কঙ্কাবতী কিছুতেই বুঝতে পারছে না, এত তাড়াতাড়ি কী করে রসুলপুরের মেয়ে লতাকে ঘোতন পছন্দ করলো ! খবরাখবর নিয়ে কঙ্কাবতী জানতে পেরেছে লতা খুব ডানপিটে । আরও জানতে পেরেছে, মাসীর বাড়িতে থেকে সালার কলেজে লতার পড়াশুনা । ব্রজেশ্বরবাবু মেয়ের চালচলনের ঠাটবাট দেখে কোনো ঝুঁকি নেননি । তাই লতাকে মাসী বাড়ি রেখে পড়ানো । সালার কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার ডিগ্রি করার লতার খুব ইচ্ছা ছিল । কিন্তু বাড়ি থেকে সেভাবে সাড়া পায়নি । তাই তার উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা থেমে গেছে । লতা মেয়ে হিসাবে ঘোতনের উপযুক্ত । কিন্তু কঙ্কাবতীর খটকা অন্য জায়গায় । নাদনঘাট থেকে ভাল একটা সম্বন্ধ এসেছিল । সেই মেয়েটা যেমন শিক্ষিত, তেমনি মার্জিত । মেয়ের বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক । ভদ্র পরিবার । মেয়েটি ফর্সা না হলেও তাকে পুরোপুরি শ্যামলা বলা যাবে না । কঙ্কাবতী যতটুকু জেনেছিল, মেয়েটির স্বভাব-চরিত্র যেমন ভাল তেমনি মেয়েটি কর্মঠ । পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ শিখত । মেয়েটির প্রতি কঙ্কাবতীর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল । কিন্তু ঘোতন এককথায় নাকচ করে দিয়ে বলেছিল, “মেয়েটি কালো ।“ অথচ মেয়েটির বাবা নাদনঘাটের বিশিষ্ট মানুষ । সেখানকার মানুষ তাঁকে সমীহ করে চলে । কঙ্কাবতীর দৃষ্টিতে লতার চেয়ে নাদনঘাটের মেয়েটি ঘোতনের জীবনসঙ্গিনী হিসাবে বেশী উপযুক্ত ।
যাই হোক ঘোতনের ইচ্ছা অনুসারে লতার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হলো । কিন্তু গোঁ ধরলো ঘোতন । তার ইচ্ছা, দোকানটা আরও সাজিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে । অন্যদিকে বিয়ে দেরীতে হোক, লতা তার ঘোরতর বিরোধী । তাই ঘোতনের মতলব জানার পর লতা সরাসরি ঘোতনের দোকানে এসে হাজির । বর্ধমানের রসুলপুর থেকে মিঁয়া স্টেশন পৌঁছানো ভীষণ ঝকমারী । তবুও বর্ধমান, কাটোয়া হয়ে দুপুরের আগে সোজা ঘোতনের দোকানে । লতাকে দেখে ঘোতন অবাক ! কৌতুহলি দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ লতার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
ফ্যালফ্যাল করে তাকানো দেখে লতার ঝটিকা প্রশ্ন, “আপনি জীবনে কোনোদিন মেয়ে দেখেননি ? ঐভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন ? অনেক দূর থেকে এসেছি । কোথায় আমাকে বসতে বলবেন কিংবা খাবার এনে খাওয়াবেন, সেসব না করে হাঁদার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন !”
প্রশ্নের জেরবারে থতোমতো খেয়ে ঘোতন কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! ভ্যাবাচেকা খেয়ে তড়িঘড়ি করে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “বসুন ম্যাডাম ।“
উঁহু, ম্যাডাম নয় । আমি আপনার বৌ হতে যাচ্ছি, সুতরাং শুধুমাত্র লতা । তবে শুনুন, আমি বসতে আসিনি ?
“তবে ?” প্রশ্ন করেই আবার লতার দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে রইলো ।
এবার কিছুটা ধমকের শুরে লতা ঘোতনকে বলল, “মশাই, আর তাকাতে হবে না । কিছুদিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে ঘর বাঁধতে স্থায়ীভাবে আসছি । কিন্তু …?”
আবার কিন্তু কেন ?
আমাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসাটা দেরী করলে চলবে না । পুজোর পরে অগ্রহায়ণ মাসেই আমাদের বিয়ে হবে এবং সেটা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহেই । আমি পঞ্জিকা দেখে এসেছি । ৪ঠা অগ্রহায়ণ বুধবার, বিয়ের ভাল দিন । ঐদিন আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে বলুন । অন্যথা হলে, আমার দিকে ফ্যালফ্যাল তাকানোর আর সুযোগ পাবেন না । কথাটা মনে রাখবেন । তারপর দোকান ঘরের দিকে তাকিয়ে লতা বলল, “ঘরটা এত নোংরা কেন ? একটু গায়ে-গতরে খেটে পরিষ্কার রাখতে পারেন তো ?”
কী যেনো বলতে যাচ্ছিলো ঘোতন । তাকে থামিয়ে দিয়ে লতা বলল, “আমার দরকারি কথা বলা শেষ ! এবার আমি বাড়ি চললাম ।“
ঘোতন এতক্ষণ লতার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তার চোখা-চোখা কথাগুলি শুনছিলো আর ভাবছিলো মেয়ে তো নয়, পুরোমাত্রায় থানার দারোগা ! রাখঢাক নেই । সোজাসাপ্টা কথা সোজাসাপ্টাভাবে বলার অভ্যাস । সুতরাং এই মেয়ে নিয়ে তার কপালে কী আছে, কে জানে ? ঘোতনের মতো ঠাটবাট ছেলেকেও ঘোল খাওয়াতে লতা একাই একশ ! তারপর লতার মুখে চলে যাওয়ার কথা শুনে ঘোতন আরও ঘাবড়ে গেলো । কী মেয়েরে বাবা ! রসুলপুর থেকে বয়স্থা মেয়ে একা সোজা মিঁয়া স্টেশন পৌঁছানো, প্রচণ্ড ধকলের ব্যাপার । তার উপর দিনের দিন ফিরে যাওয়ার চিন্তা ! অতোটা পথ ফিরে যাওয়া খুবই কষ্টকর । যাতায়াতের ঝক্কি-ঝামেলা ভীষণ সাংঘাতিক ! লতার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ঘোতন এবার বেঁকে বসলো এবং বলল, “বাড়ি ফিরে যাওয়া হবে না । আজ এখানে থাকতে হবে । তার আগে আপনার খাওয়া-দাওয়া ।“
বিরবির করে লতা বলল, “ক্যাবলাকান্তের মুখে বোল ফুঁটেছে ।“
কী বলছেন বিরবির করে ?
বলছি, থাকার জন্য আসিনি । আর থাকলে লোকে আপনাকে দুষবে এবং বলবে, “বিয়ের আগে মেয়েটাকে বাড়ি ডেকে এনে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করছেন ! তাতে আপনার সম্মানহানি ঘটবে । সুতরাং মশাই, এবার আমার বাড়ি ফেরার পালা !”
উঁহু আপনাকে আমি একা ছাড়ছি না ।
তাহলে কী আপনি আমার সঙ্গে যাবেন ?
দরকার হলে যাবো ।
রসুলপুর, অনেক দূর । কথাটা ভেবে বলছেন তো ?
ঘোতন পড়েছে ফ্যাসাদে । অতো সাতপাঁচ ভেবে কথাটা বলেনি । এখন সত্যিই যেতে হলে রাতে বাড়ি ফেরা অসম্ভব । তবুও ঢোক গিলে বলল, “ম্যাডাম, আমি আপনার সঙ্গে যাবো ।“
বেশ ! রেডি হয়ে নিন ।
মিঁয়া স্টেশন থেকে তিনটে কুড়ির ট্রেন ধরে প্রথমে কাটোয়া । সেখানে নেমে বর্ধমানের বাস ধরার আগে বাস স্ট্যান্ডে দুজনে দুটো কেক্ কিনে গরম চা খেলো । বর্ধমান থেকে সন্ধ্যা ৭টায় বাস পেলো । বর্ধমান – বিষ্ণুপুর বাস । সোনামুখী হয়ে যাচ্ছে । সেই বাসে রসুলপুর ।
ঘোতন বাড়ি ফিরতে চাইলে লতা নাছোড়বান্দা, তার বাড়ি ফেরা হবে না । এতক্ষণ দুজনে খুব কাছাকাছি একসঙ্গে সফর করার জন্য তাদের কথাবার্তায় “আপনি” উঠে গিয়ে এখন শুধু “তুমি” । তাই একরকম জোর দিয়ে লতা বলল,”তোমাকে আমি ছাড়ছি না । ভয় নেই, আমরা এক ঘরের ভিতর শুয়ে তার কাটাবো না । তার গ্যারান্টি থাকলো ।“
অগত্যা ঘোতন লতাদের বাড়ি থাকার সিদ্ধান্ত নিলো ।
রাত্রিবেলায় খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন ! দেশী চিকেন, পুকুরের কাতলা মাছ ! রসুলপুরের বাস স্ট্যান্ডের ঘনাদার মিষ্টির দোকানের গরম গরম রসগোল্লা । আরও কতো কী !
তারপর…………?
তারপর পরেরদিন ভোরবেলায় পূর্ব আকাশে কেবল সূর্য উঠেছে । ঘোতন বাড়ি ফেরার জন্য জামা-কাপড় পরে রেডি । ঘোতনকে জামা-কাপড় পরা অবস্থায় দেখে ব্রজেশ্বরবাবু বললেন, “রেডি হলে চলবে না বাবা । দুটো ভাত খেয়ে রওনা দেবে ! কেননা অনেকটা পথ । বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যেতে পারে ।“ ব্রজেশ্বরবাবুর কথা শেষ হতেই কোথা থেকে লতা ছুটে এসে একেবারে ঘোতনের সামনে । হাঁপিয়ে গেছে বেচারা ! হাতে ছোট একটা পুটুলি । তার মধ্যে গোটা পাঁচ-ছয় কাঁচা পেয়ারা । দুটো পেয়ারা ঘোতনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আজ তোমার বাড়ি যাওয়া বন্ধ । আমি চা বানিয়ে আনছি । চুপচাপ চা খাও । তারপর বাজারে যাওয়া । বাজার থেকে ফিরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে তোমাকে শক্তিগড়ের ল্যাংচা খাওয়াতে নিয়ে যাবো । তারপর দুপুরের খাওয়ার পর কালী মন্দির । সেখানে গ্রামীন মেলা বসেছে । মেলায় তোমার সঙ্গে নাগরদোলায় উঠবো । আপাতত এই কয়েকটা প্রোগ্রাম । সুতরাং বাড়ি ফেরার একদম নাম করা চলবে না । তারপর ঘোতনকে লতা হাত ধরে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসিয়ে বলল, “এখানে চুপচাপ বসো । আমি এক্ষণি চা বানিয়ে আনছি ।“ ইত্যবসরে লতার মা দুটো প্লেটে দু-কাপ চা এনে হাজির ।
চা খাওয়ার পর লতা বাবাকে বলল, “আজ তোমাকে বাজারে যেতে হবে না । আমি বাজারে যাবো ।“ বাবাকে কথাটা বলেই ঘর থেকে বাজারের ব্যাগ এনে ঘোতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার দয়া করে আমার সঙ্গে বাজারে চলো ।“
বাজারটা লতাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে । লতার বাবা ব্রজেশ্বরবাবু সাধারণত সাইকেলে বাজারে যান । লতার একটা লেডিস্ সাইকেল রয়েছে । তা সত্ত্বেও লতা ঠিক করলো, “পায়ে হেঁটে বাজারে যাবে । তাতে ঘোতনের সাথে অনেক কথা বলা যাবে ।“
রাস্তায় রতন কাকার সাথে দেখা । রতন কাকা জিজ্ঞাসা করলে, “হনহন করে কোথায় চললি লতা ?”
