Categories
প্রবন্ধ

পানিহাটির চিঁড়া-দধি মহোৎসবের প্রচলনে শ্রীল রামদাস বাবাজী মহাশয়ের অবদান : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

এই বৎসর পানিহাটির প্রসিদ্ধ চিঁড়া-দধি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ২রা জুন। বৈষ্ণব ইতিহাসের পরম ঐতিহ্যবাহী ‘দণ্ডোমহোৎসব’-কে স্মরণ করতে এ উৎসবের প্রচলনে বরানগর পাঠবাড়ির রামদাস বাবাজী মহাশয়ের অবদান অনস্বীকার্য। কি ভাবে ?

আসুন জেনে নেওয়া যাক , সেই মহোৎসবের আকর্ষণীয় ইতিহাস আর সেই ইতিহাস শ্রদ্ধা-স্মরণে রামদাস বাবাজী মহাশয়ের প্রচেষ্টার কথা।

নবদ্বীপ সমাজবাড়ির বড়বাবা তথা শ্রীল রাধারমণচরণ দাসদেব তাঁর প্রিয় শিষ্য বরানগর পাঠবাড়ির রামদাস বাবাজীকে আদেশ দিয়েছিলেন নতুন মঠ-মন্দির স্থাপন নয়, বরং লুপ্ত বৈষ্ণব তীর্থগুলি উদ্ধার করার দিকে বেশী মনোনিবেশ করতে হবে। অর্থাৎ, যে যে স্থানে আমাদের অন্তরের আপনার জন শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ-গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এবং তাঁদের পার্ষদরা লীলা করেছেন সেই সকল মহিমান্বিত স্থানগুলির প্রাচীন ইতিহাসকে লোকমননে স্মরণ করিয়ে দেওয়া , লোকচক্ষুর সম্মুখে আনা তথা কালের গর্ভে লুপ্তিকরণ হতে উদ্ধার করা।

আর , একজন যোগ্য শিষ্যের মতই রামদাস বাবাজী মহারাজ আজীবন সেই আদেশকে শিরোধার্য করে লুপ্ত বৈষ্ণব তীর্থ উদ্ধারে এবং জনমনন থেকে হারিয়ে যাওয়া লীলাগুলির ইতিহাস পুনঃ জাগরণে সদা সচেষ্ট থেকেছেন।

বর্তমান পানিহাটির গঙ্গাপাড়ে দণ্ডমহোৎসব তলায় প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে আমরা যে ‘চিড়াদধি মহোৎসব’ উপলক্ষে প্রায় চার-পাঁচ লক্ষ ভক্তসমাগম দেখি, তার হোতা কিন্তু রামদাস বাবাজী মহারাজ-ই। পরম দয়াল শ্রীনিত্যানন্দের এক ঐতিহাসিক লীলা যা প্রায় পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল(১৫১৭খ্রিষ্টাব্দে) পানিহাটির শ্রীরাঘব ভবনের অদূরে এই গঙ্গাতীরে—সেই লীলার কথা কেবল গ্রন্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু, সেই লীলাকে স্মরণ করে আবারও একবার সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে প্রণত হওয়া, অশ্রুভেজা আঁখিতে ভক্তপ্রাণ হৃদয়ে ভাববিহ্বল হওয়া—-এসবের অগ্রপথিক রামদাস বাবাজী মহারাজ। তিনি বেশ কয়েকজন অনুগত ভক্তজনাদের সাথে করে প্রতি বছর এই তিথিতে উপস্থিত হতেন পানিহাটিতে । তারপর চৈতন্য ভাগবত ,চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ থেকে পয়ার গেয়ে , তাতে আখর দিয়ে কীর্তন করে লীলা স্মরণ করতেন আর অশ্রুবন্যার প্লাবন আনতেন দণ্ডোমহোৎসব তলায় সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত সুপ্রাচীন বটবৃক্ষমূলে। প্রায় একশো বছর পূর্বে বাবাজী মহারাজ এমন সেবা শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে প্রতি বৎসর পালিত হওয়া সেই প্রথা আজকের সুবৃহৎ চিঁড়াদধি মেলার রূপ নেয়। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে বিগত দু’বছর ভক্তসমাগম বন্ধ ছিল । তবে, শ্রীপাঠবাড়ি আশ্রম থেকে প্রাণের আয়োজন অব্যাহত ছিল । বাবাজী মহারাজ চিত্রপটে গমন করেছেন সেস্থানে আর তাঁদের সংকীর্তনের ধারাও অক্ষুণ্ন ছিল । এবছর ভক্তদের আনন্দের অবধি নেই। করোনা যদিও পুরোপুরি যায়নি , কখন আবার রক্তচক্ষু নিয়ে দৃষ্টি দেবে ঠিক নেই , তবু প্রকোপ যখন কম , তখন উৎসবে ভক্তির আনন্দের অংশীদার তো হতেই হয় !

আসুন এবার দণ্ডমহোৎসবের ইতিহাস কী জানা যাক।

দণ্ড অর্থাৎ শাস্তি। শাস্তি যখন মহৎ কারণে হয় ,মহা লাভ ঘটায় ,তখন তাতে মহোৎসব করাই যায় ,এটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ,কেন শাস্তি ?

১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দে যখন পুরীধাম থেকে সন্ন্যাসী মহাপ্রভু গৌড়ে আসেন ,তখন পানিহাটির এই ঘাটে নেমে রাঘব পণ্ডিতের ভবনে ওঠেন। আবার ১৫১৭খ্রীষ্টাব্দে মহাপ্রভুর নির্দেশে নিত্যানন্দ যখন পুরীধাম থেকে বঙ্গে চলে আসেন , তখন তিনিও এই রাঘব পণ্ডিতের কাছেই ওঠেন তাঁর সকল পার্ষদদের নিয়ে। আর ,মূলতঃ নিত্যানন্দের এই আসাতেই পানিহাটির মহোৎসবের ইতিহাস লুকিয়ে আছে।
হুগলী জেলার সেসময় সমৃদ্ধপূর্ণ গ্রাম সপ্তগ্রাম। এখানকার জমিদার হিরণ্য দাস আর গোবর্দ্ধন দাস–দুই ভাই। তাঁদের একমাত্র উত্তরাধিকারী হলেন রঘুনাথ দাস। রঘুনাথের হৃদয়ে ছিল তীব্র গৌরপ্রীতি । তাঁর মন সংসারে নেই। সংসার ত্যাগ করে শ্রীক্ষেত্রে গৌরাঙ্গের কাছে চলে যাবেন বলে , তিনি কতবার কত প্রচেষ্টা করেছেন।‌কিন্তু ,বাবা-জ্যাঠার প্রখর নজরদারিতে প্রতিবারই অসফল হয়েছেন। একদিন শুনলেন গৌরাঙ্গের একান্ত নিজজন নিত্যানন্দ আসছেন পানিহাটিতে। অনেক অনুনয় বিনয় করে বাবা-জ্যাঠাকে রাজী করিয়ে দর্শন করতে এলেন নিত্যানন্দকে।
নিত্যানন্দ গঙ্গাতীরে বটগাছের তলায় পিণ্ডার ওপর বসে আছেন। চারপাশে তাঁকে ঘিরে প্রায় হাজার ভক্ত দাঁড়িয়ে ,বসে। নিত্যানন্দের প্রতিপত্তি দেখে রঘুনাথ বিস্মিত। তিনি দণ্ডবৎ প্রণাম জানালেন।জমিদার পুত্রকে দেখিয়ে একজন পরিচয় দিলেন নিত্যানন্দের কাছে। নিত্যানন্দ বললেন, ” আয় ,আয় ,চোরা। এদিকে আয় । ওহ্,তুমি আমায় না বলে গৌরকে পেতে চেয়েছিলে ! তুমি জানো না ,আমি না দিলে গৌরকে পাওয়া যায় না ! গৌরাঙ্গ আমার সম্পদ। না জানিয়ে সম্পদ নিলে চুরি করা হয়। তুমি চুরি করতে চেয়েছ।তাই, তোমায় আজ দণ্ড দেব।” রঘুনাথ বললেন, ” দণ্ড পেয়ে যদি গৌরচরণ পাওয়া যায় ,তবে তাতেই আমি রাজি। দণ্ড দিয়ে আমায় গৌরাঙ্গকে দিন। বলুন ,কী শাস্তি আমার । আমি মাথা পেতে নেব, যে কোন প্রকার শাস্তি।” নিত্যানন্দ বললেন,”এখানে মহোৎসব হবে ।সকলকে চিড়ে, দই , ফল আহার করাবে তুমি। সকল খরচ তোমায় বহন করতে হবে মহোৎসবের।” মহাখুশি রঘুনাথ আয়োজন করলেন সবকিছুর।
সেই মহোৎসবে জাতপাতের সকল বিভেদ ভুলে একসাথে ছত্রিশ জাতির প্রায় হাজারজন মানুষ বসে প্রসাদ পেলেন,যা আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে এক অসম্ভব, অভাবনীয় ,অবাস্তব ব্যাপার ছিল । নিত্যানন্দের মানবমুখী , সাম্যবাদী নীতির এ এক দারুণ দৃষ্টান্ত। সারাদিন মহাসংকীর্তন ধ্বনিতে আকাশে বাতাসে মহামিলনের মহাকল্লোল উঠল। জাতিদ্বন্ধ ভুলে মানুষ আবেগের অশ্রুতে ভেসে একে অপরকে কোলাকুলি করলেন । চারিদিকে সৌভ্রাতৃত্বের সৌরভ। পদকর্তা বিস্মিত হয়ে তাইতো লিখলেন –“ব্রাক্ষ্মণে চণ্ডালে করে কোলাকুলি ,কবে বা ছিল এ রঙ্গ।”
নিত্যানন্দ অনেক কৃপা করলেন রঘুনাথকে। তিনি তাঁকে কাছে ডেকে তাঁর মাথায় নিজের চরণ স্পর্শ করিয়ে বললেন, “আজ তুমি যে পুলিন ভোজন করালে তাতে চৈতন্য মহাপ্রভু বড় প্রীত হয়েছেন তোমার প্রতি। তোমায় কৃপা করতেই তাঁর আগমন হয়েছিল এখানে। তিনি কৃপা করে চিঁড়া-দধি ভোজন করেছেন। কীর্তনে নৃত্য দর্শন করে রাত্রে প্রসাদ ভক্ষণও করেছেন। নিজে এসে তোমায় উদ্ধার করে গেছেন গৌরহরি। তোমার যত বিঘ্ন সবের বিনাশ হয়ে গেছে। তোমায় তিনি অন্তরঙ্গ ভক্ত করে নিজের কাছে রাখবেন। স্বরূপ দামোদরের কাছে তোমায় সমর্পণ করবেন। নিশ্চিন্তে থেকো, তুমি খুব শীঘ্রই তাঁর চরণ পাবে।”

এরপরই রঘুনাথের সংসারের বন্ধন মোচন হয়। তিনি শ্রীক্ষেত্রে মহাপ্রভুর কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন। মহাপ্রভু রঘুনাথকে কাছে টেনে নিলেন‌।
এই ঘটনা এই সত্যই প্রতিস্থাপিত করে যে ,গৌরাঙ্গের কৃপা নিতাইমূলা। অর্থাৎ, নিত্যানন্দ কৃপা না করলে মহাপ্রভু কৃপা করেন না। তাই সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিতাই কৃপা পাবার জন্য ,নিজেদের সকল অপরাধের মোচন করার জন্য ভক্তরা আজও চিঁড়ে-দই নিবেদন করেন নিতাই-নিমাই-এর কাছে। আজও এই তিথিতে সেখানে সপার্ষদ নিতাই-নিমাই প্রকট হন সেদিনের মত করে।
এই তিথিতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডমহোৎসব তলায় শুরু হয়ে যায় কমপক্ষে একশোটি ছাউনিতে কীর্তন । বরানগর পাঠবাড়ি আশ্রম, ভারত সেবা সঙ্ঘ, গৌড়ীয় মঠ, ইসকন,ভবা পাগলা সম্প্রদায় ,সদগুরু সম্প্রদায় ইত্যাদি নানা সংগঠন তাদের নিজের নিজের সুন্দর করে সাজানো আশ্রমমন্দির ছাউনিতে কীর্তন ,ভোগরাগ সম্পন্ন করেন। আর ,এদিনের ভোগে অবধারিত ভাবে যা নিবেদিত হয় তা হল চিড়ে,দই , মিষ্টি আর ফল। অন্নের সাথে অন্যান্য সুস্বাদু ব্যজ্ঞন কিন্তু নিবেদিত হয় না।

বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া যে দুই ভাই নিতাই-নিমাই বিরাজ করছেন , তাঁদেরকে অন্তরের আঙিনায় আবার একবার প্রেমাভিষেক করাবার জন্য এই বিশেষ দিনে ভক্তদের যাবতীয় প্রচেষ্টা তাই দেখা যায়।

অন্তর ভরে প্রণাম জানাই সপার্ষদ নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে। প্রণাম জানাই রামদাস বাবাজী মহারাজকে। আপনাদের কৃপায় এ অধমার সকল অপরাধের মোচন হোক । ভক্তসেবায় যেন এ জীবন উৎসর্গ করতে পারি—এ প্রার্থনা জানালাম।

——-সেবা অভিলাষিণী
ভক্তকৃপা প্রার্থিনী
জীবাধমা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক‌।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *