কুহেলির ধারণা, “যত দিন যাচ্ছে পান্তা মাসি বাবার সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধন শক্ত করতে ততো মরিয়া হয়ে উঠছে ।“ পান্তা মাসি এটাও বুঝতে পারছে, তার পথের কাঁটা হচ্ছে কুহেলি । পান্তা মাসি ইদানীং কুহেলিকে সহ্য করতে পারছে না । তাই প্রমাদ গুনছে, কীভাবে কুহেলিকে টাইট দেওয়া যায় এবং কীভাবে কুহেলির অগোচরে সানাইকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায় !
সপ্তাহ খানেক আগে রাত্রিবেলায় পান্তা মাসির সাথে সানাইয়ের প্রচণ্ড ঝগড়া ! ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দু কুহেলি । তুমুল বাগ্বিতণ্ডা । ঝগড়ার কথাগুলি শুনে কুহেলি তাজ্জব ! পান্তা মাসির বক্তব্য, “আশা দিয়ে কেন তাকে ঝোলাচ্ছ ?” কুহেলি বুঝতে পারলো না, পান্তা মাসি কীসের আশার কথা বলছে ? পান্তা মাসি খুব নিম্ন মানের অরুচিকর কথার মাধ্যমে কুহেলির বাবাকে ফাঁসাতে চাইছে । দুইজনের কথাতে কুহেলি নিশ্চিত, তার বাবা পান্তা মাসির কাছে ফেঁসে গেছে ।
বাবাকে পরেরদিন কুহেলি বলেছিল, “আমি বড় হয়েছি । বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না আমি করতে পারি । তাহলে পান্তা মাসিকে আর কী দরকার ?”
কথাটা শুনে সানাই কিচ্ছুক্ষণ কুহেলির দিকে করুণ দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল । কোনো কথা বলেনি । কিন্তু বাবার করুণ চোখের তাকানোর মাহাত্ম্য কিছুটা হলেও কুহেলি আন্দাজ করতে পেরেছিল । কুহেলির বদ্ধ ধারণা, তার বাবা পান্তা মাসির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে ।
কুহেলি ভরতপুর হাই স্কুলে এগারো ক্লাসে ভর্তি হলো ।
প্রথম কয়েকদিন সানাই মেয়েকে ভরতপুর পর্যন্ত পৌঁছে দিতো । কিন্ত কুহেলিকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার পর সানাই বাড়ি ফিরতে অনেক দেরী করত । কুহেলি এটা জানতে পারে কাকীমার কাছে । যখন বাড়ি ফিরত, তখন সঙ্গে পান্তা মাসি । কোথায় যেতো কুহেলি সেটা উদ্ধার করতে পারেনি । এমনকি সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেও সঙ্কোচ বোধ করত । তাই তাকে পৌঁছে দিয়ে বাবা কোথায় যায়, আজও কুহেলির অজানা !
ভরতপুর হাই স্কুলের কলেবর তুলনামূলকভাবে অনেক বড় । ক্লাসের বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়ে ঐ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ । কুহেলিরা কয়েকজন বাইরের স্কুল থেকে আগত এবং নবাগত । ফলে ক্লাসে ঐ স্কুলের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগলো । ভরতপুর স্কুলে পড়াশুনায় কুহেলির তেমন কোনো সমস্যা নেই । কিন্তু ফেরার সময় কিছু উটকো ছেলের পাল্লায় পড়তে হচ্ছে কুহেলিকে । সম্ভবত তাদের বাড়িতে কাজকর্ম বলে কিছু নেই । যার জন্য রাস্তার পাশে গাছ তলায় বসে আড্ডা । তারা ইচ্ছা করেই বিকেলবেলাটা বেছে নিয়েছে । স্কুল ছুটি হলে ছেলে-মেয়েগুলি ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরবে । যারা আমলাই, খয়রা, ইত্যাদি গ্রামের ছেলে-মেয়ে, তারা সকলেই ঐ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফেরে । আড্ডাবাজ ছেলেগুলির টার্গেট, উঁচু ক্লাসের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ।
আজ বুধবার । স্কুলে যাওয়ার জন্য মন বসছিল না কুহেলির । বাড়িতে বসে ঘুমানোর ইচ্ছা । সকাল থেকে শরীরটা আলস্যে ভরা । কোনোকিছুতেই মন বসছে না । বাবার কথা ভেবেই কুহেলির মনটা আনচান ! বাপ-বেটির মাঝখানে ঢুকে পান্তা মাসি কুহেলির জীবনে বিপদ ডেকে আনছে কিনা সেটা ভেবেই কুহেলি আকুল । পান্তা মাসির জন্য ভবিষ্যতে তার কপালে কী বিপদ লুকিয়ে আছে, সেটা ভেবেই কুহেলি অস্থির ! ভাবনাটা ইদানীং বেশী বাড়ছে । তাই বাবাকে কুহেলি বলল, “আজ স্কুলে যেতে মন বসছে না । আর তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্লাসও নেই । যার জন্য আজ আমার স্কুলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক ।“
“না, মা । বাড়িতে বসে থাকলে বরং উল্টোটা হবে । শরীর আরও খারাপ হতে পারে ।“ বাবা কুহেলিকে বোঝালো ।
কুহেলির গলার আওয়াজ পেয়ে পান্তা মাসি কোথা থেকে ছুটে এসে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “স্কুলে না গিয়ে নিশ্চয় শীতলের সঙ্গে দুনিয়া ঘোরার মতলব ?” কুহেলিকে বলেই সানাইয়ের দিকে তাকিয়ে পান্তা মাসি একরকম চিল্লিয়ে বলল, “তোমাকে আগেও বলেছি এই মেয়েটা কেলেঙ্কারি বাধিয়ে তবেই ছাড়বে । কিছুতেই শীতলকে ভুলতে পারছে না । মনে হচ্ছে শীতল তাকে বিয়ে করবে ! আমার কাছে শুনে নাও, শীতল জিন্দেগিতে এই মেয়েকে বিয়ে করবে না । নতুন নতুন মেয়েদের সাথে ওদের ফষ্টিনষ্টি করা স্বভাব !”
শীতলের নামে পান্তা মাসির মুখে কটুকথা শুনে কুহেলি চিৎকার করে পান্তা মাসিকে বলল, “ভদ্রভাবে কথা বলো । এরপরে শীতলের নামে একটি কথা বললে তোমাকে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবো । আমাদের বাড়িতে থাকছ, আমাদের অন্ন ধ্বংস করছ আর আমাদেরকে নিয়ে তোমার জ্বালা !“ তারপর রাগে গজরাতে গজরাতে সানাইকে বলল, “বাবা, খুব তাড়াতাড়ি পান্তা মাসিকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলো । নতুবা আমি থানার সাহায্য নিয়ে পান্তা মাসিকে বাড়ি থেকে তাড়াবো ।“
“মা, ঐভাবে বলতে নেই । পান্তা মাসি তোমার গুরুজন ।“ সানাই বোঝালো ।
বাবার কথা শুনে কুহেলি ছুটে ঘরের ভিতর ঢুকলো ।
“দেখেছো, তোমার আদরের মেয়ের আস্পর্ধা দেখেছো ? পুলিশ দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াবে ? সাহস থাকে তো তাড়িয়ে দেখাক !” চোখ বড় বড় করে সানাইকে পান্তা মাসি শাসালো । আবার বলতে শুরু করলো, “ওকে আজ স্কুলে পাঠাও নতুবা আমি ঘাড় ধরে স্কুলে পাঠিয়ে ছাড়ব ।“
“খবরদার ! তুমি আমার মেয়েকে কিচ্ছু বলবে না । যা বলার আমি বলবো ।“ সানাই রেগে গিয়ে পান্তা মাসিকে বলল ।
আমি তোমার চমকানোতে ডরাই না । আজ আমাদের সম্পর্কের একটা বিহীত চাই ? নতুবা অনন্তকাল আমি ধৈর্য ধরতে পারব না ।
তুমি কী করবে জানি না । আমি আগেও বলেছি আজও বলছি, মেয়ের বিয়ে না দিয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারব না । তোমার জন্য মেয়েটাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে পারব না ।
“তোমার অতিরিক্ত আহ্লাদের জন্য ঐ গুণধর মেয়ে একদিন আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে, এটা তোমাকে বলে রাখলাম !” জোর দিয়ে পান্তা মাসি সানাইকে বলল ।
তোমার কথামতো চাষের সব জমি বিক্রি করে দিলাম । আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে মেয়েটা বাঁচবে কীভাবে ? মেয়েটাকে অগাধ জলে ভাসিয়ে দিয়ে আমি সুখ আহ্লাদে বাঁচতে চাই না । এটা তুমি কেন বুঝতে পারছো না ?
“নিজে বাঁচলে বাপের নাম ! এটা বোঝো তো ?” পান্তা মাসি বলল ।
“তুমিই বোঝো । আমি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারব না ।“ তারপর বাইরে থেকে মেয়েকে ডাকতে শুরু করলো, “মা, রাগ করে থাকিস না । বাইরে বেরিয়ে এসে রেডি হয়ে স্কুলে যা মা ।“ মেয়ের কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো সানাই ।
এবার সানাই পান্তা মাসির কথা ভাবছে, সে আচ্ছা জ্বালায় পড়লো । পান্তা মাসি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে নতুন ঘর বাঁধার । ঘর বাঁধার ক্ষেত্রে কাঞ্চন নগরে থাকতে রাজি না । দূরে গিয়ে ঘর বাঁধতে চায় । সানাই বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছে, পান্তা মাসি কুহেলিকে সহ্য করতে পারছে না । অথচ পান্তা মাসি জানে, সানাইয়ের একমাত্র অবলম্বন কুহেলি । সেই কুহেলিকে নিয়ে তার যত হিংসা, বিদ্বেষ ! এটা কিছুতেই সানাই মেনে নিতে পারছে না । কুহেলি পান্তা মাসির পেটের মেয়ে নয়, কিন্তু তার পেটের মেয়ের মতো । সেটা সানাই বারবার বলা সত্ত্বেও পান্তা মাসি কুহেলিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না । অন্যদিকে পান্তা মাসিকে নিয়ে সানাই ঘর বাঁধার স্বপ্নও দেখছে, সেটা ঠিক । তবে সানাই চাইছে, মেয়েটাকে সঠিক জায়গায় পাত্রস্থ করে পান্তা মাসির সাথে ঘর বাঁধতে । কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, পান্তা মাসিকে থামানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।
কুহেলি বেজার মুখে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাবাকে বলল, “আমি স্কুলের জন্য তৈরী হচ্ছি । তুমি আমাকে ভরতপুর পৌঁছে দিয়ে আসবে ।“
সানাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ।
স্কুলে যাওয়ার পথে আইসক্রিমের বাক্স সমেত আইসক্রিমওয়ালাকে দেখতে পেয়ে কুহেলির কী আনন্দ ! তাই কুহেলির বায়না, “বাবা ! আইসক্রিম খাবো ।“
সানাই মেয়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলো, আইসক্রিম দেখে কুহেলির আনন্দ ঠিক ছোটবেলার আনন্দের মতো । ছোটবেলায় আইসক্রিমের বাক্সের শব্দ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে বাবার কাছে কুহেলির বায়না, “বাবা, আইসক্রিম !” আজ সেই রকম বায়না দেখে সানাইয়ের চোখে জল চলে আসছিল । নিজেকে সামলে নিয়ে আইসক্রিমওয়ালাকে বলল, “দাদা, বাটির আইসক্রিম দিন তো ?”
“বাটির আইসক্রিম নেই । তবে ভাল মানের আইসক্রিম আছে ।“ বলেই বাক্স থেকে নতুন মডেলের আইসক্রিম বের করে সানাইয়ের সামনে তুলে ধরলো ।
আইসক্রিম দেখে সানাই বলল, “একটু দাঁড়ান দাদা ! আমি মেয়ের কাছে জেনে আসি, সে এই আইসক্রিম খাবে কিনা ?”
দূর থেকে আইসক্রিম দেখতে পেয়ে বাবাকে হাতের ইশারায় কিনতে বলল ।
আইসক্রিম খেয়ে আবার স্কুলের উদ্দেশে রওনা । কুহেলি বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে, বাবা খুব খোশ মেজাজে রয়েছে । তাই কুহেলি আস্তে করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা ! একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ?”
হ্যাঁ মা । কী বলবে, বলো ।
তুমি এতদিন আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কোথায় যেতে ?