বাজারে যাচ্ছি ।
কেন, তোর বাবা কোথায় গেলো ?
বাবার শরীরটা ভাল না । তাই আমি বাজারে যাচ্ছি ।
তোর সঙ্গের ছেলেটিকে তো চিনতে পারলাম না !
ইনি আমাদের বাড়ির কুটুম ।
কেমন কুটুম ? ইতিপূর্বে তাকে কখনও তো দেখিনি !
আমার বান্ধবীর দাদা । কাকা, আমার তাড়া আছে । আমি বাজারে চল্লুম ।
এক ঝলক মুচকী হাসি দিয়ে রতন কাকা লতাকে বললেন, “ছেলেটির সাথে তোর ভীষণ মানিয়েছে ।“
লতা রতন কাকার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাজারে ।
হঠাৎ রাস্তার বা-পাশের অর্জুন গাছ তলা থেকে প্রথমে একটা শিস দেওয়ার আওয়াজ । ঘোতন তাকিয়ে দেখে গাছের নীচে কতকগুলি ছেলের জটলা । ছেলেগুলোর চেহারার ধরন দেখে ঘোতন বুঝতে পারলো, উটকো ছেলে-পেলেদের জটলা । তারা আড্ডায় মত্ত । তারপর জটলার মধ্যে থেকে একজন উটকো ছেলে সম্ভবত তাদের মধ্যের অন্যজনকে চিৎকার করে লতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, চেয়ে দ্যাখ । তোর ভালবাসার লতার সাথে অন্য আর একজন নাগর ঘুরছে !”
ঘোতন দাঁড়িয়ে পড়লো । ঘোতনের শারীরিক কায়দা দেখে লতা ঘাবড়ে গিয়ে কোনোকিছু না ভেবে ঘোতনের হাত টেনে ধরে আরও জোরে হাঁটতে লাগল । বাজারে ঢুকে প্রথমে মাছ বাজারে ঢুকলো । সোনালী রঙের লোকাল ট্যাংরা মাছ । দামটা একটু বেশী । তারপর বড় সাইজের বোয়াল মাছ । মাটন কিনতে ঘোতন বারণ করেছিল । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! লতা বেশ খানিকটা মাটন কিনলো । তারপর সবজির বাজার । আলু, পিঁয়াজ, আদা, রসুন, কাঁচা লঙ্কা, টমেটো, পটল, গরমমশলা, ইত্যাদি কিনে এবার রিক্সায় উঠলো । লতার ভয়, গাছ তলার ছেলেগুলি আবার বিরক্ত করলে ঘোতনকে সামলানো দায় হয়ে দাঁড়াবে !
রিক্সা মৃদুমন্দ গতিতে এগোচ্ছে । অর্জুন গাছের কাছাকাছি আসা মাত্র লতা লক্ষ্য করলো, সবগুলি উটকো ছেলে লাঠি নিয়ে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়েছে । লতা পরিষ্কার বুঝতে পারলো ছেলেগুলির ধান্দা খারাপ ! মারপিট করার ধান্দা !
হঠাৎ উটকো ছেলেগুলির মধ্যে পল্লবকে দেখে ঘোতনের চোখ ছানাবড়া ! নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, ঘাটের মরাটা এখানে কেন ? তারপর কোনোকিছু বোঝবার আগেই উটকো ছেলেগুলি ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ……?
(চলবে)
Category: উপন্যাস
কয়েক মাস কেটে গেলো । ঘোতনের দোকান এখন অনেক চালু । দোকানের আয় থেকে পুঁজিও অনেক বেড়েছে । ঘোতন দোকানে খুব খাটছে । তার ইচ্ছা, ভাল ভাল ব্রান্ডের কাটা-কাপড় রাখা । যাতে তার টেলারিং ঢুকে একজন চাইলে, জামা-প্যান্টের কাপড় কিনে প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারবেন । সেইজন্য ঘোতনের অতিরিক্ত খাটুনি ।
অন্যদিকে কঙ্কাবতী ঘোতনকে অনবরত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে বিয়ের জন্য । হরিবল্লভপুরের বনমালী ঘটক কঙ্কাবতীর পিছনে লেগে রয়েছে । তাঁর হাতে নাকি তিনজন সুন্দরী পাত্রী রয়েছে । তাড়াতাড়ি যোগাযোগ না করলে তারাও হাত-ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা । বনমালীর তর সইছে না । তাঁর রোজ একবার করে তাগাদা দেওয়া চাই । তিনজন মেয়ের মধ্যে একজন মেয়ের বাবার নাম লাখহরি । তিনি সোমপাড়া বাজারের বড় ব্যবসায়ী । তিনি ব্যবসায়ী পাত্র খোঁজ করছেন । বনমালীর কাছে ঘোতনের খবর পেয়ে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন ঘোতনকে জামাই করার জন্যে । লাখহরির মেয়ের বয়স বেশী । গায়ের রঙ চাপা । চাপা থাকার কারণে পাত্র ঠিকমতো জুটছিলো না । যার জন্য বয়স বেশী । লাখহরিবাবু ভাবলেন, ঘোতনকে কিছু টাকা পয়সা দিলে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে ঘোতন রাজি হয়ে যাবে । তা ছাড়া খোঁজ খবর নিয়ে লাখহরিবাবু জেনেছেন, দোকানটা বাড়াতে ঘোতনের এখন অনেক টাকার দরকার ! সুতরাং এই সুযোগে ঘোতনকে টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে বোঝাতে পারলে তাঁর মেয়ে বিয়ের একটা বিহিত হবে । নতুবা মেয়ের দিকে তাকালে তাঁর ভীষণ কষ্ট ! মেয়ের সমবয়সী মেয়েদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে । একমাত্র তাঁর মেয়ের বিয়ে বাকী । সেইজন্য মেয়েটা বিষণ্ণতায় ভুগছে ।
বনমালী কঙ্কাবতীর সাথে দেখা করে লাখহরির মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলো । লাখহরিবাবুর নগদ টাকা যৌতুক দেওয়ার প্রস্তাবও, বনমালী কঙ্কাবতীকে জানালো । কিন্তু কঙ্কাবতী বনমালীকে বুঝিয়ে বলল, “বিয়ে করবে ঘোতন । পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছেলের মতামতকেই মা হিসাবে কঙ্কাবতী গুরুত্ব দেবে । তাতে লাখহরির মেয়েকে ঘোতন পছন্দ করলে কঙ্কাবতীর কোনো আপত্তি নেই । কঙ্কাবতীর নগদ টাকার উপর কোনো লোভ নেই । সে গতরে খেটে উপার্জন করার পক্ষপাতী । তার মতে, পরিশ্রম করে স্বচ্ছতার সঙ্গে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ অপরিসীম !
এদিকে ঘোতন বিয়ে করার ব্যাপারে বেঁকে বসলো । ঘোতন চাইছে, স্টেশন চত্বরে একটা বাড়ি বানাতে । হয় মিঁয়া স্টেশন কিংবা বাজারসৌ স্টেশনের আশেপাশে । কেননা তাদের চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে যাতায়াতের খুব সমস্যা । ব্যবসা চালাতে গেলে স্টেশন চত্বরে বাড়ি হলে সবদিক দিয়ে মঙ্গল । চড়ুইডাঙ্গা গাঁয়ে যেমন বড় ভাই রয়েছে, সে সেখানে জমি জায়গা চাষবাস নিয়ে থাকুক । আর একটা বাড়ি স্টেশন চত্বরে হলে ভাল হয় । সেইজন্য ঘোতন বিয়ে নিয়ে একেবারেই ব্যস্ত নয় ।
ইতিমধ্যে মিঁয়া স্টেশন লাগোয়া শক্তিপুর যাওয়ার রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠা জমি ও বাড়ির খোঁজ পেয়েছে । বাড়িতে দুখানি ঘর, রান্না ঘর, বাথ রুম ও একটি টিউবওয়েল রয়েছে । দামটা নিয়ে ঘোতনের একটু আপত্তি । তবে জায়গাটা ঘোতনের খুব মনে ধরেছে । স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট । আবার অন্যদিকে সাইকেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শক্তিপুর বাজার । জায়গাটা যার, তিনি কর্ণসুবর্ণ স্টেশনের কাছে পাকাপাকিভাবে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন । তিনি আর মিঁয়া ফিরতে চাইছেন না । তাঁর একমাত্র ছেলে সেখানকার হাইস্কুলের মাস্টার । তাই জায়গাটা বিক্রি করে দেওয়া তাঁদের উদ্দেশ্য ।
কঙ্কাবতী জায়গার দাম শুনে চিন্তায় পড়ে গেলো । অতো টাকার জোগাড় কীভাবে হবে সেই চিন্তায় অস্থির । অথচ ঘোতন জায়গাটা কিনতে মরিয়া ।
বোনেরা ঘোতনের পাশে এসে দাঁড়ালো । জমি ও বাড়িটা কেনার ব্যাপারে চার বোন সর্বতোভাবে দাদাকে সহায়তা করলো । তারাও চায়, স্টেশনের কাছাকাছি একটি বাড়ি হোক । বোনেদের সহায়তায় আর সামান্য কিছু ধার-দেনা করে ঘোতন বাড়ি-সহ জমিটা কিনলো ।
জমিটা কেনার জন্য আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে মনীষা যথেষ্ট সহযোগিতা করলো । যার জন্য ঘোতনের পক্ষে জমিটা কিনতে বেশী বেগ পেতে হলো না ।
জমিটা রেজিস্ট্রি হওয়ার সাথে সাথে গবরডাঙ্গা গ্রাম থেকে ব্রজেশ্বর কামাল কঙ্কাবতীর বাড়ি এসে উপস্থিত । তাঁর ছোট মেয়ের জন্য । ব্রজেশ্বর কামালের তিন মেয়ে । ছেলে নেই । প্রথম দুই মেয়ে বিবাহিত । বড় জামাই হাসপাতালের স্টাফ । বাড়ি বেলডাঙ্গা । আর দ্বিতীয় জামাই বিডিও অফিসের ক্লার্ক । বাড়ি বর্ধমানের রসুলপুরে । ছোট মেয়ের বিয়ে বাকী । ছোট মেয়েটা সালার কলেজ থেকে স্নাতক । চাকরি-বাকরি নেই । ছোট মেয়ের নাম লতা । লতার ইচ্ছা ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার । কিন্তু তার সে আশায় বালি । মানুষের সব আশা পূরণ হয় না । তেমনি লতার চাকরি পাওয়ার আশা পূরণ হলো না । যার জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে ব্রজেশ্বর কামালের বড্ড দেরী হয়ে গেলো । লতা একটু ডানপিটে ধরনের মেয়ে । গ্রামের সব ব্যাপারেই তার মাথাব্যথা । গাঁয়ে কে অসুস্থ, কে খেতে পেলো না, সব কিছুতেই তার জড়ানো চাই । আপদে-বিপদে সকলের পাশে থাকতে লতা ভীষণ সাবলীল ! ব্রজেশ্বরবাবু কাঙাল ঘোষের মুখে জানতে পেরেছেন, কঙ্কাবতী ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ করছে ! খবর জানা মাত্র ব্রজেশ্বরবাবু সোজা কঙ্কাবতীর দরবারে ।
কী আশ্চর্যের ব্যাপার, লতাকে ঘোতনের খুব পছন্দ । তাই মাকে সরাসরি জানিয়ে দিলো, “লতাকেই সে বিয়ে করতে চায় ।“
(চলবে)
অবশেষে প্রমোদ পাকাপাকিভাবে অনীশার দোকানে এসে উঠলো । এছাড়া উপায় নেই । বাড়ি্তে প্রমোদ ত্যাজ্যপুত্র । বাড়িতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ । তাই অনীশার সাথে ব্যবসায় হাত লাগালো প্রমোদ । দোকানটা আরও কীভাবে বড় করা যায় সেই ব্যাপারে দুজনের ধ্যান-জ্ঞান । কাজে তারা এখন অনেক বেশী চাঙা । বেঁচে থাকার পথ এখন দোকান থেকে আয়ের উপর । তা ছাড়া চায়ের দোকানের পাশাপাশি খাবারের রেস্টুরেন্টের উপর তারা জোর দিলো । ধীরে ধীরে স্টেশন চত্বরে দোকানটির কলেবর বৃদ্ধি পেলো ।
বেশ কিছুদিন পর চায়ের দোকানের পাশাপাশি খাবারের দোকান চালু হয়ে গেলো । অনেক টোটোওয়ালা, ভ্যান-ওয়ালা, অনীশার খাবারের দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার । দুপুরে ডাল, ভাত, তরকারি, মাছের ঝোল দিয়ে হোটেল চালু । পেট পুরে খাওয়া, অথচ খরচাও খুব কম । যার জন্য অনীশার খাবারের দোকানে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে । রাতে রুটি তরকারি, ডিমের ওমলেট্ । ট্রেনের অনেক যাত্রী যাওয়া-আসার রাস্তায় অনীশার হোটেলে ঢুকছেন । খাবার খেয়ে খরিদ্দারেরা পরিতৃপ্ত ।
স্টেশন এলাকায় একটিমাত্র খাবারের দোকান । রাস্তার পাশে হোটেল খোলার জন্য হোটেলের প্রতি খরিদ্দারদের দৃষ্টি সর্বক্ষণ । অনীশা ও প্রমোদ দুজনে আলাদাভাবে হোটেলের কাজ ভাগ করে নিলো । খাবারের দোকানের দায়িত্ব রইল প্রমোদের উপর । খরিদ্দারের চাহিদা অনুসারে বাজার করা এবং খাবারের আয়োজন করা, প্রমোদের দায়িত্ব । খরিদ্দারদের রুচি অনুযায়ী হোটেলের খাবারের প্রস্তুতি । প্রমোদ সেই কাজটা খুব যত্ন সহকারে পালন করছে । যার জন্য হোটেলের সুনাম খুব তাড়াতাড়ি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । অন্যদিকে অনীশার দায়িত্ব, চায়ের দোকান ঠিকমতো চালু রাখা । যদিও অনীশা দীর্ঘদিন ধরে চায়ের দোকান সামলাচ্ছে, সেই কারণে তার চায়ের দোকান ভীষণ ভাল চলছে । দোকানের আয় থেকে এখন তাদের হাসিমুখে সংসার ।
কঙ্কাবতী ঘোতনকে তাগাদা দিলো, অনীশাদের দো-তলায় শীঘ্র দোকান খুলতে । কিন্তু দোকান খোলা নিয়ে ঘোতনের ছিল ভীষণ আড়ষ্টতা । এতদিন তার সারা শরীরে আলস্য ভর করে ছিল । মায়ের কথা শুনে তার টনক নড়ল । ঘোতনের আন্তরিক উপলব্ধি, এবার তাকে দোকান খোলার উপর নজর দিতে হবে । তার একটাই চিন্তা, দোকান খোলার পুঁজির সংস্থান ?
ঘোতনের ইচ্ছা ছিল, রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান খোলার । কিন্তু মহাজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যেটা বুঝেছে তাতে ব্যবসা শুরুর সময় বেশ কিছু নগদ টাকার দরকার ! নতুবা নতুন দোকানের ক্ষেত্রে মহাজনেরা বাকীতে কারবার করতে রাজি নয় । প্রথমে নগদ টাকা দিয়ে মাল তুলতে হবে । তারপর কাজের হালহকিকৎ দেখে ধার-বাকীতে লেনদেন । সুতরাং দোকান খোলার প্রারম্ভে ঘোতনের মোটা টাকা দরকার । দোকান খুলতে গিয়ে ঘোতনের অভিজ্ঞতা মাকে সবিস্তারে জানালো । তাই কঙ্কাবতী নিজেও শহরে কাপড়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করলো । তাঁদের সেই এক বক্তব্য, নতুন দোকানের ক্ষেত্রে বিনা পয়সায় মাল দিতে তাঁরা গররাজি ।
মাকে হতাশ অবস্থায় দেখে ঘোতন তার মত বদলালো । পুঁজির অভাবে রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান আর খুলতে চায় না । সে টেলারিং দোকান খুলতে চায় । ইতিমধ্যে সে টেলারিংয়ের কাজ অনেকটাই শিখেছে । টেঁয়া স্টেশন বাজারে আলম ফকিরের টেলারিং দোকানে বসে কাপড় কাটা এবং সেলাইয়ের কাজ ঘোতনের অনেকটাই রপ্ত । আলম ফকির আন্তরিকতার সাথে ঘোতনকে কাজ শিখিয়েছে । এর পেছনে একটা কারণও রয়েছে । একবার কিছু উটকো মস্তানদের পাল্লায় পড়ে তার দোকান বন্ধ হওয়ার উপক্রম । জোরজুলুম করে পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জঘন্য ধান্দা ছিল ! উটকো মস্তানদের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে উপযাজক হয়ে আলম ফকিরকে বাঁচাতে ঘোতন ষড়যন্ত্রকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । যার জন্য সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল আলম ফকির । তার অনেকদিন পর যখন ঘোতন আলম ফকিরের কাছে কাজ শিখতে গেলো, তখন আলম ফকির সাদরে স্বাগত জানিয়ে ঘোতনকে কাজ শেখাবার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হলো । আলম ফকির বলেছিল, “কাজটা শিখতে কিছুদিন সময় লাগবে । কিন্তু মনোযোগ দিয়ে কাজ শিখলে ভবিষ্যতে টেলারিং দোকান খুললে স্থায়ী আয়ের একটা বন্দোবস্ত হবে ।“ তাই ঘোতন এখন ভাবছে, সেই আলম ফকিরের ভবিষ্যতবাণী ঘোতনের জীবনে ফলে গেলো । ঘোতন টেলারিং দোকান খুলতে চলেছে ।
ঘোতন ছুটলো আলম ফকিরের কাছে । কীভাবে দোকান খুলবে এবং টেলারিং দোকানে কী কী সামগ্রী লাগবে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে আনলো । সেই সময় আলম ফকির ঘোতনকে আরও বলল, “প্রয়োজনে সে সবরকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ।“ আলম ফকিরের আশ্বস্থতা পেয়ে ঘোতন যারপরনাই আনন্দে উদ্বেলিত ।
ইতিমধ্যে আলম ফকির একটি পুরানো সেলাই মেশিন ঘোতনকে দিয়েছে । ঊষা কোম্পানীর মেশিন । মেশিনটির অবস্থা এখনও অনেক ভাল । চালু মেশিন । ঘোতন ঠিক করলো, ঐ পুরানো মেশিন দিয়ে তার টেলারিং দোকান চালু করবে । তারপর স্থানীয় ব্যাঙ্কের স্মরণাপন্ন হবে । লোনের জন্য । লোন না নিলে দোকানটা সাজাতে পারবে না । ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখায় দেখা করে এসেছে । লোনের ব্যাপারে শাখা প্রবন্ধক যেভাবে পরামর্শ দিয়েছেন । সেদিকেই হাঁটছে ঘোতন ।
কঙ্কাবতী চাইছে, ঘোতন শারীরিক কসরত করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ।
অনীশার রেস্টুরেন্টের উপরের তলায় দোকান ঘর সাজালো ঘোতন । খুব সাধারণভাবে দোকান ঘর সাজিয়ে তুললো । পুরানো একটি সেলাই মেশিন । তার সাথে কিছু সরঞ্জাম যেমন মাপ করার ফিতে ও স্কেল, কাপড় কাটার কাঁচি, বিভিন্ন রঙের সুতো, ইত্যাদি । স্টেশনে যাওয়ার পথে দোকান হওয়ায় সুবাদে কিছুদিনের মধ্যে ঘোতনের টেলারিং দোকান মানুষের নজরে পড়লো । দোকানে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে । ছেঁড়া ফাটা কাপড় যেমন সেলাইয়ের জন্য তেমনি নতুন শার্ট, প্যান্ট, পায়জামা, ব্লাউজ, সায়া, ইত্যাদি তৈরীর জন্য খরিদ্দারদের ভিড় বাড়ছে । তবে ডোরাকাটা চেক লুঙ্গির সেলাই প্রতিদিন থাকছে । লুঙ্গি অর্থাৎ দুই মুখ জোড়া লাগানো কাপড় যাকে বলে কাছা-কোঁচাহীন ধুতি পরনের চল এলাকায় বেশী । যার জন্য প্রতিদিন বেশ কয়েকটি লুঙ্গি সেলাইয়ের কাজ থাকে ।
কাজের প্রতি ঘোতনের খুব মনোযোগ । ব্যবসায় সে দাঁড়াতে চায় । আশেপাশের ঝুটঝামেলা থেকে সে এখন অনেক দূরে । ঝুটঝামেলার কারণে মাঝে মাঝে ডাক এলে তাদের সরাসরি “না” করে দিচ্ছে । তার একটাই বক্তব্য, তাকে তার ভবিষ্যত জীবনের কথা ভাবতে হবে । নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । সুতরাং কোনোরকম অপ্রীতিকর কাজে সে আর জড়াতে চায় না । ঘোতনের সংসার-প্রীতি অনেকের আবার অপছন্দ, যার জন্য তারা মাঝে মাঝে ঘোতনকে উত্ত্যক্ত করে । কিন্তু ঘোতন তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল । ফলে তার বিরূদ্ধে কিছু বন্ধু-বান্ধবের রোষ বাড়ছে । সেটা ঘোতন টের পেয়েও নির্বিকার । ঐসব উটকো ছেলেদের কীভাবে টাইট দিতে হয় সেই ঔষধ তার জানা । সেইজন্য উটকো ছেলেদের তড়পানিতে ডরায় না ঘোতন । তার মাথায় একটাই চিন্তা, ব্যবসা বাড়ানো !
দেখতে দেখতে ঘোতনের এক বছর কেটে গেলো । কঙ্কাবতী ঘোতনকে তাগাদা দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য । ঘোতনের এখন বিয়ের বয়স, বরং বলা চলে বিয়ের মোক্ষম সময় । তাই বিয়েতে ঘোতনকে রাজি করানো । কিন্তু ঘোতন এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাইছে না । সে দোকানটাকে আরও বাড়াতে চায় !
ব্যাঙ্ক থেকে অল্প কিছু লোন পেলো । তাতে নতুন একটা মেশিন কিনলো এবং প্যান্ট-শার্টের জন্য কাপড় কিনলো । দোকান ঘরটাও কাঠের আসবাব দিয়ে সাজালো । দোকান ঘরটা এমনভাবে সাজালো খরিদ্দারেরা দোকানে ঢুকে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ঘোতনকে বলতে বাধ্য হল, “এতদিনে মনে হচ্ছে সত্যিকারের টেলারিং দোকানে ঢুকলাম ।“ খরিদ্দারদের কথাগুলি ঘোতনকে খুব তৃপ্তি দেয় ।
প্যান্ট শার্ট কাটিং করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে সোজা টেঁয়ার আলম ফকিরের দোকানে । তার কাছ থেকে ভাল করে বুঝে তারপর প্যান্টের বা শার্টের কাপড়ের কাটিং । এইভাবে ঘোতন নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকলো । এর মধ্যে স্থানীয় এক ভদ্রলোক পর্দার কাপড় সেলাইয়ের অর্ডার দিলেন । সেই কাজ হাতছাড়া করলো না ঘোতন । রাত-দিন অতিরিক্ত খেটে সেই অর্ডার পালন করলো । এইভাবে তার টেলাইং কাজের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেলো ।
ঘোতনের টেলারিং দোকান থেকে আয়ের পরিমান ক্রমশ বাড়ছে । সংসার চালাতে মাকে নিয়মিত টাকা দিচ্ছে ঘোতন । যদিও তার সব বোনেরা কিছু না কিছু কাজ করছে, ফলে তাদের জন্য ঘোতনের চিন্তা কম । তবে বোনদের বিভিন্ন আবদার কঙ্কাবতী মেটায় । ঘোতন ও অনীশা এক বিল্ডিংয়ে সুন্দর ও লাভজনকভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে । ভাই-বোনের ব্যবসা দেখে অনেকের মুখে এখন আলোচনার বিষয়, “কঙ্কাবতীর ছেলে-মেয়েগুলি ভীষণ কর্মঠ ।“
ব্যাঙ্কের ম্যানেজারবাবু পোস্ট-স্যাঙ্ক (Post Sanction Inspection) ইন্সপেকশনে এলেন । তিনি টেলারিং দোকান দেখে ভীষণ উৎফুল্ল । ঘোতনের কাজকর্মের বর্তমান অবস্থান ও ব্যবসার গতিধারা দেখে তিনি নিশ্চিত হলেন, “যোগ্য জায়গায় লোনটা দেওয়া হয়েছে ।“ মিষ্টি খেতে পীড়াপীড়ি করলো ঘোতন । তিনি কিছুই খেলেন না । কিন্তু টেলারিং থেকে ব্যাঙ্কে ফিরে যাওয়ার আগে বললেন, “এক কাপ চা দাও বরং চা খেয়ে ওঠা যাক ।“
চা খেয়ে বিদায় নিলেন ম্যানেজারবাবু ।
চলবে
কঙ্কাবতী প্রমোদের বাড়ি গিয়ে হতাশ ! প্রমোদের বাড়িতে আদর-আপ্যায়ন দূরে থাক তার বাবা-মায়ের ব্যবহারে মর্মাহত । প্রমোদের বাবার অমানবিক ব্যবহারে উদ্বিগ্ন ! হতাশ হয়ে অনিন্দ কঙ্কাবতীকে বলল, “এখানে অনীশার বিয়ে দেওয়া চাপ হয়ে দাঁড়াবে ।“
অনিন্দকে আশ্বস্ত করে কঙ্কাবতী বলল,”ধীরে, আগেভাগে নেতিবাচক মন্তব্য করো না । আজকের ঘটনাটা নিয়ে প্রমোদের সঙ্গে আলাদা বসে আলোচনা করলে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যাবে ।“
কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে মাকে ঘোতন বলল, “আমাদের জাতি ও আমাদের পরিবার সম্বন্ধে তাঁরা অনেক আগেই অবগত । তা সত্ত্বেও কেন বিশ্রিভাবে প্রমোদের বাবা বললেন, আপনাদের সম্প্রদায়ে আমরা আত্মীয়তা করতে পারব না । তা ছাড়া তিনি আরও বললেন, আমাদের পরিবার নাকি তাঁদের অপছন্দ ? এইসব কথা বলার পেছনে তাঁদের কী অভিপ্রায়, বোঝা গেলো না ।“
“প্রমোদ বাড়িতে অনীশার সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসার বিষয়টি ভালভাবে বোঝাতে পারেনি । অথবা অনীশাকে ভালবাসে, একথাটাও বাড়িতে জানায়নি । ফলে বাড়ির লোকজন ভাবছেন, পাঁচটা পরিবার যেমন মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ছেলের বাড়ি হাজির হন তেমনি আমরাও আমাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের বাড়ি হাজির হয়েছি । যার জন্য প্রমোদের বাবা ঘুণাক্ষরেও মেয়ের সম্বন্ধে ইতি বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন না । জাত-পাতের ইস্যু তুলে আমাদের বিদায় দিলেন ।“ এই কথাগুলি ছেলের প্রশ্নের উত্তরে বলেই কঙ্কাবতী আবার বলল, “প্রমোদকে এবার দায়িত্ব নিতে হবে তার বাবা-মাকে বোঝানোর । তাহলে তাঁরা আর তাঁদের ছেলের বিয়ে আমাদের অনীশার সাথে বিয়ে দিতে গররাজি হবেন না । আমরা এখানে এসেছি অনীশার কথার উপর নির্ভর করে । আমরা কিন্তু প্রমোদের সাথে কোনোরকম আলাপ আলোচনা করিনি । সুতরাং এবার ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে পরবর্তী সিদ্ধান্তে আসতে হবে ।“
কঙ্কাবতী সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো ।
উন্মুখ হয়ে বসেছিলো অনীশা । বাবা-মায়ের ফ্যাকাশে মুখ দেখে অনীশা কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলো না । তাই সে আগ বাড়িয়ে কিছু জানতেও চাইলো না । বরং কঙ্কাবতী অনীশার কাছে এসে বলল, “তুই একটু প্রমোদকে খবর দে, সে যেনো সত্বর আমাদের সাথে দেখা করে ।“ আর একটা কথা, “প্রমোদের বাড়ি গিয়ে আমরা ভাল খবর আনতে পারিনি ।“
“কী হয়েছে, আমাকে একটু খুলে বলবে ?” মাকে জোর দিলো অনীশা ।
প্রমোদের বাবা আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ে দিতে অনিচ্ছুক !
অনীশা জানতে চাইলো, “কেন অনিচ্ছুক, সেই ব্যাপারে কিছু কী বলেছে ?”
সেসব কিছু বলেননি । শুধুমাত্র তিনি এই মুহূর্তে তাঁর ছেলের বিয়ে আমাদের পরিবারের সাথে দিতে রাজি নন । তাঁর এইটুকু ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন ।
অনীশা আর কথা বাড়ালো না । সে বুঝতে পারলো, কোথাও একটা ভুল বোঝবুঝির শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে । সেটা শোধরানোর জন্য সম্ভবত মা প্রমোদকে ডেকে পাঠালো ।
*****************************
প্রমোদকে ডেকে তার বাবা-মা জানিয়ে দিয়েছেন, চড়ুইডাঙ্গার অনিন্দবাবুর মেয়েকে তাঁরা পুত্রবধূ করে ঘরে তুলতে নারাজ । প্রমোদ অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু তার বাবা-মা কোনো যুক্তি মানতে রাজি নন । ফলে অনীশার সাথে বিয়ের জন্য বাড়ির অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে প্রমোদ প্রচণ্ড হতাশ !
অনীশার পাঠানো খবর পেয়ে প্রমোদ সশরীরে দোকানে হাজির ।
“তোমার বাবা নাকি আমাদের বিয়ে মানতে নারাজ ? কথাটা কী সত্যি ?” অনীশা প্রমোদের কাছে জানতে চাইলো ।
প্রমোদ চুপ করে থাকলো ।
ঠিক সেই সময় অনীশার চায়ের দোকানে কঙ্কাবতী উপস্থিত । প্রমোদকে দেখতে পেয়ে কঙ্কাবতী বলল, “ আমি তোমাকে খোঁজ করছিলাম ?”
কাঁচুমাচু হয়ে প্রমোদ কঙ্কাবতীকে বলল, “ঐদিন আপনাদের প্রতি বাবা-মায়ের ব্যবহারে আমি লজ্জিত । আমি বাবা-মায়ের হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।
“ব্যাপারটা ক্ষমার প্রশ্ন নয় । প্রশ্ন হচ্ছে “তুমি অনীশাকে ভালবাসো” এই কথাটা বাড়িতে বুঝিয়ে বলতে পারোনি । এটা তোমার একধরনের গাফিলতি । বাবা-মাকে আগেভাগে বোঝানো থাকলে তোমার বাবা-মা নিশ্চয় ভাল ব্যবহার করতেন । আমি তোমার বাবা-মায়ের ব্যবহারে এতটুকু বিভ্রান্ত হইনি । আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি তোমার মা-বাবাকে তোমাদের দুইজনের ঘর বাঁধার স্বপ্নের কথা খুলে বোঝাতে পারোনি । তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ । স্কুলের মাস্টার মশাই ছিলেন । তাঁর একটা নিজস্ব মতামত রয়েছে । তিনি গাঁয়ের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি । তাই তাঁর ছেলের বিয়ের ব্যাপারে অনেক স্বপ্ন থাকতে পারে । সুতরাং আমার অনুরোধ, তুমি আগে মা-বাবাকে বোঝাও । তারপর তোমাদের চার হাত এক-করার দায়িত্ব আমাদের !” কঙ্কাবতী প্রমোদের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “আমি কী তোমাকে বোঝাতে পারলাম ?”
মাথা নেড়ে তার সম্মতির কথা জানালো প্রমোদ ।
বাবার কাছে নিজের বিয়ের কথা বলতে গিয়ে এবার রীতিমতো ধমক খেলো প্রমোদ । তার বাবার সাফ জবাব, তিনি বেঁচে থাকতে বে-জাতের মেয়েকে কিছুতেই ঘরে তুলতে পারবেন না ।
প্রমোদের বাবা আগেকার ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী । ছেলে-মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনোরকম আপসে যেতে রাজী নন । তাই প্রমোদের বাবা জাত-পাত দেখে পাত্রী নির্বাচন করার পক্ষপাতী । প্রমোদের কোনো যুক্তি তিনি মানলেন না ।
বাবার কড়া ভাষার কচকচানিতে প্রমোদের মনটা ভেঙ্গে চুড়মার । কয়েকদিন চুপচাপ ঘরে বসে কাটিয়ে দিলো । ভাবনার জগতে সে নিমজ্জিত, অতঃপর কী করণীয় ?
বন্ধুবান্ধবদের সাথে শলাপরামর্শ মোতাবেক প্রমোদ সিদ্ধান্ত নিলো, “সে বাবা-মায়ের অমতে অনীশাকে বিয়ে করবে !”
তারপর…………?
তারপর হঠাৎ দোকান বন্ধ রেখে অনীশা প্রমোদের সঙ্গে উধাও । কেউ তাদের খোঁজখবর পাচ্ছে না । এমনকি প্রমোদের বাবা কঙ্কাবতীর বাড়ি গিয়ে ছেলের খোঁজ নিয়ে এসেছে । সেখানে তাকে দেখতে না পেয়ে কী করবেন, সেটাই ভাবছেন ! কঙ্কাবতীকেও তার মেয়ে অনীশা কিছুই বলে যায়নি । সবটাই তারা গোপন রেখেছে । যার জন্য কঙ্কাবতী নিজেও তার মেয়ের উধাও হওয়ার ব্যাপারে পুরোটাই অন্ধকারে । তবে কঙ্কাবতী এবার পরিষ্কার বুঝতে পারছে, প্রমোদ তার ভালবাসাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত । এটা একটা ভাল লক্ষণ । এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রমোদ সত্যিই অনীশাকে ভালবাসে ।
চারিদিকে খোঁজাখুঁজি । ঘোতন কয়েকটি জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে বোনের কোনো হদিস পেলো না । সম্ভাব্য সব জায়গায় হানা দিয়ে ঘোতন হতাশ ! তার ধারণা, অনীশা ও প্রমোদ পালিয়ে লোকালয় থেকে অনেক দূরে চলে গেছে এবং সেই খবরটা উদ্ধার করাও খুব কঠিন !
প্রমোদের বাবা স্থানীয় পঞ্চায়েতে নালিশ জানালেন, তাঁর ছেলেকে নাকি কঙ্কাবতীর গুণ্ডা ছেলে ঘোতন গায়েব করে দিয়েছে । কোথায় আটকে রেখেছে সেই হদিস এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । অথচ তার ছেলে প্রচণ্ড গোবেচারা । সে কোনো ঝুটঝামেলার মধ্যে থাকে না । শোনা যাচ্ছে, কঙ্কাবতীর মেয়ে অনীশাকেও পাওয়া যাচ্ছে না । সুতরাং ছক কষে কঙ্কাবতী ও তার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে প্রমোদকে গায়েব করে দিয়েছে । তিনদিন ধরে ছেলেটা নিখোঁজ । অথচ আজ পর্যন্ত জানা গেলো না, “ছেলেটি কোথায় লুকিয়ে রয়েছে ?”
পঞ্চায়েত প্রধান কড়জোড়ে প্রমোদের বাবাকে জানিয়ে দিলেন, দুজনেই অনেক বড় । নিজেরা নিশ্চয় যুক্তি করে পালিয়েছে । সুতরাং সেখানে পঞ্চায়েতের বা পুলিশের ভূমিকা নেই বললেই চলে । দেশের সুনাগরিক হিসাবে এবং অ্যাডাল্ট হিসাবে তাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আইনগত বাঁধা নেই । সেই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে হস্তক্ষেপ করা আইন-বিরোধী ।
তাহলে কী আমার ছেলেকে আর ফিরে পাবো না ?
“অবশ্যই ফিরে পাবেন । প্রয়োজনে দৈনিক খবরের কাগজে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিন ।“ এই কথাগুলি বলে পঞ্চায়েত প্রধান অতিরিক্ত আর একটি বাক্য ব্যয় করলেন না । বরং স্থান ত্যাগ করলেন ।
প্রমোদের বাবা থানা পর্যন্ত গেলেন । সেখানে একটা মিসিং ডায়েরী করলেন । কিন্তু সেখানেও ছেলে ফিরে পাওয়ার কোনো হদিস পেলেন না । কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তিনি নন । অনেক ভেবেচিন্তে প্রমোদের বাবা জেলা প্রশাসনের স্মরণাপন্ন হলেন ।
এইদিকে প্রমোদ ও অনীশা সোজা রামপুরহাট । তারামায়ের মন্দিরে পুজো দিয়ে পুরোহিতকে প্রমোদ বলল, “ঠাকুর মশাই, আমি ও অনীশা একে অপরকে ভালবাসি এবং দুইজনে বিয়ে করতে চাই । আপনি আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করুন ।“
পুরোহিত মশাই বিয়ের সরঞ্জাম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । ঠিক সন্ধ্যা সাতটার সময় পুরোহিত মশাই বিয়ের পিঁড়িতে বর ও কনেকে ডাকলেন । অন্যদিকে তারামায়ের মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি চলছে । ঐদিকে সান্ধ্যকালীন মায়ের পূজো এবং এইদিকে প্রমোদ ও অনীশার বিয়ে, দুটিই সমানতালে চলছে । প্রমোদের ও অনীশার বিয়ের সময় পুরোহিত ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি উপস্থিত নেই । হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে বিয়ের সময় উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি ।
হঠাৎ পুলিশ নিয়ে বিয়ের আসরে সরাসরি হাজির প্রমোদের বাবা । সঙ্গে প্রমোদের মা ও গাঁয়ের কয়েকজন গণ্যমান্য গ্রামবাসী ।
পুলিশকে উদ্দেশ্য করে প্রমোদের বাবা বললেন, “দেখুন স্যার । নিজের চোখে দেখুন । আমার ছেলেটাকে তুলে এনে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে । আপনি এর একটা বিহিত করুন । মেয়েটার ছোট ভাই এলাকার নামকরা মস্তান । তার অঙ্গুলি হেলনে আমার ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে ।“
পুরোহিতকে পুলিশ বললেন, “এই বিয়ে বন্ধ করুন ।“
বেঁকে বসলো প্রমোদ । তাই প্রমোদ পুরোহিতকে বলল, “আপনি বিয়ের পর্ব চালিয়ে যান । আপনি বিয়ের কাজে থামবেন না ।“
আবার পুলিশ পুরোহিতকে বললেন, “আপনি বিয়ে বন্ধ করুন ।“
পুরোহিত ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশ বললেন, “স্যার, আমি বরের নির্দেশ মতো কাজ করছি । যা বলার বিয়ে যিনি করছেন সেই বরকে বলুন ।“
পুলিশ প্রমোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমোদবাবু, আপনার বাবা আমাদের কাছে লিখিত নালিশ জানিয়েছেন আপনার নাকি আপনার অমতে বিয়ে হচ্ছে । এটা কী সঠিক ?”
“একদম বেঠিক । আমরা অ্যাডাল্ট । দুজনের পূর্ণ সম্মতিক্রমে এই বিয়ে হচ্ছে । সুতরাং বাবার লিখিত নালিশ এইক্ষেত্রে খাটবে না ।“ বলেই পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বিয়ের মন্ত্র বলতে শুরু করলো প্রমোদ ।
পুলিশ প্রমোদের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেল, “সরি, দুইজনের মতে যেহেতু বিয়েটা সংঘটিত হচ্ছে সেখানে আমাদের কিচ্ছু করার নেই ।“ তারপর পুলিশ যেকজন এসেছিলেন, জিপে উঠে ফিরে গেলেন ।
প্রমোদের বাবা রেগে ছেলেকে শুধুমাত্র মারতে বাকী । যাচ্ছেতাইভাবে গালিগালাজ করলেন । গ্রামের মানুষের সামনে রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “আজ থেকে প্রমোদ আমার ত্যাজ্যপুত্র । আমি তার মুখ দর্শন করতে চাই না ।“ বলেই সবাইকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।
দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)
— ( চলবে )
কঙ্কাবতীর মাথায় হাত ! বৃহস্পতিবারদিন সাধারণত বিক্রিবাট্টা কম । গেরস্তের বাড়ি থেকে নগদ টাকা বের করা নাকি সংসারের অমঙ্গল । চিরাচরিত ধ্যানধারণার সংস্কার এখনও গাঁয়ের দিকে বিদ্যমান । গাঁয়ের মানুষের কথা ভেবে কঙ্গাবতী যদিও বৃহস্পতিবার বাজার থেকে সব্জীও কম তোলে । সকাল আটটায় বেরিয়ে তিনটি গ্রাম ঘোরা হয়ে গেলো । কিন্তু বিক্রির হালহকিকৎ দেখে কঙ্কাবতী হতাশ ! অগত্যা ভর দুপুরে বিরক্তমুখে বাড়ি ফিরলো । বাড়ি ফিরে দেখে, বড় মেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে । তার চোখ দুটি ছলছল !
তানিশাকে তানিশার নিজের ইচ্ছামতো অনেক আগেই বিয়ে দিতে হয়েছিল কঙ্কাবতীকে । তানিশা তখন সাগরের প্রেমে বিহ্বল । তাই তাকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না কঙ্কাবতীর । ফলে নিজের মতের বিরূদ্ধে গিয়ে সাগরের সাথে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল । এই মুহুর্তে তানিশাকে দেখে কঙ্কাবতী রীতিমতো উদ্বিগ্ন।
মাকে দেখে তানিশার কান্না শুরু হলো । তার কী কান্না ! তানিশার কান্না থামানো দায় হয়ে দাঁড়ালো ! কঙ্কাবতী যতবার কান্না থামিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইছে, ততবার তানিশার কান্নার ঊর্ধ্বগতি বাড়ছে ।
শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে কান্না থামানোর জন্য ধমক দিলো কঙ্কাবতী ।
শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছলো তানিশা । তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল । তাকে দেখেই কঙ্কাবতীর মনে হচ্ছে, তার বড় মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । মুখটা শুকনো । মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন খায়নি । মাথার চুল উসকো-খুসকো । চেহারার করুণ দশা । অবিন্যস্ত বেশভূষা । এত সুন্দর দেখতে তার মেয়েগুলি, অথচ তানিশাকে দেখলে মনে হবে সে কঙ্কাবতীর পেটের মেয়ে নয় । অনেক কষ্টে তার কান্না থেমেছে বটে, কিন্তু তখনও তানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । মুখ দিয়ে তার কথা বের হচ্ছে না । কঙ্কাবতীর চোখ গরমের জন্য তানিশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো । পিঠের কাপড় সরিয়ে মাকে দেখতে ইশারা করল । কঙ্কাবতী তানিশার পেছনের পিঠ দেখে বিস্ময়ে হতবাক ! সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কাবতীর মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, “তোকে এভাবে কে পেটালো ?”
এতক্ষণ পর তানিশার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে কথা বের হলো, “তোমার গুণধর জামাই !”
কঙ্কাবতী ভীষণ রেগে গিয়ে উল্টে তানিশার উপর চোটপাট ! বুদ্ধুর মতো লাঠির ঠ্যাঙানি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি ফিরে এলি । একবারও ভাবলি না, তোকে শ্বশুর বাড়ির লোক অন্যায়ভাবে মেরেছে । সুতরাং এর একটা বিহিত হওয়া দরকার । তুই স্পটে যতটা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারতিস, এখন সেটা অনেক কমে যাবে । কিছু করতে না পারলে অন্তত ফোঁস করতে পারতিস । তা না করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলি । এটা একটা মুর্খতার পরিচয় ! তোর হারাবার কিছু ছিল না । সব হারিয়ে তুই বাড়ির দিকে পা রাখছিস, সুতরাং তোকে অন্তত তাদের বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত “তোর একটা আত্মসম্মান আছে” । সেই আত্মসম্মানে তারা আঘাত করেছে । সুতরাং শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সহজে ছেড়ে দেবে না । আহাম্মকের মতো লাঠির প্রহার খেয়ে পালিয়ে এলি । তারা তোকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল । দুটো লাঠির ঘা’য়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল । আমার পেটের মেয়ে হয়ে এই শিক্ষা মায়ের কাছ থেকে কী পেয়েছিস ? দেশে কী আইন-প্রশাসন নেই । থানায় গিয়ে নালিশ জানাতে তোকে কে বাধা দিয়েছিল ? সেগুলি না করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোজা পলায়ন ! এটা তোমার একদম ঠিক হয়নি । বিয়েটা করেছিলে নিজের পছন্দ মতো । বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ঐ পাষণ্ড ছেলেটার সুমিষ্ট কথা শুনে গলে গিয়িছিলি । খোঁজ খবর নিয়ে আমি এমনও বলেছিলাম, ছেলেটা বখাটে ! কিচ্ছু কাজকর্ম করে না । তা ছাড়া ছেলেটার স্বভাব চরিত্র ভাল না । বিয়ের পরে ছেলেটাকে তার বাবা-মায়ের উপর নির্ভর করতে হবে ।“ তুই আমার কথা শুনলি না । উল্টে মাকে সন্দেহ করলি, “আমি নাকি তোদের সম্পর্কটাকে সন্দেহ করছি ?”
তখন তোর বিয়ের জন্য তর সইছিল না । আমি ঢিলা দিয়ে তোর বাবাকে ফাগুনডাঙায় পাঠিয়েছিলাম, সাগরদের বাড়ির খোঁজখবর নিতে । তোর বাবা ফাগুনডাঙা গাঁয়ের আশেপাশের মানুষের সঙ্গে খোঁজখবর নিয়ে বলেছিল, “সাগর ছেলেটার সাথে বিয়ে হলে মেয়েটা সুখী হতে পারবে না ।“ সাগরের নৈতিক চরিত্র নাকি খুব খারাপ । তা ছাড়া উপার্জনের জায়গাটা নেই । কাজকর্ম কিচ্ছু করে না । সাগরদের পরিবারের ব্যাপারে তোর বাবার উষ্মার কথা তোকে জানাতে পারিনি, পাছে তুই অসন্তুষ্ট হস্ । বিয়ের সময় দাবী-দাওয়ার লম্বা লিষ্ট, যেটা কোনোরকমে ম্যানেজ করেছিলাম । বিয়ের পরেও সাগরের দাবীমতো পঞ্চাশ হাজার টাকা গোপনে পৌঁছে দিয়েছিলাম তোর সুখের কথা ভেবে ।
প্রিয় ভালবাসার মানুষটি লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো । অথচ তার বিরূদ্ধে একটা কথাও বললি না । সুতরাং এই অবস্থায় আমার বাড়িতে বসে অসহায়ের মতো কাঁদলে হবে না । এক্ষুণি আমার সাথে তোকে যেতে হবে !
কোথায় যাবো ? আমি কিন্তু ঐ লম্পটদের বাড়ি আর যেতে চাই না ।
সেকথা বললে হবে না মা । সমস্যা সৃষ্টির মূলে তুমি । সুতরাং সমস্যা মোকাবিলা তোমাকেই করতে হবে । আমি কিন্তু সাগরকে অত সহজে ছেড়ে দেবো না । আমার মেয়েকে যে বা যারা তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের আমি যতক্ষণ উচিত শিক্ষা দিতে না পারছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই । আমার নাম কঙ্কাবতী । কঙ্কাবতী কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না । অন্যায়ের সঙ্গে আপোশ করা আমার ধাতে নেই । আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সুতরাং তাদের সারাজীবন মেয়েকে ভরণপোষন দিতে হবে । নতুবা আমি আইনের দ্বারস্থ হব । দেশ থেকে এখনও আইন শৃঙ্খলা উঠে যায়নি । প্রয়োজন হলে আমি আইনি সাহায্য নেবো ।
সাগরদের বাড়ি পড়েছে বলরামপুর থানার অধীনে । থানায় ছুটলো কঙ্কাবতী । সঙ্গে অনিন্দ । বড়বাবু থানায় উপস্থিত ছিলেন । কঙ্কাবতী বড়বাবুর চেম্বারে সোজা ঢুকে গেলো ।
“স্যার, আমার মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে ।“ কঙ্কাবতী কথাগুলি বলেই মেয়ের পিঠের কাপড় সরিয়ে এবং ব্লাউজের হুক খুলে বড়বাবুকে মারের আঘাতের চিহ্নগুলো দেখালো । আঘাতের চিহ্নগুলি দেখিয়ে চোখ লাল করে বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, এটা কী সুস্থ মানবিকতার লক্ষণ ?”
বড়বাবু ঐ দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না । তাই অস্বস্তিবোধ করছিলেন । তিনি মৃদু স্বরে কঙ্কাবতীকে আপত্তি করে বললেন, “প্লীজ আপনারা বসুন । আমাদের মহিলা পুলিশ আধিকারিক চেম্বারে ঢুকলে তাঁর সামনে ক্ষত চিহ্নগুলি দেখাবেন ।“ বড়বাবু উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে মহিলা পুলিশ চেম্বারে ঢুকলেন । তাঁকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ম্যাডামের ঘটনাটা নোট করুন ।“
“উঁহু স্যার ! ঘটনাটা নোট করলে হবে না । এফ-আই-আর নিতে হবে ।“ কঙ্কাবতী বড়বাবুকে অনুরোধ করলো ।
“আপনি কাদের বিরুদ্ধে এফ-আই-আর করতে চান ?” মহিলা পুলিশ আধিকারিক জানতে চাইলেন ।
“মেয়ের স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ।“
গৃহবধূ নিগ্রহের ঘটনাটা শুনে বড়বাবু দৃশ্যত ক্ষুব্ধ । যার জন্য তিনি মহিলা পুলিশ আধিকারিককে নির্দেশ দিলেন, “এফ-আই-আর হয়ে গেলে আপনি ও মেজবাবু আমার সঙ্গে মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি চলুন । এই জাতীয় ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা সত্বর করা আশুকর্তব্য । অমানবিক কী ভয়ঙ্কর নিগ্রহ, দেখলেন ম্যাডাম ! অল্প বয়সের বৌকে কীভাবে মেরেছে । পিঠের দাগগুলি দেখে মনে হচ্ছে বাঁশ দিয়ে বলদ গরুকে ঠাঙাবার মতো ।“ মহিলা পুলিশ আধিকারিক মাথা নেড়ে বড়বাবুর কথার সম্মতি জানালেন ।
“সাগরবাবু, বাড়ি আছেন ?” বড়বাবু কঙ্কাবতীর জামাইকে ডাকলেন ।
বাড়িতে পুলিশ দেখে সাগর ভয় পেয়ে গেলো । বিপদ আসন্ন ভেবে পুলিশ দেখা মাত্র সাগর বাড়ির পেছন দিয়ে উধাও । শ্বশুর মশাই পুলিশের হ্যাপার খপ্পড় থেকে দূরে থাকতে তিনিও বাড়ি থেকে উধাও । শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বড়বাবু নিশ্চিত, শ্বশুর বাড়ির লোকজন তানিশাকে অমানুষিকভাবে মেরে তাড়িয়েছে । সাগর ও তানিশার শ্বশুরকে সত্বর থানায় দেখা করতে শাশুড়িকে নির্দেশ দিয়ে বড়বাবু থানায় ফিরে গেলেন ।
কঙ্কাবতী মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ।
বড়বাবু রাতে হঠাৎ হানা দিয়ে সাগরকে না পেয়ে তার বাবাকে বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করলেন । তারপর সোজা থানার লক আপে । থানার বড়বাবুর ধারণা, বাবাকে ধরলেই ছেলে ধরা দিতে বাধ্য । পালিয়ে বেশীদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে না । পুলিশের বক্তব্য, “কান টানলে মাথা আসবেই ।“
অ্যারেস্ট করার আগে সাগরের বাবা থানার বড়বাবুকে চেপে ধরলেন, “আমাকে অ্যারেস্ট করার অপরাধ ?”
“ছেলের বৌকে নিগ্রহ এবং তাকে ‘অ্যাটেম্প টু মার্ডার’ করার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল ।“
এর প্রমাণ কী ?
অভিযোগকারী আপনার বৌমা, তানিশা । সাক্ষী দিয়েছেন কঙ্কাবতী ও আপনাদের গাঁয়ের মাতবর সুফল তরফদার ।
মায়ের কাছে সমস্ত ঘটনা শোনার পর ঘোতন রেগে আগুন ! তার বড় বোন তানিশাকে মেরে পিঠে রক্ত বের করে দিয়ে কিনা প্রমাণ চাইছে ? নিজের মনে স্বগতোক্তি করে ক্রদ্ধ স্বরে বলল, “এবার সাগরকে গণধোলাই না দিতে পারলে তার শান্তি নেই ।“ ঘোতন সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে সাগরের ঠিক হদিস পেলো । তাকে খুঁজে বার করলো । কলার চেপে ঘর থেকে বের করে রাতের অন্ধকারে বেদম প্রহার । রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ঘোতন বলল, “তানিশাকে মেরেছিস, এবার তোকে কে বাঁচাবে ?” তারপর ভ্যানে চাপিয়ে তার হাত পা বেঁধে থানায় পৌঁছে বড়বাবুর চেম্বারের সামনে রেখে ঘোতন উধাও । সাগরকে কে মেরেছে তার কোনো প্রমাণ রইল না । ঘোতন এইভাবে বড় বোনের মার খাওয়ার বদলা নিলো ।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাগর অল্প বয়সের একটি মেয়েকে আবার বিয়ে করলো ।
বড় মেয়েটা বাড়িতে থাকার কারণে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, সব জায়গায় কঙ্কাবতী উত্তর দেয় তার চারটি মেয়ে । চারটি মেয়েই বড়, ডাগর-ডোগর ।
অন্যদিকে তানিশার কঙ্কাবতীর বাড়িতে স্বাভাবিক জীবন যাপন । কঙ্কাবতীর নির্দেশমতো টেলারিং শিখতে লাগল তানিশা । এইজন্য সপ্তাহে তিনদিন বহরমপুরে যেতে হচ্ছে তানিশাকে । এক বছরের কোর্স । তবে একবছরের মধ্যে কোনো বড় টেলারিং দোকানে তাকে হাতে কলমে এক মাস শিখতে হবে । টেলারিং কাজটা তানিশার খুব মনে ধরেছে । কাজটা তার ভাল লাগে । তাই খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটা শিখছে তানিশা । কঙ্কাবতীর বক্তব্য, কাজটা শিখলে তানিশা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে । বাবা-মা সারাজীবন বাঁচবে না । সুতরাং জীবনে চলার পথে অসুবিধা ঘটলে উপার্জনের জন্য চিন্তা থাকবে না । এক মুঠো ভাতের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে ।
মিঁয়া হল্ট স্টেশন বাজারে একটা ঘরের সন্ধান পেলো কঙ্কাবতী । ছোট্ট একফালি জায়গার উপরে ছোট্ট একটি ঘর । যার পান-বিড়ির দোকান ছিল, তিনি তার একমাত্র মেয়ের কাছে জলপাইগুড়ি চলে গেছে । স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন । যার জন্য জায়গাটা খুব অল্প দামে পাওয়া গেলো । গুমটি কুঠুরি বটে, কিন্তু বাজারের মাঝখানে । যারজন্য তানিশার টেলারিং সকলের নজরে পড়বে এবং তার টেলারিং ব্যবসা ভাল চলবে । কঙ্কাবতীর দূরদর্শিতা ভীষণ গঠনমূলক । যার জন্য মেয়েদের স্বাবলম্বী করার দিকে কঙ্কাবতীর ঝোঁক ।
তানিশার বহরমপুরের টেলারিং কোর্স শেষ । সেই কারণে তানিশার টেলারিং ব্যবসা খোলার উদ্যোগ নিলো কঙ্কাবতী । সত্বর দোকানটা খোলার একটাই কারণ, সামনে দুর্গা পুজা । দুর্গা পুজার মার্কেট ধরতে মরিয়া কঙ্কাবতী । ধার-দেনা করে একটা সেলাই মেশিন কিনলো । শুভ জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার দিন দোকান উদ্বোধন করার মনস্থির করলো । সেই মতো গুমটি ঘরটি সাজালো । উদ্বোধনের দিন নিয়ামতপুর ব্লকের বি-ডি-ও ম্যাডামকে উপস্থিত থাকতে নিমন্ত্রণ জানালো কঙ্কাবতী । ম্যাডাম কথা দিলেন, রথের দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন ।
কঙ্কাবতীর বিপদ পদে পদে । রথের আগের রাত্রিতে দোকান ঘর সাজানো শেষ । তানিশা ও কঙ্কাবতী দোকানের সাটার বন্ধ করে বাইরেটা ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজালো । বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা দোকান ঘর সাজানোর তারিফ করলেন । তারপর তারা বাড়ি ফিরে খেতে বসেছে, এমন সময় তাদের দোকানের উল্টোদিকে মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের ভম্বলের টেলিফোন, “তোমাদের দোকানের বাইরের সাজানো ফুল ছিঁড়ে ফেলছে । শিগ্গির না এলে সাটার ভাঙতে পারে ।“
“কারা ফুল ছিঁড়ছে, তাদের চিনতে পারলি ?” জানতে চাইল কঙ্কাবতী ।
“না । গামছা দিয়ে তাদের মুখ ঢাকা ।“ মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারী ভম্বল জানালো ।
ঘোতন শুনতে পেয়ে খাওয়া ফেলে ছুটলো দুর্বৃত্তদের ধরতে । ঘোতন পৌঁছানোর আগে তারা পালিয়েছে । কিন্তু ঘোতন হাল ছাড়বার পাত্র নয় । ভম্বলের কাছে জানতে পারলো তারা সংখ্যায় তিনজন এবং সাইকেলে তারা পূর্ব দিক দিয়ে পালিয়েছে । ঘোতনের অনুমান তারা বেশীদূরে পালাতে পারেনি । যেদিক দিয়ে পালিয়েছে সেইদিকে মনু ময়রার মোটর বাইক নিয়ে ছুটলো ঘোতন । বাবলা নদীর কিনারের রাস্তা দিয়ে তারা তখন প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল ছোটাচ্ছে ! ঘোতন মোটর বাইক নিয়ে তিনজনের সামনে দাঁড়ালো । দুর্বৃত্তরা তখন মারমুখী । প্রচণ্ড আক্রোশে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন তেজী জওয়ান । নিমেষের মধ্যে তিনজনকে ঘায়েল করে ফেললো । তিনটিই তখন রাস্তার উপর গড়াগড়ি । তারপর দুর্বৃত্তদের কাছে ঘোতনের প্রশ্ন, “দোকান ঘর কেন ভাঙলি ?” কিন্তু কিছুতেই উত্তর দিতে চাইছে না । তাদের মুখে কুলুপ আঁটা । ঘোতন জানে, কীভাবে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে হয় । একজন দুর্বৃত্তের বুকের পা রেখে বলল, এবার না বললে একে একে তিনটিকেই জাহান্নামে পাঠাবো । ততক্ষণে ভম্বল ও তানিশার মেজ বোন মনীষা স্পটে হাজির । অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল, “তাদের পাঠিয়েছিল সাগর !” ঘোতনের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার । রাগ মেটাতে তানিশার টেলারিং দোকান খোলা বানচাল করার ধান্দা !
ঘোতন এবার দুর্বৃত্তদের কড়া ভাষায় বলল,”ভাল চাস্ তো দোকান ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনি করে সাজিয়ে আয় । নতুবা তোদের সাগরের মৃত্যু আমার হাতে !”
পরেরদিন সকাল দশটায় ব্লক আধিকারিকের উপস্থিতিতে তানিশার টেলারিংয়ের দোকান উদ্বোধন হয়ে গেলো । মিঁয়াগ্রাম বাজারে এই প্রথম মেয়েদের টেলারিং দোকান । যার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো । কঙ্কাবতী খুশী, কেননা বড় মেয়ের অন্তত নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা হিল্লে হল ।
************************
গাঁয়ের কাকু ষষ্টীকমলকে নিয়ে কঙ্কাবতী পড়েছে মহা ফাঁপরে । মনীষা জানিয়েছিল, বিপাশা নাকি রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় ষষ্টীকমলকাকুর বাসায় যায় এবং সেখানে কিছু সময় দাদুর সাথে কাটায় । বিপাশার দাদু অর্থাৎ ষষ্টীকমল বিপাশাকে খুব ভালবাসে । গেলেই লজেন্স, চকলেট এবং আরও ভাল ভাল লোভনীয় খাবার খাওয়ায় । দশ মিনিট মতো দাদুর সঙ্গে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে । এটা নাকি এখন বিপাশার নিত্য রুটিন । কঙ্কাবতীর এতে কোনো আপত্তি ছিল না । ষষ্টীকমলকে কঙ্কাবতী অনেক আগে থেকেই কাকু সম্বোধনে ডাকে । তেমনি কাকু কঙ্কাবতীর পারিবারের এবং ব্যবসার খোঁজখবর নেয় । গাঁয়ের একজন বয়স্ক মানুষ তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছে, এতে কঙ্কাবতী খুশী । কেননা গাঁয়ে অনেক মানুষের বসবাস, অথচ ঘুণাক্ষরেও তাঁরা কঙ্কাবতীদের দিকে ফিরেও তাকায় না । সেই নিরিখে ষষ্টীকমলকাকা তাদের পরিবারের একজন হিতাকাক্ষী মানুষ । তাই তাঁকে কঙ্কাবতী শ্রদ্ধা করে । তা ছাড়া তাঁর একমাত্র ছেলে ও বৌ দুইজনেই খুব শিক্ষিত । ছেলেটা সরকারি উচ্চপদে চাকুরিরত এবং বৌমা রেলওয়েতে কর্মরত । দুইজনেরই শহরে পোস্টিং । খুব সকালে তারা অফিসে বেরিয়ে যায়, আর ফেরে রাত্রিতে । ষষ্টীকমলকাকুর একটাই মেয়ে । তার বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ে জামাই থাকে বেনারসে । ষষ্টীকমলকাকুর গিন্নি আবার বছরের বেশীর ভাগ সময় মেয়ের কাছে থাকে । কারণ মেয়ের সন্তানকে দেখাশোনা করতে হয় । জামাই বড় মাপের ডাক্তার । মেয়ে সরকারি দপ্তরে আধিকারিক । দায়িত্বপূর্ণ কাজ । ফলে সেখানে কাকীমাকে বাচ্চা আগলাবার জন্য থাকতে হচ্ছে । তাই ছোট মেয়ের কাকুর বাড়ি যাওয়া-আসায় কঙ্কাবতীর আপত্তি নেই ।
কিন্তু মনীষা খবর দিলো, বিপাশা আজকাল ষষ্টীকমলকাকুর বাড়ি বেশী সময় কাটাচ্ছে । এটা চোখে লাগছে । দাদুর সাথে এমন কী কথা, যার জন্য বিপাশাকে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট কাটাতে হচ্ছে । এটা মনীষার ভাল লাগছে না । তাই মনীষা মাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছে ছোট বোনটার দাদু-প্রীতি কমাতে ।
ষষ্টীকমলকাকু ভাল সরকারি চাকরি করতেন । শোনা গেছে তিনি প্রচণ্ড ঘুষ খেতেন । সেটা দপ্তরের কয়েকজনের চোখে ভাল লাগে না । তাঁরা ফঁন্দি পেতে ঘুষের টাকা নেওয়াটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে দেন । এমনকি কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা সংস্থা ষষ্টীকমলকাকুকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেন । তারপর যা হওয়ার সেটাই হয়েছে । প্রথমে বিভাগীয় তদন্ত । তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত ! সেই কারণে অবসরের ষাট বছর হওয়ার আগে চাকরি জীবন থেকে তাঁর ছুটি । এখন তাঁর অবসরকালী জীবন । কিন্তু তিনি যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ । যার জন্য চেহারা ধরে রেখেছেন । কেউ তাঁকে দেখলে বলবে না, তিনি রিটায়ার্ড ।
স্কুল ছুটি হলে বিপাশা পা টিপে টিপে চুপি চুপি দাদুর ঘরে ঢোকে । দাদু আগেভাগেই বাড়ির সদর দরজা খোলা রাখেন । বিপাশার স্কুল শুরু হয় সকাল সাতটায় এবং শেষ হয় বেলা সাড়ে-এগারোটায় । স্কুল থেকে হাঁটা পথে দাদুর বাড়ি পনের মিনিট । তাই বিপাশা সাধারণত দুপুর বারোটা নাগাদ দাদুর বাড়িতে ঢোকে । দাদু তখন সেজেগুজে ফিটফাট । নাতনীর জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন । বিপাশার জন্য নিত্যদিন চকলেট বাধা । এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল রেডি রাখে । ঠিক ঐ সময় দাদুর বাড়ি ফাঁকা । ছেলে-বৌমা তখন অফিসে । সকাল দশটার মধ্যে কাজের মাসি কাজ সেরে চলে যায় । কাকীমা দীর্ঘদিন মেয়ের বাড়ি বেনারসে । বাড়িতে তখন দাদু ছাড়া কেউ থাকে না । ফাঁকা বাড়ি পেয়ে বিপাশা মহা আনন্দে সারা বাড়ি ধেইধেই ঘুরে বেড়ায় ।
ষষ্টীকমলকাকু তখন বিপাশার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন । বিপাশা সদ্য মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে পাঠরত । হাপালো মেয়ে । ডাগর-ডোগর । বিপাশাকে দেখলে মনে হবে সে কলেজে ফাইনাল ইয়ার । সুতরাং বিপাশা যখন এঘর-সেঘর দৌড়-ঝাঁপ করে, তখন তার পুরো শরীরটা নড়াচড়া করে । সেটা দেখতে ষষ্টীকমলকাকুর খুব ভাল লাগে । বিপাশা দাদুর ঐরকম তাকানোতে খুব মজা পায় । এইজন্য অনেক সময় দাদুর ঠিক সামনে স্কিপিং করার মতো লাফায়, আর হাসে । তখন দাদুরও চোখে-মুখে প্রশান্তির হাসি ।
বেলা বারোটা পার হয়ে গেলে ষষ্টীকমলবাবু উতলা হয়ে উঠেন । যতক্ষণ বিপাশা ঘরে না ঢুকছে ততক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন । ষষ্টীকমলবাবু নিজেও জানেন না, বিপাশার জন্য তাঁর মন কেন আনচান করে ?
