Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

গোদাবরী তটে শ্রীমন্ মহাপ্রভু রায় রামানন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন, “দুঃখ মধ্যে কোন্ দুঃখ হয় গুরুতর ?’ রায় রামানন্দ তদুত্তরে বলেছিলেন— “কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর।।” নিরন্তর ভক্তসঙ্গে ভজনের যে পরিপাটী লাভ করা যায় তা যে কোন একজন সাধকের ঈপ্সিত লক্ষ্য। একজন পথচারী যখন দুর্গম বনপথ দিয়ে একা গমন না করে অনেকের সঙ্গে আলাপচারিতা, কথোপকথন বা হাস্য পরিহাসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন, তখন তাঁর দস্যুভয় বা হিংস্র পশু আক্রমণের বিপদের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায়। তেমনই, সাধক যদি নিত্য উপযুক্ত ভক্তসঙ্গ করেন তখন সংসারের দস্যুতুল্য, পশুতুল্য কামনা-বাসনা, বিষয়-বাসনা বা কোন প্রকার ভজন অহংকার তাঁর মনে অযথা উপদ্রব হয়ে তাঁকে সাধন-পথভ্রষ্ট করতে পারে না। তাইতো শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় বলেছেন— “করহ ভকত সঙ্গ, প্রেমকথা রসরঙ্গ, তবে হয় বিপদ বিনাশ।” ভক্তসঙ্গ করার দরুণ ভক্তে-ভক্তে হয় বন্ধুত্ব। এ বন্ধুত্ব আমাদের প্রাকৃত জগতের বন্ধুত্ব নয়। দিব্য অপ্রাকৃত বন্ধুত্ব হল তা। প্রাকৃত বন্ধুত্ব নশ্বর, ক্ষণিক। তা স্বার্থ সম্বন্ধের সুক্ষ্ম আবেশ মিশ্রিত হলেও হতে পারে। কিন্তু দুই ভক্তের ভিতর ভক্তিকে কেন্দ্র করে যে বন্ধুত্ব, তা নিত্য, সত্য, স্বার্থগন্ধহীন। কারণ, এই বন্ধুত্বে কৃষ্ণেতর বস্তুতে কোন কৌতূহল থাকে না। এই বন্ধুত্বের একমাত্র লক্ষ্য পরস্পরের নিকট হতে কৃষ্ণপ্রেমরস আস্বাদন, নিরন্তর একে অপরের সঙ্গে কৃষ্ণকথা আলাপন ও একত্রে নাম-সংকীৰ্ত্তন রূপ আনন্দ সমুদ্রে অবগাহন। কৃষ্ণ মাধুর্য আস্বাদনের লোভে এক ভক্ত যখন অপর ভক্তের সঙ্গ-সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে, তখন অচিরেই অমলিন, নিষ্পাপ, অপ্রাকৃত বন্ধুত্বের রূপ পায় তাদের উভয়ের অন্তরের টান। এরূপ বন্ধুত্ব সাধনের পরিপুষ্টি আনে। আর তাই সাধক এমন বন্ধুত্ব সঙ্গ প্রত্যাশা করে। তাই তো রামানন্দ রায় যখন মহাপ্রভুকে দশদিন গোদাবরী তীরে বাস করে তাঁকে সঙ্গ দিতে অনুরোধ করেন, তখন মহাপ্রভু বলেন— “দশদিনের কা কথা যাবৎ আমি জীব। তাবৎ তোমার সঙ্গ ছাড়িতে নারিব।। নীলাচলে তুমি আমি থাকিব এক সঙ্গে। সুখে গোঙাইৰ কাল কৃষ্ণকথা রঙ্গে।।” (চৈ. চ. / মধ্য/ ৮ম পরিঃ)।

কৃষ্ণকথা তো এ জগতে শুদ্ধকথা সার। সে অমৃত যতই পান করা যায় ততই তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায় আরও পানের। অদ্ভূত, অলৌকিক, অবিশ্বাস্য প্রভাব কৃষ্ণকথামৃতের। ভক্তমনকে জড়ীয় প্রপঞ্চের ভাবনা থেকে অপসারিত করে আনন্দলোকের মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত করে। পার্থিব লোক হতে হৃদয়কে উৎপাটিত করে কৃষ্ণলোকে রোপণ করে, যেখানে মাধুর্য্য-লাবণ্য বলতে যা , সব কিছুই কৃষ্ণকেন্দ্রিক। আর যা কৃষ্ণকেন্দ্রিক তা মায়াগন্ধহীন, কামকলুষমুক্ত। “কৃষ্ণ সূৰ্য্য সম মায়া হয় অন্ধকার। যাঁহা কৃষ্ণ তাঁহা নাহি মায়া অধিকার।। (চৈ. চ./মধ্য/২২পরিঃ)। তা সদানন্দময়, চিদানন্দময়। কৃষ্ণকথা শুরু হলে তা ভক্তমনকে এমন বিবশ করে যে, “সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়” –তাও ভক্ত টের পায় না। এ কথার আবেশে ভক্ত কখনো হাসে কখনো কাঁদে, কখনো গায় আবার কখনো আনন্দের আতিশয্যে নৃত্যও করে ফেলে। ঠিক যেমন মহাপ্রভু আর রামানন্দ রায় টের পান নি। “এইমত দুইজনে কৃষ্ণকথা রসে। নৃত্য-গীত-রোদন হৈল রাত্রি শেষে।।” (চৈ .চ/মধ্য/৮ম পরিঃ)। তাইতো, এমন দিব্য আনন্দদানকারী বন্ধুত্বে যখন বিচ্ছেদ আসে তখন ভক্তের কাছে তা এক অপূরণীয় বিরাট ক্ষতি।
যখন ঠাকুর হরিদাস মহাপ্রভুকে জানান যে, তিনি এবার মৃত্যুবরণ করতে চান, যাতে মহাপ্রভুর অপ্রকটলীলার বেদনা তাঁকে সহ্য করতে না হয়। তখন মহাপ্রভু বলেন তিনিও ঠাকুর হরিদাসের মতো ভক্তসঙ্গের বিরহ বহন করতে কষ্ট পাবেন। “কিন্তু আমার যা কিছু সুখ সব তোমা লঞা। তোমা যোগ্য নহে, যাবে আমারে ছাড়িয়া।।” (চৈ. চ./ অন্ত্য/১২ পরিঃ)। কৃষ্ণভক্ত-বন্ধুর বিরহবেদনার জ্বালার উপশম হয় না সহজে। সেই দুঃখানুভূতির কোন তুলনা হয় না কোন কিছুর সাথে। সে অভাবের কোন পূরণ হয় না। এমনটা তো হয়েছিল শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর ক্ষেত্রেও। তাঁর এবং শ্রীল রূপগোস্বামীর ভিতর ছিল এমনই অপ্রাকৃত কৃষ্ণপ্রেমময় বন্ধুত্ব। মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর যখন তিনি বৃন্দাবনে এসেছিলেন তখন তাঁর মনে মনে সংকল্প ছিল যে, বৃন্দাবনের লীলাস্থলী দর্শন করার পর গিরিরাজ গোবর্দ্ধন হতে ভৃগুপাতে জীবন বিসর্জন দেবেন। কারণ, তাছাড়া অন্য কোন উপায়ে মহাপ্রভুর কৃপা সঙ্গহীনতার মনোবেদনা নাশের পথ ছিল না তাঁর। কিন্তু ব্রজেতে আগমন করে যখন তিনি শ্রীরূপ-সনাতনের সান্নিধ্যে শ্রীব্রজধাম, গিরিরাজ শ্রীগোবর্ধন এবং শ্রীরাধাকুণ্ড দর্শন করলেন তখন তাঁর অন্তরের গৌরসুন্দর-বিরহের কিছুটা লাঘব হয়েছিল, উপশম হয়েছিল। তিনি শ্রীরাধাকুণ্ডের আশ্রয়তটে ভজনে নিমগ্ন হয়েছিলেন। শান্তি পেয়েছিলেন। অথচ, এই ব্রজধাম, এই গেবর্দ্ধন ,এই রাধাকুণ্ডই তাঁর কাছে ভয়াশ্রয়া, ভয়াল, অসহ্য মনে হয়েছিল শ্রীরূপ গোস্বামীর অপ্রকট হবার পর। তাঁর বিরহবেদনায় তিনি লিখেছিলেন—“শূন্যায়তে মহাগোষ্ঠং গিরীন্দ্রোহজগরায়তে। ব্যাঘ্রতুণ্ডায়তে কুণ্ডং জীবাতু রহিতস্য মে।।” অর্থাৎ, শ্রীরূপ গোস্বামীপাদের বিরহে জীবন ধারণের উপায় স্বরূপ এই মহাগোষ্ঠভূমি আমার নিকট শূণ্য-শূণ্য প্রতিভাত হচ্ছে। শ্রীগোবর্দ্ধন যেন অজগরের ন্যায়। শ্রীরাধাকুণ্ড যেন ব্যাঘ্রের ন্যায় মুখব্যাদান করে বসে আছে, মনে হচ্ছে। মহাবিরহে চরম বিচ্ছেদে মর্মাহত হয়ে, অধীর হয়ে খেদ করে বলেছেন- “গৌরাঙ্গচন্দ্রমিহ রূপযুগং ন পশ্যান হা বেদনাঃ কহি সহে স্ফুটরে ললাটে।”—হায়! শ্রীগৌরাঙ্গচন্দ্র ও শ্রীরূপ-সনাতনকে না দেখে আর কত বিরহ সহ্য করবো ! ওরে ললাট, তুই শতধা বিদীর্ণ হয়ে যা!

ঠিক এমনই বন্ধুপ্রীতি ছিল ঠাকুর নরোত্তম এবং শ্রীনিবাস আচার্য্য ঠাকুরের শিষ্য শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের ভিতর। রামচন্দ্র কবিরাজ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীচিরঞ্জীব সেনের পুত্র। পদকর্তা শ্রীগোবিন্দ কবিরাজের জ্যেষ্ঠ সহোদরও। তিনি মহাপণ্ডিত মহাকবি ছিলেন। আর মহাভক্ত তো বটেই। তাঁর সঙ্গে ঠাকুর মহাশয়ের বন্ধুপ্রীতি সম্পর্কে ‘ভক্তিরত্নাকরে’ ঠাকুর নরহরি চক্রবর্তী লিখেছেন— “রামচন্দ্র নরোত্তম দোঁহার যে রীত। আগে জানাইব এথা কহি সে কিঞ্চিৎ।। তনু মন প্রাণ নাম একই দোঁহার। কবিরাজ নরোত্তম নাম-এ প্রচার।। নরোত্তম কবিরাজ কহে সৰ্ব্বজন। কথাদ্বয় মাত্র যৈছে নর-নারায়ণ।। রামচন্দ্র নরোত্তম বিদিত জগতে। হৈল যুগল নাম সবে সুখ দিতে।।”
নরোত্তম-কবিরাজের তনু-মন-প্রাণ অভিন্নতার একটি চিত্তহারী লীলা আছে। রামচন্দ্র কবিরাজ তখন খেতুরীতে ঠাকুর মহাশয়ের সান্নিধ্যে অবস্থনারত। তাঁর পত্নী রত্নমালাদেবী রামচন্দ্রকে একাধিকবার পত্রমারফত অনুরোধ করেন যে একটি বার অন্ততঃ দর্শনদান করে ধন্য করেন তিনি রত্নমালাদেবীকে। কিন্তু সংসারত্যাগী রামচন্দ্র কবিরাজের মন একটিবারের জন্যও সে অনুরোধে উচাটন হয়নি। তিনি নরোত্তম সঙ্গ ছাড়তে নারাজ। পরিশেষে রত্নমালাদেবী পত্র মারফত অনুরোধ করলেন ঠাকুর মহাশয়কে যাতে তিনি অন্ততঃ একটি বারের জন্য রামচন্দ্র কবিরাজকে গৃহে প্রেরণ করেন বুঝিয়ে। নরোত্তম ঠাকুর কবিরাজ মহাশয়কে বললেন—তিনি যেন সে দিনই দুপুরে প্রসাদ পেয়ে কুমারনগরে নিজের গৃহে যান আর পরদিন প্রভাতে ফিরে আসেন। বললেন , “আমার শপথ ইহা না করিহ অন্যথা। না করিলে, মনে আমি পাব বড় ব্যথা।।’ (গৌরভক্তামৃতলহরী-৮ম খণ্ড, শ্রীকিশোরী দাস বাবাজী)
রামন্দ্র কবিরাজ বেজায় দুর্বিপাকে পড়লেন। বন্ধু নরোত্তমের শপথ অন্যথা করতে পারবেন না আবার সংসারের মোহভরা ঘেরাটোপে এক মুহুর্তের জন্যও যেতে চান না নরোত্তম সঙ্গ ছেড়ে। চিত্ত বড় ব্যাকুল হল। শেষে, “কান্দিতে কান্দিতে প্রেমে করয়ে গমন। খেতুরি পানে একদৃষ্টে করি নিরীক্ষণ।।” (ঐ)। পত্নী সম্ভাষণে গেলেন কবিরাজ মহাশয় বান্ধবের শপথ রক্ষা করতে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে কুমারগ্রাম ত্যাগ করে যখন খেতুরীতে প্রত্যাগমন করলেন তখন প্রভাত। পূজারী আরতি করছেন শ্রীমন্দিরে। তিনি একাধারে রাখা মার্জনী (ঝাড়ু)টি তুলে নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গন মার্জন করতে লাগলেন। কবিরাজ মহাশয় আড় চোক্ষে ঠাকুর মহাশয়কে দর্শন করে… নিজেকেই নিজে তিরস্কার করে বলতে লাগলেন, ‘হায়। আমি কী অধম চিত্তের অধিকারী। এখানকার এমন দিব্য সুখ আমার ভালো লাগলো না। আমি বহু সময় হেলায় নষ্ট করে এলাম কাল। ধিক্ আমায় ধিক্‌।’—এই প্রলাপ করেই তিনি নিজের পৃষ্ঠে নিজেই মার্জনী দ্বারা প্রহার করতে লাগলেন। অবিলম্বে নরোত্তম ঠাকুর তাঁকে বিরত করতে তাঁর হস্ত ধরে ফেললেন। বললেন, ‘আহা। করো কী, করো কী রামচন্দ্র! আমার যে বড় ব্যথা লাগলো। আর এমন কর্ম কোরো না। দেখতো কী করলে আমার অবস্থা।”—এই বলে নিজের পৃষ্ঠখানি রামচন্দ্রের সম্মুখে ধরলেন। আর রামচন্দ্র কবিরাজ দেখলেন তাঁর বান্ধব নরোত্তমের পৃষ্ঠ ফুলে গিয়েছে প্রহারে। নিজের পৃষ্ঠের প্রতিটি আঘাত নরোত্তম ঠাকুরের পৃষ্ঠে পড়েছে। সকল বেদনা তাঁর বান্ধব নিজের শরীরে ধারণ করেছেন। তখন উভয়ের ক্রন্দন আর থামে না। এমন বন্ধুপ্রীতি যে ইহজগতের ঘটনা নয়। ভাবের আবেশে ভাববিহ্বল তনু-মন-প্রাণ একাত্ম হয়ে ভূমিতে গড়াগড়ি করে বিস্তর ক্রন্দন করলেন। “দোঁহে গলাগলি কান্দে ভূমি গড়ি যায়। দুইজনে হেন প্রীতি জানে গোরারায়।।” (ঐ)।
{ ‘শ্রীগুরুকৃপার দান’ গ্রন্থে, শ্রীপাদ রামদাস বাবাজী মহাশয়ের শ্রীমুখ নিঃসৃত ‘শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের সূচক কীৰ্ত্তনে বলা হয়েছে— “শ্রীআচার্য্য প্রিয়তম নরোত্তম প্রাণ যেন / রামচন্দ্র কবিরাজ সেই। … গুরুবাক্যে নিষ্ঠা তাঁর (রামচন্দ্র-র) ত্রিভুবনে পরচার/ এই বাক্য হয় সুপ্রমাণ…. যদি গুরুপদে হয় রতি তুলনা নাহিক কতি/ শুনহ সে অপূৰ্ব্ব কথন/ একদিন শ্রীআচার্য্য /আদেশিলেন রামচন্দ্রে/ রামচন্দ্র একবার যাও/সম্ভাষণ করে এস/বিবাহিতা পত্নীসনে সম্ভাষণ করে এস./…… অপূর্ব রহস্য কথা…../ সারা নিশি করলেন আলাপন …. শ্রীগুরু-গৌর লীলা প্রসঙ্গ সারা নিশি করলেন আলাপন… নিশি পরভাত হল…. শ্রীগুরুসেবার সময় হয়েছে। চলিলেন ত্বরা করে……/ শ্রীযাজিগ্রামের পথে এসে মনে হল/ প্রভু আজ্ঞা করেছিলেন…./পুনঃরায় ফিরে গেলেন/সম্ভাষণ করলেন/রামচন্দ্রের পুরুষ অভিমান নাই / সেই স্বভাবে রামচন্দ্র করিলেন আলিঙ্গন/লাগিল রামচন্দ্র ললাটে/প্রিয়ার সিঁথির সিন্দুর লাগিল রামচন্দ্র ললাটে/ উপনীত যাজিগ্রামে/তখন নরোত্তম করছিলেন আঙ্গিনা মার্জ্জন/জিজ্ঞাসেন রামচন্দ্রে/ কোথা গিয়েছিলে বা এখন বা যাও কোথা / পত্নী সম্ভাষণে গিয়েছিলাম/ এখন যাই শ্রীগুরুসেবায় /(তখন) নরোত্তম আঘাত করলেন রোষভরে/রামচন্দ্রের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করলেন রোষভরে/ সম্মার্জ্জনী লয়ে করে আঘাত করলে রোষভরে/…. আবার মধ্যাহ্নে নরোত্তমের সেবা/ করিতেছিলেন তৈল মৰ্দ্দন/শ্রীনিবাস আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে করিতেছিলেন তৈল মৰ্দ্দন/অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/আচার্য্যের পৃষ্ঠ-দেশে মার্জ্জনীর আঘাত অকস্মাৎ দেখতে পেলেন/মনে মনে ভাবলেন /কার অঙ্গে আঘাত করেছি/ এ তো নয় রামচন্দ্রের দেহ/নরোত্তম ব্যাকুল হলেন/অপরাধ স্খালন লাগি/ নরোত্তম করলেন মনে/এ হাত পোড়াব আগুনে নরোত্তম করলেন মনে … সে ভাব বুঝে আচার্য্য বলেন মনে মনে……এ দেশে বিচার নাই বাপ রে বাপ। দিনে মারে ঝাঁটার বাড়ী রাত্রে পোড়ায় হাত।।/কি সুমধুর লীলা রে/বালাই লয়ে মরে যাই/শ্রীগুরুসেবার আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র/ শ্রীগুরুপদে আত্ম-সমর্পণের আদর্শ শ্রীরামচন্দ্র/বিকালে তাঁর পদতলে সর্ব্বোত্তমা গতি মিলে……}

এমনই হরিহর আত্মা ছিলেন নরোত্তম-কবিরাজ। যখন শ্রীনিবাস আচার্য্য শিষ্য রামচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনে গমন করলেন তখন ঠাকুর নরোত্তমের বিপ্রলম্ভ ভাব অর্থাৎ বিরহ ভাব আর চক্ষে দেখা যেত না। তিনি তাঁর প্রেমস্থলী নামক ভজন স্থানে ভূমিতে পড়ে অহর্নিশি বুকফাটা রোদন করতেন। বিশ্বে তাঁর মতো বন্ধুবিরহীকে সান্ত্বনাদানের কোন বস্তু বা ভাষা ছিল না। সব শূণ্য তাঁর কাছে তখন। বিরহালনে দগ্ধ হৃদয় হয়ে কী মর্মবিদরী পয়ার লিখলেন—’রামচন্দ্র কবিরাজ সেই সঙ্গে মোর কাজ /তাঁর সঙ্গ বিনা সব শূণ্য। যদি হয় জন্ম পুনঃ তাঁর সঙ্গ হয় যেন /তবে হয় নরোত্তম ধন্য।। (প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা-১১৮)। এখানে ‘সেই সঙ্গে মোর কাজ’ বলতে রামচন্দ্র কবিরাজের মতো ভক্তবন্ধুর সঙ্গপ্রসঙ্গে তিনি যে ভগবৎমাধুরী ও কৃষ্ণপ্রেমরস আস্বাদন করতেন তার কথা বলেছেন। আবার নিজের প্রেমভক্তির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে, ভক্তির অতৃপ্তি স্বভাববশতঃ যারপরনাই দৈন্য ভরে ভেবেছেন হয়তো তাঁকে আবার জন্ম নিতে হবে। আর তখন যদি রামচন্দ্র কবিরাজের মতো ভক্তের সঙ্গ পান তখনই তাঁর জীবন ধন্য হবে। তাঁর পুনঃ প্রার্থনাতেও তাঁকে লিখতে দেখা যায় “রামচন্দ্র সঙ্গ মাগে নরোত্তম দাস।” এ হেন অন্তরে সুহৃদ, পরমপ্রেমিক রামচন্দ্র। কবিরাজের মতো বান্ধব-বিরহে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর তাই লিখেছেন—— “তাঁর সঙ্গ বিনা সব শূণ্য ।’ তাইতো —- “কৃষ্ণ-ভক্ত বিরহ বিনা দুঃখ নাহি আর” ।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *