কানাই কাকা হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে । কাকাকে দেখা মাত্র কুহেলি পেছন ডেকে বলল, “কাকা ! তোমার সাথে একটা দরকারি কথা আছে !”
“হ্যাঁ মা । তুমি বলো, তোমার কথাটা শুনে যাই । আমাকে এখন সালার যেতে হবে । চাষের জমিতে কীট-পতঙ্গ মারবার জন্য ঔষধ আনতে হবে । তাই তাড়াহুড়ো ।” কানাই কুহেলির দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য বর্ণনা করলো ।
অন্যদিকে কাকীমা খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলো, “দিলি তো পেছন ডেকে । তোর কথা বলার দরকার থাকলে আরও সকালে ঘরে এসে বলতে পারতিস । দেখছিস, হন্তদন্ত হয়ে লোকটা কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে । ঠিক সেই সময় তাকে পেছন ডাকার দরকার হলো বেহায়া মেয়ে !”
কাকীমার দিকে তাকিয়ে কানাই কাকা বলল, “তুমি চুপ করো । দেখছো মেয়েটা কাঁচমাচু হয়ে কী যেনো বলতে এসেছে, নিশ্চয় খুব দরকার !”
“দরকার না ছাই ! দ্যাখো, টাকা চাওয়ার অছিলায় তোমাকে ডাকছে কিনা ? এই মেয়েকে দিয়ে বিশ্বাস নেই । এত করে তুমি বললে, মামা বাড়ি গিয়ে থাকতে । মেয়েটার সেদিকে হেলদোল নেই । উল্টে ঠ্যাটার মতো বাড়িতে রয়ে গেলো । এখন ঐ রাজরানীকে কে টাকা দেবে ?” এই কথা বলে কাকীমা কাকুর দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে বলল, “যদি কোনোদিন শুনি ঐ বেহায়া মেয়েকে লুকিয়ে টাকা দিয়েছো, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না ।“
আহা গিন্নি ! ঘরে যাও । কুহেলি-মা, সেরকম মেয়ে নয় । কুহেলি মায়ের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ষোলোআনা !
কাকীমা কানাই কাকার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙ্চিয়ে বড় বড় চোখ করে স্থান ত্যাগ করলো । কিন্তু যাওয়ার সময় শারীরিক ভাষায় কানাই কাকাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো, কুহেলির কোনোরকম বায়না-আবদার শোনা যাবে না ।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কুহেলির কানাই কাকা । তারপর কুহেলির দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি এনে জিজ্ঞাসা করলো, “বলো মা, কী বলবে ?”
বলছিলাম আমার করুণ জীবনের কথা । পয়সা-কড়ি শেষ ! ভাবছি, নিজের চেষ্টায় উপার্জনের কথা !
বেশ তো ! কীভাবে উপার্জনের কথা ভাবলে, আমাকে খুলে বলো ?
কাকা, আমি কাঞ্চন নগর গাঁয়ে ঢোকার মুখে চায়ের ভদোকান খুলতে ? তোমার কী মত ?
ভাল প্রস্তাব ! কিন্তু সেখানে লোহাদহের মুরারী ঘটকের চায়ের দোকান রয়েছে । মোড় দিয়ে লোকজনের যাতায়াত কম । সুতরাং একটা দোকান থাকা অবস্থায় তুমি দোকান খুললে বেচাকেনা কেমন হবে সেই ব্যাপারে আগেভাগে ভেবেচিন্তে এগোতে হবে । যাতে পরে পস্তাতে না হয় ?
কাকা, আমি এখন চা দিয়ে শুরু করতে চাই । পরবর্তী সময়ে দোকানে লাভের মুখ দেখলে, দোকানটির কলেবর বাড়াতে চাই ।
কেমন ধরনের ব্যবসার কথা বলছো ?
বলছি, চায়ের দোকান ভাল চললে আমি সেখানে মুড়ি, ঘুগনি, পাউরুটি, পাকা কলা, ইত্যাদি রাখতে চাই । যাতে সাধারণ মানুষ সকালে বিকালে আমার দোকান থেকে জল খাবার খেয়ে তাঁদের কাজে বের হতে পারেন ।
অতি উত্তম প্রস্তাব । দোকান খোলার ব্যাপারে আমার সায় আছে । তবে মা, খুব সাবধান ! দিনকাল ভাল নয় । এখনকার মানুষ আগের মতো উদার বা হিতাকাঙ্ক্ষী নয় । মানুষ সুযোগ খোঁজে “তিলকে তাল করার জন্য” । কেউ কারও ভাল দেখতে পারে না । সুতরাং তুমি যতোটা সহজে দোকান খোলার কথা ভাবছো, সেটা অতো সহজ ব্যাপার নয় । বাস্তব জগত বড় কঠিন ! সুতরাং যেটা করবে খুব সাবধানে করবে । তবেই আখেরে তোমার ব্যবসার উন্নতি ঘটবে । আমার সময় হয়ে গেছে, আমি এবার ভরতপুরের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি ! সেখান থেকে বাসে আমার গন্তব্যস্থল, সালার । কানাই কাকা কুহেলির মাথায় হাত রেখে বলল, “ঈশ্বর তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করুক !”
কাকা চলে যাওয়ার পর প্রমাদ গুণতে থাকলো সে কীভাবে চায়ের দোকান খুলবে ।
কুহেলি গভীরভাবে অনুধাবন করছে, তার পুরানো প্রেমিক শীতল ইদানীং তার খোঁজখবর রাখে না । লোক মুখে কুহেলি জানতে পেরেছে, “শীতলের বাড়ির মানুষের তীব্র আপত্তির জন্য কুহেলির সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ ।“ অথচ শীতল একদিন কথা দিয়েছিল, কুহেলির সমস্ত বিপদ-আপদে শীতল তার পাশে ঢাল হয়ে থাকবে । কলকাতায় পড়তে যাওয়ার পর থেকে শীতলের মানসিকতা্র পুরোপুরি বদল । কুহেলির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ । ভরতপুরের এক বান্ধবীর মারফত কুহেলি আরও জেনেছে, শীতল নাকি অন্য একটি মেয়ের খপ্পরে পড়ে কুহেলির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে । শীতলের জীবনে কী হয়েছে সেটা কুহেলির অজানা । তবে একদিনের একান্ত আপন মানুষ ছিল শীতল । সেই মানুষটি নিমেষের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেলো, এটাই কুহেলির কাছে হিসাব মিলছে না । নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কোনো অজুহাত খুঁজে পচ্ছে না কুহেলি । তাই কুহেলি এবার নিজের ব্যাপারে খুব সতর্ক । ভেবেচিন্তে পা ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । সমবয়সী ছেলেদের কোনোরকম প্রলোভনে পা দিতে গররাজি । ইতিমধ্যে সিসগ্রামের তপু বেশ কিছুদিন ঘুরঘুর করছিল । কুহেলি বুঝতে পেরেছিল তপুর মতলব খারাপ । তাই একদিন কুহেলি তপুকে ডেকে বলেছিল, “আমার পেছনে খালি ঘুরঘুর করছো, তোমার মতলব কী ?”
তপু উত্তরে বলেছিল, “আমি তোকে ভালবাসি ।“
কেন আমাকে ভালবাসো, জানতে পারি ?
একসঙ্গে পড়েছি । তোকে আমার ভাল লাগে । সেজন্য ভাল লাগা থেকে তোকে ভালবাসা ।
শোনো তপু, আমি তোমাকে ভালবাসি না । সুতরাং আমার পেছনে ঘোরাঘুরি বন্ধ করো । তোমার ঘোরাঘুরির জন্য গাঁয়ের মানুষ আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে ! এটা আমার কাছে বিড়ম্বনার ?
তোর চালচুলোর কিছু নেই ।সুতরাং তোর আবার মান-সম্ভ্রবের জায়গা আছে নাকি ? তোর বড় বড় কথা শুনে হাসি পাচ্ছে ?
“এরপর থেকে তোমাকে যদি আমার পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখি, সেদিন বুঝবে আমার মান-সম্ভ্রবের তেজ কাকে বলে ?” চোখ গরম করে বেশ ঝাঁঝালো সুরে কথা শুনিয়েছিল তপুকে । তারপর থেকে তপু আর কুহেলিকে বিরক্ত করেনি ।
**********************************************
এখন কুহেলি সিদ্ধান্ত নিলো, কাকার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে । কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শতবার ভাববে এবং তারপর ভেবেচিন্তে এগোবে ।
বড় রাস্তা থেকে কাঞ্চন নগরে ঢোকার মুখে একটা ছোটখাটো বাজার । মুরারী ঘটক কাকার চায়ের দোকান ছাড়া একটি মিষ্টির দোকান এবং মুদিখানার দোকানসহ কইয়েকটি হাতে গোনা দোকান । তবে প্রতিদিন বিকেলে সবজির বাজার বসে । আশেপাশের গ্রাম থেকে চাষিরা নিজের জমির চাষের আনাজ-পাতি নিয়ে বসে । কেননা এলাকার মানুষ চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত । অর্থনৈতিক পরিকাঠামো চাষবাসের উপর নির্ভরশীল ! তাই ভোরবেলা থেকে চাষিরা চাষবাস নিয়ে ব্যাস্ত থাকে । বিকেলে ক্ষেতি জমি থেকে ফিরে স্নান সেরে মোড়ে এসে বসেন । গল্পগুজব করেন । চায়ের দফোকানে তখন উপচে পড়া স্থানীয় মানুষের ভিড় । ফেরার সময় তাঁদের নিত্য প্রয়োজনীয় সবজি কিনে ঘরে ফেরেন । ফলে বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত জমজমাট বাজার । তবে সন্ধ্যা আটটার পরে মোড় এলাকা প্রায় ফাঁকা । কেননা ঐসব চাষিদের বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে অল্প রাত্রিতে ঘূমানোর অভ্যাস । তার একটাই কারণ পরেদিন ভোর চারটের মধ্যে ঘুম থেকে ওঠে গরু-বাছুরকে খাওয়ানো । হালের বলদ নিয়ে তারপর জমিতে ছোটা । সুতরাং তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন ঐভাবেই ছকে বাঁধা । মানুষের অতি সহজ সরল জীবন । তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার এলাকা খুব সীমাবদ্ধ । তাঁরা শারীরিক কসরত করে খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকতে চায় । তাই তাঁরা সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত । গ্রামের এই চালচিত্র কুহেলির কাছে ছবির মতো পরিষ্কার । তাই সংসার চালানোর কথা মাথায় রেখে রোজগারের চিন্তায় চায়ের দোকান খুলে কুহেলির পয়সা উপার্জনের যাত্রা শুরু ।
ইতিমধ্যে ভরতপুরসহ সালার, কান্দি, এমনকি বাজারসৌ স্টেশনের কয়েকটি চায়ের দোকানে ঘোরাঘুরি করে চা তৈরীর রসায়ন সম্বন্ধে অনেকটাই অবগত । সালারের আলিম চাচা বললেন, “পাতা চা ব্যবহার করলে, জলটা আচ্ছা করে ফোটাতে হবে । তারপর চা পাতা দিয়ে কিছুক্ষণ চা জ্বাল দেওয়ার পাত্র ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে । তাহলে চায়ের লিকারের স্বাদ পাওয়া যাবে এবং খরিদ্দারেরা সেই চা খেয়ে তৃপ্তিবোধ করবেন ।“ অন্যদিকে বাজারসৌ স্টেশনের তপাদার কাকা বললেন, “সিটিসি চা ব্যবহার করলে চা দিয়ে অনেকক্ষণ ফোটাতে হবে । একটু সময় নিয়ে জ্বাল দিলে চায়ের টেস্ট সুস্বাদু হয় ।“ বিভিন্ন চায়ের দোকানদারের বিভিন্ন মতগুলি মনোযোগ সহকারে শুনলো কুহেলি । তারপর বাড়িতে বসে বসে চা বানিয়ে নিজে খেয়ে যাচাই করতে লাগলো । সাতদিন পরে মোটামুটি চা তৈরীর একটা ভাল রসায়ন রপ্ত করলো ।
মোড়ে টেবিল পেতে ছাতা মাথায় দিয়ে দোকান খুললো কুহেলি । সেদিন আবার রথযাত্রা । রথযাত্রার দিন নাকি পুণ্যদিন ! তাই অনেক আগেই রথযাত্রার দিন চায়ের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কুহেলি । টেবিলে তিন রকমের বিস্কুট রাখা । নোনতা, টোস্ট ও থিন । অস্থায়ীভাবে ইট দিয়ে উনুন বানানো । টেবিলের পাশে কয়লার উনুন । উনুন ধরানোর জন্য গ্রাম থেকে গবরের ঘুটে এনে রেখেছিল । রথেরদিন তার চায়ের দোকানের পথ চলা । কানাই কাকার উপস্থিতিতে চালু করলো চায়ের দোকান ।
কানাই কাকা গাঁয়ের কয়েকজন গণ্যমান্য মানুষকে আগেই নিমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিল । তাঁরা জনা পনের মানুষ এসেছেন । কুহেলি খুব মনোযোগ সহকার অতিথিদের জন্য চা বানালো । গাঁয়ের মানুষ গরুর দুধ দিয়ে চা খেতে অভ্যস্ত । তাই কুহেলি আগেই গরুর দুধ সংগ্রহ করে রেখেছিল । তা ছাড়া আমূলের পাউডার দুধ তো আছেই । তবে কুহেলি গ্রামের সজ্জনদের জন্য গরুর দুধের চা বানালো । নিজে পরখ করে বুঝতে পারলো, চায়ের গুণমান সে যেরকমটি চেয়েছিল ঠিক সেই রকম । কুহেলি চা বানিয়ে খুব খুশী । তার বিশ্বাস, চা খেয়ে গাঁয়ের মানুষকে প্রশংসা করতেই হবে । কী আশ্চর্য ! সকলের নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে কুহেলির কাছ থেকে চা কিনে খেলেন । চা খেয়ে তাঁরা কী উৎফুল্ল !
(চলবে)
Category: উপন্যাস
কানাই কাকা কিরণের অভব্যতার বিন্দুবিসর্গ টেরও পেলো না । অন্যদিকে কুহেলি উপযাজক হয়ে কাকাকে কিচ্ছু জানালো না । ইচ্ছা করেই জানালো না, কেননা কথা প্রসঙ্গে কিরণের বেয়াদপীর কথাগুলি বা কার্যকলাপগুলি কাকাকে সবিস্তারে জানাতে হবে । সেখানে শ্লীলতাহানির প্রসঙ্গও উঠবে । সেটা নিয়ে কাকা রেগে গিয়ে গাঁয়ে ফিরে হুলস্থুল বাধাতে পারে । তাতে আখেরে কুহেলির বদনাম রটবে ছাড়া ভাল কিছু ঘটবে না । সুতরাং কাকাকে সমস্ত ঘটনা না বলার সিদ্ধান্তে অটল রইলো কুহেলি । অথচ কিরণের অভব্যতার একটা যোগ্য শাস্তি হওয়া উচিত ছিল । নতুবা ভবিষ্যতে আবার চড়াও হতে পারে । কাকাকে না জানালেও কুহেলি মনে মনে ভেবে রাখলো — সময় সুযোগ মতো সে নিজে কিরণকে জব্দ করবে । যতক্ষণ পর্যন্ত কিরণকে উচিৎ শিক্ষা দিতে না পারছে, ততক্ষণ কুহেলির মানসিক শান্তি নেই । তাই সময় সুযোগের অপেক্ষায় রইলো ।
বড় রাস্তা থেকে কাঞ্চন নগর গাঁয়ে ঢোকার মুখে বড়াল কাকীমার চায়ের দোকান । কুহেলি লক্ষ করলো, কিরণ সেখানে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছে । চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে ভয়ার্ত চোখে ঘুরে ফিরে কুহেলির দিকে কিরণের নজর । অন্যদিকে বড় বড় চোখ করে কুহেলি এমন একটা ইঙ্গিত দিলো যার মর্ম – সবুর করো, দুই একদিনের মধ্যে বাদরামির যোগ্য জবাব তুমি পাবে ।
কানাই কাকা কুহেলিকে বড্ড ভালবাসে । কিন্তু কাকীমার ভয়ে কুহেলির মঙ্গলের জন্য কিচ্ছু করতে পারে না । এমনকি কুহেলিকে ভাল-মন্দ খাবার কিনে দিতে পারে না । পাছে কাকীমা জানতে পারলে তুমুল ঝগড়াঝাটির হুলস্থুল বাধিয়ে কাকাকে অশান্তির বেড়াজালে নাকানি-চোবানি খাওয়াবে !
পাকুড় গাছ তলায় দেখা মাত্র হাতে “বাপুজি কেক্” ধরিয়ে দিয়ে কানাই কাকা বলল, “খেয়ে নে মা । অনেকক্ষণ আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছিস, এখন নিশ্চয় খিদেতে পেট জ্বলছে । কেক্টা খেলে অনেকটা শান্তি !” তারপর কাঞ্চন নগরে ঢোকার আগে সাইকেল থামিয়ে কাকা জিজ্ঞাসা করলো, “তোর পরীক্ষা শুরু হচ্ছে কবে থেকে ?”
আগামী বুধবার থেকে, কাকা ।
“সুতরাং তোর পরীক্ষা এসে গেলো । পরীক্ষা ভাল হওয়া চাই । তোর উপর আমার অনেক ভরসা । আমার বিশ্বাস, তুই ভাল রেজাল্ট করবি ।“ কাকা ডান হাতটা কুহেলির মাথায় রেখে আবার বলল, “আমার আশীর্বাদ রইলো ।”
সাইকেল দাঁড় করিয়ে কুহেলি কাকার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো ।
বাড়ি ফিরে দেখে, গোটা বাড়িটা অন্ধকার । অন্ধকার বাড়ির আনাচে কানাচের গাছের ডালে জোনাকীরা মৃদুমন্দ আলো ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে । উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, মৃদুমন্দ আলোর ছটা ছাড়ানো তারাগুলিতে আকশটা ভর্তি । বাড়িতে ঢোকার মুখে দুটো কুকুর এতক্ষণ শুয়ে ছিল । কুহেলিকে দেখা মাত্র লেজ নাড়তে নাড়তে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো । যদি কুহেলি দিদিমণির কাছ থেকে খাবার পাওয়া যায় । কুকুরের চাহনীতেই বলে দিচ্ছে, তারা কুহেলির আগমনের অপক্ষায় ছিল । কুহেলির বাড়ি ঢোকার অর্থ হচ্ছে কুকুর দুটি পেট ভরে খেতে পারবে । কেননা প্রতিদিন বিশেষ করে রাত্রিতে পথ-কুকুরদের কুহেলি খাওয়ায় । তবে ইদানীং খাওয়াবার পরিমাণ কমে গেছে । বাবা থাকাকালীন, কুহেলি বাজার থেকে আলাদাভাবে কুকুরদের খাওয়াবার জন্য খাবার কিনে আনতো । কুকুরেরাও পরম তৃপ্তিতে খাবারগুলি খেতো । সেটা এখন কুহেলির কাছে ইতিহাস ! তবে কুকুরেরাও সম্ভবত জেনে গেছে তার আদরের দিদিমণির খাওয়ানোর ক্ষমতা কমে গেছে । তারা আর কুহেলিকে বেশী উত্ত্যক্ত করে না । নীরবে ঘরের সামনে এসে লেজ নাড়ে । কুহেলি তার সামর্থ্য মতো খাবার দেয় । তাতেই কুকুরগুলি খুশী ।
লাইট জ্বালিয়ে বাথ রুমে ঢুকলো । স্নান সারলো । কিরণের জাপটে ধরাটা কুহেলিকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছে । মানসিক কষ্টে বিব্রত । রাস্তার আজকের ঘটনায় কুহেলিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সে একজন অবলা নারী । নারীরা আজও মধ্যরাত্রে রাস্তা ঘাটে অসুরক্ষিত । যে কোনো মুহূর্তে তাদের বিপদ অনিবার্য । তাই নিজেকে আরও সাবধানতা অবলম্বন করার কথা ভাবছে । স্নান সেরে বসার উপায় নেই । ছুটলো রান্না ঘরে । ভাত বসালো সেই সঙ্গে ডাল ও ভেণ্ডি ভাজা । গ্যাসে রান্না । একজনের রান্না । তাই বেশী সময় নিলো না । খাওয়া দাওয়ার পর ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত্রি সাড়ে দশটা ।
পড়ার ঘরে ঢুকলো । পড়ায় তার একেবারেই মন বসছে না । বারংবার কিরণের বাদরামির ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে । কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ায় মন বসাতে পারছে না । কিরণকে নিয়ে যতো ভাবছে ততো তার চোখে ক্রোধের আগুন । কেননা কিরণকে তার অভব্যতার যোগ্য শাস্তি দিতে না পারলে কুহেলির মন শান্ত হচ্ছে না । পড়ার ঘরের লাইট নিভিয়ে শোওয়ার ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ! কুহেলি হকচকিয়ে গেলো । এত রাত্রিতে কে এলো ? তবে কী কাকা খোঁজ নিতে তার ঘরে এত রাত্রিতে কড়া নাড়ছে । ধন্দে পড়ে গেলো কুহেলি । তাই বিছানায় শুয়েই তার চিৎকার, “কে ওখানে, কে ডাকছেন ?”
কোনো সাড়া শব্দ নেই । আবার কড়া নাড়লো ।
কুহেলি এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো, কেউ দুরভিসন্ধিমূলকভাবে তার দরজায় অনবরত কড়া নাড়ছে । কাকা নিশ্চয় নয় ! কাকা থাকলে তার ডাকে সাড়া দিতো । নিজেকে শক্ত করলো কুহেলি । তারপর কাকাকে ফোন করলো । কিন্তু ঐদিক থেকে কাকা ফোন তুলছে না । এদিকে আবার জোরে জোরে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ ! তারপর বাইরে থেকে চিৎকার করে কুহেলিকে বলল, “দরজা খোল্ । নতুবা তোর দিন শেষ !”
গলার স্বর শুনে কুহেলির দৃঢ় বিশ্বাস, গলার আওয়াজ কিরণের । কুহেলি বুঝতে পারলো, কিরণ অন্য কোনো অভিসন্ধি নিয়ে রাত্রিতে এসেছে । সেই সময় কুহেলির সাথে দুর্ব্যবহার করে তার আশ মেটেনি । পুনরায় এসেছে যেনতেনপ্রকারেন কুহেলিকে অপদস্ত করতে । আর ঝুঁকি না নিয়ে কাকাকে আবার ফোন ।
“হ্যালো !” কাকা ফোন তুলেই হ্যালো সম্বোধন করে পুনরায় উত্তর পাওয়ার আশায় রইলো ।
“হ্যালো কাকা ! দরজায় অচেনা কেউ এসে কড়া নাড়ছে !” কুহেলি কাকাকে বলল ।
কাকা শোনামাত্র বলল, “আমি এক্ষুণি আসছি, মা ।“
কানাই কাকার হাঁটার শব্দ পেয়ে কিরণ সেখান থেকে চম্পট !
কাকা এসে কাউকে দেখতে না পেয়ে কুহেলিকে বলল, “কেউ এখানে নেই । তুই বরং খেয়ে শুয়ে পড় মা ।“
কাকা চলে যাওয়ার পর কুহেলি আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিলো । কুহেলির বদ্ধ ধারণা, কিরণ দরজায় কড়া নাড়ছিল । রাগে সে জ্বলছিল । কিন্তু তার পক্ষে সেই সময় কিচ্ছু করার নেই । ছেলে হলে ঘর থেকে বেরিয়ে কিরণের কলার ধরে অন্তত শাসানো যেতো । অথচ সেটাও তার পক্ষে সম্ভব হলো না । তাই চুপচাপ খানিকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকার পর হঠাৎ কুহেলির মনে পড়লো অঙ্কের কথা । ঝটাপট বিছানা থেকে উঠে লাইট জ্বালিয়ে অঙ্ক কষতে শুরু করলো । তারপর অনেক সময় বাদে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত্রি ১টা । তখন কুহেলির ঘুমও পাচ্ছে । লাইট নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেলো ।
সকালে উঠতে দেরী । সকালে উঠেই খাবারের চিন্তা ! ঘরে জমানো পয়সা প্রায় শেষ । কুহেলি কোনোরকমে পরীক্ষা পর্যন্ত জমানো পয়সায় চালাতে চায় । তাই ডাল ও ডিমের ওমলেট্ হচ্ছে তার দুপুরের খাবার । রান্নাটুকু বাদ দিয়ে বাকী সময় তার পড়াশুনা । পড়াশুনায় তার ঢিলেমি নেই । পড়ায় ভীষণ মনোযোগী । তার মাথায় সর্বদা ঘুরপাক খাচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়াবার কথা । প্রথমে লক্ষ্য গ্রাজুয়েট । তারপর সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসা । গ্রাজুয়েট ডিগ্রি থাকলে দেশের সমস্ত পরীক্ষায় বসার ছাড়পত্র মিলবে । তাই তার আপাতত স্নাতক ডিগ্রি টার্গেট ।
দেখতে দেখতে বুধবার আগত । নিজের স্কুলেই পরীক্ষার সিট্ । দুপুর বারোটা থেকে পরীক্ষা শুরু । সকালবেলায় চাষের জমিতে যাওয়ার আগে কানাই কাকা কুহেলির সঙ্গে দেখা এবং আশীর্বাদ করে গেছে । সকালবেলায় আগেভাগে সেদ্ধ-ভাত নামিয়ে রেখেছে । যাতে যাওয়ার সময় কোনোরকম দেরী না হয় । ৯টার মধ্যে স্নান শেষ । খাওয়া সেরে ঠিক সকাল ১০টায় বাড়ি থেকে পরীক্ষার উদ্দেশে রওনা দিলো । বের হবার আগে পরীক্ষায় বসার এ্যাডমিট কার্ড ও আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র যেমন কলম, ইত্যাদি ঝালিয়ে নিলো । সব ঠিক মতো বুঝে নিয়ে বাড়ি থেকে পরীক্ষার উদ্দেশে রওনা দিলো ।
পরীক্ষা ভাল দিচ্ছে কুহেলি ।
শেষদিনে অঙ্ক পরীক্ষা । বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ঠাকুরকে প্রণাম করলো কুহেলি । ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা জানালো, অঙ্ক পরীক্ষা যেনো ভাল হয় । পরীক্ষার হলে বসে অঙ্কের প্রশ্নপত্র দেখে কুহেলি অবাক ! বরং বলা ভাল খুব খুশী । প্রশ্নের অঙ্কগুলি খুব সহজ । তাই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই তার অঙ্ক প্রশ্নের উত্তর শেষ । বাকীটা সময় সিটে বসে অঙ্কগুলি পুনরায় ঝালাই করে নিলো, কোথাও ভুল হয়েছে কিনা ? ভাল করে দেখার পর কুহেলি নিশ্চিত, অঙ্কে ১০০এর মধ্যে ১০০ পাচ্ছে । সুতরাং অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে কুহেলি খুব খুশী ।
পরীক্ষা শেষ । কুহেলির মাথা থেকে পরীক্ষার টেনশন আউট্ । এখন সে ফ্রী । এখন তার মানসিক চাপমুক্ত জীবন !
রান্না করতে গিয়ে মাথায় হাত ! এক ফোঁটা সরষের তৈল নেই । তা ছাড়া চাল, ডাল, কাঁচা আনাচ-পাতি সব কিছুই বাড়ন্ত । অথচ ভাণ্ডারে একটা পয়সা নেই । চিন্তায় কুহেলি বেসামাল । এখন কী করবে ? মাঠের জমি শেষ । বাবা সেগুলি বিক্রি করে নতুন সংসার পেতেছে । সুতরাং চাষের জমি থেকে আয় আসার পথ বন্ধ । কাকীমার উপদ্রবে ভাইঝির প্রয়োজনে কানাই কাকা কাজে লাগতে পারছে না । সেটা কাকার চালচলনে প্রস্ফুটিত । পয়সা উপায়ের ব্যবস্থা কীহবে, কুহেলির মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না । এতদিন ইচ্ছা করে কুহেলি শীতলের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি । তার ঘন ঘন ফোনে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে পারে, এইসব কথা ভেবে শীতলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি । পয়সা উপার্জনের ব্যাপারে কুহেলি কিছুতেই শীতলের সঙ্গে পরামর্শ করতে নারাজ । শীতল শুনলে কুহেলির উপার্জনের ভাবনার জলাঞ্জলি ঘটবে । শীতল কিছুতেই পয়সা উপার্জনের জন্য কুহেলিকে কাজ করতে দেবে না । তার চেয়ে তাকে না জানানোই ভাল । কুহেলিকে একা সিদ্ধান্ত নিতে হবে । শলা-পরামর্শ করার কেউ নেই । কানাই কাকাও কুহেলির উপায়ের পথ খোঁজার সঙ্গে একমত হবে না । কানাই কাকা কিছুতেই কুহেলিকে এই অল্প বয়সে উপার্জনের দিকে ঠেলে দিতে চাইবে না । কাকা যদিও আগে বলে রেখেছে, পরীক্ষার পর মামা বাড়িতে গিয়ে থাকতে ।
মামা বাড়িতে থাকতে কুহেলি ঘোর বিরোধী । সে এখন যথেষ্ট বড় । বাঁচার জন্য একটা কিছু করে খাওয়ার ক্ষেত্রে কুহেলি যথেষ্ট স্বাবলম্বী । সুতরাং এইসব ছোটখাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কুহেলি একাই একশ ! পান্তা মাসিকে নিজের চোখে দেখেছে কায়িক পরিশ্রম করে বাঁচতে । পান্তা মাসিও একজন মহিলা । কুহেলি ভাবলো, সে শারীরিকভাবে শক্ত । যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষ । যদিও প্রয়োজনীয় কাজ করার ক্ষেত্রে তার অনীহা নৈব নৈব চ । বাঁচার ক্ষেত্রে যে কোনো ছোটখাট কাজও সম্মানের । অনেক ভেবে দেখলো, কাঞ্চন নগরে থাকলে পরের বাড়ি থালা-বাসন মেজে উপার্জন করা ছাড়া অন্য কোনো সম্মানজনক উপায়ের পথ খোলা নেই । তার মাথায় কয়েকটা দোকান খোলার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে । যেমন চায়ের দোকান, ফুচকার দোকান, জামা-কাপড় আইরণ করার দোকান, টেলারিং দোকান, রুটি তরকারির দোকান, ইত্যাদি । পকেটে পূঁজি নেই । ব্যবসা খুলতে পুঁজি লাগে । সুতরাং স্বল্প পুঁজিতে চায়ের দোকান খোলা যেতে পারে । ফুচকা বানাতে অল্প পুঁজি লাগে । আইরণের দোকানে নামমাত্র পুঁজি । এইসব ভাবতে ভাবতে সকালবেলাটা কেটে গেলো ।
বাজারে ছুটলো । পাঁচশ গ্রাম চাল, দুটো কাঁচকলা, অল্প পরিমাণে আলু, পিঁয়াজ, আদা, রসুন, একটা বেগুন, কয়েকটা পটল, ইত্যাদি সবজি কিনে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু । বাড়িতে এসে দেখলো, তনামিকা উঠোনের পাশে কাঠাল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে । তনামিকা পাশের গ্রামে থাকে । ওরা একসঙ্গে পড়ে । ওর বাবা স্কুল শিক্ষক । গাঁয়ে ওদের আর্থিক অবস্থা, স্বচ্ছল । তনামিকা কুহেলির ভাল বন্ধু । একসঙ্গে পড়ার সুবাদে দুইজনের সম্পর্ক খুব কাছের । তাই তনামিকাকে দেখা মাত্র কুহেলি এক গাল হাসি দিয়ে বলল, “কতক্ষণ ?”
“কিছুক্ষণ ! তুই অযথা টেনশন করিস না । তোর সঙ্গে দরকারি কথা আছে । সেটা বলতেই তড়িঘড়ি আসা ।
এবার তোর দরকারি কথাটা শোনা যাক ।
তুই একটা কাজের খোঁজ নিতে বলেছিলি ?
পেয়েছিস কী ?
পেয়েছি, তবে পরের মাস থেকে কাজে যোগ দিতে বলেছে ।
কাজটা কী ? সেটা আগে জানা দরকার ।
একটা কাপড়ের দোকানে ।
দোকানটি কোথায় ?
কাপড়ের দোকানটি সালারে । সকালে ৯টার সময় দোকানে পৌঁছাতে হবে, আর ছুটি সন্ধ্যা ৭টায় । সারাদিনের কাজ ।
মাসিক বেতন কতো ?
মাসিক বেতন ৮হাজার টাকা ।
এবার কুহেলি থামলো । তারপর তনামিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “সারাদিন কাজ করলে আমি পড়বো কখন ?”
বাড়ি ফিরে রাত্রিতে পড়বি ।
তোর কী মাথা খারাপ ! কাজটা জোগাড় করেছিস, এইজন্য আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ ! কিন্তু তুই তো জানিস, এরপর আমাকে কলেজে ভর্তি হতে হবে । সারাদিন দোকানে বসে থাকলে কলেজ কখন করবো, আর পড়বো কখন ? আর তা ছাড়া, সন্ধ্যা ৭টার পর দোকান থেকে ছাড়া পেলে আমার বাড়ি ফিরতে অনেক রাত্রি হবে । সালার থেকে বাসে ভরতপুর । তারপর সেখান থেকে সাইকেলে কাঞ্চন নগর । রাত্রিতে রাস্তায় অনেক রকমের উপদ্রব । বিশেষ করে একদল কুমতলবি ছোকরার দলের উৎপাত । তখন আমার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ?
তনামিকার কথা বন্ধ হয়ে গেলো । তখন কুহেলিকে বলতে বাধ্য হলো, “তুই বরং অন্য কোথাও কাজের চেষ্টা কর । সেটাই বরং ভাল ।“
বেজার মুখে তনামিকা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত !
তনামিকার উঠে যাওয়া দেখে কুহেলি বলল, “উঠলে হবে না । এক কাপ চা খেয়ে যেতে হবে । চা বানাতে আমার সময় লাগবে না ।“
মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দিয়ে তনামিকা হেসে হেসে বলল, “একটা পরামর্শ দেবো ?”
অবশ্যই !
তুই বরং চায়ের দোকান খোল্ । তোর হাতের চা খুব সুন্দর । তারপর ডান হাতের মাটির ভাঁড় তুলে ধরে বলল, এই রকম সুস্বাদু চা বানালে তোর চায়ের দোকান খুব ভাল চলবে ।“
এটা ভাল প্রস্তাব । চায়ের দোকান খোলা নিয়েও ভাবছি । তবে সিদ্ধান্ত নিইনি ।
তারপর তনামিকা তার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলো ।
দুপুরের রান্না শেষে স্নান সেরে খেয়ে নিলো কুহেলি ।
———–০———–
( চলবে )
কুহেলির বাড়ি থেকে চলে গেলো শীতল । কুহেলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো । সাংঘাতিক নাছোড়বান্দা শীতল । টাকা সে দেবেই । অনেক কষ্টে শীতলকে থামানো গেছে । এটাই তার শান্তি ।
কুহেলি মনের দিক থেকে স্থির প্রতিজ্ঞ, সে নিজের চেষ্টায় বড় হবে । তাতে তার খাবার জুটুক বা না-জুটুক ! তবু কারো সাহায্য বা দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে বাঁচতে চায় না । কুহেলির বাবা তাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে, সেটা হচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়ানো । তাই বাবার কথাটার মর্যাদা দিতে মানসিকভাবে ষোলোআনা প্রস্তুত । যতো ঝড় ঝঞ্ছাট আসুক, তাতে সে কিছুতেই হেলবে না । তার সিদ্ধান্তের একচুল নড়চড় হবে না । নিজের পায়ে দাঁড়াতে কুহেলি বদ্ধপরিকর !
রাত্রিতে মুড়ি-খই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কুহেলি ।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আদাজল খেয়ে লাগলো । বাড়ির কাজ নিজের হাতেই সামলাতে হচ্ছে । গ্রামে বাড়ি । গাছ-গাছলায় ভর্তি । আম, কাঠাল, পেয়ারা, লেবু, ইত্যাদি । যার জন্য গাছের পাতায় উঠোন ভর্তি থাকে । অন্যদিকে মাটির উঠোন । যার জন্য উঠোন ঝাঁট দেওয়া একটা ঝকমারি । বাড়ির টুকিটাকি কাজকর্মে অনেক সময় নষ্ট । আগে এইসব টুকিটাকি কাজ নিয়ে ভাবতে হতো না । বাবা সামলাতো । বাবা তাকে কুটোটি নাড়তে দিতো না । তাই প্রতিটা মুহূর্তে কুহেলি বাবাকে মিস করে । কিন্তু সেই বাবা কী করে তাকে ফেলে রেখে অন্যত্র ঘর বাঁধতে ছুটলো, সেটা কুহেলির মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না । এই মুহূর্তে কুহেলি অতীতের সব কিছু ভুলে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ধ্যান দিলো ।
অঙ্কের ও ইংরেজি বিষয়ের উপর আলাদা টিউশনি মাস্টার ছিল । কুহেলি টিউশনি মাস্টার ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো । তবে মাস্টার মশাইয়েরা কুহেলিকে পইপই করে বলে দিয়েছেন, সমস্যা হলে অবশ্যই পড়তে আসবে । কুহেলির জন্য টিউশনি মাস্টারের দরজা খোলা । দুজন মাস্টার মশাই খুব ব্যস্ত মানুষ । একজন কান্দী কলেজে এবং অন্যজন সালার কলেজে পড়ান । দুই জন মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি ভরতপুরে । তাঁরা বাড়িতে সকালে পড়ান । যাই হোক কুহেলি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করলো । ক্লাসের অঙ্কের মাস্টার মশাই বললেন, “পড়াশোনায় ঢিলে দেবে না । অঙ্কের বিষয়ে তোমার উপর আমাদের অগাধ ভরসা । আমার বিশ্বাস, এবারের পরীক্ষায় তুমি আমাদের স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে ।“ অঙ্কের মাস্টার মশাইয়ের এতটা ভরসা পাওয়ার কারণ, কুহেলি টেস্ট পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে । যার জন্য মাস্টার মশাইদের তাক লেগে গেছে । তাই মাস্টার মশাইরা কুহেলির উপর একটু বেশী আস্থা রেখে ফেলছেন । তবুও কুহেলি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু পড়াশুনা নিয়ে ডুবে রইলো । এমনকি শীতলের সঙ্গে ফোনেও যোগাযোগ রাখলো না পাছে পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে । কুহেলির ইংরেজিতে অতোটা চাপ নেই । সমস্যা দেখা দেয় অঙ্ক কষা নিয়ে । অনেক সময় আটকে যায় । অঙ্ক আটকে গেলে কুহেলি অঙ্কের টিউশনি স্যারের কাছে গিয়ে বুঝে আসে । অঙ্কের স্যার কুহেলিকে খুব ভালবাসেন । তাঁর বিশ্বাস, কুহেলি অঙ্কে খুব ভাল রেজাল্ট করবে ।
পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে । অন্যদিকে তার জমানো পয়সা শেষ হওয়ার পথে । অহেতুক চিন্তা থেকে নিবৃত্তি পেতে অতি সাবধানে খরচ করছে কুহেলি । যাতে পরীক্ষা পর্যন্ত সংসার চালিয়ে যেতে পারে । বাইরের খরচা তেমন নেই । ইলেক্ট্রিক বিল পেমেন্ট হয়ে গেছে । গাঁয়ের হরির মুদিখানার দোকান থেকে বাকীতে এক কেজি সঃ তৈল এনেছিল তারও পেমেন্ট হয়ে গেছে । এখন বাইরে ধার-বাকী নেই । কুহেলি মনেপ্রাণে চাইছে, পরীক্ষা পর্যন্ত জমানো পয়সায় চলুক । পরীক্ষার পর উপায়ের একটা চিন্তা করা যাবে । পরীক্ষার আগে উপায়ের চিন্তা করলে তার রেজাল্ট খারাপ হতে বাধ্য । তাই কুহেলি সাতপাঁচ না ভেবে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করলো ।
গ্রামের কিছু ছেলের উৎপাত সারাক্ষণ । তার মধ্যে ক্যাবলা কিরণের উৎপাত অভিনব । তা ছাড়া কিরণের তাকানোর মধ্যে জটিলতার আভাস কুহেলির কাছে বিরক্তিকর । কুহেলি পাত্তা দিচ্ছে না অবলোকন করে কিরণ সকালে সন্ধ্যায় উপযাচক হয়ে খোঁজ নিচ্ছে, সংসারের জন্য কুহেলির কী কী বাজার লাগবে । কিরণের অভব্য আচরণের জন্য কুহেলি বলতে বাধ্য হলো তার কোনো বাজার লাগবে না । ঘরে পয়সা নেই তার খোঁজ কেউ নিচ্ছে না । অথচ বাজার করে দেওয়ার জন্য উতলা ! কিরণের অতি উৎসাহ দেখে কুহেলি হাসবে না কাদবে, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না । তাই ঠাণ্ডা মাথায় কিরণকে এটা-সেটা বুঝিয়ে কুহেলি তাকে এড়িয়ে যেতে লাগলো ।
আবার অঙ্ক আটকালো । স্যারকে মোবাইলে পাওয়া গেলো না । পরেরদিন ভোরবেলায় ফোন করলো কুহেলি । স্যার ফোনে জানালেন, “কয়েকদিন কলেজে জরুরি কাজ থাকার জন্য সকালবেলায় তাঁকে কলেজে ঢুকতে হচ্ছিল । আজ ফাঁকা আছি । সুতরাং বিকেলে এসো । এর পরের দুদিন থাকবো না । ব্যক্তিগত কাজে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট যাবো ।“
কুহেলি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলো, “স্যার, আমি আজ বিকেলেই যাচ্ছি ।“
“ঠিক আছে কুহেলি । তুমি পাঁচটার সময় চলে এসো । একটু আগে আসাটা তোমার পক্ষে ভাল । কেননা তোমাকে আবার অনেকখানি রাস্তা ডিঙিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে ।“ মাস্টার মশাই বললেন ।
তারপর ফোনের লাইন কেটে গেলো ।
কুহেলি দুদিন ধরে ভাবছে, অঙ্কের স্যারের কাছে যাওয়ার কথা । কেননা পরীক্ষা আসন্ন । কয়েকটা অঙ্কের সমাধান কিছুতেই হচ্ছে না । কুহেলির ধারণা, পরীক্ষায় ঐ জাতীয় অঙ্ক দিলে মুশকিলে পড়বে । তার জন্য আগেভাগে মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে জেনে রাখা ভাল । পরীক্ষায় এলে অন্তত ১০ থেকে ১৫ নম্বরের অঙ্ক থাকবে । সেক্ষেত্রে তাকে ঐ নম্বরের অঙ্কের সমাধান না করেই খাতা জমা দিতে হবে । তাই কোনো কিছু চিন্তা না করে বিকেল চারটার সময় ভরতপুরে অঙ্কের স্যারের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলো । অনেকটা রাস্তা । তাই হাতে সময় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো ।
সাইকেলের চাকায় হাওয়া কম । কাঞ্চন নগরে কোনো সাইকেল সারানোর দোকান নেই । তাই তাকে সাইকেলে হাওয়া দিতে হলে অন্তত সিস্গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে । চাকায় হাওয়া কম থাকায় রাস্তা দিয়ে দ্রুত সাইকেল চলছে না । ধীরে ধীরে সাইকেল নিয়ে যখন সিস্গ্রামে কুহেলি পৌঁছালো, তখন বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে । চাকায় লিক্ । লিক্ সারাতে সময় নিলো । তারপর সিস্গ্রামে সাইকেলের লিক্ সারিয়ে চাকায় হাওয়া দেওয়ার পর যখন জোরে সাইকেল চালিয়ে কুহেলি ভরতপুর পৌঁছালো তখন স্যারের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী টিউশনিতে ঢুকে গেছে । স্যার চেয়েছিলেন, পাঁচটার সময় কুহেলি পৌঁছালে তাকে একান্ত আলাদাভাবে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে ব্যাচের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসবেন । কিন্তু দেরী করার জন্য সকল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মাস্টার মশাইয়ের পক্ষে আলাদাভাবে কুহেলিকে বোঝানো কঠিন হয়ে দাড়ালো । তাই কুহেলি পুরো অঙ্ক স্যারকে বোঝাতে অনেকটা রাত্রি । ঘড়ির কাটায় তখন রাত্রি ৯টা ।
স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কুহেলি হাই রোডে এসে দাঁড়ালো । এই হাই রোডটি সালার থেকে ভরতপুর হয়ে কান্দি হয়ে বহরমপুর যাচ্ছে । যদিও রোডটির সাথে অনেকদূর পর্যন্ত যোগাযোগ । বহরমপুর থেকে ফরাক্কা, মালদহ হয়ে সোজা উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই যোগাযোগ । অন্যদিকে কলকাতা থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেস দিয়ে ঈশ্বরগুপ্ত সেতু পার হয়ে আসাম রোড ধরে কাটোয়া হয়ে সালার, তারপর ভরতপুর । সুতরাং রাস্তাটির গুরুত্ব অপরিসীম । সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছে । ভরতপুরে লোডশেডিং । চারিদিকে অন্ধকার । কুহেলি ভাবলো, কাকাকে একবার বাড়ি ফেরার কথা জানিয়ে রাখা দরকার । তাই কাকাকে (ছোট কাকা, কানাই) ফোন করে বলল, “রাত হয়ে গেছে । সম্ভব হলে তুমি ভরতপুরের দিকে সাইকেলে এগিয়ে এসো । আমি ভরতপুর থেকে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছি ।“ ফোন করে কুহেলি আর সময় নষ্ট করলো না । সাইকেল চালিয়ে সিস্গ্রাম পার হয়ে কাঞ্চন নগরের রাস্তা ধরলো । ভরতপুর ছাড়ার পর গোটা রাস্তা অন্ধকার । মাঝে মাঝে মোটর বাইকের আলোয় অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তা দেখতে পাচ্ছিলো । রাস্তায় লোকজন কম । রাত্রি আটটার পর স্থানীয় মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হন না । ফাঁকা রাস্তা দেখে কুহেলির আতঙ্ক ! সিস্গ্রাম পার হওয়ার পর কুহেলির মনের ভিতর অজানা আশঙ্কা, “এত রাত্রিতে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে একা একা সাইকেল চালিয়ে যেতে পারবে কিনা ?” তার মাথায় অজানা বিপদের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে । কী জানি কী বিপদ আসন্ন ?
বিকেল বেলায় বাড়ি থেকে কুহেলি যখন ভরতপুরে যাচ্ছিলো, গাঁয়ের ক্যাবলা কিরণ তাকে দেখতে পায় । কিরণকে ইদানীং কুহেলি ক্যাবলা কিরণ নামেই ডাকে । তখন থেকেই কিরণ প্রমাদ গুনছে, কুহেলিকে কীভাবে জব্দ করা যায় ! অনুমানের ভিত্তিতে কিরণের ধারণা, কুহেলির বাড়ি ফিরতে আজ নির্ঘাত রাত হবে । সুতরাং কুহেলিকে কাছে পাওয়ার একটা মওকা । সে এই সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজি না । সঙ্গে কাউকে রাখেনি । একাই কুহেলিকে পাকড়াও করতে চায় । সন্ধ্যা থেকে পাকুড় গাছটার নীচে তার অপেক্ষা । চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ! তার উপর মশার কামড় । তবুও সে নাছোড়বান্দা । যেভাবে হোক কুহেলিকে তার পাকড়ানো চাই । কুহেলির তেজ ভাঙ্গতে কিরণ মরিয়া ।
স্থানীয় মানুষদের কাছে পাকুড় গাছের পাশ দিয়ে চলাটা ভীষণ ভীতির কারণ । অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা রাত্রিবেলায় ঐ পাকুড় গাছ দেখলেই শঙ্কিত হয়ে পড়ে । নীচ দিয়ে যাওয়ায় সময় অতঙ্কে থাকে । দুই একবার ভৌতিক কাণ্ডও ঘটেছে । তা ছাড়া ইতিপূর্বে বিপজ্জনক ঘটনাও ঘটেছে । সেসব ঘটনার কথা কুহেলি জানে । জানলে কীহবে ? আজ উপায় নেই । ঐ রাস্তা ধরে তাকে ফিরতে হবে । কুহেলির সাইকেল ছুটছে । পাকুড় গাছ পার হওয়ার পর প্রায় আধা কিলোমিটার সাইকেল চালালে কাঞ্চন নগরে ঢোকার মোড় পড়বে । কাঞ্চন নগরের মোড় থেকে গ্রামের দিকে ঢুকলে বিপদের সম্ভাবনা কম । সুতরাং কাঞ্চন নগরের মোড় পর্যন্ত বিপদের ঝুঁকি ষোলোআনা । সেটা কুহেলি বিলক্ষণ জানে । রাস্তা সুনসান । লোকজন নেই । ভয়ে আতঙ্কে কুহেলি জেরবার । তার উপর সাইকেল জোরে চালানোর জন্য কায়িক পরিশ্রম যথেষ্ট । যার জন্য কপালে ঘাম । বারংবার ভাবছে, বাবা থাকলে তাকে এই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো না । বাবা নিশ্চয় কুহেলিকে নিতে ভরতপুরে হাজির থাকতো ।
কিছুটা দূর থেকে কালো অন্ধকারের ভিতর কুহেলি টের পেলো পাকুড় গাছ তলায় কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে । তার হাঁটাহাঁটির জন্য পাকুড় গাছের পাতার মচমচ শব্দ । পাকুড় গাছের নীচে পৌঁছানো মাত্র কিরণ কুহেলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য, সাইকেল থেকে কুহেলি পড়ে গিয়ে রাস্তার উপরে গড়াগড়ি । সেই অবস্থায় কিরণ কুহেলিকে জাপটে ধরলো । কোনোরকমে কুহেলি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিরণের গালে জোরে এক থাপ্পড় ! চোখ গরম করে কুহেলি বলল, “বাঁচতে চাইলে রাস্তা ছাড় ! নতুবা তোকে আজ নোনাই নদীর জলে চুবিয়ে মারবো । তুই আমার এখনও রণমূর্তি দেখিস্নি । অন্ধকারে ধাওয়া করার মজা টের পাইয়ে ছাড়বো !” রীতিমতো কুহেলি হাঁপাচ্ছে ।
কুহেলি কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে পুনরায় সাইকেলে উঠলো । পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে ক্যাবলাটা থাপ্পড় খেয়ে ভাবলেশহীনভাবে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে । কিছুটা যাওয়ার পর পেছনে তাকিয়ে দেখে ক্যাবলাটা দ্রুত গতিতে বাইক নিয়ে ছুটছে । কুহেলির সাইকেলও খুব জোরে ছুটছে । কিরণ খুব জোরে বাইক চালিয়ে কুহেলিকে টপকে গেলো । কুহেলিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “নোনাই নদীতে কে কাকে চোবায় আমিও দেখবো ।“
চিৎকার করে কুহেলি বলল, “যা, এখান থেকে পালা ! তোদের হিম্মত আমার জানা আছে । তোরা হচ্ছিস লেজকাটা কুকুর । তোদের লজ্জা-স্মরণ বলে কিচ্ছু নেই । সুযোগ পেলেই গাঁয়ের নিরীহ মেয়েদের নিয়ে টানাটানি । আরে, সাহস থাকলে বে-পাড়ার মেয়ের পেছনে লেগে দেখ্ । মেরে গায়ের ছাল-চামড়া তুলে দেবে। নেমকহারাম কোথাকার !”
কিরণ রেগে গিয়ে বাইক থেকে নেমে কুহেলিকে পুনরায় রাস্তায় দাঁড় করালো । কুহেলি এবার প্রচণ্ড মারমুখি । সে সাইকেল দুই হাতে তুলে নিয়ে মাথার উপর ঘোরাতে শুরু করলো । কিরণের দিকে তাকিয়ে কুহেলি বলল, “এগিয়ে আয়, তোকে আমি এখানেই শেষ করবো ।“ তারপর কিরণের দিকে ধেয়ে গেলো । ইত্যবসরে কানাই কাকা এসে হাজির । কাকার দিকে তাকাতেই কিরণ চোখের পলকে সেখান থেকে বাইকে উধাও ।
( চলবে )
কুহেলির ধারণা, “যত দিন যাচ্ছে পান্তা মাসি বাবার সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধন শক্ত করতে ততো মরিয়া হয়ে উঠছে ।“ পান্তা মাসি এটাও বুঝতে পারছে, তার পথের কাঁটা হচ্ছে কুহেলি । পান্তা মাসি ইদানীং কুহেলিকে সহ্য করতে পারছে না । তাই প্রমাদ গুনছে, কীভাবে কুহেলিকে টাইট দেওয়া যায় এবং কীভাবে কুহেলির অগোচরে সানাইকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায় !
সপ্তাহ খানেক আগে রাত্রিবেলায় পান্তা মাসির সাথে সানাইয়ের প্রচণ্ড ঝগড়া ! ঝগড়ার কেন্দ্রবিন্দু কুহেলি । তুমুল বাগ্বিতণ্ডা । ঝগড়ার কথাগুলি শুনে কুহেলি তাজ্জব ! পান্তা মাসির বক্তব্য, “আশা দিয়ে কেন তাকে ঝোলাচ্ছ ?” কুহেলি বুঝতে পারলো না, পান্তা মাসি কীসের আশার কথা বলছে ? পান্তা মাসি খুব নিম্ন মানের অরুচিকর কথার মাধ্যমে কুহেলির বাবাকে ফাঁসাতে চাইছে । দুইজনের কথাতে কুহেলি নিশ্চিত, তার বাবা পান্তা মাসির কাছে ফেঁসে গেছে ।
বাবাকে পরেরদিন কুহেলি বলেছিল, “আমি বড় হয়েছি । বাড়ির কাজকর্ম, রান্নাবান্না আমি করতে পারি । তাহলে পান্তা মাসিকে আর কী দরকার ?”
কথাটা শুনে সানাই কিচ্ছুক্ষণ কুহেলির দিকে করুণ দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল । কোনো কথা বলেনি । কিন্তু বাবার করুণ চোখের তাকানোর মাহাত্ম্য কিছুটা হলেও কুহেলি আন্দাজ করতে পেরেছিল । কুহেলির বদ্ধ ধারণা, তার বাবা পান্তা মাসির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে ।
কুহেলি ভরতপুর হাই স্কুলে এগারো ক্লাসে ভর্তি হলো ।
প্রথম কয়েকদিন সানাই মেয়েকে ভরতপুর পর্যন্ত পৌঁছে দিতো । কিন্ত কুহেলিকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার পর সানাই বাড়ি ফিরতে অনেক দেরী করত । কুহেলি এটা জানতে পারে কাকীমার কাছে । যখন বাড়ি ফিরত, তখন সঙ্গে পান্তা মাসি । কোথায় যেতো কুহেলি সেটা উদ্ধার করতে পারেনি । এমনকি সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেও সঙ্কোচ বোধ করত । তাই তাকে পৌঁছে দিয়ে বাবা কোথায় যায়, আজও কুহেলির অজানা !
ভরতপুর হাই স্কুলের কলেবর তুলনামূলকভাবে অনেক বড় । ক্লাসের বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়ে ঐ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ । কুহেলিরা কয়েকজন বাইরের স্কুল থেকে আগত এবং নবাগত । ফলে ক্লাসে ঐ স্কুলের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগলো । ভরতপুর স্কুলে পড়াশুনায় কুহেলির তেমন কোনো সমস্যা নেই । কিন্তু ফেরার সময় কিছু উটকো ছেলের পাল্লায় পড়তে হচ্ছে কুহেলিকে । সম্ভবত তাদের বাড়িতে কাজকর্ম বলে কিছু নেই । যার জন্য রাস্তার পাশে গাছ তলায় বসে আড্ডা । তারা ইচ্ছা করেই বিকেলবেলাটা বেছে নিয়েছে । স্কুল ছুটি হলে ছেলে-মেয়েগুলি ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরবে । যারা আমলাই, খয়রা, ইত্যাদি গ্রামের ছেলে-মেয়ে, তারা সকলেই ঐ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফেরে । আড্ডাবাজ ছেলেগুলির টার্গেট, উঁচু ক্লাসের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ।
আজ বুধবার । স্কুলে যাওয়ার জন্য মন বসছিল না কুহেলির । বাড়িতে বসে ঘুমানোর ইচ্ছা । সকাল থেকে শরীরটা আলস্যে ভরা । কোনোকিছুতেই মন বসছে না । বাবার কথা ভেবেই কুহেলির মনটা আনচান ! বাপ-বেটির মাঝখানে ঢুকে পান্তা মাসি কুহেলির জীবনে বিপদ ডেকে আনছে কিনা সেটা ভেবেই কুহেলি আকুল । পান্তা মাসির জন্য ভবিষ্যতে তার কপালে কী বিপদ লুকিয়ে আছে, সেটা ভেবেই কুহেলি অস্থির ! ভাবনাটা ইদানীং বেশী বাড়ছে । তাই বাবাকে কুহেলি বলল, “আজ স্কুলে যেতে মন বসছে না । আর তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্লাসও নেই । যার জন্য আজ আমার স্কুলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক ।“
“না, মা । বাড়িতে বসে থাকলে বরং উল্টোটা হবে । শরীর আরও খারাপ হতে পারে ।“ বাবা কুহেলিকে বোঝালো ।
কুহেলির গলার আওয়াজ পেয়ে পান্তা মাসি কোথা থেকে ছুটে এসে মুখ বেঁকিয়ে বলল, “স্কুলে না গিয়ে নিশ্চয় শীতলের সঙ্গে দুনিয়া ঘোরার মতলব ?” কুহেলিকে বলেই সানাইয়ের দিকে তাকিয়ে পান্তা মাসি একরকম চিল্লিয়ে বলল, “তোমাকে আগেও বলেছি এই মেয়েটা কেলেঙ্কারি বাধিয়ে তবেই ছাড়বে । কিছুতেই শীতলকে ভুলতে পারছে না । মনে হচ্ছে শীতল তাকে বিয়ে করবে ! আমার কাছে শুনে নাও, শীতল জিন্দেগিতে এই মেয়েকে বিয়ে করবে না । নতুন নতুন মেয়েদের সাথে ওদের ফষ্টিনষ্টি করা স্বভাব !”
শীতলের নামে পান্তা মাসির মুখে কটুকথা শুনে কুহেলি চিৎকার করে পান্তা মাসিকে বলল, “ভদ্রভাবে কথা বলো । এরপরে শীতলের নামে একটি কথা বললে তোমাকে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবো । আমাদের বাড়িতে থাকছ, আমাদের অন্ন ধ্বংস করছ আর আমাদেরকে নিয়ে তোমার জ্বালা !“ তারপর রাগে গজরাতে গজরাতে সানাইকে বলল, “বাবা, খুব তাড়াতাড়ি পান্তা মাসিকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলো । নতুবা আমি থানার সাহায্য নিয়ে পান্তা মাসিকে বাড়ি থেকে তাড়াবো ।“
“মা, ঐভাবে বলতে নেই । পান্তা মাসি তোমার গুরুজন ।“ সানাই বোঝালো ।
বাবার কথা শুনে কুহেলি ছুটে ঘরের ভিতর ঢুকলো ।
“দেখেছো, তোমার আদরের মেয়ের আস্পর্ধা দেখেছো ? পুলিশ দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াবে ? সাহস থাকে তো তাড়িয়ে দেখাক !” চোখ বড় বড় করে সানাইকে পান্তা মাসি শাসালো । আবার বলতে শুরু করলো, “ওকে আজ স্কুলে পাঠাও নতুবা আমি ঘাড় ধরে স্কুলে পাঠিয়ে ছাড়ব ।“
“খবরদার ! তুমি আমার মেয়েকে কিচ্ছু বলবে না । যা বলার আমি বলবো ।“ সানাই রেগে গিয়ে পান্তা মাসিকে বলল ।
আমি তোমার চমকানোতে ডরাই না । আজ আমাদের সম্পর্কের একটা বিহীত চাই ? নতুবা অনন্তকাল আমি ধৈর্য ধরতে পারব না ।
তুমি কী করবে জানি না । আমি আগেও বলেছি আজও বলছি, মেয়ের বিয়ে না দিয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারব না । তোমার জন্য মেয়েটাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে পারব না ।
“তোমার অতিরিক্ত আহ্লাদের জন্য ঐ গুণধর মেয়ে একদিন আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে, এটা তোমাকে বলে রাখলাম !” জোর দিয়ে পান্তা মাসি সানাইকে বলল ।
তোমার কথামতো চাষের সব জমি বিক্রি করে দিলাম । আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে মেয়েটা বাঁচবে কীভাবে ? মেয়েটাকে অগাধ জলে ভাসিয়ে দিয়ে আমি সুখ আহ্লাদে বাঁচতে চাই না । এটা তুমি কেন বুঝতে পারছো না ?
“নিজে বাঁচলে বাপের নাম ! এটা বোঝো তো ?” পান্তা মাসি বলল ।
“তুমিই বোঝো । আমি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারব না ।“ তারপর বাইরে থেকে মেয়েকে ডাকতে শুরু করলো, “মা, রাগ করে থাকিস না । বাইরে বেরিয়ে এসে রেডি হয়ে স্কুলে যা মা ।“ মেয়ের কাছে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো সানাই ।
এবার সানাই পান্তা মাসির কথা ভাবছে, সে আচ্ছা জ্বালায় পড়লো । পান্তা মাসি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে নতুন ঘর বাঁধার । ঘর বাঁধার ক্ষেত্রে কাঞ্চন নগরে থাকতে রাজি না । দূরে গিয়ে ঘর বাঁধতে চায় । সানাই বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছে, পান্তা মাসি কুহেলিকে সহ্য করতে পারছে না । অথচ পান্তা মাসি জানে, সানাইয়ের একমাত্র অবলম্বন কুহেলি । সেই কুহেলিকে নিয়ে তার যত হিংসা, বিদ্বেষ ! এটা কিছুতেই সানাই মেনে নিতে পারছে না । কুহেলি পান্তা মাসির পেটের মেয়ে নয়, কিন্তু তার পেটের মেয়ের মতো । সেটা সানাই বারবার বলা সত্ত্বেও পান্তা মাসি কুহেলিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না । অন্যদিকে পান্তা মাসিকে নিয়ে সানাই ঘর বাঁধার স্বপ্নও দেখছে, সেটা ঠিক । তবে সানাই চাইছে, মেয়েটাকে সঠিক জায়গায় পাত্রস্থ করে পান্তা মাসির সাথে ঘর বাঁধতে । কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, পান্তা মাসিকে থামানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।
কুহেলি বেজার মুখে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাবাকে বলল, “আমি স্কুলের জন্য তৈরী হচ্ছি । তুমি আমাকে ভরতপুর পৌঁছে দিয়ে আসবে ।“
সানাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ।
স্কুলে যাওয়ার পথে আইসক্রিমের বাক্স সমেত আইসক্রিমওয়ালাকে দেখতে পেয়ে কুহেলির কী আনন্দ ! তাই কুহেলির বায়না, “বাবা ! আইসক্রিম খাবো ।“
সানাই মেয়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলো, আইসক্রিম দেখে কুহেলির আনন্দ ঠিক ছোটবেলার আনন্দের মতো । ছোটবেলায় আইসক্রিমের বাক্সের শব্দ পেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে বাবার কাছে কুহেলির বায়না, “বাবা, আইসক্রিম !” আজ সেই রকম বায়না দেখে সানাইয়ের চোখে জল চলে আসছিল । নিজেকে সামলে নিয়ে আইসক্রিমওয়ালাকে বলল, “দাদা, বাটির আইসক্রিম দিন তো ?”
“বাটির আইসক্রিম নেই । তবে ভাল মানের আইসক্রিম আছে ।“ বলেই বাক্স থেকে নতুন মডেলের আইসক্রিম বের করে সানাইয়ের সামনে তুলে ধরলো ।
আইসক্রিম দেখে সানাই বলল, “একটু দাঁড়ান দাদা ! আমি মেয়ের কাছে জেনে আসি, সে এই আইসক্রিম খাবে কিনা ?”
দূর থেকে আইসক্রিম দেখতে পেয়ে বাবাকে হাতের ইশারায় কিনতে বলল ।
আইসক্রিম খেয়ে আবার স্কুলের উদ্দেশে রওনা । কুহেলি বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে, বাবা খুব খোশ মেজাজে রয়েছে । তাই কুহেলি আস্তে করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা ! একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ?”
হ্যাঁ মা । কী বলবে, বলো ।
তুমি এতদিন আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কোথায় যেতে ?
তোকে এই ব্যাপারটা পরে জানাবো । তুই আমার মা । তুই আমার প্রাণ । তোকে সব জানাবো মা । তোকে জানাতে আরও কয়েকটা দিন সময় লাগবে ।
“ঠিক আছে বাবা । পরে জানালেই হবে ।“ এই কথা বলার পরে বাবার দিকে তাকিয়ে কুহেলি লক্ষ করলো বাবার চোখ ছলছল । কুহেলি আন্দাজ করতে পারলো, জিজ্ঞাসা করায় বাবা একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেছে ।
বাবাকে স্বাভাবিক করতে কুহেলি আবার বলল, “অনেকদিন তুমি আর আমি কোথাও বেড়াতে যাই না । পরের মাসে চলো দীঘা বেড়িয়ে আসি ।“
“ভাল প্রস্তাব দিয়েছিস মা ।“ সানাই চোখের জল মুছে কুহেলির বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলো ।
ভরতপুর স্কুলে পৌঁছানো মাত্র কুহেলি স্কুলের কম্পাউন্ডে ঢুকে গেলো ।
সানাই এখন একা । কুহেলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তার বাড়ি ফেরার পালা । সানাইয়ের বারবার মনে হচ্ছে কুহেলি ছাড়া তার জীবন শূন্যতায় ভরা । কুহেলিকে কোলে-পিঠে মানুষ করতে তাকে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে । তবুও সানাই ছিল নাছোড়বান্দা । কেননা তার ভিতরে জেদ ছিল, তার একমাত্র মেয়েকে অনেক শিক্ষিত করবে । এইজন্য কুহেলির পড়াশুনার প্রতি সানাইয়ের সবসময় খেয়াল । মেয়ে অনেক বড় হয়েছে । নিজে বুঝতে শিখেছে । তবুও মেয়ের আবদার মেটাবার জন্য সানাই সর্বক্ষণ তটস্থ । মেয়ের কষ্ট হোক, এমন কাজ সানাই কখনও করে না । সমস্যা বাধলো পান্তা মাসিকে নিয়ে । প্রথম দিকে পান্তা মাসি অতটা ঝঞ্ঝাটে যেতো না । চোখ বুজে বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করত । কুহেলিকে ঘুম থেকে তোলা, তাকে স্কুলের সাজে সজ্জিত করে স্কুলে পাঠানো, ইত্যাদি । এইসব সংসারের টুকিটাকি কাজ সেরে সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে গাঁয়ে-গঞ্জে ছুটত বিক্রি করতে । বিক্রি শেষে নিজের বাড়ির কাজে মন দিতো । সেই পান্তা মাসি এখন আলাদা সংসার চাইছে, যেখানে কুহেলি থাকলে বলবে না । কুহেলি কীভাবে বাঁচবে সেটা তার ধর্তব্য নয় । ইতিমধ্যে পান্তা মাসি কোচবিহার গিয়েছিল । সেখানে তার নিজের বোন জুলি থাকে । কোচবিহারের মাথাভাঙায় জুলির বাড়ি । জুলির দুই মেয়ে । অল্প বয়সেই তারা বিবাহিত । পান্তা মাসি জুলির সাহায্য নিয়ে মাথাভাঙায় একটি পুরানো বাড়ির হদিস পেয়েছে । সেটা কেনার জন্য মরিয়া । বাড়িটা বাজারের মধ্যে । বাড়ির সামনের দিকটায় দোকান ঘর । তবে মেরামত দরকার ! মাথাভাঙার বাড়িটা কেনার জন্য একরকম পান্তা মাসির চাপে মাঠের জমি বিক্রি করা । বাড়িটা কেনার জন্য অগ্রিম টাকাও দিয়েছে । বাড়ি কেনার ব্যাপারে ঝুট-ঝামেলা সামলাচ্ছে জুলি । এখন বাড়ির মালিক তাগাদা দিচ্ছেন অতি সত্বর বাড়িটা রেজিষ্ট্রি করে নিতে । সেই কারণে পান্তা মাসির ছটফটানি । যেনতেনভাবে বাড়িটা কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করা । কাঞ্চন নগরে থাকলে মানুষ নানানভাবে তাদের অতিষ্ঠ করে তুলবে । নানা অছিলায় বিরক্তিকর কথা শোনাবে । তাই পান্তা মাসির পরিকল্পনা, অনেক দূরে সকলের অগোচরে বসবাস করা ।
ভাবতে ভাবতে সাইকেল নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো সানাই । বাড়ি পৌঁছে সানাই অবাক ! তার বাড়ির সামনে একটা মারুতি ভ্যান গাড়ি দাঁড় করানো । ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না । সানাই আরও কয়েকটা দিন সময় নিয়েছিল । সানাই মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত । প্রথমদিকে গোঁ ধরেছিল মেয়েটা বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পান্তা মাসির সাথে ঘর বাঁধবে । কিন্তু পান্তা মাসির পীড়াপীড়িতে বলতে বাধ্য হয়েছে মেয়েটা অন্তত একটা চাকরি পাক্ । কিন্তু পান্তা মাসির সবুর সইলো না । সানাই নির্ঘাত বুঝতে পারছে, তাকে কাঞ্চন নগরের বাড়ি ঘর ছেড়ে পান্তা মাসির হাত ধরে এখনি কোচবিহার ছুটতে হবে ।
“শিগ্গির রেডি হও । বাজারসৌ স্টেশন থেকে ট্রেন । আমি সব ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি । খাবার রেডি । খাবার খেয়ে রওনা দিতে হবে । বেশী দেরী করা যাবে না ।“ পান্তা মাসি তাগাদা দিলো ।
অগত্যা চোখের জল ফেলে পান্তা মাসির হাত ধরে কোচবিহারের উদ্দেশে পাড়ি দিলো সানাই । কাক-পক্ষীও টের পেলো না সানাই গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে কোচবিহারে চলে গেলো । এমনকি তার ভাই কানাইও জানলো না, তার দাদা কাঞ্চন নগরের মায়া ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে কোচবিহারে বাস করার জন্য পালিয়ে গেলো ।
*************************
শেষ ক্লাস শেষ হতে বিকাল গড়িয়ে গেলো । বাজারে মুদিখানার দোকানে তার কিছু কাজ ছিল । মুদিখানার দোকানে গিয়ে সেগুলি কিনতে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেলো । ভরতপুর থেকে যখন সাইকেল নিয়ে কুহেলি স্টার্ট দিলো, তখন চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে । পিঠে বইয়ের ব্যাগ । সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো বাজারের ব্যাগ । সাইকেল চালিয়ে সিসগ্রাম পার হয়ে যখন ফাঁকা রাস্তাটা ধরলো, তখন সন্ধ্যার কালো অন্ধকার নেমে এসেছে । তার সাথে স্কুলের কোনো ছাত্র বা ছাত্রী ছিল না । সকলে অনেক আগেই বাড়ি ফিরে গেছে । কুহেলি একা বাড়ি ফিরছে । রাস্তা দিয়ে মানুষজন চলাফেরা করছে ঠিকই, কিন্তু তাঁরা নিজের নিজের কাজে ব্যতিব্যস্ত । সেই কারণে তাঁরা নিজ গন্তব্যস্থানে আপন মনে হেঁটে চলছেন ।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামার জন্য কুহেলির মনের ভিতর একটা আতঙ্ক ! শীতলটা বাড়িতে নেই । বাবা-মায়ের সঙ্গে মামা বাড়ি গেছে । ফিরতে আরও দুদিন ! বাবাকে কুহেলি আর ডাকতে চাইছে না । সকাল বেলায় তার আবদার মেনে বাবা তাকে স্কুলে ছাড়তে এসেছিল । তাই কুহেলি বাবাকে সন্ধ্যাবেলায় বিব্রত করতে চাইছে না । মাথায় সাতপাঁচ চিন্তা । সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ।
আড্ডা দেওয়া ছেলেদের কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ দিগন্ত নামে একটি অল্প বয়স্ক ছোকড়া কুহেলির হাত টেনে ধরে বলল, “তুই আমাকে বিয়ে করবি । আমি তোকে সুখে রাখব ।“
কথা শুনেই কুহেলি দিগন্তের গালে টেনে এক থাপ্পড় ! তারপর শাসিয়ে দিগন্তকে বলল, “আবার আমার দিকে তাকালে তোর চোখ দুটি আমি উপড়ে ফেলে দেবো । কথাটা মনে রাখিস্ ।“
ইত্যবসরে কাঞ্চন নগরের শ্যামল কাকু মোটর বাইকে বাড়ি ফিরছিলেন । বাইকের হেড লাইটে কুহেলিকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কুহেলি, কী ব্যাপার ? তুমি ভর সন্ধ্যাবেলায় রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে কেন ? কোনো সমস্যা ?”
“না কাকু ! এরা আমার পরিচিত । আমার সঙ্গে কথা বলছিল । চলুন, আমিও রওনা দিচ্ছি ।“ কুহেলি শ্যামল কাকুর সঙ্গে রওনা দিলো । শ্যামল কাকু বাইক নিয়ে আগে চলে গেলো, আর কুহেলি পেছন পেছন সাইকেলে চললো ।
দূরের অন্ধকার থেকে একটা পরিচিত গলার আওয়াজ ভেসে এলো, “বাড়ি যা ! বাড়িতে গেলে আর রক্ষে নেই । তোকে এবার শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে !”
কথাটা শুনে কুহেলির অন্তরটা ছ্যাঁত করে উঠলো ?
খুব দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরলো কুহেলি । এ-ঘর, সে-ঘর ঘুরেও বাবাকে দেখতে পেলো না । আতঙ্কের শিহরণ তার সারা শরীরে ! তারপর অন্ধকারে চিৎকার করে ডাকলো, “বাবা ! বাবা !” নিস্তব্ধ নীরব বাড়িতে এখন শুধু কান্নার রোল ! কুহেলির বুক চাপড়ানো আর্তনাদ, “ফিরে এসো বাবা ।“
( চলবে )
বাবলা নদীর কিনারা দিয়ে মাটির রাস্তা । নদীর পশ্চিম দিকে অর্থাৎ রাস্তা ঘেঁষে প্রকাণ্ড একটি বট গাছ । সেই বট গাছের নীচে স্কুটার রাখলো । তারপর নদীর খুব কাছাকাছি গিয়ে কুহেলি ও শীতল বসলো । নদীর কিনারে বসে নদীর জলের মৃদুমন্দ ঢেউয়ের দিকে দুজন তাকিয়ে । দুজনে চুপচাপ । অল্পবিস্তর বাতাস বইছে । সেই বাতাসে নদীর জলে মৃদুমন্দ ঢেউ । বৈকালিন পরিবেশটি তাদের কাছে মনোমুগ্ধকর । একজন পুরুষের সাথে ফাঁকা জায়গায় এইভাবে পাশাপাশি বসে থাকা কুহেলির জীবনে প্রথম । শীতল এখন পুরোপুরি যুবক । দুদিন পরে কলেজে ভর্তি হবে । অন্যদিকে কুহেলি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবে । তার শারীরিক স্থিতি দেখলে যে কেউ বলবে, কুহেলি পুরোপুরি বিয়ের উপযুক্ত । এইরূপ দুজন ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে বাবলা নদীর জলের দিকে তাকিয়ে । রাস্তা দিয়ে পথ চলতি মানুষ কৌতুহলি দৃষ্টিতে কুহেলি ও শীতলের দিকে তাকাতে তাকাতে নিজ গন্তব্যস্থানে ছুটছেন । সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা নামবে । তবুও তারা নির্বিকার । পাশাপাশি চুপচাপ বসে ভাবনার জগতে নিমজ্জিত । বাড়ি ফেরার হেলদোল নেই । কুহেলির একদম বাড়ি ফেরার তাড়া নেই । শীতলও তেমনি । শীতল মনেপ্রাণে চাইছে আরও দু-দণ্ড কুহেলির পাশে বসে থাকতে । কেননা তার জীবনেও এইভাবে বসে থাকার সুযোগ এই প্রথম । তাই কুহেলির উষ্ণ স্পর্শ শীতলের মনকে উতলা করে তুলছে । তার মনের গহন গাঙে রীতিমতো চলছে কুহেলিকে ভাললাগার ঝড় । ভালবাসার তৃষ্ণায় শীতল এখন তৃষ্ণার্ত । কুহেলি এই মুহূর্তে তার পাশ থেকে উঠে যাক, সেটা শীতল কিছুতেই চাইছে না । কলেজ জীবনে প্রবেশের আগে কুহেলির স্পর্শানুভূতিতে শীতল বিভোর ।
হঠাৎ চারিদিকে অন্ধকার । কুহেলি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে । যেকনো মুহূর্তে ঝড় উঠবে । আকাশের অবস্থা ভাল না । আকাশে মেঘের অবস্থা দেখে কুহেলির ধারণা, ঝড় ও বৃষ্টি দুটোই হওয়ার সম্ভাবনা ।
শীতল তখনও বা-হাতটা কুহেলির ডান হাতের উপর রেখে ভাবনার জগতে আবিষ্ট । যদিও এতক্ষণ কুহেলির হাতের ছোঁয়ায় শীতল তার শরীরে একটা অদ্ভূত ধরনের আনন্দে মোহিত হয়েছিল । অন্যদিকে শীতলের হাতের ছোঁয়ায় কুহেলিও এক চরম আনন্দানুভূতিতে আত্মহারা ছিল । আকাশের অবস্থা অবলোকন করে কুহেলি আর স্থির থাকতে পারলো না । বাধ্য হয়ে শীতলকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “আকাশের অবস্থা ভাল না । আকাশের দিকে তাকাও । মনে হচ্ছে শীঘ্র ঝড় উঠবে !”
কুহেলির ধাক্কায় ভাবনার জগত ছেড়ে শীতল স্বভাবিক ছন্দে ফিরলো । আকাশের অবস্থা দেখে শীতল চমকে উঠলো ! তাই তো, শীঘ্র ঝড় উঠবে । ঝড় বৃষ্টির আগে বাড়ি ফিরতে না পারলে হিতে বিপরীত হবে । বলা ভাল, কুহেলির স্পর্শের স্বাদ বিঃস্বাদ হয়ে তার জীবনে নানান অশান্তি সৃষ্টি হবে । বাড়িতে অহেতুক নানান কটু কথার সম্মুক্ষীণ হতে হবে । একেই কুহেলিকে শীতলদের বাড়িতে পছন্দ করে না । তার উপর ঝড় বৃষ্টির সময় দুজনের একসঙ্গে সময় কাটানো বাড়িতে ভালভাবে মেনে নেবে না । বরং শুরু হবে নানান অশান্তি । তাই তড়িঘড়ি স্কুটি স্টার্ট দিলো শীতল । স্কুটির সিটের পেছনে কুহেলি ।
নোনাই নদীর ব্রিজ পর্যন্ত যেতে-না-যেতেই ঝড় উঠলো । ঝড়ের দাপটে স্কুটি নিয়ে তারা এগোতে পারছে না । রাস্তা সুনসান ! লোক জনের চিহ্ন নেই । ব্রিজের উপর ওঠার মুখে পঞ্চায়েত থেকে তৈরী করা একটা বসার শেড । সেটা আবার ভাঙাচোরা । ছাদের টিন উধাও । সেখানে স্কুটি দাঁড় করালো । ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি । শেডের এক কোনে দুজনে দাঁড়িয়ে । বৃষ্টির জলের ঝাপটায় দুজনে ভিজে একশা ! কুহেলিকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে শীতল কুহেলিকে কাছে টেনে নিয়ে দাঁড় করালো । কুহেলি তখন শীতলের আবদারে বাধা দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই । তাই শীতলের সমস্ত আবদারে সায় দিলো কুহেলি ।
বৃষ্টি থেমে গেছে !
চারিদিকে অন্ধকার । ব্রিজ পার হয়ে অনেকটা রাস্তা । বাড়ি ফেরার জন্য তারা ব্যাকুল ! বৃষ্টির ঠাণ্ডা জলে ভিজে কুহেলির শরীর শীতে কাঁপছে । ভেজা অবস্থায় দুজন স্কুটিতে পুনরায় উঠলো । স্টার্ট দিলো স্কুটি । বৃষ্টিতে ভেজার জন্য স্কুটি হাতে স্টার্ট নিচ্ছিলো না । শেষে পায়ে কিক্ দিয়ে শীতল স্কুটি স্টার্ট দিলো । কুহেলিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শীতল বাড়ি ফিরলো ।
বাড়িতে সানাই ও পান্তা মাসি । পান্তা মাসি আড় চোখে কুহেলির শরীরের দিকে বিশ্রিভাবে তাকালো । কুহেলির মনে হলো, শীতলের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সে খুব বড় পাপ কাজ করে ফেলেছে । অন্যদিকে সানাই ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা গলায় বলল, “এতক্ষণ তোর জন্য টেনশনে আমি ঘামছিলাম । তুই বাড়িতে ফেরায় আমি শান্তি পেলাম । তুই শিগগির ঘরে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টিয়ে আয় ।“
ঐদিকে পান্তা মাসি তড়পাচ্ছে । পান্তা মাসি সানাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেই চলেছে, “মেয়েটাকে এখন থেকে সাবধান করতে না পারলে শীঘ্র গোল্লায় যাবে । শীতলের সঙ্গে মেলামেশা আমার একদম ভাল লাগছে না । আপনি মেয়েটাকে বোঝান । নতুবা শীতল মেয়েটার অনেক ক্ষতি করে ফেলবে ।“
সানাই যত বোঝাতে চাইছে, “মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ঢুকলো । জামা কাপড় ছাড়ুক । আগে কুহেলি স্বাভাবিক হোক । তারপর এসব কথা বলা যাবে । এইসব কথা শুনলে মেয়েটা কষ্ট পাবে ।“ সানাই মেয়েটাকে কোনোভাবে কষ্ট দিতে নারাজ । কিন্তু পান্তা মাসি সমানে বকবক করেই যাচ্ছে ।
স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে কুহেলি সানাইকে বলল, “বাবা, এক কাপ চা বসাও । গরম গরম চা খেলে ঠাণ্ডাটা কমবে ।“
আমি চা বানাতে যাচ্ছি মা ।
“আপনি যাবেন কেন ? আমি বাড়িতে রয়েছি, সুতরাং আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি ।“ পান্তা মাসি সানাইকে রান্না ঘরে যেতে বাধা দিয়ে বলল ।
“না পান্তা মাসি । তোমাকে চা বানাতে হবে না । আজ চা বানাতে বাবা যাক । কেননা বাবা আদা দিয়ে সুন্দর চা বানায় ।“ কুহেলি উল্টে পান্তা মাসিকে চা বানাতে বাধা দিলো ।
ভুল বুঝলো পান্তা মাসি । তাই সানাইকে বলল, “আপনার গুণধর মেয়ে এখন আমার হাতের বানানো চা খাবে না । সবটাই আমার কপাল । আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি, এই মেয়ে আপনার কপাল পুড়াবে ।“
পান্তা মাসির কথাগুলি কুহেলির ভাল লাগলো না । সে এখন বড় হয়েছে । তার নিজস্ব বোধবুদ্ধি হয়েছে । তা ছাড়া এই মুহূর্তে সে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত । তাই পান্তা মাসিকে শুনিয়ে বলল, “তুমি আমাকে ওসব কথা কেন বলছো ? আমি বাবার কাছে বায়না ধরেছি, বাবা আমার চা বানিয়ে দেবে । আর তা ছাড়া…………!”
পান্তা মাসি প্রতি উত্তরে জানতে চাইল, “আর তা ছাড়া………?”
আর তা ছাড়া তুমি আমাদের বাড়ির কে ? যার উপর ভিত্তি করে তুমি তড়পাচ্ছো !”
কেদে দিলো পান্তা মাসি । কাদতে কাদতে পান্তা মাসি সানাইকে বলল, “তোমার মেয়ে এখন বাড়ির সর্বময় কর্ত্রী ! সুতরাং মেয়েকে আপনার কিছু বলার ক্ষমতা নেই । বরং আপনি এখন মেয়ের দাসানুদাস !”
সানাই কোন্দিকে হেলবে বুঝতে পারছে না । সানাই জানে, পান্তা মাসি ধীরে ধীরে তার হৃদমাঝারে অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে । তাই পান্তা মাসির কথা ফেলাটাও কঠিন ! অন্যদিকে মেয়েও তার একমাত্র অবলম্বন । তাকেও এড়াতে পারছে না । দুইজনের মাঝে নিরুপায় হয়ে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো ।
ঘরে ঢুকে পান্তা মাসি চা বানাতে শুরু করলো । তারপর চা নিয়ে কুহেলিকে যখন দিতে গেলো, কুহেলি রাগে চায়ের কাপ পান্তা মাসির হাত থেকে ঘরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো ।
সেটা দেখে সানাই রেগে গিয়ে ঠাস্ করে কুহেলির গালে জোরে থাপ্পড় ।
রাগে অভিমানে কুহেলি ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ।
রাত বাড়ছে । কুহেলি দরজা খুলছে না । ইতিমধ্যে পান্তা মাসি রাতে খিচুড়ি রান্না করেছে । খিচুড়ি রান্নার একটাই যুক্তি, বৃষ্টি নেমেছে । ঠাণ্ডা আবহাওয়া । সুতরাং খিচুড়ি ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মানাসই ।
কুহেলির ফোন বেজে উঠলো, “হ্যালো ! তুমি কী করছো ?”
শীতলের ফোন পেয়ে কুহেলি কেঁদে দিলো, “ঘরে শুয়ে আছি । তোমার সাথে ঘুরতে গিয়ে যতো অশান্তি ! অশান্তির মধ্যমণি পান্তা মাসি । বাবা অতটা কিছু বলেননি । কিন্তু পান্তা মাসির সেই এক কথা, শীতল বড় লোকের ছেলে । তার সাথে মিশলে আখেরে কুহেলির সমূহ বিপদ !”
অন্যদিকে শীতলদের বাড়িতে কুহেলিকে নিয়ে বিশাল হুলস্থুল । শীতল বাড়ির ঘটনাটা কুহেলিকে শোনাতে শুরু করলো, “বাবা-মা কিছুতেই তোর সাথে মিশতে দিতে চাইছেন না ।“
“কিন্তু কেন ?” উতলা হয়ে কুহেলি জিজ্ঞাসা করলো ।
তাঁদের বক্তব্য, “কুহেলি নীচ সম্প্রদায়ের মেয়ে । তা ছাড়া ওদের পূর্ব-পুরুষ ছিল ঝাড়খণ্ডে । জাতের ঠিক নেই । কুহেলি সাঁওতাল নাকি অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত ? সেটাই প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে ? তাই এই মেয়ের সাথে শীতলকে মেলামেশা বন্ধ করতে হবে । কীরকম দুঃসাহস মেয়েটার । সেদিনকার মেয়ে, শীতলকে পটিয়ে তার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া ! আস্পর্ধা কম নয় । মেয়েটার বাবাকেও জানিয়ে রাখতে হবে, যাতে কুহেলি শীতলের সঙ্গে না-মেশে ।“
কুহেলি পাল্টা প্রশ্ন করলো, “উত্তরে তুমি কী বললে ?”
“আমি নীরব রইলাম । বাড়িতে একদণ্ড ভাল লাগছে না । সবাই মিলে আমাকে তোর বিরূদ্ধে নানান অভব্য কথা শোনাচ্ছে, যেটা আমার কাছে খুবই বিড়ম্বনার !”
কুহেলি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো । শীতলদের বাড়ির কচকচলানি শুনতে কুহেলির একদম ভাল লাগছিল না । তার উপর তাদের জাত নিয়ে অবান্তর কথাবার্তা । ঈশ্বরের অশেষ করুনায় তার জন্ম । জন্ম ও মৃত্যুতে তার কোনো হাত নেই । ঘটনাচক্রে তার সাঁওতাল সম্প্রদায়ে জন্ম । অথচ সমস্ত মানুষের শরীরের অংশ বেলেট দিয়ে কাটলে রক্ত বের হবে এবং সেই রক্তের রঙ লাল ! দেশের সমস্ত স্তরের মানুষের রক্ত লাল হলে, সমাজ ব্যবস্থায় এত ভেদাভেদ কেন ? জাতপাত নিয়ে এত সোরগোল কেন ? এটাই কুহেলির মাথায় ঢুকছে না ! তার মতে, সমস্ত মানুষের একটাই জাত হওয়া উচিত, সেটা হচ্ছে মনুষ্যজাতি বা মানবজাতি !
বাবার ডাকে ঘর থেকে বের হলো, কিন্তু রাত্রিবেলায় খিচুড়ি না খেয়ে শুয়ে পড়লো । কুহেলির শুয়ে পড়া ভালভাবে নিলো না পান্তা মাসি । পান্তা মাসি সানাইয়ের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগলো । এমনভাবে কানের কাছে পান্তা মাসি কুহেলির বিরূদ্ধে সানাইয়ের কান ভারী করছে তাতে কুহেলির দেখে মনে হয় পান্তা মাসি সানাইয়ের বিবাহিত স্ত্রী ।
তারপর………………?
তারপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো । মাধ্যমিক রেজাল্ট বের হলো । কুহেলির স্টার মার্ক । সানাই মেয়ের রেজাল্ট দেখে খুব খুশী । তার বারবার মনে হচ্ছে কুহেলির মা বেঁচে থাকলে সে ভীষণ খুশী হতো । পান্তা মাসি শুধুমাত্র জানে, পরীক্ষায় পাশ । স্টার মার্ক সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই । তাই পান্তা মাসির কাছে কুহেলি শুধুমাত্র মেট্রিক পাশ করেছে । তাতে তার কোনো তাপ-উত্তাপ বা আনন্দ নেই ।
পান্তা মাসি ইতিমধ্যে সানাইয়ের জীবনে অনেকখানি জায়গা করে নিয়েছে । ইতিমধ্যে বার কয়েক সানাইকে বলা হয়ে গেছে, পান্তা মাসিকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য । কিন্তু সানাই আমতা আমতা করছে । তার মনে এখনও দ্বিধা ! কেননা সে মেয়েকে খুব ভয় পায় । পান্তা মাসির জন্য মেয়েটা বিগড়ে গেলে মেয়েকে নিয়ে তার আশার জলাঞ্জলি । সানাই চায়, তার মেয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষিত হোক । মানুষের মতো মানুষ হোক । তাই পান্তা মাসির ঘ্যানঘ্যানানিতে কর্ণপাত করছে না সানাই ।
( চলবে )
সানাই বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি ডাল সেদ্ধ ও ভাত নামিয়ে দিলো । গরম গরম সেদ্ধ ভাত খেয়ে কুহেলি স্কুলে গেলো । টিফিন বানিয়ে দেওয়ার মতো ঘরে কিছু ছিল না । তাই টিফিন ছাড়াই কুহেলিকে স্কুলে যেতে হলো । ক্লাসে ভাল ছাত্রী না হলেও পড়াশুনায় গতানুগতিক । তবুও সে ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে । কুহেলি আর পাঁচটা মেয়ের মতো চঞ্চল বা ছট্ফটে নয় । নিজস্ব ঢঙে স্বাভাবিক ছন্দে জীবন যাপন করে । কো-এডুকেট স্কুল । ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে পড়াশুনা । গ্রামবাংলার মধ্যে হাই স্কুল । এতদিন জুনিয়র হাই ছিল । সম্প্রতি মাধ্যমিক পর্যন্ত উন্নীত । উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার ক্ষেত্রে ভরতপুর হাই স্কুল । তারপর কলেজ সালারে । কুহেলি সাইকেলে হাই স্কুল যায় । বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার । তবে গাঁয়ের রাস্তা হলেও পাকা রাস্তা । পাকা রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাতায়াতে সমস্যা নেই । কাঞ্চন নগরের অন্যান্য ছেলে-মেয়ে সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে । সুতরাং স্কুলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কুহেলির কোনো সমস্যা নেই । কুহেলি কুছুটা চুপচাপ ! কুহেলি ক্লাসের ছেলে-মেয়ের সাথে ততটা খোলামেলা নয় । নিজেকে সর্বদা গুটিয়ে রাখে । তবুও ক্লাসের মধ্যে বিবেক ছেলেটি তার ভাল বন্ধু ।
কুহেলির চালচলনে সীমাবদ্ধতা দেখে ক্লাসের বিবেক একদিন জিজ্ঞাসা করলো, “কিরে কুহেলি ! তুই আমাদের সাথে খেলতে যাস না কেন ? স্কুল মাঠে সবাই খেলতে গেলে তুই চুপচাপ ক্লাসে বসে থাকিস কেন ? তা ছাড়া তুই কেমন যেনো নিজেকে গুটিয়ে রাখিস ! এটা ঠিক নয় । সবার সঙ্গে হেসে-খেলে মিশবি । দেখবি তোর মন ভাল থাকবে ।“
উত্তরে কুহেলি বলল, “আমার ভাল লাগে না । আমি নীচু জাতের মেয়ে । সকলে আমার সঙ্গে মিশতে ততটা আন্তরিক নয় ! তাই চুপচাপ ক্লাসেই বসে থাকি । তবে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে গাঁয়ের মাঠে খেলতে যাই । সেখানে গাঁয়ের সব বন্ধুদের সাথে খেলি ।“
“নীচু জাতের হলেও তুই তো মানুষ । তুই আমাদের বন্ধু । সুতরাং কখনও হীনমন্যতায় ভূগবি না । যতটা পারবি, মনের আনন্দে হৈচৈ করে সময়টা কাটিয়ে দিবি । এখন চল, মাঠে খেলবি !” বিবেক কুহেলিকে জোর দিলো ।
কুহেলির আচরণ সেইরকম ! মাঠে যাওয়ার হেলদোল নেই । তাই বিবেককে বলল, “তোরা মাঠে যা । আমি পরে আসছি ।“
অগত্যা বিবেক বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে শুরু করলো । বিবেক জানে কুহেলিদের পরিবার ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছে । তারা সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত । কুহেলির দাদুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় কঞ্চন নগরের ঘনশ্যাম ঘড়ামী । ঘনশ্যাম ঘড়ামীর পরামর্শে তাদের পরিবার কাঞ্চন নগরে বসবাস শুরু করে । সেই সময় ঝাড়খণ্ডে তাদের গ্রামে তীব্র অভাব অনটন শুরু হয়েছিল । তা ছাড়া গাঁয়ে শুরু হয়েছিল মহামারী । মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপে পড়ে গ্রামের মানুষেরা । সেই সময় বাঁচার তাগিদে কিছু মানুষ অসমের বিভিন্ন জায়গার চা বাগানে কাজের খোঁজে ছুটে গিয়েছিল । তারা আজও ঝাড়খণ্ডে ফেরেনি । কিন্তু কুহেলির দাদু ডেরা বাঁধে কাঞ্চন নগরে । জাতে সাঁওতাল হলেও বর্তমান সময়ে কেউ তাদের সাঁওতাল হিসাবে জানে না । গ্রামটা আগাগোড়া কায়েত পাড়া, তাই আশেপাশের গ্রামের মানুষজন জানে কাঞ্চন নগরে যারা বাস করে তারা প্রায় সকলে কায়েত । হাতে গোনা গোটা কয়েক পরিবার নীচু সম্প্রদায়ভুক্ত । অনেক খাটাখাটুনি করে কুহেলির দাদু কাঞ্চন নগরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে । মাঠে চাষের জমি বাড়ায় । কমপক্ষে পয়তাল্লিশ বিঘে চাষের জমি । কাঞ্চন নগরে আসার পর অতো সহজে তারা দাঁড়াতে পারেনি । কুহেলির দাদুকে অনেক ঝড়ঝাপ্টা পোহাতে হয়েছিল । দাদুকে প্রথমে গাঁয়ে গাঁয়ে মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়েছিল । তারপর ধান সেদ্ধ করে চাল তৈরীর ব্যবসা । আস্তে আস্তে তিন খানা গাই গরু কিনে দুধের ব্যবসা ! দুধ বিক্রি করে টাকা উপার্জন । প্রথমে মাঠে জলাশয় ঘেঁষে দশ বিঘে জমি । সেই জমিতে চাষ আবাদ করে কুহেলির দাদুর বাড়-বাড়ন্ত ।
কুহেলির ঠাকুমার চিকিৎসার জন্য বিঘে পাঁচেক জমি বিক্রি করতে হয়েছিল । দাদুর আগে ঠাকুমা বিদায় নিয়েছিলেন । দাদু বেঁচে থাকতে সানাই ও কানাইকে সমান ভাগে চাষের জমি ভাগ করে দিয়ে গেছেন । কানাই অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল । সানাই কিছুটা আলস্যের কারণে সংসারে উন্নতি করতে পারেনি । তার উপর পত্নী বিয়োগ হওয়ার পর সানাই ঘাম ঝরা পরিশ্রম একদম করে না । চাষের জমিতে যেটুকু ফসল হয় তাতেই সানাইয়ের সংসার ভালভাবে চলে যায় । যদিও তার অর্ধেক জমি ভাগে দেওয়া । সেখান থেকে অর্ধেক ফসল তার ঘরে ঢোকে । বাপ-বেটি তাদের ঠিকঠাক চলে যাচ্ছে । সেইজন্য সানাই বেশী খাটতে রাজি নয় । অন্যদিকে কানাই দিন রাত পরিশ্রম করে নিজে চাষ করার জন্য আরও কয়েক বিঘা চাষের জমি ইতিমধ্যে বাড়িয়েছে । তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে । সানাইয়ের আগে কানাইয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয় । কানাইয়ের ভরা সংসার । বাড়িতে চাষবাসের প্রচুর কাজকর্ম । কানাইয়ের দুই ছেলে স্কুলে যাওয়ার নাম করেনি । তাই তারা চাষের কাজে নিয়োজিত । ফলে কানাইয়ের স্বচ্ছল পরিবার ।
কাঞ্চন নগর গ্রামে জাতপাত নিয়ে কচলাকচলি তুঙ্গে । ছোট্ট একটি গ্রাম । অথচ মানুষের মধ্যে জাতপাত প্রথা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । গ্রামের অনেক অনুষ্ঠানে ঘড়ামি, জেলে, কামার, সাঁওতালদের পরিবারেরা নিমন্ত্রিত হয় না । বরং বলা চলে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের নিমন্ত্রণ করা হয় না । ছোঁয়াছুঁয়িতে জাত যেতে পারে । এই অছিলায় তাদের ব্রাত্য রাখে । এটা এখন সানাইদের কাছে গা-সওয়া ! তাই গ্রামের মানুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া সানাই মেশে না ।
তারপর…………
তারপর বিবেক লক্ষ্য করলো কুহেলি গুটি গুটি পায়ে মাঠে ঢুকছে । তখন বিবেক বল নিয়ে মাঠে খেলছিল । খেলা বন্ধ রেখে কুহেলিকে বলল, “এতক্ষণে তোর মাঠে আসার সময় হলো ।“
শুনে কুহেলি এক ঝলক হাসি দিয়ে বলল, “তোকে আগেই বলেছি স্কুলের খেলার মাঠে আসতে আমার ভাল লাগে না ।“
টিফিন টাইম শেষ । ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠলো । সবাই ক্লাসে ছুটলো । পরের ক্লাসটা ভুগোল মাস্টার মশাইয়ের । কিন্তু জানা গেলো ভুগোলের মাস্টার মশাই স্কুলে আসেননি । তাই ইংরেজির মাস্টার মশাই ক্লাস নেবেন । ইংরেজি কুহেলির প্রিয় বিষয় । ইংরেজি পড়তে ও লিখতে কুহেলির খুব ভাল লাগে । ক্লাসে স্যার ঢুকেই কুহেলিকে খোঁজ করলেন । বোর্ডে গরু নিয়ে দশ লাইন লিখতে বললেন । লিখতে গিয়ে দুটো বানান ভুল করলো কুহেলি । তার জন্য শাস্তি হিসাবে মাস্টার মশাই কুহেলিকে ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসতে বললেন । তারপর বানান দুটো সুন্দরভাবে স্যার বুঝিয়ে দিলেন । পরেরদিন সবাইকে “আমাদের দেশ” নিয়ে দশ লাইন লিখে আনতে বললেন । মাস্টার মশাই চলে গেলেন । তারপর আরও দুটি ক্লাসের পর স্কুল ছুটি হলো । ছুটির পর বাড়ি ফিরে কুহেলি দেখলো, পান্তা মাসি তাদের বাড়িতে । তার বাবার সঙ্গে গল্প মস্করায় মত্ত । বাবার সঙ্গে পান্তা মাসির ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা কুহেলির একেবারেই না-পসন্দ ! তাই পান্তা মাসির আগমন কুহেলির ভাল লাগলো না । সোজা ঘরে ঢুকে বইয়ের ব্যাগটা রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলো ।
সানাই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল, কুহেলি পান্তা মাসিকে পছন্দ করে না । তবুও মেয়ের অপছন্দকে আমল দিতে চাইনি সানাই । উল্টে সানাই ভেবেছিল, কুহেলিকে ভালভাবে বুঝিয়ে বললে পান্তা মাসির প্রতি তার রাগ কমে যাবে । পান্তা মাসি স্বেচ্ছায় বাড়ির কাজকর্ম করে দিচ্ছে । রান্না করে দিচ্ছে । যার জন্য তাদের সংসারে অনেকটাই সুরাহা ! তা ছাড়া পান্তা মাসি নিয়ম করে কুহেলিদের বাড়ি আসে । রান্না করা ছাড়াও ইদানীং দু-দণ্ড বসে কুহেলির বাবার সঙ্গে নানান বিষয়ে শলা-পরামর্শ করে । সানাই ক্রমশ ঘর গৃহাস্থলির ব্যাপারে পান্তা মাসির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে । অন্যদিকে কুহেলি ক্রমশ বড় হচ্ছে । সে এখন ক্লাস এইটে । সানাই চাইছে, তার মেয়ে পড়াশুনায় ভাল হোক । কুহেলির জন্য এখন তিনজন প্রাইভেট মাস্টার । পাশের গ্রাম সিসগ্রাম থেকে একজন অঙ্কের মাস্টার বাড়ি এসে পড়ায় । আর বাকী দুজন মাস্টারের বাড়ি গিয়ে কুহেলি পড়ে আসে । সাইকেলে যাতায়াত । সকালে একজন এবং সন্ধ্যাবেলায় অন্যজন । সকালে বিজ্ঞানের বিষয় ছাড়াও বাংলাটাও শেখে । অন্যদিকে সন্ধ্যাবেলায় ইংরেজি । সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরার সময় কুহেলির সঙ্গে সানাই থাকে । প্রচুর পরিশ্রম করার জন্য কুহেলি ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলো । কুহেলির রেজাল্ট দেখে সানাই খুব খুশী । মেয়ের মাথায় হাত রেখে সানাই গর্বের সঙ্গে বলল, “তুই যতোদূর ইচ্ছা পড়বি । আমি তোকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবো । সমাজে তুই মাথা উঁচু করে বাঁচবি, আমি সেটা দেখে যেতে চাই ।“ এই কথা বলার পর সানাইয়ের চোখে জল ।
বাবা ! তুমি কাদছো ?
তোর মায়ের জন্য মন খারাপ । তোর মা বেঁচে থাকলে রেজাল্ট দেখে তোর মা খুব খুশী হতো । তারপর বিড়বিড় করে বলল, মেয়েটাকে জন্ম দিয়ে অকালে বিদায় নিলো । অথচ মেয়েটার বড় হওয়া দেখে যেতে পারলো না ! অদৃষ্টের কী নিষ্ঠুর পরিহাস !
নবম শ্রেণীতে ওঠার পর কুহেলির পড়াশোনার চাপ আরও বেড়ে গেলো । সংসারের কাজ করতে সময় পায় না বললেই চলে । স্কুল ও প্রাইভেট টিউশন নিয়ে কুহেলি নাজেহাল । তাই রীতিমতো ভীষণ ব্যস্ত । ঘরের কাজ ও চাষের কাজ একসঙ্গে চালাতে গিয়ে সানাইয়ের হিমসিম অবস্থা ! সানাই ঘরের কাজের জন্য একটু বেশীমাত্রায় পান্তা মাসির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লো । পান্তা মাসির সঙ্গে সানাইয়ের মেলামেশা নিয়ে গাঁয়ে গুঞ্জন অহরহ । সবচেয়ে বেশী ফ্যাসাদে পড়তে হচ্ছে কুহেলিকে । কুহেলির স্কুলের বন্ধুরা পান্তা মাসিকে নিয়ে নানান ধরনের তির্যক মন্তব্য করে । সেদিন স্কুলে যাওয়ার সময় গ্রামের কায়েত বাড়ির মনিটুসি বলে কিনা পান্তা মাসি তোর বাবাকে বিয়ে করে ঘর সংসার বাঁধতে চায় । স্কুল থেকে ফেরার সময় গাঁয়ের চৌধুরী বাড়ির মধ্য বয়স্ক ফুল কাকিমা কুহেলিকে জিজ্ঞাসা করলো, “সবজি বিক্রি করে বিধবাটা তোদের বাড়িতে কেন ঘোরাঘুরি করে ? সকালবেলায় ঢুকে বেলা গড়িয়ে গেলেও বাড়ি থেকে বের হওয়ার নাম করে না । আবার সেই সময় তোর বাবাও বাড়ি থেকে কোথাও বের হবে না । ব্যাপারটা কী ?” কুহেলির এইসব কথা একদম ভাল লাগে না । বাবার নামে কেউ কুৎসা রটাক, সেটা কুহেলির না-পসন্দ । অথচ পান্তা মাসিকে বলতেও প[রছে না, “তুমি আমাদের বাড়ি আসবে না ।“ বাবাকে জড়িয়ে পান্তা মাসিকে নিয়ে লোকের বলাবলি, গাঁয়ে আনাচে-কানাচে গুঞ্জন কুহেলির শিশু মনে খুব আঘাত করে । তবুও চুপচাপ থাকে একটাই কারণে, পান্তা মাসি বাড়িতে আসার জন্য ঘর-সংসারের কাজে অনেক সুরাহা ।
তারপর অনেকদিন কেটে গেলো ……………………
সামনে কুহেলির মাধ্যমিক পরীক্ষা । পড়াশুনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত । অন্যদিকে শীতলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা । তবুও ইতিমধ্যে কুন্তল বাড়িতে এসে কুহেলির পরীক্ষার খোঁজ খবর নিয়ে গেছে । আসলে শীতলদের বাড়ি থেকে কেউ মনেপ্রাণে চায় না , শীতল কুহেলির সঙ্গে মিশুক । শীতলেরা বনেদী পরিবার । শীতলের বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক । মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা । অনেক জমি জায়গা । তা ছাড়া কুহেলি সাঁওতালদের মেয়ে । বড় বংশের ছেলে হয়ে কেন সে নীচু বংশের মেয়ের সঙ্গে মিশবে ? উপরন্ত, তার মা নেই । মা না থাকলে শীতলদের পরিবারের ধারণা, মা-হারা মেয়ে খুব সহজে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে । সুতরাং শীতলদের পরিবার গোড়া থেকেই কুহেলির সঙ্গে শীতলের মেলামেশা বন্ধ করতে মরিয়া । কিন্তু শীতল এইসব নিয়ে একটুকু গুরুত্ব দিতে নারাজ । কুহেলির প্রতি পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক, শীতলের কুহেলিকে তার ভাল লাগে । তাই কুহেলির প্রতি শীতলের টান অফুরন্ত । তার মনের গহন গাঙে এখন শুধু কুহেলি বিরাজমান !
মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়লো ভরতপুর হাই স্কুলে । পরীক্ষা দেওয়ার সময় প্রতিদিন কুহেলির সাথে তার বাবা সঙ্গে যাচ্ছে । একা একা পরীক্ষার সময় কুহেলিকে ছাড়তে সানাই নারাজ । গরম ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া এবং সঙ্গে টিফিন বাক্স । বাড়ির পাহাড়ায় থাকছে পান্তা মাসি । ভরতপুরে সাইকেলে যাতায়াত । কাঞ্চন নগরের সকল ছেলেমেয়ের সাথে কুহেলির ভরতপুরে যাতায়াত । তাই যাতায়াতে কোনোরকম অসুবিধা হচ্ছে না । হৈচৈ করে পরীক্ষা দিতে যাওয়া । অন্যদিকে কুহেলির মাধ্যমিক পরীক্ষা খুব ভাল হচ্ছে । তবে ভুগোল পরীক্ষা ভাল দেয়নি । ইংরেজি প্রশ্নের ক্ষেত্রে পাঁচ নম্বর উত্তর দিতে পারেনি । অঙ্কেও তেমনি । চার নম্বর ছাড়তে হয়েছে । তাতে কুহেলির ধারণা সে স্টার মার্ক রাখতে সক্ষম হবে । পরীক্ষা দিয়ে কুহেলি খুব খুশী ।
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ ! কুহেলি এখন চাপমুক্ত ! অনেক হাল্কা ।
পরীক্ষার পর কুহেলির অফুরন্ত সময় ! অন্যদিকে শীতলও তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা খুব ভাল দিয়েছে । শীতল স্কুলে ভাল ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম । সুতরাং শীতলের পরীক্ষা ভাল হবে সেতা কুহেলি জানতো । পরীক্ষার পর শীতল এখন ঘন ঘন কুহেলির সাথে মিশতে শুরু করলো । পান্তা মাসি আবার কুহেলির সাথে শীতলের মেলামেশাটা পছন্দ করে না । পান্তা মাসির ভয়, “কুহেলি বড় হয়েছে । এখনও তার বোধবুদ্ধি সেভাবে পাকেনি । শীতলেরা বড় লোক । গরীব মানুষের মেয়ের সাথে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করে পরে তাকে চিনতে পারবে না । ঠিক মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়ার মতো । চা খাওয়া হয়ে গেলে মাটির ভাঁড় দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চম্পট । সেই ক্ষেত্রে কুহেলির সর্বনাশ ছাড়া ভাল কিছু হবে না । তাই পান্তা মাসি সানাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কুহেলি যেনো শীতলের সঙ্গে না মেশে ।“ এখানেই কুহেলির বড্ড রাগ ! পান্তা মাসি কেন কুহেলির ব্যক্তিগত জীবনের নানান ব্যাপারে নাক গলাবে ? সে এখন অনেক বড় । মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে । নিজেকে অনেক বুঝতে শিখেছে । নিজের ভাল-মন্দের ব্যাপারে এখন অনেক বেশী সজাগ ! সুতরাং তার জীবনের চলার পথের ক্ষেত্রে কেউ নাক গলাক, কুহেলির সেটা না-পসন্দ ।
সেদিন রবিবার । বাবা গিয়েছে সালারে । গ্রীষ্মের ধান চাষের জমিতে কীট-পোকা লেগেছে । তার জন্য কীট-নাশক ঔষধ দরকার । সেটা পাওয়া যায় সালারের কৃষি ভাণ্ডার দোকানে । ফিরতে বেলা গড়িয়ে যাবে । কেননা বাড়ি থেকে সাইকেলে ভরতপুর এবং তারপর ভরতপুর থেকে বাসে সালার । যদিও রাস্তা এখন ভাল । ভরতপুর থেকে সালার পৌঁছানো খুব বেশী সময় লাগে না । সালারে কাজ সেরে পুনরায় ভরতপুর । ভরতপুরে কিছু দোকান-বাজার রয়েছে । সেগুলো সেরে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরী । তাই বিকালবেলা কুহেলি ভাবলো, শীতলের সঙ্গে ঘুরতে বের হবে । শীতল ভাল স্কুটি চালায় । ওর স্কুটিতে বাবলা নদী পর্যন্ত যাবে ।
ফোন করলো শীতলকে । শীতল ফোন পেয়েই প্রথমে তার পাল্টা প্রশ্ন, “তুই কী ফোন কিনেছিস ?”
তুই কী পাগল হয়েছিস, আমি ফোন কিনবো কোথা থেকে ?
তবে এই ফোন নম্বরটা কার ?
ফোন ও ফোন নম্বর দুটোই আমার । মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাবা কিনে দিয়েছেন । আগেই বলেছিলেন, মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেলে মোবাইল কিনে দেবেন । সেই কথা রাখতে, বাবা মোবাইলটা গতকাল আমাকে দিয়েছেন । মোবাইলটা বাবা বেশ কিছুদিন আগে বহরমপুর থেকে কিনেছিলেন । কিন্তু আমাকে বলেননি । পাছে আমার পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে । তাই মোবাইল কিনে সযত্নে ঘরে রেখে দিয়েছিলেন । বলতে পারিস, ফোন থেকে প্রথম ফোন তোকে করলাম । তবে একটা ফোন গতকাল করেছিলাম, সেটা মামার কাছে । বাবা বললেন, মামাকে একটা ফোন করে কথা বলতে । সেই সময় একমাত্র মামাকে একটা ফোন করেছিলাম । তিনি আমার ফোনের কথা শুনে খুব খুশী ।
এবার বলুন ম্যাডাম, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি ?
আমার সঙ্গে ঘুরতে যেতে হবে ।
ঘুরতে ? কিন্তু কোথায় ঘুরতে যাবি ?
তুই স্কুটি নিয়ে আসবি । স্কুটিতে বসে সিদ্ধান্ত নেবো, কোথায় যাবো ?
ঠিক আছে ম্যাডাম । এখন বিকেল তিনটে । আমি চারটের মধ্যে তোর বাড়ি হাজির হচ্ছি । রেডি থাকবি কিন্তু !
আচ্ছা বেশ ! আমি রেডি থাকবো ।
তারপর দুজনে লোহাদহের ঘাটে । বাবলা নদীর পারে । হরিনগরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় স্কুটি দাঁড় করালো । এবার শীতল ভাল করে কুহেলির দিকে তাকিয়ে দেখলো, কুহেলি আর সেই ছোট্ট কুহেলি নেই । এখন সে দস্তরমতো বড়োসড়ো মেয়ে । দেখতে কলেজ পাশ করা মেয়ের মতো দেখতে । কুহেলির চেহারার বাধন চিত্তাকর্ষক । অনেক লম্বা । হাসলে গালে টোল পড়ে । তাতে কুহেলিকে দেখতে বেশ লাগে । শীতল অবাক দৃষ্টিতে কুহেলির দিকে তাকিয়ে রইলো । শীতল কুহেলির উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না ।
শীতলের তাকিয়ে থাকা দেখে কুহেলি চোখের ইশারায় বলল, “ঐভাবে তাকিয়ে কী দেখছো ?”
শীতল কোনোরকম রাখঢাক না করে বলেই ফেললো, “আজ তোকে দেখতে ভীষণ ভীষণ ভাল লাগছে ।“
শীতলের মুখে কুহেলি তার রূপের প্রশংসা শুনে আবেগে উৎফুল্ল । অন্যদিকে লজ্জায় কিছুটা আড়ষ্ঠ ! তবুও তার মনের ভিতর শীতলের মিষ্টি কথাগুলি তোলপাড় করছে, “তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে !”
(চলবে)
সানাই কানাই দুই ভাই । সানাই বড় ও কানাই ছোট । সানাইয়ের মেয়ে কুহেলি । কাঞ্চন নগরে তাঁদের বাড়ি । দুই ভাইয়ের পাশাপাশি বসবাস । বেঁচে থাকতে সানাইয়ের বাবা জমি-জায়গা দুজনকে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছেন । সানাইয়ের বেশী বয়সে বিয়ে । সেইজন্য বিয়ের অনেক বছর বাদে তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান, কুহেলি । সানাইয়ের জীবনে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, কুহেলি জন্ম নেওয়ার সময় তার স্ত্রী বিয়োগ । স্ত্রীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল সানাই । কিন্তু কিছুটা ডাক্তারদের অবহেলার কারণে কুহেলির মায়ের অকাল বিয়োগ । সেই থেকে সানাই মনমরা ! তবুও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সানাইয়ের বাঁচার স্বপ্ন !
কিন্তু সমস্যা অন্যত্র । সমস্যা শুরু হলো কুহেলির পান্তা মাসিকে নিয়ে । পান্তা মাসি অল্প বয়সে বিধবা । পাশের গ্রাম সুরেশপুরে তার বাড়ি । প্রতিদিন সবজি বোঝাই ঝুড়ি মাথায় নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে বিক্রি । সবজি বিক্রি করে তার সংসার । পান্তা মাসির একটাই মেয়ে । অল্প বয়সে সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ের শ্বশুর বাড়ি ভরতপুরে । ভরতপুর ব্লক অফিসের পাশে জামাইয়ের চায়ের দোকান । চায়ের দোকান খুব চালু । ভাল ঘরে মেয়ের বিয়ে হওয়ায় পান্তা মাসির খুব শান্তি ! জামাই খুব কর্মঠ । ব্যবহার আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে আলাদা । মার্জিত স্বভাব ! সর্বোপরি জামাই পান্তা মাসিকে মায়ের চেয়েও বেশী শ্রদ্ধা করে । মেয়ে বিয়ে দিয়ে এইজন্যে পান্তা মাসির মনে খুব শান্তি । মেয়েটা অন্তত সুখে শান্তিতে বাকী জীবন কাটাতে পারবে !
মেয়ের বিয়ের পর থেকে পান্তা মাসি বাড়িতে একা । সারাদিন মাথায় ঝুড়ি নিয়ে এ-গাঁয়ে সে-গাঁয়ে ঘোরাঘুরি । গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে তার সবজি বিক্রি । দিনের শেষে তিন-চারশ টাকা লাভ । তাতেই পান্তা মাসির শান্তি । কেননা পান্তা মাসি অল্পতেই সন্তুষ্ট ।
কুহেলি হাই স্কুলে ভর্তি হলো । ক্লাস ফাইভে । কুহেলির মুখটা ভীষণ মিষ্টি । গাঁয়ের লোকজন প্রায়শই বলে, দুর্গা মায়ের মুখটা কুহেলির মুখে বসানো । তার নাকি প্রতিমার মতো সুন্দর মুখশ্রী । আপশোশ করে বয়স্ক মহিলারা বলেন, কুহেলির মা তাঁর মেয়েটার সুন্দর মুখশ্রী দেখে যেতে পারলো না । মুখপুড়িটা মেয়েকে জন্ম দিয়ে বিদায় নিলো ।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে পান্তা মাসির কুহেলিদের বাড়ি ঘন ঘন যাতায়াত । বাড়ি থেকে বেরিয়ে পান্তা মাসি সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে প্রথমেই কুহেলিদের বাড়ি । সেই সময় কুহেলি ঘুম থেকে ওঠে । অন্যদিকে তার বাবা প্রাতর্ভ্রমণ সেরে বাড়ির দাওয়ায় বসে । পান্তা মাসি সানাইকে দেখতে পেলে সবজির ঝুড়ি নামিয়ে তাদের রান্না ঘরে ছোটে । চা বানিয়ে প্রথমে কুহেলির বাবাকে খাওয়ায় । তারপর কুহেলির জন্য টিফিন বানিয়ে দেওয়া । কাজের খুব চাপ না থাকলে, পান্তা মাসি কুহেলিদের দুপুরের রান্না বানিয়ে, তারপর সবজি বিক্রি করতে পাড়ায় ছোটে ।
রান্না ঘরে ঢোকার জন্য কুহেলির বাবার সঙ্গে পান্তা মাসির ঘনিষ্টতা ক্রমশ বাড়তে থাকে । সকাল আটটার মধ্যে কুহেলিদের বাড়ি ঢুকে নিজের বাড়ির মতো পান্তা মাসির কাজ শুরু হয়ে যায় । শোয়ার ঘরের বিছানা তোলা । ঘর-দোর ঝাঁট দেওয়া । কুহেলির যত্ন নেওয়া । কুহেলিকে স্কুলে যাওয়ায় আগে যেমন স্কুল ব্যাগ, স্কুলের জন্য আলাদা টিফিন, ইত্যাদি গুছিয়ে দেওয়া । সকালের চা-জলখাবারের পর্ব শেষ হয়ে গেলে দুপুরের রান্নায় মন দেয় । প্রতিদিন জেলেরা গাঁয়ে মাছ বিক্রি করতে আসে । তাদের কাছ থেকে নিজে মাছ কেনে পান্তা মাসি । ডাল ছাড়া প্রতিদিন মাছের ঝোল ও একটা সবজির তরকারি রান্না করা চাই । তবে রান্না করার পর নিজে কিছুতেই খাবে না । পান্তা মাসিকে খাওয়ার জন্য সানাই অনেক অনুরোধ করেছে । কিন্তু তার একটাই কথা, মা-মরা মেয়েটার কথা ভেবে আমার রান্না করা । তার মুখে দু-মুঠো খাবার তুলে দিতে পারছি, এটাই আমার শান্তি ! আমাকে খেতে বলবেন না প্লীজ, আমি খেতে পারব না । দুপুরের রান্না শেষ করে পুনরায় ঝুড়ি মাথায় পান্তা মাসি সবজি বিক্রি করতে পাশের গ্রামে ছোটে ।
একদিন কৌতুহলবশত কুহেলি পান্তা মাসিকে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি আমাদের বাড়ি এত কাজ করো কেন ? এতে তোমার খাটুনি বাড়ে বই কমে না । আমাদের বাড়িতে পরিশ্রম করে তোমার কী লাভ ?”
ফ্যাকাশে মুখে পান্তা মাসি কিছুক্ষণ কুহেলির দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি দিয়ে কান্তা মাসি বলল, “তুই এই খাটুনির মর্ম বুঝবি না । বড় হলে বুঝতে পারবি ।“
ভরা বৈশাখ মাসে প্রখর তাপের মধ্যে গাঁয়ে ঘুরেঘুরে কাজ করার জন্য পান্তা মাসি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো । সেই সময় কুহেলি লক্ষ্য করলো, “তার বাবা খুব মনমরা । সকালে ওঠে আগের মতো প্রাণচঞ্চল নয় ! সকালে হাঁটতে বের হয় না । বাড়িতে মনমরা হয়ে বসে থাকে ।“ কুহেলি কাকীমার কাছে জানতে পারলো, সে স্কুলে বেরিয়ে গেলে তার বাবা পান্তা মাসির বাড়ি যায় । তাকে ডাক্তার দেখানো, ঔষধ কেনা, রান্না করা, সবকিছু করে দিয়ে বাড়ি ফেরে । ফলে তার বাবার দুপুরের খাবার খেতে নাকি বেলা তিনটে গড়িয়ে যায় । কাকীমার কাছে এতকথা শুনলেও কুহেলি বাবাকে কিচ্ছুটি জিজ্ঞাসা করে না । তবে কয়েকদিন যাওয়ার পর কুহেলি তার কৌতুহল চেপে রাখতে পারলো না । তাই বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা ! পান্তা মাসির কী হয়েছে ?” উত্তরে মনমরা সুরে সানাই বলল, “তোর পান্তা মাসির টাইফয়েড জ্বর হয়েছে ।“
ডাক্তার কী বলল ?
“জ্বর এখন নিয়ন্ত্রণে ।“ ডাক্তারবাবু বললেন । তবে তোর পান্তা মাসিকে দেখভালের জন্য একটা লোক দরকার । আর তা ছাড়া তাকে নিয়মিত দামী দামী ফল খাওয়ানো খুব প্রয়োজন !
“তুমি চিন্তা করো না বাবা । পান্তা মাসি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে ।“ বাবাকে সান্ত্বনা দিলো কুহেলি ।
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে এ-ঘর ও-ঘর খুঁজেও বাবাকে পাচ্ছে না কুহেলি । বাবা কোথায় গেলো ? ভয় পেয়ে গেলো কুহেলি । বাবা তাকে না জানিয়ে কোথাও যায় না । কাঞ্চন নগরের শেষ মাথা দিয়ে একে-বেঁকে গেছে নোনাই নদী । দীর্ঘদিনের নোনাই নদী । এই নদীতে গ্রীষ্মকালে ভাল মাছ পাওয়া যায় । কুহেলি জানে, কারণে-অকারণে বাবা মাঝে মাঝে নোনাই নদীর পারে গিয়ে বসে থাকে । তাই কুহেলি ভাবলো, বাবা সম্ভবত নোনাই নদীর পারে গিয়ে বসে থাকতে পারে । তাই কুহেলি হাঁটতে হাঁটতে নোনাই নদীর পারে গিয়ে উপস্থিত । নোনাই নদীর পারে গিয়ে কুহেলি দেখলো, গাঁয়ের অনেক মানুষ সেখানে রয়েছেন । অনেকে খেপলা জালে নদীতে মাছ ধরছে । অত লোকের মাঝে কোথাও তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না । হতাশ হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো কুহেলি ।
রাস্তায় শীতলের সঙ্গে দেখা ।
“এত সকালে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় চললি ?” জিজ্ঞাসা করলো শীতল ।
নোনাই নদীর পারে গিয়েছিলাম, এখন বাড়ি ফিরছি ।
হঠাৎ নোনাই নদীর পারে কেন ?
ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা বাড়িতে নেই । তাই ভাবলাম, বাবাকে নদীর পারে পাওয়া যাবে !
তোর বাবাকে সুরেশপুরে দেখলাম । বলেই শীতল পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, “তোর বাবা এত সকালে ঐ গ্রামে কেন ?”
কাজ আছে নিশ্চয় ! কিন্তু তুই সেখানে কী করছিলি ? পাল্টা প্রশ্ন করলো কুহেলি ।
আমি পড়তে গিয়েছিলাম । তুই তো জানিস, আমাদের অঙ্কের স্যার সুরেশপুরে থাকেন । তাঁর কাছে অঙ্ক শিখতে গিয়েছিলাম ।
সাইকেল থেকে নেমে শীতল হাঁটা শুরু করলো ।
মাঝখানে তিন-চারদিন কুহেলির সাথে শীতলের দেখা হয়নি । গাঁয়ে খেলার মাঠে কুহেলি কয়েকদিন যায়নি । অথচ কুহেলির অন্যান্য বন্ধুরা মাঠে প্রতিদিন যাচ্ছে এবং তারা কিৎ কিৎ, দৌড়, ইত্যাদি খেলায় মত্ত । স্কুল থেকে ফেরার সময়ও কুহেলির সাথে শীতলের দেখা হয়নি । শীতল ক্লাস সেভেনে পড়ে । কিন্তু কুহেলির সাথে শীতলের খুব ভাব । দু-ক্লাস উপরে হলেও শীতল কুহেলিকে খুব পছন্দ করে । টিফিন ভাগ করে খায় । স্কুল থেকে ফেরার সময় একসঙ্গে বাড়ি ফেরে । দুজনের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক ।
“দুদিন খেলার মাঠে আসলি না কেন ?” শীতল কুহেলিকে প্রশ্ন করলো ।
স্কুল থেকে ফিরে বাবার সঙ্গে কাজ করছিলাম ।
“বাবার সঙ্গে কাজ করছিলি !” কথাটা পুনরুক্তি করেই শীতলের কী হাসি !
হাসছিস কেন ?
বাবার সঙ্গে তুই কী কাজ করছিলি ? তুই কী বাবার মতো কাজ করতে পারিস ?
বড্ড হাসবি না । আমি বাবাকে রাতের রান্নার সবজি কেটে দিচ্ছিলাম ।
তুই কী রান্না জানিস ?
জানি তো ! জানিস শীতল, আমি ভাত ও ডাল রান্না করতে পারি ।
কোনোদিন রান্না করেছিস ?
হ্যাঁ করেছি । গত রবিবারদিন বাবা জরুরি একটা কাজে ভরতপুর গিয়েছিল । যদিও বলে গিয়েছিল বাড়ি ফিরে রান্না করবে । কিন্তু আমি বাবার জন্য অপেক্ষা করিনি । বাবা ফেরার আগেই ভাত ও ডাল বানিয়েছিলাম । ভাতের মধ্যে আলু সেদ্ধ দিয়েছিলাম । বাবা খাবার খেয়ে খুব খুশী !
ডালে ঠিকমতো নুন দিয়েছিলি ?
বোকার মতো প্রশ্ন করিস না । তুই একটা হাঁদারাম !
হাঁদারাম বললি কেন ?
কেন হাঁদারাম বলবো না ! আমি ডাল রান্না করে বাবাকে খাওয়ালাম, অথচ প্রশংসা দূরে থাক একটা ধন্যবাদ দিলি না !
এবার বুঝেছি !
কী বুঝেছিস ?
তোর অভিমান হয়েছে !
আমি অভিমান শব্দের অর্থ বুঝি না । কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে কথা বলবি না । আমি গরীব মানুষ । বাবা স্কুলে পড়াচ্ছে, কিন্তু বাড়িতে মাস্টার রেখে পড়াতে পারছে না । শুধুমাত্র ক্লাসের মাস্টার মশাইদের পড়াগুলি ঠিকমতো করি । সুতরাং অতো কঠিন শব্দ এখনও শিখিনি, বুঝলি !
তারপর বাড়ির দোরগড়ায় পৌঁছে কুহেলি শীতলকে বলল, “আমি এসে গেছি । সুতরাং তুই এখন বাড়িতে ফিরে যা ।“
আজ স্কুল যাবি তো ?
এখনও বুঝতে পারছি না । বাবা এখনও বাড়ি ফেরেনি । সুতরাং বাবা বাড়িতে না ফিরলে স্কুলে যাওয়া হবে কিনা সন্দেহ !
হঠাৎ শীতল পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে কুহেলির বাবা বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছেন । তখন কুহেলিকে শীতল বলল, তোর বাবা বাড়ির দিকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরছেন । এবার নিশ্চয় তোর স্কুলে যাওয়ার সমস্যা নেই ।
এক গাল হাসি দিয়ে কুহেলি বলল, “অবশ্যই স্কুলে যাচ্ছি । তখন দেখা হবে ।“
তারপর শীতলের দিকে তাকিয়ে ‘টা টা’ দিয়ে বাবার দিকে ছুটলো কুহেলি । বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি যাওয়ার সময় বলে যাওনি ? তাই আমি তোমাকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছি ।“
আমার অন্যায় হয়ে গেছে মা । আর আমার ভুল হবে না । এরপর যেখানেই যাই না কেন, তোমাকে অবশ্যই বলে যাবো ।“
কথা দিচ্ছ !
“হ্যাঁ দিচ্ছি ।“ তারপর বাপ-বেটির কী হাসি ।
(চলবে)
তানিশা পল্লীদহ গ্রামের চয়ন হালদারকে বিয়ে করলো । গাঁয়ে চয়নের মুদিখানার দোকান । ভীষণ চালু দোকান । চয়নের সাথে তানিশার পরিচয় ছোটবেলা থেকে । কিন্তু মাঝখানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল । কিন্তু সাগরের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর তানিশা নিয়মিত চয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো, যেটা বাড়িতে কেউ টের পায়নি । তানিশাকে অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে পেয়ে খুশীতে বিহ্বল । অন্যদিকে তানিশার বিয়ে হওয়ায় কঙ্কাবতী স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ।
তারপর …………?
তারপর তার মোবাইলে থানা থেকে হঠাৎ ফোন পেয়ে কঙ্কাবতী চমকে উঠলো । নিয়ামতপুর থানা থেকে স্বয়ং বড়বাবুর ফোন । ভয়ে ভীতিতে কঙ্কাবতী আমতা আমতা করে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আমাদের অপরাধ ?”
থানার বড়বাবু উত্তরে বললেন, “আপনি থানায় আসুন ! থানায় দেখা করলে টের পাবেন আপনার অপরাধ কী ?” থানার বড়বাবু আরও নির্দিষ্ট করে বললেন, “পরেরদিন সকাল এগারোটার মধ্যে আপনাকে থানায় আসার অনুরোধ রইল ।“
কঙ্কাবতী তার জামাইদের ডাকলো । সন্ধ্যায় কঙ্কাবতীর বাড়িতে চার মেয়ে ও চার জামাই এবং দুই ছেলে ও বৌমা উপস্থিত । কঙ্কাবতী সবাইকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করলো, তারা কোনো গর্হিত কাজ করেছে কিনা ? যার জন্য বড়বাবুর হঠাৎ তলব ! আলোচনায় কঙ্কাবতী বুঝতে পারলো, তার মেয়ে-জামাই এমনকি ছেলে-বৌমারা কেউ কোনো অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত নেই । সুতরাং কঙ্কাবতী নিশ্চিন্ত, তাদের পরিবারের কেউ কোনো অপরাধমূলক কাজ করেনি । এমনকি কোনো অপরাধমূলক কাজের ষড়যন্ত্রেও তারা যুক্ত নয় । তাই কঙ্কাবতী ঠিক করলো, পরিবারের সকলে দল বেঁধে থানায় যাবে । বিনা অপরাধে বড়বাবুর কেন তলব ?
পরেরদিন সকালবেলা । রুটি ও কুমড়োর তরকারি রেডি । সবাই রুটি তরকারি খেয়ে চায়ের জন্য অপেক্ষারত ! নতুন বৌ লতা চা বানালো । চায়ের চুমুক দিয়ে ঘোতন সকলের উদ্দেশে বলল, “আর দেরী করা যাবে না । পরের ট্রেনটা মিঁয়া হল্টে ঠিক নটা দশ মিনিটে । ঐ ট্রেন যেভাবে হোক পেতে হবে । নতুবা অনেক দেরী হয়ে যাবে ।“
মিঁয়া থেকে সালার । সালার স্টেশনে নেমে বাসে নিয়ামতপুর থানা ।
বাড়ি থেকে বের হতে যাবে ঠিক সেই সময় চঞ্চল বটব্যাল এসে হাজির । চঞ্চল বটব্যাল পাশের গ্রামে বাস করেন । তিনি পুলিশের বড় অফিসার । এতকাল উত্তরবঙ্গে পোস্টিংয়ে ছিলেন । খুব সম্প্রতি তিনি নিয়ামতপুর থানায় বদলী হয়ে এসেছেন । গাঁয়ে তাঁর অনেক জমি জায়গা । এলাকার মানুষ তাঁকে সমীহ করে চলেন । কঙ্কাবতী শুনেছে, চঞ্চল বটব্যাল নাকি নিয়ামতপুর থানার মেজবাবু । কিন্তু কঙ্কাবতী ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, তাঁর মতো নামজাদা পুলিশ অফিসার তার বাড়িতে আসবে । তাই চঞ্চল বটব্যালকে দেখে কঙ্কাবতী তাঁকে আপ্যয়ন করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো ।
কঙ্কাবতীর ব্যতিব্যস্ততা দেখে চঞ্চলবাবু বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না । বরং যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যাওয়ার প্রতি ধ্যান দিন ।“
“তা হয় নাকি ! আপনি জীবনে প্রথম আমাদের মতো গরীবের বাড়িতে পা রাখলেন । সুতরাং আপনাকে একটিবারের জন্য হলেও বসতে হবে । আপনাকে চা খেয়ে যেতে হবে । দরকার হলে, থানায় একটু পরে যাবো ।“
“উহুঁ ! থানায় যেতে দেরী করবেন না । সেই কথা বলতেই আমার আসা । থানায় আপনাকে আর্জেন্ট দরকার ।“ চঞ্চল বটব্যাল জোর দিয়ে কঙ্কাবতীকে বললেন ।
সাহস পেয়ে কঙ্কাবতী চঞ্চলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “থানায় কেন আমার মতো গরীব মানুষের হঠাৎ তলব ? আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না ! বিপদের কথা ভেবে গত রাত্রিতে আমার ঘুম হয়নি । থানায় আমাকে তলব কেন, জানালে আশ্বস্থ হতাম ।“
আমি কিচ্ছু জানি না । আমাকে বড়বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং আপনাকে থানায় সঠিক সময়ে পৌঁছানোর জন্য বলেছেন ।
কঙ্কাবতী পুনরায় চঞ্চল বটব্যালবাবুকে বলল, “স্যার, আমার বড্ড ভয় করছে ! জীবনে এভাবে থানা থেকে আমাকে কোনোদিন ডাকেনি । এমনকি কোনো প্রশাসনিক দপ্তর থেকেও এভাবে ডাক পাইনি ।“
“আপনি অযথা উতলা হবেন না । থানার বড়বাবু ভীষণ ভদ্র মানুষ । আপনাদের কোনোরকম অসুবিধা হবে না ।“ চঞ্চলবাবু কঙ্কাবতীকে আশ্বস্ত করলেন । তারপর তিনি বাড়ির দিকে রওনা দিলেন ।
আর কালবিলম্ব না করে কঙ্কাবতী তার চার মেয়ে ও চার জামাই এবং দুই ছেলে ও দুই বৌমা এবং স্বামী অনিন্দ্যকে নিয়ে নিয়ামতপুরের দিকে রওনা দিলো । পরিবারের সবাইকে নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, যদিও বিপদজনক কিছু ঘটে তবে সকলে মিলে থানার বড়বাবুর চেম্বারের বাইরে ধর্ণায় বসবে । নিরপরাধ মানুষকে ডেকে এনে কেন হুজ্জুতি ? কঙ্কাবতীর দূরদৃষ্টি সাংঘাতিক । বিপদে পড়লে নিজের লোকেরাই পাশে দাঁড়াবে । পাড়া প্রতিবেশীরা সমালোচনায় সিদ্ধহস্ত, অথচ বিপদে পড়লে তাঁরা বরং মুখটা ঘুরিয়ে নেয় । বেশী করে কটুকথা শোনায় । তাঁদের ভাবটা এমন, আমরা যতো বিপদে পড়বো ততো তাদের শান্তি !
সালারে পৌঁছে কী বিপদ ! নিয়ামতপুর যাওয়ার কোনো বাস নেই । বাস ধর্মঘট । সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত । সালার থেকে নিয়ামতপুর যাওয়ার রাস্তা খুব বেশী নয় । খুব বেশী সময় লাগলে, লাগবে আধা ঘন্টা । সকাল দশটা বাজে । কীভাবে পৌঁছাবে সেই চিন্তায় কঙ্কাবতী অস্থির । বাড়িতে এসে থানার মেজবাবু বলে গেছেন, ঠিক সময়ে থানায় পৌঁছাতে । অথচ যাতায়াতের কোনো যানবাহন নেই । সালার থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করলে, অনেক টাকা খরচ ! তারা সংখ্যায় অনেক । বড় গাড়ি দরকার ! কঙ্কাবতী ঠাহর করতে পারছে না, তারা এখন কীভাবে পৌঁছাবে ?
ইত্যবসরে বড়বাবুর টেলিফোন, “হ্যালো ! আমি কি কঙ্কাবতী ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলছি ?”
মায়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মনীষা পাল্টা জানতে চাইলো, “আপনি কে বলছেন ?”
“আমি নিয়ামতপুর থানার বড়বাবু বলছি ।“
“নমস্কার স্যার । আমি কঙ্কাবতীর মেয়ে বলছি । ট্রেন থেকে নেমে আমরা সালারে আটকে গেছি । বাস ধর্মঘট ! নিয়ামতপুর পৌঁছানোর কোনো যানবাহন নেই । কী করব, ঠিক বুঝতে পারছি না ।“
আপনারা একসঙ্গে কতোজন আছেন ?
আমরা পরিবারের সবাই আছি । সংখ্যায় ১৪জন । বড় বৌদি আবার সন্তান সম্ভাবনা । যার জন্য আরও চিন্তা !
বড়বাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “এই মুহূর্তে আপনারা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন ?”
আমরা স্টেশন লাগোয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি ।
“আপনারা সকলে সালার স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়ান । সালার থানা থেকে পুলিশের গাড়িতে আপনাদের নিয়ামতপুরে পৌঁছে দেবে ।“ বড়বাবু তারপর লাইন কেটে দিলেন ।
কঙ্কাবতী আরও শঙ্কিত, কী বিপদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ! পুলিশ নিজ দায়িত্বে তাদের থানায় নিয়ে যাচ্ছে । অনিন্দ্য যতোবার বোঝাবার চেষ্টা করছে, আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। সুতরাং ভয়ের কোনো কারণ নেই । তবুও কঙ্কাবতীর আশঙ্কার ধন্দে কাটছে না । ভয়ে বরং বলা চলে গুটিয়ে রয়েছে । অথচ থানার বড়বাবুর ডাককে উপেক্ষা করতে পারছে না । ঘোতনও মাকে বোঝাচ্ছে, “তুমি অযথা চিন্তা করছো ? নিশ্চয় বড়বাবু কোনো কাজের কথাবার্তার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন !”
ইতিমধ্যে সালার থানা থেকে পুলিশের দুখানি জিপ গাড়ি এসে হাজির ।
জেলার মধ্যে নিয়ামতপুর থানা একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরানো থানা । আশেপাশে অনেক লোকজন ও দোকানপাট । এলাকায় হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণীয় মানুষের বসবাস । তবুও মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট । এই ব্যাপারে থানার ভূমিকা অনস্বীকার্য । নিয়ামতপুরে রয়েছে ব্লক অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আরও অসংখ্য ছোট ছোট অফিস । যার জন্য মহাকুমার মধ্যে নিয়ামতপুরের গুরুত্ব অপরিসীম ।
থানায় নামার সাথে সাথে ভয়ে কঙ্কাবতীর বুক ধড়ফড় !
থানার সামনে নীল-লাল বাতি লাগানো বেশ কয়েকটা গাড়ি । গাড়ি দেখে কঙ্কাবতীর আরও ভয় পেয়ে গেলো । অনিন্দ্যকে বলল, “আমাকে এক গ্লাস জল খাওয়াও ।“
অনিন্দ্য তড়িঘড়ি দোকান থেকে দশ টাকা দিয়ে জলের বোতল এনে কঙ্কাবতীকে খাওয়ালো । তারপর তার তেষ্টা মেটে ।
চঞ্চল বটব্যাল হাসতে হাসতে কঙ্কাবতীর কাছে উপস্থিত । তিনি কঙ্কাবতীকে বললেন, “আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি ।“
কঙ্কাবতী তখনও ভয়ে জড়সড় । কঙ্কাবতীর আড়ষ্টতা অবলোকন করে চঞ্চলবাবু আবার বললেন, “ম্যাডাম, ভয়ের ব্যাপার নয় । আপনি আপনার কথা নির্ভয়ে বলবেন । এখন আমার সঙ্গে চলুন ।“
আপনার সঙ্গে কোথায় যাব ?
বড়বাবুর চেম্বারে ।
আমার স্বামী ও পরিবারের লোকজন কখন যাবে ?
আপনি ভিতরে ঢুকে স্যারকে বলবেন, “আপনার পরিবারের লোকজন আপনার সঙ্গে আলোচনায় থাকতে চায় ? তিনি সানন্দে সম্মতি জানাবেন । কিন্তু এই মুহুর্তে আপনি একা আমার সাথে বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকুন । কেননা সেখানে জেলার অনেক উচ্চপদস্থ আধিকারিকগণ বসে আছেন । বড়বাবুর অনুমতি ব্যতিরিকে পরিবারের লোকজন চেম্বারে ঢোকাটা শোভনীয় হবে না । আর সময় নষ্ট করবেন না । আমার সঙ্গে চলুন ।“
বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকে দুই হাত জড়ো করে কঙ্কাবতী বলল, “নমস্কার স্যার ।“
“বসুন ।“ হাত দিয়ে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন বড়বাবু । বড়বাবুর নির্দেশ মতো কঙ্কাবতী চেয়ারে বসলো ।
তারপর বড়বাবু আবার বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই । আপনার পাশে রয়েছেন এলাকার বি ডি ও সাহেব এবং একেবারে সামনে রয়েছেন মহাকুমা শাসক এবং বা-পাশে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলা শাসক । আপনাকে এখানে ডাকার কারণ এবার খুলে বলি ।
কঙ্কাবতী বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আলোচনার মধ্যে আমার পরিবারের লোকজন থাকলে ভাল হয় ।“
“অবশ্যই তারা থাকবেন ।“ বড়বাবু তারপর চঞ্চলবাবুকে বললেন, “কঙ্কাবতীর সাথে যারা এসেছেন, সবাইকে ডাকুন ।“
একদিকে জেলা প্রশাসনের মানুষজন বসেছেন এবং ঠিক তার উল্টোদিকে মুখোমুখি কঙ্কাবতীর বাড়ির লোকজন ।
বড়বাবু শুরু করলেন, “আপনার নাম কঙ্কাবতী ?”
হ্যাঁ স্যার ।
আপনার চার মেয়ে ও দুই ছেলে ?
“হ্যাঁ স্যার । কিন্তু স্যার, আমার বাড়ির এত খবর জানলেন কীভাবে ?” কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলো কঙ্কাবতী ।
“সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি । এবার আপনার সঙ্গে কয়েকটা জরুরি কথা সেরে নিই !” বড়বাবু হাসিমুখে কথাগুলি বলছিলেন । ঠিক তার মাঝখানে কঙ্কাবতী মুখটা ভার করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আমি জ্ঞানত কোনো অন্যায় করিনি । আবার কী ধরনের বিপদের কথা শোনাবেন, বুঝতে পারছি না ?”
অতিরিক্ত জেলা শাসক চঞ্চলবাবুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “আপনারা ম্যাডামকে কিছু জানাননি ?”
চঞ্চলবাবু সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বললেন, “স্যার, আমাদের বড়বাবু স্যারের নির্দেশ ছিল ‘ম্যাডামকে আগেভাগে কিছু না জানাতে’ । সেই মোতাবেক আমরা ম্যাডামকে কিছুই জানাইনি ।“
এবার বড়বাবু অতিরিক্ত জেলা শাসকের দিকে তাকিয়ে বল্লেন, “ম্যাডামকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য খবরটা জানাইনি ।“
তারপর অতিরিক্ত জেলা শাসক কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি বসুন ম্যাডাম । বড়বাবু একটা ভাল খবর শোনাবেন । যে খবরটার জন্য আমরা জেলার মানুষ গর্বিত ।“
বাড়ির সকলের দৃষ্টি এখন বড়বাবুর দিকে ।
বড়বাবু আবার শুরু করলেন, “ম্যাডাম, আপনি সমস্ত প্রতিকুলতা কাটিয়ে যেভাবে আপনার চার মেয়েকে মানুষ করেছেন এবং তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছেন, তার স্বীকৃতি স্বরূপ কেন্দ্রিয় সরকার আপনাকে “নারীশক্তি” সম্মাননা দিয়ে সম্মান জানাবেন । এটি একটা বিরল সম্মান । আমাদের রাজ্য থেকে একমাত্র আপনি সেটা পাচ্ছেন ।“
খবরটা জানানোর সাথে সাথে সকল প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে কঙ্কাবতীকে সম্মান জানালো । কঙ্কাবতী তখন তার চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না । স্পটেই কেদে দিলো । পরিবারের সবাই তখন কঙ্কাবতীকে জড়িয়ে ধরে আবেগে উচ্ছ্বাসে আনন্দাশ্রুতে বিহ্বল ।
————-০—————
মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বোধের উন্মেষ । মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে । শিশু যখন মাতৃভাষায় পড়া ও লেখা শুরু করে, তখন থেকে ভাষার মাধ্যমে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জানা ও বোঝার ক্ষমতার পাশাপাশি আরও অনেকগুলি সক্ষমতা বা দক্ষতা তৈরী হতে থাকে । বিশেষ করে, যুক্তি-বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা । যাকে বলে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ । শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার তেমন গুরুত্ব । মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে । মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয় । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব । মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি । কারণ এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না । মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ সম্ভব ।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে । আমরা জানি, শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ । মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না । তাই শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের । একটা শিশুর মাতৃভাষা হলো তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ । মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মুল তাৎপর্য হলো মাতৃভাষা নিয়ে সচেতন হওয়া ও বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা । ইউনেস্কোর সম্মেলনে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে বলা হয় – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার । মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে ।
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন । একটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত । বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ।
( ২ )
এবারে আসছি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে । ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে । প্রথমে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের কথায় আসা যাক । ভাষা আন্দোলনকারীর প্রবীণদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত । তিনি ছিলেন সেই সময়কার পাকিস্তান গণপরিষদয়ের সদস্য । ১৯৪৮ সালের ২৫শে আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে বাংলাকে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি উত্থাপন করেন । এখানে উল্লেখ থাকে যে, ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিটিং, মিছিল, পিকেটিং আন্দোলন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তরুন রাজনীতিবিদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তারপর ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত প্রসঙ্গে আরও জানা যায় — তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারী দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে ৫৬শতাংশের বেশী মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে । এমনকি শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে । সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আপনারা উর্দু ভাষাকে অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দিতে পারেন না । আপনারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিন ।“ কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন । শুধু তাই নয়, ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের উপর “এডবো” (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়োগ করেন । যার জন্য তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন । ১৯৭১ সালে ২৯শে মার্চ রাতে ছেলে দিলীপ কুমার দত্ত সহ গ্রেপ্তার হন । ময়নামতি সেনানিবাসে থাকাকালীন তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন হয় এবং তারপরে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । তাই তাঁকে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত নামে সকলে চেনে । আর মাতৃভাষার প্রথম দাবিদার এই শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ।
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানে উর্দু হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা (Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan) । এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেননি । ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । এর প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল করে । মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে । মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন । ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সাথে সাথে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় । এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র যুব হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হস্টেলে সমবেত হন । নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে । ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর রাখার জন্য ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে উঠে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ১৯৫২ সালে ভাষা অন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে । ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি । ১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলা ভাষা প্রচলণ বিল” পাশ হয় । যা কার্যকর হয় ৮ই মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় । এতে তরতাজা ছাত্র-যুবকেরা হতাহত হন । সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে । ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিলো ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ । লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ । তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন
জেগে উঠেঃ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ।
( ৩ )
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতি সংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে । ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশন মোতাবেক এখন থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ । সুতরাং ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন হয়ে আসছে ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক । ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের স্মরণে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের গণআন্দোলনের প্রতীক, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুমহানস্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতীর পিতা (বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্ত্বা থাকবে শহীদদের আমরা ভুলতে পারবো না । আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না । এ বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়” ।
পরিশেষে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো । মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা । বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো । সারা বিশ্বে বাঙালী জাতির কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন । তাই ২১ আমাদের গর্ব, ২১ আমাদের অহংকার ।
আজ এই পুণ্যদিনে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
————————–0—————————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী / মো-৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
অনেক দিন আগের ঘটনা । পল্লব একদিন ঘোতনের হাতে বিশ্রীভাবে নিগৃহীত হয়েছিল । মারামারির ঘটনাটা ঘটেছিল সালারে । সেই থেকে ঘোতনের উপর পল্লবের রাগ জমা ! সেই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর পল্লব রসুলপুরে তার মামার বাড়ি চলে আসে । মামা রসুলপুরের বড় চাষি । এখানে পল্লবের ব্যবসা করার ইচ্ছা । কিন্তু মামা ব্যবসার ব্যাপারে পল্লবকে কিছুই ব্যবস্থা করে দেননি । যার জন্য বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে যেখানে সেখানে পল্লবের আড্ডা । অর্জুন গাছ তলার আড্ডাটা দীর্ঘদিনের । অর্জুন গাছ তলায় আড্ডা দেওয়ার পুরানো লোকজন এখন আর কেউ নেই । রসুলপুরে আসার পর পল্লব অর্জুন গাছ তলার আড্ডাটা পুনরায় চালু করে । পল্লবের নজর পড়েছিল লতার উপর । মনে মনে লতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত । সেই লতার সঙ্গে ঘোতনকে দেখতে পেয়ে পল্লব নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে । রাগে গজরাতে থাকে । তার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে ঘোতনের ফষ্টিনষ্টি, পল্লব সহ্য করতে পারে না । লতা ভালবাসুক বা না-ভালবাসুক, কিন্তু পল্লব তাকে ভালবাসে । লতার পাশে ঘোতনকে দেখে তার আরও রক্তচক্ষু ! সে জানে, ঘোতন এখানে নতুন । সুতরাং এই সুযোগ, পুরানো রাগের বদলা নেওয়ার । তাই কিছু দুষ্কৃতিদের নিয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো লতা ও ঘোতনের উপর ।
রিক্সা থেকে রাস্তার পাশে পড়ে গেলো দুজনে । অন্যদিকে বাজারের ব্যাগ ছিটকে পড়লো পাকা রাস্তার উপর । বাজারের সবজি যেমন টমেটো, পিয়াঁজ, কাঁচা-লঙ্কা, ইত্যাদি রাস্তার উপর গড়াগড়ি । এমনকি মাছ, মাটন রাস্তায় গড়াগড়ি । লতা এমনভাবে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ল ঘোতন যেখানে পড়েছে ঠিক তার পাশে । লতার শরীরে তেমন চোট লাগলো না । কিন্তু বা-হাতে প্রচণ্ড আঘাত পেলো ঘোতন । যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ! তার উপর চার-পাঁচ জন দুষ্কৃতি ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার উপর । ঘোতনকে এলোপাথারি ঘুষি । হাতের যন্ত্রণার জন্য ঘোতন ঠিকভাবে পাল্টা আক্রমণ করতে পারছে না । নিমেষেই পল্লবদের কিল-ঘুষিতে ঘোতন কাহিল ।
মার খেয়ে ঘোতনের মর্মান্তিক অবস্থা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লতা সহ্য করতে পারলো না । একটু দূরে গোটা ইট দেখতে পেয়ে ছুটে ইটটা নিয়ে, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোজা পল্লবের মাথায় আঘাত ! ইটের আঘাতে পল্লবের মাথা ফেটে রক্ত ! প্রচুর রক্তক্ষরণ ! ততক্ষণে বাজারের অনেক মানুষ ভিড় জমিয়েছেন । ইত্যবসরে পাড়ার সুনীল কাকা মারামারির স্পটে হাজির । তাঁর শক্ত-সামর্থ চেহারা । এতক্ষণ পল্লবদের মারপিটের ভিডিও করছিল । ঘোতনকে অন্যায়ভাবে কীভাবে দুষ্কৃতিরা মারছে তার পুরো ভিডিও সুনীল কাকা তৈরী করে রাখলো । এবার মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে তাঁর বা-হাতের মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে পল্লবের সাগরেদদের এলোপাথারি আঘাত । সুনীল কাকা লতাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাওয়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা নড়েচড়ে উঠলেন । তাঁরাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন লতাদের বাঁচাতে । হঠাৎ জন-রোষ দেখে দুষ্কৃতিরা পালিয়ে বাঁচে ।
লতা ঘোতনকে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালে । হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্র প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাতের এক্স-রে করলো । এক্স-রে রিপোর্ট এবং শারীরিক স্থিতি দেখে হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বললেন, “ভয়ের কারণ নেই । হাতে চোট পেয়েছে । মলম দিচ্ছি । গরম সেক ও মলম লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে ।“ তারপর ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরলো লতা ও ঘোতন ।
কঙ্কাবতীকে ঘোতন জানিয়ে দিলো, তার বাড়ি ফিরতে দুদিন দেরী হবে । শরীরের ঘটনাটা কঙ্কাবতীর কাছে গোপন রাখলো ।
অনেক ভেবেও ঘটনার প্রেক্ষাপট লতা বুঝে উঠতে পারছে না । তবে সে একটা জিনিস ভালভাবে বুঝেছে, ঘোতনের সঙ্গে পল্লবের সম্পর্ক মধুর নয় । লতা কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছিল, কতকগুলি ছেলে-ছোকরা একত্রে অর্জুন গাছ তলায় বসে হাসি মশকরায় মত্ত থাকে । বিশেষ করে তাকে দেখলে তাদের হাসি, ঠাট্টা, তামাশার উচ্ছৃঙ্খলতা অনেক বাড়ে । তবে এগুলো লতা পাত্তা দেয় না । কেননা এইসব ঘটনা তার জীবনে আকছার ঘটে । সবগুলি পাত্তা দিলে অনর্থক ঝগড়া তার পিছু হটবে না ।
হাসপাতাল থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে আছে ঘোতন । ঠিকমতো মলম লাগানো ও গরমের সেক দেওয়ার পর অনেকটা সুস্থ । লতার ঘরে ঢোকার আওয়াজ পেয়ে ঘোতন বিছানায় উঠে বসলো । লতার দিকে তাকিয়ে ঘোতন বলল, “অহেতুক তোমাদের বিরক্ত করছি ।“
“এটা কোনো বিরক্তির ব্যাপার নয় ! আমি ভাবছি, পল্লব পুনরায় আক্রমণ করতে পারে । আপনার এখানে থাকাটা নিরাপদ হবে কিনা বুঝতে পারছি না ?” লতা তার উদ্বিগ্নতার কথা জানালো ।
আমি দুদিন বাদে বাড়ি ফিরব । বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি । দুদিনে মোটামুটি শারীরিক দিক দিয়ে নিশ্চয় চাঙ্গা হয়ে উঠব । তুমি অযথা চিন্তা করো না । ঐসব কাপুরুষের দল আমাকে কিচ্ছু করতে পারবে না !
“কিচ্ছু করতে পারবে না” এই কথাটা আর বলো না । সেদিন পল্লবের দল মিলে তোমাকে যেভাবে নাকানি-চোবানি খাওয়ালো তাতে আমি এখনও সন্দিহান, বেটা সুযোগ পেলেই আবার ছোবল মারবে । অথচ তুমি বলছো, পল্লব কিচ্ছু করতে পারবে না ।
সেদিন আচমকা আক্রমণ করায় ও তুমি সঙ্গে থাকায়, আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম । সেটা আর কোনোদিন হবে না ।
থাক ! বীর-পুরুষের মতো কথা এখন ছাড়ো । কী খাবে বলো ?
এখন একটু চা পেলেই খুশী ।
লতা চা তৈরী করতে ঘরে ঢুকলে, রাগে ঘোতনের চোখ লাল হয়ে উঠলো । বদলা না নিতে পারলে তার মাথা ঠিক রাখতে পারছে না । পল্লবের এত সাহস তাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে ! এর যোগ্য শিক্ষা পল্লবকে না দিতে পারলে তার রসুলপুর ছাড়লে চলবে না । তাতে ভবিষ্যতে যা হয় হবে । ইতিমধ্যে এখানে চাউর হয়ে গেছে, ঘোতন দুর্বল । অতর্কিতে হানা দেওয়ার জন্য ঘাবড়ে গিয়েছিল ঘোতন । ঘোতন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি পল্লব রসুলপুরে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে । উপরন্ত তার সঙ্গে লতা ছিল । লতাকে আগে বাঁচানো দরকার ! লতাকে বাঁচাতে গিয়ে ঘোতন বেকায়দায় পড়ে গেলো । নতুবা স্পটে পল্লব ও তার দলবলদের উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তো । এই মুহুর্তে তার শরীর অনেক চাঙ্গা । তাই ঘোতন চাইছে, সুযোগ পেলেই পল্লবদের উপর যে কোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে । পল্লবদের এলোপাথারি উত্তম-মধ্যম দিতে পারলে যদি তার মনের জ্বালা কিছুটা মেটে !
“বাবু, এবার চা খেয়ে নড়েচড়ে বসেন ।“ মুচকি হেসে লতা ঠাট্টা করে কথাগুলি ঘোতনকে বলল ।
চায়ে চুমুক দিয়ে ঘোতন লতাকে আড়ষ্টতার সঙ্গে বলল, “চা খেয়ে একটু রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসি । অনেকক্ষণ থেকে ঘরে শোওয়া ! ঘোরাঘুরি করলে শরীরটা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে ।“
যথা আজ্ঞা !
আর একটা কথা, দুপুরের খাবার এখনও খাওয়া হয়নি । তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে । তুমি ফিরে এলেই খেতে বসবো ।
যথা আজ্ঞা !
তবে ভাল করে শোনো, বাজারের দিকে যাওয়া চলবে না । বিশেষ করে এখন কিছুতেই যাবে না । কেননা বাজার যাওয়ার রাস্তার পাশে অর্জুন গাছ তলায় পল্লবদের আড্ডা ! তোমাকে দেখলে তারা পুনরায় তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে !
“মাথা খারাপ ! আমি ঐ রাস্তার দিকেই যাবো না, বরং উল্টোদিকে যাবো ।“
একদম ঠিক । উল্টোদিকে যাওয়াই তোমার শ্রেয় ! তবে তোমাকে একা ছাড়তে আমার ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না ? বেশীদূর যাওয়ার দরকার নেই । কেননা খাবার রেডি ।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বোঝাতে চাইলো, লতার কথা অক্ষরে অক্ষরে সে পালন করবে !
বেলা তখন প্রায় দু-টো । ঘোতন এদিক-ওদিক কোনোকিচ্ছু ভাবলো না । চা খেয়ে লতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা অর্জুন গাছ তলায় । অর্জুন গাছ তলায় ঢোকার আগে ঘোতন লক্ষ্য করলো তিনটে বন্ধুর সঙ্গে পল্লবের তুমুল বাকবিতাণ্ডা !
চারজনের গতিবিধির অবস্থানের পরিস্থিতি অবলোকন করে ঘোতন মানসিকভাবে নিজেকে তৈরী করে নিলো । যেভাবে হোক আজ তাকে বদলা নিতে হবে । বদলা নেওয়ার এটাই মোক্ষম সময় । উপযুক্ত সময়টাকে ঘোতন কাজে লাগাতে চায় । যতক্ষণ বদলা না নিচ্ছে ততক্ষণ ঘোতনের মনের ভিতরের রাগের জ্বালা থামছে না । ভর দুপুরে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই । সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঘোতন । অতর্কিতে আক্রমণ করে প্রথমেই পল্লবকে ঘায়েল করলো । তারপর পায়ের লাথি দিয়ে অন্য তিনজনকে কুপোকাত ! নিমেষের মধ্যে চারজনকে ভূপতিত করে ঘোতন পল্লবকে চেঁচিয়ে বলল, “আমার বিরুদ্ধে লাগা । ভবিষ্যতে লতার দিকে তাকিয়েছিস্ তো, সব কটাকে মেরে অজয় নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তবেই আমার শান্তি ! ভেবেছিলি, সালার থেকে রসুলপুরে পালিয়ে এসে বেঁচে যাবি ? সেটা হবার নয় । আমি বেঁচে থাকতে তোর সেই আশায় বালি !”
ইতিমধ্যে অন্য তিনজন সেখান থেকে উধাও ।
পল্লব পিছু হটতে হটতে চিৎকার করে বলল, “আজ তোকে যদি থানার লক-আপে ঢোকাতে না পারি তবে আমার নাম পল্লব না !”
পল্লবের কথা শুনে ঘোতন ছুটে গিয়ে তাকে জোরে লাথি, “আমাকে লক-আপে ঢোকাবি ? আগে তুই বাঁচবি কিনা সেটা দ্যাখ্ ? তারপর আমাকে লক-আপে ঢোকাবার চিন্তা !” লাথি খেয়ে আবার রাস্তার উপর পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো । তার সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই ।
পথ চলতি মানুষের মধ্যে গুঞ্জন ! পুলিশ আসছে ।
পুলিশ দেখেই ঘোতন সেখান থেকে ছুটে বড় রাস্তায় । একটা খালি লরি মেমারির দিকে যাচ্ছিল । হাত দেখিয়ে লরিকে দাঁড় করালো ঘোতন । সেই লরিতে উঠে সে জানতে পারলো, লরিটা যাচ্ছে কাটোয়া । মেমারী, মন্তেশ্বর, দাঁইহাট হয়ে কাটোয়া যাবে । বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে । কাটোয়া পৌঁছাতে রাত্রি হয়ে যাবে । রাত্রি হলেও সমস্যা নেই । ঘোতন এই মুহূর্তে পুলিশের জেরা থেকে অন্তত বাঁচলো ।
ফোনে লতাকে ঘোতন জানিয়ে দিয়ে বলল, “এইমাত্র বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি ফিরছি । বাড়িতে মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ । সুতরাং আমি বাড়ি ফিরতে বাধ্য হলাম ।“ “পল্লবদের মেরে শায়েস্তা করেছে” সেই কথা কিছুতেই লতাকে বলল না ।
ফোনে কথা শেষ হতেই লতাদের বাড়িতে পুলিশ এসে হাজির । সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে । পুলিশের পেছনে পল্লব এবং তার কয়েকজন সাগরেদ । সব কটাকেই লতার চেনে ও জানে । পল্লবের সারা শরীরে রক্তের দাগ ! পল্লবের শরীরে রক্তের দাগ দেখে বুদ্ধিমতী লতা সহজেই বুঝতে পারলো, এটা বীরপুরুষ ঘোতনের কাজ । সঙ্গে সঙ্গে লতা পুলিশকে মোকাবিলা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে নিলো !
লতাকে পুলিশ বললেন, “আপনাদের বাড়ির আত্মীয় ঘোতনকে ডেকে দিন ?”
“স্যার শুনুন ! ঘোতন আমাদের আত্মীয় নয় । আত্মীয়তা করতে তিনি এসেছিলেন । কিন্তু আপনাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পল্লব এবং তার সাগরেদরা ঘোতনকে এমনভাবে মেরেছে, মার খেয়ে বেচারা হাসপাতাল থেকে সোজা বাড়ি । এতক্ষণ সম্ভবত বাড়ি পৌঁছে গেছে । আর সেই পল্লবদের নিয়ে আপনারা ঘোতনের খোঁজ করছেন । আমি ভাবছি, পল্লবদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত রিপোর্ট জমা দেবো । ঘোতনকে মারার অপরাধে পল্লবদের ধরে লক-আপে ঢোকাতে হবে !” বেশ জোরের সঙ্গে সওয়াল করলো লতা ।
লতার কথা শুনে থানার পুলিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! কী উত্তর দেবে বুঝতে তাঁরা রীতিমতো ধন্দে ?
পল্লব এবার এগিয়ে এসে লতার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, “তুমি পুলিশের কাছে এইসব আজেবাজে অভিযোগ করছো, তার কোনো প্রমাণ আছে ?”
বেশী ভাট বকো না । লতা বিনা প্রমাণে ভাট বকে না । নির্লজ্জ বেহায়ার মতো তড়পিয়ো না । ঘোতনকে অন্যায়ভাবে মেরে আবার বড় বড় কথা ! এবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে লতা বলল, “স্যার, পল্লবকে অ্যারেস্ট করুন ?”
আপনার মুখের কথায় কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না । উপযুক্ত প্রমাণ চাই ।
প্রমাণ আমি দিচ্ছি । তার আগে বলুন, বিনা প্রমাণে কোন্ সাহসে একটা নিরপরাধ মানুষকে হাত-কড়া পড়াতে চলে এলেন ? পল্লব আপনাদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে । আমরা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ । এভাবে কারো কথায় বিনা প্রমাণে বাড়িতে হানা দিয়ে সমাজের কাছে আমাদের অপদস্ত করবেন না, স্যার !
পুলিশ নীরব !
সুনীল কাকা সমস্ত মারপিটের ভিডিও পেন-ড্রাইভে তুলে সেটা একটু আগেই লতাকে দিয়ে গিয়েছিল । তাই বাঁচোয়া । ঘরের ভিতর ঢুকে পেন-ড্রাইভ এনে পুলিশের হাতে দিয়ে লতা বলল, “চালিয়ে দেখুন । এখানে থেকে সব প্রমাণ পেয়ে যাবেন ।“
ল্যাপটপ চালিয়ে পুলিশ স্পটে ঘটনাটা দেখতে শুরু করলেন । ভিডিও চলাকালীন পেছন থেকে পল্লব ও তার সাগরেদরা সেখান থেকে উধাও ।
পল্লবদের পালাতে দেখে লতা পুলিশকে বলল, “ধরুন স্যার, ওরা পালাচ্ছে !”
দুজন পুলিশ কন্সটেবল ও সাব-ইন্সপেক্টর পল্লবদের পেছনে ছুট্ ! তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে লতাদের চোখের দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে গেলো । লতা তারপর বেমালুম চেপে গেলো । পল্লবদের ব্যাপারে থানা-পুলিশ আর করলো না । লতা পরে জানতে পারলো, ঘোতন পল্লবদের উচিত শিক্ষা দিয়ে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেছে । তখনও সে বাড়ি পৌঁছায়নি । সুতরাং লতা আর পুলিশ কেসে নিজেকে অহেতুক জড়াতে চাইলো না ।
তারপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেলো । কঙ্কাবতী আর ছেলেকে রসুলপুর পাঠিয়ে বিপদ ডেকে আনতে চাইলো না । ব্রজেশ্বরবাবুকে প্রস্তাব দিলো, লতাকে সালারের মাসির বাড়ি রেখে বিয়ের পর্ব সারতে । সেই মোতাবেক বিয়ের কথাবার্তা এগোতে লাগলো ।
বৈশাখ মাসের ১৫তারিখে বিয়ের দিন পাকা ।
বাড়িতে ছোট ছেলের বিয়ে । তাই কঙ্কাবতীর ধুমধামের মাত্রা বেশী । শহর থেকে সানাইয়ের বাজনা । ব্যাণ্ড-পার্টির বাজনা এলো সালার থেকে । নিমন্ত্রিত লোকের সংখ্যা অনেক । মিঁয়া ও বাজারসৌ স্টেশন চত্বরের আমন্ত্রিত মানুষের সংখ্যা বেশী । কঙ্কাবতীর আবার লতাকে খুব পছন্দ । খবর নিয়ে জেনেছে, লতা খুব সাহসী মেয়ে । ঘোতনের জীবনে এমনই ডানপিটে একটা মেয়ে দরকার । কঙ্কাবতীদের বাড়িতে আনন্দের সীমা নেই । তার সব মেয়ে জামাই উঠে-পড়ে ঘোতনের বিয়ের কাজে ব্যতিব্যস্ত ।
বৈশাখ মাসে ঝড়-বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে প্যাণ্ডেল । প্যাণ্ডেলও সেভাবেই পোক্তভাবে তৈরী । ইলেক্ট্রিক লাইটের জমকালো আলোর রোশনাই । শহর থেকে রান্নার ঠাকুর । খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কঙ্কাবতী কোনো আপোসে যেতে রাজি নয় । তাই সমস্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কঙ্কাবতী নিজে । মিঁয়ার মানুষ টের পাচ্ছেন, অনেকদিন পর গ্রামে জমজমাট বিয়ের আসর ।
ঘোতন ও লতার বিয়ে মহাধুমধামে সম্পূর্ণ হলো ।
(চলবে)