Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

আজ আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস, জানুন দিনটি কেন পালিত হয় এবং গুরুত্ব।

ভূমিকা—–

 

আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস হল একটি আন্তর্জাতিক দিন যা অনুবাদ পেশাদারদের স্বীকৃতি দেয়।  এটি ৩০ সেপ্টেম্বর, যেটি সেন্ট জেরোমের ভোজের দিন, বাইবেল অনুবাদক যাকে অনুবাদকদের পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করা হয়।

 

আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস কবে—

 

প্রতি বছর ৩০শে সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস পালিত হয় অনুবাদক, ভাষা পেশাজীবীদের কাজকে উদযাপন করার জন্য যারা বিশ্ব শান্তির উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণে অবদানকারী দেশগুলোর মধ্যে সংলাপ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

বিশ্ব অনুবাদক সম্প্রদায়ের সংহতি প্রদর্শন এবং অনুবাদের পেশাকে উন্নীত করার জন্য আন্তর্জাতিক অনুবাদক ফেডারেশন (এফআইটি) দ্বারা ১৯৯১ সালে দিবসটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  ফেডারেশন হল অ্যাসোসিয়েশনগুলির একটি সমষ্টি যা অনুবাদক, দোভাষী এবং পরিভাষাবিদদের প্রতিনিধিত্ব করে।  এটি ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

 

দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ এটি একই দিনে সেন্ট জেরোমের পরব উদযাপিত হয়।  সেন্ট জেরোম অনুবাদ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটি সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচিত এবং অনুবাদকদের পৃষ্ঠপোষক সন্ত।  তিনি একজন খ্রিস্টান পণ্ডিত এবং পুরোহিত ছিলেন যিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি বাইবেলটিকে মূল হিব্রু থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন যাতে এটি পাঠকদের কাছে আরও সহজলভ্য হয়।

 

আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস সম্প্রতি বিশ্ব ইভেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।  জাতিসংঘ (ইউএন), ২৪ মে, ২০১৭ তারিখে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩০ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস হিসাবে ঘোষণা করার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

 

জাতিসংঘের প্রস্তাব—-

 

২৪ মে ২০১৭-এ, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৭১/২৮৮ রেজোলিউশন পাশ করে ৩০ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস ঘোষণা করে, যা জাতিকে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে পেশাদার অনুবাদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়।  খসড়া রেজোলিউশন A/71/L.68 এগারোটি দেশ স্বাক্ষর করেছে: আজারবাইজান, বাংলাদেশ, বেলারুশ, কোস্টা রিকা, কিউবা, ইকুয়েডর, প্যারাগুয়ে, কাতার, তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান এবং ভিয়েতনাম।  ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ট্রান্সলেটরস ছাড়াও, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ কনফারেন্স ইন্টারপ্রেটার্স, ক্রিটিক্যাল লিঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ প্রফেশনাল ট্রান্সলেটরস অ্যান্ড ইন্টারপ্রেটার্স, রেড টি, ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার্স সহ আরও কয়েকটি সংস্থার দ্বারা এই রেজোলিউশনটি গ্রহণের পক্ষে সমর্থন জানানো হয়েছিল।  .
জাতিসংঘ আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রাশিয়ান, স্প্যানিশ এবং জার্মান ভাষায় অনুবাদের জন্য একটি বার্ষিক সেন্ট জেরোম অনুবাদ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।

 

 ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ট্রান্সলেটর—

 

১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই উদযাপনগুলিকে International Federation of Translators (FIT) দ্বারা প্রচার করা হয়েছে৷ ১৯৯১ সালে, FIT একটি পেশা হিসেবে অনুবাদকে প্রচার করার প্রয়াসে বিশ্বব্যাপী অনুবাদক সম্প্রদায়ের সাথে সংহতি দেখানোর জন্য একটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবসের ধারণা চালু করে৷  যা বিশ্বায়নের যুগে ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

 

 আমেরিকান অনুবাদক সমিতি—

 

২০১৮ সাল থেকে আমেরিকান ট্রান্সলেটর অ্যাসোসিয়েশন প্রফেশনাল অনুবাদক এবং দোভাষীদের ভূমিকা সম্পর্কে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার এবং জনসাধারণকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলির একটি সিরিজ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস উদযাপন করেছে।  ATA ছয়টি ইনফোগ্রাফিকের একটি সেট প্রকাশ করে ITD 2018 উদযাপন করেছে যা পেশা সম্পর্কে তথ্য চিত্রিত করে।  ২০১৯ সালে, ATA “অনুবাদক বা দোভাষীর জীবনে একটি দিন” চিত্রিত একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে।

 

আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবসের তাৎপর্য—-

 

বিশ্ব বিশ্বায়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে অনুবাদকদের গুরুত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।  ভাষা পেশাদাররা একটি ইতিবাচক পাবলিক বক্তৃতা এবং আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগে সাহায্য করে।

 

অনুবাদকরা সাহিত্যিক কাজ, বৈজ্ঞানিক কাজ, প্রযুক্তিগত কাজ সহ এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় স্থানান্তর করতে সহায়তা করে যা একটি উন্নত বিশ্বের দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করে।  তারা একে অপরের সংস্কৃতি বুঝতে সাহায্য করে যা অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাকে উৎসাহিত করে।

 

তারা সঠিক অনুবাদ, ব্যাখ্যা এবং পরিভাষায় সাহায্য করে যা বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

 

অনুবাদক এবং ভাষা পেশাদারদের কাজ কেবলমাত্র আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে যখন আমরা আরও আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের দিকে অগ্রসর হব।

 

২০২৩ সালে, আমরা স্পিচ-টু-স্পিচ এবং স্পিচ-টু-টেক্সট অনুবাদে আরও উন্নয়নের মাধ্যমে অনুবাদ শিল্পে আরও উন্নতির আশা করতে পারি।  AI মেশিন অনুবাদ প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে, এটিকে আরও দক্ষ এবং নির্ভুল করে তুলবে৷ অনুবাদের ভবিষ্যত মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং AI-চালিত মেশিন অনুবাদের মধ্যে সহযোগিতার মধ্যে নিহিত৷  মানব অনুবাদকরা সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং নির্দিষ্ট শ্রোতাদের জন্য অনুবাদকে অভিযোজিত করার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে, যখন AI পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলি স্বয়ংক্রিয় করার জন্য আদর্শ।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
কবিতা

একান্ত আপন : প্রবীর কুমার চৌধুরী।

ভুলে যাওয়া
যত পাওয়া
বেদনার পাওনা,

মধ্যাহ্নের অবেলায়
বড় বেশি অবহেলায়
ভোলা তবু যায়না।

ঘুরে-ঘুরে ফিরে আসে
নিঃসঙ্গতা ভালোবাসে
সহচর্যহীন এ জীবন,

কোথা পাই কোথা খুঁজি
আজ বড় একা বুঝি
ভবপারে ,অপেক্ষাতে একান্ত আপন।

সংরক্ষিত
গড়িয়া,কলকাতা।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প নারী কথা

সন্তানস্নেহে : প্রবীর কুমার চৌধুরী ।

আর মাত্র ৫টি  মাস বাকি চাকুরী থেকে অবসর নিতে। কতদিন,কত মাস, বছর দেখতে, দেখতে কেটে গেল চাকুরী জীবনের । আজও মনে হয়  যেন এইতো সেদিন আসলো কর্মক্ষেত্রে। পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, তারপর প্রশিক্ষণের চিঠি হাতে পাওয়া।
প্রথম,প্রথম তো প্রশিক্ষিণ সময়ে এতো কাজের চাপ ছিল খাওয়া, নাওয়ার সময় পেতোনা বিপাশা। ক্লাসের সঙ্গে, আবার ওয়ার্ডও ডিউটি করতে হত। সাথে নাইট।
মাঝে, মাঝে তো বিশেষ, বিশেষ অনুষ্ঠানে বাইরের ক্যাম্পগুলোতেও যেতে হতো।অবশ্য সেগুলো বছরে দুয়েকবার। খুব আনন্দ হত সে ক্যাম্পে। ভীষণ ক্লান্ত লাগতো,এতো পরিশ্রম হতো  যে ভাবতো  প্রশিক্ষণ ছেড়ে বাড়ি চলে যাবে।

এই করতে,করতে একদিন বিপাশা তিনবছরের নার্সিং প্রশিক্ষণ শেষ করে প্রথম পোস্টিং পেল বর্ধমান মেডিকেল কলেজে। তারপর  হেলথ উনিভারসিটি থেকে বিএসসি,  এমএসসি  পাশ করলো। ধাপে, ধাপে প্রমোশন পেতে, পেতে আজ সে  একটা ইনস্টিটিউশননের অধ্যাক্ষা।
আজকাল বিপাশা তার চেম্বারে বসে প্রায়ই এসব কথা ভাবে। একটার পর একটা স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে চলে বিদায় বেলায়।
আজ একটু আগেই বিপাশা সব ক্লাস ভিজিট করে এসেছে। এখন  কিছু বিল যা  গতকাল  অব্জেকশন হয়ে ফিরে এসেছে সেগুলোর রিপ্লাই লিখছিলো। বিলক্লার্ক মনোতোষ দুবার তাগাদা দিয়েছে”  ম্যাডাম দুটোর পর কিন্তু আর অব্জেকশন বিল জমা নেবে না” ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অব্জেকশনের মিটিয়ে দিয়ে  বিপাশা বেল দিতেই অর্ডালি বিকাশ ঘরে ঘুকতেই বলল ” বিকাশ যাওতো কম্পিউটার অপরেটর সত্যবাবুকে জিজ্ঞাসা কর এলোটমেন্টের যে চিঠিটা করতে দিয়েছি হয়েছে কিনা? হলে সাথে করে নিয়ে আসবে “।
বিপাশা এখানে ডি, ডি, ও হলে কি হবে রোজ একটা, দুটো  ক্লাসও  নেয় অন্যান্য কাজের মধ্যেই । এটা তার মনের খোরাক, শান্তি পায় ছোট, ছোট মেয়েদের সংস্পর্শে। মনে পড়ে ফেলে আসা দিনের কথা। মনে পড়ে ক্লাসমেট দের কথা। অবশ্য কয়েক জনের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে। বিনতা, শেফালী, তনুশ্রী, আশালতা, ভারতী বিভিন্ন হাসপাতালে পোস্টিং হলেও প্রায় রাত্রে কথা হয়। ওদের মধ্যে শেফালী সিস্টার ইনচার্জ হয়ে গেছে। তনুশ্রীও মেট্রোন হয়েছে। কিন্তু বিপাশার অমায়িক ব্যবহারে আজও যে সব বান্ধবীরা ওর নিচে আছে কেউই বিপাশাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি।এখনও তারাও যোগাযোগ রাখে। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়।
বিকাশ বেরিয়ে যেতেই সিস্টার টিউটর মজুলা এসে বলল – ” শুনেছেন ম্যাডাম। ফার্স্ট ইয়ারের মানসী মণ্ডল আজ কদিন ছাতু মুড়ি খাচ্ছে। হোস্টেল থেকে মিল নিচ্ছে না। বললে মুখে কোন কথা নেই। একেবারে চুপচাপ। ওর বন্ধুরাও কারণ জানতে পারেনি “।
বিপাশা অবাক  হয়ে যায় শুনে। ভাবে মানসী মণ্ডল খুব ভালো মেয়ে। অমায়িক ব্যবহার। দেখতেই শুধু সুন্দরীই নয়, লেখাপড়ায় উন্নত,। বারোক্লাসের রেজাল্ট তো  বেশ উপরের দিকে আছে । শতকৱা আশির উপরে নং । স্বভাব খুব নম্র ও ভদ্র, কথাবার্তাও খুব মার্জিত । লেখাপড়া ছাড়াও ভালো নাচ জানে। সুন্দর কবিতা আবৃতি করে। কোন একটা নাটকের গ্রুপে নাকি অভিনয় করতো ট্রেনিং এ আসতে সে গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছে।
এবার লাইমলাইট অনুষ্ঠানে তো ওর নাচ দেখে সবাই মোহিত হয়ে গেছে। এমন মেয়েকে স্নেহ না করে কেউ থাকতে পারে?  বিপাশাতো ভীষন পছন্দ করে মেয়েটিকে।
বিপাশা শুনে বলল না ” এটা তো ভালো ব্যাপার নয়। ওকে ডেকে পাঠাও তো ক্লাস থেকে” ।
বিকাশ গিয়ে ডেকে আনলো মানসীকে। ধীর, স্থির পায়ে ঢুকলো সে। বিপাশা
স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করলো ” কী ব্যাপার মানসী, তুমি শুনলাম কদিন হোস্টেলের মিল নিচ্ছো না। ছাতুমুড়ি খেয়ে থাকছো। কেন গো শরীর খারাপ। নাকি হোস্টেলের রান্না তোমার ভালো লাগছে না?
মানসী নিরুত্তর,চুপ। বিপাশা আবার জিজ্ঞেসা করলো ” বলো, মিল খাচ্ছো না কেন? কি অসুবিধা তোমার? ”
এবারেও মানসী কোন  উত্তর না দিয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে  মার্বেলের মেঝের উপর পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে লাগলো।
মঞ্জুলা মানসীর এই ঔদ্ধত্ব দেখে অবাক। ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করছেন এতবার আর ও  কিনা জবাব দেওয়া প্রয়োজন মনে করছে না। ধমকে ওঠে মঞ্জুলা  বলল ” একি ম্যাডাম তোমায় এতবার জিজ্ঞাসা করছেন তুমি ওনার কথায় কোন উত্তর দিচ্ছো না। তোমার গার্জেন কল করবো ” ?
মানসীর বাড়ি হোস্টলের খুব কাছে তাই মঞ্জুলা একথা বলে মানসিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো ।
বিপাশা কাছে ডেকে সস্নেহে আবার জিজ্ঞাসা করলো ‘ আমায় বলো। কোন ভয় নেই। আমি অসুবিধা হলে ব্যবস্থা নেবো “।
ম্যাডামের স্নেহের স্পর্শে এবার মানসী হার মানলো। খুব পরিষ্কার উচ্চারণে আস্তে আস্তে বলল –  ‘ ম্যাডাম গত রবিবারে মা, বাবা এসেছিলেন। সঙ্গে এনেছিলেন পাঁঠার মাংস। বাড়ির কথা, দিদির বিয়ের কথা আলোচনা হচ্ছিলো। আমার খাওয়া হলে  ভুলে করে এটো থালার সাথে পরিষ্কার করা থালাগুলো  ব্যাগে ভরে নিয়ে মা চলে যান। আমিও কথা বলতে, বলতে নিতে ভুলে যাই।  তাই থালার অভাবে আমি ভাত খেতে  পারছিনা  বলেই  ছাতুমুড়ি খাচ্ছি ম্যাডাম “।

মানসীর কথায় মঞ্জুলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ব্যাপারটা তার  কিছুই বোধগম্য হলো না। মানসী কি বলছে!
বিপাশা  বিস্ময়ে বলল ” মানে তোমার বাড়ির লোকেরা প্রতি সপ্তাহে এসে তোমার এটো থালা বাড়ি নিয়ে যান? আর সপ্তাহের পরিষ্কার থালা দিয়ে যান?”
মানসী অপরাধীর মতো মুখ করে বলল
”  হ্যাঁ ম্যাডাম। এটো থালা নিয়ে যান আর পরিষ্কার থালা দিয়ে যান। কিন্তু এবার নানাবিষয়ে কথা বলতে বলতে ভুল হয়ে গেছে।

বিপাশা হোহো করে হেসে ওঠে এতক্ষনে। মঞ্জুলাও এতক্ষনে ব্যাপারটা বুঝে সেও  হেসে ওঠে।
ম্যাডামের চেম্বারে সমবেত হাসির আওয়াজে কৌতূহলী হয়ে অন্যান্য সিস্টার টিউটররাও বিপাশার চেম্বারে এসে জড়ো হয়। তারপর সব শুনে  তাঁরাও হাসিতে দেন। সে যেন এক নির্মল হাসির মেলা।
হাসি থামলে বিপাশা স্টোরকিপার  শোভনবাবুকে  ডেকে স্টোর থেকে ফার্স্ট ইয়ারের মানসী মন্ডলের নামে একটা থালা, একটি গ্লাস ও বাটি  ইস্যু করতে বলে। আর  মানসীকে বলে ” শোভনবাবুর থেকে ওগুলো নিয়ে হোস্টেলের মিল খেয়ে ক্লাসে যাও।
প্রায় চারটে নাগাদ বিপাশা তখন শেষ বেলার ডাক দেখছিলো। হোস্টেলের রাঁধুনিদের একজন   মিনতি দাস দরজা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বলল – “একটু আসবো ম্যাডাম? বিপাশা একমনে একটা আর্জেন্ট চিঠি দেখছিল  একটু বিরক্ত হয়ে বলল
” তোমার আবার কী সমস্যা হলো মিনতি” ? ”
মিনতি বলল ” ম্যাডাম মানসী মণ্ডল তো খেয়ে দেয়ে এটো বাসন পরিষ্কার না করে কিচেনে রেখে ক্লাসে চলে গেছে। এখন কে পরিষ্কার করবে”?
বিপাশা কলম থামিয়ে বলল ‘ ওকে ডেকে পরিষ্কার করে রাখতে বলো।  যাও ”
কি মনে হতে বিপাশা নিজেই  কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। দেখে মানসীর বাসন মাজছে আর কাঁদছে।
বিপাশা অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে  মানসী বলল – ” ম্যাডাম বাসন মাজার সাবানের খাড়ে আমার হাতময় এলার্জি বেরোয় লাল ডুমু, ডুমু। তাই আমায় মা বাবা বাসন মাজতে দেননা আর সেই কারণেই মা থালা, বাটি, গেলাস  মেজে আনেন ও পুরানোটা নিয়ে যান পরিষ্কার করে আনার জন্যে “।
বিপাশা স্নেহের ছাত্রীটিকে  মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে বললেন – ” কাল দ্বিতীয় পিরিয়ডে তুমি অবশ্যই স্কিন ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ডক্টর ব্যানার্জীকে দেখাবে।আমি বলে রাখবো। তুমি ট্রিটমেন্ট করোনি বোধহয় তাই কষ্ট পাচ্ছ। ভয় নেই একেবারেই সেরে যাবে “।
মানসীর চোখের জল তখনও শুকাইনি। তার কথা শুনে সামনে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে আসা কারুর  মুখে এখন একটুও হাসি ফুটলো না।

এখন মানসী তৃতীতবর্ষের ছাত্রী। বিপাশা ম্যাডাম অবসর নিয়েছেন অনেকদিন। তাঁর স্নেহের কথা ভুলতে পারে না  মানসী। এখনও ম্যাডামের সাথে ফোনে যোগাযোগ রেখেছে। হাতের এলার্জি কবেই সেরে গেছে। কোন সমস্যা হলেই ফোনে জিজ্ঞাসা করে। ম্যাডামও আপন সন্তানের মতো সবকিছু সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেন। মানসী বিপাশা ম্যাডামের কথায় তার নিজের মায়ের ছোঁয়া পায়।

শুধু মাঝে, মাঝে, মজা করে ম্যাডাম  জিজ্ঞাসা করেন ” এই মেয়ে নিজের এটো
থালা,বাটি, গ্লাস এখন নিজেই মাজো  তো, নাকি মাকে দিয়ে মাজাও …”?

সমাপ্ত
দূরভাষ -৮৭৭৭৭৪১৩০১

Share This
Categories
কবিতা

সৃষ্টি র রহস্য : শীলা পাল।

 

তুমি বললে
কবিতা সৃষ্টি করো।
মনের সব ভালো লাগা দিয়ে
একটু একটু করে সাজাও তাকে।
তার রূপে তোমার স্বপ্ন ফুটে উঠবে।
তোমার কাব্য তার চোখে মুখে শরীরে
লাবণ্যের স্পর্শ পেয়ে প্রাণবন্ত হবে।
তবে তোমাকে থামতে জানতে হবে।
তুমি যদি সাজাতেই থাকো, না থেমে
তোমার কবিতা কিন্তু পথ হারাবে।
পরিমিতি বোধ আগে আনো
তবে তো পরিপূর্ণ হয়ে তোমাকে
পূর্ণতা দেবে।
অনেক ভাবলাম দেখি তোমার কথাই ঠিক ।
আমি এতো এতো বর্ণনার মালা পরিয়েছি
তার সুন্দর গ্রীবা গেছে ঢেকে
তার বড়ো বড়ো কাজলকালো চোখ
সুর্মার আধিক্যে মোহময় দৃষ্টি টাই গেছে হারিয়ে ।
আমি একটু একটু করে অতিরিক্ত যা মনে হলো
তুলে নিলাম খুলে নিলাম ।
বেশি আভরনে যে আবরণ ছিল সরে গেল।
তাকিয়ে দেখি আমার কবিতা হাসছে
সেই হাসি আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলাম ।
আমার স্বপ্ন ধরা দিয়েছে তার উচ্ছল হাসিতে।
আমি আবার তোমার কথা স্মরণ করলাম ।
আমি ঠিক জায়গায় থামতে পেরেছি।

Share This
Categories
কবিতা

নদীর কথা : শীলা পাল।

আমি জল ছলছল ছোট্ট
একটি নদী
এক আকাশ বিষাদ মেখে আশ্বিন এসে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
আমি ছোট নদীটি
আপনমনে মনের সুখে ভেসে যাই স্রোতের টানে।
গাছগাছালির মধুর হাওয়া
আমার গায়ে আপনজনের দোলা মাখিয়ে আদর করে,
পাখিরা গান শুনিয়ে মনের মাঝে ঢেউ তুলে যায়।
এই শরতে এ কেমন মনখারাপী হাওয়া আমার প্রাণে এসে বাজলো
‘বিচার চাই বিচার চাই ‘
আমার চলার স্রোতের রঙ
রক্তের মত লাল হয়ে যেন বললো, দ্যাখ শারদীয় আকাশে রক্তমাখা মুখ ভাসে তাই তোমার জলেও
সেই রঙ।
এত অবিচার?
আমি ছোট নদী তবু আমার জলের তরঙ্গে তরঙ্গে ধিক্কার ছড়িয়ে দিলাম পৃথিবীর সর্বত্র।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

রথ যাত্রা : শীলা পাল।

শুনেছি সোজা রথ দেখলে নাকি উল্টোরথ দেখতে হয়।মনে বাসনা ছিল অনেকদিনের
সুযোগ এসে গেল।দশ বারো বছর আগে।আমরা ছসাতজন মিলে ঠিক করলাম এবং উল্টোরথের দু দিন আগে পুরী গিয়ে পৌঁছলাম।বাপরে কি ভীড় কি ভীড় ।লোক থৈ থৈ করছে।আমরা গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম ।ভুবনেশ্বর থেকে পুরী ঢুকতে মধ্য রাত হয়ে গেল।গাড়ির ভীড় মানুষের ভীড় দেখে আমার রথ দেখার ইচ্ছে টাই যেন চলে গেল।কেমন যেন বুকের ভেতর টা গুড়গুড় করছে।কি জানি বাবা দর্শন হবে তো।
পরের দিন গাড়ি চলবে সকালে।ঠিক হোলো মাসির বাড়ি গিয়ে জগন্নাথ দর্শন করে আসবো।বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় প্রভুর দর্শন হয়ে গেল।মন তৃপ্তিতে ভরে গেল।এবার রথে একবার দর্শন হলেই পুণ্য অর্জন ভালোই হবে।আমাদের দুজন অভিভাবক ছিলেন সঙ্গে ।এক আমার বেয়াইমশাই আর তার বন্ধু ।তিনি পুরীর বাসিন্দা।এবং বেশ নাম আছে ওখানে।আমার বেয়ায়মশাইদের জমিদারি ছিল ।এবং পুরীতে বেশ বড় বাড়ি এবং পরিচিতি দেখলাম ।ঠিক হোলো মন্দিরের কাছাকাছি রথ এলে আমাদের জানাবেন আমরা বাড়ি থেকে একটু আগে বেরিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে রথ যাত্রা দেখবো।
উল্টোরথের দিন প্রভু যাত্রা করেছেন ।আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে রথ আর যাবে না।আমরা রাতে গিয়ে রথে প্রভু জগন্নাথ কে দেখে এলাম ।পান্ডারা বললেন ভোরে রথ মন্দির অভিমুখে যাবে।আমরা ঠিক করলাম ভোরে এসে রথের দড়ি স্পর্শ করে যাবো।আমার বেয়ান খুব হুল্লোড়বাজ।আমাকে কানে কানে বললো দিদি ওরা বলুক আমরা রথ টানবো।আমি ভয়ে বললাম না না এই ভীড়ের মধ্যে মাথা খারাপ ।
ভোরে স্নান টান করে রথ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এসে দাঁড়ালাম।একটি দোকানের সামনে ভালো দেখা যাবে।সবই ওই অভিজ্ঞ বন্ধু টির পরামর্শ মতো।আমরা রথ তৈরি হচ্ছে সেই সময় দড়ি ধরে দাঁড়ালাম।আস্তে আস্তে যখন চলবে একটু টেনেই চলে আসবো টানাও হবে পুণ্য ও হবে।সেইমতো সবাই গিয়ে রথের দড়ি ধরে দাঁড়ালাম।রথ চলতে শুরু করলো ওরা পেছন থেকে ডাকছে এবার চলে এসো।সুপ্রিয়া আমার হাত চেপে ধরে থাকলো।সবাই বেরিয়ে গেল রথ জোরে ছুটছে আমরা দুজনে ছুটছি।কি জোরে যাচ্ছে আমরাও সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ লোকের সঙ্গে দড়ি ধরে ছুটে চলেছি।কি আনন্দ কি আনন্দ ভোরের পবিত্র আলোয় যেন হাওয়ায় ভেসে চলেছি।কোনও ভয় নেই ভাবনা নেই পিছুটান নেই প্রভুর রথের দড়ি ধরে ছুটে চলেছি।কি উদ্দেশ্যে জানি না কি মনস্কামনা ভুলে গেছি কি প্রার্থনা করবো ভুলে গেছি শুধু সামনে জগন্নাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন এই আনন্দে যেন সারা শরীর মন অপার্থিব পরিতৃপ্তি তে ভরে যাচ্ছে ।একবার রথ থামলো।অনেকে ভেতরে ঢুকে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে বলছে আরতি করো মা আমরা মনের সুখে দুজনে আরতি করলাম ।প্রভু জগন্নাথ তুমি দয়া করো।একটা বাচ্চা ছেলে নারকেল এনে বললো প্রভুকে নিবেদন করো।নারকেল ফাটিয়ে প্রভুকে পথের ধুলোমাখা নৈবেদ্য দিলাম।তুমি তো আজ পথেই আছো প্রভু তাই এই নিবেদন গ্রহণ করো মনে মনে বলি।বাচ্চা টা টাকা চাইলে যা হাতে উঠে এলো দিয়ে দিলাম ।হিসেব করি নি নিজেই যে বেহিসেবি এখন।
রথ আবার চলতে শুরু করলো সুপ্রিয়া বললো দিদি বেরিয়ে পড়ি চলো।এবার জোরে ছুটবে আর বেরোতে পারবো না।ভীড় ঠেলে বাইরে আসি দূরে মন্দিরের চূড়ো ঝকঝক করছে।
অনেক দূরে চলে এসেছি।রাস্তা ফাঁকা ।ওদের খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছি।দেখতে পাচ্ছি না ।
এদিকে ওরা রথ যাওয়ার সময় চোখ বুজে সবাই যখন আত্মমগ্ন সেই তালে তো আমরা পালিয়েছি।প্ল্যান তো আগেই করা ছিলো। এদিকে আমাদের না পেয়ে ওখানে তো হুলুস্থুলু কান্ড।নির্ঘাত আমরা হারিয়ে গেছি ঐ ভীড়ের মধ্যে কি করবো কোথায় যাবো ভেবে অস্থির ।শেষ মেশ যখন পুলিশকে জানাতে যাবে আমার দিদি চেঁচিয়ে বললো ওই তো আসছে ওরা।আমরা ভয়ে ভয়ে এসে ওদের কাছে আসতেই আমার বেয়াইমশায়ের উৎকন্ঠিত গলা আপনার ছেলেকে আমি কি বলতাম দিদি।
ভেতরটা হাসিতে ফেটে পড়ছে।বাড়ি ফিরে আগে আমরা দুজনে প্রাণ খুলে হেসে নিলাম।তারপর ভালমানুষের মতো এসে বললাম আমরা বুঝতে পারি নি রথ জোরে ছুটছিল বেরোতে ও পারছিলাম না।উনি আমাদের মন খারাপ দেখে বললেন ঠিক আছে।বিদেশ বিভুঁয়ে চিন্তা হয়।আপনি ভীতু মানুষ ।
জয় জগন্নাথ ক্ষমা করে দিও।
মনে মনে বলতে থাকলাম
জগন্নাথ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে

Share This
Categories
কবিতা

নদীর কথা : শীলা পাল।

আমি জল ছলছল ছোট্ট
একটি নদী
এক আকাশ বিষাদ মেখে আশ্বিন এসে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
আমি ছোট নদীটি
আপনমনে মনের সুখে ভেসে যাই স্রোতের টানে।
গাছগাছালির মধুর হাওয়া
আমার গায়ে আপনজনের দোলা মাখিয়ে আদর করে,
পাখিরা গান শুনিয়ে মনের মাঝে ঢেউ তুলে যায়।
এই শরতে এ কেমন মনখারাপী হাওয়া আমার প্রাণে এসে বাজলো
‘বিচার চাই বিচার চাই ‘
আমার চলার স্রোতের রঙ
রক্তের মত লাল হয়ে যেন বললো, দ্যাখ শারদীয় আকাশে রক্তমাখা মুখ ভাসে তাই তোমার জলেও
সেই রঙ।
এত অবিচার?
আমি ছোট নদী তবু আমার জলের তরঙ্গে তরঙ্গে ধিক্কার ছড়িয়ে দিলাম পৃথিবীর সর্বত্র।

Share This
Categories
কবিতা

কামনা : শীলা পাল।

যদি আমি দ্রৌপদী হতাম
পঞ্চ স্বামী কখনও চাইতাম না।
এতো মন রেখে কতো বুঝে শুনে
প্রতি পদে পদে সমঝোতা করা
নৈব নৈব চ।
শুধু আমার থাকতো প্রিয় সখা
মৃদু হেসে ভালোবেসে ডাকবে এসে
সখী ভালো আছো?
হাতে নিয়ে বাঁশি
বাজাবে আসি
মনে মনে তারে
দেব ভালবাসি
যা আছে দেওয়ার আমার ।
সুখে দুঃখে পাশে
মুহূর্তে দাঁড়াবে এসে
শুধাবেআমায়
সখী কি হয়েছে তোমার ।
আমার বেদনা যতো
নিয়ে নেবে নিজ বুকে
আমি যেন থাকি সুখে।

অলীক ভাবনা জানি
তবু তাহা প্রকাশে আনি
জানালাম নারীর কামনা খানি।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার, জন্ম দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার । তাঁর পসম্পর্কে বলা যেতে পারে, তিনি লেখক, দার্শনিক, পণ্ডিত, অনুবাদক, প্রকাশক ও মানবহিতৈষী । সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন । সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও অপরবোধ্য করে তোলেন । বাংলা গদ্যের সার্থক রূপকার তিনিই ।
বিদ্যাসাগরের যখন জন্ম (১৮২০), তখন শিক্ষা সংস্কারে ও বাংলা ভাষার আধুনিকরণের একটা ডামাডোল পরিস্থিতি । বিশৃঙ্খলার বাতাবরণ । শিক্ষার লক্ষ্য, পদ্ধতি ও পাঠক্রম নিয়ে চলছিল নানান বিতর্ক । অথচ বাঙালী সমাজ জানে, আধুনিক শিক্ষা ও সমাজ  সংস্কারে বিদ্যাসাগরের গৌরবময় অবদানের কথা ।

তাঁর নির্মিত বাংলা ভাষার ভিত্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম অধ্যায় । বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে বোধগম্য এবং সবরকমের ভাব ও চিন্তা প্রকাশের যোগ্য করে তুলেছিলেন । তাই আজও বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয় ।
আটপৌরে বাঙালি পোশাকে বিদ্যাসাগর ছিলেন সর্বত্রগামী । প্রবল জেদ ও আত্নসম্মানবোধ নিয়ে সরকারি চাকরি করেছেন, দ্বিরুক্তি না করে ইস্তফা দিয়েছেন । পাঠ্যবই লিখে ছেপে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেছেন, দানের জন্য ধারও করেছেন ।  উনিশ শতকে সমাজ বদলের সব আন্দোলনেই তিনি ছিলেন পুরোভাগে । এমন ব্যক্তিত্ব সবসময়ে  ব্যতিক্রম ।
বিদ্যাসাগরের একটা আপ্ত বাক্য আজও সমাজজীবনে উজ্জীবিত, “কোনো বিষয়ে প্রস্তাব করা সহজ, কিন্তু নির্বাহ করে ওঠা কঠিন” । অথচ তিনি এককভাবে ধুতিচাদর পরে একটার পর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা বাস্তবায়িত করে গেছেন, যেমন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ শিক্ষার সংস্কার ও বিধবা বিবাহ প্রচলন । এটা সর্বজনবিদিত, বিদ্যাসাগরের লড়াইটা ছিল একার লড়াই । বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বিশ্বকবি  রবীন্দ্রনাথের  মন্তব্য পরিষ্কার, তিনি গতানুগতিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন  স্বতন্ত্র, সচেতন ও পারমার্থিক ।
এটা অনস্বীকার্য যে,  বাঙালী সমাজে আজও বিদ্যাসাগরের প্রদীপ্ত উপস্থিতি ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়ে । প্রাথমিক শিক্ষায় ‘বর্ণপরিচয়’ এর  মাহাত্ম্য সকলের জানা । মুর্শিদাবাদ  জেলার শক্তিপুর হাই স্কুলের বাংলা ক্লাসের  দিদিমণি আমার রচনা লেখার গঠন অবলোকন করে হঠাৎ তাঁর সম্মুখে তিনি আদর করে ডেকে আমাকে বললেন, “তুই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থের নাম শুনেছিস” ? মাথা নেড়ে আমি  বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় গ্রন্থটির নাম শুনেছি জানালাম ।  তারপর চুপি চুপি বাংলা বিষয়ের শ্রদ্ধেয়া দিদিমণি বললেন, রোজ রাতে শোওয়ার আগে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’  বইখানা পড়বি । রচনা লেখার সময়ে তোর বানানের জড়তা কেটে যাবে ।“  সুতরাং শৈশব থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় আজও অমলিন । সেই বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ অতিক্রান্ত  । তাই দুশো বছর ধরে শিক্ষা জীবনের বাস্তবতায় ও শিক্ষা বিকাশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক ।
বিদ্যাসাগর যখন জন্মগ্রহন করেছিলেন সেই  সময়টা ছিল রামমোহনের যুগ, যিনি একজন শিক্ষিত ও অগ্রণী পুরুষ ছিলেন এবং সমাজ সংস্কারের অন্যতম কারিগর ।  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর  মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত ও বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা পুরুষ। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরিতে খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করতেন । পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের অতীত ছিল। সেই কারণে বালক ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী’র  সঙ্গে বাস করতেন।
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির ছ’মাসের মধ্যেই পাঁচ টাকা বৃত্তি পান ।  তাঁর প্রতিভার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে শিক্ষকেরা সকলে স্তম্ভিত । তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্মজীবন শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম (১৮৪১) কলেজের প্রধান পন্ডিত হিসাবে । ঐসময়েই  তাঁর ইংরেজি শিক্ষার যথাযথ শিক্ষালাভ । কেননা বিদ্যাসাগরকে সকলে জানতেন সংস্কৃতের পণ্ডিত হিসাবে । ইংরেজি হাতের লেখাও ছিল নজরকাড়া । ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে অর্থাৎ ১৮৫১ সালের ২২শে জানুয়ারী ঐ  কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন।  ঐ সময়েই ১৮৫১ সালে বিদ্যালয় দেখলেন, সংস্কৃত কলেজে গোড়া থেকেই  শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানদের পড়বার অধিকার ছিল । কিন্তু বৈদ্যদের আবার ধর্মশিক্ষায় ছিল আপত্তি । স্বভাবতই প্রশ্ন উঠল কায়স্থ ও অন্যান্য হিন্দু বর্ণদের কথা । তখনকার পণ্ডিত সমাজের তোয়াক্কা না করে, বিদ্যাসাগর তদানীন্তন কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিলেন ব্রাম্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্যান্য বর্ণের বিশেষ করে শূদ্রদের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশে তাঁর আপত্তি নেই । যদিও সেই সময় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকরা বিদ্যাসাগরের মতে গররাজী ছিলেন, তথাপি বিদ্যাসাগরের মতটাকেই মান্যতা দিয়েছিলেন তদানীন্তনকালের কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সেক্রেটারি । এবং পর পরই ১৮৫৪ সালের শেষে বিদ্যাসাগর হিন্দুদের সব শ্রেনীর জন্য সংস্কৃত কলেজের দরজা খুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন এবং সেই প্রস্তাব যথাসময়ে অনুমোদিত হয়েছিল ।
সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া,  শিক্ষা প্রসারে তাঁর আরও অবদান সর্বজনবিদিত ।  ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে বাংলা ভাষাকে সহজবোধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন । ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে  বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগ  প্রকাশ করে তিনি বাঙালীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন। ১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন,  তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।  ১৮৫৯ সালে তিনি “ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল” স্থাপনে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। ১৮৬৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় “হিন্দু মেট্রেপলিটন ইসস্টিটিউট”। ইংরাজ অধ্যাপকের সাহায্য ছাড়া এবং কোনোরকম সরকারি সাহায্য ছাড়া, বিদ্যাসাগর স্কুলটিকে ১৮৭২ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত করেছিলেন । বর্তমানে এর নাম “বিদ্যাসাগর কলেজ”। এটি দেশের প্রথম কলেজ যার প্রতিষ্ঠাতা – পরিচালক – শিক্ষক স্কলেই ভারতীয় ।  এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।
ব্রাম্মণ হয়েও বিদ্যাসাগর ত্রিসন্ধ্যা জপ করেননি । কোনো  মন্দিরে যাননি এবং ঈশ্বর  বিষয়ক কোনো লেখা তিনি লেখেননি । বিদ্যাসাগর ছিলেন নাস্তিক । ধর্ম সম্বন্ধে  তিনি শুধু মনে করতেন জগতের কল্যাণসাধন ও বিদ্যাচর্চা । এপ্রসঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষের উক্তিটি প্রনিধাযোগ্য, ধর্মের কোন বহিরঙ্গ মানতেন না । তিনি, আচরণও করতেন না । এখন যেমন অনেকে বলেন, ধর্মটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, অনেকটা সেইরকম ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ, বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন । সেদিনের সমাজে প্রচলিত প্রথার নির্মম পরিণতির জন্য নারীদের ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন আপামর জনতা অবলোকন করেছিলেন । শোনা যায়, একসময় রাজা  রাজবল্লভ নিজের বালবিধবা কন্যাকে পুনর্বিবাহ দেওয়ার অনুমতি সমাজের পণ্ডিতদের কাছ থেকে পেয়েও সেই বিবাহ কারও কারও বাধায় দিতে পারেননি ।  বিদ্যাসাগরের “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা” বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ ও সমাজ চমকে উঠেছিল । শেষ পর্য্যন্ত ১৮৫৫ সালের ১৬ই  জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়  । তারপর ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই বিধবা বিবাহ আইন স্রকারিভাবে আইন হিসাবে মঞ্জর হয় ।   বিদ্যাসাগরের দরদী হৃদয় কেঁদেছিল সেকালের সমগ্র হিন্দু নারী সমাজের দুর্গতি দুর্দশায় । বিধবা বিবাহ আইন নামে পরিচিত ১৮৫৬ সালের আইনটি কেবলমাত্র বিধবা নারীর দ্বিতীয় বিবাহের স্বীকৃতি দেয়নি, আইনটি যেমন বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে তেমনই মৃত স্বামীর এবং দ্বিতীয় বিবাহের এবং পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তিতে অধিকার সুনিদ্দিষ্ট করে ।  বিভিন্নভাবে জানা যায়, ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত মোট ৬০টি বিধবা বিবাহ সংঘটিত   হয়  ।  আরও      জানা   যায়,   বিদ্যাসাগর     ও  তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচণ্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তা ছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। এতে একটা জিনিস পরিস্কার,  বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগরের দৃঢ় সংকল্প শতভাগ সফল ।
তিনি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন, যাকে পরবর্তীতে বেথুন কলেজ নামকরণ করা হয়। নারীদের শিক্ষার দিকে আনার জন্য তিনি একটি অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন, যা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখান থেকে মেয়েদের শিক্ষার জন্য যাবতীয় অর্থের ব্যবস্থা করা হতো। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিত । দরিদ্রদের দানে তিনি সর্বদাই মুক্তহস্ত ছিলেন ।  তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন । এখানে বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র উক্তি প্রনিধানযোগ্য,
“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু ! উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম কান্তি অম্লান কিরণে” ।
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের। তাঁর বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে । পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের,  যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ।
তিনি তাঁর একক ও সহযোগীর উদ্যোগে রেখে গেলেন আধুনিক ব্যবহারযোগ্য একটি (উচ্চারণ অনুযায়ী ও মুদ্রণযোগ্য) বাংলা ভাষা, প্রাথমিক ও নীতিশিক্ষার বহু জনপ্রিয় গ্রন্থ, বাংলা মাধ্যম স্কুলব্যবস্থা ও নারীশিক্ষার পাকা বুনিয়াদ । মাতৃ/বাংলা ভাষার শিক্ষার আর একটি প্রাক শর্ত হল ভাল পাঠ্যপুস্তকের সুলভতা । বিদ্যাসাগরের সময় তার যথেষ্ট অভাব ছিল । বিদ্যাসাগরকেও অবতীর্ণ হতে দেখা যায় এক দিকে, বাংলায় ব্যকরণসিদ্ধ মুদ্রণযোগ্য অক্ষর ও বানান সংস্কার করে, নানা পাঠ্যপুস্তক রচনা, ছাপা ও বিপণনের আয়োজন । পাঠ্যপুস্তক রচনার পাশাপাশি ছাপা  বইয়ের সম্পাদনা ও সম্মার্জনার প্রতি তাঁর অখণ্ড মনোযোগ চিরদিন বজায় ছিল । একবার  তিনি হতদরিদ্র সাঁওতালদের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন তিনি, সেই সময় (১৮৭৮) চর্যাপদের আবিস্কর্তা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও তাঁর এক সঙ্গী লখনউ যাওয়ার পথে এক রাত বিদ্যাসাগরের আতিথ্যগ্রহণ করেন । রাত্রে বিশ্রামের পর সকালে উঠে শাস্ত্রী মশাই দেখলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয় বারান্দায় পাইচারি করিতেছেন এবং মাঝে মাঝে টেবিলে বসিয়া কথামালা কি বোধোদয়ের প্রূফ দেখিতেছেন । প্রূফে  বিস্তর কাটকুটি  করিতেছেন । যেভাবে প্রূফগুলি পড়িয়া আছে, বোধ হইল, তিনি রাত্রেও প্রূফ দেখিয়াছেন । আমি বলিলাম, কথামালার প্রূফ আপনি দেখেন কেন ? তিনি বলিলেন, ভাষাটা এমন জিনিস, কিছুতেই মন  স্পষ্ট হয় না ; যেন আর একটা শব্দ পাইলে ভাল হইত ; — তাই সর্বদা কাটকুটি করি । ভাবিলাম — বাপ রে, এই বুড়ো বয়সেও ইহার বাংলার ইডিয়ামের ওপর এত নজর ।“ (সূত্রঃ অ-বা-প,পৃঃ৪/ ২৭-৯-১৯) ।
এই অনন্য ও  বিরাট ব্যক্তিত্বের মানুষটি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ধর্মের কোনও বহিরঙ্গ মানতেন না এমনকি, আচরণও করতেন না ।   অথচ চালচলনে তিনি ছিলেন নিতান্তই সাদাসিধে ।  খুব বিনয়ী  এবং জীবনে  দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে ছিলেন  তিনি দৃঢ় মনোভাবাপন্ন । তিনি ছিলেন  একাধারে মহান সমাজ সংস্কারক  অন্যদিকে এক জন শিক্ষাবিদ  এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন অবিরাম । ভারতে শিক্ষার প্রতি তার অবদান এবং নারীর অবস্থার পরিবর্তন জন্য তিনি চিরস্বরণীয়। তাঁর অবর্ণনীয় মাতৃ ভক্তি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও চর্চিত ।
হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরোধী, বিধবা বিবাহের প্রচলনকারী, নারী শিক্ষার প্রবর্তক, উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, সমাজ সংস্কারক, বর্ণপরিচয় ও বহু গ্রন্থের রচয়িতা, মহান শিক্ষাবিদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনের প্রাক্কালে তাঁর মহান স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য ।