তোকে এই ব্যাপারটা পরে জানাবো । তুই আমার মা । তুই আমার প্রাণ । তোকে সব জানাবো মা । তোকে জানাতে আরও কয়েকটা দিন সময় লাগবে ।
“ঠিক আছে বাবা । পরে জানালেই হবে ।“ এই কথা বলার পরে বাবার দিকে তাকিয়ে কুহেলি লক্ষ করলো বাবার চোখ ছলছল । কুহেলি আন্দাজ করতে পারলো, জিজ্ঞাসা করায় বাবা একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেছে ।
বাবাকে স্বাভাবিক করতে কুহেলি আবার বলল, “অনেকদিন তুমি আর আমি কোথাও বেড়াতে যাই না । পরের মাসে চলো দীঘা বেড়িয়ে আসি ।“
“ভাল প্রস্তাব দিয়েছিস মা ।“ সানাই চোখের জল মুছে কুহেলির বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলো ।
ভরতপুর স্কুলে পৌঁছানো মাত্র কুহেলি স্কুলের কম্পাউন্ডে ঢুকে গেলো ।
সানাই এখন একা । কুহেলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তার বাড়ি ফেরার পালা । সানাইয়ের বারবার মনে হচ্ছে কুহেলি ছাড়া তার জীবন শূন্যতায় ভরা । কুহেলিকে কোলে-পিঠে মানুষ করতে তাকে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে । তবুও সানাই ছিল নাছোড়বান্দা । কেননা তার ভিতরে জেদ ছিল, তার একমাত্র মেয়েকে অনেক শিক্ষিত করবে । এইজন্য কুহেলির পড়াশুনার প্রতি সানাইয়ের সবসময় খেয়াল । মেয়ে অনেক বড় হয়েছে । নিজে বুঝতে শিখেছে । তবুও মেয়ের আবদার মেটাবার জন্য সানাই সর্বক্ষণ তটস্থ । মেয়ের কষ্ট হোক, এমন কাজ সানাই কখনও করে না । সমস্যা বাধলো পান্তা মাসিকে নিয়ে । প্রথম দিকে পান্তা মাসি অতটা ঝঞ্ঝাটে যেতো না । চোখ বুজে বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করত । কুহেলিকে ঘুম থেকে তোলা, তাকে স্কুলের সাজে সজ্জিত করে স্কুলে পাঠানো, ইত্যাদি । এইসব সংসারের টুকিটাকি কাজ সেরে সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে গাঁয়ে-গঞ্জে ছুটত বিক্রি করতে । বিক্রি শেষে নিজের বাড়ির কাজে মন দিতো । সেই পান্তা মাসি এখন আলাদা সংসার চাইছে, যেখানে কুহেলি থাকলে বলবে না । কুহেলি কীভাবে বাঁচবে সেটা তার ধর্তব্য নয় । ইতিমধ্যে পান্তা মাসি কোচবিহার গিয়েছিল । সেখানে তার নিজের বোন জুলি থাকে । কোচবিহারের মাথাভাঙায় জুলির বাড়ি । জুলির দুই মেয়ে । অল্প বয়সেই তারা বিবাহিত । পান্তা মাসি জুলির সাহায্য নিয়ে মাথাভাঙায় একটি পুরানো বাড়ির হদিস পেয়েছে । সেটা কেনার জন্য মরিয়া । বাড়িটা বাজারের মধ্যে । বাড়ির সামনের দিকটায় দোকান ঘর । তবে মেরামত দরকার ! মাথাভাঙার বাড়িটা কেনার জন্য একরকম পান্তা মাসির চাপে মাঠের জমি বিক্রি করা । বাড়িটা কেনার জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়েছে । বাড়ি কেনার ব্যাপারে ঝুট-ঝামেলা সামলাচ্ছে জুলি । এখন বাড়ির মালিক তাগাদা দিচ্ছেন অতি সত্বর বাড়িটা রেজিষ্ট্রি করে নিতে । সেই কারণে পান্তা মাসির ছটফটানি । যেনতেনভাবে বাড়িটা কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করা । কাঞ্চন নগরে থাকলে মানুষ নানানভাবে তাদের অতিষ্ঠ করে তুলবে । নানা অছিলায় বিরক্তিকর কথা শোনাবে । তাই পান্তা মাসির পরিকল্পনা, অনেক দূরে সকলের অগোচরে বসবাস করা ।
ভাবতে ভাবতে সাইকেল নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো সানাই । বাড়ি পৌঁছে সানাই অবাক ! তার বাড়ির সামনে একটা মারুতি ভ্যান গাড়ি দাঁড় করানো । ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না । সানাই আরও কয়েকটা দিন সময় নিয়েছিল । সানাই মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত । প্রথমদিকে গোঁ ধরেছিল মেয়েটা বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পান্তা মাসির সাথে ঘর বাঁধবে । কিন্তু পান্তা মাসির পীড়াপীড়িতে বলতে বাধ্য হয়েছে মেয়েটা অন্তত একটা চাকরি পাক্ । কিন্তু পান্তা মাসির সবুর সইলো না । সানাই নির্ঘাত বুঝতে পারছে, তাকে কাঞ্চন নগরের বাড়ি ঘর ছেড়ে পান্তা মাসির হাত ধরে এখনি কোচবিহার ছুটতে হবে ।
“শিগ্গির রেডি হও । বাজারসৌ স্টেশন থেকে ট্রেন । আমি সব ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি । খাবার রেডি । খাবার খেয়ে রওনা দিতে হবে । বেশী দেরী করা যাবে না ।“ পান্তা মাসি তাগাদা দিলো ।
অগত্যা চোখের জল ফেলে পান্তা মাসির হাত ধরে কোচবিহারের উদ্দেশে পাড়ি দিলো সানাই । কাক-পক্ষীও টের পেলো না সানাই গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে কোচবিহারে চলে গেলো । এমনকি তার ভাই কানাইও জানলো না, তার দাদা কাঞ্চন নগরের মায়া ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে কোচবিহারে বাস করার জন্য পালিয়ে গেলো ।
*************************
শেষ ক্লাস শেষ হতে বিকাল গড়িয়ে গেলো । বাজারে মুদিখানার দোকানে তার কিছু কাজ ছিল । মুদিখানার দোকানে গিয়ে সেগুলি কিনতে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেলো । ভরতপুর থেকে যখন সাইকেল নিয়ে কুহেলি স্টার্ট দিলো, তখন চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে । পিঠে বইয়ের ব্যাগ । সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো বাজারের ব্যাগ । সাইকেল চালিয়ে সিসগ্রাম পার হয়ে যখন ফাঁকা রাস্তাটা ধরলো, তখন সন্ধ্যার কালো অন্ধকার নেমে এসেছে । তার সাথে স্কুলের কোনো ছাত্র বা ছাত্রী ছিল না । সকলে অনেক আগেই বাড়ি ফিরে গেছে । কুহেলি একা বাড়ি ফিরছে । রাস্তা দিয়ে মানুষজন চলাফেরা করছে ঠিকই, কিন্তু তাঁরা নিজের নিজের কাজে ব্যতিব্যস্ত । সেই কারণে তাঁরা নিজ গন্তব্যস্থানে আপন মনে হেঁটে চলছেন ।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামার জন্য কুহেলির মনের ভিতর একটা আতঙ্ক ! শীতলটা বাড়িতে নেই । বাবা-মায়ের সঙ্গে মামা বাড়ি গেছে । ফিরতে আরও দুদিন ! বাবাকে কুহেলি আর ডাকতে চাইছে না । সকাল বেলায় তার আবদার মেনে বাবা তাকে স্কুলে ছাড়তে এসেছিল । তাই কুহেলি বাবাকে সন্ধ্যাবেলায় বিব্রত করতে চাইছে না । মাথায় সাতপাঁচ চিন্তা । সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ।
আড্ডা দেওয়া ছেলেদের কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ দিগন্ত নামে একটি অল্প বয়স্ক ছোকড়া কুহেলির হাত টেনে ধরে বলল, “তুই আমাকে বিয়ে করবি । আমি তোকে সুখে রাখব ।“
কথা শুনেই কুহেলি দিগন্তের গালে টেনে এক থাপ্পড় ! তারপর শাসিয়ে দিগন্তকে বলল, “আবার আমার দিকে তাকালে তোর চোখ দুটি আমি উপড়ে ফেলে দেবো । কথাটা মনে রাখিস্ ।“
ইত্যবসরে কাঞ্চন নগরের শ্যামল কাকু মোটর বাইকে বাড়ি ফিরছিলেন । বাইকের হেড লাইটে কুহেলিকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কুহেলি, কী ব্যাপার ? তুমি ভর সন্ধ্যাবেলায় রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে কেন ? কোনো সমস্যা ?”
“না কাকু ! এরা আমার পরিচিত । আমার সঙ্গে কথা বলছিল । চলুন, আমিও রওনা দিচ্ছি ।“ কুহেলি শ্যামল কাকুর সঙ্গে রওনা দিলো । শ্যামল কাকু বাইক নিয়ে আগে চলে গেলো, আর কুহেলি পেছন পেছন সাইকেলে চললো ।
দূরের অন্ধকার থেকে একটা পরিচিত গলার আওয়াজ ভেসে এলো, “বাড়ি যা ! বাড়িতে গেলে আর রক্ষে নেই । তোকে এবার শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে !”
কথাটা শুনে কুহেলির অন্তরটা ছ্যাঁত করে উঠলো ?
খুব দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরলো কুহেলি । এ-ঘর, সে-ঘর ঘুরেও বাবাকে দেখতে পেলো না । আতঙ্কের শিহরণ তার সারা শরীরে ! তারপর অন্ধকারে চিৎকার করে ডাকলো, “বাবা ! বাবা !” নিস্তব্ধ নীরব বাড়িতে এখন শুধু কান্নার রোল ! কুহেলির বুক চাপড়ানো আর্তনাদ, “ফিরে এসো বাবা ।“
( চলবে )
Categories