Categories
উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (সপ্তদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

অনেক দিন আগের ঘটনা । পল্লব একদিন ঘোতনের হাতে বিশ্রীভাবে নিগৃহীত হয়েছিল । মারামারির ঘটনাটা ঘটেছিল সালারে । সেই থেকে ঘোতনের উপর পল্লবের রাগ জমা ! সেই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর পল্লব রসুলপুরে তার মামার বাড়ি চলে আসে । মামা রসুলপুরের বড় চাষি । এখানে পল্লবের ব্যবসা করার ইচ্ছা । কিন্তু মামা ব্যবসার ব্যাপারে পল্লবকে কিছুই ব্যবস্থা করে দেননি । যার জন্য বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে যেখানে সেখানে পল্লবের আড্ডা । অর্জুন গাছ তলার আড্ডাটা দীর্ঘদিনের । অর্জুন গাছ তলায় আড্ডা দেওয়ার পুরানো লোকজন এখন আর কেউ নেই । রসুলপুরে আসার পর পল্লব অর্জুন গাছ তলার আড্ডাটা পুনরায় চালু করে । পল্লবের নজর পড়েছিল লতার উপর । মনে মনে লতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত । সেই লতার সঙ্গে ঘোতনকে দেখতে পেয়ে পল্লব নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে । রাগে গজরাতে থাকে । তার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে ঘোতনের ফষ্টিনষ্টি, পল্লব সহ্য করতে পারে না । লতা ভালবাসুক বা না-ভালবাসুক, কিন্তু পল্লব তাকে ভালবাসে । লতার পাশে ঘোতনকে দেখে তার আরও রক্তচক্ষু ! সে জানে, ঘোতন এখানে নতুন । সুতরাং এই সুযোগ, পুরানো রাগের বদলা নেওয়ার । তাই কিছু দুষ্কৃতিদের নিয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো লতা ও ঘোতনের উপর ।
রিক্সা থেকে রাস্তার পাশে পড়ে গেলো দুজনে । অন্যদিকে বাজারের ব্যাগ ছিটকে পড়লো পাকা রাস্তার উপর । বাজারের সবজি যেমন টমেটো, পিয়াঁজ, কাঁচা-লঙ্কা, ইত্যাদি রাস্তার উপর গড়াগড়ি । এমনকি মাছ, মাটন রাস্তায় গড়াগড়ি । লতা এমনভাবে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ল ঘোতন যেখানে পড়েছে ঠিক তার পাশে । লতার শরীরে তেমন চোট লাগলো না । কিন্তু বা-হাতে প্রচণ্ড আঘাত পেলো ঘোতন । যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ! তার উপর চার-পাঁচ জন দুষ্কৃতি ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার উপর । ঘোতনকে এলোপাথারি ঘুষি । হাতের যন্ত্রণার জন্য ঘোতন ঠিকভাবে পাল্টা আক্রমণ করতে পারছে না । নিমেষেই পল্লবদের কিল-ঘুষিতে ঘোতন কাহিল ।
মার খেয়ে ঘোতনের মর্মান্তিক অবস্থা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লতা সহ্য করতে পারলো না । একটু দূরে গোটা ইট দেখতে পেয়ে ছুটে ইটটা নিয়ে, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোজা পল্লবের মাথায় আঘাত ! ইটের আঘাতে পল্লবের মাথা ফেটে রক্ত ! প্রচুর রক্তক্ষরণ ! ততক্ষণে বাজারের অনেক মানুষ ভিড় জমিয়েছেন । ইত্যবসরে পাড়ার সুনীল কাকা মারামারির স্পটে হাজির । তাঁর শক্ত-সামর্থ চেহারা । এতক্ষণ পল্লবদের মারপিটের ভিডিও করছিল । ঘোতনকে অন্যায়ভাবে কীভাবে দুষ্কৃতিরা মারছে তার পুরো ভিডিও সুনীল কাকা তৈরী করে রাখলো । এবার মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে তাঁর বা-হাতের মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে পল্লবের সাগরেদদের এলোপাথারি আঘাত । সুনীল কাকা লতাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাওয়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা নড়েচড়ে উঠলেন । তাঁরাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন লতাদের বাঁচাতে । হঠাৎ জন-রোষ দেখে দুষ্কৃতিরা পালিয়ে বাঁচে ।
লতা ঘোতনকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালে । হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্র প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাতের এক্স-রে করলো । এক্স-রে রিপোর্ট এবং শারীরিক স্থিতি দেখে হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বললেন, “ভয়ের কারণ নেই । হাতে চোট পেয়েছে । মলম দিচ্ছি । গরম সেক ও মলম লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে ।“ তারপর ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরলো লতা ও ঘোতন ।
কঙ্কাবতীকে ঘোতন জানিয়ে দিলো, তার বাড়ি ফিরতে দুদিন দেরী হবে । শরীরের ঘটনাটা কঙ্কাবতীর কাছে গোপন রাখলো ।
অনেক ভেবেও ঘটনার প্রেক্ষাপট লতা বুঝে উঠতে পারছে না । তবে সে একটা জিনিস ভালভাবে বুঝেছে, ঘোতনের সঙ্গে পল্লবের সম্পর্ক মধুর নয় । লতা কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছিল, কতকগুলি ছেলে-ছোকরা একত্রে অর্জুন গাছ তলায় বসে হাসি মশকরায় মত্ত থাকে । বিশেষ করে তাকে দেখলে তাদের হাসি, ঠাট্টা, তামাশার উচ্ছৃঙ্খলতা অনেক বাড়ে । তবে এগুলো লতা পাত্তা দেয় না । কেননা এইসব ঘটনা তার জীবনে আকছার ঘটে । সবগুলি পাত্তা দিলে অনর্থক ঝগড়া তার পিছু হটবে না ।
হাসপাতাল থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে আছে ঘোতন । ঠিকমতো মলম লাগানো ও গরমের সেক দেওয়ার পর অনেকটা সুস্থ । লতার ঘরে ঢোকার আওয়াজ পেয়ে ঘোতন বিছানায় উঠে বসলো । লতার দিকে তাকিয়ে ঘোতন বলল, “অহেতুক তোমাদের বিরক্ত করছি ।“
“এটা কোনো বিরক্তির ব্যাপার নয় ! আমি ভাবছি, পল্লব পুনরায় আক্রমণ করতে পারে । আপনার এখানে থাকাটা নিরাপদ হবে কিনা বুঝতে পারছি না ?” লতা তার উদ্বিগ্নতার কথা জানালো ।
আমি দুদিন বাদে বাড়ি ফিরব । বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি । দুদিনে মোটামুটি শারীরিক দিক দিয়ে নিশ্চয় চাঙ্গা হয়ে উঠব । তুমি অযথা চিন্তা করো না । ঐসব কাপুরুষের দল আমাকে কিচ্ছু করতে পারবে না !
“কিচ্ছু করতে পারবে না” এই কথাটা আর বলো না । সেদিন পল্লবের দল মিলে তোমাকে যেভাবে নাকানি-চোবানি খাওয়ালো তাতে আমি এখনও সন্দিহান, বেটা সুযোগ পেলেই আবার ছোবল মারবে । অথচ তুমি বলছো, পল্লব কিচ্ছু করতে পারবে না ।
সেদিন আচমকা আক্রমণ করায় ও তুমি সঙ্গে থাকায়, আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম । সেটা আর কোনোদিন হবে না ।
থাক ! বীর-পুরুষের মতো কথা এখন ছাড়ো । কী খাবে বলো ?
এখন একটু চা পেলেই খুশী ।
লতা চা তৈরী করতে ঘরে ঢুকলে, রাগে ঘোতনের চোখ লাল হয়ে উঠলো । বদলা না নিতে পারলে তার মাথা ঠিক রাখতে পারছে না । পল্লবের এত সাহস তাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে ! এর যোগ্য শিক্ষা পল্লবকে না দিতে পারলে তার রসুলপুর ছাড়লে চলবে না । তাতে ভবিষ্যতে যা হয় হবে । ইতিমধ্যে এখানে চাউর হয়ে গেছে, ঘোতন দুর্বল । অতর্কিতে হানা দেওয়ার জন্য ঘাবড়ে গিয়েছিল ঘোতন । ঘোতন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি পল্লব রসুলপুরে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে । উপরন্ত তার সঙ্গে লতা ছিল । লতাকে আগে বাঁচানো দরকার ! লতাকে বাঁচাতে গিয়ে ঘোতন বেকায়দায় পড়ে গেলো । নতুবা স্পটে পল্লব ও তার দলবলদের উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তো । এই মুহুর্তে তার শরীর অনেক চাঙ্গা । তাই ঘোতন চাইছে, সুযোগ পেলেই পল্লবদের উপর যে কোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে । পল্লবদের এলোপাথারি উত্তম-মধ্যম দিতে পারলে যদি তার মনের জ্বালা কিছুটা মেটে !
“বাবু, এবার চা খেয়ে নড়েচড়ে বসেন ।“ মুচকি হেসে লতা ঠাট্টা করে কথাগুলি ঘোতনকে বলল ।
চায়ে চুমুক দিয়ে ঘোতন লতাকে আড়ষ্টতার সঙ্গে বলল, “চা খেয়ে একটু রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসি । অনেকক্ষণ থেকে ঘরে শোওয়া ! ঘোরাঘুরি করলে শরীরটা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে ।“
যথা আজ্ঞা !
আর একটা কথা, দুপুরের খাবার এখনও খাওয়া হয়নি । তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে । তুমি ফিরে এলেই খেতে বসবো ।
যথা আজ্ঞা !
তবে ভাল করে শোনো, বাজারের দিকে যাওয়া চলবে না । বিশেষ করে এখন কিছুতেই যাবে না । কেননা বাজার যাওয়ার রাস্তার পাশে অর্জুন গাছ তলায় পল্লবদের আড্ডা ! তোমাকে দেখলে তারা পুনরায় তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে !
“মাথা খারাপ ! আমি ঐ রাস্তার দিকেই যাবো না, বরং উল্টোদিকে যাবো ।“
একদম ঠিক । উল্টোদিকে যাওয়াই তোমার শ্রেয় ! তবে তোমাকে একা ছাড়তে আমার ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না ? বেশীদূর যাওয়ার দরকার নেই । কেননা খাবার রেডি ।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বোঝাতে চাইলো, লতার কথা অক্ষরে অক্ষরে সে পালন করবে !
বেলা তখন প্রায় দু-টো । ঘোতন এদিক-ওদিক কোনোকিচ্ছু ভাবলো না । চা খেয়ে লতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা অর্জুন গাছ তলায় । অর্জুন গাছ তলায় ঢোকার আগে ঘোতন লক্ষ্য করলো তিনটে বন্ধুর সঙ্গে পল্লবের তুমুল বাকবিতাণ্ডা !
চারজনের গতিবিধির অবস্থানের পরিস্থিতি অবলোকন করে ঘোতন মানসিকভাবে নিজেকে তৈরী করে নিলো । যেভাবে হোক আজ তাকে বদলা নিতে হবে । বদলা নেওয়ার এটাই মোক্ষম সময় । উপযুক্ত সময়টাকে ঘোতন কাজে লাগাতে চায় । যতক্ষণ বদলা না নিচ্ছে ততক্ষণ ঘোতনের মনের ভিতরের রাগের জ্বালা থামছে না । ভর দুপুরে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই । সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘোতন । অতর্কিতে আক্রমণ করে প্রথমেই পল্লবকে ঘায়েল করলো । তারপর পায়ের লাথি দিয়ে অন্য তিনজনকে কুপোকাত ! নিমেষের মধ্যে চারজনকে ভূপতিত করে ঘোতন পল্লবকে চেঁচিয়ে বলল, “আমার বিরুদ্ধে লাগা । ভবিষ্যতে লতার দিকে তাকিয়েছিস্‌ তো, সব কটাকে মেরে অজয় নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তবেই আমার শান্তি ! ভেবেছিলি, সালার থেকে রসুলপুরে পালিয়ে এসে বেঁচে যাবি ? সেটা হবার নয় । আমি বেঁচে থাকতে তোর সেই আশায় বালি !”
ইতিমধ্যে অন্য তিনজন সেখান থেকে উধাও ।
পল্লব পিছু হটতে হটতে চিৎকার করে বলল, “আজ তোকে যদি থানার লক-আপে ঢোকাতে না পারি তবে আমার নাম পল্লব না !”
পল্লবের কথা শুনে ঘোতন ছুটে গিয়ে তাকে জোরে লাথি, “আমাকে লক-আপে ঢোকাবি ? আগে তুই বাঁচবি কিনা সেটা দ্যাখ্‌ ? তারপর আমাকে লক-আপে ঢোকাবার চিন্তা !” লাথি খেয়ে আবার রাস্তার উপর পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো । তার সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই ।
পথ চলতি মানুষের মধ্যে গুঞ্জন ! পুলিশ আসছে ।
পুলিশ দেখেই ঘোতন সেখান থেকে ছুটে বড় রাস্তায় । একটা খালি লরি মেমারির দিকে যাচ্ছিল । হাত দেখিয়ে লরিকে দাঁড় করালো ঘোতন । সেই লরিতে উঠে সে জানতে পারলো, লরিটা যাচ্ছে কাটোয়া । মেমারী, মন্তেশ্বর, দাঁইহাট হয়ে কাটোয়া যাবে । বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে । কাটোয়া পৌঁছাতে রাত্রি হয়ে যাবে । রাত্রি হলেও সমস্যা নেই । ঘোতন এই মুহূর্তে পুলিশের জেরা থেকে অন্তত বাঁচলো ।
ফোনে লতাকে ঘোতন জানিয়ে দিয়ে বলল, “এইমাত্র বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি ফিরছি । বাড়িতে মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ । সুতরাং আমি বাড়ি ফিরতে বাধ্য হলাম ।“ “পল্লবদের মেরে শায়েস্তা করেছে” সেই কথা কিছুতেই লতাকে বলল না ।
ফোনে কথা শেষ হতেই লতাদের বাড়িতে পুলিশ এসে হাজির । সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । পুলিশের পেছনে পল্লব এবং তার কয়েকজন সাগরেদ । সব কটাকেই লতার চেনে ও জানে । পল্লবের সারা শরীরে রক্তের দাগ ! পল্লবের শরীরে রক্তের দাগ দেখে বুদ্ধিমতী লতা সহজেই বুঝতে পারলো, এটা বীরপুরুষ ঘোতনের কাজ । সঙ্গে সঙ্গে লতা পুলিশকে মোকাবিলা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে নিলো !
লতাকে পুলিশ বললেন, “আপনাদের বাড়ির আত্মীয় ঘোতনকে ডেকে দিন ?”
“স্যার শুনুন ! ঘোতন আমাদের আত্মীয় নয় । আত্মীয়তা করতে তিনি এসেছিলেন । কিন্তু আপনাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পল্লব এবং তার সাগরেদরা ঘোতনকে এমনভাবে মেরেছে, মার খেয়ে বেচারা হাসপাতাল থেকে সোজা বাড়ি । এতক্ষণ সম্ভবত বাড়ি পৌঁছে গেছে । আর সেই পল্লবদের নিয়ে আপনারা ঘোতনের খোঁজ করছেন । আমি ভাবছি, পল্লবদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত রিপোর্ট জমা দেবো । ঘোতনকে মারার অপরাধে পল্লবদের ধরে লক-আপে ঢোকাতে হবে !” বেশ জোরের সঙ্গে সওয়াল করলো লতা ।
লতার কথা শুনে থানার পুলিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! কী উত্তর দেবে বুঝতে তাঁরা রীতিমতো ধন্দে ?
পল্লব এবার এগিয়ে এসে লতার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, “তুমি পুলিশের কাছে এইসব আজেবাজে অভিযোগ করছো, তার কোনো প্রমাণ আছে ?”
বেশী ভাট বকো না । লতা বিনা প্রমাণে ভাট বকে না । নির্লজ্জ বেহায়ার মতো তড়পিয়ো না । ঘোতনকে অন্যায়ভাবে মেরে আবার বড় বড় কথা ! এবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে লতা বলল, “স্যার, পল্লবকে অ্যারেস্ট করুন ?”
আপনার মুখের কথায় কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না । উপযুক্ত প্রমাণ চাই ।
প্রমাণ আমি দিচ্ছি । তার আগে বলুন, বিনা প্রমাণে কোন্‌ সাহসে একটা নিরপরাধ মানুষকে হাত-কড়া পড়াতে চলে এলেন ? পল্লব আপনাদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে । আমরা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ । এভাবে কারো কথায় বিনা প্রমাণে বাড়িতে হানা দিয়ে সমাজের কাছে আমাদের অপদস্ত করবেন না, স্যার !
পুলিশ নীরব !
সুনীল কাকা সমস্ত মারপিটের ভিডিও পেন-ড্রাইভে তুলে সেটা একটু আগেই লতাকে দিয়ে গিয়েছিল । তাই বাঁচোয়া । ঘরের ভিতর ঢুকে পেন-ড্রাইভ এনে পুলিশের হাতে দিয়ে লতা বলল, “চালিয়ে দেখুন । এখানে থেকে সব প্রমাণ পেয়ে যাবেন ।“
ল্যাপটপ চালিয়ে পুলিশ স্পটে ঘটনাটা দেখতে শুরু করলেন । ভিডিও চলাকালীন পেছন থেকে পল্লব ও তার সাগরেদরা সেখান থেকে উধাও ।
পল্লবদের পালাতে দেখে লতা পুলিশকে বলল, “ধরুন স্যার, ওরা পালাচ্ছে !”
দুজন পুলিশ কন্সটেবল ও সাব-ইন্সপেক্টর পল্লবদের পেছনে ছুট্‌ ! তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে লতাদের চোখের দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে গেলো । লতা তারপর বেমালুম চেপে গেলো । পল্লবদের ব্যাপারে থানা-পুলিশ আর করলো না । লতা পরে জানতে পারলো, ঘোতন পল্লবদের উচিত শিক্ষা দিয়ে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেছে । তখনও সে বাড়ি পৌঁছায়নি । সুতরাং লতা আর পুলিশ কেসে নিজেকে অহেতুক জড়াতে চাইলো না ।
তারপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেলো । কঙ্কাবতী আর ছেলেকে রসুলপুর পাঠিয়ে বিপদ ডেকে আনতে চাইলো না । ব্রজেশ্বরবাবুকে প্রস্তাব দিলো, লতাকে সালারের মাসির বাড়ি রেখে বিয়ের পর্ব সারতে । সেই মোতাবেক বিয়ের কথাবার্তা এগোতে লাগলো ।
বৈশাখ মাসের ১৫তারিখে বিয়ের দিন পাকা ।
বাড়িতে ছোট ছেলের বিয়ে । তাই কঙ্কাবতীর ধুমধামের মাত্রা বেশী । শহর থেকে সানাইয়ের বাজনা । ব্যাণ্ড-পার্টির বাজনা এলো সালার থেকে । নিমন্ত্রিত লোকের সংখ্যা অনেক । মিঁয়া ও বাজারসৌ স্টেশন চত্বরের আমন্ত্রিত মানুষের সংখ্যা বেশী । কঙ্কাবতীর আবার লতাকে খুব পছন্দ । খবর নিয়ে জেনেছে, লতা খুব সাহসী মেয়ে । ঘোতনের জীবনে এমনই ডানপিটে একটা মেয়ে দরকার । কঙ্কাবতীদের বাড়িতে আনন্দের সীমা নেই । তার সব মেয়ে জামাই উঠে-পড়ে ঘোতনের বিয়ের কাজে ব্যতিব্যস্ত ।
বৈশাখ মাসে ঝড়-বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে প্যাণ্ডেল । প্যাণ্ডেলও সেভাবেই পোক্তভাবে তৈরী । ইলেক্ট্রিক লাইটের জমকালো আলোর রোশনাই । শহর থেকে রান্নার ঠাকুর । খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কঙ্কাবতী কোনো আপোসে যেতে রাজি নয় । তাই সমস্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কঙ্কাবতী নিজে । মিঁয়ার মানুষ টের পাচ্ছেন, অনেকদিন পর গ্রামে জমজমাট বিয়ের আসর ।
ঘোতন ও লতার বিয়ে মহাধুমধামে সম্পূর্ণ হলো ।
 (চলবে)

