Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

১০২৭ বছরের মল্ল রাজ কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো, রাজবাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় মল্লরাজাদের প্রাচীণ ইতিহাসের পদধ্বনি।

মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু গর্জে উঠল কামান। ৯ টি তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হল ১০২৭ বছরের মল্ল রাজ কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো।  মল্ল রাজারা আর নেই, নেই রাজ্যপাঠ। ভাঙ্গাচোরা রাজবাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় মল্লরাজাদের প্রাচীণ ইতিহাসের পদধ্বনি। প্রাচীন রীতি ও ঐতিহ্য মেনে  বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের দুর্গোৎসবের সূচনা হয়ে গেল। প্রাচীণ রীতি মেনে এদিন থেক শুরু হয়ে টানা ১৭ দিন চলবে পুজো।

‘পট পুজো’ই এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকতা মেনে আজও ফি বছর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোটো ঠাকুরাণীর আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন। মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয়।

 

 

প্রাচীণ প্রথানুযায়ী, দেবী পক্ষের চতুর্থীর দিন থেকে রাজপরিবারের মেজ ঠাকরুন অর্থাৎ দেবী মহালক্ষী ও সপ্তমীর দিন থেকে ছোটো ঠাকরণী অর্থাৎ দেবী মহাসরস্বতীর পুজো শুরু হয়। বড়, মেজো ও ছোটো ঠাকরুণী এই তিনজনকেই দেবী মহামায়ার রুপ হিসেবে মল্লরাজাদের হস্ত লিখিত বলীনারায়নী পুথি অনুযায়ী পূজিতা হন।

নয় নয় করে এই রীতির বয়স ১০২৭ বছর। সেই প্রাচীন রীতি মেনেই আজ মূর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু গর্জে উঠল কামান। বিষ্ণুপুরে শুরু হল মল্ল রাজ কূল দেবী মৃন্ময়ীর পুজো।

 

 

একসময় মল্ল রাজত্বের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদ্যুম্নপুরে। ৯৯৭ খৃষ্টাব্দে মল্ল রাজ জগৎমল্ল শিকারের সন্ধানে ঘন জঙ্গলে ঘুরুতে ঘুরতে একসময় এসে হাজির হন আজকের বিষ্ণুপুরে। কথিত আছে সেখানে ক্লান্ত হয়ে রাজা একটি বট গাছের নীচে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসে পড়লে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন অলৌকিক কান্ড কারখানা ঘটতে থাকে। জনশ্রুতি সে সময় দেবী মৃন্ময়ী প্রকট হয়ে জগৎমল্লকে বিষ্ণুপুরে মৃন্ময়ীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পুজোর নির্দেশ দেন। পাশাপাশি রাজধানী বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করে রাজত্ব শাসনের নির্দেশ দেন।

 

 

কথিত আছে এরপরই মল্ল রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পাশাপাশি রাজ প্রাসাদ লাগোয়া বিশাল মৃন্ময়ী মন্দির তৈরি করে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। কথিত আছে এরপর থেকেই মল্ল রাজারা সবদিক থেকে সমকালীন অন্যান্য রাজাদের তুলনায় এগিয়ে যেতে শুরু করে। বৈভব আর আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগে মৃন্ময়ীর পুজোতেও। রাজার পুজো। তাই তার আচার, সংস্কার ও পুজো পদ্ধতি আলাদা। পুজোর পনেরো দিন আগে জীতাষ্টমীর পরের দিন নবমী তিথিতে শুরু হয় দেবীর পুজো।

 

 

এদিন স্থানীয় একটি পুকুরে পুজো অর্চনা করে মৃন্ময়ীর মন্দিরে নিয়ে আসা হয় বড় ঠাকরুণ নামের একটি পটকে। বড় ঠাকরুণ আসলে মহাকালী। এই পট পুজো অর্চনা করে মন্দিরে আনার প্রতিটি নির্ঘন্ট ঘোষণা করা হয় তোপধ্বনীর মধ্য দিয়ে। এদিন থেকেই কার্যত শুরু হয়ে যায় মল্ল রাজ পরিবারের কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো। কালের নিয়মে মল্ল রাজত্ব ও রাজারা হারিয়ে গেলেও অতীতের সেই নিয়ম নিষ্ঠা আজো অটুট মৃন্ময়ীর পুজোয়। প্রাচীন নিয়ম মেনে এদিন সকালে রাজ পরিবারের সদস্যরা রাজ পুরোহিত সহ গেলেন স্থানীয় পুকুর ঘাটে।

 

 

পবিত্র মন্ত্র উচ্চারনের মধ্য দিয়ে বড় ঠাকরুনের পট পুজো করে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হল মৃন্ময়ীর মন্দিরে। স্থানীয় মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু গর্জে উঠল কামান। কামানের বজ্র নির্ঘোষ শব্দে মল্ল রাজত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আগমনীর আগমন বার্তা।

সারা বছরের পাশাপাশি পুজোর এই দিন গুলিতে মন্দির নগরীতে বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের ঢল নামে। প্রাচীন ঐতিহ্য আর পরম্পরার সাক্ষী থাকতে আজও জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ভীড় করেন।

 

।।কলমে : আবদুল হাই, বাঁকুড়া।।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *