ভূমিকা—-
বাংলার রবীন্দ্রযুগে স্বনামধন্য পল্লীপ্রেমী কবি ও শিক্ষাবিদ কবি ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক।গ্রাম বাংলার সহজ-সরল জীবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর কবিতায় প্রধান বিষয়। আজও তাঁর কবিতায় সৃষ্ট প্রাকৃতিক রূপ, রস, অনুভূতি, বাংলা সাহিত্যের পরোতে পরোতে তাকে চিরঞ্জীবী করে রেখেছে। অজয় নদ, কুনুর নদীর স্রোত তাঁর উপস্থিতি অনুভব করায়। তার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- “কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাংলার গ্রামের তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।” পেশায় তিনি ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অন্যতম ছাত্র। ‘উজানী’, ‘অজয়’, ‘তূণীর’, ‘স্বর্ণসন্ধ্যা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
জন্ম ও বংশ পরিচয়—
১৮৮৩ সালের ১ লা মার্চ অবিভক্ত বাংলার পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামে (বর্তমানে কুমুদগ্রাম) মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখন্ড গ্রামে৷ পিতা পূর্ণচন্দ্র মল্লিক ছিলেন কাশ্মীর রাজসরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মাতা ছিলেন সুরেশকুমারী দেবী। তাঁদের পূর্বপুরুষ বাংলার নবাবের থেকে মল্লিক উপাধি লাভ করেন। তাদের পদবী সেন শর্মা বা সেনগুপ্ত।
শিক্ষা জীবন—
ছাত্র হিসাবে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। কুমুদরঞ্জন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে এফ.এ. এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন ও বঙ্কিমচন্দ্র সুবর্ণপদক প্রাপ্ত হন।
কর্মজীবন—-
তিনি বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন।
কবি প্রতিভা—-
কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ বাল্যকাল থেকেই ঘটে।নদী ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন কবি কুমুদ রঞ্জন। কবির গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে অজয় ও কুনুর নদী। এই গ্রাম আর নদীই হল কবির মুখ্য প্রেরণা। কবিতায় নির্জন গ্রামজীবনের সহজ-সরল রূপ তথা নিঃস্বর্গ প্রেম চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লী-প্রিয়তার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবনা যুক্ত হয়ে তার কবিতার ভাব ও ভাষাকে স্নিগ্ধতা ও মাধুর্য দান করেছে। ধর্ম নিয়ে লিখলেও ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। ‘কপিঞ্জল’ ছদ্মনামে তিনি চুন ও কালি নামে ব্যঙ্গকাব্য রচনা করেন।
পল্লীকবির উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলঃ— পল্লীকবির রচিত একাধিক কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি ও গ্রাম্য পরিবেশে সৌন্দর্যের বর্ণনা। শিশু বয়সে বেশীরভাগ মানুষই পড়েছে কবি রচিত কবিতা-
চুন ও কালি (১৯১৬), বীণা (১৯১৬), বনমল্লিকা (১৯১৮), শতদল (১৯০৬ – ০৭), বনতুলসী (১৯১১), উজানী (১৯১১), একতারা (১৯১৪), বীথি (১৯১৫), কাব্যনাট্য দ্বারাবতী (১৯২০), রজনীগন্ধা (১৯২১), নূপুর (১৯২২), অজয় (১৯২৭), তূণীর (১৯২৮), স্বর্ণসন্ধ্যা (১৯৪৮)। তার অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি হল ‘গরলের নৈবেদ্য’। এটি সোমনাথ মন্দির সম্পর্কিত ১০৮ টি কবিতার সংকলন হিসাবে প্রকাশ।
সম্মাননা—
কবি হিসেবে তিনি সম্মানিত হয়েছেন সর্বত্র। কুমুদরঞ্জন বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান সাহিত্যতীর্থের ‘তীর্থপতি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ দিয়ে সম্মান জানায়।১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ২১ এপ্রিল ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।
মৃত্যু—-
১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সমস্ত সাহিত্য কবিতা অনুরাগী মানুষকে গভীর শোকের নিমজ্জিত করে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ।।