৷
নাচত নারিগণ ঘনপরিরম্ভণ
চুম্বন লুবধল নটবর রাজ॥
কানুপরশ রসে অবশ রমণিগণ
অঙ্গে অঙ্গে মিলি ঝাঁপি রহু।
পূরল সবহুঁ মনোরথ মনোভব
মোহন গোবিন্দদাসিয়া পহু।।

ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হোরীলীলা বা হোলিখেলা আদপে প্রেম প্রদানের উৎসব। প্রেমের বৈচিত্র্যময় ভাবের মূর্তিমন্ত রূপই হল যেন নানান রঙের আবীর আর ফাগ। মুঠো মুঠো ফাগ ছুঁড়ে ,রঙ মাখিয়ে যেন সেই প্রেমকেই নতুন করে নিবেদন করা মনের মানুষটিকে,কাছের জনকে । প্রাণ ভরে সারাদিন অক্লান্ত হোরি খেলে খানিক জিরিয়ে নিতে দোলনায় বসে দোল খান শ্রীরাধাকৃষ্ণ। তাই ,এ উৎসবের আর এক নাম দোলযাত্রা ,একথা মনে হলেও ,আদপে সেটি নয় । দোলযাত্রার ইতিহাস আরও হাজার হাজার বৎসর পূর্বে—সেই ঋকবেদের সময়কালের, অর্থাৎ সাত-আট হাজার বৎসর পূর্বের।

উত্তরায়ণের আগমনে নতুন বছরের সূচনা রূপে আর্য ঋষিরা এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বিষ্ণুর পূজা করতেন। পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চারকারী সূর্যকে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুরই প্রতিভূ মেনে তাঁরা সে পূজায় নারায়ণ শিলাকে উত্তর দক্ষিণে তিনবার ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোল দিতেন,যাতে আগামী বৎসরেও সূর্যের যাত্রা নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নকে মাধ্যম করে। আর তাই নাম দোলযাত্রা।

সাত-আট হাজার পূর্বের দোলোৎসব পূজাই পরবর্তীতে হয় হোলি বা হোরীলীলা । দোলযাত্রা হল বছরে একটি নয় দুটি— একটি দোল পূর্ণিমায় অপরটি শ্রাবণী পূর্ণিমায় হিন্দোলযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। দোল অর্থাৎ দোলন আর যাত্রা অর্থে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গমন । অতএব, দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা। যেমন রথযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। একটা কথা মনে দোলা দিতে পারে যে দেবী দুর্গাও তো যাত্রা করেন পতিগৃহ থেকে পিতারগৃহে কিছুদিনের জন্য । তবে কেন আমরা দুর্গাযাত্রা বলি না। আসলে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালির উৎসব এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে তা দুর্গোৎসব নামেই যথার্থতা পায়। আর, তাছাড়া যাত্রা শব্দটি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর গমনের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে। ফিরে আসি দোলযাত্রার কথায়,ব্রজের হোলিতে।

এই প্রেমের উৎসবের আগমণী সুর কিন্তু ফুলেরা দুজের দিনই ধ্বনিত হয়ে যায় বৃন্দাবন আর মথুরায় । ‘ফুলেরা দুজ’ হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা-মঞ্চের তথা দোলনা প্রস্তুতির সূচনা দিবস ;যা ফাল্গুনের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে পালিত হয়। এদিন ফুলের নয়নাভিরাম সাজে সজ্জিত হন বিগ্রহগণ। মন্দিরচত্বর থেকে শুরু করে সর্বত্র ফুলের সজ্জা।মন্দিরে-মন্দিরে ,গৃহে-গৃহে হোলির গীত,নৃত্য ,নাটকের অপূর্ব উপস্থাপনা শুরু হয়ে যায় এদিন থেকেই। এরপর চতুর্থীর দিন পালিত হয় লাড্ডু হোলি‌।

মথুরার রাভেলের ভূস্বামী তথা রাধারাণীর পিতা ‘বৃষভানু’ কংসের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের মাথায় সুউচ্চ স্থানে প্রাসাদ গড়লেন । নতুন জনপদ ‘বৃষভানুপুর’(এরই অপভ্রংশ বর্ষাণা)-এর পত্তন হল।সেসময় কংসের নানান অত্যাচারে একইভাবে অতিষ্ঠ নন্দগ্রামবাসীরাও।রাজা বৃষভানু আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বন্ধু নন্দরাজা তথা শ্রীকৃষ্ণের পিতাকে; বললেন, নন্দগ্রামবাসীসমেত বৃষভানুপুরে এসে বাস করতে ।এই বসন্ত চতুর্থীর দিনেই নাকি গোপীগণের চিত্তহারী-চপল-চটুল- নওলকিশোর নন্দকুমার কৃষ্ণ তাঁর গ্রাম নন্দগাঁও থেকে রাধারাণীর গ্রাম বর্ষাণায় এসেছিলেন ।তখন তাঁদের আতিথেয়তা করা হয়েছিল লাড্ডু খাইয়ে।আর তাই,সেদিনের সেই আনন্দ দিবসের স্মরণে আজও বর্ষাণায় লাড্ডু তো খাওয়া হয়ই,তার সাথে চলতে থাকে একে অপরকে লক্ষ্য করে লাড্ডু ছোঁড়াছুঁড়ির পালা;যা লাড্ডু হোলিতে পর্যবসিত হয়। সত্যি,এহেন মিষ্টিমধুর আনন্দময় উৎসব ভারতভূমিতেই বুঝিবা সম্ভব।

ঠিক পরদিন, বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে বর্ষাণায় পালিত হয় লাঠমার হোলি , অর্থাৎ লাঠি দিয়ে মারের হোলি। পড়তে অদ্ভুত লাগছে তাই না! যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে পুরুষরা কোন বিশেষ কার্যে গ্রামে নেই, আর হঠাৎ,কংসের অত্যাচারী দুষ্টু পেয়াদারা এল বর্ষাণায়। তখন মহিলারা আত্মরক্ষা করবেন কীভাবে(!) –তার মহড়া শুরু হল সেখানে। গোপিনীরা লাঠি দিয়ে মেরে শক্তি প্রদর্শন করলেন ,আর মার খেলেন মাথায় বালির বস্তা ,হাতে ঢাল নিয়ে গোপেরা dummy সেজে। মহিলাদের সেই লাঠিখেলা আজও অব্যাহত হয়ে পালিত হয় এই লাঠমার হোলির দিন।তবে তাতে লেগেছে উৎসবের আবেশ,আমেজ আর আনন্দ। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সখারা জোর করে রঙ মাখিয়েছিলেন শ্রীরাধাসহ তাঁর সখীদের। ছদ্ম প্রণয়কোপ প্রকাশ করতে প্রফুল্লিত গোপিনীরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন লাঠি। সেই স্মৃতিতেই তো আজও নন্দগ্রাম থেকে পুরুষরা রঙ মাখাতে আসেন বর্ষাণার মহিলাদের। আর মহিলারা লাঠমার দেন মাথায় ছোট বস্তা বাঁধা,মাটির ঢাল হাতে সজ্জিত পুরুষদের। লাঠির ঘায়ে একজনের ঢাল ভেঙ্গে গেলে,অপরেরটা কেড়ে আত্মরক্ষা করে সে। এভাবে চরম হাসাহাসি,আনন্দ,উৎফুল্লতার মধ্য দিয়ে এই হোলি পালিত হয়।

তারপর ,মূল হোলির উৎসব আগত হয় ; বসন্ত পূর্ণিমার শেষলগ্নের দিন তা পালিত হয়। তবে তার আগের দিন পালিত হয় হোলিকাদহনোৎসব । দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র বালক প্রহ্লাদ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। অনেক প্রকার চেষ্টা করেও , অনেক শিক্ষা দিয়েও যখন প্রহ্লাদের মতিগতির পরিবর্তন করা গেল না , তখন ক্ষুব্ধ হিরণ্যকশিপু স্থির করলেন দুষ্ট গোরুর থেকে শূণ্য গোয়াল ভালো— অর্থাৎ, প্রহ্লাদকে প্রাণে নিধন করবেন। কিন্তু প্রাণে মারার নানান রকম প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল । হতাশ হিরণ্যকশিপুকে দেখে শেষে ভগ্নী হোলিকা বলে বসলেন তিনি এবার হাল ধরবেন‌ । হোলিকা বরপ্রাপ্তা ছিলেন যে তাঁর অঙ্গকে অগ্নি স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি তাই প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে অগ্নিসংযোগ করিয়ে দিতে বললেন তাঁকে চতুর্দিক থেকে। জ্বলন্ত অগ্নির দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠা গ্রাসে ফল হল বিপরীত। দুষ্ট অভিসন্ধি নিয়ে স্বেচ্ছায় অঙ্গে অগ্নিসংযোগ করায় , প্রাপ্ত বর কাজে লাগলো না । হোলিকা জ্বলেপুড়ে ভস্মীভূত হল আর বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কোন ক্ষতি হল না। কথায় আছে রাখে হরি মারে কে ! আসুরী শক্তির , অশুভ উল্লাসের পরাজয় যে সর্বদা হয়— তা স্মরণ করতে ও করাতে এবং আর্য ঋষিদের দ্বারা কৃত উত্তরায়ণের নব বৎসরের দোলযাত্রা উৎসবের আগের দিন পুরাতন আবর্জনা পুড়িয়ে পরিবেশ পরিষ্কার করার ও আগত নব বৎসরের আনন্দের দ্যোতক রূপে পালিত হয় এই হোলিকাদহন উৎসব । প্রচলিত নাম চাঁচর । চাঁচর শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার চর্চরী শব্দ থেকে। অর্থ— উৎসবের হর্ষধ্বনি। খড়, বাঁশ, শরপাতা, পুরানো গাছের ডাল, তালপাতা , নারকেল পাতা—- এসব দিয়ে তৈরী করা হয় ঘরের মত করে স্তূপ। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সেই স্তূপে অগ্নিসংযোগ করে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে হোলিকাদহনোৎসব পালন । এর অপর একটি প্রচলিত নামও আছে —-মেড়াপোড়া । আসুরী শক্তির প্রতীকী রূপে পিটুলি দিয়ে তৈরি একটি ভেড়াকে (যার নাম মেন্ডাসুর) ওই খড়ের ঘরের মধ্যে রেখে দেওয়া হতো। এই অসুর মেন্ডাকে পোড়ানো থেকেই হয় মেড়াপোড়া, যা আরও অপভ্রংশ হয়ে হয় নেড়াপোড়া। মনে পড়ছে , নেড়াপোড়ার সময় আমাদের বাংলায় প্রচলিত এক ছড়া—-আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল , পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল। উল্লেখ্য যে, সম্ভবতঃ হোলিকার নাম থেকেই হোলি উৎসব হয়েছে।

কথিত আছে, নব-নীরদ-বরণ শ্রীকৃষ্ণকে সান্ত্বনা দিতে মা যশোদা তাঁর হাতে রঙ দিয়ে বলেছিলেন, গৌরবর্ণা রাধার গাত্রে লেপন করে তাঁকে নিজের মত এক বর্ণের করে নিতে। সবান্ধব শ্রীকৃষ্ণ লুকিয়ে ছুঁড়লেন রঙ রাধা ও তাঁর সখীদের লক্ষ্য করে। গোপিনীরাই বা দমবেন কেন! তাঁরাও কলসে কাদামাটি গুলে তৎক্ষণাৎ দিলেন ঢেলে কানু আর তার গোপসখাদের মাথায়। ব্যস,মাখামাখি ,হাতাহাতি আনলো হাস্য-পরিহাস আনন্দের বন্যা। সেই থেকে রঙ দেওয়া-নেওয়া খেলার শুরু হয়ে গেল।
ফাগু খেলিতে ফাগু উঠিল গগনে।
বৃন্দাবনের তরুলতা রাতুল বরণে ।।
আবীর ,রঙ,ফাগের স্নানে সমগ্র বৃন্দাবন রেঙে ওঠে । রঙ তো নয় ,যেন হাতভর্তি মুঠো মুঠো ভালোবাসা অর্পিত হয় একে অপরের প্রতি। বর্ণবিদ্বেষকে যেন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেবার দ্যোতক এই দোল উৎসব। মানবের মহামিলনের ,মহানন্দের হাট বসে যেন। আবার ,এই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতেই তো শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ তথা মধ্যযুগের বাঙলার নবজাগরণের নায়ক শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মহাবির্ভাব মর্ত্য মাঝে। সে দিন ছিল ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ,শনিবার সন্ধ্যাবেলা।

কৈছন মধুরিমা, কৈছন রাধাপ্রেম, কৈছন প্রেমে তিঁহ ভোর——অর্থাৎ, রাধার প্রেমের মাধুর্য কেমন, রাধার প্রেমই বা কেমন আর সেই প্রেম আস্বাদন করে রাধা কী জাতীয় সুখ আস্বাদন করেন— এই তিন বাসনা পূরণ করতে তথা জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে শ্রীরাধার ‘ভাব’ কে নিজের হৃদয়ে ধরে , শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি অঙ্গে মেখে শ্রীশ্যামসুন্দর আবির্ভূত হলেন অবনী মাঝে শ্রীগৌরাঙ্গ হয়ে। দোল পূর্ণিমা এবার নবনামে আরো বেশী উজ্জ্বল ও ভাস্বর হল । আরও মহিমাময় হল। গৌরচন্দ্রের গৌরববোজ্জ্বল উদয় হয়েছে যে এই তিথিতে ! তাইতো ‘গৌরপূর্ণিমা’ হল। আহা , কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে -চারিপার্শ্বে ! বসন্ত রাগে শ্রীল নরহরি চক্রবর্তীপাদ গেয়ে উঠলেন তাঁর শ্রীভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে—-
জয় জয় জয় মঙ্গলরব ফাল্গুন পূর্ণিমা ফাল্গুন নিশি নবশোভিত
শচী-গর্ভে প্রকট গৌর বরজ (ব্রজ) রঞ্জনা
ঝলকতবর কনক তনু, কুঙ্কুম থির দামিনী ভানু,
চমকত মুখচন্দ মধুর ধৈরজভর ভঞ্জনা…
গায়ত কিন্নর সুধঙ্গ, বায়ত মৃদুতর মৃদঙ্গ
ধা ধি ধি ধিকিতা ধিক্ ধিক্ ধিক্কট তক ধিন্নানা।

তাই, সব মিলিয়ে ফাল্গুনী পূর্ণিমা এক বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ মধুময় তিথি ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই ঋক্ বেদের সময়কাল থেকে।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

কল্যাণীর সতীমার দোল মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

যতদূর জানা যায়, আনুমানিক দুশো বছর আগে আউলিয়া সম্প্রদায়ের সতীমা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী এই মেলার প্রবর্তন করেন । এপার বাংলা- ওপার বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষপাড়ার সতীমার দোল মেলা । খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষদয়ের নিয়ে গড়ে ওঠে আউলচাঁদ সমাজ । এই সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিলেন আউলচাঁদ । তাঁর মৃত্যুর পর আউল সমাজের কর্তাপদ লাভ করেন রামশরণ পাল । তাঁরই স্ত্রী ছিলেন সরস্বতী দেবী যিনি পরবর্তীকালে সতী মা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন ।
বাউল, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লীগীতির সুরে মেলা জমে ওঠে । আখড়ায় আখড়ায় সারা রাত ধরে বসে গানের আসর । শ্রোতারা অধিকাংশই গ্রাম ও মফঃস্বলের । বিভিন্ন জায়গায় তৈরী হয় লালন মঞ্চ । গানের পাশাপাশি বিশাল উনুন জ্বালিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হয় ঐ আখড়াগুলিতে । দূরদূরান্তের যাত্রীদের আশ্র্যস্থল এই আখড়াগুলি ।


এবার আসছি কর্তাভজা সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদ থেকে বিকশিত একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় । এই সম্প্রদায়ের মূল গুরু আউল চাঁদ ।
প্রথমেই বলি, আউল চাঁদ হলেন একজন বাঙালি ধর্ম প্রচারক ও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু । কিংবদন্তি বা লোকবিশ্বাস যে, গোরাচাঁদ অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যদেব আউল চাঁদ রূপে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন । গৃহী মানুষকে বৈরাগ্য ধর্ম শেখাতে শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হন আউল চাঁদ ফকির হয়ে । এখানে তাই কোনো জাতিভেদ নেই ।
আউল চাঁদের জন্ম খ্রিষ্টাব্দ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে । শোনা যায়, তিনি হিন্দু না মুসলমান সেটা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি । তবে প্রচলিত লোক কাহিনী অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার উলা গ্রামের ( অনেকের মতে, নদীয়া জেলার প্রাচীন জনপদ উলা বীরনগর ) পান ক্ষেত থেকে একটি নবজাতক শিশু পাওয়া যায় । ক্ষেতের মালিক মহাদের বারুই ভগবানের আশীর্বাদ ভেবে তাঁকে লালন-পালন শুরু করেন । বড় হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন । আউল চাঁদের পুরানো নাম পূর্ণচন্দ্র । সংস্কৃত ভাষা শেখানোর জন্য তাঁকে পাঠানো হয় সে সময়কার বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য হরিহরের কাছে । বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং নানাভাবে শিক্ষালাভ করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধিলাভ করেন । তাঁর নতুন নাম হয় ফকিরচাঁদ বা আউল চাঁদ । বহু দেশ ঘোরার পর নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় রামশরণ পাল নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি তাঁকে আশ্রয় দেন । আউল চাঁদের ২২জন শিষ্যের মধ্যে অন্যতম শিষ্য রামশরণ পাল । ২২জনের মধ্যে রামশরণ পাল আউল চাঁদের মৃত্যর পর গুরুপদ প্রাপ্ত হন । যারজন্য তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্তাভজা ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান, যা পরবর্তী সময়ে সতী মায়ের মন্দির নামে সবার কাছে পরিচিত । রামশরণ পালের স্ত্রীর নাম সরস্বতী, যার নামেই এই মন্দির—-সতী মায়ের মন্দির । কথিত আছে, সরস্বতীর প্রথম অক্ষর “স” আর শেষ অক্ষর “তী” অনুসারে সতী । আউল চাঁদের শিষ্য রামশরণ পাল গুরুর ভাবাদর্শকে ভিত্তি করে কর্তাভজা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন । এইজন্য ভক্তের নিকট তিনি “কর্তা” এবং তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী “কর্তামা” নামে অভিহিত । রামশরণ পালের পর সরস্বতী দেবী এই সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেন । রামশরণ পালের স্ত্রী কর্তাভজা সম্প্রদায়কে দিশা দেখান । রামশরণের স্ত্রী সরস্বতী দেবী ছিলেন অতীব ধর্মপরায়ণা । শোনা যায়, আউল চাঁদ হিম সাগরের জল ও ডালিম গাছের তলার মাটির সাহয্যে সরস্বতী দেবীকে অলৌকিক উপায়ে মৃত্যের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন । আরও শোনা যায়, আউল চাঁদই রামশরণ পাল ও সরস্বতী দেবীর সন্তান হয়ে পরবর্তীতে জন্ম নেন দুলাল চাঁদ নামে । দুলাল চাঁদ (১৭৭৬-১৮৩৩) কর্তাভজা সম্প্রদায়কে সাংগঠনিক রূপ দেন । তিনি বহু পদ রচনা করে কর্তাভজা ধর্মমতকে একটা তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত করেন । পদগুলি ভাব-গীত-রূপে ভক্তদের নিকট সমাদৃত । কর্তাভজারা কোনো জাতিভেদ মানেন না । তাঁরা লোভ-মোহ-কাম-ক্রোধকে নৈতিক পাপ বলে মনে করেন । সৎ পথে থেকে এবং মিথ্যা কথা পরিহার করে নৈতিকভাবে ধর্মকর্ম করা তাঁদের প্রধান লক্ষ্য । তাঁর সময়ে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত গড়ায় । মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় । এরপর তাঁর মা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী কর্তা মা বা সতীমা নামে খ্যাতিলাভ করেন ।
নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ার রামশরণ পালের আদি ভিটেটুকু ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র । ভিটের পাশেই ডালিম গাছ । এই গাছের নীচেই যেহেতু সতীমা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেই হেতু ভক্তরা ডালিম গাছের ডালে ঢিল বেঁধে মানত করেন । বাতাসা, কদমা, চিড়ে, মুড়কি দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তদের সতীমাকে পুজো দেওয়ার রীতি ।


জনশ্রুতি, শেষ বয়সে সরস্বতী দেবী সন্তানহারা হলে দোলপূর্ণিমার দিন গুরু পুজার আয়োজন করেন । সেই থেকে দোল পূর্ণিমার সূচনা । হাজার হাজার মানুষের সঙ্গেও বাউলেরা আসেন । তাই সতী মায়ের মেলাটা আউল-বাউলের মেলা বা আখড়া নামে পরিচিত ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় মূর্তিপুজা এবং সকল প্রকার আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী । কর্তাভজা প্রচারক দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান, সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান ।“ উক্ত ভাবের গীত থেকে বোঝা যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজনে মানব সেবার প্রসঙ্গটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । এই প্রসঙ্গে ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “মানুষ ভজ, মানুষ চিন্ত, মানুষ কর সার, সকলি মানুষের খেলা মানুষ বই নাই আর” ।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য । এই সম্প্রদায়ে নারী পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না । এই কারণে গুরুদেবের ভূমিকায় নারী পুরুষ উভয়কেই দেখা যায় । একই ভাবে তাঁরা বাউল সম্প্রদায়ের মতো জাতিভেদ প্রথা মানেন না । দুলাল চাঁদের ভাবের গীতে তাই বলা হচ্ছে—- “ভেদ নাই মানুষে মানুষে, খেদ কেন ভাই এদেশে ।”
সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ে । এ বিষয়ে কবি নবীন চন্দ্র সেনের বক্তব্য অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য । তাঁর মতে, “কর্তাভজা সম্প্রদায়ে কোন জাতিভেদ নেই । সকলেই এক রন্ধনশালার পাক গ্রহণ করে । ছোঁয়াছুয়ির দোষ এদের কাছে মুখ্য নয় । মানুষ সেবা তাঁদের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় ।“
কর্তাভজাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গুরুদেবের পুত্র অযোগ্য হলে তাঁরা তাকে গুরু নির্বাচন করতে চান না । তাঁদের নিয়মাবলী নামক ভাবের গীতে এই প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করে বলা হয়েছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিই গুরুদেব হবার অধিকারী । এই জায়গায় কর্তাভজা সম্প্রদায় বর্ণবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন ।
আজও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীমায়ের কৃপা পাওয়ার নিরিখে যথেষ্ট উন্মাদনা । তাঁদের মধ্যে সরল বিশ্বাস ও ভক্তি আজও উজ্জীবিত । যার জন্য দোল পূর্ণিমার দিন সতী মায়ের মেলায় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে । এদেশ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকেও মেলাপ্রাঙ্গনে অনেক মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো । বাউলদের সমারোহ আলাদা মাধুর্যে ভরপুর থাকে ঘোষপাড়ার এই মেলা । (তথ্যঃ সংগৃহীত) ।
—————-০———–
লেখক কথা সাহিত্যিক (ভারত) / +৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া ‘সরোজিনী নায়ডু’।

ভূমিকা—-

“মহাত্মা গান্ধীর “মিকি মাউস” সরোজিনি নাইডুর মৃত্যুদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।”

সরোজিনী নায়ডু (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯ – ২ মার্চ ১৯৪৯) ছিলেন স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি। তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে সরোজিনী নাইডু অনেকবার কারাবরণ করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পিছু হটেননি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি যোগ দেন ডান্ডি পদযাত্রায়। গান্ধী, আব্বাস তয়েব ও কস্তুরবা গান্ধী গ্রেফতার হলে তিনি ধারাসন সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাগ্মী এবং ইংরেজি ভাষার যশস্বী কবি।  তিনি ভারতীয় কোকিল (দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া) নামে পরিচিত। সরোজিনী নায়ডু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম (ভারতীয়) মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীন ভারতে তিনি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজ্যপালও হয়েছিলেন।

 

 

জন্ম ও পরিবার—

 

১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সরোজিনী চট্রোপাধ্যায় ভারতের হায়দরাবাদ শহরের একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি বরদাসুন্দরী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা।  অঘোরনাথ ছিলেন নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি ও তার বন্ধু মোল্লা আব্দুল কায়ুম ছিলেন হায়দরাবাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সদস্য। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে পদচ্যুত করে হয়। সরোজিনীর ভাই বীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী।

 

 

শিক্ষা—-

 

সরোজিনী নাইডু ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। ১২ বছর বয়সে, তিনি ১২ তম পরীক্ষায় ভাল নম্বর নিয়ে পাস করেছিলেন। তিনি ১৩ বছর বয়সে ‘লেডি অফ দ্য লেক’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যা তাকে বিখ্যাত করেছে। স্কুলে বসে অঙ্কের ১৩০০ লাইনে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এতে হায়দ্রাবাদের নিজাম এত খুশি হয়েছিলেন যে তাকে বিদেশে পড়ার জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজে এবং পরে কেমব্রিজের গ্রিটন কলেজে পড়াশোনা করতে যান। বারো বছর বয়সে সরোজিনী মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সমগ্র মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৯১ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা বন্ধ রেখে তিনি নানা বিষয় অধ্যয়ন করেন। ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজ ও পরে কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফার্সি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। তার প্রিয় কবি ছিলেন পি. বি. শেলি।

 

স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ—–

 

সরোজিনী নাইডু গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং গান্ধীজির চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সত্যাগ্রহ ও সংগঠনে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবেও তাঁর প্রতিভা দেখিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং জেলে যান।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরোজিনী যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, অ্যানি বেসান্ত, সি. পি. রামস্বামী আইয়ার, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন।
১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ভারতের নানা স্থানে যুবকল্যাণ, শ্রমের গৌরব, নারীমুক্তি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বক্তৃতাদান করেন। ১৯১৬ সালে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি চম্পারণে নীলচাষীদের হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৫ সালে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।

 

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন জারি করে সকল প্রকার রাজদ্রোহমূলক রচনা নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করলে সরোজিনী সর্বপ্রথমেই আন্দোলনে যোগ দেন। পরে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনের উপর ব্যাপক দমননীতি প্রয়োগ করে।
১৯১৯ সালের জুলাই মাসে সরোজিনী ইংল্যান্ডে হোমরুল লিগের দূত মনোনীত হন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসের তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পর ১ অগস্ট গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসের দুই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিনিধির অন্যতম রূপে নির্বাচিত হন।
১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি নিউ ইয়র্ক সফর করেন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকান ও আমেরিইন্ডিয়ানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা করেন তিনি। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

 

১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৫ মে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর অনতিকাল পরেই গ্রেফতার হন সরোজিনী। এই সময় কয়েক মাস তিনি কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি, গান্ধীজির সঙ্গে সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়। সেই বছরেই পরে আবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। স্বাস্থ্যহানির কারণে অল্পদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যান সরোজিনী। গান্ধীজি মুক্তি পান ১৯৩৩ সালে। ১৯৩১ সালে গান্ধীজি ও পণ্ডিত মালব্যের সঙ্গে তিনিও গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই সময় গান্ধীজির সঙ্গে ২১ মাস কারারুদ্ধ ছিলেন সরোজিনী।

মহাত্মা গান্ধী যখন স্বাধীনতা নিয়ে দেশে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল তা শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় সরোজিনী নাইডু তাকে ‘শান্তি দূত’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং সহিংসতা বন্ধ করার আবেদন করেছিলেন।

 

 

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সরোজিনী নায়ডুর সম্পর্ক এতটাই অন্তরঙ্গ ছিল গান্ধীজি তাঁকে ‘ভারত নাইটিঙ্গেল’ উপাধি দেন। কিন্তু চিঠিতে তিনি কখনো কখনো ‘প্রিয় বুলবুল’, ‘প্রিয় মীরাবাই’ এমনকি ‘আম্মাজান’, ‘মা’ও মজা করে লিখতেন। সরোজিনীও তাকে ‘তাঁতি’, ‘লিটল ম্যান’ এবং কখনো কখনো ‘মিকি মাউস’ বলে সম্বোধন করতেন।

 

ব্যক্তিগত জীবন—-

 

১৭ বছর বয়সে সরোজিনী ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নায়ডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। উল্লেখ্য, সেই যুগে অসবর্ণ বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। সরোজিনী ব্রাহ্মণ হলেও গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে ১৮৭২ সালের আইন অনুযায়ী তাদের বিবাহ হয়। তাদের চারটি সন্তান হয়েছিল: জয়সূর্য, পদ্মজা, রণধীর ও লীলামণি। কন্যা পদ্মজা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন।

 

কর্ম জীবন—-

 

১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এশীয় সম্পর্ক সম্মেলনের স্টিয়ারিং কমিটির পৌরোহিত্য করেন সরোজিনী নায়ডু।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার পর সরোজিনী নায়ডু যুক্তপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যপাল নিযুক্ত হন।

 

 

তাঁর রচনাবলি—-

 

লেখাপড়ার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। গোল্ডেন থ্রেশহোল্ড ছিল তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাব্য সংকলন ‘সময়ের পাখি’ এবং ‘ব্রোকেন উইং’ তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়কে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা কবিদের মধ্যে অন্যতম মনে করা হয়। বিশ্বনন্দিত অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সাহিত্যিক তার সাহিত্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। পোয়েট্রি সুপ নামের একটি ওয়েবসাইট তাকে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ১০০ জন কবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেখানে তার অবস্থান ছিল ১৯তম। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফারসি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। সরোজিনী নাইডু ইংরেজি ভাষায় কবিতাও লিখতেন।

উল্লেখযোগ্য  রচনাবলি—

The Golden Threshold (১৯০৫);  The Bird of Time: Songs of Life, Death & the Spring (১৯১২); The Broken Wing: Songs of Love, Death and the Spring (১৯১৭);
The Sceptred Flute: Songs of India (১৯৪৩); The Feather of the Dawn (১৯৬১);  The Gift of India;

 

মৃত্যু—-

 

স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি বিক্রমপুর কন্যা ভারতীয় কোকিলা সরোজিনি নাইডু ১৯৪৯ সালের আজকের দিনে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।  তার মৃত্যুর পর যুগ যুগ ধরে এই অতি অসামান্য বিদুষী নারী সমগ্র মহিলাজাতির পথপ্রদর্শিকা হিসেবে সম্মানিত হযে আসছেন।

 

।।ছবি ও তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
অনুগল্প প্রবন্ধ

সাহিত্যের ছোটো আকাশ, বড়ো আকাশ : শুভঙ্কর দাস।

এই সময়ের সাহিত্যের আকাশটা বড় থেকে
ছোটো হয়ে আসছে
তার প্রধান তিন কারণ

এক
এই সময়ের সাহিত্যচর্চায় সত্যিকারের সন্ধানীহাতের বড় অভাব।অর্থাৎ খুঁজে খুঁজে নবীন প্রতিভা বের করে প্রতিষ্ঠা দান।তার মারাত্মক অভাব।অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেই খুঁজে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিস্ময়কর আভিধানিক আবিষ্কার করেছিলেন।বুদ্ধদেব বসুর উদারতায় ও আহ্বানে জীবনানন্দের মতো বিরল প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছিল, আজকের জয় গোস্বামী, শ্রীজাত,বিনায়ক, মন্দাক্রান্তা, এমন কি মায়ে সুবোধ সরকার পর্যন্ত সকলেই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আনন্দময় সান্নিধ্যের পক্ষপাতপুষ্ট প্রতিভা।এই সূত্রে প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষের নাম স্মরণীয়। তাঁর গৃহের রবিবারের আড্ডা তো অসংখ্য সৃজনশীল হাওয়ার বাতাস হয়ে ওঠার সিঁড়ি ছিল।
এখানে উচ্চারিত নামগুলো শুধু উদাহরণ, কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য উল্লিখিত নয়, এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান এবং সাহিত্যে সৎ।
এই সময় প্রিয় ‘কবিসম্মেলন’ পত্রিকার দুই মহারথী কবি শ্যামলকান্তি দাশ ও শংকর চক্রবর্তী নীরবে ও নির্দ্বিধায় শস্যরোপনের কাজটি করে চলেছেন।এঁরা ব্যতিত নবীন প্রতিভার দাঁড়ানোর স্থান এতখানি অকুলান, তাতে যাকে অনুপ্রেরণা বলে,তা সত্যিকারের অণু হয়ে থেকে গেছে।
তাহলে
বল মা দাঁড়াই কোথা?

দুই
আপনার পাশের সাহিত্যরচনাকারীটি আপনার লেখা পড়েন না!
অর্থাৎ মহানগর তো দূরের নক্ষত্র, মফস্বলি কোনো সৃজনকর্মের পাঠক মফস্বলের পাওয়া দুষ্কর। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় কতজন সম্পাদক, সাহিত্যিক এবং সংগঠক আছেন,যাঁরা হাতে প্রাপ্ত কবিতা-গল্প-উপন্যাস যাই পান,তার এক পাতাও উলটে দেখেন কি না সন্দেহ!
ফলে তাঁর মুখে এই আফসোস প্রতিফলিত, আজকাল ভালো লেখার বড় অভাব! আসলে তিনিই যে সবচেয়ে অভাবী,দরিদ্র, একথা কাকে বোঝানো যাবে?
ঠিক একই কথা বাচিকশিল্পীদের ক্ষেত্রে খাটে,তাঁরা এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছেন,তিনি এখনও গলার শিরা ফুলিয়ে এবং হস্তসঞ্চালনপূর্বক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম এবং সুকান্তে আওড়ে চলেছেন।তাঁরা অবশ্য অনেক খুঁজে খুঁজে সুনীলের নির্বাসন,শক্তির অবনী বাড়ি আছো? জয় গোস্বামীর মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয় আর সুবোধের শাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছেন,তারপর? তারপর? তারপর সবই অঙ্কে যত শূন্য পেলে!
না, না, মোটেই আমরা বলছি না,যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত-সুকুমার পড়বেন না,আবৃত্তি করবেন না,বরং এঁদের সৃষ্টি না পড়লে,যেকোনো সাহিত্যের লাজ অসম্পূর্ণ, তা তো সত্য। কিন্তু তার পাশে নতুন জমিও সন্ধানের চোখ,কণ্ঠ এবং হস্তসঞ্চালন রাখুন,তাহলে আকাশটা বড় হবে,আপনিও…
কিন্তু তা হচ্ছে না!
ফলে নবীন প্রতিভা শেষ পর্যন্ত সেই এলেবেলে আস্তাকুঁড়ে ভবিষ্যতের বীজধান হয়ে শুয়ে থাকে!

তিন
এরপর প্রকাশক!
এঁরা এক আশ্চর্য আকাশ! বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান ধারার ধারক ও বাহক!
যাঁরা পড়েন কম, প্রকাশ করেন বেশি!তার থেকেও ব্যবসায় আবেগ খাটান আরও আরও বেশি!
আমি বই ব্যবসায়ে নেমেছি,ব্যবসাকেই প্রধান করে দেখব,একদম সঠিক।তাই তাঁদের বই প্রকাশ করে চলেন,যাঁদের বাজার তৈরি আছে।
এবং যাঁরা বাজার তৈরি করে দিতে পারবেন!
এবং তাঁদের, যাদের হাতে নিজস্ব বাজার আছে!
ফলে প্রকাশকগণ নিজে খেটে, নিজে হেঁটে প্রতিভার সন্ধান বন্ধ করে রেখেছেন!
কিন্তু এতে একদিন দেখা যাবে সাহিত্যের মৃত রথী-মহারথী ছাড়া কোনো জীবিত প্রতিভার বই প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যাবে না!
চলুক,এইভাবে চলুক…
কিন্তু তাঁরা এটা কি বোঝেন,যদি সত্যিকারের সন্ধানী চোখ দিয়ে নবীন নবীন প্রতিভা তুলে ধরে বাজারে রাখার চেষ্টা করি,তাদের মধ্যে কেউ না কেউ পাঠকসমাজ পাবেন,ফলে আবার নতুন করে বাজার তৈরি হবে!
কিন্তু সেই ঝুঁকি নিতে এঁরা আগ্রহী নয়! ফলে সাহিত্যের আকাশ,শুধু লেখার নয়, প্রকাশেরও ছোট হতে হতে সমুদ্র থেকে গর্ত হয়ে যাবে!
এবং একদিন কলেজ স্ট্রিট না গিয়েও বলে দেওয়া যাবে,ওখানে কী বই বিকোয় এবং কী বই শুকোয়!

এই সবের ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
কিন্তু তা এতো যৎসামান্য যে,আকাশটাকে কিছুতেই বড় করতে পারছে না! বরং সেই সব ব্যতিক্রমীদের এমনভাবে বাধা-বিপত্তির বেড়াজালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের নাভিশ্বাস আকাশ পর্যন্ত ওঠে না!

সুপ্রিয় সচেতন পাঠক,
এই কথাগুলো চোখ চারিয়ে,হৃদয় মিশিয়ে এবং বোধ পিষিয়ে রচিত।এ-র সঙ্গে আপনি একমত হতে পারেন আবার নাও হতেন পারেন!
আপনি কমেন্ট করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন!
সেটা সম্পূর্ণ আপনার মনন এলাকা।
কিন্তু এই আলোচনা পাঠের পর কথককে অকারণে ও অযৌক্তিক নেতিবাচক এবং সূচীশিল্পে বিদ্ধ না করিয়া কীভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নস্যাত করা যায়,তাই লিখুন…
আপনার মতামতের জন্য তো ফেসবুকে পোস্ট করা…

ওহ্ হ্যাঁ,ফেসবুক।
জয় ফেসবুকস্বতী।

যার কেউ নেই, তার ফেসবুক আছে।
এবং তাই বোধহয় হলদিয়া টু হাওড়া,কলকাতা টু কাঠমান্ডু,ঢাকা টু কাশ্মীর,নিউইয়র্ক টু নদের গঞ্জ পর্যন্ত আকাশটা বেঁচেবর্তে আছে!

Share This
Categories
প্রবন্ধ

পল্লীপ্রেমী কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক।

ভূমিকা—-

বাংলার রবীন্দ্রযুগে স্বনামধন্য পল্লীপ্রেমী কবি ও শিক্ষাবিদ কবি ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক।গ্রাম বাংলার সহজ-সরল জীবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর কবিতায় প্রধান বিষয়। আজও তাঁর কবিতায় সৃষ্ট প্রাকৃতিক রূপ, রস, অনুভূতি, বাংলা সাহিত্যের পরোতে পরোতে তাকে চিরঞ্জীবী করে রেখেছে। অজয় নদ, কুনুর নদীর স্রোত তাঁর উপস্থিতি অনুভব করায়। তার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- “কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাংলার গ্রামের  তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।”  পেশায় তিনি ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অন্যতম ছাত্র। ‘উজানী’, ‘অজয়’, ‘তূণীর’, ‘স্বর্ণসন্ধ্যা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।

জন্ম ও বংশ পরিচয়—

১৮৮৩ সালের ১ লা মার্চ  অবিভক্ত বাংলার  পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামে (বর্তমানে কুমুদগ্রাম) মাতুলালয়ে  জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখন্ড গ্রামে৷ পিতা পূর্ণচন্দ্র মল্লিক ছিলেন কাশ্মীর রাজসরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মাতা ছিলেন সুরেশকুমারী দেবী। তাঁদের পূর্বপুরুষ বাংলার নবাবের থেকে মল্লিক উপাধি লাভ করেন। তাদের পদবী সেন শর্মা বা সেনগুপ্ত।

শিক্ষা জীবন—

ছাত্র হিসাবে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। কুমুদরঞ্জন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে এফ.এ. এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন ও বঙ্কিমচন্দ্র সুবর্ণপদক প্রাপ্ত হন।

কর্মজীবন—-

তিনি বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন।

কবি প্রতিভা—-

কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ বাল্যকাল থেকেই ঘটে।নদী ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন কবি কুমুদ রঞ্জন। কবির গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে অজয় ও কুনুর নদী। এই গ্রাম আর নদীই হল কবির মুখ্য প্রেরণা। কবিতায় নির্জন গ্রামজীবনের সহজ-সরল রূপ তথা নিঃস্বর্গ প্রেম চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লী-প্রিয়তার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবনা যুক্ত হয়ে তার কবিতার ভাব ও ভাষাকে স্নিগ্ধতা ও মাধুর্য দান করেছে। ধর্ম নিয়ে লিখলেও ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না।  ‘কপিঞ্জল’ ছদ্মনামে তিনি চুন ও কালি নামে ব্যঙ্গকাব্য রচনা করেন।

পল্লীকবির উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলঃ— পল্লীকবির রচিত একাধিক কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি ও গ্রাম্য পরিবেশে সৌন্দর্যের বর্ণনা। শিশু বয়সে বেশীরভাগ মানুষই পড়েছে কবি রচিত কবিতা-

চুন ও কালি (১৯১৬), বীণা (১৯১৬), বনমল্লিকা (১৯১৮), শতদল (১৯০৬ – ০৭), বনতুলসী (১৯১১), উজানী (১৯১১), একতারা (১৯১৪), বীথি (১৯১৫), কাব্যনাট্য  দ্বারাবতী (১৯২০), রজনীগন্ধা (১৯২১), নূপুর (১৯২২), অজয় (১৯২৭), তূণীর (১৯২৮), স্বর্ণসন্ধ্যা (১৯৪৮)। তার অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি হল ‘গরলের নৈবেদ্য’। এটি সোমনাথ মন্দির সম্পর্কিত ১০৮ টি কবিতার সংকলন হিসাবে প্রকাশ।

