ওঁ নমঃ শ্রী ভগবতে প্রণবায় ।
আমাদের মানুষের এই বৈচিত্র্যময় জীবনে ঘটে অসংখ্য ঘটনা, সত্য মিথ্যা, সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আনন্দ বেদনা, সব মিলিয়ে চলে জীবন। পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল অঙ্কের নামই জীবন। আমরা সবাই জানি *সত্যমেব জয়তে* সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, সত্য সবসময় সুন্দর, কিন্তু *সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটি ও একটি অপ্রিয় সত্য।* সত্যমেব জয়তে (সংস্কৃত: सत्यमेव जयते) আমাদের এই সুন্দর তপোভূমি, পুণ্যভূমি ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিবাক্য। এর অর্থ “সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।” সত্যমেব জয়তে মুন্ডক উপনিষদের একটি মন্ত্র। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে মহাত্মা পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময় এই মন্ত্রটিকে জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে এসে খুব জনপ্রিয় করেন।
*सत्यमेव जयते नानृतं सत्येन पंथा विततो देवयानः।
येनाक्रमंतयषयो दृत्कामा यत्र सत्यस्य परमं निधानभ।।*
(মুন্ডক উপনিষদ)
অর্থ :— সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার নয়। সত্যের দ্বারা ঐশ্বরিক পথ পরিপূর্ণ হয়, যারা ইচ্ছা থেকে মুক্ত, সত্যের সর্বোচ্চ আবাসে পৌঁছায়।
*सत्यमेव जयते*এই সুন্দর মন্ত্রটি দেবনাগরী হরফে আমাদের তপোভূমি, পুণ্যভূমি ভারতের জাতীয় প্রতীকের নিচের অংশে এবং সমস্ত ভারতীয় মুদ্রায় লেখা আছে ।
আমরা যদি পৌরাণিক ভারতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, মহাভারতের মহানযোদ্ধা মহাবীর কর্ণের দিকে। কি দেখি? প্রথমত, সে ছিলো একজন যোগ্য সন্তান। দ্বিতীয়ত, সে ছিল একজন দানবীর রাজা। তৃতীয়ত, সে ছিল একজন মহাবীর যোদ্ধা। চতুর্থত, সে ছিল একজন মিত্রপ্রেমী মানুষ। পঞ্চমত, সে ছিল একনিষ্ঠ ও ধার্মিক চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু কর্ণের জন্ম ইতিহাস গোপনীয় ছিল। জন্মদাত্রী মায়ের অবহেলার জন্য ক্ষত্রিয় পরিচয় থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। অন্যদিকে পালিত মায়ের থেকে প্রাপ্ত নৈতিক শিক্ষা ও আদর্শ তাকে নিজের অধিকারের দাবিতে লড়াই করতে শিখিয়ে ছিল। যার জন্য কর্ণের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সংগ্রামের সাথে অবহেলিত, লাঞ্চিত জীবন কেটেছে। সত্যের জয় (প্রকাশ) যখন হলো, মৃত্যুর সময়ে, কর্ণের জীবন তখন শেষ। এটি একটি অপ্রিয় সত্য। *সত্যমেব জয়তে* সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, সত্য সবসময় সুন্দর, কিন্তু *সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য।* সত্যের সুফল কর্ণের জীবনে, জীবদ্দশায় কোনো কাজেই লাগলো না।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন- দেখো পার্থ, তুমি জানো না , কর্ণ কৌরবপক্ষের সেনাপতি হওয়ার পর আমি তার শিবিরে গিয়েছিলাম কর্ণকে পাণ্ডবপক্ষে আসার নিমন্ত্রণ দিতে, ধর্মপক্ষে আসার সুযোগ দিতে। কিন্তু কর্ণ বলেছিল যতই দুর্যোধন অধর্মের পথে থাকুক, কিন্তু বিপদের দিনে সে আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। অতএব সেই মিত্রতার ঋণ শোধ করাই হবে তার প্রথম ধর্ম। কর্ণ এও বলেছিল এই যুদ্ধে জয় পাণ্ডবদেরই হবে। কিন্তু তাই বলে সে দুর্যোধনকে ধোঁকা দিতে পারবে না। সে প্রাণ দিয়ে দেবে তবু কৌরবপক্ষ ছাড়বে না। আর কর্ণ তাই করলো। একদিকে প্রাণ দিয়ে দুর্যোধনের মিত্রতার ঋণ শোধও করলো অন্যদিকে ধর্মের বিজয়ের পথও প্রশস্ত করে দিল। হে পার্থ! যদি কোনোদিন কর্ণের জীবনের পূর্ণ কথা জানার সুযোগ পাও সেদিন তুমি মাটিতে শুয়ে ওকে প্রণাম করবে। তাহলে এবার ভাবো শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর যোদ্ধা আসলে কে? অর্জুন না কর্ণ!
শ্রীকৃষ্ণ বললেন তাছাড়া তুমি কর্ণকে হারাওনি অর্জুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন- দেখো পার্থ পিতামহ ভীষ্ম তোমার সামনে যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় হয়েছিলেন, তার মানে কি তুমি পিতামহ ভীষ্মের চেয়েও বড় ধনুর্ধর হয়ে গেলে?
মহাভারতে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর আসলে কে??? তাই, সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য।
আমরা যদি সুন্দর তপোভূমি,পুণ্যভূমি ভারতের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৬ বৎসরপূর্তি, অমৃত মহোৎসব এরপর ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটন হলো না। তাই, সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্যের উজ্জ্বল উদাহরণ।*সত্যমেব জয়তে* সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, সত্য সবসময় সুন্দর, কিন্তু *সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য।*
আমরা যদি স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। পণ্ডিত লালবাহাদুর শাস্ত্রী ভারতের মতো, মহান গণতান্ত্রিক দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৬ বৎসরপূর্তির পর ও পণ্ডিত লালবাহাদুর শাস্ত্রীজী মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটন হলো না। তাই, সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্যের উজ্জ্বল উদাহরণ।*সত্যমেব জয়তে* সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, সত্য সবসময় সুন্দর, কিন্তু *সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য।*
আমরা যদি স্বাধীন ভারতের শত শত আদালত গুলির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। দৈনিক শত শত নিষ্পাপ জনগণ নৈতিক ন্যায়বিচার এর আশায়, সত্যের জয়এর আশায়, বছরের পর বছর, প্রজন্ম পর প্রজন্ম ঘূরপাক খায় ন্যায়বিচার এর আশায় সত্যের জয়এর জন্য। এটি ও একটি অপ্রিয় সত্যের উজ্জ্বল উদাহরণ।*সত্যমেব জয়তে* সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, সত্য সবসময় সুন্দর, *কিন্তু সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য।*
আমরা যদি বর্তমান আধুনিক ভারতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। উদাহরণ স্বরূপ আদালত এর ন্যায়বিচার পুরুলিয়ার দরিদ্র ধনঞ্জয়! *ধনঞ্জয় এর ফাঁসি* যাত্রাপালা ধনঞ্জয় কি ন্যায়বিচার পেয়েছে? আসলে কে দোষী? ধনঞ্জয় কি আসল দোষী? না, আসল দোষী কোনো ধনীর দুলাল টাকার বলে মেঘএর আড়ালে উঁকি দিচ্ছে হাসতে হাসতে। তাই, *সত্যমেব জয়তে* সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, সত্য সবসময় সুন্দর, কিন্তু সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য।
আমাদের এই পবিত্র তপোভূমি, জন্মভূমিতে এই ধরনের অপ্রিয় সত্য ঘটনা, বাস্তব ঘটনা, আমাদের জীবনে, অনেক ব্যক্তির জীবনে, অনেক প্রতিষ্ঠানে এই পবিত্র ভূমিতে প্রতিদিন প্রতি-নিয়ত ঘটছে। এই রকম কত শত শত সত্যের উদ্ঘাটন হয় না। তাই, সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য। তাই, আমরা মানি বা না মানি, *সবসময় সত্যের জয় হয় না, এটিও একটি অপ্রিয় সত্য।* তাই, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
শ্রী শ্রী জগৎ গুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশির্বাদ আপনাদের সকলের শিরে বর্ষিত হোক… এই প্রার্থনা করি…!***
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ
তথ্যসূত্র: ১) মহাভারত ও অন্যান্য বই।
২) ইন্টারনেট এবং ফেসবুক ইত্যাদি।
NB:-এই লেখাটি বর্তমান, ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনীর অনন্য মিলন ও সুন্দর সংগ্রহ। মানুষ মরতে পারে কিন্তু ইতিহাস চিরকাল থেকে যায়।এটি কোনো ব্যক্তি বিশেষ বা প্রতিষ্ঠান এর উদ্দেশ্য করে লেখা নয়। মূল্যবান মনুষ্য জীবনের জন্য এই বিশ্লেষণী তথ্যাবলী। সুতরাং, কোন ত্রুটি হয়ে থাকলে তা উদ্দেশ্য মূলক বা ইচ্ছা কৃত নয়।
~~ স্বামী আত্মভোলানন্দ