এযে আমার প্রাণের সখার মতো
মধু বাতাস এসে জড়িয়ে ধরে কি আহ্লাদে
আমার রঙের খেলা যায় নি এখনও ফুরিয়ে
সে কথাটি বলে যায় বারে বারে
পলাশগুলি ফুটেছে কত আহ্লাদে
শিমূল বনের উদাস হাওয়া বলে যায় কানে কানে
সব ছেড়ে দিয়ে এসো আমার কাছে
আমার রঙে করব তোমায় রঙীন
আমার চোখ দুটি বুজে যায় আবেশে
কে যে ডাকে এমন করে বুঝতে পারিনা
লাল রঙে যেন ঢেকে গেছে চারিদিক
শরীরে আমার টুপটুপ
করে ঝরে হলুদে মাখানো পলাশের ডাল থেকে থোকা থোকা হলুদ ফুল
এত রঙ আমি রাখি কোথায়
আমি দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি বুকে
এমন ভালো আর কি কেউ বাসতে পারে
বসন্ত যে এসেছে ভুবন জুড়ে
এসো আমার প্রাণে– –বলি মনে মনে বলি হৃদয় দিয়ে।
Month: February 2023
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী –দিনটিকে আমরা বাঙালীরা ভুলতে পারিনা। বাঙালির কাছে এ এক স্মরণীয় দিন । ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিন বাংলাদেশে ‘শহীদ দিবস’ রূপে পালিত হয় আর ২০০০ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী “আর্ন্তজাতিক মাতৃদিবস” হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
আমাদের মাতৃভাষা- বাংলাভাষা-যে ভাষায় নিতাই- গোরা সারা দেশে ভক্তিস্তোত্র বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- যে ভাষাতে রবীন্দ্রনাথ,বঙ্কিমচন্দ্র,মধুসূদন,শরৎচন্দ্র বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন – এই ভাষাতেই বিদ্রোহি কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রক্ত-ঝরা কবিতা লিখে ব্রিটিশ শক্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন – এই ভাষাতেই ‘হরিবোল’ গাইতে গাইতে আমরা ভবসাগর পার হয়ে যায়।
এই ভাষাতেই আমরা বাঙালীরা বড় হয়েছি, কথা বলেছি, গান গেয়েছি এবং আজও বেঁচে আছি।
কিন্তু এই মাতৃভাষা দিবসটা সিক্ত হয়ে রয়েছে অনেক সন্তানহারা-মায়ের অশ্রুজলে- তাই ভুলতে পারছিনা ছেলে- হারা-মায়ের অশ্রুতে গড়া একুশে ফেব্রুয়ারীর কথা। কারন এই দিনটিতে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কয়েকশ বাঙালী ভাইয়ের রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছিল- এদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের নাম প্রকাশ্যে আসে-তারা হলেন আব্দুল সালাম, বরকত জব্বর,আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও শফিউর।
সেই রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি আজও মুছে যাইনি এবং শত শত বছর পরেও মুছে যাবেনা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো কিন্তু দ্বিখন্ডিত হয়ে – একটি ভারত যুক্তরাষ্ট্র অপরটি পাকিস্তান রাষ্ট্র ।তবে পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত রূপে- পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান । পাকিস্তানে যেমন উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলো তেমনি বাংলাদেশেও(পূর্ব পাকিস্তানে) ঊর্দুকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো। তারা ঊর্দূভাষার ডাকটিকিট প্রকাশ করলো, ফর্মে ও খামে এবং সমস্ত ধরনের সাইনবোর্ডে ঊর্দূকে স্থান দিল।
কিন্তু বাংলার জনৈক মুসলিম ভাই মহঃ শহীদুল্লা উচ্চকণ্ঠে জানালেন –“আমরা যেমন মুসলমান সত্য, তেমনি আমারা বাঙালী”। অতএব বাংলাকেই আমাদের দেশে মর্যাদা দিতে হবে।“১৯৪৮ সালে আলিজিন্না জানালেন – পাকিস্তানে উর্দূই হবে রাষ্ট্রভাষা“। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনও জানিয়ে দিলেন- এদেশে উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
কিন্তু বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা এই দাবীকে অগ্রাহ্য করলো এবং ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারে ঘোষিত ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে মিছিল নিয়ে এগিয়ে চললো বীর বিক্রমে।কিন্তু সরকার নৃশংসভাবে জনতার উপর গুলি চালালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে – যেখানে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো কতশত তরুন তরতাজা যুবক। কয়েক শত হতাহত তরুণ প্রান-রক্তে লাল হয়ে উঠলো ঢাকার রাজপথ । বেশির ভাগ শহীদ হওয়া রক্তাক্ত দেহকে হাপিস করে দেওয়া হলো।
কিন্তু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন থামলো না, বরং আরও তীব্রতর হলো পৃথিবীর ব্যাপী বিভিন্ন প্রান্তে । শেষকালে ১৯৯৮ সালে ২৯ শে মার্চ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কফি আন্নানের হাতে একটি আবেদন পত্র এসে পৌঁছালো।এই আবেদন পত্রে লেখা হয়েছিল – “পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে।“ সেই আবেদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের কথা এবং পাঁচ জন তরুনের শহীদ হওয়ার কথা। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে সকল রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখ মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। তারপরে২০০০সালের ২১শে ফ্রেবুয়ারী প্রথম আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালিত হয়।
আজও আমরা প্রতিবছর এই দিনটিকে স্মরণ করে সেই মৃত্যুহীন প্রাণ শহীদের প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই – কবিরা নতুন নতুন গান সৃষ্টি করেন, পত্রিকায়,ম্যাগাজিনে এই দিনের তাৎপর্য নিয়ে লেখা হয়, বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠান এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে।
দুই বাংলার বাঙালিরা ভাষার আকর্ষনে এক অভিনব মিলন সেতু তৈরী করে। কলকাতার বইমেলায় দেখা যায় বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকদের ,গড়ে ওঠে বাংলাভাষীদের মৈত্রী – হিন্দু মুসলিম পৃথক সত্ত্বা ভুলে যায় – বাঙালির ভাষার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে ঐক্যতান।
কিন্তু এত কিছুর পরেও একটা বেদনা মনের মধ্যে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে কি আর বাংলা ভাষার কদর থাকবে ? দেখা যাচ্ছে ,বাংলা ভাষা বাঙালিদের কাছে ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে। সম্পন্ন ঘরের ছেলে মেয়েরা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে যাচ্ছে, বাবা-মা ছেলে মেয়েদের ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে গর্ববোধ করছেন। অনেকে বলেন – আমার ছেলে বেশ ভাল ইংরাজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু বাংলাটা ঠিক আসে না তাই পড়তে চায় না। আবার কেউ কেউ বাংলা ভাষা না জানাটাই গর্বের বস্তু বলে মনে করেন। শহরে এমনকি গ্রামেগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠছে। সেখানে অনেক অনেক বেশি খরচ করে অভিভাবকগণ ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করছেন শুধুমাত্র ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবার জন্য।
আমি জানি ইংরাজি ভাষা একটা আর্ন্তজাতিক ভাষা এই ভাষাতে দক্ষতা অর্জন করা অতি অবশ্যই প্রয়োজন, এমনকি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতেও আমদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করা একদম উচিত নয়।
তাছাড়া আমাদের রাজ্যে এখনও ব্যাঙ্কে,পোষ্ট অফিসে বা সরকারী অফিসের সব ধরনের ফর্মগুলি ইংরাজি ভাষায় লিখিত। ইংরাজি নববর্ষে আমরা Happy New Year বলতে অভ্যস্ত । আমাদের কোনো অফিসে দরখাস্ত পাঠাতে হলে ইংরাজি ভাষায় লিখতে হবে। সুতরাং আমাদের বাংলার দৈন্যতার জন্য আমরাই দায়ী।
আজ আমরা যারা বাংলাকে ভালবাসি তাদের উচিত ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশের শহীদদের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানানো তেমনি আমাদের মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ বাংলাভাষাকে নতুন করে ভালোবাসা জানানো । আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে বাংলা কবিতার বই ,গল্পের বই, ঠাকুরমার ঝুলি প্রভৃতি উপহার হিসাবে তুলে দেব।কারন বাংলা ভাষাই হচ্ছে বাঙালির আশা ভরসা। বাংলা ভাষা যদি অবলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আর বাঙালির অস্ত্বিত্ব থাকবে না।
এজন্য আজ সমস্ত বাঙালিকেই সজাগ থাকতে হবে, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আর একটা কথা আমাদের জানা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির শহীদ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে- তবুও এই দিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সকল ভাষা ভাষীর মানুষ নিজ নিজ ভাষাকে ভালোবাসবে, নিজের নিজের ভাষার উন্নতির চেষ্টা করবে।সাঁওতালরা তাদের সাঁওতালী ভাষাকে প্রাধান্য দিবে, নেপালীরা তাদের নেপালী ভাষার জন্য গর্ববোধ করবে, উড়িয়ারা তাদের উড়িয়া ভাষাকে উন্নততর করার চেষ্টা করবে – এমনি করে প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজের ভাষাকে মাতৃদুগ্ধ মনে করবে। তবেই ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটি উদযাপন করা সার্থকমন্ডিত হয়ে উঠবে।
মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বোধের উন্মেষ । মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে । শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমন গুরুত্ব । মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে । মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয় । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব । মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি । কারণ, এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না। মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ সম্ভব ।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে । নিজেদের ভাষাকে উন্নত ও কার্যকরী করেই বিশ্বের জাতিসমূহ উন্নত ও অগ্রসর হতে পেরেছে ।
উনিশ শতকের ভারতীয় চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় রাজনারায়ণ বসু (০৭.০৯.১৮২৬ — ১৮.০৯.১৮৯৯) বলেছেন “জননীর স্তনদুগ্ধ যদ্রুপ অন্য সকল দুগ্ধ অপেক্ষা বল বৃদ্ধি করে, তদ্রূপ জন্মভূমির ভাষা অন্য সকল ভাষা অপেক্ষা মনের বীর্য প্রকাশ করে ।”
মাতৃভাষা হল মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রকৃত প্রকাশ মাধ্যম । তার জিয়নকাঠির স্পর্শেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা তাঁর জীবনস্মৃতিতে লেখা ) হয়, বোধের গভীরে চিন্তার বুদবুদ কারার দ্বার ভেঙে বাইরে এসে বাক্মূর্তি ধারণ করে । আর অন্যদিকে শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ । মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না । তাই সেই অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তস্থলের আবেগের যোগ থাকা একান্ত আবশ্যক । সেকারণে শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের । প্রাণের ভাষা ও প্রাণের জ্ঞান একত্রিত হলে তবেই একজন সার্থক মানুষরূপে পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে । একটা শিশুর মাতৃভাষা হলো তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ । মাতৃভাষা ‘সফলভাবে কাজ ও কথা বলার সামাজিক ধরনকে’ প্রতিফলন ঘটাতে সাহাযা করে ।
তাই মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মুল তাৎপর্য হলো মাতৃভাষা নিয়ে সচেতন হওয়া ও বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা । বাঙালিদের মতে, মায়ের মুখের ভাষাই হলো জীবন, ভাষাই হলো স্বাধীনতা ।
আবার সংস্কৃতির একটি অংশ ভাষা । তবে এ ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক । ইউনেস্কোর সম্মেলনে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে বলা হয় – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার । মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে । সুতরাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলো প্রতিটি মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনো ভাষার উপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা । এদিবসে প্রত্যেক ভাষাভাষি মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালবাসবে তেমনি অন্যজাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে । সুতরাং বলা যায়, একুশকে ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ ।
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন । একটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত । বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ।
এবারে আসছি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে । ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে । প্রথমে ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয় । ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানে উর্দু হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা (Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan) । এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেন নি । ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । এর প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল করে । মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে । মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন । ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সাথে সাথে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় । এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র যুব হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হস্টেলে সমবেত হন । নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে । ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর রাখার জন্য ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে উঠে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি । ১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলা ভাষা প্রচলণ বিল” পাশ হয় । যা কার্যকর হয় ৮ই মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় । এতে তরতাজা ছাত্র-যুবকেরা হতাহত হন । সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে । ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিলো ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ । লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ । তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে উঠে ঃ
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লেখেন । যেমন –
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি “একুশের গান” শিরোনামে প্রকাশিত হয় । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ যিনি সেসময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরিতে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিলো । পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে । ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।
এবার আসছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রসঙ্গে । কানাডার ভ্যাঙকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুল সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতি সংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আননের কাছে ১৯৯৮ সালে । সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসাবে কর্মরত হাসান ফিরদৌসের নজরে এই চিঠিটি আসে । তিনি ১৯৯৮ সালের ২০শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন । পরে রফিক আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান । এতে একজন ইংরেজভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন । তারা আবার কফি আননকে “এ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন । ১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সাথে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন । আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫টি দেশ — কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে । ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতি সংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে । ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশন মোতাবেক এখন থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ । সুতরাং ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন হয়ে আসছে ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক । ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের স্মরণে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের গণআন্দোলনের প্রতীক, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুমহানস্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতীর পিতা (বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্ত্বা থাকবে শহীদদের আমরা ভুলতে পারবো না । আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না । এ বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়” ।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাদিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন । এ সময় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।
পরিশেষে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো । মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা । বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারকে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো । সারা বিশ্বে বাঙালী জাতির কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন । তাই ২১ আমাদের গর্ব, ২১ আমাদের অহংকার । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই চেতনাকে সবার মধ্যে সঞ্জীবিত করার মধ্যেই নিহিত আছে এই মহান দিবসের সার্থকতা ।
প্রসঙ্গত, আমরা স্মরণ করতে পারি কবি অতুল প্রসাদ সেনের লেখা ঃ—-
মোদের গরব, মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা !
কি যাদু বাংলা গানে ! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো !
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা ।
আজ এই পুণ্যদিনে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
————————–0—————————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী (৭৪১২৩৫), ভারত
স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার । তিনি ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের একমাত্র শিষ্য । তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নত করে বিবেকানন্দ সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন । স্বামী বিবেকানন্দ জীবপ্রেমের দীক্ষা পান শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন ‘যত্র জীব, তত্র শিব’। জীবের সেবা করলে স্রষ্টারও সেবা করা হয় । স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ । সবার আগে মানব সেবা । সুতরাং মানুষের সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা করা সম্ভব। জীবপ্রেমের দর্শন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর দুটি চমৎকার লাইনেঃ
“বহুরুপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবপ্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর ।“
তাই আমরা কেউ বিবেকানন্দকে পরিপূর্ণভাবে বুঝিনি । কারণ তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব । তিনি প্রচুর বই পড়তেন । দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, ইত্যাদি বিষয়ে । তা ছাড়া তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল বেদ, উপনিষদ, ভাগবতগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, প্রভূতি হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে । যার জন্য সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ব, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ছিলো গভীর ব্যুৎপত্তি । তাই তিনি নিজেই বলেছেন, “বিবেকানন্দকে বুঝতে হলে আরেক বিবেকানন্দকে দরকার” । কর্মী বিবেকানন্দ, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, গুরু বিবেকানন্দ, শিষ্য বিবেকানন্দ, জ্ঞানী বিবেকানন্দ, যোগী বিবেকানন্দ, কবি বিবেকানন্দ সবই বাহ্য । কারণ এই সমস্ত গুণেই তিনি শীর্ষস্থানের অধিকারী হলেও তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, ‘ভালোবাসায় ভরা হৃদয় বিবেকানন্দ’ ।
বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের “শিব জ্ঞানে জীব সেবা” মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । তাই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধনকেই প্রকৃত ঈশ্বর সাধনা বলে মনে করেছিলেন ।
বিবেকানন্দ ছিলেন মানব প্রেমিক সন্ন্যাসী । মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়কেই সমানভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন । তাঁর মতে “ধর্ম”” মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বকে ফোটাবে । বিজ্ঞান মানুষকে সুখ ও সমৃদ্ধি উপহার দেবে । শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ প্রথমে আত্মবিশ্বাসী হবে । আর আত্মবিশ্বাস থেকে আসবে আত্মনির্ভরশীলতা । বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষাই সমাজের সকল সমস্যা দূরীকরণের মূল চাবি কাঠি । শিক্ষার আলো মানুষের মনের অন্ধকারকে দূর করে এবং মানুষকে স্বনির্ভর করতে সাহায্য করে । বিবেকানন্দের শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যেই ছিল সমাজে যথার্থ “মানুষ” তৈরি করা –যাতে চরিত্র গঠিত হয়, মনের শক্তি বাড়ে । বুদ্ধি বিকশিত হয়, মানুষ নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে শেখে । উপরন্ত বিবেকানন্দের শিক্ষা ছিল সার্বজনীন । তিনি চেয়েছিলেন বিশেষভাবে যুব সমাজের নবচেতনার অভ্যুদয় । নিষ্ঠা, সততা ও আত্মনির্ভরতা ছিল তাঁর আরাধ্য । এসব গুণ জগতের সব সমাজের সব মানুষেরই সম্পদ ।
( ২ )
এখানে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য – বিবেকানন্দ যেভাবে ভারতবর্ষকে চিনেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন, অন্য কোনো ব্যক্তি ঠিক সেভাবে ভারতবর্ষকে অনুভব করতে পারেননি । পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করে বিবেকানন্দ ধন্য মনে করেছিলেন । ভগিনী নিবেদিতার ভাষায়, “তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ – রক্তমাংসে গড়া ভারত প্রতিমা ।“ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রোমাঁ রোলাঁকে (ফরাসী সাহিত্যিক) বলেছিলেন, “যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও বিবেকানন্দকে জানো । বিবেকানন্দের লেখা আগে পড়ো । “
বিবেকানন্দ সহজে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবকে গুরু মানেননি । প্রথমদিকে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে গুরু বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন । এমনকি তাঁর চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন । অথচ উল্টে তিনি রামকৃষ্ণ দেবের ব্যক্তিত্বের কাছে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন । যার জন্য ঘনঘন তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন । ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য নরেন্দ্রনাথ সেইসময় মূর্তিপূজা, বহুদেববাদ, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কালী পুজা সমর্থন করতেন না । এমনকি অদ্বৈত বেদান্তমতবাদকেও তিনি ঈশ্বরদ্রোহিতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন । নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে পরীক্ষা করতেন । রামকৃষ্ণ দেবও শান্তভাবে তার যুক্তি শুনে বলতেন, “সত্যকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করবি ।“
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে । চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে প্রথমে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর ও পরে কাশীপুরের একটি বাগান বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয় । সেখানেই নরেন্দ্র নাথের ধর্ম শিক্ষা চলতে থাকে । কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন । তারপর রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে সন্ন্যাস ও গৈরিক বস্ত্র লাভ করেন । রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নরেন্দ্রনাথকে শিক্ষা দেন “মানব সেবাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সাধনা” । এরপর ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট শেষ রাত্রে কাশীপুরেই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব প্রয়াত হন । ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নরেন্দ্রনাথের গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুরে আমন্ত্রণ জানান । সেখানেই তাঁরা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতো জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেন । তখন নরেন্দ্রনাথ “স্বামী বিবেকানন্দ” নাম গ্রহণ করেন ।
এরপরে পরিব্রাজকরূপে তাঁকে আমরা কী দেখলাম । ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিব্রাজকরূপে মঠ ত্যাগ করেন বিবেকানন্দ । পরিব্রাজক হিন্দু সন্ন্যাসীর এক ধর্মীয় জীবন — এই জীবনে তিনি স্বাধীনভাবে পর্যটন করে বেড়ান কোনো স্থায়ী বাসস্থান ও বন্ধন ছাড়াই । পরিব্রাজক জীবনে বিবেকানন্দের সঙ্গী ছল একটি কমন্ডলু, লাঠি এবং তাঁর প্রিয় দুটি গ্রন্থ –ভাগবদ্গীতা ও ইশানুসরণ । বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত হন । এই সময় ভিক্ষোপজীবী হয়ে সারা ভারত পদব্রজেই পর্যটন করেন বিবেকানন্দ । সেইজন্য বিবেকানন্দকে সারা বিশ্বের মানুষ “পরিব্রাজক” হিসেবে জানে । ভারতবর্ষ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন পণ্ডিত, দেওয়ান, রাজা এবং হিন্দু-মুসলমান, খ্রিষ্টান এমনকি নিম্নবর্গীয় ও সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গেও মেলামেশা ও একসঙ্গে বাস করেন ।
( ৩ )
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বারাণসী থেকে যাত্রা শুরু করেন । তখন সাক্ষাৎ হয় বিশিষ্ট বাঙালী লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও বিশিষ্ট সন্ত ত্রৈলঙ্গস্বামীর সাথে । বৃন্দাবন, হথরাস ও হৃষীকেশে ভ্রমণের সময় হথরাসে তাঁর সঙ্গে স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্তের সাক্ষাত হয় । তিনি পরে বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সদানন্দ নামে পরিচিত হন । তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের প্রথম যুগের শিষ্য । ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে আবার নৈনিতাল, আলমোড়া, দেরাদুন, ঋষীকেশ, হরিদ্বার এবং হিমালয় ভ্রমণে যান । তারপর রওনা দেন দিল্লি । এইভাবে পশ্চিম ভারত, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ সারেন ।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩০শে জুন থেকে ১৪ই জুলাই শিকাগো যাওয়ার পথে বিবেকানন্দ জাপান ভ্রমণ করেন । তিনি ঘুরে দেখেছিলেন কোবে, ওসাকা, কিওটো, টোকিও আর য়োকোহামা শহর । ১০ই জুলাই ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে য়োকোহামার ওরিয়েন্টাল হোটেল থেকে তাঁর ভক্ত মাদ্রাজের আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দ জানিয়েছিলেন জাপান নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা । তিনি জাপানীদের “পৃথিবীর সবচেয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জনগণের অন্যতম” বলে অভিহিত করেছিলেন । তারপর চিন, কানাডা হয়ে তিনি শিকাগো শহরে পৌঁছান ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে । কিন্তু শিকাগো শহরে পৌঁছে মূলত দুটি সমস্যায় পড়েন । মহাসভা শুরু হতে দেড় মাস বাকী । অন্যটা কোনো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসাপত্র বা পরিচয়পত্র ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বধর্ম মহাসভায় গ্রহণ করা হবে না । তারপর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সংস্পর্শে এলেন । তাঁকে হার্ভার্ডে আমন্ত্রণ জানানোর পর এবং ধর্মসভায় বক্তব্যদানে বিবেকানন্দের প্রশংসাপত্র না থাকা প্রসঙ্গে রাইটের বক্তব্য, “আপনার কাছে প্রশংসাপত্র চাওয়াটা হচ্ছে স্বর্গে সূর্যের আলো দেওয়ার অধিকার চাওয়ার মতো অবস্থা ।“ রাইট তখন প্রতিনিধিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিকট এক চিঠিতে লিখলেন, “আমাদের সকল অধ্যাপক একত্রে যতটা শিক্ষিত ইনি তাঁদের থেকেও বেশী শিক্ষিত ।“
বিশ্বধর্ম মহাসভা ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হয় । তিনি ভারত এবং হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন । পাশ্চাত্যে অভিযানের নিরিখে যেসব অভিজ্ঞতা, তাতে শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় সনাতন ও বেদান্তের উপর ভাষণ দেওয়া ভীষন তাৎপর্যপূর্ণ । তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন, “আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ …।“ — সম্ভাষন করে । তাঁর বক্তব্যে সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গ ওঠে । গীতা থেকে উদাহরণমূলক পংক্তি তুলে ধরেন । তাঁর বক্তব্যে বিশ্বজনীন চেতনা ধ্বনিত হয় ।
প্রেসের কাছে তিনি “ভারতের সাইক্লোন সন্ন্যাসী” হিসেবে অভিহিত হন । “নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক” লিখেছিল “ঐশ্বরিক অধিকারবলে তিনি একজন বক্তা এবং তাঁর শক্তিশালী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার চেয়ে বরং আগ্রহোদ্দিপক ছিল ঐ সকল ছন্দময়ভাবে উচ্চারিত শব্দসমূহ ।“ আমেরিকার পত্রিকাসমূহ বিবেকানন্দকে “ধর্মসভার সবচেয়ে মহান ব্যক্তিত্ব” হিসেবে প্রতিবেদন লিখেছিল । পরবর্তীতে শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত ভারতে ফিরে এসে লিখেছিলেন, “গেরুয়াধারী কম বয়স্ক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন মঞ্চে বিবেকানন্দ ছিলেন সূর্যের মতো তেজস্বী এক পুরুষ ।“
তারপর ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর আমেরিকা ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ শেষে ইংল্যান্ড থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । তারপর ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারী কলম্বো তিনি পৌঁছান ।
( ৪ )
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বিবেকানন্দের সদর্থক ভূমিকা । রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু । সেই বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ছিলেন “আধুনিক ভারতের স্রষ্টা ।“ জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনার প্রতি তিনি ছিলেন সতত সংবেদনশীল । সুতরাং বিবেকানন্দের স্বদেশমন্ত্র দেশ স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । বলা চলে বিবেকানন্দ স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন । যার জন্য মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “বিবেকানন্দের রচনা তাঁর “দেশপ্রেম হাজারগুণ” বৃদ্ধি করেছিল ।“ যখন পরাধীন ভারতবাসী আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, তখন বিবেকানন্দ চেয়েছেন মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ । তাই তিনি বলেছেন, “তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারি, পবিত্র ও পূর্ণ । তুমি নিজেকে দুর্বল বলো কী করে ? ওঠো, সাহসী হও, বীর্যবান হও ।“
স্বদেশমন্ত্রে তিনি বলেছেন, হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা … এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করবে ? এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে ? হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী । ভুলিও না, তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর । ভুলিও না, তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের —নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে । ভুলিও না, তুমি জন্ম হতেই “মায়ের” জন্য বলিপ্রদত্ত । ভুলিও না, নীচজাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই । হে বীর, সাহস অবলম্বন করো, সদর্পে বলো —- আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই । বলো, মুর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই । সদর্পে বলো, ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী । বলো ভাই, ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ । ভারতের কল্যান, আমার কল্যান । “
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ই জুলায় রাত ৯.১০ মিনিটে ধ্যানরত অবস্থায় দেহত্যাগ করেন । তাঁকে বেলুড়ে গঙ্গা নদীর তীরে একটি চন্দন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতার উপর দাহ করা হয় । যার বিপরীত পাশে ষোলো বছর আগে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মরদেহ দাহ করা হয়েছিল ।
আজ তাঁর শুভ জন্মদিন (জন্মঃ ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩) । তাঁর শুভ জন্মদিনে আমার শতকোটি প্রণাম ।
———–০————–
মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বোধের উন্মেষ । মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে । শিশু যখন মাতৃভাষায় পড়া ও লেখা শুরু করে, তখন থেকে ভাষার মাধ্যমে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জানা ও বোঝার ক্ষমতার পাশাপাশি আরও অনেকগুলি সক্ষমতা বা দক্ষতা তৈরী হতে থাকে । বিশেষ করে, যুক্তি-বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা । যাকে বলে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ । শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার তেমন গুরুত্ব । মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে । মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয় । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব । মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি । কারণ এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না । মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ সম্ভব ।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে । আমরা জানি, শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ । মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না । তাই শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের । একটা শিশুর মাতৃভাষা হলো তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ । মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মুল তাৎপর্য হলো মাতৃভাষা নিয়ে সচেতন হওয়া ও বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা । ইউনেস্কোর সম্মেলনে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে বলা হয় – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার । মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে ।
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন । একটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত । বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ।
( ২ )
