সমাজ উন্নয়নের নিরিখে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি । আমরা যেটা বুঝি, পরিবর্তনের সাধারণতঃ দুটো দিক —-একটা উত্তরন আর একটা অবক্ষয় । সব দেশের সমস্ত জাতির মধ্যে এটা পরিলক্ষিত । আমাদের দেশের সামাজিক পরিবর্তনের দিকে তাকালে একই কথা প্রযোজ্য । আগের মানুষের জীবন যাত্রার অবস্থান যেটা ছিলো, আজকের দিনে তার অনেক পরিবর্তন । সমাজ জীবন এখন ডিজিটাল যুগের মধ্যে দিয়ে ধাবমান । ক্রমশঃ উন্নয়নের পথে । তবুও অবক্ষয়ের গতিধারা তার নিজস্ব ঢঙে প্রবাহমান ।
অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। ক্ষয়ে যাওয়া যেটাকে আমরা বলতে পারি পতন ঘটে যাওয়া, বিপর্যয় হয়ে যাওয়া । সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, ইত্যাদি গুণাবলী নষ্ট হয়ে যাওয়াটাকেই বলা যেতে পারে সামাজিক অবক্ষয় । অবক্ষয়ের দিকে তাকালে দেখা যায় মানবিক অবক্ষয়, সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার অবক্ষয়, জাতীয় আদর্শের অবক্ষয়, ইত্যাদি ।
(২)
অবক্ষয় ঘটতে পারে অনেকগুলি কারণে । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুশিক্ষার অভাব, মাদকের আসক্তি, বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি, অপসংস্কৃতির অনুকরণ, দুর্নীতি ও অনৈতিকতার অনুশাসন, ইত্যাদি । পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রে অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় । সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত নৈতিকতা ছাড়া আমাদের শান্তি ও মুক্তির পথ দিবাস্বপ্নের ন্যায় । তাই নৈতিক মূল্যবোধ চর্চায় এগিয়ে আসা দেশের সুশীল নাগরিকের আশুকর্তব্য ।
যুব সমাজ দেশের ভবিষ্যৎ । তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক পদচারণা ও কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠাটা নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ । কিন্তু তারা যদি সৎ চারিত্রিক গুণাবলির প্রক্রিয়া নিজেদের মধ্যে না ঘটায় তাহলে তাদের নিজেদের অবনতির সাথে সাথে সমাজ তথা দেশের সার্বিক অগ্রগতিও থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা । এটা পরিস্কার, বাস্তবে কোনো মানুষের যদি নৈতিক মূল্যবোধ না থাকে তাহলে তিনি ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবনে সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা লাভ করতে পারেন না । আমরা জানি, নৈতিক মূল্যবোধ-সম্পন্ন মানুষ সাধারণত উত্তম চরিত্রের হয় । তাই সৎ চরিত্রবান মানুষের প্রভাব পড়ে সমাজে । মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের পতন ঘটে নানাবিধ কারণে । ফলে অবক্ষয়ের শিকার হয় বহু মানুষ । সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশের যুব সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও উচ্ছৃঙ্খলতা অবলোকন করে দেশের মানুষ ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন । তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার কলঙ্কিত স্বাক্ষর পড়ে পরীক্ষা হলে, ট্রেনে-বাসে, পথে-প্রান্তরে, সমাজ জীবনের অলিতে-গলিতে । তা ছাড়া কুরুচি ও নৈতিকতার অবক্ষয়পূর্ণ চলচ্চিত্র প্রদর্শনী যুবসমাজকেও অনেক সময়ে অসৎ পথে পরিচালিত করে ।
(৩)
আমরা ডিজিটাল যুগে এসে সুবিধা যেমন ভোগ করছি তেমনি ছাত্র ছাত্রী তথা যুব সমাজের মধ্যে তার বিরূপ প্রভাব প্রচণ্ডভাবে পড়ছে । এখন ধনী মানুষের ছেলেমেয়েরাই নয় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ছেলেমেয়েরাও প্রায় প্রত্যেকেই মোবাইল ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত । মোবাইলের খুঁটিনাটি তাদের কন্ঠস্থ । বিভিন্ন কুসংস্রবে পড়ে আপত্তিজনক ফটো ছাত্রদের মোবাইলে অহরহ ঘোরে । এমনকি তারা সেই ফটো ধরে রাখার জন্য যেমন পেন-ড্রাইভ ব্যবহার করে তেমনি মেমারি কার্ডে্র মধ্যমে লোড করে রাখে । সেইসব অপ্রীতিকর ফটোগুলি বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে হামেশাই আদান প্রদান চলে । এতে স্বাভাবিকভাবে ছেলেমেয়েগুলির স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে, যার ফলে তাদের পড়াশুনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে । বিশ্বের ইন্টারনেট জগৎ যেভাবে দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষার ক্ষেত্রে গতি বাড়িয়েছে, পাশাপাশি নৈতিকতার ধ্বংস নামিয়েছে সমানভাবে । এটা এক ধরনের নৈতিক অবক্ষয় ।
এবার আসছি, বাবা মায়ের পরেই শিক্ষাগুরু হচ্ছেন, শিক্ষক । এজন্য শিক্ষকদের ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ বলা হয় । শিক্ষকেরা সমাজের কাছে সম্মানিত মানুষ । আগে স্কুল এমনকি কলেজের ছেলেমেয়েরা রাস্তা-ঘাটে শিক্ষকদের দেখলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতো । কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শিক্ষকদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার বালাই নেই, এমনকি শ্রদ্ধেয় মাস্টার মশাইদের সামনে সিগারেট খেতে দ্বিধা নেই । মাস্টার মশাইদের সামনে ছেলেমেয়েরা একে অপরের সাথে অবাঞ্ছিত কথাবার্তায় লাগামছাড়া । এখানেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে আদর্শ শিক্ষার অভাব ।
(৪)
আমরা নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর বিশ্বায়ন, নারীর শিক্ষা নিয়ে যতোই চিৎকার করি না কেন, তাঁরা এখনও বিভিন্নভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অপ্রীতিকর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন । নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন । তা ছাড়া আমরা প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রায় দেখি, বিভিন্ন জায়গায় নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে । কিছু কিছু সমাজবিজ্ঞানী এবং অপরাধবিদ্যা বিশেষজ্ঞ এই অপরাধ প্রবণতা বাড়ার পেছনে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা ভাবছেন । আসলে সত্যিই কী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়ছে ? নাকি দায়িত্বশীল নাগরিকের সচেতনতার অভাব ? তবুও এই পরিস্থিতির বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য আমার মনে হয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসারতা প্রয়োজন । এটাও ঘটনা, মানুষের রুচিবোধ এবং তার প্রয়োগের বিষয়টির উৎকর্ষতা বাড়ে শিক্ষার মাধ্যমে । শিক্ষা মানুষকে মননশীল করে গড়ে তোলে । শিক্ষার আভিধানিক অর্থ যাই হোক না কেন, বাস্তবে নাগরিক সমাজের মানবিক উৎকর্ষ সাধন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার হলো শিক্ষা । সুতরাং শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের মানবিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ঘটাটা, সময়োচিত ।
নৈতিক অবক্ষয় এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে । যেমন রাষ্ট্র এবং সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয়গুলি হচ্ছে প্রশাসনে দুর্নীতি, ঘুষ প্রদান, উৎকোচ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি, যারা সৎ, কর্মঠ এবং নৈতিকতাসম্পন্ন কর্মীদের হেয় করে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা, ইত্যাদি । নৈতিক অবক্ষয়ের উদাহরণের শেষ নেই ।
এই সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষার ব্যাপক প্রসার, আদর্শ শিক্ষার প্রসার, সন্তানের প্রতি পিতামাতার সর্বদা সজাগ দৃষ্টি, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলন আরো দৃঢ় করা, বেকার সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ , দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মহিলাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অপসংস্কৃতির প্রসার রোধ, ঘুষ ও যৌতুক প্রথা বন্ধ, ইন্টারনেট ও মোবাইলের মন্দ ব্যবহারের সুযোগগুলো বন্ধ করা, ইত্যাদি । সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সচেতন নাগরিকদের আরও এগিয়ে আসাটা এখন খুব দরকার । তাই সবটাই প্রশাসনের উপর নির্ভর করলে আখেরে অবক্ষয়ের গতিধারাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে । আমরা সমাজ ও দেশকে ভালবাসি । সুতরাং নিজেদের ও ভবিষ্যত প্রজম্মের স্বার্থে একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী সমাজ ও দেশ গঠনে সম্মিলিত ভাবে আমাদের আত্মনিয়োগ অবশ্যাম্ভাবী ।