Share This
Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, ষষ্ঠদশ পর্ব) : দিলীপ রায়।

কঙ্কাবতী কিছুতেই বুঝতে পারছে না, এত তাড়াতাড়ি কী করে রসুলপুরের মেয়ে লতাকে ঘোতন পছন্দ করলো ! খবরাখবর নিয়ে কঙ্কাবতী জানতে পেরেছে লতা খুব ডানপিটে । আরও জানতে পেরেছে, মাসীর বাড়িতে থেকে সালার কলেজে লতার পড়াশুনা । ব্রজেশ্বরবাবু মেয়ের চালচলনের ঠাটবাট দেখে কোনো ঝুঁকি নেননি । তাই লতাকে মাসী বাড়ি রেখে পড়ানো । সালার কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার ডিগ্রি করার লতার খুব ইচ্ছা ছিল । কিন্তু বাড়ি থেকে সেভাবে সাড়া পায়নি । তাই তার উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা থেমে গেছে । লতা মেয়ে হিসাবে ঘোতনের উপযুক্ত । কিন্তু কঙ্কাবতীর খটকা অন্য জায়গায় । নাদনঘাট থেকে ভাল একটা সম্বন্ধ এসেছিল । সেই মেয়েটা যেমন শিক্ষিত, তেমনি মার্জিত । মেয়ের বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক । ভদ্র পরিবার । মেয়েটি ফর্সা না হলেও তাকে পুরোপুরি শ্যামলা বলা যাবে না । কঙ্কাবতী যতটুকু জেনেছিল, মেয়েটির স্বভাব-চরিত্র যেমন ভাল তেমনি মেয়েটি কর্মঠ । পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ শিখত । মেয়েটির প্রতি কঙ্কাবতীর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল । কিন্তু ঘোতন এককথায় নাকচ করে দিয়ে বলেছিল, “মেয়েটি কালো ।“ অথচ মেয়েটির বাবা নাদনঘাটের বিশিষ্ট মানুষ । সেখানকার মানুষ তাঁকে সমীহ করে চলে । কঙ্কাবতীর দৃষ্টিতে লতার চেয়ে নাদনঘাটের মেয়েটি ঘোতনের জীবনসঙ্গিনী হিসাবে বেশী উপযুক্ত ।
যাই হোক ঘোতনের ইচ্ছা অনুসারে লতার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হলো । কিন্তু গোঁ ধরলো ঘোতন । তার ইচ্ছা, দোকানটা আরও সাজিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে । অন্যদিকে বিয়ে দেরীতে হোক, লতা তার ঘোরতর বিরোধী । তাই ঘোতনের মতলব জানার পর লতা সরাসরি ঘোতনের দোকানে এসে হাজির । বর্ধমানের রসুলপুর থেকে মিঁয়া স্টেশন পৌঁছানো ভীষণ ঝকমারী । তবুও বর্ধমান, কাটোয়া হয়ে দুপুরের আগে সোজা ঘোতনের দোকানে । লতাকে দেখে ঘোতন অবাক ! কৌতুহলি দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ লতার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
ফ্যালফ্যাল করে তাকানো দেখে লতার ঝটিকা প্রশ্ন, “আপনি জীবনে কোনোদিন মেয়ে দেখেননি ? ঐভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন ? অনেক দূর থেকে এসেছি । কোথায় আমাকে বসতে বলবেন কিংবা খাবার এনে খাওয়াবেন, সেসব না করে হাঁদার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন !”
প্রশ্নের জেরবারে থতোমতো খেয়ে ঘোতন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! ভ্যাবাচেকা খেয়ে তড়িঘড়ি করে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “বসুন ম্যাডাম ।“
উঁহু, ম্যাডাম নয় । আমি আপনার বৌ হতে যাচ্ছি, সুতরাং শুধুমাত্র লতা । তবে শুনুন, আমি বসতে আসিনি ?
“তবে ?” প্রশ্ন করেই আবার লতার দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে রইলো ।
এবার কিছুটা ধমকের শুরে লতা ঘোতনকে বলল, “মশাই, আর তাকাতে হবে না । কিছুদিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে ঘর বাঁধতে স্থায়ীভাবে আসছি । কিন্তু …?”
আবার কিন্তু কেন ?
আমাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসাটা দেরী করলে চলবে না । পুজোর পরে অগ্রহায়ণ মাসেই আমাদের বিয়ে হবে এবং সেটা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহেই । আমি পঞ্জিকা দেখে এসেছি । ৪ঠা অগ্রহায়ণ বুধবার, বিয়ের ভাল দিন । ঐদিন আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে বলুন । অন্যথা হলে, আমার দিকে ফ্যালফ্যাল তাকানোর আর সুযোগ পাবেন না । কথাটা মনে রাখবেন । তারপর দোকান ঘরের দিকে তাকিয়ে লতা বলল, “ঘরটা এত নোংরা কেন ? একটু গায়ে-গতরে খেটে পরিষ্কার রাখতে পারেন তো ?”
কী যেনো বলতে যাচ্ছিলো ঘোতন । তাকে থামিয়ে দিয়ে লতা বলল, “আমার দরকারি কথা বলা শেষ ! এবার আমি বাড়ি চললাম ।“
ঘোতন এতক্ষণ লতার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তার চোখা-চোখা কথাগুলি শুনছিলো আর ভাবছিলো মেয়ে তো নয়, পুরোমাত্রায় থানার দারোগা ! রাখঢাক নেই । সোজাসাপ্টা কথা সোজাসাপ্টাভাবে বলার অভ্যাস । সুতরাং এই মেয়ে নিয়ে তার কপালে কী আছে, কে জানে ? ঘোতনের মতো ঠাটবাট ছেলেকেও ঘোল খাওয়াতে লতা একাই একশ ! তারপর লতার মুখে চলে যাওয়ার কথা শুনে ঘোতন আরও ঘাবড়ে গেলো । কী মেয়েরে বাবা ! রসুলপুর থেকে বয়স্থা মেয়ে একা সোজা মিঁয়া স্টেশন পৌঁছানো, প্রচণ্ড ধকলের ব্যাপার । তার উপর দিনের দিন ফিরে যাওয়ার চিন্তা ! অতোটা পথ ফিরে যাওয়া খুবই কষ্টকর । যাতায়াতের ঝক্কি-ঝামেলা ভীষণ সাংঘাতিক ! লতার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ঘোতন এবার বেঁকে বসলো এবং বলল, “বাড়ি ফিরে যাওয়া হবে না । আজ এখানে থাকতে হবে । তার আগে আপনার খাওয়া-দাওয়া ।“
বিরবির করে লতা বলল, “ক্যাবলাকান্তের মুখে বোল ফুঁটেছে ।“
কী বলছেন বিরবির করে ?
বলছি, থাকার জন্য আসিনি । আর থাকলে লোকে আপনাকে দুষবে এবং বলবে, “বিয়ের আগে মেয়েটাকে বাড়ি ডেকে এনে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করছেন ! তাতে আপনার সম্মানহানি ঘটবে । সুতরাং মশাই, এবার আমার বাড়ি ফেরার পালা !”
উঁহু আপনাকে আমি একা ছাড়ছি না ।
তাহলে কী আপনি আমার সঙ্গে যাবেন ?
দরকার হলে যাবো ।
রসুলপুর, অনেক দূর । কথাটা ভেবে বলছেন তো ?
ঘোতন পড়েছে ফ্যাসাদে । অতো সাতপাঁচ ভেবে কথাটা বলেনি । এখন সত্যিই যেতে হলে রাতে বাড়ি ফেরা অসম্ভব । তবুও ঢোক গিলে বলল, “ম্যাডাম, আমি আপনার সঙ্গে যাবো ।“
বেশ ! রেডি হয়ে নিন ।
মিঁয়া স্টেশন থেকে তিনটে কুড়ির ট্রেন ধরে প্রথমে কাটোয়া । সেখানে নেমে বর্ধমানের বাস ধরার আগে বাস স্ট্যান্ডে দুজনে দুটো কেক্‌ কিনে গরম চা খেলো । বর্ধমান থেকে সন্ধ্যা ৭টায় বাস পেলো । বর্ধমান – বিষ্ণুপুর বাস । সোনামুখী হয়ে যাচ্ছে । সেই বাসে রসুলপুর ।
ঘোতন বাড়ি ফিরতে চাইলে লতা নাছোড়বান্দা, তার বাড়ি ফেরা হবে না । এতক্ষণ দুজনে খুব কাছাকাছি একসঙ্গে সফর করার জন্য তাদের কথাবার্তায় “আপনি” উঠে গিয়ে এখন শুধু “তুমি” । তাই একরকম জোর দিয়ে লতা বলল,”তোমাকে আমি ছাড়ছি না । ভয় নেই, আমরা এক ঘরের ভিতর শুয়ে তার কাটাবো না । তার গ্যারান্টি থাকলো ।“
অগত্যা ঘোতন লতাদের বাড়ি থাকার সিদ্ধান্ত নিলো ।
রাত্রিবেলায় খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন ! দেশী চিকেন, পুকুরের কাতলা মাছ ! রসুলপুরের বাস স্ট্যান্ডের ঘনাদার মিষ্টির দোকানের গরম গরম রসগোল্লা । আরও কতো কী !
তারপর…………?
তারপর পরেরদিন ভোরবেলায় পূর্ব আকাশে কেবল সূর্য উঠেছে । ঘোতন বাড়ি ফেরার জন্য জামা-কাপড় পরে রেডি । ঘোতনকে জামা-কাপড় পরা অবস্থায় দেখে ব্রজেশ্বরবাবু বললেন, “রেডি হলে চলবে না বাবা । দুটো ভাত খেয়ে রওনা দেবে ! কেননা অনেকটা পথ । বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যেতে পারে ।“ ব্রজেশ্বরবাবুর কথা শেষ হতেই কোথা থেকে লতা ছুটে এসে একেবারে ঘোতনের সামনে । হাঁপিয়ে গেছে বেচারা ! হাতে ছোট একটা পুটুলি । তার মধ্যে গোটা পাঁচ-ছয় কাঁচা পেয়ারা । দুটো পেয়ারা ঘোতনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আজ তোমার বাড়ি যাওয়া বন্ধ । আমি চা বানিয়ে আনছি । চুপচাপ চা খাও । তারপর বাজারে যাওয়া । বাজার থেকে ফিরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে তোমাকে শক্তিগড়ের ল্যাংচা খাওয়াতে নিয়ে যাবো । তারপর দুপুরের খাওয়ার পর কালী মন্দির । সেখানে গ্রামীন মেলা বসেছে । মেলায় তোমার সঙ্গে নাগরদোলায় উঠবো । আপাতত এই কয়েকটা প্রোগ্রাম । সুতরাং বাড়ি ফেরার একদম নাম করা চলবে না । তারপর ঘোতনকে লতা হাত ধরে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসিয়ে বলল, “এখানে চুপচাপ বসো । আমি এক্ষণি চা বানিয়ে আনছি ।“ ইত্যবসরে লতার মা দুটো প্লেটে দু-কাপ চা এনে হাজির ।
চা খাওয়ার পর লতা বাবাকে বলল, “আজ তোমাকে বাজারে যেতে হবে না । আমি বাজারে যাবো ।“ বাবাকে কথাটা বলেই ঘর থেকে বাজারের ব্যাগ এনে ঘোতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার দয়া করে আমার সঙ্গে বাজারে চলো ।“
বাজারটা লতাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে । লতার বাবা ব্রজেশ্বরবাবু সাধারণত সাইকেলে বাজারে যান । লতার একটা লেডিস্‌ সাইকেল রয়েছে । তা সত্ত্বেও লতা ঠিক করলো, “পায়ে হেঁটে বাজারে যাবে । তাতে ঘোতনের সাথে অনেক কথা বলা যাবে ।“
রাস্তায় রতন কাকার সাথে দেখা । রতন কাকা জিজ্ঞাসা করলে, “হনহন করে কোথায় চললি লতা ?”
বাজারে যাচ্ছি ।
কেন, তোর বাবা কোথায় গেলো ?
বাবার শরীরটা ভাল না । তাই আমি বাজারে যাচ্ছি ।
তোর সঙ্গের ছেলেটিকে তো চিনতে পারলাম না !
ইনি আমাদের বাড়ির কুটুম ।
কেমন কুটুম ? ইতিপূর্বে তাকে কখনও তো দেখিনি !
আমার বান্ধবীর দাদা । কাকা, আমার তাড়া আছে । আমি বাজারে চল্লুম ।
এক ঝলক মুচকী হাসি দিয়ে রতন কাকা লতাকে বললেন, “ছেলেটির সাথে তোর ভীষণ মানিয়েছে ।“
লতা রতন কাকার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাজারে ।
হঠাৎ রাস্তার বা-পাশের অর্জুন গাছ তলা থেকে প্রথমে একটা শিস দেওয়ার আওয়াজ । ঘোতন তাকিয়ে দেখে গাছের নীচে কতকগুলি ছেলের জটলা । ছেলেগুলোর চেহারার ধরন দেখে ঘোতন বুঝতে পারলো, উটকো ছেলে-পেলেদের জটলা । তারা আড্ডায় মত্ত । তারপর জটলার মধ্যে থেকে একজন উটকো ছেলে সম্ভবত তাদের মধ্যের অন্যজনকে চিৎকার করে লতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, চেয়ে দ্যাখ । তোর ভালবাসার লতার সাথে অন্য আর একজন নাগর ঘুরছে !”
ঘোতন দাঁড়িয়ে পড়লো । ঘোতনের শারীরিক কায়দা দেখে লতা ঘাবড়ে গিয়ে কোনোকিছু না ভেবে ঘোতনের হাত টেনে ধরে আরও জোরে হাঁটতে লাগল । বাজারে ঢুকে প্রথমে মাছ বাজারে ঢুকলো । সোনালী রঙের লোকাল ট্যাংরা মাছ । দামটা একটু বেশী । তারপর বড় সাইজের বোয়াল মাছ । মাটন কিনতে ঘোতন বারণ করেছিল । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! লতা বেশ খানিকটা মাটন কিনলো । তারপর সবজির বাজার । আলু, পিঁয়াজ, আদা, রসুন, কাঁচা লঙ্কা, টমেটো, পটল, গরমমশলা, ইত্যাদি কিনে এবার রিক্সায় উঠলো । লতার ভয়, গাছ তলার ছেলেগুলি আবার বিরক্ত করলে ঘোতনকে সামলানো দায় হয়ে দাঁড়াবে !
রিক্সা মৃদুমন্দ গতিতে এগোচ্ছে । অর্জুন গাছের কাছাকাছি আসা মাত্র লতা লক্ষ্য করলো, সবগুলি উটকো ছেলে লাঠি নিয়ে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়েছে । লতা পরিষ্কার বুঝতে পারলো ছেলেগুলির ধান্দা খারাপ ! মারপিট করার ধান্দা !
হঠাৎ উটকো ছেলেগুলির মধ্যে পল্লবকে দেখে ঘোতনের চোখ ছানাবড়া ! নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, ঘাটের মরাটা এখানে কেন ? তারপর কোনোকিছু বোঝবার আগেই উটকো ছেলেগুলি ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ……?
 (চলবে)