এবারে আসছি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে । ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে । প্রথমে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের কথায় আসা যাক । ভাষা আন্দোলনকারীর প্রবীণদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত । তিনি ছিলেন সেই সময়কার পাকিস্তান গণপরিষদয়ের সদস্য । ১৯৪৮ সালের ২৫শে আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে বাংলাকে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি উত্থাপন করেন । এখানে উল্লেখ থাকে যে, ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিটিং, মিছিল, পিকেটিং আন্দোলন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তরুন রাজনীতিবিদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তারপর ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত প্রসঙ্গে আরও জানা যায় — তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারী দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে ৫৬শতাংশের বেশী মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে । এমনকি শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে । সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আপনারা উর্দু ভাষাকে অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দিতে পারেন না । আপনারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিন ।“ কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন । শুধু তাই নয়, ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের উপর “এডবো” (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়োগ করেন । যার জন্য তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন । ১৯৭১ সালে ২৯শে মার্চ রাতে ছেলে দিলীপ কুমার দত্ত সহ গ্রেপ্তার হন । ময়নামতি সেনানিবাসে থাকাকালীন তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন হয় এবং তারপরে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । তাই তাঁকে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত নামে সকলে চেনে । আর মাতৃভাষার প্রথম দাবিদার এই শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ।
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানে উর্দু হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা (Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan) । এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেননি । ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । এর প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল করে । মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে । মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন । ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সাথে সাথে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় । এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র যুব হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হস্টেলে সমবেত হন । নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে । ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর রাখার জন্য ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে উঠে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ১৯৫২ সালে ভাষা অন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে । ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি । ১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলা ভাষা প্রচলণ বিল” পাশ হয় । যা কার্যকর হয় ৮ই মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় । এতে তরতাজা ছাত্র-যুবকেরা হতাহত হন । সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে । ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিলো ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ । লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ । তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন
জেগে উঠেঃ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ।
( ৩ )
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতি সংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে । ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশন মোতাবেক এখন থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ । সুতরাং ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন হয়ে আসছে ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক । ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের স্মরণে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের গণআন্দোলনের প্রতীক, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুমহানস্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতীর পিতা (বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্ত্বা থাকবে শহীদদের আমরা ভুলতে পারবো না । আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না । এ বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়” ।
পরিশেষে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো । মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা । বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো । সারা বিশ্বে বাঙালী জাতির কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন । তাই ২১ আমাদের গর্ব, ২১ আমাদের অহংকার ।
আজ এই পুণ্যদিনে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
————————–0—————————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী / মো-৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
একদিন মহাপ্রভু গেছেন শ্রীজগন্নাথ দর্শন করতে, সিংহদ্বারে দ্বারপাল তাঁকে দেখেই এগিয়ে এসে চরণবন্দনা করলেন । অমনই মহাপ্রভু , “কোথায় আমার কৃষ্ণ ? আমার প্রাণনাথ কোথায় গো? তুমি আমার সখা ; আমায় দেখাও সখা ,আমার প্রাণনাথকে ।”—-বলে অনুনয় করার মত দ্বারপালের হাতখানা জড়িয়ে ধরলেন। দ্বারপাল বললেন, “আমি দর্শন করাচ্ছি আপনাকে , চলুন ।” শ্রীমন্ মহাপ্রভুর হাত ধরে মন্দিরের জগমোহনে নিয়ে গেলেন দ্বারপাল। আর তারপর , শ্রীপুরুষোত্তমকে দেখিয়ে বললেন, “ঐ যে তিনি ! আপনার প্রাণনাথ।”
গরুর স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করতেন মহাপ্রভু । তিনি কখনোই গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথ দর্শন করতেন না । প্রতিদিনের মত আজও দ্বারপাল নিয়ে তাঁকে গরুর স্তম্ভের পিছনে বাঁ দিকটায়(গরুড়ের বাম দিক) দাঁড় করালেন এবং সেখান থেকেই মহাপ্রভু দু’নয়ন মেলে জগন্নাথকে দর্শন করলেন । জগন্নাথ আজ এখন মুরলীবদন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ধরা দিলেন মহাপ্রভুর নেত্রে । —-এই লীলার কথা রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাঁর ‘শ্রীচৈতন্যস্তবকল্পবৃক্ষ’ গ্রন্থের সপ্তম শ্লোকে প্রকাশ করেছেন।
“ক্ক মে কান্তঃ কৃষ্ণস্ত্বরিতমিহ তং লোকয়
সখে ! ত্বমবেতি দ্বারাধিপমভিবদন্নুন্মদ ইব।।
দ্রুতং গচ্ছ দ্রস্টুং প্রিয়মিতি তদুক্তেন
ধৃততদ্ভুতজান্তর্গৌরাঙ্গো হৃদয় উদয়ন্মাং মদয়তি ।।”
এমন সময় গোপালবল্লভ ভোগ লাগলো জগন্নাথের । ভোগের পর শঙ্খ , ঘন্টা আদি সহ আরতি হল । ভোগ সরলে জগন্নাথের সেবকগণ প্রসাদ নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে এলেন। তাঁকে প্রসাদী মালা পরিয়ে প্রসাদ হাতে দিলেন। সেই প্রসাদের আঘ্রাণ নিলেন মহাপ্রভু আর বললেন, “বহুমূল্য প্রসাদ ! এ যে সর্বোত্তম বস্তু !” এর অল্প নিয়ে তিনি জিহ্বায় দিলেন আর বাকিটা সেবক গোবিন্দ দাস আঁচলে বেঁধে নিলেন। সেই কণিকা মাত্র প্রসাদের অমৃতাস্বাদ করে প্রভুর মনে যেন চমৎকার হলো, সর্বাঙ্গে পুলক তাঁর । আর নেত্র থেকে অশ্রুধারা বইতে থাকলো। তিনি আপন মনে বিস্মিত হয়ে বললেন , “এই দ্রব্যে এত স্বাদ কোথা থেকে এলো ! ওহ্, এতে তো কৃষ্ণের অধরামৃত সঞ্চারিত হয়েছে ! তাই বুঝি এই বস্তু এত মধুময় হয়েছে স্বাদে !”—- এ কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মধ্যে প্রেমাবেশ হলো । কিন্তু পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সম্বরণ করে নিলেন জগন্নাথের সেবকরা তাঁর সামনে আসায় ।
মহাপ্রভু বারবার ‘সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত’ বলতে থাকলেন। জগন্নাথের সেবক মহাপ্রভুর মুখে এই শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রভু , সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে কি? অর্থ কি এর ?” তখন মহাপ্রভু বললেন , “এই যে তুমি আমায় কৃষ্ণের অধরামৃত দিলে ,এই বস্তু ব্রহ্মা আদি দেবতাদেরও দুর্লভ এবং অমৃতের স্বাদকেও নিন্দনীয় হতে হয় এর কাছে। শ্রীকৃষ্ণের ভুক্তাবশেষের নামই হল ফেলা । তিনি ভাগ্যবান যিনি ফেলামৃত লব মাত্র পান । সামান্য ভাগ্য যার সে এই বস্তু প্রাপ্ত হতে পারে না। যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ কৃপা তিনি তা পান। আর, তিনিই সুকৃতীবান যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের কৃপা থাকে । অর্থাৎ সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে হল যাঁর সুকৃতি লাভ হয় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ হয় তিনিই ফেলা রূপ অমৃত লাভ করতে পারেন ; শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত আস্বাদনের অধিকারী হন।”— এই বলে মহাপ্রভু সকলকে বিদায় দিলেন । তারপর জগন্নাথের উপলভোগ দর্শন করে গম্ভীরায় ফিরে এলেন।
মধ্যাহ্নকালে ভিক্ষা নির্বাহণ করলেন মহাপ্রভু । কিন্তু অন্তরে কৃষ্ণ-অধরামৃতের স্বাদ সর্বদা স্মরণ হচ্ছে তাঁর। বাইরে কর্ম করছেন অথচ অন্তরে প্রেমে গরগর মন হয়ে আছে। সেই সঘন আবেশ অত্যন্ত কষ্ট করে সম্বরণ করছেন তিনি। সন্ধ্যা বেলায় যখন পুনরায় নিজের পার্ষদগণের সাথে বসে কৃষ্ণকথা রঙ্গে নিভৃতে কাল কাটাচ্ছেন , তখন সেবক গোবিন্দ দাসকে ইঙ্গিত দিলেন দুপুরের সেই আঁচলে বেঁধে রাখা প্রসাদ এখন আনার জন্য । পুরী-ভারতী তথা তাঁর গণের সন্ন্যাসীদের জন্য কিছুটা পাঠিয়ে দেওয়া হলো , আর সেখানে উপস্থিত রামানন্দ রায় , সার্বভৌম ভট্টাচার্য , স্বরূপ দামোদর ও অন্যান্যদের সেই প্রসাদ বিতরণ করা হলো। প্রসাদের সৌরভ-মাধুর্য আস্বাদন করেই সকলে বিস্মিত হলেন । যে প্রসাদ এমন দিব্য সৌরভ সম্পন্ন , সেই প্রসাদের স্বাদ না জানি কেমন অলৌকিক হবে ! তখন মহাপ্রভু বললেন , “দ্যাখো, প্রসাদে যা যা আছে যেমন ধরো আখের গুড় , কর্পূর, মরিচ, এলাচ , লবঙ্গ,কাবাবচিনি, দারুচিনি এইগুলো সব প্রাকৃত দ্রব্য। তোমরা সকলেই এই সব প্রাকৃত দ্রব্যগুলোর স্বাদ, সুগন্ধ কেমন জানো । কিন্তু এই প্রসাদে তাহলে এত আমোদ কোথা থেকে এলো? প্রসাদের এই সৌরভ —এতো লোকাতীত ! এর আস্বাদন তাহলে কত না দিব্য ! আস্বাদ করে দেখ সকলের মনে প্রতীত হবে তাহলে। আস্বাদন তো অনেক পরের কথা , কেবল গন্ধেই মন মাতিয়ে দেয়। তাই না ! প্রসাদের এমন মাধুর্য যে আস্বাদন সময়ে আস্বাদন ব্যতীত অন্য সকল কিছু বিস্মৃত করিয়ে দেয় । কেন? কারণ , শ্রীকৃষ্ণের অধর স্পর্শ করেছে এই প্রসাদ। তাঁর অধর রসের গুণ সব সঞ্চারিত হয়েছে প্রসাদে, তাইতো অলৌকিক সুগন্ধ মাধুর্য হয়েছে এমন ! মহাভক্তি করে সকলে প্রসাদ আস্বাদ করো।”
সকলে হরিধ্বনি দিয়ে প্রসাদ আস্বাদন করলেন এবং আস্বাদন মাত্রই সকলের মন প্রেমে মত্ত হল। মহাপ্রভুর মধ্যে প্রেমাবেশ সে সময় । তিনি আজ্ঞা দিলেন রামানন্দ রায় কে শ্লোক পাঠ করতে। রামানন্দ রায় শ্রীমদ্ ভাগবতের শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।
“সুরতবর্দ্ধনং শোক নাশনং , স্বরিতবেণুনা সুষ্ঠচুম্বিতম্ ।
ইতররাগবিস্মারণং নৃণাং, বিতর বীর নস্তেহধরামৃতম্ ।।”
(শ্রীমদ্ ভাগবত, ১০, ৩১, ১৪ শ্লোক)
—– শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসমন্ডল থেকে অকস্মাৎ অন্তর্ধান হয়ে যান, শোকাকুলা গোপীরা বিলাপ করে বলছেন তখন— হে বীর ! তোমার সেই সুরতবর্ধনকারী (সম্ভোগেচ্ছা ক্রমশঃ বর্ধনকারী) অধরের সুধা যা তোমার বিরহ জনিত শোক রাশিকে নাশ করে তা আমাদেরকে বিতরণ কর । তোমার অধরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বেণু পঞ্চম সুরে নাদিত হয়ে মানবের সকল আসক্তি ভুলিয়ে দেয় ; সেই অধরের অমৃত আমাদের দাও।
সেই শ্লোক শ্রবণ করে রসরাজ-মহাভাবের মিলিত স্বরূপ মহাপ্রভু তখন ভাবাবিষ্ট হয়ে রাধার উৎকণ্ঠা জনিত একটি শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।
“ব্রজাতুলকুলাঙ্গনেতর রসালি তৃষ্ণাহরঃ ,
প্রদীব্যদধরামৃতঃ সুকৃতিলভ্য ফেললাবঃ।
সুধাজিদহিবল্লিকাসুদলবীটিকাচর্বিতঃ,
স মে মদনমোহনঃ সখি তনোতি জিহ্বাস্পৃহাম্।।”
(গোবিন্দলীলামৃত, ৮, ৮শ্লোক)
—- শ্রীমতী রাধিকা তাঁর সখী বিশাখাকে বলছেন, হে সখি ! অনন্যা ব্রজকুলবতী ললনাদের যিনি অধরামৃত দ্বারা আনন্দ দান করে তাঁদের অন্য সকল রস-তৃষ্ণাকে হরণ করেন , যাঁর চর্বিত তাম্বুলে অমৃতাপেক্ষা অধিক স্বাদ—-সেই শ্রীমদনমোহন আমার জিহ্বার স্পৃহাকে বিস্তৃতি দান করেছেন।
তারপর মহাপ্রভু নিজেই দুই শ্লোকের অর্থ প্রলাপের মত উচ্চারণ করে গেলেন । সকলে শ্রবণ করে ভাবের ভিয়ানে বিহ্বল হলেন। গ্রন্থ– মহাপ্রভুর মধুময় কথা , লেখিকা —- রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক, প্রকাশক–তথাগত।
শ্রীজগদানন্দ পন্ডিত বৃন্দাবন ভ্রমণ করে নীলাচলে মহাপ্রভুর কাছে ফিরে যাচ্ছেন । শ্রীসনাতন গোস্বামী তাই তাঁর হাত দিয়ে মহাপ্রভুর জন্য কিছু ভেট বস্তু অর্থাৎ উপহার সামগ্রী পাঠালেন । কী কী সেই উপহার ? — রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা , শুষ্ক পাকা পীলু ফল আর গুঞ্জামালা । জগদানন্দ পন্ডিত ফিরে যেতেই সনাতনের মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। এতদিন তো মহাপ্রভুর অতি কাছের একজন মানুষ, প্রিয় পরিকর বা দূত যাই বলি না কেন তিনি ছিলেন সনাতনের কাছে। জগদানন্দের সঙ্গ পেয়ে সনাতনের মনে হতো যেন মহাপ্রভুর আবেশ উপলব্ধি করছেন । যেমনটা হয় আর কী ! প্রিয়জনের কাছের কাউকে পেলেও মনে এক অদ্ভুত প্রেম ভাব জাগে , ভালো লাগে—তেমন আর কী ! আজ জগদানন্দ চলে যেতে সনাতনের মন তাই কেঁদে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। দ্বাদশ আদিত্য টিলার উপর একটি মঠ পেয়ে , সে স্থান সংস্কার করে চালা বেঁধে রেখে দিলেন তিনি, যাতে ব্রজে এসে মহাপ্রভু সেখানে বাস করতে পারেন নিরালায় ।
ওদিকে জগদানন্দ পথে একটুও দেরী না করে খুব শীঘ্র চলে এলেন নীলাচলে । তাঁর যে আর তর সইছে না মহাপ্রভুকে দু’চোখ ভরে দেখার জন্য। নীলাচলে মহাপ্রভু সহ আর সব ভক্তদের পেয়ে তাঁর মনে পরম আনন্দ হল । প্রভুর চরণ বন্দনা করে সকলের সাথে আলিঙ্গন করলেন। মহাপ্রভুও তাঁকে দৃঢ় আলিঙ্গন দিলেন । ব্রজ থেকে ফেরত এসেছে যে প্রাণপ্রিয় বাল্যবান্ধব জগদানন্দ ! তাই। এরপর জগদানন্দ সেই সমস্ত ভেট তথা উপহার সামগ্রী মহাপ্রভুর শ্রীহস্তে তুলে দিলেন, যা-যা সনাতন প্রেরণ করেছিলেন মহাপ্রভুর জন্য ।
রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা আর গুঞ্জামালা নিজের কাছে রেখে মহাপ্রভু পীলু ফলগুলি তখনই সকলের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বললেন । ভক্তরা বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফল দেখেননি। গৌড়দেশে পীলুফল হয়ও না। বৃন্দাবন থেকে এসেছে যে ফল সে ফল না জানি কত ভালো , কত সুস্বাদু, কত অমৃতসম মিষ্টি হয়তো বা ! তাই তো সনাতন পাঠিয়েছেন পীলু ফল ! তাই না ! একারণে সকলের মধ্যেই মহা আগ্রহ পীলু ফল খাবার । সকলে মহা আনন্দের সাথে পীলু ফল হাতে নিলেন খাবেন বলে।
যাঁরা জানেন তাঁরা পীলু ফল নিয়ে চুষতে থাকলেন আর যাঁরা জানেন না বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফলে কামড় বসিয়ে চিবোতে শুরু করে দিলেন। আর যে মুহূর্তে চিবোলেন অমনি তাঁদের মুখের ছাল উঠে গেল, জিহ্বা প্রচন্ড জ্বালা করতে থাকলো । আসলে পিলু ফল এমনই হয় ,চিবিয়ে খেতে নেই ,চুষে খেতে হয় । চিবোলেই মুখ জ্বলে যায় । স্বাভাবিক ভাবেই পীলু ফলকে কেন্দ্র করে তখন সেখানে এক মহা রগড় হলো মহাপ্রভু ও ভক্তদের মধ্যে।
“সনাতন প্রভুকে কিছু ভেট বস্তু দিলা ।।
রাসস্থলীর বালু আর গোবর্ধনের শিলা ।
শুষ্ক পক্ক পীলু ফল আর গুঞ্জামালা ।।
জগদানন্দ পণ্ডিত চলিলা সব লইয়া।
*************************************
*************************************
*************************************
সনাতনের নামে পন্ডিত দণ্ডবৎ কৈল।
রাসস্থলীর বালু আদি সব ভেট দিল ।।
সব দ্রব্য রাখি পীলু দিলেন বাঁটিয়া ।
বৃন্দাবনের ফল বলি খাইল হৃষ্ট হইয়া।।
যে কেহ জানে সে আঁটি চুষিতে লাগিল ।
যে না জানে গৌড়ীয়া পীলু চিবাইয়া খাইল।।
মুখে তার ছাল গেল জিহবা করে জ্বালা ।
বৃন্দাবনের পীলু খাইতে এই এক লীলা।।”
(চৈ।চ। অন্ত্য,১৩)
শ্রীগৌরাঙ্গের পতিত-পাবন নামের সার্থক প্রমাণ হল শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই উদ্ধার লীলা। ভক্ত শিরোমণি জগাই-মাধাইয়ের অবণীতে আবির্ভাব হয় প্রভুর ইচ্ছায় দুরাচারী, অত্যাচারী, মদ্যপ ও অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরূপে। এমন কোন পাপকর্ম জগৎ-এ ছিল না, যা, তাঁরা করতেন না। চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, গোমাংস ভক্ষণ, পরের গৃহ অগ্নিদগ্ধ করা, স্ত্রী-হত্যা, ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি সব রকম অসৎকর্মই তাঁরা অবলীলায় করতেন। তবে হ্যাঁ, উল্লেখ্য যে, বৈষ্ণব অপরাধ তাঁরা কখনও করেননি। মদ্যপ সঙ্গীদের সঙ্গ সবসময় করতেন বলে বৈষ্ণব অপরাধ করার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনদিন হয়ে উঠেছিল না।
নবদ্বীপবাসী ব্রাহ্মণ শুভানন্দ রায়। নবদ্বীপের জমিদার বলেই তাঁর দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছিল। সুমিষ্ট, সৎ ব্যবহারের জন্য পাৎসাহ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তাঁর দুই পরম-সুন্দর পুত্র—–জ্যেষ্ঠ রঘুনাথ, কনিষ্ঠ জনার্দন দাস। রঘুনাথের পুত্রের নাম জগন্নাথ আর জনার্দনের পুত্র মাধব। এই জগন্নাথ ও মাধবই ওরফে ‘জগাই-মাধাই’ বলে পরিচিত ছিলেন। নবদ্বীপের কোটাল এই দুই ভাই। যদিও জগাই-মাধাইয়ের পূর্বপুরুষরা সকলেই সদাচারী ছিলেন, কিন্তু মদ্যপ-কুসঙ্গীদের পাল্লায় পরে জগাই-মাধাইয়ের চরিত্রের অবনমন ঘটে। আর সেজন্য স্বজনদের দ্বারা তাঁরা পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। ভক্তসঙ্গ কী জিনিষ তা তাঁরা জানতেনই না। মদ্যপান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি পর্যন্ত যেতেন, কখনো বা বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন, আবার কখনো অশ্রাব্য গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যেই কিল-চড়-লাথি দিতেন। লোকে তাঁদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন সব সময়। যে পথ দিয়ে জগাই-মাধাই যেতেন। দূর থেকে দেখতে পেলে সেই পথ এড়িয়ে অন্য পথ ধরতেন ভীত পথিকেরা।
এমনই একদিন প্রচুর মদ্যপান করে রাস্তায় ধুলোয় পড়ে ‘কিলাকিলি-লাথালাথি করছিলেন জগাই-মাধাই। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশে প্রতিদিন নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের প্রতি ঘরে ঘরে গমন করে মানুষকে কৃষ্ণ বলাচ্ছেন সেসময়। সেদিন তাঁরা সম্মুখীন হলেন পথে জগাই-মাধাইয়ের। দেখলেন ওভাবে মদের নেশার বিক্ষেপে তাঁদের পশুবৎ দশা। তখন পরম করুণ নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন, “ইস্! কী করুণ দশা এদের! এমন পাতকী তো কোথাও দেখিনি। আমার প্রভু গৌরাঙ্গ পাতকীদের উদ্ধার করতেই এই কলিতে এসেছেন। যদি এদের মতো পাপীদের তিনি উদ্ধার করেন, তবেই তো তাঁর পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে, তবে তো জগৎবাসী জানবে যে আমার প্রভুর মহিমা কতখানি! যাঁর ভৃত্য বলে আমরা গর্ব বোধ করি, তিনি যে কতখানি ক্ষমতা ধরেন সে প্রমাণ পাবে মানুষ তখন। না, এদেরকে ভক্তিপথে আনতেই হবে। যাঁরা ভক্ত হয় তাঁরা অতি সহজেই নাম নেয়; কিন্তু যদি এদের মত দুরাচারীকেও নাম নেওয়ানো যায়, তবেই আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সফল হবে। না হলে তো বৃথা আষ্ফালন সব আমাদের ! না, হরিদাস, আমাদের এখন প্রথম কাজ হবে এদেরকে উদ্ধার করা। অন্য জায়গায় আমরা পরে যাব। গৌরীহরিকে এদের কথা জানাবো। হরিদাস, তোমাকে যবনরা অত্যাচার করেছিল। তুমি তো তাদেরও মঙ্গল কামনা করেছিলে। এবার এদের মঙ্গল চাও। কারণ, তোমার মত ভক্তের চাওয়া ভগবান পূরণ করবেনই। এরা উদ্ধার হবে এই পাপী জীবন থেকে তবে।”
হরিদাস বললেন, “সে কী কথা! তুমি চেয়েছো যখন তখনই তো তা পূরণ হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। তোমার ইচ্ছাই যে প্রভুর ইচ্ছা। আবার আমাকে টানছো কেন!” নিত্যানন্দ একথায় হেসে প্রেমালিঙ্গন দিলেন হরিদাসকে। তারপর একটু দূর থেকে উপদেশের সুরে জগাই-মাধাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, লহ কৃষ্ণনাম। কৃষ্ণ মাতা, কৃষ্ণ পিতা, কৃষ্ণধন প্রাণ।। তোমা সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার। হেন কৃষ্ণ ভজ, সব ছাড় অনাচার।।”
কিন্তু উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হল । জগাই এমন কথা শুনে একটু মাথা তুলে প্রথমে দেখলেন, তারপরই মহাক্রোধে “ধরতো! ধরতো!” বলে ধাওয়া করলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে। “রক্ষ কৃষ্ণ, রক্ষ কৃষ্ণ” বলে নিতাই-হরিদাস কোনক্রমে জগাইয়ের প্রহারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। সে কী অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য! গর্জন করতে করতে দুই দস্যু ধাওয়া করছেন আর সামনে প্রেমে বিহ্বল দুই মহাভক্ত হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছেন।
শ্রীবাস গৃহে ভক্ত সমেত বসে আছেন বিশ্বম্ভর। নিতাই-হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সব বললেন তাঁকে। শ্রীবাস পন্ডিত ও গঙ্গাদাস জগাই-মাধাইয়ের বংশ পরিচয় দিলেন এবং তাঁদের দুষ্কর্মের আদ্যোপান্ত বর্ণনাও দিলেন। নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু, আগে তোমায় এদেরকে উদ্ধার করতেই হবে। তারপর অন্য কথা। তোমার পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে এদের পাপমোচনের দ্বারা। বিশ্ববাসী তোমার মহিমা দেখুক।” গৌরাঙ্গ হেসে বললেন, “যে মুহুর্তে তোমার দর্শন ওরা পেয়েছে, তুমি চেয়েছো ওদের উদ্ধার, সেই মুহূর্তেই ওদের সব পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু তুমি ওদের মঙ্গল চিন্তা করো, দেখবে অচিরেই কৃষ্ণ ওদের মঙ্গল সাধন করে দিয়েছেন। তোমার ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হবে।”
রাত্রিবেলায় একদিন নগর ভ্রমণ করে নিত্যানন্দ যাচ্ছেন পথ দিয়ে হেঁটে, এমন সময় জগাই-মাধাই তাঁর পথ অবরোধ করলেন। বললেন, “কে রে? কে তুই?” নিত্যানন্দ বললেন, “আমি অবধূত, গৌরগুণ গাই। এখন বাড়ি যাচ্ছি।” অবধূত শব্দ শোনা মাত্র মাধাই করলেন কী, পথের পাশে পড়ে থাকা এক ভাঙা কলসী উঠিয়ে নিয়ে আছাড় মারলেন নিত্যানন্দের মস্তকে। সজোরে আঘাত করায় মাথা ফেটে গেল নিতাইয়ের। আর অবিরল ধারায় রক্ত ঝরতে লাগলো। অক্রোধ পরমানন্দ, অভিমান শূন্য নিতাই গৌরস্মরণ করে নির্বিকার চিত্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর নির্লিপ্ততা দেখে মদ্যপ মাধাই আবার মারতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রক্তধারা আর নিতাইয়ের নিশ্চুপতা দেখে জগাইয়ের মন দৈবেচ্ছায় মাখনের মত গলে গেল। তিনি মাধাই কে বললেন, “না, না, আর মেরো না। ও তো অবধূত, তা আবার দেশান্তরী ! ওকে মেরে লাভ কী তোমার! এত নির্দয় হয়ো না।” এই বলে তিনি মাধাইয়ের হাত ধরে ফেললেন। এদিকে অন্যান্য পথচারীদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে এ দুঃসংবাদ দিলেন গৌরাঙ্গকে।
শোনামাত্র গৌরাঙ্গ সপরিকর ছুটতে ছুটতে এলেন সেই মুহুর্তেই। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইয়ের অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! এ কী সহ্য করা সম্ভব! প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন গৌরাঙ্গ। স্বয়ং তাঁকে প্রহার করে রক্ত ঝরিয়ে দিলেও এতখানি ক্রোধিত হতেন না, যতখানি নিতাইয়ের ক্ষেত্রে হলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি “চক্র, চক্র” বলে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান জানিয়ে নিজের হাত উপরে তুললেন। সুদর্শন চলে এলেন তাঁর হাতে। ভক্তরা সকলে প্রমাদ গুনলেন। এবার তো আর নিস্তার নেই জগাই-মাধাইয়ের! চক্র দ্বারা প্রভু তাঁদের সংহার করবেনই করবেন। কিন্তু, কলিতে এই অবতারে তো তাঁর অস্ত্র ধরার কথা নয়। তাঁর অঙ্গ-উপাঙ্গ স্বরূপ পার্ষদরাই তাঁর অস্ত্র। পার্ষদদের দ্বারা নাম-প্রেম বিতরণ করিয়ে তিনি পতিতদের উদ্ধার করবেন। তাঁর রূপ মাধুর্য্যের দ্বারা অসুরের আসুরিক স্বভাবের পরিবর্তন করবেন। তাঁকে দর্শন করেই দুরাচারীদের মন পরিবর্তিত হবে। এযুগে তো তিনি কাউকে সংহার করবেন না। বরং মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রেমভক্তিতে মনকে জারিত করবেন, ভক্ত বানাবেন অভক্তদের। মহাভাগবত হবেন তাঁরা এক-একজন সব।
নিত্যানন্দ করলেন কৌশলতা এক। তিনি মহাপ্রভুর মন ঘোরাবার চেষ্টা করলেন, বললেন- “প্রভু, দেখ, দেখ, এই যে জগাইকে দেখছো , এ আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছে। মাধাই মারতে গেলেও তাঁকে বাঁধা দিয়ে রক্ষা করেছে আমায়।” একথা শুনেই গৌরাঙ্গের মনসংযোগ চক্রের প্রতি থেকে সরলো। বললেন- “তাই নাকি! তুমি আমার নিতাইকে রক্ষা করেছো জগাই ! প্রভু তোমার অনেক মঙ্গল করুক। নিত্যানন্দকে বাঁচিয়ে তুমি আমায় কিনে নিলে আজ।” এই বলেই তিনি জগাইকে জড়িয়ে ধরলেন। জগাইকে রেখে পাছে মাধাইকে মারেন, তাই নিত্যানন্দ বলে চললেন- প্রভু, এই দু’জনার শরীরই আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি। তুমি তো এযুগে প্রতিজ্ঞা করেছো যে অস্ত্র না ধরেও জীবতারণ করবে। তবে কেন তার ব্যাতিক্রম করবে! এই দুইজনকেই তুমি কৃপা কর।”
এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেমালিঙ্গন দেওয়ায় প্রেমভার বইতে না পেরে জগাই মূর্ছিত হয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ বললেন- “ওঠো জগাই। তোমার যা বর লাগে, তুমি চেয়ে নাও আজ। আমি আজ সত্য সত্যই তোমায় প্রেমভক্তি প্রদান করলাম। আমার দেহ থেকেও নিত্যানন্দের দেহ বড় আমার কাছে জেনো। তুমি তাঁকে রক্ষা করেছো যখন, শ্রীকৃষ্ণ তোমায় অনেক কৃপা করবেন এই আমি বললাম।” জগাই দেখলেন গৌরহরি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রেমানন্দে করজোড়ে তখন প্রাণের আকুতিভরা প্রণাম জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গকে জগাই। তাঁর নয়নের জল সর্বাঙ্গ বয়ে নীচে পড়ছে। তিনি আবার জ্ঞান হারালেন। তখন গৌরহরি নিজের শ্রীচরণখানি তাঁর বক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। যাঁর অভয়পদ স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর জীবন, সেই পদ হৃদয়ে ধরে জগাই সদৈন্যে তখন কেঁদেই চলেছেন। সেই দুরাচারী জগাই কই আর! ইনি যে এখন মহাভক্ত এক। জগাইয়ের ওপর গৌরহরির এমন করুণা দেখে উপস্থিত ভক্তবৃন্দরা হরিধ্বনি দিতে থাকলেন উচ্চৈঃস্বরে। আকাশ ভেদ করে সে দিব্যধ্বনি যেন গোলকে পৌঁছে যাচ্ছিল।
এতক্ষণ ধরে এতসবের সাক্ষী মৌন মাধাই। তাঁর ভাবান্তর ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী জগাই এমন কৃপা পেয় গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্ধার হয়ে গেল, অথচ, তিনি তিমিরেই পড়ে রইলেন !—– একথা ভেবে মাধাই তখন পাগলপ্রায় হয়ে গৌরাঙ্গের পাদপদ্মে পড়ে গেলেন ছিন্নমূল বৃক্ষের মত। তাঁর দুর্বুদ্ধির বিনাশ হয়ে গেছে। তিনিও এখন দুষ্কর্ম ছেড়ে জগাইয়ের মত ভক্ত হতে চান। তাই বিনয় বচনে বললেন- “আমরা দুই ভাই জগাই-মাধাই সর্বক্ষণ একসাথে থাকি। একই কুকর্ম করি, তবে কেন একজনকে কৃপা করে অন্যজনকে বঞ্চিত করবে প্রভু? আমাকেও উদ্ধার কর। ক্ষমা করে দাও আমায়। অনুগ্রহ করে আমাকেও তোমার নাম-গান প্রচারে সামিল কর। আমার মত দুর্জনকে তুমি উদ্ধার না করলে, আর কী গতি হবে আমার! কৃপা কর দয়াময়। কৃপা কর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “না, তোমার ত্রাণ কোনমতে হবে না। তুমি নিত্যানন্দের দেহে আঘাত করেছো।” মাধাই—-“প্রভু, তোমার অন্যান্য অবতারে কত অসুর তো তোমায় বাণেতে বিদ্ধ করেছে। তুমি তো তাঁদের সকলকেই উদ্ধার করেছো। তোমার অভয়পদে স্থান দিয়েছো। তবে আমার বেলায় কেন তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করবে তোমার! গৌরাঙ্গ, “তুমি তো আমায় নির্য্যাতন করোনি। করেছো আমার প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইকে। যদি আমায় করতে, তাহলে ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিতাম। কিন্তু, আমার দেহের থেকেও নিত্যানন্দের দেহ যে অনেক প্রিয় , অনেক বড় আমার কাছে। তাঁকে দুঃখ দিয়ে আমার কৃপা কোনমতেই পাবে না আমার থেকে।” মাধাই, “প্রভু, তুমি তো সর্ব রোগহর বৈদ্য চূড়ামণি। তবে আমার এই কঠিন রোগ কেমন করে দূর হবে বলো! বলে দাও কী করলে আমার পরিত্রাণ হবে এ ঘৃণ্য অপরাধের থেকে। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।” তখন গৌরসুন্দর বললেন- “যদি নিজের পাপমোচন করতে চাও, তবে যাঁর চরণে অপরাধ হয়েছে, তাঁর শরণ নাও। নিতাইয়ের অপরাধী তুমি, তাই নিতাইয়ের কাছেই তোমার ক্ষমাভিক্ষা করতে হবে। সে যতক্ষণ না কৃপা করবে, তোমার প্রেমভক্তি ততক্ষণ বাদ।”
মাধাই নিত্যানন্দের শ্রীচরণে পড়লেন। যে পদ দেব ঋষিগণ প্রার্থনা করেন, রেবতী যে পদযুগলকে সেবা করেন সেই পদে মাথা কুটতে থাকলেন মাধাই। গৌরহরি বললেন, “নিতাই তুমি ওকে ক্ষমা না করলে যে ও উদ্ধার হবে না ! তোমার কৃপা বিনা তো কেউ প্রেমভিক্ষা পায় না। তাই, এবার দেখো তুমি ওকে কী করবে!” নিত্যানন্দ হেসে বললেন, “আমার জীবনে যদি কিছু সুকৃতী থেকে থাকে, আমি তার সমস্তটা আজ মাধাইকে দান করলাম।” এই বলে মাধাইকে নিজের চরণ থেকে তুলে কৃপালিঙ্গন দিলেন তিনি। মাধাইয়ের শরীরে নিজ শক্তি সঞ্চার করে দিলেন। সকল বন্ধনের বিমোচন হয়ে গেল মাধাইয়ের। মহাভাগবত হলেন মাধাই সে মুহুর্তেই। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই-মাধাই, তোমাদের কোটি জন্মের সব পাপের ভার আমার হল। আর কিন্তু নতুন কোন পাপ কার্য করো না, আজ থেকে। তোমাদের পূর্বের কর্মের সবদায় আমার হল।“ জগাই-মাধাই সমস্বরে বলে উঠলেন- “না, না, বাবা, আর নয়। আমরা আর কোনদিন, কোন কুকর্ম করবো না। এমনকী করার কথা ভাববোও না।” গৌরাঙ্গ, “বেশ, তবে তোমাদের দেহ আমার অবতার হবে। তোমাদের দুজনার মুখ দ্বারা আহার হবে আমার।” এমন কৃপাশীর্বাদ পেয়ে দু’ভাই বাহ্য হারালেন। গৌরাঙ্গ তাঁর পরিকরদের বললেন, “এদের দুজনকে আমার ঘরে নিয়ে চল। ব্রহ্মার দুর্লভ যে ধন, আজ সেই ধন আমি এদেরকে দেব। সকলের থেকে উত্তম বানাবো। এদেরকে স্পর্শ করলে গঙ্গাস্নানের সমান ফল প্রাপ্ত হওয়া যাবে এমন পূণ্যবান ভক্ত বানাবো এদের।”
জগাই-মাধাই দু-ভাইকে নিয়ে গেলেন ভক্তরা প্রভুর ঘরে। তাঁদের দুজনকে ঘিরে সংকীর্তন শুরু হল। কীর্তনের রোল শ্রবণ করে প্রেমানন্দে উঠে বসে দু’বাহু তুলে অপার নৃত্য করতে থাকলেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দেহে বাহ্যস্মৃতি লোপ পেল। প্রেমে বিভোর দুই তনু তখন ঢলঢল, গড়গড়। অশ্রুনীরে সর্বাঙ্গ সিক্ত। সাত্ত্বিকভাবের প্রকাশ দেহে। দৈন্য, স্তুতি করে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের সেই দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়। তাঁদের দৈন্য দেখে বুক ফাটে এমন দশা তখন ভক্তদের। গৌরাঙ্গ বললেন, “আজ থেকে এরা আর মদ্যপ হবে না। এরা আমার সেবক। সকলে প্রাণঢেলে আশীর্বাদ কর এদেরকে যেন জন্মে-জন্মে আমায় না ভোলে আর। কারোর চরণে যদি কিছু অপরাধ থেকে থাকে এদের, তাহলে তোমরা নিজগুণে সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিও। কৃপা কর সকলে জগাই-মাধাইকে।” তখন দু’ভাই জগাই-মাধাই চোখের জলে ভেসে সকলের চরণ ধরে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকলেন । সকলে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাঁদেরকে আপন করে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেদিন থেকে তাঁরা অনুগত সেবক হলেন গৌর-নিতাইয়ের। এরপর সকলে মিলে কীর্তন করতে করতে গঙ্গাস্নান করতে গেলেন। অনেক জলকেলি হল। জগাই-মাধাইয়ের সব পাপ নিজে ধারণ করে নিলেন প্রভু। প্রমাণ দিতে ‘কালিয়া-আকার’ ধারণ করেছিলেন সেদিন। স্নান সেরে তীরে উঠে, নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ প্রভুদ্বয় আপন আপন কন্ঠের মালা জগাই-মাধাইকে পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে মহাভাগবত হলেন দু-ভাই জগাই ও মাধাই।
“মহাপ্রভু দুঁহে করিয়া আলিঙ্গন।
বোলে আজি হৈতে মোর সেবক দুইজন।। নিতাই আলিঙ্গিয়া দুঁহে বলয়ে বচন।
প্রিয় শিষ্য হৈলে মোর তোমরা দুইজন।। জগাই মাধাই হৈলা ভক্ত অতিশয়।
দুই প্রভুর দুই শাখা মধ্যে গণনা যে হয়।।”
(প্রেমবিলাস, ২১)
“এতেক যতেক কৈল এই দুইজনে।
করিলাম আমি ঘুচাইলাম আপনে।।
ইহা জানি এ দুইয়ে সকল বৈষ্ণব।
দেখিয়া অভেদ দৃষ্ট্যে যেন তুমি সব।।
শুন এই আজ্ঞা মোর যে হও আমার।
এ দুইয়ে শ্রদ্ধা করি যে দিব আহার।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যত মধু আছে।
সে হয় কৃষ্ণের মুখে দিলে প্রেমরসে।।
এ দুইরে বট মাত্র দিবে যেই জন।
তার সে কৃষ্ণের মুখে মধু সমর্পণ।।
এ দুই জনেরে যে করিবে উপহাস।
এ দুইর অপরাধে তার সর্বনাশ।।
তবে গলার মালা দোঁহার গলে দিল।
প্রভু কৃপা পাই দোঁহে প্রেমেতে ভাসিল।।”
(চৈ.ভা-১৩)
পরম প্রেমিক, মহাভক্ত জগাই-মাধাই দু’ভাই এখন দিবানিশি কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে আঁখি নীরে ভাসেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে এসে তাঁরা দুই লক্ষ নাম নেন। কৃষ্ণ বলে নিরবধি হা-হুতাশ করেন। কৃষ্ণময় জগৎ এখন তাঁদের। কিন্তু, এত সবের সঙ্গে নিজেদের অতীতের কীর্তিকলাপের কথা ভেবে ধিক্কার দেন নিজেদেরকেই তাঁরা। নিজেদের জীবহিংসার কথা ভেবে মরমে মরে যায়। ভূমিতে পড়ে আকুলি-বিকুলি করেন অনুশোচনায়। পতিত পাবন গৌরসুন্দর কত দয়াময় আর নিত্যানন্দ এত করুণাময়(!), তাঁদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন এত অবলীলায়, এত কৃপা করলেন!—–এসব ভেবে কেঁদে আকুল হন তাঁরা। বিহ্বল হয়ে যান প্রভুদের কৃপালীলার কথা ভেবে। কখনো কৃষ্ণপ্রেমানন্দে, কখনো নিজেদের কর্মের কথা ভেবে প্রায়ই আহার করেন না। তখন নিতাই-গৌরসুন্দর অনেক বুঝিয়ে আহার তুলে দেন মুখে তাঁদের।
মাধাই আরও বেশী অনুশোচনায় ভোগেন জগাইয়ের থেকে। তিনি নিতাইকে প্রহার করেছেন, রক্ত বের করে দিয়েছেন মাথা থেকে; কত না পাপীষ্ঠ তিনি! —-একথা ভেবে বক্ষ ভাসান নয়ন জলে। যদিও নিতাই তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও একদিন দন্তে তৃণ ধরে আবার নিত্যানন্দের চরণে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন তিনি। চোখের জলে নিত্যানন্দের চরণ ধুয়ে দিলেন, স্তব করলেন কত না। সন্তুষ্ট নিত্যানন্দ বুকে টেনে নিলেন তাঁর প্রিয় মাধাইকে। বললেন- “মাধাই, তুমি এখনো এতদিন পরেও কেন এমন করো। শোক পরিহার কর। তুমি তো এখন আমার দাস। তোমার শরীর এখন আমার সম্পদ। তুমি এভাবে দৈন্যক্রন্দন করে আমাকে কেন কষ্ট দাও। শিশুপুত্র যদি পিতাকে মারে, পিতার কী কিছু যায় আসে তাতে! পুত্রের অপরাধ দেখে না পিতা। তেমন তুমিও তখন অজ্ঞানী ছিলে শিশুপুত্রের ন্যায়। তোমার কোন অপরাধ আমি দেখিনি। তার ওপর আমার প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ তোমায় আপন করেছেন। যাকে তিনি কৃপা করেন, সে আমার জন্মে জন্মে প্রিয়পাত্র হয়। আর যে জন তাঁকে লঙ্ঘন করে আমায় পূজা দেয়, সেই মূঢ় কখনো আমার কৃপার প্রাপ্ত হয় না, প্রিয়পাত্র হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তোমায় তিনি কৃপা করেছেন যখন, তখন তুমি আমার যে কত প্রিয় হয়েছো, তা আমি বোঝাতে পারবো না।” এইবলে নিত্যানন্দ মাধাইকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। তখন মাধাইয়ের অন্তর শান্ত হলেন। মাধাই বললেন, কিন্তু, প্রভু আমার যে অনেকের কাছে অনেক অপরাধ জমা আছে। তার কি হবে? আমি তো তাদের সকলকে চিনিও না। ভুলে গেছি কারা তারা। কি করে তাদের কাছে আমি ক্ষমা চাইবো? আমি বহু বহু পাপ করেছি এতদিন ধরে। কি করে সেই অপরাধবোধ যাবে আমার?”
তখন নিত্যানন্দ বললেন, বেশ, তবে এক কাজ করো। তুমি প্রতিদিন গঙ্গারঘাটে গিয়ে মার্জন করবে ঘাঁট। যারা স্নান করতে আসবে তাদের যতটা সম্ভব সেবা করবে। তারা স্নান করে উঠলে তাদের প্রণাম জানিয়ে ক্ষমা চাইবে। প্রসন্ন হয়ে তারা তোমায় আশীর্বাদ করবে কল্যাণ হোক বলে, তাতেই তোমার পাপস্খলন হবে, অপরাধবোধ চলে যাবে। হৃদয় প্রশান্ত হবে। এই আকুলতা দূর হবে।
নিত্যানন্দের দেখানো পথেই এখন জগাই-মাধাই আচরণ করেন। সকলের চরণ ধরে প্রার্থনা করেন- “জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যত পাপ করেছি আপনার প্রতি, ক্ষমা চাইছি সবের জন্য। আপনি ক্ষমা করুন এই জীবাধমকে, এই পতিতকে। এ নরাধম ভিক্ষা মার্জনা চাইছে আপনার থেকে।” তাঁদের ক্রন্দন দেখে আর অনুরোধ শুনে ঘাটে আগত স্নানার্থীদের চোখেও জল এসে যেত। তাঁরাও নয়নাশ্রু ফেলে ক্ষমা করে দিতেন। আবেগে তাঁদের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যেত জগাই-মাধাইয়ের বিনয় দেখে।
প্রেমিক সুজন জগাই-মাধাই কঠোর থেকে কঠোরতম ভজনে মগ্ন হলেন। ব্রহ্মচারী বলে তাঁরা খ্যাত হলেন। তাঁরা কোদাল চালিয়ে মাটি কেটে গঙ্গার ঘাট বানালেন। এখনও সে স্থান দর্শন হয়। ‘মাধাইয়ের ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ সে ঘাট, নিত্যানন্দের করুণাগুণে তাঁরা চৈতন্যচরণ পেয়েছেন। গৌরাঙ্গের পতিত পাবন লীলার মহাপ্রমাণ হলেন তাঁরা। নিতাইয়ের কৃপাপাত্র এই দুই ভাগ্যবান ভ্রাতারা আসলে শ্রীনারায়ণের ধাম বৈকুন্ঠের দুই দ্বারপাল ‘জয়’ ও ‘বিজয়’। সনকাদি মুনির অভিশাপে দুর্বৃত্ত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরণীতে। “বৈকুন্ঠে দ্বারপালৌ যৌ জয়াদ্য বিজয়ান্তকৌ। তাবাদ্য জাতৌ স্বেচ্ছাতঃ শ্রীজগন্নাথ-মাধবৌ।” (গৌ.গ.দি.-১১৫)
নিত্যানন্দ চেয়েছিলেন প্রাকৃত মদ্যপান করে যেমন অস্পৃশ্যরা উন্মত্ত হয়, তেমন মদ্যপ জগাই-মাধাই প্রেমভক্তিসুধা পান করে পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হোক, কীর্তন করুক, নৃত্য করুক আবেশে, ভজন পরায়ণ হোক,সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হোক গৌরকৃপাপাত্র হবার——সে ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রকৃত অর্থেই। মহা ভাগবত, ভজনানন্দী হয়েই সারাটা জীবন কাটালেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দর্শনেই মানব পাপমুক্ত হত, কৃপা প্রাপ্ত হত।
ওহে প্রেমিকসুজন দুই ভ্রাতা ‘শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই’ , কৃপা করুন যাতে নিরবধি নিতাইচরণ চিন্তা করতে পারি, চৈতন্য কৃপার যোগ্য পাত্রী যেন হতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণে অনন্ত অর্বুদ কোটি প্রণাম এ জীবাধমার।
—– (সংকলিত), গ্রন্থ — ‘মহাপ্রভুর মধুময় কথা’, লেখিকা–রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক,
উত্তর ভারত থেকে পুরী যাওয়ার পথে প্রধান সড়কের ধারেই বিষ্ণুপুর অবস্থিত।ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে এখানে মন্দিরের সংখ্যা ছিল ৩৬০টি।ফলে পুরী যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা এখানে আসতেন আর দেববিগ্রহের পূজা দিয়ে দক্ষিণা-প্রণামীও দিতেন। স্বভাবতঃই মন্দির গুলো থেকে আয় হত প্রচুর।বিষ্ণুপুরের আয়ের এক অন্যতম উৎস ছিল মন্দির। আর, দেববিগ্রহদের মধ্যে সবথেকে বেশী আকর্ষনীয় বিগ্রহ ছিল শ্রীমদনমোহনদেব। মদনমোহন মন্দিরের আয় ছিল বিষ্ণুপুরের সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এ তথ্য পাওয়া যায় ১৭৮৯সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা একটি চিঠিতে। চিঠিটি লিখেছিলেন বীরভূমের সেইসময়ের কালেক্টর জী. কীটিংসয়ে’র এ্যাসিস্ট্যান্ট অন ডেপুটেশন– এ. হেসিলরীজ। সেসময় বিষ্ণুপুরে অর্থাভাব চলছিল আর মদনমোহনদেব কলকাতার বাগবাজারে ছিলেন। হেসিলরীজ লিখেছিলেন–‘এই বিগ্রহকে যদি বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় , তবেই সেখানকার সম্পদবৃদ্ধির সম্ভবনা আছে।’ অতএব, মদনমোহনদেবের নাম প্রাচীন বিষ্ণুপুরের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। আবার, এক দেববিগ্রহকে নিয়ে রাজপরিবারে মামলা , বন্ধকী, ডিক্রী— এ ঘটনা ইতিহাসে আর নেই। তাই মদনমোহন বিগ্রহ বিষ্ণুপুরের রাজপ্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক দলিল স্বরূপ। বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে(?)—তাঁর বর্তমান অবস্থানকে কেন্দ্র করে বিতর্ক বা ধোঁয়াশা এখনও পর্যন্ত মেটেনি বললেই চলে। সেইসাথে তাঁর নানান অবিশ্বাস্য অলৌকিক লীলা— সমস্তটা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় শ্রীমদনমোহনদেবের কাহিনী ভীষণ আকর্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর। আসুন, মদনমোহনকে নিয়ে ইতিহাসের সেই টানা-পোড়েন দৃশ্য একটু দেখার চেষ্টা করি।
ষোড়শ শতকে বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের ৪৯তম রাজা ছিলেন বীর হাম্বীর বা হাম্বীর মল্ল । ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজত্ব শুরু করেন।তাঁর অধীনে ডাকাত বাহিনী থাকতো।পথচারীরা বিষ্ণুপুরের জঙ্গল পার করতে গেলেই এই সব ডাকাতরা দস্যুতা করে সব ছিনিয়ে নিত। তারপর সব সম্পদ বীর হাম্বীরকে দিয়ে দিত ।বদলে এদের ভরণপোষণের ভার রাজা বহন করতেন। সেসময় এই ডাকাতদের জন্য পথচারীদের পক্ষে বনবিষ্ণুপুর পেরোনো রীতিমত ত্রাসের ব্যাপার ছিল।
“ঐছে দুষ্ট রাজা নাই ভারতভূমিতে ।
কেহ না পারয়ে এ পাপীরে দন্ড দিতে।।”
(ভক্তিরত্নাকর,৭/৭১)
বৃন্দাবন থেকে শ্রীরূপ-সনাতন,কবিরাজ গোস্বামী ও অন্যান্য গোস্বামীদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে গৌড় দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন শ্রীনিবাস , নরোত্তম ও শ্যামানন্দ প্রভু। উদ্দেশ্য গৌড়দেশে ভক্তি গ্রন্থ প্রচার করবেন। সকল গ্রন্থ পেটিকায়(বাক্স বা সিন্দুক) ভরে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ;সাথে দুজন পাহারাদারও রয়েছে। জঙ্গলপথে বিষ্ণুপুরের ডাকাতদের নজরে পড়লো গো-শকট আর তাতে যত্ন করে রাখা পেটিকা। তারা পিছু নিল। রাতের বেলায় বিশ্রাম নিতে গাড়ি থামিয়ে যখন সকলে ঘুমোচ্ছে তখন পেটিকা ডাকাতি করে পালিয়ে গেল ডাকাতরা। জমা দিল রাজকোষাগারে।পরদিন সকালে ডাকাতির দ্রব্য দেখতে রাজা এলেন।পেটিকা খোলা হল। সে কি !সোনা, রূপা, হীরে , জহরত কিছুই তো নেই ভেতরে। কেবল পুঁথি আর পুঁথি! কিন্তু সোনা-রূপো না থাকলেও যা ছিল তা সোনার থেকেও মহিমায় অমূল্য রতন। রাধা-কৃষ্ণতত্ত্ব ,ভক্তিতত্ত্ব ,ভক্তিসিদ্ধান্ত সমৃদ্ধ মহাজন লিখিত গ্রন্থগুলো স্পর্শ করা মাত্র লেখনীর দিব্য প্রভাবে যেন পরিবর্তিত হয়ে গেল দস্যুরাজা বীর হাম্বীরের হৃদয় ।
এদিকে সকালে শ্রীনিবাস আচার্যদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।সংবাদ গেল বৃন্দাবনে। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে লেখা মহাগ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’র পান্ডুলিপিও ছিল পেটিকায়। লেখক অশীতিপর বৃদ্ধ শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন যে তিনি জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করলেন । বিষ্ণুপুরে অনেক অন্বেষণ করেও যখন গ্রন্থপেটিকা পাওয়া গেল না তখন শ্রীনিবাস হতাশ শ্যামানন্দ ঠাকুর ও নরোত্তম ঠাকুরকে তাঁদের নিজেদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন আর নিজে রয়ে গেলেন বিষ্ণুপুরে । মনে মনে ভাবলেন এক না একদিন কোন না কোনভাবে গ্রন্থের সুলুক সন্ধান তিনি পাবেনই পাবেন ।
দশ দিন কেটে গেল , অনেক অনুসন্ধান করেও কোন কিনারা করতে পারলেন না শ্রীনিবাস। একটি গাছের তলায় ক্লান্ত,শ্রান্ত হয়ে মলিন মনে বসে আছেন আর দুঃশ্চিন্তা করছেন। এমন সময় কৃষ্ণবল্লভ নামে এক ব্রাক্ষ্মণ কিশোর হাজির হল সেখানে। তার সঙ্গে আলাপ করে কথা প্রসঙ্গে বনবিষ্ণুপুরের রাজার আচরণ জানতে পারলেন শ্রীনিবাস। রাজা রাতে দস্যুবৃত্তি করান আর দিনের বেলায় রাজসভায় শাস্ত্র আলোচনা করান — একথা জেনেই সেই কিশোরকে তিনি বললেন, ” আমায় একদিন নিয়ে যেতে পারবে সেই সভায়?” কিশোর সানন্দে রাজী হয়ে মাথা নাড়ল। শ্রীনিবাস এলেন রাজসভায় শাস্ত্র ব্যাখ্যা শুনতে। ব্যাস চক্রবর্তী পুরাণ ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছিলেন।মনে মনে শ্রীনিবাস যা ভেবেছিলেন তাই হল। পন্ডিত এর ব্যাখ্যায় ভুল ছিল। শ্রীনিবাস ভুল ধরলেন ।রাজা বীর হাম্বীর বলে বসলেন , “এত যখন সাহস দেখালেন , তাহলে এবার আপনিই ব্যাখ্যা করুন। শুনি সকলে।” শ্রীনিবাস এটাই চাইছিলেন ,কারণ ,তিনি জানতেন কোনভাবে যদি রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে পারেন তবে রাজার হস্তক্ষেপে গ্রন্থপেটিকা প্রাপ্তিতে সুবিধা হতে পারে। হলও তাই ।তিনি ভ্রমর গীতা শ্রবণ করালেন। তাঁর প্রেমভক্তি সমন্বিত অসাধারণ শাস্ত্র ব্যাখ্যায় , নিখুঁত বিশ্লেষণে সভায় উপস্থিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্রত্যেকের চোখে জল এল আবেগে, ভক্তিতে ।খুশি হয়ে পুরষ্কার ঘোষণা করতে চাইলেন রাজা, বললেন, ” আপনার যা চাই আমি তাই দেব , আর এবার থেকে আপনাকে রোজ ভাগবত প্রবচন করতে হবে সভায়।” শ্রীনিবাস বললেন,” রাজামশাই আমার কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। আপনি যদি পারেন আমার অপহৃত ধনের প্রাপ্তিতে একটু সাহায্য করুন ।” এই বলে সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাজা বললেন ,”আপনি আসুন আমার সঙ্গে।” রাজকোষাগারে নিয়ে গেলেন তাঁকে। বিস্মিত শ্রীনিবাস দেখলেন, যে গ্রন্থপেটিকার জন্য তিনি এতো অনুসন্ধান চালিয়ে চলেছেন হন্যে হয়ে, তা সব রাজার কাছেই গচ্ছিত রয়েছে। শ্রীনিবাস আচার্যকে গ্রন্থপেটিকা ফিরিয়ে তো দিলেনই রাজা ,পরবর্তীতে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন তাঁর থেকে। বীর হাম্বীরের পত্নীর নাম ‘সুলক্ষণা’ ও পুত্রের নাম ছিল ‘ধাড়ীহাম্বীর’ ।পরম বৈষ্ণব হলেন সপরিবারে তাঁরা। বীর হাম্বীরের সময় থেকেই বংশপরম্পরায় মল্ল রাজারা বৈষ্ণব ভক্ত হলেন । তার আগে তো তাঁরা শাক্ত ছিলেন।বিষ্ণুপুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মৃন্ময়ীর যে মন্দির আমরা দেখতে পাই তা ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজা জগৎমল্লই নির্মাণ করে দিয়েছিলেন । বীর হাম্বীর সমস্ত অসাধু কর্ম ত্যাগ করলেন । তিনি শ্রীকালাচাঁদ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করালেন শ্রীনিবাস আচার্যের দ্বারা।
“হৈল বীর হাম্বীরের পরম উল্লাস।
শ্রীকালাচাঁদের সেবা করিলা প্রকাশ।।
রাজা বীর হাম্বিরের রাণী সুলক্ষণা।
আচার্য্য প্রভুরে কত করিলা প্রার্থনা।।
আচার্য্য প্রসন্ন হইয়া দীক্ষামন্ত্র দিলা।
পাইয়া যুগল মন্ত্র রাণী হর্ষ হৈলা।।”
(ভক্তিরত্নাকর, ৯/২৭০)
পরবর্তীতে রাজা বীর হাম্বীর বৈষ্ণব ধর্মের একজন পরম পৃষ্ঠপোষক হলেন। তিনি কালাচাঁদকে নিয়ে অপূর্ব পদ রচনা করেন, যেগুলি পদকল্পতরু’তে স্থান পেয়েছে। যখন নিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী শ্রীমতী জাহ্নবা ঠাকুরাণী বৃন্দাবনে কাম্যবনের গোপীনাথের জন্য রাধিকা মূর্তি নির্মাণ করিয়ে গৌড়দেশ থেকে বৃন্দাবনে পাঠান ,তখন সেই বিগ্রহের জন্য মূল্যবান অলংকার সামগ্রী, বস্ত্র, বাসনপত্র ও যাবতীয় উপঢৌকন সব এই বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বীরই প্রদান করেছিলেন। বৃন্দাবনের আচার্য শ্রীল জীব গোস্বামীজী প্রসন্ন হয়ে তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন ‘চৈতন্য দাস’ ।
“শ্রীজীব গোস্বামী হইলা প্রসন্ন তোমারে ।
শ্রীচৈতন্য দাস নাম থুইল তোমার ।।”
( ভক্তিরত্নাকর, ৯,২০৫)
এই বীর হাম্বীর রাজা একবার বৃষভানুপুরের বনে পথ হারিয়ে ক্লান্ত ,অবসন্ন হয়ে সন্ধ্যাবেলায় উপস্থিত হলেন এক কুটীরে। সে কুটীরে সাধনা করতেন এক তান্ত্রিক। তান্ত্রিকের কাছে পূজিত হতেন অপূর্ব দর্শন শ্রীমদনমোহন বিগ্রহ। বিগ্রহের রূপমাধুরী দর্শন করা মাত্র রাজার ইচ্ছা হলো সে বিগ্রহ নিজের কাছে রাখার । তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তান্ত্রিক ওই বিগ্রহ কোথায় পেয়েছেন। তান্ত্রিক জানালেন যে ,বনবিষ্ণুপুরের বিল থেকে এক জেলেনীর জালে উঠেছিলেন বিগ্রহ । জেলেনী নিজে পূজার্চনার কিছু জানতেন না বলে তান্ত্রিককে সেটি দিয়ে দিয়েছিলেন পূজা করার জন্য।
বৃষভানুপুর থেকে কোন উপায়ে বীর হাম্বীর সে বিগ্রহ রাজপ্রাসাদে উঠিয়ে আনলেন । এদিকে বিগ্রহ-হারা তান্ত্রিক লোক মারফৎ জানতে পারলেন যে, মদনমোহন রাজার কাছে আছে। তিনি বিগ্রহ ফেরত চাইতে রাজদরবারে আসলেন। কিন্তু, রাজা বললেন, “তোমার যত ধন সম্পত্তি লাগে নিয়ে যাও, ওই বিগ্রহ আমাকে দিয়ে দাও তুমি।” তান্ত্রিক রাজী নন। তাঁর অন্য কিছু নয় , বিগ্রহই লাগবে। কয়েকদিন পর ফেরৎ দেবেন এই বলে শেষে রাজা সময় চাইলেন। এক নকল বিগ্রহ গড়ালেন আর তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে বললেন তান্ত্রিককে।কিন্তু বিগ্রহকে বুকে লাগিয়ে তাঁর অঙ্গগন্ধ নিতেই তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন যে, সেই বিগ্রহ তাঁর নয়, নকল বিগ্রহ সেটি। তিনি নিজের বিগ্রহ চাইলেন। রাজা বললেন, নিতে হলে ওই বিগ্রহই নিতে হবে, ওটিই আসল । শেষে অশ্রুপাত করতে করতে তান্ত্রিক বললেন ,”আজ আপনার দিন ভালো যাচ্ছে তাই আমায় এমন করে ফেরাতে পারলেন। একদিন এমন আসবে যখন আপনাদেরও এই বিগ্রহের জন্য কাঁদতে হবে, বলে গেলাম আমি।”
“মল্ল রাজাদের সময় ভালো হইতে সদয় ।
সময় গেলে কবে তারে দেখ কাঁদিতে হয়।।”
(মদনমোহন বন্দনা, অভয়পদ মল্লিক)
মদনমোহন রয়ে গেলেন রাজার কাছে। ভালোই থাকেন। ভক্ত রাজা যত্ন করেন ,মন প্রাণ ঢেলে সেবার ব্যবস্থা করেছেন। রাজপুরোহিত ধরণী মহাপাত্রকে নিযুক্ত করলেন সেবার্চনার জন্য। মদনমোহনের জন্য রাসমঞ্চ নির্মাণ করিয়ে দিলেন । সেটা তখন ১৬০০খ্রিষ্টাব্দ।রাসমঞ্চের বিশাল বেদী।বেদীর ওপর মঞ্চ, চূড়া ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। চূড়ার শৈলী পিরামিডের মত। ৩৫ফুট উঁচু ও ৮০ফুট চওড়া টেরাকোটার কারুকার্যে খোদিত এই অসামান্য রাসমঞ্চ পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। মূলতঃ বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার স্থাপত্য বীর হাম্বীরের আমল থেকেই প্রসার লাভ করে । তাঁর অপর এক কীর্তি হল দলমাদল কামান স্থাপন।এই কামানও অতীব আশ্চর্য দর্শণীয় বস্তু। কারণ, মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথর গলানো ,লোহা দিয়ে তৈরী ২৯৬মণ ওজনের এই কামানে এখনো একবিন্দুও মরচে ধরেনি। কামানের নাম সম্ভবতঃ প্রথমে ছিল দোলমর্দন ( মর্দন অর্থাৎ দলন, শত্রু পীড়ন) ।কালের অপভ্রংশে নাম হয় দলমাদল। তবে জনশ্রুতি বলে যে ,বীর হাম্বীর দল ও মাদল নামে দুটি কামান বসিয়েছিলেন। মাদল কামনটি বর্তমানে লালবাঁধে জলের মধ্যে পড়ে আছে ,দেখতে পাওয়া যায় না। আর , যে কামানটি দেখা যায় সেটি হল ‘দল’ কামান। যদিও সম্প্রতি কালে লালবাঁধ সংস্কার হলেও কোন কামান কিন্তু সেখানে দেখা যায় নি। এখন, এত বছরে জলকাদায় মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে কিনা সেটাই বা কে বলতে পারে। বিষ্ণুপুর মিউজিয়ামের তত্ত্বাবধায়ক ঐতিহাসিক শ্রী তুষার সরকার জানালেন যে, ট্রেজারি বিল্ডিং-এ একটি কামান ছিল এতদিন ধরে , বর্তমানে বিষ্ণুপুর প্রশাসনিক ভবনের সামনে সেটি স্থাপন করা হয়েছে। এই কামানটির কোন ইতিহাস জানা যায় না । এই কামানটি ‘মাদল’ কামান হলেও হতে পারতো। কিন্তু, এটি আকারে অন্য কামানটির থেকে এতটাই ছোট যে সেটিও নিশ্চিত রূপে বলা সম্ভব নয়। অতএব, আলাদা করে মাদল কামান ছিল কিনা তা প্রশ্নবোধক।এই দলমাদল কামানের সঙ্গে মদনমোহনের এক অবিশ্বাস্য অলৌকিক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বীরহাম্বীর। বীর হাম্বীরের পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে রাজা হন ধাড়ী হাম্বীর, রঘুনাথ মল্লদেব,বীর সিংহদেবের পর দুর্জন সিংহদেব। এই রাজা দুর্জন সিংহদেব মদনমোহনদেবের জন্য নির্মাণ করে দেন মন্দির। বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার শ্রেষ্ঠ মন্দির এটিই। দৈর্ঘ্য ১২.২মিটার ও প্রস্থ ১০.৭মিটার। মন্দিরের টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকার্যময় খিলান, দেওয়াল আজও বিস্ময়ান্বিত করে দেশ-বিদেশের পর্যটক ও গবেষকদের। Archeological Survey of India (Kolkata circle)মন্দিরের বাইরে প্রশস্তিতে লিখেছে –‘এই মন্দিরটি ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ তৈরি করেন। বাংলা চালার ছাদে একটি শিখর বিশিষ্ট ইটের একরত্ন মন্দিরগুলির মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ। মন্দির দেওয়ালের পোড়ামাটির অলঙ্করণও দেখার মত।’
প্রসঙ্গত, বীর হাম্বীরের পৌত্র রঘুনাথ মল্লদেবের সময় মল্লরাজারা মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে ‘সিংহ’ উপাধি পেয়েছিলেন।আর তাই, রঘুনাথের পরবর্তী রাজাদের নামের পরে মল্লের পরিবর্তে ‘সিংহদেব’ যুক্ত হয়।
দুর্জন সিংহের পর দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহদেব , আর তারপর গোপাল সিংহদেব রাজা হন। গোপাল সিংহ ছিলেন কট্টর বৈষ্ণব। বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক রাজ্যবাসীকে সন্ধ্যেবেলায় হরি নামের মালা জপ করার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।এমনকি প্রজারা ঠিকঠাক মালা জপ করছে কিনা ,তা পরীক্ষার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করেছিলেন। এদিকে বর্ধমানের বর্গী রাজা ভাস্কর রাও আক্রমণ চালাবার প্রস্তুতি শুরু করে দেন বৈষ্ণবরাজা গোপাল সিংহের নিরীহতার সুযোগ নিয়ে।
একদিন আচমকাই মধ্যরাতে মারাঠা বর্গীরা অতর্কিত হামলা করল বিষ্ণুপুরের ওপর। খবর আগে থাকতেই পেয়েছিলেন গোপাল সিংহ ।কিন্তু মদনমোহনের চরণে একান্ত শরণাগত ,আত্মনিবেদিত রাজা একটুও বিচলিত হলেন না। তিনি রাজ্যবাসীদের আদেশ দিলেন সকলে যেন সারা রাত ধরে হরিনাম করতে থাকে। কোন অস্ত্র কেউ ধরল না । প্রত্যেক সৈনিক পর্যন্ত হরিনাম নিতে থাকলেন আর রাজার নিজের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ , সারা রাত ধরে রাজ্যবাসী কামানের গোলাবর্ষণের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শুনলেন। অনেকে তো ভয়ে মূর্ছিত হলেন কামানের ভীষণ শব্দে। পরে দেখা গেল যে ৫২ হাজার বর্গী সেনার একজনও আর নেই । তাহলে গোলা বর্ষণ করল কে? কামান চালাল কে?
সকালে পুরোহিত গর্ভগৃহের দ্বার খুলে দেখেন বিগ্রহের সারা গায়ে বারুদের দাগ আর পোড়া বারুদের গন্ধে ভরে মন্দির। এদিকে এক গোয়ালা এসে ধরলো রাজাকে ;নিবেদন করলো, ” রাজামশাই ,আপনার ছেলে দই খাওয়ার টাকা শোধ করুন ।সে বলেছে আপনার থেকে চেয়ে নিতে।” রাজা বললেন–“আমার ছেলে আবার কখন দই খেল, তা আবার তোমার থেকে?” গোয়ালা বললো–‘আপনারই ছেলে তো! সিপাহির বেশ পরা, সারা গায়ে-মুখে কালি ঝুলি মাখা ।বারুদপোড়া গন্ধ কী তাঁর শরীর থেকে! নাম বলল বোধহয় মদনমোহন।” রাজার মূর্ছা যাবার উপক্রম হল শুনতেই।বললেন , “গোয়ালা তোমার যে কত সৌভাগ্য কী বলবো। তুমি সাক্ষাৎ বিষ্ণুপুরের ভগবানকে দর্শন করেছ আজ। তাঁকে দই খাইয়েছ! তুমি ধন্য।” আনন্দের আতিশয্যে পাগলপ্রায় দশা তখন গোয়ালার। ভগবানকে দেখেছে সে —- এ সৌভাগ্যের কথা কাকে বলবে, কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ দেখা গেল তার দইয়ের হাঁড়িগুলো চকচক করে উঠলো , সোনার হয়ে গেল।রাজা গোপাল সিংহ আর ঠিক থাকতে পারলেন না ।তাঁর মদনমোহনের এতসব অলৌকিক কীর্তিকলাপ দেখে তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে গেলেন। আসলে, যাঁর চরণে সব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা , দায় তো সব, তাঁর ওপরই বর্তায় তখন ।তাই মদনমোহন নিজেই কামাল দেগে বর্গী তাড়িয়েছেন সারারাত ধরে। আর তখনই নাকি যুদ্ধ শেষে মাদল কামানটি জলে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
” লালবাঁধে দল-মাদল দুটি কামান ছিল।
তার মধ্যে ৮০মণ বারুদ ভরিল।।
দুইটি কামান প্রভু লইলো দুই বগলে।
দুই হাতে দু-কামানে দিল পলতে জ্বেলে।।
এক কোপে বহু বর্গী হইল নিধন।
কামানের শব্দে মূর্চ্ছা গেল বহুজন।।”
(মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য, গাইড বুক)
ভক্তের বিপদের সময় ভগবান যে বিপদভঞ্জন হন, সে প্রমাণ দিলেন মদনমোহন। আর , তা জানাবার জন্যই মদনমোহন করেছিলেন দই খেয়ে পয়সা না দেবার লীলা। সেই গোয়ালার নাম ছিলো গোপাম মূরতি।
এখন, সময়টা ১৭৪৮ সাল। বিষ্ণুপুরের রাজসিংহাসনে রাজা গোপাল সিংহদেবের পর রাজা চৈতন্য সিংহদেব বসেছেন। তিনিও ভক্তিমান রাজা । এদিকে রাজপরিবারের অপর সদস্য দামোদর সিংহদেব সিংহাসন দখল করার জন্য মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে হাত মেলালেন ।নবাব সাহায্য করলেন ।বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন বাঁকুড়া ।কিন্তু ,লক্ষ্য পূরণ হলো না। জিততে পারলেন না । এরপর নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ১৭৫৬ সালে পলাশীর যুদ্ধে হেরে প্রাণ হারান ইংরেজদের হাতে। তিনিই ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। সেসময় বাংলার প্রত্যেকটি রাজ্য ইংরেজের করদ্ রাজ্যে পরিণত হল। অর্থাৎ , রাজাদের সকলকেই ইংরেজদেরকে খাজনা বা কর দিতে হত। সামন্তরা ইংরেজের তোষামোদকারী জমিদারে পরিণত হয়েছেন। আবার ইংরেজদের ছত্রছায়ায় সেসময় উত্থান ঘটলো আরেক নতুন গোষ্ঠীর….. তাঁরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ।
হাওড়া জেলার কোন্নগরে বাস করতেন শ্রী সীতারাম মিত্র মহাশয়। বর্গীদের প্রচণ্ড উৎপাত ,অত্যাচার মাঝেমধ্যেই হয় সেখানে । তাই সেখান থেকে মিত্র মহাশয় চলে এলেন সুতানটি গ্রামে বা এখনকার কলকাতার বাগবাজারে । এখানে তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য। রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা।ফলে বর্গীদের উৎপাত ছিল না বললেই চলে । সীতারাম মিত্রের পুত্র শ্রী গোকুলচন্দ্র মিত্রের ছিল লবণের ব্যবসা। বড় ব্যবসায়ী তিনি ,সেইসাথে অত্যন্ত দয়ালুও ছিলেন । তাঁর আমলে প্রত্যেকদিন হাজার জন অনাথ-আতুড় খাবার পেত। ব্যবসার সূত্রে গোকুল মিত্র কোন ভাবে পরিচিত ছিলেন রাজা চৈতন্য সিংহের সঙ্গে। চৈতন্য সিংহদেবের আমন্ত্রণে তিনি বেশ কয়েকবার বিষ্ণুপুর এসেছিলেন। যেবার তিনি প্রথম দর্শন করেন মদনমোহনদেবকে , সেবারই দর্শন মাত্র মদনমোহনের প্রতি এক অপার্থিব টান অনুভব করেন। মন যেন চাইতে থাকল মদনমোহনের সান্নিধ্য, তাঁকে সেবা করার সৌভাগ্য। হয়তো বা সে কারণেই গোকুল মিত্র একাধিকবার বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন ।
এক সময় চৈতন্য সিংহদেবের কিছু অর্থাভাব হয় ।গোকুলচন্দ্র বাড়িয়ে দেন চৈতন্য সিংহদেবের দিকে সাহায্যের হাত। তিনি তিন লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন চৈতন্য সিংহকে। তবে গোকুল মিত্র শর্ত একটা রাখলেন যে যতদিন না টাকা ফেরৎ দিতে পারবেন চৈতন্য সিংহ ,ততদিন মদনমোহনদেবকে তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখতে হবে। অর্থাৎ কিনা বন্ধক রাখতে হবে । আসলে সেই যে মিত্র মহাশয়ের মন বিকিয়ে গেছে মদনমোহনের পদপঙ্কজে ,এখন এসুযোগে তিনি নিজের কাছে মদনমোহনকে রেখে দিতে চান ,প্রাণভরে সেবা করতে চান কিছুদিন । আবার,ভক্তবৎসল ভগবান তো প্রেমের কাঙ্গাল চিরকালই। তাঁরও মন হয়েছিল গোকুল মিত্রের প্রেমসেবা গ্রহণ করে তাঁকে সুখী করতে। ভক্ত যেমন ভগবানকে সুখ দিতে চায় , ভগবানও তো তেমন তাঁর ভক্তকে সুখী দেখতে ভালোবাসেন। তাই হয়তো বা এমন পরিস্থিতি তৈরী হল।মন একবিন্দুও না চাইলেও ভাগ্যের পরিহাসে চৈতন্য সিংহদেবকে বাধ্য হয়ে কুলদেবতা মদনমোহনকে বন্ধক রাখতে হল গোকুল মিত্রের কাছে। রাজা আকুল হয়ে অশ্রু বিসর্জন করছেন দেখে , মদনমোহনদেব সান্ত্বনার পরশ দিলেন তাঁর প্রিয় চৈতন্য সিংহকে । তিনি পূর্ণ সায় জানালেন তাঁকে বন্ধক রাখার জন্য।তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে বন্ধক হয়ে গেলেন বাগবাজারে মদনমোহনদেব ।বাগবাজারে গোকুলধামের মন্দিরের ফলকে লেখা ১৭৬১ সালে শ্রীমদনমোহন জীউ স্থাপিত হয়েছেন। সম্ভবত, ঐ বছরেই বিষ্ণুপুর থেকে এখানে মদনমোহনদেবকে আনা হয়েছিল।
এদিকে এসময় থেকে মল্লরাজাদের সম্পদ ক্ষয় হতে শুরু করে দেয়, পতনের সূচনা হয় রাজত্বের।অভয়পদ মল্লিকের লেখা ‘History of Bishnupur Raj’-এ পাওয়া যায়– ‘ Thus according to Babu Balindra Nath Singha of Indus , a scion of immediate cause of the decay and downfall were :–1) The Mahratta raids,
2) The famine of 1770,
3) The imposition of crusing land Tax by the British Government and
4) Family dissensions
He also enumerated some indirect causes such as 5) the adoption of the Vaishnavas and 6) its corollary the construction of costly temples etc.অর্থাৎ, বর্গী বা মারাঠাদের ক্রমাগত হানা, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ, ব্রিটিশদের খাজনা আদায়, রাজবংশের অন্দরে কোন্দল, বৈষ্ণব ধর্মমত গ্রহণ করায় রাজার আচরণে নীরিহতা আর মন্দির নির্মাণে বহুব্যায় —- এসব কারণের দরুণ মল্ল রাজত্ব ক্ষয় এবং পতনের দিকে যেতে থাকে।
সেসময় বর্গীরা যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে যেত সেখানকার সব শস্য তছনছ করে দিয়ে , ধানক্ষেত পুড়িয়ে দিয়ে প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে যেত নগর-গ্রাম। ওদিকে চৈতন্য সিংহদেব আর দামোদর সিংহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল,যুদ্ধ।আবার দুর্ভিক্ষের সময় অনাহারে ক্লীষ্ট প্রজাদের বাঁচাতে ধর্মপ্রাণ চৈতন্য সিংহদেব দু’হাতে শস্য ,সম্পদ বিলোতে থাকেন। ফলে রাজকোষাগার আকস্মিক ভাবে প্রায় খালি হয়ে যায়। ইংরেজদের কাছে খাজনা বাকী পড়তে থাকে। রাজ্য নিলামে ওঠার পরিস্থিতি তৈরী হয়।এই ভীষণ সংকট কালে অর্থ জোগাড় করে মদনমোহন বিগ্রহ ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে চৈতন্য সিংহদেবের পক্ষে।
বাগবাজারে গোকুল মিত্র প্রাণঢালা সেবাপূজা করেন বিগ্রহের। আদরে-সোহাগে সুখেই আছেন মদনমোহন। গোকুলের বাল্যবিধবা কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়া নিজের পতিরূপে ভজনা করেন মদনমোহনকে।আর মদনমোহনও তাঁর প্রেমে বাঁধা পড়লেন ।একদিন রাত্রে লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে মদনমোহন নিজের চূড়া, বাঁশী খুলে রেখে গেলেন শয্যায় । পরদিন প্রভাতে পুজারীজী মদনমোহনের চূড়া -বাঁশী খুঁজে পাচ্ছেন না। চারদিকে খোঁজ খোঁজ রব। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে লক্ষ্মীপ্রিয়া দেখেন তাঁর শয্যায় তাঁর মাথার বালিশের ওপরে রাখা ওগুলো । এ লীলা দ্বারা মদনমোহন যেন বার্তা দিলেন যে তিনিও লক্ষ্মীপ্রিয়াকে নিজের পত্নীরূপে দেখেন , আর তাই রাত্রে শয়ণে যান লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে।
আর একবার তো ভগবান নিজে সেবক ভৃত্য সেজে তাঁর ভক্তের সেবা করলেন ।গোকুল মিত্র ভৃত্য মদনাকে ডেকে তামাক সাজিয়ে দিতে বললেন ।ঘটনাক্রমে মদনা সে সময় বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। আর গোকুল মিত্রের তামাক সেবনের সময় পেরিয়ে যেতে থাকলো। মদনমোহন করলেন কী, নিজে তামাক সাজিয়ে নিয়ে এসে গড়গড়ার নল এগিয়ে দিলেন গোকুল মিত্রের কাছে। গোকুল মিত্র মনের সুখে তামাক টানলেন। পরে মন্দিরের পূজারী দেখলেন মদনমোহন বিগ্রহের হাতে তামাক ও টীকার দাগ। আশ্চর্য হয়ে জানাতে গেলেন মিত্র মহাশয়কে। গোকুল মিত্র নিজে ছুটে এলেন সত্য কিনা পরীক্ষা করতে। সত্যিই তো! পরক্ষণেই মনে পড়লো তিনি তো তামাক দিতে বলেছিলেন ভৃত্য মদনা কে। খোঁজ নিয়ে জানলেন , মদনা তো তখন ভবনে ছিলেনই না, বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে , সে তামাক কে সেজে এনেছিল আর কেনই বা ঠাকুরের হাতে অমন দাগ।মিত্র মহাশয় আদেশ দিলেন , আর কেউ যেন ভবনে তামাক সেবন না করে এবার থেকে।ভগবানকে ভৃত্য হতে হয়েছে যে কারণের জন্য, সেই কারণটাই তিনি নির্মূল করে দিতে চাইলেন।এভাবে একের পর এক মধুর লীলা করতে থাকলেন মদনমোহনদেব বাগবাজারে গোকুল ভবনে।
এরপর একদিন চৈতন্য সিংহদেব এলেন তাঁর প্রাণের বিগ্রহ ফেরৎ নিতে। তখন সম্ভবত ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ । তিনি পরিবারের সকলের অলংকারের বদলে টাকা জোগাড় করে বিগ্রহ নিতে এলেন। এদিকে গোকুল মিত্র এতদিনে ভীষণ ভাবে মদনমোহনের প্রেমে পড়ে গেছেন। বিগ্রহ ছাড়া থাকতে পারবেন না তিনি। তাই ,তিনি টাকার বদলে বিগ্রহ দান করে দিতে অনেক অনুরোধ-উপরোধ করলেন রাজাকে। কিন্তু, রাজী নন রাজা। শেষে গোকুল ,ছলে-বলে-কৌশলে বিগ্রহ পাবার জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হেস্টিংস সাহেবের কাছে চৈতন্য সিংহের বিরুদ্ধে সময়মত টাকা ফেরৎ না দেবার নালিশ জানিয়ে আরও অনেক টাকা দাবী করে বিগ্রহের নামে ডিক্রী আদায় করলেন । অত টাকা দিতে অসমর্থ রাজা । আলিপুর আদালতের একতরফা রায় গেল গোকুল মিত্রের দিকে। ব্যাস, ডিক্রী হয়ে গেলেন বিগ্রহ । তবে থেকে গোকুল মিত্রের বরাবরের সম্পদ হলেন মদনমোহনদেব। তখন মদনমোহনদেব রাজাকে আশ্বাস দেন যে প্রতিদিন আরতি ও ভোগের সময় তিনি বিষ্ণুপুরে প্রকট থাকবেন। প্রথম বিষ্ণুপুরের ইতিহাস লেখক শ্রী ফকির নারায়ণ কর্মকার তাঁর ‘বিষ্ণুপুরের অমরকাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন , ‘ তাই নিজের ভাগ্যকে নিজে ধিক্কার দিয়ে সেই অপকৌশলের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁর প্রাণের ঠাকুরকে কলকাতার বাগবাজারে রেখে আসতে বাধ্য হন তিনি। শেষ হয়ে যায় চৈতন্য সিংহদেবের সব আশা ভরসা।বিবাদ বিসম্বাদের মধ্যেই তিনি যে মদনমহনকে ওখানে রেখে এসেছিলেন সেই কথাই সত্য।’ শ্রীমতী বন্দনা বিশ্বাস তাঁর ‘কথা ও কাহিনীতে বিষ্ণুপুর ‘- বইয়ে লিখেছেন—‘বিগ্রহ ফেরতের ব্যাপারে গোকুল মিত্র মোটা টাকা দাবী করলে রাজা অপারগ হন—ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, অবশেষে আদালতে গোকুল মিত্রের এক তরফা ডিক্রীলাভ হয়। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় ৬০জন রাজা বিষ্ণুপুরে রাজত্ব করেছেন, কিন্তু এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি কখনো।’ ‘সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী’-তেও বলা হয়েছে মামলায় জিতেছিলেন গোকুল আর তাই আসল মদনমোহনদেব তাঁর কাছে থেকে যায় কোর্টের আদেশে ডিক্রি হয়ে। “বিচার মতে রাজার ঠাকুর গোকুল ডঙ্কা মেরে নিলা।” আবার এই জীবনী বইয়ে বলা হয়েছে যে, গোকুল মিত্রই নাকি পূর্ব জন্মে ছিলেন সেই দইওয়ালা,যিনি সিপাহী মদনমোহনকে দই খাইয়েছিলেন। মদনমোহন যখন দইয়ের হাঁড়ি সোনার করে দিয়েছিলেন তখন দইওয়ালা বলেছিলেন, সেসবে তিনি ভুলবেন না, মরণকালে তাঁর মদনমোহনের অভয়চরণ প্রাপ্তি চাই।
“রাজা বলে ভয় নাই জমি দিব আমি।
কোনখানে খেলেন দৈ দেখাও দেখি তুমি।।
বকুলতলায় দৈ খেলেন গোয়ালা দেখাইলো।
গোয়ালার হাড়ি যত সোনা হয়ে গেল।
পায়ে ধরে গোয়ালা কান্দিতে লাগিল।
ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন দেখিতে পাইল।।
গোয়ালা বলে ভুলাও কি হে মদনমোহন ।
মরণকালে দিও প্রভু অভয়চরণ।।”
তবে কোন কোন বইয়ে কিন্তু গোকুল মিত্রের জিতে যাবার কথা লেখা নেই। হেরে যাবার কথা লেখা আছে।মদনমোহন বিগ্রহ বাগবাজারে রয়েছেন এ কথা বিষ্ণুপুরবাসীরা অনেকেই মানতে নারাজ। বিষ্ণুপুরে পাঁচালীর আকারে লেখা যেসব ভ্রমণ গাইড পুস্তিকা গুলো বিক্রী হয় , সেগুলোতে ঘটনা অন্য রকম লেখা।’মদনমোহন মাহাত্ম্য’ বইতে লেখা চৈতন্য সিংহ যখন তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে কুলদেবতা মদনমোহনকে বাগবাজার থেকে আবার বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনতে যান, তখন গোকুল মিত্র বিগ্রহ ছাড়তে নারাজ। তিনি মিথ্যা দলিল দেখিয়ে জানালেন যে, মদনমোহন তো রাজা বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁর কাছে আগেই । রাজা মনের দুঃখে চোখের জল ফেলে ফিরে যাচ্ছিলেন , সেসময় তাঁকে স্বয়ং মদনমোহন আদেশ দেন ,”হতাশ না হয়ে বরং আলিপুর কোর্টে গোকুল মিত্রের বিরুদ্ধে মামলা করো। তোমার হয়ে আমি পাগড়ী পরা উকিল সেজে সওয়াল-জবাব করবো।” মদনমোহনের পরামর্শ মতো রাজা আপিল করলেন আদালতে ।বিচারের দিন মদনমোহন এসে দাঁড়ালেন উকিলের বেশে ।ম্যাজিস্ট্রেট নাম জিজ্ঞাসা করলে উকিল বলেন যে , তাঁর নাম মদন আর বিষ্ণুপুরের রাজার অধীনে তিনি বেতনভুক কর্মচারী। উকিল মদনের ক্ষুরধার প্রশ্নের সামনে অপ্রস্তুত , অপারগ গোকুল মিত্র হেরে গেলেন। কোর্ট আদেশ দিল বিগ্রহ ফিরিয়ে দিতে ।
গোকুল মিত্র একই রকম দেখতে একটি নকল বিগ্রহ তুলে দিলেন রাজার হাতে। চিনতে না পেরে নকল বিগ্রহ নিয়েই ফিরলেন রাজা। কিন্তু নদীর ধার থেকে এক বালক জোরে হেঁকে বলে যে , ” রাজা , তুমি তো নকল বিগ্রহ নিয়ে ফিরে যাচ্ছো।” সে বালক নাকি স্বয়ং মদনমোহনই ছিলেন। রাজার টনক নড়লো। আসল মদনমোহন ফেরত নিতে আবার এলেন বাগবাজার।অভিযোগ জানালেন । গোকুল মিত্র বললেন,” আপনি বরং এক কাজ করুন। পাশাপাশি তিনটি বিগ্রহ রাখা হবে। চিনে নিয়ে আপনারটি আপনি নিয়ে যান। আমার কোন আপত্তি নেই ,সবেতেই রাজী।” তিনটিই এক রকম দেখতে।’মদনমোহন মাহাত্ম্য কথা’-য় বলা হয়েছে এসময় মদনমোহনই নাকি উপদেশ করেন, “যে বিগ্রহের বামাঙ্গ ভিজে থাকবে ও নাকের ওপর সাদা মাছি বসে থাকবে সেটি আমি ।” ঘটলও তাই। রাজা আসল বিগ্রহকে তুলে নিলেন। মদনমোহনদেব ফিরে এলেন বিষ্ণুপুর। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে সেবাপূজা শুরু হল মদনমোহনের আবার। বিষ্ণুপুরের মত অনুযায়ী, যখন মদনমোহন চলে আসেন কলকাতা ছেড়ে, তখন তিনি গোকুল মিত্রকে কথা দিয়েছিলেন এই বলে ,”ওহে গোকুল, তুমি কেঁদো না। প্রতিবছর অন্নকূট উৎসবের সময় আমি তোমার কাছে বারো দন্ড থাকবো কথা দিচ্ছি ।”
কুলদেবতাকে কেন্দ্র করে বিষ্ণুপুরে মহোৎসাহে শুরু হল দোলযাত্রা, ঝুলন উৎসব ,রাসউৎসব ইত্যাদি।বিষ্ণুপুর পূর্ণ হল হর্ষে-আনন্দে। ১৮০২খ্রিষ্টাব্দে চৈতন্য সিংহদেবের মৃত্যু হয় । তার আগের বছর অর্থাৎ ১৮০১-এ তিনি পৌত্র মাধব সিংহকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন।বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা তথা মল্লরাজাদের রাজপুরোহিত বংশের বিশিষ্টজন শ্রী মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র জানালেন, বিতর্ক এড়াতে অনেক লেখকই আসল ঘটনা না জেনে , অনুমান ভিত্তিক লিখেছেন। ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। তিনি বলেন , তাঁদের পূর্বপুরুষরা বলতেন যে আসল মদনমোহন বিষ্ণুপুরে ফেরৎ আসেন। বিষ্ণুপুরেই নাকি বিরাজ করছেন তিনি। (এ প্রবন্ধ লেখায় অনেক তথ্য ও ছবি দিয়ে সাহায্য করেছেন মৃত্যুঞ্জয় মহাশয়। )
বাগবাজারে গোকুল মিত্র মদনমোহনদেবের পাশে রাধিকার এবং ললিতা-বিশাখার বিগ্রহদের স্থাপন করলেন রাস উৎসবের সময় । সেরাত্রে আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার জীবনাবসান হল। বলা হয় যে , শ্রীরাধা বিগ্রহের মধ্যেই নাকি গোকুল মিত্রের কন্যার আত্মা বিরাজিত রয়েছে।
মদনমোহনদেবের জন্য বড় মন্দির , রাসমঞ্চ,ঝুলনমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন গোকুল মিত্র। সমস্ত সম্পত্তি তিনি তাঁর জামাই শ্রীমদনমোহনদেবের নামে করে দিয়েছেন ,যাতে তাঁর অবর্তমানে মদনমোহনের সেবা পূজায় কোন বিঘ্ন না ঘটে। এখনও পর্যন্ত উত্তর কলকাতা চিৎপুর রোডে রাজবল্লভ পাড়ায় গোকুল মিত্র লেনে মদনমোহন তলা নামে সুপ্রসিদ্ধ মদনমোহন মন্দির এলাকা ।গোকুলধাম নামে বিখ্যাত সেই সুবিশাল মন্দির। রাজবল্লভ পাড়ার মোড়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী বাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ডানদিকে মন্দির পরে ।মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেই বাঁ দিকে বিশাল চওড়া শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে দোতলায় উঠে যেতে হয়। সেটি দর্শনার্থীদের ব্যবহারের জন্য সিঁড়ি। উপরে দোতালাতে অবস্থান করেন শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব। আর যদি সিঁড়িতে না উঠে প্রবেশদ্বার দিয়ে সোজা এগিয়ে আসা হয় , তবে নাটমন্দির চোখে পড়ে। এখানে মদনমোহনদেবের জন্য নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। এই চত্বরেই প্রতিদিন আগে অনাথ-আতুরদের প্রসাদ ভোজন করানো হত।নাটমন্দিরকে ঘিরে আঙ্গিনার ওপারে তিনদিকে ঠাকুর বাড়ীর দালান।একদিকে ভোগের রন্ধনশালা ,আর একদিকে মন্দিরের অফিসঘর ,এসব । আর নাটমন্দিরের ডানদিকটার পুরোটা জুড়ে বিশাল ঝুলনমন্দির। মার্বেল বাঁধানো ঝুলন মঞ্চ। মঞ্চের মধ্যে দোলনা সিংহাসন।ঝুলনের সময় এখানেই ঝুলন উৎসব হয় বড় করে।
উপরে দোতলায় মদনমোহনদেবের রাজত্ব । সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডানদিকে দরবার হল তাঁর। দরবার হলের শেষপ্রান্তে সিংহাসনে শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন বিরাজ করছেন । সাথে আছেন ললিতা-বিশাখা সখীর বিগ্রহ, শালগ্রাম শিলা আর ছোট্ট গোপালসোনা। নিরাপত্তার কারণে ব্যবধান দেওয়া লোহার গ্রিলের । সব মন্দিরে যেখানে বিগ্রহ অবস্থান করেন সেখানে সামনেই ভোগ লাগানো হয় , মদনমোহনের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয় । তাঁর ভোগের ঘর আলাদা, বিশ্রামের ঘরও আলাদা।ভোগের সময় সিংহাসন থেকে নেমে যান ভোগমন্দিরে। সেখানে ভোজন করে আসেন বিশ্রাম কক্ষে। বারান্দা পার করে বিশ্রাম ঘর। বিশ্রাম করার পর এখানেই তাঁকে শৃঙ্গার করানো হয় ।নতুন সাজে সজ্জিত হলে আবার প্রবেশ করেন দরবার হলে। সিংহাসনে আরোহন করেন এরপর।আর, তিনি কখনও ফেরৎ যাত্রা করেন না অর্থাৎ একমুখী হয়ে গমন করেন সবসময়,একই পথে উল্টো দিকে হাঁটেন না।
দোতালায় অপরদিকে ভাঁড়ার-ঘর(স্টোর রুম)। এত বড় ভাঁড়ার ঘর সমগ্র কলকাতায় আর নাকি নেই। তারপাশে অতিথিদের থাকার ঘর । এরপরে আবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামা। সেই সিঁড়ি দিয়ে মদনমোহন নামেন ঝুলনের সময় , রাসের সময়। মন্দির থেকে বেড়িয়ে বাঁ দিকে আরো একটু এগিয়ে গেলেই রাস্তার ওপরে পাকা রাসমঞ্চ তৈরী আছে। ।রাসের সময় উৎসব হয় । বিগ্রহদের নিয়ে যাওয়া হয় তখন সেখানে। এছাড়া সারা বছরই উৎসব হয় গোকুলধামে। বড় করে পালিত হয় অন্নকূট উৎসব। অন্নকূটে নীচে একতলায় ভক্তরা কাপড় পেতে ধরেন আর ওপরের দোতলার বারান্দা থেকে মদনমোহনদেবের অমৃতপ্রসাদ ফেলা হয় ।ভক্তরা আকুলতাসহ হুড়োহুড়ি করে সংগ্রহ করেন প্রতিটি কণা প্রসাদের।
বর্তমানে বাগবাজারে মদনমোহনদেবের পালাদার সেবাইত হলেন শ্রী মাধবমিত্র। ১৫ই এপ্রিল ,২০১৯ থেকে ১৩ই এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত মদনমোহনের সেবার ভার তাঁর। আর , বিগ্রহ অর্চন-বন্দন-পূজার ভার শ্রী সুব্রত পূজারী মহাশয়ের ওপর। তিনি হলেন ধরণী মহাপাত্রের সপ্তম অধস্তন পুরুষ। মল্লরাজারা ‘পূজারী’ উপাধি দিয়েছিলেন তাঁদের। পূজারী মহাশয় জানালেন , যখন মদনমোহন বাগবাজারে চলে আসেন, তখন তাঁর পূর্বপুরুষরাও বিষ্ণুপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন মদনমোহনদেবের সেবা করবেন বলে। সেই প্রথম দিন থেকে তাঁদের বংশের পূজারীরাই মদনমোহনদেবের পূজার্চনার দায়িত্বে। মদনমোহনই নাকি স্বয়ং গোকুল মিত্র কে আদেশ দিয়েছিলেন কেবল এই বংশের হাতেই তিনি পূজা নেবেন। ফকির নারায়ণের লেখাতেও একই কথা পেলাম–‘ মিত্র মহাশয়ের প্রতি স্বপ্নাদেশ হয়। স্বপ্নে মদনমোহন তাঁকে বলেন ,”আমার সেবাইত, পুরোহিত ব্যতীত অপরের হাতে সেবা-পূজা নিয়ে আমার তৃপ্তি হয় না ।তাদের অভাবে আমি উপবাসী আছি। আমার স্বপ্নাদেশের কথা রাজাকে জানিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আয়। নইলে এইরকম উপবাসী অবস্থাতেই আমাকে দিন কাটাতে হবে।”…. সবকিছু শুনে রাজা কাঁদতে থাকেন। দ্বিরুক্তি করেন না ।সেবাইত, পুরোহিতকে পাঠিয়ে দেন তাঁদের সঙ্গে।’
সুব্রত পূজারী মহাশয় জানালেন, বাগবাজারের বিগ্রহই আসল মদনমোহন। তিনটি বিগ্রহের অবশিষ্ট বিগ্রহটি বর্তমানে তাঁদের ব়ংশে রয়েছেন। এখনও নানান অলৌকিক লীলা করেন মদনমোহন। দিনে-দুপুরে-রাত্রে মদনমোহনের চলার নূপুরের ধ্বনি শোনা যায় , হঠাৎ ম-ম করে ওঠে তাঁর অঙ্গগন্ধ নির্জন বারান্দায়।
শ্রীমদনমোহনের অলৌকিক লীলা নিয়ে প্রচুর বই প্রকাশ হয়েছে । সেগুলির কোন কোনটি বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা বা বিষ্ণুপুর রাজবংশের ঘনিষ্ঠ কবিরা লিখেছেন , আবার কোনটা রচনা করেছেন গোকুল মিত্রের দিকের কবিরা। তাই সেসব লেখাতে পক্ষপাতিত্বের একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় । মূল বিগ্রহ যে প্রকৃত কোথায় অবস্থিত, বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে এটা নিয়ে একটা চোরা দ্বন্দ এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে।বিষ্ণুপুর থেকে বলা হয় মদনমোহনদেব বিরাজ করছেন বিষ্ণুপুরেই। আর,বাগবাজার থেকে বলা হয় মূলবিগ্রহ রয়েছেন বাগবাজারে। তবে হ্যাঁ , বর্তমানে মদনমোহন যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, তিনি যে দল-মাদল কামান দেগেছেন আর গোকুল মিত্রের কাছে তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে বন্ধক ছিলেন এ কথা কিন্তু সত্য—–প্রতিটি গ্রন্থেই স্বীকৃত হয়েছে । ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’গ্রন্থে ড. সুকুমার সেন লিখেছেন –“অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় দেবদেবী ,ব্যক্তি বা ঘটনা বিশেষ ও দৈব-দুর্বিপাক লইয়া ছড়া গান রচিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি আমাদের হস্তগত হইবার পূর্বেই লুপ্ত হইয়াগিয়াছে ।…..একাধিক কবি রচিত মদনমোহন বন্দনা পাওয়া গিয়াছে। ইহার বর্ণনীয় বিষয় হইতেছে মদনমোহন কর্তৃক দল-মাদল কামান দাগিয়া বিষ্ণুপুর হইতে বর্গী বিতরণ এবং চৈতন্য সিংহ কর্তৃক কলিকাতায় গোকুল মিত্রের নিকট মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখা।”
মদনমোহন সর্বদা তাঁর ভক্তের সঙ্গে থেকেছেন সেবক রূপে, ভৃত্য রূপে, বন্ধু রূপে ।তা সে বিষ্ণুপুরের ভক্তিমান রাজা গোপাল সিংহ ,চৈতন্য সিংহই হন বা বাগবাজারের ধনাঢ্য ,দানবীর ,ভক্তমহাজন গোকুল মিত্রই হন না কেন। ভগবান যে তাঁর ভক্তের পরম সুহৃদ, পরম বান্ধব, পরম হিতৈষীজন এই সত্য সংস্থাপিত হয়েছে বারে বারে ,নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ মদনমোহনদেবের নানান অলৌকিক লীলায়।
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলতেন , কিছু চাইতে হলে তিন জনার কাছে চাইতে হয়–দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী, খড়দহের শ্যামসুন্দর আর বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের কাছে।
মদনমোহনদেবের অলৌকিক কাহিনী শুনে, তাঁর মনোলোভা চিতচোর সৌন্দর্যের কথা জেনে এখনও পর্যন্ত ভক্তরা তাঁকে দর্শন করতে ছুটে যান কলকাতার বাগবাজারে আর বিষ্ণুপুরের মন্দিরে। আসল বিগ্রহ যেখানেই থাকুন না কেন , উভয় স্থানে গিয়েই ভক্তরা অনুভব করতে পারেন শ্রীশ্রীমদনমোহনদেবের উপস্থিতির আবেশ ও তাঁর লীলার দিব্য অনুভূতি। আসলে, ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ভগবান যে সকল স্থানেই প্রকট হতে একান্ত ভাবে ভালোবাসেন….. তাঁর অবস্থিতি তো সর্বস্থানে!
জয় শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব।
সমাপ্ত
আহা ! শান্তিপুরের আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির শ্রীশ্যামসুন্দরের যেমন চিত্তাকর্ষক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য তেমনই তাঁর অপূর্ব সব লীলা । পুত্র যেমন পিতার কাছে আবদার করে, বায়না করে তেমনভাবেই শ্যামসুন্দর নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ রূপে করেছেন এটা-সেটার দাবি। কখনো শ্রীআনন্দকিশোর গোস্বামীর কাছে কখনও বা শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের কাছে। প্রসঙ্গতঃ জানাই , আনন্দকিশোর গোস্বামী ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের পিতাপ্রভু ।
অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র শ্রীদেবকীনন্দন ছিলেন আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরজীউ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হন স্বয়ং অদ্বৈত, তাঁর পুত্র বলরাম এবং পৌত্র দেবকীনন্দন— তিনজনের দ্বারা মিলিত ভাবে। দেবকীনন্দন নির্দেশিত নিয়ম মেনেই এখনও সেবাপূজা চলে। বিশ্ববিশ্রুত সিদ্ধ মহাপুরুষ ,প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই বংশেই জন্মগ্রহণ করেন বলে এই বাটীকে ‘বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাটী’-ও বলা হয়।
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখনও ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করেননি। মনে-প্রাণে তিনি ভীষণ ভাবে ব্রাহ্মধর্মে বুঁদ হয়ে আছেন । কলকাতাতে থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার চালাচ্ছেন জোরকদমে । মাঝে মধ্যে শান্তিপুরে যান । আর যখনই শান্তিপুরে যান তখনই শ্যামসুন্দর তাঁর সম্মুখে প্রকট হন। প্রেমচাহিদার যেন শেষ নেই বিজয়কৃষ্ণের কাছে শ্যামসুন্দরের । ওদিকে ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণ নীতিগতভাবে মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী থাকলেও , কোন অজ্ঞাত কারণে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ , টান অনুভব করেন শ্যামসুন্দরের প্রতি। আর , তাই শ্যামসুন্দরের আবদারও মিটিয়ে চলেন একের পর এক।
একবার নটখট্ শ্যামসুন্দর বললেন , “শোন বিজয় ! আমার দেখ না বাঁশি নেই ! একটা বাঁশী বানিয়ে দে না !” এমন ভাবে শ্যামসুন্দর বললেন, যে বুকে গিয়ে বাজলো বিজয়কৃষ্ণের সে কথা । তিনি বাংলাদেশের ঢাকাতে অর্ডার দিয়ে খুব সুন্দর একটি বাঁশি প্রস্তুত করিয়ে দিলেন। বাঁশি পেয়ে বড় আনন্দ পেলেন বিগ্রহ শ্যাম।
আবার একবার শ্যামসুন্দর বললেন , “বাঁশী তো দিলি , এবার চূড়াটাও গড়িয়ে দে। বাঁশি-চূড়া না থাকলে কী সাজ সম্পূর্ণ হয়, বল !” শ্যামসুন্দরের বলার ঢঙে হেসে ফেললেন বিজয়কৃষ্ণ । মনটা কোমল হয়ে গেল যেন । স্নেহব্যথা পেলেন চিনচিনে এক । তিনি পরদিনই ঢাকায় সংবাদ পাঠিয়ে চূড়ার অর্ডার দিলেন । বেশকিছুদিন পর ঢাকা থেকে এল চূড়া । বাঁশি আর চূড়ার সাজে শ্যামসুন্দরের সুন্দর সাজ এমন সুন্দর হল যে নয়ন ফেরানো যায় না । কিন্তু, না , শ্যামসুন্দরের মনের ইচ্ছা অন্য । তিনি বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ নিয়ে হাজির । অনুযোগের সুরে বললেন , “চূড়া তো দিলি , ভালো হয়েছে। কিন্তু , আমার মনোমতো হয়নি।” বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “কেন , কি রকম হলে তোমার মনোমতো হবে শুনি !” শ্যামসুন্দর বায়নার মত করে বললেন , “আমার সোনার চূড়া চাই। রূপার চূড়া নেব না ।”
বিজয়কৃষ্ণ বললেন অবাক হয়ে, “সে কী কথা ! আমি সোনার চূড়া কোথায় পাবো ! অত টাকা আছে নাকি আমার !কোথায় পাব টাকা !” শ্যামসুন্দর বললেন, “রাঙ্গা ঠাকুরাণীর অনেক টাকা আছে, জানিস তো ! তুই আমার নাম করে বল , দেখবি টাকা দেবে ।”
রাঙ্গা ঠাকুরাণী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাকিমা ছিলেন । তাঁকে বিজয়কৃষ্ণ সব জানালেন । তিনি শুনেই আনন্দে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না । শ্যামসুন্দরের মুখে তাঁর নাম ! শ্যামসুন্দর নিজে যেচে তাঁর থেকে সেবা নিতে চেয়েছেন । এমন সৌভাগ্যও তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো, আহা ! পুলকিত , রোমাঞ্চিত হলেন তিনি । অতি শীঘ্র টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বিজয়কৃষ্ণকে । সে টাকা থেকে রূপোর চূড়ায় সোনার পাত বসিয়ে সোনার চূড়া বানানো হল। অপূর্ব দর্শন রূপোর বাঁশি আর সোনার চূড়ায় সেজে শ্যামসুন্দরের যে মনোহারী, মনাকর্ষক , মুগ্ধকর সাজ হল তা ভাষায় বর্ণনার অতীত । তিনি নিজেও অনুধাবন করলেন যে , এরূপ দেখলে বিজয়কৃষ্ণও তাঁর প্রেমে পরে যাবেন । তাইতো বিজয়কৃষ্ণের কাছে এবার বললেন, “হ্যাঁ রে, দিলি তো চূড়া-বাঁশী । এবার একটু দেখবি না আমায় এসব পরে কেমন লাগছে ! যা, মন্দিরে যা, দেখ আমায়।”
বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “বা-রে ! আমি না ব্রাহ্ম! মন্দির-টন্দিরে আমায় যেতে নেই জানো না ! ওসব দেখতে নেই।”
শ্যামসুন্দর—”তাতে কী ! ব্রাহ্ম না হয় হলিই। দেখতে দোষ কী । আর ব্রাহ্ম তো তুই আমার ইচ্ছেতেই হয়েছিস । আমিই বানিয়েছি ব্রাহ্ম তোকে।”
শ্যামসুন্দরের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ চুপ করে রইলেন । পরে একসময় মন্দিরে গিয়ে দর্শন করে এলেন শ্যামসুন্দরকে। সত্যিই শ্যামসুন্দরের সৌন্দর্য দর্শনে মন যেন কেমন করে উঠল তাঁর।বোধহয় ইচ্ছে হল একবারটি নিজের কোলে করার, বক্ষে ধরে নেওয়ার ; শ্যামসুন্দরের ওই রাতুল চরণে মস্তক স্পর্শ করাতে ইচ্ছে হল আত্মনিবেদনের ভাব নিয়ে।
ঠিক এমনই ঘটনা আবারও একদিন হল। বিজয়কৃষ্ণের মনে হল যেন কেউ নূপুর পরে হাঁটছে। তিনি বেরিয়ে এলেন । নূপুরের ধ্বনি যেদিকে, সেদিকে এগিয়ে গেলেন। মনে তাঁর দোলা দিয়েছে, এ ধ্বনি শ্যামসুন্দরের চরণের নূপুরের না তো ! কারণ, মাঝেমধ্যেই তিনি শ্যামসুন্দরের নিক্কণের ধ্বনি পান। তাঁর পিতা-মাতা বা পরিবারের অনেকেই পান । শ্যামসুন্দর নিজের উপস্থিতি জানান দেন এভাবে। তাই আজ বিজয়কৃষ্ণ নূপুরের ধ্বনি শুনেই কোন যেন অমোঘ টানে চলে গেলেন শ্যামসুন্দরকে দেখবেন বলে বা ধরবেন বলেই হয়তো বা ।
হ্যাঁ , শ্যামসুন্দরও আজ যেন বিজয়কৃষ্ণের জন্যই রূপের ফাঁদ পেতেছেন । বিজয়কৃষ্ণ দেখলেন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে শ্যামসুন্দর । দুষ্টুমির ঝলক তাঁর আখির প্রান্তে । তাঁর রূপ দেখে বিজয়কৃষ্ণ ক্ষণিকের জন্য বিহবল হয়ে গেলেন। আর অন্তর্যামীর দেরী হল না অন্তর পড়তে বিজয়কৃষ্ণের । বিদ্যুতের ঝলকের থেকেও তাঁর অনুধাবন ক্ষমতা অতি তীব্র, অতি দ্রুত যে। তখন শ্যামসুন্দরের মনের ভাবখানা এমন যে কেমন ফাঁদ পেতেছি আমি, দেখলি তো ! কেমন ধরা পড়লি সে ফাঁদে, বল ! আর সেকারণেই ছিল দুষ্টুমির ঝলক নট্খট্ নওলকিশোর শ্যামসুন্দরের নয়নের কোনায়। কন্ঠে তিনি দুষ্টুমির সুর করে বললেন, “ বল তো , এবার আমায় কেমন দেখছিস ?” স্বগোতক্তির ন্যায় বিজয়কৃষ্ণের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “অতি সুন্দর তুমি।” পরক্ষণেই বিজয়কৃষ্ণের একটা কথা মনে এল, তিনি বলে ফেললেন তা আপনমনে —-”আচ্ছা, একটা কথা বলো তো ! আমায় দর্শন দিয়ে এত কৃপা করার ইচ্ছে যখন তোমার , তাহলে কেন এমন করে ব্রাহ্ম করলে আমায়?”
শ্যামসুন্দর আকর্ণ-বিস্তৃত মধুময় হাসি হেসে বললেন, “জানিস, অলংকার ভেঙ্গে আবার গড়ালে আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয় তা।” বিজয়কৃষ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন এ উত্তর পেয়ে । শ্যামসুন্দরও অন্তর্ধান করলেন সেই মুহূর্তেই , আসল কাজ করা হয়ে গেছে এই মন নিয়ে।
শ্যামসুন্দর নিজের প্রিয় পাত্র বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগও করতেন । একবার পূজারী ভোগের সময় জল দিতে ভুলে গেলেন। শ্যামসুন্দর বাচ্চা ছেলেদের মতো এসে বিজয়কৃষ্ণকে বললেন, “দেখ বিজয়, তোদের পূজারী কেমন ! মধ্যাহ্নভোগে পারস করেছে আর জল দিতে ভুলে গেছে । বলতো খেতে বসে জল না দিলে হয় !” তখন বিজয়কৃষ্ণ পূজারীকে খানিকটা তিরস্কার করেই ঘটনা জানালেন সব। আর যেন এমন ভুল না হয় সাবধান করলেন।
আবার অন্য একটা দিনের কথাও জানাই । মন্দিরে চুরি করল এক চোর । শ্রীরাধারাণীর মুকুটটি বড় ভালো লাগায় হয়তো বা লোভ সামলাতে না পেরে সেটি নিয়ে গেল। তবে পরে নিজের ভুল বুঝে অনুতাপানলে জ্বলে ফেরত দিতে চাইলো । কিন্তু, আর তো উপায় নেই গর্ভমন্দিরে ঢুকে রাধারাণীর মস্তকে মুকুট পরিয়ে দেবার । ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে । তাই করলো কী , মুকুটটি মন্দির চত্বরেই একটু আড়াল করা স্থানে ফেলে গেল। মুকুটের খোঁজ চলছে এদিকে । পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই । তখন শ্যামসুন্দরের শ্রীরাধিকা বিজয়কৃষ্ণের কাছে প্রকাশিত হলেন । সে সময় আসনে বসে ধ্যান করছেন বিজয়কৃষ্ণ। শ্রীরাধিকা মুকুটের অবস্থান বলে দিলেন । বিজয়কৃষ্ণ তা সকলকে জানালেন। সত্যিই সে স্থানে পাওয়া গেল মুকুট।
ভক্তিপূর্ণ প্রণাম পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করি এহেনো সুন্দরের সুন্দর শ্যামসুন্দর বিগ্রহকে ও যাঁর সঙ্গে তিনি এমন মধুময় লীলা করেছেন সেই শ্রদ্ধেয় প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে।