ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের অব্যর্থ পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে সরোজিনী নায়ডু প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু শহীদ ভগৎ সিং-এর মতই নয় বরং শক্তিশালী নারীদের দ্বারা প্রশস্ত হয়েছিল যারা তাদের মাটিতে দাঁড়িয়েছিল এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করেছিল। সরোজিনী নায়ডু ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিকন্যা ছিলেন তিনি।
সরোজিনী নায়ডুর জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরের একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি বরদাসুন্দরী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা।
সরোজিনী নাইডু ছিলেন স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি। তিনি ভারত কোকিলা (দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া) নামে পরিচিত। সরোজিনী নাইডু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম (ভারতীয়) মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীন ভারতে তিনি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজ্যপালও হয়েছিলেন।
সরোজিনী নাইডু ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি যোগ দেন ডান্ডি পদযাত্রায়। গান্ধী, আব্বাস তয়েব ও কস্তুরবা গান্ধী গ্রেফতার হলে তিনি ধারাসন সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাগ্মী এবং ইংরেজি ভাষার যশস্বী কবি। তাঁর রচিত গ্রন্থ গুলি —-
The Golden Threshold (১৯০৫), The Bird of Time: Songs of Life, Death & the Spring (১৯১২), The Broken Wing: Songs of Love, Death and the Spring (১৯১৭), The Sceptred Flute: Songs of India (১৯৪৩), The Feather of the Dawn (১৯৬১), The Gift of India।
১৯০৫ সালে, সরোজিনী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯০৩ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে, তিনি গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, অ্যানি বেসান্ট, সিপি রামস্বামী আইয়ার, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু ইত্যাদির সংস্পর্শে আসেন।
১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে, তিনি ভারতের বিভিন্ন অংশে যুব ক্ষমতায়ন, শ্রম গর্ব, নারী মুক্তি এবং জাতীয়তাবাদের উপর বক্তৃতা দেন। ১৯১৬ সালে জওহরলাল নেহরুর সাথে দেখা করার পর, তিনি চম্পারনে নীল চাষীদের জন্য একটি আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ১৯২৫ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি ছিলেন।
১৯১৯ সালের মার্চ মাসে, ব্রিটিশ সরকার সমস্ত রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ নিষিদ্ধ করে রাওলাট আইন জারি করে। গান্ধীজি যখন প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেন, তখন সরোজিনীই প্রথম আন্দোলনে যোগ দেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনের ওপর ব্যাপক দমননীতি বাস্তবায়ন করে।
১৯১৯ সালের জুলাই মাসে সরোজিনী ইংল্যান্ডে হোমরুল লিগের দূত মনোনীত হন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসের তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পর ১ অগস্ট গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসের দুই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিনিধির অন্যতম রূপে নির্বাচিত হন।
১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি নিউ ইয়র্ক সফর করেন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকান ও আমেরিইন্ডিয়ানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা করেন তিনি। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারী, জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৫ মে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর পরপরই সরোজিনীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তিনি কয়েক মাস কারাবরণ করেন। ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারী, তিনি গান্ধীজির সাথে মুক্তি পান। ওই বছরের শেষের দিকে তারা আবার গ্রেপ্তার হন। অসুস্থতার কারণে সরোজিনীকে কিছুদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হয়। গান্ধীজি ১৯৩৩ সালে মুক্তি পান। ১৯৩১ সালে তিনি গান্ধীজি এবং পন্ডিত মালব্যের সাথে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এই সময়ে, সরোজিনী গান্ধীজীর সাথে ২১ মাস বন্দী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সরোজিনী নাইডুর সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে তিনি গান্ধীজিকে “মিকি মাউস” বলেও ডাকতেন।
১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এশীয় সম্পর্ক সম্মেলনের স্টিয়ারিং কমিটির পৌরোহিত্য করেন সরোজিনী নায়ডু।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার পর সরোজিনী নায়ডু যুক্তপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যপাল নিযুক্ত হন। তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল। ১৯৪৯ সালের ২ মার্চ কার্যকালেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।