Categories
উপন্যাস

 দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

বাবলা নদীর কিনারা দিয়ে মাটির রাস্তা । নদীর পশ্চিম দিকে অর্থাৎ রাস্তা ঘেঁষে প্রকাণ্ড একটি বট গাছ । সেই বট গাছের নীচে স্কুটার রাখলো । তারপর নদীর খুব কাছাকাছি গিয়ে কুহেলি ও শীতল বসলো । নদীর কিনারে বসে নদীর জলের মৃদুমন্দ ঢেউয়ের দিকে দুজন তাকিয়ে । দুজনে চুপচাপ । অল্পবিস্তর বাতাস বইছে । সেই বাতাসে নদীর জলে মৃদুমন্দ ঢেউ । বৈকালিন পরিবেশটি তাদের কাছে মনোমুগ্ধকর । একজন পুরুষের সাথে ফাঁকা জায়গায় এইভাবে পাশাপাশি বসে থাকা কুহেলির জীবনে প্রথম । শীতল এখন পুরোপুরি যুবক । দুদিন পরে কলেজে ভর্তি হবে । অন্যদিকে কুহেলি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবে । তার শারীরিক স্থিতি দেখলে যে কেউ বলবে, কুহেলি পুরোপুরি বিয়ের উপযুক্ত । এইরূপ দুজন ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে বাবলা নদীর জলের দিকে তাকিয়ে । রাস্তা দিয়ে পথ চলতি মানুষ কৌতুহলি দৃষ্টিতে কুহেলি ও শীতলের দিকে তাকাতে তাকাতে নিজ গন্তব্যস্থানে ছুটছেন । সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা নামবে । তবুও তারা নির্বিকার । পাশাপাশি চুপচাপ বসে ভাবনার জগতে নিমজ্জিত । বাড়ি ফেরার হেলদোল নেই । কুহেলির একদম বাড়ি ফেরার তাড়া নেই । শীতলও তেমনি । শীতল মনেপ্রাণে চাইছে আরও দু-দণ্ড কুহেলির পাশে বসে থাকতে । কেননা তার জীবনেও এইভাবে বসে থাকার সুযোগ এই প্রথম । তাই কুহেলির উষ্ণ স্পর্শ শীতলের মনকে উতলা করে তুলছে । তার মনের গহন গাঙে রীতিমতো চলছে কুহেলিকে ভাললাগার ঝড় । ভালবাসার তৃষ্ণায় শীতল এখন তৃষ্ণার্ত । কুহেলি এই মুহূর্তে তার পাশ থেকে উঠে যাক, সেটা শীতল কিছুতেই চাইছে না । কলেজ জীবনে প্রবেশের আগে কুহেলির স্পর্শানুভূতিতে শীতল বিভোর ।
হঠাৎ চারিদিকে অন্ধকার । কুহেলি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে । যেকনো মুহূর্তে ঝড় উঠবে । আকাশের অবস্থা ভাল না । আকাশে মেঘের অবস্থা দেখে কুহেলির ধারণা, ঝড় ও বৃষ্টি দুটোই হওয়ার সম্ভাবনা ।
শীতল তখনও বা-হাতটা কুহেলির ডান হাতের উপর রেখে ভাবনার জগতে আবিষ্ট । যদিও এতক্ষণ কুহেলির হাতের ছোঁয়ায় শীতল তার শরীরে একটা অদ্ভূত ধরনের আনন্দে মোহিত হয়েছিল । অন্যদিকে শীতলের হাতের ছোঁয়ায় কুহেলিও এক চরম আনন্দানুভূতিতে আত্মহারা ছিল । আকাশের অবস্থা অবলোকন করে কুহেলি আর স্থির থাকতে পারলো না । বাধ্য হয়ে শীতলকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “আকাশের অবস্থা ভাল না । আকাশের দিকে তাকাও । মনে হচ্ছে শীঘ্র ঝড় উঠবে !”
কুহেলির ধাক্কায় ভাবনার জগত ছেড়ে শীতল স্বভাবিক ছন্দে ফিরলো । আকাশের অবস্থা দেখে শীতল চমকে উঠলো ! তাই তো, শীঘ্র ঝড় উঠবে । ঝড় বৃষ্টির আগে বাড়ি ফিরতে না পারলে হিতে বিপরীত হবে । বলা ভাল, কুহেলির স্পর্শের স্বাদ বিঃস্বাদ হয়ে তার জীবনে নানান অশান্তি সৃষ্টি হবে । বাড়িতে অহেতুক নানান কটু কথার সম্মুক্ষীণ হতে হবে । একেই কুহেলিকে শীতলদের বাড়িতে পছন্দ করে না । তার উপর ঝড় বৃষ্টির সময় দুজনের একসঙ্গে সময় কাটানো বাড়িতে ভালভাবে মেনে নেবে না । বরং শুরু হবে নানান অশান্তি । তাই তড়িঘড়ি স্কুটি স্টার্ট দিলো শীতল । স্কুটির সিটের পেছনে কুহেলি ।
নোনাই নদীর ব্রিজ পর্যন্ত যেতে-না-যেতেই ঝড় উঠলো । ঝড়ের দাপটে স্কুটি নিয়ে তারা এগোতে পারছে না । রাস্তা সুনসান ! লোক জনের চিহ্ন নেই । ব্রিজের উপর ওঠার মুখে পঞ্চায়েত থেকে তৈরী করা একটা বসার শেড । সেটা আবার ভাঙাচোরা । ছাদের টিন উধাও । সেখানে স্কুটি দাঁড় করালো । ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি । শেডের এক কোনে দুজনে দাঁড়িয়ে । বৃষ্টির জলের ঝাপটায় দুজনে ভিজে একশা ! কুহেলিকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে শীতল কুহেলিকে কাছে টেনে নিয়ে দাঁড় করালো । কুহেলি তখন শীতলের আবদারে বাধা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই । তাই শীতলের সমস্ত আবদারে সায় দিলো কুহেলি ।
বৃষ্টি থেমে গেছে !
চারিদিকে অন্ধকার । ব্রিজ পার হয়ে অনেকটা রাস্তা । বাড়ি ফেরার জন্য তারা ব্যাকুল ! বৃষ্টির ঠাণ্ডা জলে ভিজে কুহেলির শরীর শীতে কাঁপছে । ভেজা অবস্থায় দুজন স্কুটিতে পুনরায় উঠলো । স্টার্ট দিলো স্কুটি । বৃষ্টিতে ভেজার জন্য স্কুটি হাতে স্টার্ট নিচ্ছিলো না । শেষে পায়ে কিক্‌ দিয়ে শীতল স্কুটি স্টার্ট দিলো । কুহেলিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শীতল বাড়ি ফিরলো ।
বাড়িতে সানাই ও পান্তা মাসি । পান্তা মাসি আড় চোখে কুহেলির শরীরের দিকে বিশ্রিভাবে তাকালো । কুহেলির মনে হলো, শীতলের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সে খুব বড় পাপ কাজ করে ফেলেছে । অন্যদিকে সানাই ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা গলায় বলল, “এতক্ষণ তোর জন্য টেনশনে আমি ঘামছিলাম । তুই বাড়িতে ফেরায় আমি শান্তি পেলাম । তুই শিগগির ঘরে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টিয়ে আয় ।“
ঐদিকে পান্তা মাসি তড়পাচ্ছে । পান্তা মাসি সানাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেই চলেছে, “মেয়েটাকে এখন থেকে সাবধান করতে না পারলে শীঘ্র গোল্লায় যাবে । শীতলের সঙ্গে মেলামেশা আমার একদম ভাল লাগছে না । আপনি মেয়েটাকে বোঝান । নতুবা শীতল মেয়েটার অনেক ক্ষতি করে ফেলবে ।“
সানাই যত বোঝাতে চাইছে, “মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ঢুকলো । জামা কাপড় ছাড়ুক । আগে কুহেলি স্বাভাবিক হোক । তারপর এসব কথা বলা যাবে । এইসব কথা শুনলে মেয়েটা কষ্ট পাবে ।“ সানাই মেয়েটাকে কোনোভাবে কষ্ট দিতে নারাজ । কিন্তু পান্তা মাসি সমানে বকবক করেই যাচ্ছে ।
স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে কুহেলি সানাইকে বলল, “বাবা, এক কাপ চা বসাও । গরম গরম চা খেলে ঠাণ্ডাটা কমবে ।“
আমি চা বানাতে যাচ্ছি মা ।
“আপনি যাবেন কেন ? আমি বাড়িতে রয়েছি, সুতরাং আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি ।“ পান্তা মাসি সানাইকে রান্না ঘরে যেতে বাধা দিয়ে বলল ।
“না পান্তা মাসি । তোমাকে চা বানাতে হবে না । আজ চা বানাতে বাবা যাক । কেননা বাবা আদা দিয়ে সুন্দর চা বানায় ।“ কুহেলি উল্টে পান্তা মাসিকে চা বানাতে বাধা দিলো ।
ভুল বুঝলো পান্তা মাসি । তাই সানাইকে বলল, “আপনার গুণধর মেয়ে এখন আমার হাতের বানানো চা খাবে না । সবটাই আমার কপাল । আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি, এই মেয়ে আপনার কপাল পুড়াবে ।“
পান্তা মাসির কথাগুলি কুহেলির ভাল লাগলো না । সে এখন বড় হয়েছে । তার নিজস্ব বোধবুদ্ধি হয়েছে । তা ছাড়া এই মুহূর্তে সে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত । তাই পান্তা মাসিকে শুনিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ওসব কথা কেন বলছো ? আমি বাবার কাছে বায়না ধরেছি, বাবা আমার চা বানিয়ে দেবে । আর তা ছাড়া…………!”
পান্তা মাসি প্রতি উত্তরে জানতে চাইল, “আর তা ছাড়া………?”
আর তা ছাড়া তুমি আমাদের বাড়ির কে ? যার উপর ভিত্তি করে তুমি তড়পাচ্ছো !”
কেদে দিলো পান্তা মাসি । কাদতে কাদতে পান্তা মাসি সানাইকে বলল, “তোমার মেয়ে এখন বাড়ির সর্বময় কর্ত্রী ! সুতরাং মেয়েকে আপনার কিছু বলার ক্ষমতা নেই । বরং আপনি এখন মেয়ের দাসানুদাস !”
সানাই কোন্‌দিকে হেলবে বুঝতে পারছে না । সানাই জানে, পান্তা মাসি ধীরে ধীরে তার হৃদমাঝারে অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে । তাই পান্তা মাসির কথা ফেলাটাও কঠিন ! অন্যদিকে মেয়েও তার একমাত্র অবলম্বন । তাকেও এড়াতে পারছে না । দুইজনের মাঝে নিরুপায় হয়ে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো ।
ঘরে ঢুকে পান্তা মাসি চা বানাতে শুরু করলো । তারপর চা নিয়ে কুহেলিকে যখন দিতে গেলো, কুহেলি রাগে চায়ের কাপ পান্তা মাসির হাত থেকে ঘরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো ।
সেটা দেখে সানাই রেগে গিয়ে ঠাস্‌ করে কুহেলির গালে জোরে থাপ্পড় ।
রাগে অভিমানে কুহেলি ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ।
রাত বাড়ছে । কুহেলি দরজা খুলছে না । ইতিমধ্যে পান্তা মাসি রাতে খিচুড়ি রান্না করেছে । খিচুড়ি রান্নার একটাই যুক্তি, বৃষ্টি নেমেছে । ঠাণ্ডা আবহাওয়া । সুতরাং খিচুড়ি ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মানাসই ।
কুহেলির ফোন বেজে উঠলো, “হ্যালো ! তুমি কী করছো ?”
শীতলের ফোন পেয়ে কুহেলি কেঁদে দিলো, “ঘরে শুয়ে আছি । তোমার সাথে ঘুরতে গিয়ে যতো অশান্তি ! অশান্তির মধ্যমণি পান্তা মাসি । বাবা অতটা কিছু বলেননি । কিন্তু পান্তা মাসির সেই এক কথা, শীতল বড় লোকের ছেলে । তার সাথে মিশলে আখেরে কুহেলির সমূহ বিপদ !”
অন্যদিকে শীতলদের বাড়িতে কুহেলিকে নিয়ে বিশাল হুলস্থুল । শীতল বাড়ির ঘটনাটা কুহেলিকে শোনাতে শুরু করলো, “বাবা-মা কিছুতেই তোর সাথে মিশতে দিতে চাইছেন না ।“
“কিন্তু কেন ?” উতলা হয়ে কুহেলি জিজ্ঞাসা করলো ।
তাঁদের বক্তব্য, “কুহেলি নীচ সম্প্রদায়ের মেয়ে । তা ছাড়া ওদের পূর্ব-পুরুষ ছিল ঝাড়খণ্ডে । জাতের ঠিক নেই । কুহেলি সাঁওতাল নাকি অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত ? সেটাই প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে ? তাই এই মেয়ের সাথে শীতলকে মেলামেশা বন্ধ করতে হবে । কীরকম দুঃসাহস মেয়েটার । সেদিনকার মেয়ে, শীতলকে পটিয়ে তার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া ! আস্পর্ধা কম নয় । মেয়েটার বাবাকেও জানিয়ে রাখতে হবে, যাতে কুহেলি শীতলের সঙ্গে না-মেশে ।“
কুহেলি পাল্টা প্রশ্ন করলো, “উত্তরে তুমি কী বললে ?”
“আমি নীরব রইলাম । বাড়িতে একদণ্ড ভাল লাগছে না । সবাই মিলে আমাকে তোর বিরূদ্ধে নানান অভব্য কথা শোনাচ্ছে, যেটা আমার কাছে খুবই বিড়ম্বনার !”
কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো । শীতলদের বাড়ির কচকচলানি শুনতে কুহেলির একদম ভাল লাগছিল না । তার উপর তাদের জাত নিয়ে অবান্তর কথাবার্তা । ঈশ্বরের অশেষ করুনায় তার জন্ম । জন্ম ও মৃত্যুতে তার কোনো হাত নেই । ঘটনাচক্রে তার সাঁওতাল সম্প্রদায়ে জন্ম । অথচ সমস্ত মানুষের শরীরের অংশ বেলেট দিয়ে কাটলে রক্ত বের হবে এবং সেই রক্তের রঙ লাল ! দেশের সমস্ত স্তরের মানুষের রক্ত লাল হলে, সমাজ ব্যবস্থায় এত ভেদাভেদ কেন ? জাতপাত নিয়ে এত সোরগোল কেন ? এটাই কুহেলির মাথায় ঢুকছে না ! তার মতে, সমস্ত মানুষের একটাই জাত হওয়া উচিত, সেটা হচ্ছে মনুষ্যজাতি বা মানবজাতি !
বাবার ডাকে ঘর থেকে বের হলো, কিন্তু রাত্রিবেলায় খিচুড়ি না খেয়ে শুয়ে পড়লো । কুহেলির শুয়ে পড়া ভালভাবে নিলো না পান্তা মাসি । পান্তা মাসি সানাইয়ের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগলো । এমনভাবে কানের কাছে পান্তা মাসি কুহেলির বিরূদ্ধে সানাইয়ের কান ভারী করছে তাতে কুহেলির দেখে মনে হয় পান্তা মাসি সানাইয়ের বিবাহিত স্ত্রী ।
তারপর………………?
তারপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো । মাধ্যমিক রেজাল্ট বের হলো । কুহেলির স্টার মার্ক । সানাই মেয়ের রেজাল্ট দেখে খুব খুশী । তার বারবার মনে হচ্ছে কুহেলির মা বেঁচে থাকলে সে ভীষণ খুশী হতো । পান্তা মাসি শুধুমাত্র জানে, পরীক্ষায় পাশ । স্টার মার্ক সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই । তাই পান্তা মাসির কাছে কুহেলি শুধুমাত্র মেট্রিক পাশ করেছে । তাতে তার কোনো তাপ-উত্তাপ বা আনন্দ নেই ।
পান্তা মাসি ইতিমধ্যে সানাইয়ের জীবনে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছে । ইতিমধ্যে বার কয়েক সানাইকে বলা হয়ে গেছে, পান্তা মাসিকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য । কিন্তু সানাই আমতা আমতা করছে । তার মনে এখনও দ্বিধা ! কেননা সে মেয়েকে খুব ভয় পায় । পান্তা মাসির জন্য মেয়েটা বিগড়ে গেলে মেয়েকে নিয়ে তার আশার জলাঞ্জলি । সানাই চায়, তার মেয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষিত হোক । মানুষের মতো মানুষ হোক । তাই পান্তা মাসির ঘ্যানঘ্যানানিতে কর্ণপাত করছে না সানাই ।
( চলবে )

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

সম্বন্ধ : রাণু সরকার।

এক ঘটক তার মেয়েকে বিয়ে দেবে পাত্রের ভীষণ দরকার, তার একটি মেয়ে আছে দেখতে বিশেষ ভালো না বলে অভাব হচ্ছে পাত্রের। তার স্ত্রী বলে বলে কানের পোকা বেরকরে দিচ্ছে- বলছে স্বামী মেয়ের বিয়ের দিন পার হচ্ছে কবে বিয়ে দেবে?
মেয়ে তো শেয়ানা হয়েছে এর পরে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে।
ছেলে একটা তো দেখে এলাম মাইনা একটু কম পায়,
ছেলেকে দেখে যখন বেরোলাম গিন্নী কি বলবো- পাশের বাড়ির একটি মেয়ে নাম তার টেপি সে এসে বললো হর দম নাকি নেশা করে কি করি বলতো গিন্নী।

আর মাস খানেক দেখবো ,তারপর যাকে পাবো তার সাথেই দেবো বিয়ে-
তুমি এতো চিৎকার করো গিন্নী তোমার ভয়ে ভয়ে মুখ বুঁজে থাকতে হয় আমার।
আর একটি দেখেছি ছেলে,মাইনা যদিও বা পায় একটু বেশি কিন্তু বংশটা একদমই ভালো না ভাবছি কি করা যায়।
শোন গিন্নী, বংশ মাইনা সব যদি ঠিকঠাক মিলে যায় তবেই দেবো বিয়ে।
আমাদের জমির কিছু অংশ দেবো বেঁচে কি বলো?
কেনো না ছেলে ভালো হলে পণ সোনা সবই চাইবে তাই না?
আর একটি ছেলে আছে,শুনেছি বংশটা ভালো ওর ভাগ্যে থাকলে রানী হয়ে থাকতে পারবে।
এখন ভালো সহজ সরল ছেলে কোথায় আছে বলো দেখি শুনি?
এখনের ছেলেরা-প্রেমের শিকারি মদ মাতাল আর কখনো খুন টুন ও করে শুনি।
জেনে শুনে দিতে পারি কিরবো বলো? মেয়ে আমাদের একটু কমজুড়ি দেখতেও ভালো না কি করে যে হলো এমন ভাবতেই পারিনা গিন্নী।

মেয়ে তো আমাদের একটু আবা প্রেমটেম ওসব কিছুই বুঝবে না তাই বলো স্বামী?
চালাক যদি হতো আজ অব্দি-একলা কি থাকতো বল গিন্নী? ঠিক একটা না একটা ছেলে পটিয়ে ফেলতো।

আমি আর গিন্নী মেয়ের পাত্রের আলোচনা করছিলাম
হঠাৎই দরজাতে টুট টুট শব্দ খুলে দেখি মেয়ের সাথে মাঝ বয়সি এক ছেলে,একদম হাঁদা,বোকা দাঁত কিছু আছে ওই ফোকলা দাঁতে হাসছে। দুজনার গায়ে
বিয়ের পোশাক কিজানি ওগো গিন্নী ভুল দেখছি নাতো।
মেয়ে বলছে এই তোমাদের জামাই মা- তোমরা মোটেও ভুল দেখনিকো।
দেখতে কত সুন্দর তাই না মা? মা একটু তাকি হু বললো, দেখেছো মা হাজার টাকা কামাই করে কিন্তু একটাও দাঁত নেই সবাই ছিছি বলে চলে গেলো।
হাজার টাকা মাইনে পায় শুনে-জ্ঞান হারালো গিন্নী স্বামী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
এর মধ্যেই পাড়া পড়শির কানে গেলো-সবাই এসে হাজির, বললো সবাই হাঁদা বোকা মেয়ে তোমার যা করেছে ঠিক করেছে, ভোজের জন্য করো সবাইকে আহ্বান।