Share This
Categories
কবিতা

পোয়াতি : রাণু সরকার।

এসে দেখি তুমি অবহেলায় ঘুমিয়ে আছো-
কেনো তোমার শরীর খারাপ বুঝি?
এতো খোঁজ নিচ্ছো যে-
তুমি কি ভালোবাসো?

না, বাসি না-
ভালো না বাসলেও বিচ্ছেদের ব্যথাটা ভালো বুঝতে পারি।

ভালো না বেসে কিকরে বোঝো?

বুঝি গো বুঝি, শোন তবে-
আমার ভালোবাসা পোয়াতি হয়েছিলো-
ভরা মাস তীরটা এসে জঠরে বিঁধলো,
জীবনমরণ কঠিন সমস্যা আমি বেঁচে গেলাম
কিন্তু গর্ভেই মৃত্যু ঘটলো আমার ভালোবাসা জন্ম নেবার সুযোগ পেলোনা!

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

নারী নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মুক্তা সালভে ::: সৌরভকুমার ভূঞ্যা।।।

অনেক বিশ্বাস মতে ঈশ্বর স্রষ্টা। তিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। সেই হিসেবে নারী পুরুষ উভয়ে তার সৃষ্টি। তাই যদি সত্য হয় তাহলে নারী পুরুষ উভয়ে সমান। সমান অধিকার তাদের প্রাপ্য। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে রয়েছে নারী বঞ্চনার ইতিহাস। “সমাজে পুরুষেরা কেন নারীদের দুর্বল ভাবে? কেন তাদের সমান অধিকার দেয় না?” আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে নিজের লেখা বই “স্ত্রী-পুরুষ তুলনা”-তে এমন জোরালো প্রশ্ন রেখেছিলেন নারী নবজাগরনের অন্যতম পথিকৃৎ তারাবাই সিন্ধে। মনে করা হয় তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি নারীবাদী বই লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “যে পুরুষ নারীদের শিক্ষার আলো দিতে পারে না, তাদের অধিকার দিতে পারে না, বিধবাদের দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে পারে না, সে পুরুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ কিংবা বলবান ভাবে কী করে?” গোটা বই জুড়ে এভাবে শানিত কলমে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। এককথায় তার প্রতিবাদ ছিল পুরুষদের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

তারাবাই সিন্ধের মতো এরকমই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আরও এক নারী। তবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন একটা সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আরও পরিস্কার করে বললে, একজন দলিত নারী হয়েও বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “যদি বেদ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের হয় (এমনটা দাবি করত ব্রাহ্মণেরা), তাহলে আমরা বেদ অনুসারে চলতে বাধ্য নই।” ব্রাহ্মণরা বলতেন শুদ্রদের বেদ পড়া দূরে থাক, বেদের দিকে তাকানোটাও ছিল পাপ। সে কথা উল্লেখ করে মুক্তা বলেছিলেন, “বেদ-এর দিকে তাকালেই যদি আমাদের পাপ হয়, তাহলে বেদ-এর নীতি নিয়ম মান্য করা আমাদের বোকামি নয় কি?” ব্রাহ্মণ আধিপত্য সমাজ ব্যবস্থার দিকে এরকম কঠোর প্রশ্ন ছুঁরে দিয়েছিলেন সতেরো বছরের দলিত কিশোরী মুক্তা সালভে। মনে করা হয়ে থাকে তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা দলিত লেখিকা। মহারাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিপ্লবী ক্রান্তিবীর লাহুজির নাতনি তিনি।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। মহারাষ্ট্রে তখন পেশোয়ার শাসন। জাতপাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়, সমাজের মাথা ছিলেন বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা। আর সবচেয়ে নিচে ছিল শূদ্র। মুক্তা সালভে ছিলে মাং সম্প্রদায়ের মহিলা। মাং এবং মাহার সম্প্রদায় ছিল দলিত (শূদ্র)। সমাজে দলিতদের স্থান ছিল অবর্ণনীয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মাচরণ প্রভৃতি কোনোকিছুর অধিকার ছিল না তাদের। মন্দির, স্কুল প্রভৃতির দরজা ছিল তাদের জন্য বন্ধ। তারা ছিল অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ। তাদের স্পর্শ দূরে থাক, উচ্চ বর্ণের লোকেরা তাদের ছায়াও মাড়াত না একসময়। ব্রাহ্মণরা তাদের মানুষ বলে গন্য করত না। গরু-মহিষের থেকেও তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। নির্ধারিত কয়েকটি নিম্ন পেশা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার অধিকার ছিল না তাদের। ফলে দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। এককথায়, নিদারুন অপমান আর বঞ্চনার জীবন কাটাতে বাধ্য হত তারা। কেউ পড়াশোনা করতে চাইলে তার জীবনে নেমে আসত চরম বিপর্যয়। সামান্য সামান্য অপরাধে (হয়তো তা সে অর্থে অপরাধও নয়)তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হত। অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ হয়ে অপমান আর অবমাননার জীবন কাটাতে বাধ্য হত তারা। একটা দীর্ঘ সময় অন্ধকারে ডুবেছিল তাদের জীবন। এই অন্ধকারের প্রধান কারণ ছিল শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকা।

দলিতদের নিয়ে যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহাত্মা জ্যোতিবারাও ফুলে এবং বি-আর আম্বেদকর। সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবারাও বুঝেছিলেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে দলিতদের এই অবস্থার উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষত তিনি জোর দিয়েছিলেন নারীশিক্ষার ওপর। নিজের স্ত্রী সাবিত্রীবাই ফুলেকে তিনি পড়াশোনা করিয়েছিলেন। স্বামীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় সাবিত্রীবাই কেবল নিজে শিক্ষিত হননি, নারী সমাজকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করেছিলেন। সাবিত্রীবাই হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা শিক্ষক। শুধু তাই নয় প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে তিনি কোনো স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন।

সকল সম্প্রদায়ের মহিলাদের শিক্ষিত করার জন্য ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি জ্যোতিবারাও এবং সাবিত্রীবাই একটি স্কুল স্থাপন করেন। মাত্র ৮ জন মহিলা নিয়ে এই স্কুল শুরু হয়। এই ৮ জন মহিলার মধ্যে ১৪ বছরের মুক্তা সালভে ছিলেন একজন। এখানে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেছেন। বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুক্তা জানতে পেরেছিলেন দলিত মানুষদের পূর্বেকার অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা। নিজের সময়েও তিনি দেখেছেন দলিতদের বঞ্চনা, অপমান। শিক্ষার আলো তার চোখ খুলে দেয়। মনের অন্ধকার দূর করে। তাকে সাহসী করে তোলে। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস যেখানে মানুষের ছিল না, সেখানে সতেরো বছরের কিশোরী মুক্তা সালভে একেবারে কলম তুলে নেন লিখে ফেলেন একটি প্রবন্ধ, “Mang Maharanchya Dukhavisatha (About the Grief of Mahar and Mangs)” ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ‘Dnyanodaya’ নামক পাক্ষিক পত্রিকায় দুই কিস্তিতে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয় ১ মার্চ সংখ্যায়।

পুরো প্রবন্ধে তিনি জোরালো প্রতিবাদ করেছেন সমাজের জাত-পাত, ধর্ম বিভাজন নিয়ে। ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ তোলেন। তাদের জমি দখল করে ব্রাহ্মণরা নিজেদের বসতি স্থাপন করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে, এমন জোরালো অভিযোগ জানান। ধর্মের নিষ্ঠুরতা নিয়ে ঈশ্বরের কাছে আবেদন করেছেন, “হে ভগবান, দয়া করে বল আমাদের ধর্ম কী। হে ভগবান, আমাকে তোমার সত্যকার ধর্ম শেখাও। যাতে করে সেই মতো আমরা চলতে পারি।”

ধর্ম বলতে তিনি সেই ধর্মের কথা বলেছেন যা সংকীর্ণতা মুক্ত। যেখানে সমানাধিকার থাকবে। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ” এমন ধর্ম, যেখানে এক ব্যক্তি সুবিধা পায়, অন্যরা বঞ্চিত হয়, তাকে এই পৃথিবী থেকে লুপ্ত করে দাও। এমন ধর্ম যেন আমাদের মধ্যে আর কখনও প্রবেশ করতে না পারে।”

এ-কথা বলা কতখানি দুঃসাহসিক, কতখানি স্পর্ধার তা সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কল্পনা করলে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারি, কতখানি দুঃসাহস ছিল তার মধ্যে। একটি দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত চরম শক্তিধর সমাজ ব্যবস্থার বুকে তিনি ঘা মেরেছিলেন। সেটা পেরেছিলেন, কেননা শিক্ষার আলো তিনি পেয়েছিলেন। এটাও বুঝেছিলেন শুধু তিনি বললে হবে না। বাকিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য চাই শিক্ষার আলো। তাই তিনি তার প্রবন্ধের শেষে বলেছেন, “ওহে মাং ও মাহাররা, তোমরা গরিব, অসুস্থ। কেবল জ্ঞানের ঔষধই পারে তোমাদের সারিয়ে তুলতে। শিক্ষাই পারে তোমাদের কুসংস্কারের জঘন্য বিশ্বাস থেকে দূরে সরাতে। শিক্ষা তোমাদের ন্যায় পরায়ণ ও নীতিবান করে তুলবে তোমাদের ওপর যে অত্যাচার তা রোধ করতে পারবে। যে সব লোকেরা তোমাদের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করে, তা করতে আর তারা সাহস পাবে না।”

শিক্ষার শক্তি কতখানি তা তিনি তার তিন বছরের শিক্ষাজীবনে অনুভব করতে পেরেছিলেন। কিন্তু গতানুগতিক ধারার প্রভাবে দলিত সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের শিক্ষার প্রতি তেমন উৎসাহ ছিল না। শিক্ষা যে তাদের প্রয়োজন, এটা তারা অনুভব করতে পারত না। তাদের সেই ঘুম থেকে জাগাতে চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, “পড়াশোনা কর। কঠোর পরিশ্রম কর। শিক্ষিত হও এবং একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠো।”

মুক্তা সালভের আর কোনো লেখার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই একটিমাত্র লেখার মাধ্যমে তিনি নিজেকে একটি আলাদা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নারীমুক্তি তথা দলিত সমাজের অধিকারের দাবিতে তার এই লেখা এক শানিত হাতিয়ার। একটি সমাজ ব্যবস্থাকে একটু হলেও তিনি ধাক্কা দিতে পেরেছিলেন।

বর্তমান সময়ে আমাদের আলোচনায় উঠে আসে বহু উজ্জ্বল নারীদের নাম। মুক্তা সালভের মতো মহিলারা হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অন্তরালে। কিন্তু, সলতে পাকানোর কাজটা তারা করেছিলেন। নারী নবজাগরণে এদের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এদেরকে বেশি বেশি করে স্মরণ করা অবশ্যই প্রয়োজন।

Share This
Categories
নারী কথা

আয়ালাসোমায়াজুলা ললিতা ::: সৌরভকুমার ভূঞ্যা।।।

বয়স মাত্র আঠারো। কোলে চার মাসের শিশু সন্তান। সদ্য বিধবা মেয়েটির চারপাশে একরাশ অন্ধকার। নিজ ঘরে অনেকটা পরগাছার মতো জীবন। উঠতে বসতে গঞ্জনা, আপবাদ। একে তো স্বামী হারানোর বেদনা, অন্যদিকে চারপাশের অসহনীয় পরিবেশ। তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া মেয়েটি তখন আকুল ভাবে খুঁজছে মুক্তির পথ। আর মৃত্যুর থেকে মুক্তির সহজ উপায় আর কী হতে পারে! কিন্তু মৃত্যুতেই কি মুক্তি নাকি হেরে যাওয়া? মেয়েটি ভাবে কেন সে হেরে যাবে জীবনের কাছে? তার দোষ কোথায়? ওই ছোট্ট শিশুটিরও দোষ কোথায়? তাহলে মুক্তি কোথায়? মেয়েটি ভাবে। বুঝতে পারে পরাধীনতার জীবন মুক্ত হয়ে যদি সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে মুক্তি সমম্ভ। আর তার জন্য চাই লেখাপড়া। কিন্তু মেয়েদের লেখাপড়া করার পথটাও সুগম নয়। তারপরে সে বিধবা। কিন্তু পিছিয়ে গেলে চলবে না। মেয়েটি নিজেকে বোঝায় হেরে যাওয়া চলবে না। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। নিজের জন্য বাঁচবে। বাঁচবে তার মেয়ের জন্য। শুরু হয় তার জীবনের নতুন লড়াই, নতুন অধ্যায়। সাফল্যের বরমাল্য গলায় পরে নতুন নজির সৃষ্টি করে হয়েছিলেন দেশের প্রথম মহিলা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অসামান্যা এই নারী হলেন আয়ালাসোমায়াজুলা ললিতা।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট চেন্নাইয়ের এক মধ্যবিত্ত তেলেগু পরিবারে ললিতার জন্ম। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বাবা পাপ্পু সুব্বারাও ছিলেন গুইন্ডির কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক। ছেলেমেয়ে উভয়ের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সচেতন। তার সব ছেলেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন।
সেকেন্ডারি স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট পাওয়ার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় ললিতার। তৎকালীন সামাজিক নিয়ম মেনে মাত্র পনেরো বছর বয়সে বিয়ে যায় ললিতার। ১৯৩৭-এ তাঁর মেয়ের জন্ম হয়। মেয়ের বয়স যখন মাত্র চার মাস তখন তার স্বামী মারা যায়। অষ্টাদশী বিধবা ললিতার জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ছেলের অকাল মৃত্যুর জন্য শাশুড়ি ললিতাকে নানারকম কথা শোনাতেন। তাঁকে অপয়া বলে গালিগালাজ করতেন। জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ললিতা ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প নেন।
শুরু হয় ললিতার জীবনের নতুন অধ্যায়। কুইন মেরি কলেজ থেকে তিনি ইন্টার মিডিয়েট পাশ করেন প্রথম বিভাগে। সিদ্ধান্ত নেন বাবা-ভাইদের মতো ইঞ্জিনিয়ার হবেন। সেই সময় একজন মেয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্তটি বেশ অভিনব ও সাহসের। তবে বাবা তাঁর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন।
যাই হোক, ইঞ্জিনিয়ারিং তো পড়বেন কিন্তু কোথায়? তখন গুইন্ডির কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মেয়েদের পড়ার সুযোগ ছিল না। পরিত্রাতা হয়ে এগিয়ে এলেন বাবা। তিনি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল এবং পাবলিক ইনস্ট্রাকশান ডিরেক্টরকে মেয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যাপারটা বলেন এবং বুঝিয়ে তাদের মত আদায় করেন। কলেজের ইতিহাসে তৈরি হয় এক নতুন অধ্যায়। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন ললিতা।
কলেজের অসংখ্য ছেলের মধ্যে একমাত্র মেয়ে হয়ে প্রথম প্রথম বেশ অস্বস্তি ও অসুবিধার মধ্যে পড়েন ললিতা। ধীরে ধীরে তিনি সব অসুবিধা কাটিয়ে ওঠেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্য আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থা করেন। ললিতার একাকীত্বের ব্যাপারটা কলেজ কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা ভাবেন যদি আরও মেয়েকে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে এই সমস্যা দূর হবে। সেই মতো পরের বছর তাঁরা মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ব্যাপারে বিজ্ঞাপন দেন। সেই বিজ্ঞাপন দেখে দুজন মহিলা ভর্তি হন, পি-কে থ্রেশিয়া ও লীলাম্মা কোশি জর্জ। তাদের বিষয় ছিল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং।
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন ললিতা। স্থাপন করেন এক নতুন নজির। তিনি হলেন ভারতের প্রথম মহিলা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর তিনি জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে এক বছর শিক্ষানবিশীর কাজ করেন প্রাকটিক্যাল ট্রেনিং-এর জন্য। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেন্ট্রাল স্টান্ডার্ড অর্গানাইজেশনে সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। পোস্টিং হয় সিমলাতে। এখানে তিনি দু-বছরের কিছু বেশি সময় কাজ করেন। ১৯৪৬-এর ডিসেম্বর মাসে তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন।
ললিতার বাবা পাপ্পু সুব্বারাও কিছু গবেষণার কাজ করছিলেন। বাবার অনুরোধে চাকরি ছেড়ে ললিতা সেই গবেষণার কাজে যোগ দেন। কিন্তু ন-মাস পর তিনি এই কাজও ছেড়ে দেন। এরপর তিনি কলকাতায় অ্যাসোসিয়েটেড ইলেকট্রিক্যাল ইনডাস্ট্রিজে যোগ দেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ও সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন তিনি। এখানে তিনি বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারতের বৃহত্তম ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধের বৈদ্যুতিক জেনারেটর নিয়ে কাজ। তিরিশ বছরের বেশি এখানে কাজ করেছেন তিনি।
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের কাউন্সিল অব দ্য ইনস্টিটিউশন অহ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারস তাকে অ্যাসোশিয়েট সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এখানকার পূর্ণ সময়ের সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৬৪-এর জুন মাসে নিউইয়র্কে আয়োজিত প্রথম ইন্টারন্যাশন্যাল কনফারেন্স অব ওমেন ইঞ্জিনিয়ারস অ্যান্ড সাইন্টিস্টস-এ তিনি আমন্ত্রণ পান। নিজের ব্যবস্থাপনায় তিনি এই কনফারেন্সে যোগ দেন। এখান থেকে ফিরে আসার পর বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। নিজের বক্তব্যে তিনি মেয়েদের পড়াশোনা ও কাজে যোগাদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে নিজের মন্তব্য প্রকাশ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনের ওমেন ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটির স্থায়ী সদস্য হন।
১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর ব্রেন অ্যানিউরিজমে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ষাট বছর বয়সে মারা যান ললিতা।
পরাধীন ভারতবর্ষে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ দেওয়া হত না, তাদের পড়াশোনা করার বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা করার নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এক বিধবা মেয়ের হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি কেবল অনন্য নজির স্থাপনই করেননি, আগামী প্রজন্মের মহিলাদের কাছে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করেছিলেন।

Share This
Categories
কবিতা

জাগরন : সুমন।।।।

১.
যে মেয়েটি প্রতিদিন রাতে তার মাতাল স্বামীর অত্যাচারে কুঁকড়ে থাকত, আজ সেই মেয়ে নিশ্চিন্তে স্বামীর বুকে মাথা রেখে পূর্ণীমার আলো মেখে প্রেমের গানগায়।

২.
যে সীমান্তে গুলিড় লড়াইয়ে শূন্য হত হাজার মায়ের কোল, আজ সেই সীমান্তে খোলা আকাশের নীচে নির্ভয়ে ঘুমায় সে দিনের সেই অতন্দ্র প্রহরীরা। কাঁটা তারের দেওয়াল জুড়ে লবঙ্গলতার ফুল।

৩.
রাজনৈতিক লড়াইয়ে শ্লোগান আর দেওয়াল লিখনে ভোরে যাওয়া দেওয়াল গুলোতো আজ শুধুই মহাজনদের মহৎ বানী!

৪.
পাখিরা নিশ্চিন্তে স্বাধীনতার ডালা মেলে উড়ে বেড়ায় নীল আকাশে, খাঁচার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে প্রশান্ত হাঁসি হাসে দারোয়ান।

৫.
জেলের গারদ গুলো স্মৃতী হয়ে দাঁড়িয়ে সৌজন্যের শুভেচ্ছা বিনিময় করে মানুষের সাথে।

৬.
ব্যারিকেট হীন মৌনতার মিছিল নিখুত নিশব্দে অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে ভালোবাসার দরজায়

৭.
অচেনার ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া এক দিন, আজ সব চেনা চেনা লাগে। চারিপাশে শুধুই আপনজনদের চোখ আর বাড়ানো বিশ্বাসী হাতের ভীড়।

৮.
আমিনার পোষ্যটিকে আদর করে ভাতের ফেন খাওয়ায় বাবুদের গিন্নী।

৯.
স্বপ্ন দেখা গোরিব মেধাবী ছাত্রটির স্বপ্ন সফল করার স্বপ্ন এখন সকলের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চোখে মুখে স্পষ্ট।

১০.
একা হেঁটে যাওয়া মানুষ গুলোর চার পাশে এখন হাজার পায়ের শব্দ।

১১.
ভালোবাসার মিছিলে নীরবতার স্লোগান গোষ্ঠী, গোত্র, পরিচয় হীন দের। সব হারানো পরিবারের বুকে আজ অনেক পাওয়ার শান্তি।

১২.
ভিন্ জাতের মেয়ে টিকে পুত্র বধূ করে নিয়ে যায় যে পিতা, সেথায় কন্যা রূপে লাললন পালন হচ্ছে সে একই স্নেহ মমতায়।

১৩.
ঘুম ভেঙ্গে শুনি নিরূপমার মৃত্য হয়নি। ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল।

১৪.
রিজিওয়ানুর ঘর আলো করে এসেছে নতুন অতিথি, রামরহিম।

১৫.
বৃদ্ধ মানুষ গুলোকে আর লাঠির খোঁজ করতে হয়না, তাদের চারপাশে এখন অনেক শক্তপোক্ত কাঁধের ইমারত।

১৬.
এখন আর জয় পরাজয় অশান্ত উল্লাস নেই।অঙ্কের কাটাকুটিতে হেরে যাওয়া মানুষগুলোও আজ নিশ্চিন্তে ঘুমায়।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর — একটি পর্যালোচনা ।।।।

এটা অনস্বীকার্য যে, বাঙালী সমাজে আজও বিদ্যাসাগরের প্রদীপ্ত উপস্থিতি ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়ে । প্রাথমিক শিক্ষায় ‘বর্ণপরিচয়’ এর মাহাত্ম্য সকলের জানা । মুর্শিদাবাদ জেলার শক্তিপুর হাই স্কুলের বাংলার দিদিমণি আমার রচনা লেখার গঠন অবলোকন করে হঠাৎ তাঁর সম্মুখে ডাকলেন, “তুই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ নাম শুনেছিস ? তারপর চুপি চুপি বললেন, রোজ রাতে শোওয়ার আগে বিদ্যাসাগরের বইখানা পড়বি । রচনা লেখার সময়ে তোর বানানের জড়তা কেটে যাবে” । সুতরাং শৈশব থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় আজও অমলিন । সেই বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর । তাই দুশো বছর ধরে শিক্ষা জীবনের বাস্তবতায় বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক ।
বিদ্যাসাগর যখন জন্মগ্রহন করেছিলেন সেই সময়টা ছিল রামমোহনের যুগ, যিনি একজন শিক্ষিত ও অগ্রণী পুরুষ ছিলেন এবং সমাজ সংস্কারের অন্যতম কারিগর । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত ও বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা পুরুষ। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরিতে খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতেন । পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের অতীত ছিল। সেই কারণে বালক ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী’র সঙ্গে বাস করতেন।
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির ছ’মাসের মধ্যেই পাঁচ টাকা বৃত্তি পান । তাঁর প্রতিভার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে শিক্ষকেরা সকলে স্তম্ভিত । তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্মজীবন শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম (১৮৪১) কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসাবে । ঐসময়েই তাঁর ইংরেজি শিক্ষার যথাযথ শিক্ষালাভ । কেননা বিদ্যাসাগরকে সকলে জানতেন সংস্কৃতের পন্ডিত হিসাবে । ইংরেজি হাতের লেখাও ছিল নজরকাড়া । ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন। সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষা প্রসারে তাঁর আরও অবদান সর্বজনবিদিত । এর আগে এ কলেজে পড়ার অধিকার ছিল কেবল ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য ছাত্রদের, কিন্তু তিনি সব শ্রেণির হিন্দুদের জন্যে কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেন। ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন । ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে প্রথম বর্ণপরিচয় প্রকাশ করে তিনি বাঙালীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন। ১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৮৫৯ সালে তিনি “ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল” স্থাপনে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। ১৮৬৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় “হিন্দু মেট্রেপলিটন ইসস্টিটিউট”। বিদ্যাসাগর হন এর সেক্রেটারী। ১৮৭২ সালে এটিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং ১৮৭৯ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত করা হয়। বর্তমানে এর নাম “বিদ্যাসাগর কলেজ”। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ, বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন । সেদিনের সমাজে প্রচলিত প্রথার নির্মম পরিণতির জন্য নারীদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন আপামর জনতা অবলোকন করেছিলেন । শোনা যায়, একসময় রাজা রাজবল্লভ নিজের বালবিধবা কন্যাকে পুনর্বিবাহ দেওয়ার অনুমতি সমাজের পন্ডিতদের কাছ থেকে পেয়েও সেই বিবাহ কারও কারও বাধায় দিতে পারেন নি । যাই হোক ১৮৫৫ জানুয়ারি মাসে বিদ্যাসাগরের “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা” বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ ও সমাজ চমকে উঠেছিল । শেষ পর্য্যন্ত ১৮৫৫ সালের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয় । বিদ্যাসাগরের দরদী হৃদয় কেঁদেছিল সেকালের সমগ্র হিন্দু নারী সমাজের দুর্গতি দুর্দশায় । বিধবা বিবাহ আইন নামে পরিচিত ১৮৫৬ সালের আইনটি কেবলমাত্র বিধবা নারীর দ্বিতীয় বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি, আইনটি যেমন বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে তেমনই মৃত স্বামীর এবং দ্বিতীয় বিবাহের এবং পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তিতে অধিকার সুনিদ্দিষ্ট করে । বিভিন্নভাবে জানা যায়, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ পর্য্যন্ত মোট ৬০টি বিধবা বিবাহ সংঘটিত হয় । আরও জানা যায়, বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচন্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তাছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। এতে একটা জিনিস পরিস্কার, বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগরের শতভাগ সাফল্য সর্বজনবিদিত ।
তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন, যাকে পরবর্তীতে বেথুন কলেজ নামকরণ করা হয়। নারীদের শিক্ষার দিকে আনার জন্য তিনি একটি অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন, যা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখান থেকে মেয়েদের শিক্ষার জন্য যাবতীয় অর্থের ব্যবস্থা করা হতো। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিত (তাঁকে এ বিশেষণ প্রথমে দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত) । তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের। তাঁর বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে। পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের, যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ।
বিরাট ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অথচ চালচলনে তিনি ছিলেন নিতান্তই সাদাসিধে । খুব বিনয়ী ছিলেন এবং জীবনে দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে কাটিয়ে দিলেন। তিনি একাধারে মহান সমাজ সংস্কারক অন্যদিকে এক জন শিক্ষাবিদ ছিলেন এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করে গেছেন অবিরাম । ভারতে শিক্ষার প্রতি তার অবদান এবং নারীর অবস্থার পরিবর্তন জন্য তিনি চিরস্বরণীয়। তাঁর অবর্ণনীয় মাতৃ ভক্তি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও চর্চিত ।
——————————-০———————————————–
মো – ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

Share This
Categories
কবিতা

দিব্যি দেয়নি : রাণু সরকার।

দরিদ্রের আবার দিন আছে
নাকি-
দিনরাত দলবদ্ধ হয়েছে!
এক ফাঁকে কিছু কষ্ট
গোপন রেখেছি
তোমাকে দিতে চাই-

মনের বেদনা গুলো দিবার
প্রথম প্রহরে সেতারে বাজাবে
দেখতে চাই তারা সংগীতের সুরে
কত রূপসী!

আমাকে প্রবঞ্চিত করে
বিকট আওয়াজ করে
আঙুলের ফাঁক দিয়ে পালায়–
রেওয়াজ করিনি কতদিন-
আচ্ছা আমি কি নষ্ট?
কি এমন করেছি-
ভাদ্রের জলে পা ডুবিয়েছি!

পেছন থেকে কেউ বারণ
করেনি-
দু চোখ বিভোর কি জানি কি
ভাবছে পথিক!
দ্বিপ্রহরে খরার তাপে
অনাবৃষ্টিতে এলো বৃষ্টি
পঞ্চম মাসে!

যুগল চোখের ভাষা ছিলো
অস্পষ্ট!
বেশ করেছি পা ডুবিয়ে
কেউ আমায় দিব্যি দেয়নি!

Share This
Categories
উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (পঞ্চদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

কয়েক মাস কেটে গেলো । ঘোতনের দোকান এখন অনেক চালু । দোকানের আয় থেকে পুঁজিও অনেক বেড়েছে । ঘোতন দোকানে খুব খাটছে । তার ইচ্ছা, ভাল ভাল ব্রান্ডের কাটা-কাপড় রাখা । যাতে তার টেলারিং ঢুকে একজন চাইলে, জামা-প্যান্টের কাপড় কিনে প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারবেন । সেইজন্য ঘোতনের অতিরিক্ত খাটুনি ।
অন্যদিকে কঙ্কাবতী ঘোতনকে অনবরত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে বিয়ের জন্য । হরিবল্লভপুরের বনমালী ঘটক কঙ্কাবতীর পিছনে লেগে রয়েছে । তাঁর হাতে নাকি তিনজন সুন্দরী পাত্রী রয়েছে । তাড়াতাড়ি যোগাযোগ না করলে তারাও হাত-ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা । বনমালীর তর সইছে না । তাঁর রোজ একবার করে তাগাদা দেওয়া চাই । তিনজন মেয়ের মধ্যে একজন মেয়ের বাবার নাম লাখহরি । তিনি সোমপাড়া বাজারের বড় ব্যবসায়ী । তিনি ব্যবসায়ী পাত্র খোঁজ করছেন । বনমালীর কাছে ঘোতনের খবর পেয়ে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন ঘোতনকে জামাই করার জন্যে । লাখহরির মেয়ের বয়স বেশী । গায়ের রঙ চাপা । চাপা থাকার কারণে পাত্র ঠিকমতো জুটছিলো না । যার জন্য বয়স বেশী । লাখহরিবাবু ভাবলেন, ঘোতনকে কিছু টাকা পয়সা দিলে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে ঘোতন রাজি হয়ে যাবে । তা ছাড়া খোঁজ খবর নিয়ে লাখহরিবাবু জেনেছেন, দোকানটা বাড়াতে ঘোতনের এখন অনেক টাকার দরকার ! সুতরাং এই সুযোগে ঘোতনকে টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে বোঝাতে পারলে তাঁর মেয়ে বিয়ের একটা বিহিত হবে । নতুবা মেয়ের দিকে তাকালে তাঁর ভীষণ কষ্ট ! মেয়ের সমবয়সী মেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে । একমাত্র তাঁর মেয়ের বিয়ে বাকী । সেইজন্য মেয়েটা বিষণ্ণতায় ভুগছে ।
বনমালী কঙ্কাবতীর সাথে দেখা করে লাখহরির মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলো । লাখহরিবাবুর নগদ টাকা যৌতুক দেওয়ার প্রস্তাবও, বনমালী কঙ্কাবতীকে জানালো । কিন্তু কঙ্কাবতী বনমালীকে বুঝিয়ে বলল, “বিয়ে করবে ঘোতন । পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছেলের মতামতকেই মা হিসাবে কঙ্কাবতী গুরুত্ব দেবে । তাতে লাখহরির মেয়েকে ঘোতন পছন্দ করলে কঙ্কাবতীর কোনো আপত্তি নেই । কঙ্কাবতীর নগদ টাকার উপর কোনো লোভ নেই । সে গতরে খেটে উপার্জন করার পক্ষপাতী । তার মতে, পরিশ্রম করে স্বচ্ছতার সঙ্গে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ অপরিসীম !
এদিকে ঘোতন বিয়ে করার ব্যাপারে বেঁকে বসলো । ঘোতন চাইছে, স্টেশন চত্বরে একটা বাড়ি বানাতে । হয় মিঁয়া স্টেশন কিংবা বাজারসৌ স্টেশনের আশেপাশে । কেননা তাদের চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে যাতায়াতের খুব সমস্যা । ব্যবসা চালাতে গেলে স্টেশন চত্বরে বাড়ি হলে সবদিক দিয়ে মঙ্গল । চড়ুইডাঙ্গা গাঁয়ে যেমন বড় ভাই রয়েছে, সে সেখানে জমি জায়গা চাষবাস নিয়ে থাকুক । আর একটা বাড়ি স্টেশন চত্বরে হলে ভাল হয় । সেইজন্য ঘোতন বিয়ে নিয়ে একেবারেই ব্যস্ত নয় ।
ইতিমধ্যে মিঁয়া স্টেশন লাগোয়া শক্তিপুর যাওয়ার রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠা জমি ও বাড়ির খোঁজ পেয়েছে । বাড়িতে দুখানি ঘর, রান্না ঘর, বাথ রুম ও একটি টিউবওয়েল রয়েছে । দামটা নিয়ে ঘোতনের একটু আপত্তি । তবে জায়গাটা ঘোতনের খুব মনে ধরেছে । স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট । আবার অন্যদিকে সাইকেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শক্তিপুর বাজার । জায়গাটা যার, তিনি কর্ণসুবর্ণ স্টেশনের কাছে পাকাপাকিভাবে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন । তিনি আর মিঁয়া ফিরতে চাইছেন না । তাঁর একমাত্র ছেলে সেখানকার হাইস্কুলের মাস্টার । তাই জায়গাটা বিক্রি করে দেওয়া তাঁদের উদ্দেশ্য ।
কঙ্কাবতী জায়গার দাম শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো । অতো টাকার জোগাড় কীভাবে হবে সেই চিন্তায় অস্থির । অথচ ঘোতন জায়গাটা কিনতে মরিয়া ।
বোনেরা ঘোতনের পাশে এসে দাঁড়ালো । জমি ও বাড়িটা কেনার ব্যাপারে চার বোন সর্বতোভাবে দাদাকে সহায়তা করলো । তারাও চায়, স্টেশনের কাছাকাছি একটি বাড়ি হোক । বোনেদের সহায়তায় আর সামান্য কিছু ধার-দেনা করে ঘোতন বাড়ি-সহ জমিটা কিনলো ।
জমিটা কেনার জন্য আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে মনীষা যথেষ্ট সহযোগিতা করলো । যার জন্য ঘোতনের পক্ষে জমিটা কিনতে বেশী বেগ পেতে হলো না ।
জমিটা রেজিস্ট্রি হওয়ার সাথে সাথে গবরডাঙ্গা গ্রাম থেকে ব্রজেশ্বর কামাল কঙ্কাবতীর বাড়ি এসে উপস্থিত । তাঁর ছোট মেয়ের জন্য । ব্রজেশ্বর কামালের তিন মেয়ে । ছেলে নেই । প্রথম দুই মেয়ে বিবাহিত । বড় জামাই হাসপাতালের স্টাফ । বাড়ি বেলডাঙ্গা । আর দ্বিতীয় জামাই বিডিও অফিসের ক্লার্ক । বাড়ি বর্ধমানের রসুলপুরে । ছোট মেয়ের বিয়ে বাকী । ছোট মেয়েটা সালার কলেজ থেকে স্নাতক । চাকরি-বাকরি নেই । ছোট মেয়ের নাম লতা । লতার ইচ্ছা ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার । কিন্তু তার সে আশায় বালি । মানুষের সব আশা পূরণ হয় না । তেমনি লতার চাকরি পাওয়ার আশা পূরণ হলো না । যার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে ব্রজেশ্বর কামালের বড্ড দেরী হয়ে গেলো । লতা একটু ডানপিটে ধরনের মেয়ে । গ্রামের সব ব্যাপারেই তার মাথাব্যথা । গাঁয়ে কে অসুস্থ, কে খেতে পেলো না, সব কিছুতেই তার জড়ানো চাই । আপদে-বিপদে সকলের পাশে থাকতে লতা ভীষণ সাবলীল ! ব্রজেশ্বরবাবু কাঙাল ঘোষের মুখে জানতে পেরেছেন, কঙ্কাবতী ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ করছে ! খবর জানা মাত্র ব্রজেশ্বরবাবু সোজা কঙ্কাবতীর দরবারে ।
কী আশ্চর্যের ব্যাপার, লতাকে ঘোতনের খুব পছন্দ । তাই মাকে সরাসরি জানিয়ে দিলো, “লতাকেই সে বিয়ে করতে চায় ।“
 (চলবে)

Share This
Categories
রিভিউ

সে তুমি কবি হও বা নাও হও, আমি জানি কবিতার ঈশ্বর তুমি, কবিতা ::: শুভঙ্কর দাস।।।

“আমি ঈশ্বরের নামমাত্র প্রশংসা করব না,
বরং ঈশ্বরের উচিত আমার স্তুতি করা,আমার হৃদয়ের
সামনে মাথা নত করে ক্রন্দন করা,আমার অশ্রু অথবা
অফুরন্ত আবেগের জন্য আবার একটি জন্ম উপহার দেওয়া,যাতে আমি জ্বলন্ত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত

নারীকে,হৃদয়বতীকে এমনভাবে রক্তমাংসমদির ভালোবাসি,মুগ্ধতার পদাবলি রচনা করি এবং একটু স্পর্শের জন্য প্রাণ তুচ্ছ করতে পারি!

যা ঈশ্বরের করা অসম্ভব,অকল্পনীয় এবং অরতিময়!

কে কার সৃষ্টি জানি না!প্রেমের ফুল হাতে নিলেই
ভেতরে যে ধ্বনিত হচ্ছে শ্বাসবায়ুরচিত কবিতা,তা
গালিবের লেখা,লেখা নয়, তাই গালিব

সে তুমি কবি হও বা না হও!”( গালিবের কবিতা।শুভঙ্কর দাস)

প্রায় দু’শতাব্দী আগে এক প্রেমিক-কবির জন্ম হয় ১৭৯৭ সালে আগ্রায়,তিনি সৈনিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও,কখনো অস্ত্র ধরেননি,বরং নিজের হৃদয়কে ফুল করলেন,প্রতিটি শানিত অস্ত্র যাতে ফুল এবং অস্ত্র ভান্ডার ফুলের বাগানে পরিণত হয়।
তিনি উর্দুতে কবিতা লিখতেন। শেষ পর্যন্ত এই ভাষার প্রতি তাঁর পরম নিষ্ঠা ও বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।তাঁর সারাজীবন ছিল সৌন্দর্য সন্ধানের আকর।তিনি লক্ষ্য করলেন,ঈশ্বরের সৃষ্ট এই জগতে সত্যিকারের সুন্দরতম বলে কিছু থেকে থাকে,তা হল নারী।
সেই নারীর হৃদয় জয় করা তাঁর কাছে শত সাম্রাজ্য জয় করার সমান মনে হত।
ডেই নারীর হৃদয়ে স্থান পাওয়াকে তিনি মনে করতেন বেহস্তে যাওয়ার সমান।
তপ্ত হৃদয়ের ভেতর ছায়া আনতে এবং মরুসদৃশ ওষ্ঠতৃষ্ষা মেটাতে পারে একমাত্র নারী।তাই সেই কবির কাছে প্রেম,নারীর প্রেম জীবন ও মরণ,ত্যাগ ও ভোগের একাত্ম সাধনরূপ হয়ে উঠল।
তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে বুলবুল,গোলাপ,বসন্ত,চাঁদ, ফুল,ময়ূর,কেশদাম,সুরা, লায়লা-মজনু এবং যে শব্দটি অযুতবার এসেছে, তা হল চুম্বন।
অর্থাৎ তিনি নারীর প্রেমকে ও তার প্রাপ্তিকে জীবনের সবশ্রেষ্ঠ গজল মনে করতেন।
প্রায় ১৭৯৬ টি কবিতা রচনা করেছেন।
তিনি ইংরেজি জানতেন না!
তিনি বাংলা যে জানতেন না,তা বলা বাহুল্য!
তিনি ফার্সি জানতেন কিন্তু পদ রচনায় তিনি উর্দুকেই বাহন করেছিলেন।
তার সত্ত্বেও তাঁর হৃদয়আর্তিকে আটকে রাখা যায়নি!
অনুবাদের মাধ্যমে আলোকিত কবি-প্রেমিক সম্রাট হয়ে আছেন সারা ভুবনে।

তিনি মির্জা আসাদুল্লাহ্ খান।
গোটা জগৎ তাঁকে মির্জা গালিব নামে চেনে।

কাব্য-বিশেষজ্ঞের মতামত এই “গালিব শুধুমাত্র বড় কবি নন,তিনি অত্যন্ত দুরূহ কবি।তাঁর কবিতা ও গজল দু’শতাব্দী অতিক্রম করেও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক। গালিবকে তাঁর জীবনী ও কবিতায় আমরা পাই সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, মেধা ও মননের সমৃদ্ধ সমকালীন ভারতীয় সংস্কৃতির পটভূমিকায় একজন অমিত শক্তিধর স্রষ্টা হিসেবে। সমগ্র উর্দু ও ফারসি কাব্যে একমাত্র ইকবাল ব্যতীত আর কোনো কবি একরকম কালোত্তীর্ণ প্রতিভা নিয়ে উপস্থিত হননি”

আর মহাকবি গালিব নিজে স্বয়ং কী বলেন, তাও শোনা দরকার–
“শোনো,দুটি পৃথিবী আছে,একটি আত্মার, অন্যটি মাটি ও জলের পৃথিবীর। সাধারণ নিয়ম এই যে মাটিজলের পৃথিবীতে যারা অপরাধী তারা আত্মার পৃথিবীতে শাস্তি পাবে,আবার যারা আত্মার জগতে অপরাধী তারা মাটিজলের পৃথিবীতে শাস্তি পাবে”

তাঁর আত্মা কবিতার জন্য নিবেদিত ছিল।তাই তিনি মাটিজলের পৃথিবীতে নানা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে প্রেমকে প্রজ্বলিত করেছেন তিলে তিলে…
তিনি তাই বলেন—
“আমাদের প্রেমের ব্যাকুলতা তোমার মহত্ত্বকে প্রকাশ করে
তোমার পৃথিবী তোমার মুখের তুলনায় অতি সামান্য
একটি আয়না মাত্র! ”
সেই আয়না যদি উর্দু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকত,তাহলে সসাগরা বসুন্ধরা এই অতুলনীয় প্রেমের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকত,তাই আমরা যারা অসহায় অথচ গালিব পড়তে আগ্রহী এবং বহুভাষাজ্ঞানহীন অথচ বহুমাত্রিক প্রেমসন্ধানী, তাদের জন্য অনুবাদ একান্ত প্রয়োজন।
এগিয়ে এলেন কবি তপনকুমার মাইতি।
কবি তপনকুমার মাইতি অখন্ড মেদিনীপুরের প্রেমের কবিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনাকার।তিনি নিজে অসংখ্য এবং সার্থক প্রেমের কবিতা সৃষ্টি করেছেন।এবং যা আবৃত্তিশিল্পীদের স্বর্ণকলস হতে পারে! যেমন একটি শোনাই—

“ভালোবাসলে সব মানুষের মুখ সুন্দর দেখায়
তখন শত্রুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলা যায়,বুকে এসো
তখন ঝরা ফুল হাতে নিয়ে বলা যায়,বৃন্তে ফিরে যাও
তখন ছোট ছোট লোভ ও ঘৃণাগুলো নক্ষত্র হয়ে যায়
তখন অচেনা মানুষের দুঃখের ভেতর দাঁড়ানো যায়

ভালোবাসলে পাখি নেমে আসে গাছ থেকে
মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে আসে

ভালোবাসার মত স্বচ্ছ আয়না আর একটিও নেই। ”

সেই মানুষটি প্রেমের হৃদয় দিয়ে গালিব ভাষান্তর করেছেন। মূল উর্দু কবিতার পাশাপাশি বাংলায় অনুবাদ।কয়েকটি প্রেমপ্রদীপ জ্বালানো যেতেই পারে—

“ঘুম তো তারই,গর্বও তারই,রাত্রিও তার
তোমার অবিন্যস্ত কেশদাম যার বাহুর উপর বিছিয়ে আছে”

“দেওয়াল ও দরজাবিহীন একটি ঘরে বানাতে চাই
সেখানে কোনো পাহারাদার থাকবে না,থাকবে না কোনো পড়শি”

“তুমি বলছ কুড়িয়ে পাওয়া হৃদয়টা ফিরিয়ে দেবে না
হৃদয় কোথায় যে লুকিয়ে রাখবে? আমি পেলাম আকাঙ্ক্ষিত করুণা”

এইরকম কবি তপনকুমার মাইতি একশো দুটি অনুবাদ করেছেন গালিবের কবিতার।মূল উর্দুর সঙ্গে পড়তে এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যায়,তবে হয়তো যে শব্দ বা বাক্য উর্দুতে প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে,তার বাংলা সেই আবেদন নিয়ে কোথাও কোথাও হাজির হয়নি,অনুবাদ সদর্থক এবং সাবলীল, কিন্তু ভাষান্তরে সেই ধ্বনিময় অনুভবজারিত রস পাওয়া অসম্ভব।
তা সত্ত্বেও কবি তপনকুমার মাইতি আমাদের জন্য যে স্বর্ণখনি নির্মাণ করেছেন,তাতে মুগ্ধ হতেই হয় এবং অবশ্যই পাঠ করতে হয়।

গালিব বাংলা ভাষায় কবিতাচর্চা করতেন না,এমন কি তিনি বাংলার কবিতাসম্ভার জানতেন কি না,জানা যায় না,কিন্তু ১৮২৬ সালে কলকাতায় এসেছিলেন।দিল্লির শেষ বাদশা বাহাদুর শাহের সভাকবি ছিলেন তখন।সেইসময় কলকাতায় তাঁকে ঘিরে একটি উর্দু কবিমন্ডল তৈরি হয়। যে সময় কলকাতায় রাজা রামমোহন রায় একের পর এক সমাজসংস্কারমূলক বাংলা বই রচনা করে চলেছেন এবং রামমোহন নিজে খুব ভালো ফার্সি ও উর্দুভাষা জানতেন।সেদিক থেকে গালিবের সঙ্গে রাজা রামমোহনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না,জানা যায় না! রামমোহন গালিবের চেয়ে ২৩ বছরের বড় ছিলেন।এবং গালিব যখন কলকাতায় সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বীরসিংহের টোলে পড়াশুনা করছেন এবং তাঁর বয়স মাত্র ছয়।
এবং সেই সময় বাংলার প্রধান কবি ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত।
তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রে গালিবের কোনো সংবাদ প্রকাশিত অথবা গালিবের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন বা প্রকাশ করেছিলেন কি না,জানা যায় না!
এইসব ইতিহাসের উর্ধ্বে যা থাকে,তা হল গালিবের কবিতা।তাই আমরা হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি, কবি তপনকুমার মাইতির আয়োজনে,এটাই বড় প্রাপ্তি।এই আলোচনায় অনেকের মনে হতে পারে,শব্দার্থ বা উপমা প্রয়োগ অথবা ভাষান্তরে ভাবের বিস্তার বা সংকোচ হল কি না,তা তো আলোচিত হল না!
না,আমি সেসব করতে বসিনি,সে যোগ্যতাও আমার নেই।আমি শুধু এক কবি হৃদয়ের আর্তি অপর কবিহৃদয় কীভাবে সঞ্জাত করে গালিবপ্রিয় পাঠকের মনে সঞ্চারিত করল,তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরলাম।মহাকবি মধুসূদন তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্যের একটি জায়গায় বলেছেন—

” যে যাহারে ভালোবাসে/সে যাইবে তার পাশে
মদন রাজার বিধি লঙ্ঘিবে কেমনে?
যদি অবহেলা করি/রুষিবে শম্বর-অরি
কে সমস্বরে স্মরশরে এ তিন ভুবনে?”

এই সত্যিটুকু মির্জা গালিবের কবিতায় আছে,কবি তপনকুমার মাইতির কবিতায় আছে এবং পাঠান্তর তাই আমার মতো তুচ্ছ নগন্য পাঠকের মনেও সোনালি রেখায় স্পন্দিত হয়েছে,এরপর আর কি চাই??
শেষ করব গালিবের কবিতা দিয়ে,যা তপনকুমার অনন্য হৃদয়ময়তায় ফুটিয়ে তুলেছেন—

“অনুযোগে আমিও পূর্ণ, বাদ্যযন্ত্র যেমন রাগিনীতে
একটু বিচ্ছেদ দাও,দেখ কেমন বেজে উঠি”

————————//——————–

Share This