সম্মাননা—

কবি হিসেবে তিনি সম্মানিত হয়েছেন সর্বত্র। কুমুদরঞ্জন বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান সাহিত্যতীর্থের ‘তীর্থপতি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ দিয়ে সম্মান জানায়।১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ২১ এপ্রিল ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।

মৃত্যু—-

১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সমস্ত সাহিত্য কবিতা অনুরাগী মানুষকে গভীর শোকের নিমজ্জিত করে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ও আমরা বাঙালী : প্রশান্ত কুমার দাস।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী –দিনটিকে আমরা বাঙালীরা ভুলতে পারিনা। বাঙালির কাছে এ এক স্মরণীয় দিন । ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিন বাংলাদেশে ‘শহীদ দিবস’ রূপে পালিত হয় আর ২০০০ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী “আর্ন্তজাতিক মাতৃদিবস” হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
আমাদের মাতৃভাষা- বাংলাভাষা-যে ভাষায় নিতাই- গোরা সারা দেশে ভক্তিস্তোত্র বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- যে ভাষাতে রবীন্দ্রনাথ,বঙ্কিমচন্দ্র,মধুসূদন,শরৎচন্দ্র বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন – এই ভাষাতেই বিদ্রোহি কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রক্ত-ঝরা কবিতা লিখে ব্রিটিশ শক্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন – এই ভাষাতেই ‘হরিবোল’ গাইতে গাইতে আমরা ভবসাগর পার হয়ে যায়।
এই ভাষাতেই আমরা বাঙালীরা বড় হয়েছি, কথা বলেছি, গান গেয়েছি এবং আজও বেঁচে আছি।
কিন্তু এই মাতৃভাষা দিবসটা সিক্ত হয়ে রয়েছে অনেক সন্তানহারা-মায়ের অশ্রুজলে- তাই ভুলতে পারছিনা ছেলে- হারা-মায়ের অশ্রুতে গড়া একুশে ফেব্রুয়ারীর কথা। কারন এই দিনটিতে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কয়েকশ বাঙালী ভাইয়ের রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছিল- এদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের নাম প্রকাশ্যে আসে-তারা হলেন আব্দুল সালাম, বরকত জব্বর,আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও শফিউর।
সেই রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি আজও মুছে যাইনি এবং শত শত বছর পরেও মুছে যাবেনা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো কিন্তু দ্বিখন্ডিত হয়ে – একটি ভারত যুক্তরাষ্ট্র অপরটি পাকিস্তান রাষ্ট্র ।তবে পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত রূপে- পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান । পাকিস্তানে যেমন উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলো তেমনি বাংলাদেশেও(পূর্ব পাকিস্তানে) ঊর্দুকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো। তারা ঊর্দূভাষার ডাকটিকিট প্রকাশ করলো, ফর্মে ও খামে এবং সমস্ত ধরনের সাইনবোর্ডে ঊর্দূকে স্থান দিল।
কিন্তু বাংলার জনৈক মুসলিম ভাই মহঃ শহীদুল্লা উচ্চকণ্ঠে জানালেন –“আমরা যেমন মুসলমান সত্য, তেমনি আমারা বাঙালী”। অতএব বাংলাকেই আমাদের দেশে মর্যাদা দিতে হবে।“১৯৪৮ সালে আলিজিন্না জানালেন – পাকিস্তানে উর্দূই হবে রাষ্ট্রভাষা“। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনও জানিয়ে দিলেন- এদেশে উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
কিন্তু বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা এই দাবীকে অগ্রাহ্য করলো এবং ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারে ঘোষিত ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে মিছিল নিয়ে এগিয়ে চললো বীর বিক্রমে।কিন্তু সরকার নৃশংসভাবে জনতার উপর গুলি চালালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে – যেখানে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো কতশত তরুন তরতাজা যুবক। কয়েক শত হতাহত তরুণ প্রান-রক্তে লাল হয়ে উঠলো ঢাকার রাজপথ । বেশির ভাগ শহীদ হওয়া রক্তাক্ত দেহকে হাপিস করে দেওয়া হলো।
কিন্তু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন থামলো না, বরং আরও তীব্রতর হলো পৃথিবীর ব্যাপী বিভিন্ন প্রান্তে । শেষকালে ১৯৯৮ সালে ২৯ শে মার্চ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কফি আন্নানের হাতে একটি আবেদন পত্র এসে পৌঁছালো।এই আবেদন পত্রে লেখা হয়েছিল – “পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে।“ সেই আবেদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের কথা এবং পাঁচ জন তরুনের শহীদ হওয়ার কথা। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে সকল রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখ মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। তারপরে২০০০সালের ২১শে ফ্রেবুয়ারী প্রথম আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালিত হয়।
আজও আমরা প্রতিবছর এই দিনটিকে স্মরণ করে সেই মৃত্যুহীন প্রাণ শহীদের প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই – কবিরা নতুন নতুন গান সৃষ্টি করেন, পত্রিকায়,ম্যাগাজিনে এই দিনের তাৎপর্য নিয়ে লেখা হয়, বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠান এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে।
দুই বাংলার বাঙালিরা ভাষার আকর্ষনে এক অভিনব মিলন সেতু তৈরী করে। কলকাতার বইমেলায় দেখা যায় বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকদের ,গড়ে ওঠে বাংলাভাষীদের মৈত্রী – হিন্দু মুসলিম পৃথক সত্ত্বা ভুলে যায় – বাঙালির ভাষার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে ঐক্যতান।
কিন্তু এত কিছুর পরেও একটা বেদনা মনের মধ্যে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে কি আর বাংলা ভাষার কদর থাকবে ? দেখা যাচ্ছে ,বাংলা ভাষা বাঙালিদের কাছে ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে। সম্পন্ন ঘরের ছেলে মেয়েরা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে যাচ্ছে, বাবা-মা ছেলে মেয়েদের ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে গর্ববোধ করছেন। অনেকে বলেন – আমার ছেলে বেশ ভাল ইংরাজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু বাংলাটা ঠিক আসে না তাই পড়তে চায় না। আবার কেউ কেউ বাংলা ভাষা না জানাটাই গর্বের বস্তু বলে মনে করেন। শহরে এমনকি গ্রামেগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠছে। সেখানে অনেক অনেক বেশি খরচ করে অভিভাবকগণ ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করছেন শুধুমাত্র ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবার জন্য।
আমি জানি ইংরাজি ভাষা একটা আর্ন্তজাতিক ভাষা এই ভাষাতে দক্ষতা অর্জন করা অতি অবশ্যই প্রয়োজন, এমনকি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতেও আমদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করা একদম উচিত নয়।
তাছাড়া আমাদের রাজ্যে এখনও ব্যাঙ্কে,পোষ্ট অফিসে বা সরকারী অফিসের সব ধরনের ফর্মগুলি ইংরাজি ভাষায় লিখিত। ইংরাজি নববর্ষে আমরা Happy New Year বলতে অভ্যস্ত । আমাদের কোনো অফিসে দরখাস্ত পাঠাতে হলে ইংরাজি ভাষায় লিখতে হবে। সুতরাং আমাদের বাংলার দৈন্যতার জন্য আমরাই দায়ী।
আজ আমরা যারা বাংলাকে ভালবাসি তাদের উচিত ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশের শহীদদের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানানো তেমনি আমাদের মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ বাংলাভাষাকে নতুন করে ভালোবাসা জানানো । আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে বাংলা কবিতার বই ,গল্পের বই, ঠাকুরমার ঝুলি প্রভৃতি উপহার হিসাবে তুলে দেব।কারন বাংলা ভাষাই হচ্ছে বাঙালির আশা ভরসা। বাংলা ভাষা যদি অবলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আর বাঙালির অস্ত্বিত্ব থাকবে না।
এজন্য আজ সমস্ত বাঙালিকেই সজাগ থাকতে হবে, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আর একটা কথা আমাদের জানা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির শহীদ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে- তবুও এই দিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সকল ভাষা ভাষীর মানুষ নিজ নিজ ভাষাকে ভালোবাসবে, নিজের নিজের ভাষার উন্নতির চেষ্টা করবে।সাঁওতালরা তাদের সাঁওতালী ভাষাকে প্রাধান্য দিবে, নেপালীরা তাদের নেপালী ভাষার জন্য গর্ববোধ করবে, উড়িয়ারা তাদের উড়িয়া ভাষাকে উন্নততর করার চেষ্টা করবে – এমনি করে প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজের ভাষাকে মাতৃদুগ্ধ মনে করবে। তবেই ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটি উদযাপন করা সার্থকমন্ডিত হয়ে উঠবে।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ভাষা দিবসের তাৎপর্য – একটি সমীক্ষা :: দিলীপ রায়।

মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বোধের উন্মেষ । মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে । শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমন গুরুত্ব । মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে । মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয় । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব । মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি । কারণ, এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না। মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ সম্ভব ।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে । নিজেদের ভাষাকে উন্নত ও কার্যকরী করেই বিশ্বের জাতিসমূহ উন্নত ও অগ্রসর হতে পেরেছে ।
উনিশ শতকের ভারতীয় চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় রাজনারায়ণ বসু (০৭.০৯.১৮২৬ — ১৮.০৯.১৮৯৯) বলেছেন “জননীর স্তনদুগ্ধ যদ্রুপ অন্য সকল দুগ্ধ অপেক্ষা বল বৃদ্ধি করে, তদ্রূপ জন্মভূমির ভাষা অন্য সকল ভাষা অপেক্ষা মনের বীর্য প্রকাশ করে ।”
মাতৃভাষা হল মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রকৃত প্রকাশ মাধ্যম । তার জিয়নকাঠির স্পর্শেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা তাঁর জীবনস্মৃতিতে লেখা ) হয়, বোধের গভীরে চিন্তার বুদবুদ কারার দ্বার ভেঙে বাইরে এসে বাক‌্মূর্তি ধারণ করে । আর অন্যদিকে শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ । মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না । তাই সেই অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তস্থলের আবেগের যোগ থাকা একান্ত আবশ্যক । সেকারণে শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের । প্রাণের ভাষা ও প্রাণের জ্ঞান একত্রিত হলে তবেই একজন সার্থক মানুষরূপে পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে । একটা শিশুর মাতৃভাষা হলো তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ । মাতৃভাষা ‘সফলভাবে কাজ ও কথা বলার সামাজিক ধরনকে’ প্রতিফলন ঘটাতে সাহাযা করে ।
তাই মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মুল তাৎপর্য হলো মাতৃভাষা নিয়ে সচেতন হওয়া ও বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা । বাঙালিদের মতে, মায়ের মুখের ভাষাই হলো জীবন, ভাষাই হলো স্বাধীনতা ।
আবার সংস্কৃতির একটি অংশ ভাষা । তবে এ ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক । ইউনেস্কোর সম্মেলনে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে বলা হয় – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার । মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে । সুতরাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলো প্রতিটি মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনো ভাষার উপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা । এদিবসে প্রত্যেক ভাষাভাষি মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালবাসবে তেমনি অন্যজাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে । সুতরাং বলা যায়, একুশকে ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ ।
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন । একটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত । বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ।
এবারে আসছি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে । ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে । প্রথমে ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয় । ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানে উর্দু হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা (Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan) । এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেন নি । ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । এর প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল করে । মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে । মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন । ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সাথে সাথে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় । এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র যুব হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হস্টেলে সমবেত হন । নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে । ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর রাখার জন্য ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে উঠে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি । ১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলা ভাষা প্রচলণ বিল” পাশ হয় । যা কার্যকর হয় ৮ই মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় । এতে তরতাজা ছাত্র-যুবকেরা হতাহত হন । সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে । ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিলো ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ । লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ । তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে উঠে ঃ
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লেখেন । যেমন –
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি “একুশের গান” শিরোনামে প্রকাশিত হয় । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ যিনি সেসময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরিতে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিলো । পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে । ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।
এবার আসছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রসঙ্গে । কানাডার ভ্যাঙকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুল সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতি সংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আননের কাছে ১৯৯৮ সালে । সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসাবে কর্মরত হাসান ফিরদৌসের নজরে এই চিঠিটি আসে । তিনি ১৯৯৮ সালের ২০শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন । পরে রফিক আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান । এতে একজন ইংরেজভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন । তারা আবার কফি আননকে “এ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন । ১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সাথে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন । আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫টি দেশ — কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে । ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতি সংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে । ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশন মোতাবেক এখন থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ । সুতরাং ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন হয়ে আসছে ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক । ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের স্মরণে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের গণআন্দোলনের প্রতীক, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুমহানস্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতীর পিতা (বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্ত্বা থাকবে শহীদদের আমরা ভুলতে পারবো না । আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না । এ বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়” ।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাদিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন । এ সময় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।
পরিশেষে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো । মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা । বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারকে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো । সারা বিশ্বে বাঙালী জাতির কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন । তাই ২১ আমাদের গর্ব, ২১ আমাদের অহংকার । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই চেতনাকে সবার মধ্যে সঞ্জীবিত করার মধ্যেই নিহিত আছে এই মহান দিবসের সার্থকতা ।
প্রসঙ্গত, আমরা স্মরণ করতে পারি কবি অতুল প্রসাদ সেনের লেখা ঃ—-
মোদের গরব, মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা !
কি যাদু বাংলা গানে ! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো !
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা ।
আজ এই পুণ্যদিনে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
————————–0—————————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী (৭৪১২৩৫), ভারত

Share This