 

কলমে : দিলীপ  রায়।
————————-০——————————

 

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস : একটি অনন্য অ্যান্টার্কটিক ল্যান্ডমার্ক।

বিশ্বের সবচেয়ে প্রত্যন্ত কোণগুলির মধ্যে একটিতে অবস্থিত, অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস একটি আকর্ষণীয় আকর্ষণ যা বন্যপ্রাণী, ফিলাটেলি এবং অ্যাডভেঞ্চারকে একত্রিত করে। এই অদ্ভুত ফাঁড়িটি পর্যটক, গবেষক এবং স্ট্যাম্প সংগ্রহকারীদের জন্য একইভাবে একটি প্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

*ইতিহাস*

পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস, আনুষ্ঠানিকভাবে পোর্ট লকরয় পোস্ট অফিস নামে পরিচিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 1944 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে, এটি একটি ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি হিসাবে কাজ করেছিল, কিন্তু 1996 সালে, এটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল এবং একটি পোস্ট অফিস এবং যাদুঘর হিসাবে পুনরায় চালু করা হয়েছিল। আজ, এটি অস্ট্রাল গ্রীষ্মকালে (নভেম্বর থেকে মার্চ) কাজ করে এবং যুক্তরাজ্য অ্যান্টার্কটিক হেরিটেজ ট্রাস্ট (ইউকেএএইচটি) এর স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল দ্বারা কর্মরত।

*অনন্য বৈশিষ্ট্য*

1. *দূরবর্তী অবস্থান*: পোস্ট অফিসটি অ্যান্টার্কটিকার পোর্ট লকরয়ের উপকূলে গৌডিয়ার দ্বীপে অবস্থিত। দর্শকদের অবশ্যই নৌকায় করে আসতে হবে, বরফের জল এবং অনাকাঙ্খিত আবহাওয়ার সাহস।
2. *পেঙ্গুইন প্রতিবেশী*: পোস্ট অফিসটি একটি সমৃদ্ধ জেন্টু পেঙ্গুইন কলোনির সাথে তার অবস্থান শেয়ার করে। দর্শনার্থীরা অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার জন্য এই ক্যারিশমাটিক পাখিগুলিকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
3. *হ্যান্ড-স্ট্যাম্পড মেইল*: পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস থেকে পাঠানো চিঠি এবং পোস্টকার্ডগুলি একটি অনন্য হ্যান্ড-স্ট্যাম্প পায়, যা তাদের অত্যন্ত সংগ্রহযোগ্য করে তোলে।
4. *সীমিত অ্যাক্সেস*: এর দূরবর্তী অবস্থান এবং পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে, পোস্ট অফিসে সীমিত অ্যাক্সেস রয়েছে। ভঙ্গুর অ্যান্টার্কটিক ইকোসিস্টেম রক্ষা করার জন্য দর্শকদের অবশ্যই কঠোর নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে।

*পর্যটন এবং অপারেশন*

প্রতি মৌসুমে, প্রায় 18,000 পর্যটক পেঙ্গুইন পোস্ট অফিসে যান, বেশিরভাগই ক্রুজ জাহাজের মাধ্যমে। পোস্ট অফিস টিম বছরে প্রায় 70,000 টুকরো মেল প্রক্রিয়া করে, যা UKAHT-এর সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।

*সংরক্ষণ প্রচেষ্টা*

UKAHT অ্যান্টার্কটিকার প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। পোস্ট অফিস অপারেশন সাপোর্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করা তহবিল:

1. *বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ*: পেঙ্গুইনের আবাসস্থল রক্ষা করা এবং জনসংখ্যা পর্যবেক্ষণ করা।
2. *ঐতিহাসিক সংরক্ষণ*: পোর্ট লকরয়ের ঐতিহাসিক ভবন এবং নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণ।
3. *শিক্ষা*: অ্যান্টার্কটিক সচেতনতা এবং পরিবেশগত স্টুয়ার্ডশিপ প্রচার করা।

*উপসংহার*

অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস একটি অসাধারণ গন্তব্য যা অ্যাডভেঞ্চার, বন্যপ্রাণী এবং ইতিহাসকে মিশ্রিত করে। এই বিচ্ছিন্ন ফাঁড়িটি পৃথিবীর সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত কিন্তু শ্বাসরুদ্ধকর অঞ্চলগুলির একটিতে মানব সংযোগ এবং অনুসন্ধানের একটি আইকনিক প্রতীক হয়ে উঠেছে।

*ভিজিটিং তথ্য*

ঠিকানা: পোর্ট লকরয়, গৌডিয়ার দ্বীপ, অ্যান্টার্কটিকা
খোলা: নভেম্বর থেকে মার্চ (অস্ট্রাল গ্রীষ্ম)
অ্যাক্সেস: নৌকা দ্বারা, সংগঠিত ট্যুর বা ক্রুজ জাহাজের মাধ্যমে
যোগাযোগ: UKAHT (লিঙ্ক অনুপলব্ধ))

*বিশ্বের নিচ থেকে একটি পোস্টকার্ড পাঠান!*

যারা পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যাওয়ার সাহস করেন, তাদের জন্য পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস একটি অতুলনীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করে। অনন্য হ্যান্ড-স্ট্যাম্প সহ একটি পোস্টকার্ড বা চিঠি পাঠান এবং এই অবিশ্বাস্য, হিমায়িত ল্যান্ডস্কেপে সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করুন।

Share This