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

সানাই বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি ডাল সেদ্ধ ও ভাত নামিয়ে দিলো । গরম গরম সেদ্ধ ভাত খেয়ে কুহেলি স্কুলে গেলো । টিফিন বানিয়ে দেওয়ার মতো ঘরে কিছু ছিল না । তাই টিফিন ছাড়াই কুহেলিকে স্কুলে যেতে হলো । ক্লাসে ভাল ছাত্রী না হলেও পড়াশুনায় গতানুগতিক । তবুও সে ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে । কুহেলি আর পাঁচটা মেয়ের মতো চঞ্চল বা ছট্‌ফটে নয় । নিজস্ব ঢঙে স্বাভাবিক ছন্দে জীবন যাপন করে । কো-এডুকেট স্কুল । ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে পড়াশুনা । গ্রামবাংলার মধ্যে হাই স্কুল । এতদিন জুনিয়র হাই ছিল । সম্প্রতি মাধ্যমিক পর্যন্ত উন্নীত । উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার ক্ষেত্রে ভরতপুর হাই স্কুল । তারপর কলেজ সালারে । কুহেলি সাইকেলে হাই স্কুল যায় । বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার । তবে গাঁয়ের রাস্তা হলেও পাকা রাস্তা । পাকা রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাতায়াতে সমস্যা নেই । কাঞ্চন নগরের অন্যান্য ছেলে-মেয়ে সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে । সুতরাং স্কুলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কুহেলির কোনো সমস্যা নেই । কুহেলি কুছুটা চুপচাপ ! কুহেলি ক্লাসের ছেলে-মেয়ের সাথে ততটা খোলামেলা নয় । নিজেকে সর্বদা গুটিয়ে রাখে । তবুও ক্লাসের মধ্যে বিবেক ছেলেটি তার ভাল বন্ধু ।
কুহেলির চালচলনে সীমাবদ্ধতা দেখে ক্লাসের বিবেক একদিন জিজ্ঞাসা করলো, “কিরে কুহেলি ! তুই আমাদের সাথে খেলতে যাস না কেন ? স্কুল মাঠে সবাই খেলতে গেলে তুই চুপচাপ ক্লাসে বসে থাকিস কেন ? তা ছাড়া তুই কেমন যেনো নিজেকে গুটিয়ে রাখিস ! এটা ঠিক নয় । সবার সঙ্গে হেসে-খেলে মিশবি । দেখবি তোর মন ভাল থাকবে ।“
উত্তরে কুহেলি বলল, “আমার ভাল লাগে না । আমি নীচু জাতের মেয়ে । সকলে আমার সঙ্গে মিশতে ততটা আন্তরিক নয় ! তাই চুপচাপ ক্লাসেই বসে থাকি । তবে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গাঁয়ের মাঠে খেলতে যাই । সেখানে গাঁয়ের সব বন্ধুদের সাথে খেলি ।“
“নীচু জাতের হলেও তুই তো মানুষ । তুই আমাদের বন্ধু । সুতরাং কখনও হীনমন্যতায় ভূগবি না । যতটা পারবি, মনের আনন্দে হৈচৈ করে সময়টা কাটিয়ে দিবি । এখন চল, মাঠে খেলবি !” বিবেক কুহেলিকে জোর দিলো ।
কুহেলির আচরণ সেইরকম ! মাঠে যাওয়ার হেলদোল নেই । তাই বিবেককে বলল, “তোরা মাঠে যা । আমি পরে আসছি ।“
অগত্যা বিবেক বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে শুরু করলো । বিবেক জানে কুহেলিদের পরিবার ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছে । তারা সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত । কুহেলির দাদুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় কঞ্চন নগরের ঘনশ্যাম ঘড়ামী । ঘনশ্যাম ঘড়ামীর পরামর্শে তাদের পরিবার কাঞ্চন নগরে বসবাস শুরু করে । সেই সময় ঝাড়খণ্ডে তাদের গ্রামে তীব্র অভাব অনটন শুরু হয়েছিল । তা ছাড়া গাঁয়ে শুরু হয়েছিল মহামারী । মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপে পড়ে গ্রামের মানুষেরা । সেই সময় বাঁচার তাগিদে কিছু মানুষ অসমের বিভিন্ন জায়গার চা বাগানে কাজের খোঁজে ছুটে গিয়েছিল । তারা আজও ঝাড়খণ্ডে ফেরেনি । কিন্তু কুহেলির দাদু ডেরা বাঁধে কাঞ্চন নগরে । জাতে সাঁওতাল হলেও বর্তমান সময়ে কেউ তাদের সাঁওতাল হিসাবে জানে না । গ্রামটা আগাগোড়া কায়েত পাড়া, তাই আশেপাশের গ্রামের মানুষজন জানে কাঞ্চন নগরে যারা বাস করে তারা প্রায় সকলে কায়েত । হাতে গোনা গোটা কয়েক পরিবার নীচু সম্প্রদায়ভুক্ত । অনেক খাটাখাটুনি করে কুহেলির দাদু কাঞ্চন নগরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে । মাঠে চাষের জমি বাড়ায় । কমপক্ষে পয়তাল্লিশ বিঘে চাষের জমি । কাঞ্চন নগরে আসার পর অতো সহজে তারা দাঁড়াতে পারেনি । কুহেলির দাদুকে অনেক ঝড়ঝাপ্টা পোহাতে হয়েছিল । দাদুকে প্রথমে গাঁয়ে গাঁয়ে মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়েছিল । তারপর ধান সেদ্ধ করে চাল তৈরীর ব্যবসা । আস্তে আস্তে তিন খানা গাই গরু কিনে দুধের ব্যবসা ! দুধ বিক্রি করে টাকা উপার্জন । প্রথমে মাঠে জলাশয় ঘেঁষে দশ বিঘে জমি । সেই জমিতে চাষ আবাদ করে কুহেলির দাদুর বাড়-বাড়ন্ত ।
কুহেলির ঠাকুমার চিকিৎসার জন্য বিঘে পাঁচেক জমি বিক্রি করতে হয়েছিল । দাদুর আগে ঠাকুমা বিদায় নিয়েছিলেন । দাদু বেঁচে থাকতে সানাই ও কানাইকে সমান ভাগে চাষের জমি ভাগ করে দিয়ে গেছেন । কানাই অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল । সানাই কিছুটা আলস্যের কারণে সংসারে উন্নতি করতে পারেনি । তার উপর পত্নী বিয়োগ হওয়ার পর সানাই ঘাম ঝরা পরিশ্রম একদম করে না । চাষের জমিতে যেটুকু ফসল হয় তাতেই সানাইয়ের সংসার ভালভাবে চলে যায় । যদিও তার অর্ধেক জমি ভাগে দেওয়া । সেখান থেকে অর্ধেক ফসল তার ঘরে ঢোকে । বাপ-বেটি তাদের ঠিকঠাক চলে যাচ্ছে । সেইজন্য সানাই বেশী খাটতে রাজি নয় । অন্যদিকে কানাই দিন রাত পরিশ্রম করে নিজে চাষ করার জন্য আরও কয়েক বিঘা চাষের জমি ইতিমধ্যে বাড়িয়েছে । তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে । সানাইয়ের আগে কানাইয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয় । কানাইয়ের ভরা সংসার । বাড়িতে চাষবাসের প্রচুর কাজকর্ম । কানাইয়ের দুই ছেলে স্কুলে যাওয়ার নাম করেনি । তাই তারা চাষের কাজে নিয়োজিত । ফলে কানাইয়ের স্বচ্ছল পরিবার ।
কাঞ্চন নগর গ্রামে জাতপাত নিয়ে কচলাকচলি তুঙ্গে । ছোট্ট একটি গ্রাম । অথচ মানুষের মধ্যে জাতপাত প্রথা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । গ্রামের অনেক অনুষ্ঠানে ঘড়ামি, জেলে, কামার, সাঁওতালদের পরিবারেরা নিমন্ত্রিত হয় না । বরং বলা চলে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের নিমন্ত্রণ করা হয় না । ছোঁয়াছুঁয়িতে জাত যেতে পারে । এই অছিলায় তাদের ব্রাত্য রাখে । এটা এখন সানাইদের কাছে গা-সওয়া ! তাই গ্রামের মানুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া সানাই মেশে না ।
তারপর…………
তারপর বিবেক লক্ষ্য করলো কুহেলি গুটি গুটি পায়ে মাঠে ঢুকছে । তখন বিবেক বল নিয়ে মাঠে খেলছিল । খেলা বন্ধ রেখে কুহেলিকে বলল, “এতক্ষণে তোর মাঠে আসার সময় হলো ।“
শুনে কুহেলি এক ঝলক হাসি দিয়ে বলল, “তোকে আগেই বলেছি স্কুলের খেলার মাঠে আসতে আমার ভাল লাগে না ।“
টিফিন টাইম শেষ । ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠলো । সবাই ক্লাসে ছুটলো । পরের ক্লাসটা ভুগোল মাস্টার মশাইয়ের । কিন্তু জানা গেলো ভুগোলের মাস্টার মশাই স্কুলে আসেননি । তাই ইংরেজির মাস্টার মশাই ক্লাস নেবেন । ইংরেজি কুহেলির প্রিয় বিষয় । ইংরেজি পড়তে ও লিখতে কুহেলির খুব ভাল লাগে । ক্লাসে স্যার ঢুকেই কুহেলিকে খোঁজ করলেন । বোর্ডে গরু নিয়ে দশ লাইন লিখতে বললেন । লিখতে গিয়ে দুটো বানান ভুল করলো কুহেলি । তার জন্য শাস্তি হিসাবে মাস্টার মশাই কুহেলিকে ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসতে বললেন । তারপর বানান দুটো সুন্দরভাবে স্যার বুঝিয়ে দিলেন । পরেরদিন সবাইকে “আমাদের দেশ” নিয়ে দশ লাইন লিখে আনতে বললেন । মাস্টার মশাই চলে গেলেন । তারপর আরও দুটি ক্লাসের পর স্কুল ছুটি হলো । ছুটির পর বাড়ি ফিরে কুহেলি দেখলো, পান্তা মাসি তাদের বাড়িতে । তার বাবার সঙ্গে গল্প মস্করায় মত্ত । বাবার সঙ্গে পান্তা মাসির ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা কুহেলির একেবারেই না-পসন্দ ! তাই পান্তা মাসির আগমন কুহেলির ভাল লাগলো না । সোজা ঘরে ঢুকে বইয়ের ব্যাগটা রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলো ।
সানাই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল, কুহেলি পান্তা মাসিকে পছন্দ করে না । তবুও মেয়ের অপছন্দকে আমল দিতে চাইনি সানাই । উল্টে সানাই ভেবেছিল, কুহেলিকে ভালভাবে বুঝিয়ে বললে পান্তা মাসির প্রতি তার রাগ কমে যাবে । পান্তা মাসি স্বেচ্ছায় বাড়ির কাজকর্ম করে দিচ্ছে । রান্না করে দিচ্ছে । যার জন্য তাদের সংসারে অনেকটাই সুরাহা ! তা ছাড়া পান্তা মাসি নিয়ম করে কুহেলিদের বাড়ি আসে । রান্না করা ছাড়াও ইদানীং দু-দণ্ড বসে কুহেলির বাবার সঙ্গে নানান বিষয়ে শলা-পরামর্শ করে । সানাই ক্রমশ ঘর গৃহাস্থলির ব্যাপারে পান্তা মাসির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে । অন্যদিকে কুহেলি ক্রমশ বড় হচ্ছে । সে এখন ক্লাস এইটে । সানাই চাইছে, তার মেয়ে পড়াশুনায় ভাল হোক । কুহেলির জন্য এখন তিনজন প্রাইভেট মাস্টার । পাশের গ্রাম সিসগ্রাম থেকে একজন অঙ্কের মাস্টার বাড়ি এসে পড়ায় । আর বাকী দুজন মাস্টারের বাড়ি গিয়ে কুহেলি পড়ে আসে । সাইকেলে যাতায়াত । সকালে একজন এবং সন্ধ্যাবেলায় অন্যজন । সকালে বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়াও বাংলাটাও শেখে । অন্যদিকে সন্ধ্যাবেলায় ইংরেজি । সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরার সময় কুহেলির সঙ্গে সানাই থাকে । প্রচুর পরিশ্রম করার জন্য কুহেলি ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলো । কুহেলির রেজাল্ট দেখে সানাই খুব খুশী । মেয়ের মাথায় হাত রেখে সানাই গর্বের সঙ্গে বলল, “তুই যতোদূর ইচ্ছা পড়বি । আমি তোকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবো । সমাজে তুই মাথা উঁচু করে বাঁচবি, আমি সেটা দেখে যেতে চাই ।“ এই কথা বলার পর সানাইয়ের চোখে জল ।
বাবা ! তুমি কাদছো ?
তোর মায়ের জন্য মন খারাপ । তোর মা বেঁচে থাকলে রেজাল্ট দেখে তোর মা খুব খুশী হতো । তারপর বিড়বিড় করে বলল, মেয়েটাকে জন্ম দিয়ে অকালে বিদায় নিলো । অথচ মেয়েটার বড় হওয়া দেখে যেতে পারলো না ! অদৃষ্টের কী নিষ্ঠুর পরিহাস !
নবম শ্রেণীতে ওঠার পর কুহেলির পড়াশোনার চাপ আরও বেড়ে গেলো । সংসারের কাজ করতে সময় পায় না বললেই চলে । স্কুল ও প্রাইভেট টিউশন নিয়ে কুহেলি নাজেহাল । তাই রীতিমতো ভীষণ ব্যস্ত । ঘরের কাজ ও চাষের কাজ একসঙ্গে চালাতে গিয়ে সানাইয়ের হিমসিম অবস্থা ! সানাই ঘরের কাজের জন্য একটু বেশীমাত্রায় পান্তা মাসির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লো । পান্তা মাসির সঙ্গে সানাইয়ের মেলামেশা নিয়ে গাঁয়ে গুঞ্জন অহরহ । সবচেয়ে বেশী ফ্যাসাদে পড়তে হচ্ছে কুহেলিকে । কুহেলির স্কুলের বন্ধুরা পান্তা মাসিকে নিয়ে নানান ধরনের তির্যক মন্তব্য করে । সেদিন স্কুলে যাওয়ার সময় গ্রামের কায়েত বাড়ির মনিটুসি বলে কিনা পান্তা মাসি তোর বাবাকে বিয়ে করে ঘর সংসার বাঁধতে চায় । স্কুল থেকে ফেরার সময় গাঁয়ের চৌধুরী বাড়ির মধ্য বয়স্ক ফুল কাকিমা কুহেলিকে জিজ্ঞাসা করলো, “সবজি বিক্রি করে বিধবাটা তোদের বাড়িতে কেন ঘোরাঘুরি করে ? সকালবেলায় ঢুকে বেলা গড়িয়ে গেলেও বাড়ি থেকে বের হওয়ার নাম করে না । আবার সেই সময় তোর বাবাও বাড়ি থেকে কোথাও বের হবে না । ব্যাপারটা কী ?” কুহেলির এইসব কথা একদম ভাল লাগে না । বাবার নামে কেউ কুৎসা রটাক, সেটা কুহেলির না-পসন্দ । অথচ পান্তা মাসিকে বলতেও প[রছে না, “তুমি আমাদের বাড়ি আসবে না ।“ বাবাকে জড়িয়ে পান্তা মাসিকে নিয়ে লোকের বলাবলি, গাঁয়ে আনাচে-কানাচে গুঞ্জন কুহেলির শিশু মনে খুব আঘাত করে । তবুও চুপচাপ থাকে একটাই কারণে, পান্তা মাসি বাড়িতে আসার জন্য ঘর-সংসারের কাজে অনেক সুরাহা ।
তারপর অনেকদিন কেটে গেলো ……………………
সামনে কুহেলির মাধ্যমিক পরীক্ষা । পড়াশুনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত । অন্যদিকে শীতলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা । তবুও ইতিমধ্যে কুন্তল বাড়িতে এসে কুহেলির পরীক্ষার খোঁজ খবর নিয়ে গেছে । আসলে শীতলদের বাড়ি থেকে কেউ মনেপ্রাণে চায় না , শীতল কুহেলির সঙ্গে মিশুক । শীতলেরা বনেদী পরিবার । শীতলের বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক । মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা । অনেক জমি জায়গা । তা ছাড়া কুহেলি সাঁওতালদের মেয়ে । বড় বংশের ছেলে হয়ে কেন সে নীচু বংশের মেয়ের সঙ্গে মিশবে ? উপরন্ত, তার মা নেই । মা না থাকলে শীতলদের পরিবারের ধারণা, মা-হারা মেয়ে খুব সহজে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে । সুতরাং শীতলদের পরিবার গোড়া থেকেই কুহেলির সঙ্গে শীতলের মেলামেশা বন্ধ করতে মরিয়া । কিন্তু শীতল এইসব নিয়ে একটুকু গুরুত্ব দিতে নারাজ । কুহেলির প্রতি পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক, শীতলের কুহেলিকে তার ভাল লাগে । তাই কুহেলির প্রতি শীতলের টান অফুরন্ত । তার মনের গহন গাঙে এখন শুধু কুহেলি বিরাজমান !
মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়লো ভরতপুর হাই স্কুলে । পরীক্ষা দেওয়ার সময় প্রতিদিন কুহেলির সাথে তার বাবা সঙ্গে যাচ্ছে । একা একা পরীক্ষার সময় কুহেলিকে ছাড়তে সানাই নারাজ । গরম ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া এবং সঙ্গে টিফিন বাক্স । বাড়ির পাহাড়ায় থাকছে পান্তা মাসি । ভরতপুরে সাইকেলে যাতায়াত । কাঞ্চন নগরের সকল ছেলেমেয়ের সাথে কুহেলির ভরতপুরে যাতায়াত । তাই যাতায়াতে কোনোরকম অসুবিধা হচ্ছে না । হৈচৈ করে পরীক্ষা দিতে যাওয়া । অন্যদিকে কুহেলির মাধ্যমিক পরীক্ষা খুব ভাল হচ্ছে । তবে ভুগোল পরীক্ষা ভাল দেয়নি । ইংরেজি প্রশ্নের ক্ষেত্রে পাঁচ নম্বর উত্তর দিতে পারেনি । অঙ্কেও তেমনি । চার নম্বর ছাড়তে হয়েছে । তাতে কুহেলির ধারণা সে স্টার মার্ক রাখতে সক্ষম হবে । পরীক্ষা দিয়ে কুহেলি খুব খুশী ।
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ ! কুহেলি এখন চাপমুক্ত ! অনেক হাল্কা ।
পরীক্ষার পর কুহেলির অফুরন্ত সময় ! অন্যদিকে শীতলও তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা খুব ভাল দিয়েছে । শীতল স্কুলে ভাল ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম । সুতরাং শীতলের পরীক্ষা ভাল হবে সেতা কুহেলি জানতো । পরীক্ষার পর শীতল এখন ঘন ঘন কুহেলির সাথে মিশতে শুরু করলো । পান্তা মাসি আবার কুহেলির সাথে শীতলের মেলামেশাটা পছন্দ করে না । পান্তা মাসির ভয়, “কুহেলি বড় হয়েছে । এখনও তার বোধবুদ্ধি সেভাবে পাকেনি । শীতলেরা বড় লোক । গরীব মানুষের মেয়ের সাথে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করে পরে তাকে চিনতে পারবে না । ঠিক মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়ার মতো । চা খাওয়া হয়ে গেলে মাটির ভাঁড় দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চম্পট । সেই ক্ষেত্রে কুহেলির সর্বনাশ ছাড়া ভাল কিছু হবে না । তাই পান্তা মাসি সানাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কুহেলি যেনো শীতলের সঙ্গে না মেশে ।“ এখানেই কুহেলির বড্ড রাগ ! পান্তা মাসি কেন কুহেলির ব্যক্তিগত জীবনের নানান ব্যাপারে নাক গলাবে ? সে এখন অনেক বড় । মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে । নিজেকে অনেক বুঝতে শিখেছে । নিজের ভাল-মন্দের ব্যাপারে এখন অনেক বেশী সজাগ ! সুতরাং তার জীবনের চলার পথের ক্ষেত্রে কেউ নাক গলাক, কুহেলির সেটা না-পসন্দ ।
সেদিন রবিবার । বাবা গিয়েছে সালারে । গ্রীষ্মের ধান চাষের জমিতে কীট-পোকা লেগেছে । তার জন্য কীট-নাশক ঔষধ দরকার । সেটা পাওয়া যায় সালারের কৃষি ভাণ্ডার দোকানে । ফিরতে বেলা গড়িয়ে যাবে । কেননা বাড়ি থেকে সাইকেলে ভরতপুর এবং তারপর ভরতপুর থেকে বাসে সালার । যদিও রাস্তা এখন ভাল । ভরতপুর থেকে সালার পৌঁছানো খুব বেশী সময় লাগে না । সালারে কাজ সেরে পুনরায় ভরতপুর । ভরতপুরে কিছু দোকান-বাজার রয়েছে । সেগুলো সেরে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী । তাই বিকালবেলা কুহেলি ভাবলো, শীতলের সঙ্গে ঘুরতে বের হবে । শীতল ভাল স্কুটি চালায় । ওর স্কুটিতে বাবলা নদী পর্যন্ত যাবে ।
ফোন করলো শীতলকে । শীতল ফোন পেয়েই প্রথমে তার পাল্টা প্রশ্ন, “তুই কী ফোন কিনেছিস ?”
তুই কী পাগল হয়েছিস, আমি ফোন কিনবো কোথা থেকে ?
তবে এই ফোন নম্বরটা কার ?
ফোন ও ফোন নম্বর দুটোই আমার । মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাবা কিনে দিয়েছেন । আগেই বলেছিলেন, মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেলে মোবাইল কিনে দেবেন । সেই কথা রাখতে, বাবা মোবাইলটা গতকাল আমাকে দিয়েছেন । মোবাইলটা বাবা বেশ কিছুদিন আগে বহরমপুর থেকে কিনেছিলেন । কিন্তু আমাকে বলেননি । পাছে আমার পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে । তাই মোবাইল কিনে সযত্নে ঘরে রেখে দিয়েছিলেন । বলতে পারিস, ফোন থেকে প্রথম ফোন তোকে করলাম । তবে একটা ফোন গতকাল করেছিলাম, সেটা মামার কাছে । বাবা বললেন, মামাকে একটা ফোন করে কথা বলতে । সেই সময় একমাত্র মামাকে একটা ফোন করেছিলাম । তিনি আমার ফোনের কথা শুনে খুব খুশী ।
এবার বলুন ম্যাডাম, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি ?
আমার সঙ্গে ঘুরতে যেতে হবে ।
ঘুরতে ? কিন্তু কোথায় ঘুরতে যাবি ?
তুই স্কুটি নিয়ে আসবি । স্কুটিতে বসে সিদ্ধান্ত নেবো, কোথায় যাবো ?
ঠিক আছে ম্যাডাম । এখন বিকেল তিনটে । আমি চারটের মধ্যে তোর বাড়ি হাজির হচ্ছি । রেডি থাকবি কিন্তু !
আচ্ছা বেশ ! আমি রেডি থাকবো ।
তারপর দুজনে লোহাদহের ঘাটে । বাবলা নদীর পারে । হরিনগরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় স্কুটি দাঁড় করালো । এবার শীতল ভাল করে কুহেলির দিকে তাকিয়ে দেখলো, কুহেলি আর সেই ছোট্ট কুহেলি নেই । এখন সে দস্তরমতো বড়োসড়ো মেয়ে । দেখতে কলেজ পাশ করা মেয়ের মতো দেখতে । কুহেলির চেহারার বাধন চিত্তাকর্ষক । অনেক লম্বা । হাসলে গালে টোল পড়ে । তাতে কুহেলিকে দেখতে বেশ লাগে । শীতল অবাক দৃষ্টিতে কুহেলির দিকে তাকিয়ে রইলো । শীতল কুহেলির উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না ।
শীতলের তাকিয়ে থাকা দেখে কুহেলি চোখের ইশারায় বলল, “ঐভাবে তাকিয়ে কী দেখছো ?”
শীতল কোনোরকম রাখঢাক না করে বলেই ফেললো, “আজ তোকে দেখতে ভীষণ ভীষণ ভাল লাগছে ।“
শীতলের মুখে কুহেলি তার রূপের প্রশংসা শুনে আবেগে উৎফুল্ল । অন্যদিকে লজ্জায় কিছুটা আড়ষ্ঠ ! তবুও তার মনের ভিতর শীতলের মিষ্টি কথাগুলি তোলপাড় করছে, “তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে !”
(চলবে)

Share This
Categories
কবিতা

পথ : শীলা পল।

আমার ভূষণগুলি একটি একটি করে খুলে দিলাম
অভ্যস্ত হতে হবে অলঙ্কার বিহীন এক নিরাভরণ মানুষ
একটু একটু করে জীবন থেকে চাওয়া পাওয়ার বোধ বিসর্জন দিতে পারলে তবেই তো মুক্ত মনে এক পাখি হতে পারব
সামনের পথ কতটা বাকী জানা নেই
অভ্যাস গুলো রপ্ত করে
চলতে হবে
সাথী পাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই এসব পথে সাথী থাকে না একাই চলতে হয় চলতে হবে
সঙ্গী তোমার মন
তাকে নিয়েই এই নতুন যাত্রা।
শেষ কোথায় জানা নেই
চলতে হয় চলতে হবে।

Share This
Categories
অনুগল্প

তাজা উপন্যাস : রাণু সরকার।

দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলো সেই কোন ছোট বেলায়,
পেটের দায়ে এই রাস্তা তৈরির কাজে লেগেছে মহিলাটি।

মাঝে মধ্যে চা খেত আর কাগজ পড়ত।

মহিলাটির কাগজ পড়া একদিন কন্ট্রাক্টটর বাবুর চোখে পড়ল-অন্যদের থেকে একটু আলাদা ধীর স্থির কাজ করে মন দিয়ে ফাঁকি নেই ওর কাজে।
কন্ট্রাক্টটর বাবু ডেকে বললো মনে হয় তুমি পড়াশোনা কিছু হলেও করেছো? মহিলা একটু হেঁসে মাথা নেড়ে বললো আর পড়াশোনা, পারলাম কই করতে সেও এক উপন্যাস।
তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম অনেক কবি সাহিত্যিকের কথা এবং অনেক জ্ঞানের কথাও, কন্ট্রাক্টর বাবু শুনে আশ্চর্য হলো।

যত কথা বলে তত চিনতে পারে আর মনে মনে ভাবেন এতো প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও এই কাজ করে গুণ আছে বলতে হবে। বাবু বললো
ওনাদের উপন্যাস এখন পড় না?
-আগে পড়তাম বাবু লাইব্রেরীতে গিয়ে, এখন খাবার আর সময় সবকিছুর সঙ্গে চলে লড়াই কি পড়বো বাবু।

একটু কষ্টের হাসি হেসে বললো, বাবু আমি নিচু ঘরের মানুষ পেটে ভাত নেই, ভাবছি পড়ে কি হবে- পেট তো ভরাবে না।
আমিই তো জলজ্যান্ত উপন্যাস-আর কি পড়বো, বরং আপনি আমায় নিয়ে কিছু লিখুন।

একবার যদি লিখতে শুরু করেন বাবু আমার উপন্যাস কোনদিন শেষ করতে পারবেন না।
লিখতে লিখতে অধৈর্য হয়ে পড়বেন কেনো না প্রতিদিনই আমার নতুন বাস্তব উপন্যাস জন্ম নিচ্ছে।
বাসি উপন্যাস পড়লে বাস্তবের তাজা উপন্যাসের কথা জানতে পারবেন না বাবু, বড্ড কঠিন আমার বাস্তব।
যদি পারেন আমার উপন্যাসের একটা বই ছাপা করুন লিখে,
একটু মৃদু হেসে চোখের কোলে জল মুছতে মুছতে রোজের মত কাজ সুরু করলো মহিলা।

Share This
Categories
গল্প

ভাগ্যহীনা : রাণু সরকার।

মেয়েটির সবে বড় বেলা হয়েছে সুরু, ঘুরে ঘুরে বেড়ায় যে যা দেয় তাই খায়,মাঝে মাঝে হোটেল বাসন মাজে ওখানেই থাকে। একদিন এক বৃদ্ধ এসেছে ঐ হোটেলে খেতে মেয়েটি টেবিল মুছছিলো দেখে ভীষণ কষ্ট হলো বৃদ্ধের।
বৃদ্ধের আবার দেখার কেউ থেকেও নেই। মেয়েটিকে দেখে বৃদ্ধের মায়া হওয়াতে মেয়েটিকে বললো আমার সাথে যাবি আমার বাড়ি? ভালো থাকবি খাওয়া পড়া পাবি আমার ঘরের সব কাজ করবি, মেয়েটি বললো যাবো তখন মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করলো তোর নাম কি?একটু হেসে বললো আমার নাম অভাগী বৃদ্ধ বললো এটা আবার কেমন নাম? হ্যাঁগো বাবু এটাই আমার নাম ।
আমার বাবটা মাটাকে ছেড়ে চলে গেলো সেই দুঃখে হয়তো মাটা মরে গেলো,
তখন থেকেই সবাই আমায় অভাগী বলে ডাকে,

থাক তোর কথা আর বলতে হবে না সব বুঝেছি তুই চল আমার সাথে।
অভাগী চলে এলো বৃদ্ধার বাড়ি বৃদ্ধা ভীষণ ভালোবাসতো মেয়েটিকে যা চাই তো সে তাই দিতো ধীরে ধীরে মেয়েটি বড় হলো। বৃদ্ধার একটু লোভ হলো মেয়েটির প্রতি। বৃদ্ধা ভীষণ অসুস্থ একরকম বিছানা নিয়েছে বলা চলে।মেয়েটির দোকান বাজার সব করতে হয় নিজের হাতে। এই দোকান বাজার যেতে আসতে একজনের সাথে তার ভালোবাসা হলো বৃদ্ধ সেটা জানতো না। একদিন বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে-এই অভাগী, তোর আগুন জোড়া হাত-
আমার বুকে একটু স্পর্শ করবি একটিবার কর না আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে
তোর উষ্ণতা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।
এই অভাগী,কোথায় গেলি আমার কাছে আয় না একবার।

উফ্! কুঁজোর সাধ জেগেছে চিৎ হয়ে শোবার,
আমার নারীত্বের এক টুকরোও ছিঁড়তে দেবোনা- আমি চলে যাবো এখান থেকে।
কোন চুলোয় যাবিরে মাগি? তুমি আমায় গাল দিচ্ছো? হ্যাঁ দিচ্ছি তো তোর জন্য এতো করলাম বড়ও করলাম আমার মুখে মুখে কথা?
তোর মুখে নুড়ো জ্বেলে দেবো,ছিলি তো রাস্তায়-এখানে তো হলি ডাগর ডুগোর কোন মরদ আছে তোর বল তো-আমায়?

মেয়েটি রাগ করে চলে যাচ্ছে, বলছে খাব না আর তোমার ভাত,এই আমি চললাম
তোমার মনে মনে এই ছিলো?
যাস নে অভাগী আমি এই আছি এই নেই-
আমার চাওটা কি খুব বেশি হলো?
উত্তর দে- কিনা দিয়েছি তোকে,যখন যা চাইছিস তাই পেয়েছিস।
অভাগী শুনোলো না চলে গেলো বুড়োকে একা রেখে-
তার নারীত্বের একটুরোও দেবে না,
মরদ ঠিক করা আছে যে তার।

কিছুদিন চললো মরদের সাথে ভরা যৌবন খেলা।মরদের সংসার আছে যে-মেয়টির নারীত্ব গেলো সে মা হতে চলেছে আর ভালো লাগছে না মরদের মারধর করে দিলো তাড়িয়ে।
এলো গর্ভবতী হয়ে বুড়োর দ্বারে,এসে দেখে বুড়ো মরে আছে, পাড়ার মানুষ তাকে থাকতে দেবে কেনো?
সেই আগের জায়গায় তাকে ফিরে যেত হলো।

Share This
Categories
কবিতা

অলীককল্পা : রাণু সরকার।

কল্পায় যাকে রেখেছিলে
তার সন্ধান পেয়েছো কি?

কপটাচারিণী রূপবতীর ছলে
পড়েছো বুঝেছি,
দেখছি একটা মালাও তো রেখেছো
তার জন্য!
খোপায় জড়িয়ে দেবে বুঝি!
সে কি তোমার কল্পাসৃষ্ট নাকি বাস্তব?

এনেছো মনে যেন হয় কুমোরটুলি
থেকে রূপসী সে নারী-
পারছোনা বুঝি নিশ্চল থাকতে
মিথ্যা কল্পায়সৃষ্টি করোনা তারে-
যে মালা গেঁথেছো বাস্তব হলে
দাও না তাকে পড়িয়ে !

নিজের হাতে করো প্রাণ প্রতিষ্ঠা!
শুভ কাজে কখনো করতে নেই দ্বিধা?
একবার অনুমতি নিয়ে নাও-সে যদি রাজি
থাকে!

ধীরে ধীরে করো অনুপ্রবেশ-
অন্তর সঞ্চারিত করে কর বিভূষণ
রেখোনা তারে কল্পায়!
মিষ্টি স্পর্শ করো শিল্পকুশলে
নাড়া দাও তার অনুভূতিতে
প্রাণ প্রতিষ্ঠা করো নিজের হাতে!

Share This
Categories
কবিতা

আত্মদর্প : রাণু সরকার।

আমরা সবাই জানি সংসারের সার
অলক্ষ্যে নির্দেশ করেন ঈশ্বর-
সবকিছু রেখে চলে যেতে হবে এও সর্বসাধারণের জানা
সময় যে দ্রুত ফুরায় সেও নয় অজানা।

তবে কেন সর্বসাধারণের আত্ম অহংকারের ঘোর,
দরিদ্র কে দিতে হলে কিছু করে হাতজোড়
রক্তের তেজ যতদিন আছে ততদিন বুঝি ক্ষমতার জোর।

মানুষকে- কেন ভাবতে পারে না মানুষ ঈশ্বর, কেন করিনা নিবেদন নর-নারায়ন?

দেখ আমরা আসন পেতে কত রকমের করি পূজন-
আমাদের বিশ্বাস প্রাণের প্রবাহ,
ঈশ্বরের ছোঁয়াতে কাটে হৃদয়ের দাহ।

আমাদের আবার কিসের বাড়ি কিসের ঘর
আমার আমিকে চিনতে কেটে যায় কত প্রহর।

শোন বলছি আমার কিছু কথা,
আমার আমিকে নিয়ে কোর না মাথা ব্যথা।

Share This
Categories
কবিতা

দৃষ্টিশক্তিহীন : রাণু সরকার।

আমারি শহরে রেললাইনের গা ঘেঁষে বসবাস করে
সংখ্যাতীত অশ্রুসিক্ত মানুষ,
আমি বেড়িয়ে ছিলাম অশ্রুহীন চোখ দেখবো বলে,
তা আর হলো না দেখা-ওদের নেত্রপল্লব বিরামহীন সিক্ত থাকে। আমি ওদের পাশে দাঁড়াতেই নিষ্পাপ কিছু প্রাণ আমায় ধরে- নয়নীর গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রুকণা-কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। ওদের কথা নীরবে শুনে গেলাম আমি বাকরুদ্ধ ।

এরাই তো ডোবায় পদ্ম ফোটায় তবুও এতোটুকু ক্লান্তি নেই ওদের মনে, চোখের জল সাথে নিয়ে শিটা ধরা দাঁতে করুণ এক গাল হাসি। হয়তো কষ্ট করে কয়েক লাইন বিদ্যা করেছে মুখস্থ – তবে সবাই নয় কেউ কেউ, লজ্জায় বা অর্থের অভাবে কিংবা ছোট ছোট ঝুপড়ির পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে থাকতে হয় যে-তাই আর হলো না বিদ্যা মুখস্থ করা।

তোমরা যারা ডোবায় ফোঁটাও পদ্ম আমার জন্য রেখে দিও হাজার ফোঁটা অশ্রুকণা-আমার অস্পষ্ট দৃষ্টি যদি
স্পষ্ট হয়ে নিবেদনের উপযুক্ত হয় তবে নিজেকে স্নেহধন্যা মনে হবে, আমি হাত প্রসারিত করে আছি তোমাদের জন্য।

Share This
Categories
কবিতা

অরণ্যে রোদন : রাণু সরকার।

এক বৃদ্ধ বাবা রিক্সা চালায় নিজের রুটিরুজির জন্য,
চলার পথে মনে মনে কষ্টের দর্পণ বিক্রয় চলে-
কিন্তু সেই আরশিতে হিংস্রের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে না,
এতোটাই পাষাণ তার ঔরসজাতরা।

বৃদ্ধ বাবার কান্নাটা তো অরণ্যের রোদন।

যৌবনের উদযাপন সমাপ্তি-
এই বয়সে এসে মা-বাবা দু’ভাগে হয় বিভক্ত।
কিন্তু পারেনি বিভক্ত করতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে,
তারা দূরে অনেক দূরে চলে যায়, লোকালয়ের আড়ালে।

Share This