মায়ের নীরবতা লক্ষ্য করে মানষী ভাবলো, সে একদিন সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে বিপাশা দাদুর বাড়িতে ঢুকে ঠিক কী কিরে ? তার এত সময় কাটানোর কারণ কী ? মানষীর ধন্দে কিছুতেই কাটছে না, দাদুর বাড়িতে যাওয়ার বিপাশার এত উৎসাহ কেন ? মানষী সুযোগ বুঝে ষষ্টীকমলদাদুর বাড়ি হানা দেওয়ার অপেক্ষায় রইল ।
********************
এদিকে কঙ্কাবতীর তৃতীয় মেয়ে অনীশা ও অনিন্দ ঠিক করলো, মিঁয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে তারা চায়ের দোকান খুলবে । অনীশা খুব পরিশ্রমী । পড়াশুনায় বেশীদূর এগোতে পারেনি, কিন্তু পরিশ্রম করার ক্ষেত্রে তার কোনো অলসতা নেই । অনিন্দ অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তারা বাপ-বেটী চায়ের দোকান খুলবে । মিঁয়াগ্রামের নাসিরুদ্দিনের দু-কাঠার জমির উপর একটা ভাঙাচোরা ঘর স্টেশনে যাওয়ার রাস্তার উপরেই পড়ে রয়েছে, খানিকটা পরিত্যক্তভাবে । নাসিরুদ্দিন সাম্প্রতিককালে তার একমাত্র ছেলের কাছে নিমতিতাতে (মুর্শিদাবাদ জেলা) বাস করছে । ছেলে নিমতিতার একটি নামজাদা হাই স্কুলের শিক্ষক । ছেলে একরকম জোর করে নাসিরুদ্দিনকে নিমতিতায় তাদের কাছে নিয়ে রেখেছে । ফলে ঐ জায়গাটায় তাঁর প্রস্তাবিত দোকান ঘর আর খোলা হয়নি । নাসিরুদ্দিনের ইচ্ছা ছিল ঐ জায়াগায় খাওয়ার রেঁস্তরা খোলার । তবে এই মুহূর্তে জমি সমেত ভাঙা বাড়িটা নাসিরুদ্দিনের বেচার ইচ্ছা ছিল না । কঙ্কাবতী তাঁকে চেপে ধরায় নাসিরুদ্দিন অমত করতে পারেনি । একরকম জলের দামে জায়গাটা কঙ্কাবতী কিনেছে । এটা কেনার ক্ষেত্রে অনিন্দ মধ্যস্থতা করলে জায়গাটা হাত ছাড়া হয়ে যেতো । জমিটা কেনার প্রতি দৃষ্টি মিঁয়ার অনেক ব্যবসায়ীর ছিল । তাই অতি সন্তর্পণে সুযোগ বুঝে কঙ্কাবতী সোজা নিমতিতায় হাজির । ট্রেনে পৌঁছে গিয়েছিল কঙ্কাবতী এবং সে একা গিয়েছিল । পাছে জানাজানি হয়ে যায়, এইজন্য বাড়ির কাউকে সঙ্গে নেয়নি । নিমতিতা স্টেশনের কাছাকাছি ভাগীরথী গঙ্গা । সবাই জানে, ভাগীরথী গঙ্গা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে এসেছে । আরও একটা মজার ব্যাপার, নিমতিতার উল্টোদিকে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা । ভাগীরথী গঙ্গা রাজশাহী জেলা দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশে পদ্মা নামে খ্যাত । সেই হিসাবে পদ্মা নদী ভাগীরথীর প্রধান শাখা নদী । সেই নিমতিতায় নাসিরুদ্দিনের ছেলের বাড়িতে বসে জায়াগাটা কেনাবেচা এবং চুক্তিপত্রের কাগজপত্রের কাজকর্ম সম্পন্ন হয় । নাসিরুদ্দিনের সেই জায়গার উপর অনিন্দ ও অনীশা চায়ের দোকান খোলার মনস্থির করলো ।
( ক্রমশ )
কঙ্কাবতীর মাথায় হাত ! বৃহস্পতিবারদিন সাধারণত বিক্রিবাট্টা কম । গেরস্তের বাড়ি থেকে নগদ টাকা বের করা নাকি সংসারের অমঙ্গল । চিরাচরিত ধ্যানধারণার সংস্কার এখনও গাঁয়ের দিকে বিদ্যমান । গাঁয়ের মানুষের কথা ভেবে কঙ্গাবতী যদিও বৃহস্পতিবার বাজার থেকে সব্জীও কম তোলে । সকাল আটটায় বেরিয়ে তিনটি গ্রাম ঘোরা হয়ে গেলো । কিন্তু বিক্রির হালহকিকৎ দেখে কঙ্কাবতী হতাশ ! অগত্যা ভর দুপুরে বিরক্তমুখে বাড়ি ফিরলো । বাড়ি ফিরে দেখে, বড় মেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে । তার চোখ দুটি ছলছল !
তানিশাকে তানিশার নিজের ইচ্ছামতো অনেক আগেই বিয়ে দিতে হয়েছিল কঙ্কাবতীকে । তানিশা তখন সাগরের প্রেমে বিহ্বল । তাই তাকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না কঙ্কাবতীর । ফলে নিজের মতের বিরূদ্ধে গিয়ে সাগরের সাথে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল । এই মুহুর্তে তানিশাকে দেখে কঙ্কাবতী রীতিমতো উদ্বিগ্ন ।
মাকে দেখে তানিশার কান্না শুরু হলো । তার কী কান্না ! তানিশার কান্না থামানো দায় হয়ে দাঁড়ালো ! কঙ্কাবতী যতবার কান্না থামিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইছে, ততবার তানিশার কান্নার ঊর্ধ্বগতি বাড়ছে ।
শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে কান্না থামানোর জন্য ধমক দিলো কঙ্কাবতী ।
শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছলো তানিশা । তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল । তাকে দেখেই কঙ্কাবতীর মনে হচ্ছে, তার বড় মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । মুখটা শুকনো । মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন খায়নি । মাথার চুল উসকো-খুসকো । চেহারার করুণ দশা । অবিন্যস্ত বেশভূষা । এত সুন্দর দেখতে তার মেয়েগুলি, অথচ তানিশাকে দেখলে মনে হবে সে কঙ্কাবতীর পেটের মেয়ে নয় । অনেক কষ্টে তার কান্না থেমেছে বটে, কিন্তু তখনও তানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । মুখ দিয়ে তার কথা বের হচ্ছে না । কঙ্কাবতীর চোখ গরমের জন্য তানিশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো । পিঠের কাপড় সরিয়ে মাকে দেখতে ইশারা করল । কঙ্কাবতী তানিশার পেছনের পিঠ দেখে বিস্ময়ে হতবাক ! সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কাবতীর মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, “তোকে এভাবে কে পেটালো ?”
এতক্ষণ পর তানিশার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে কথা বের হলো, “তোমার গুণধর জামাই !”
কঙ্কাবতী ভীষণ রেগে গিয়ে উল্টে তানিশার উপর চোটপাট ! বুদ্ধুর মতো লাঠির ঠ্যাঙানি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি ফিরে এলি । একবারও ভাবলি না, তোকে শ্বশুর বাড়ির লোক অন্যায়ভাবে মেরেছে । সুতরাং এর একটা বিহিত হওয়া দরকার । তুই স্পটে যতটা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারতিস, এখন সেটা অনেক কমে যাবে । কিছু করতে না পারলে অন্তত ফোঁস করতে পারতিস । তা না করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলি । এটা একটা মুর্খতার পরিচয় ! তোর হারাবার কিছু ছিল না । সব হারিয়ে তুই বাড়ির দিকে পা রাখছিস, সুতরাং তোকে অন্তত তাদের বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত “তোর একটা আত্মসম্মান আছে” । সেই আত্মসম্মানে তারা আঘাত করেছে । সুতরাং শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সহজে ছেড়ে দেবে না । আহাম্মকের মতো লাঠির প্রহার খেয়ে পালিয়ে এলি । তারা তোকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল । দুটো লাঠির ঘা’য়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল । আমার পেটের মেয়ে হয়ে এই শিক্ষা মায়ের কাছ থেকে কী পেয়েছিস ? দেশে কী আইন-প্রশাসন নেই । থানায় গিয়ে নালিশ জানাতে তোকে কে বাধা দিয়েছিল ? সেগুলি না করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোজা পলায়ন ! এটা তোমার একদম ঠিক হয়নি । বিয়েটা করেছিলে নিজের পছন্দ মতো । বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ঐ পাষণ্ড ছেলেটার সুমিষ্ট কথা শুনে গলে গিয়িছিলি । খোঁজ খবর নিয়ে আমি এমনও বলেছিলাম, ছেলেটা বখাটে ! কিচ্ছু কাজকর্ম করে না । তা ছাড়া ছেলেটার স্বভাব চরিত্র ভাল না । বিয়ের পরে ছেলেটাকে তার বাবা-মায়ের উপর নির্ভর করতে হবে ।“ তুই আমার কথা শুনলি না । উল্টে মাকে সন্দেহ করলি, “আমি নাকি তোদের সম্পর্কটাকে সন্দেহ করছি ?”
তখন তোর বিয়ের জন্য তর সইছিল না । আমি ঢিলা দিয়ে তোর বাবাকে ফাগুনডাঙায় পাঠিয়েছিলাম, সাগরদের বাড়ির খোঁজখবর নিতে । তোর বাবা ফাগুনডাঙা গাঁয়ের আশেপাশের মানুষের সঙ্গে খোঁজখবর নিয়ে বলেছিল, “সাগর ছেলেটার সাথে বিয়ে হলে মেয়েটা সুখী হতে পারবে না ।“ সাগরের নৈতিক চরিত্র নাকি খুব খারাপ । তা ছাড়া উপার্জনের জায়গাটা নেই । কাজকর্ম কিচ্ছু করে না । সাগরদের পরিবারের ব্যাপারে তোর বাবার উষ্মার কথা তোকে জানাতে পারিনি, পাছে তুই অসন্তুষ্ট হস্ । বিয়ের সময় দাবী-দাওয়ার লম্বা লিষ্ট, যেটা কোনোরকমে ম্যানেজ করেছিলাম । বিয়ের পরেও সাগরের দাবীমতো পঞ্চাশ হাজার টাকা গোপনে পৌঁছে দিয়েছিলাম তোর সুখের কথা ভেবে ।
প্রিয় ভালবাসার মানুষটি লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো । অথচ তার বিরূদ্ধে একটা কথাও বললি না । সুতরাং এই অবস্থায় আমার বাড়িতে বসে অসহায়ের মতো কাঁদলে হবে না । এক্ষুণি আমার সাথে তোকে যেতে হবে !
কোথায় যাবো ? আমি কিন্তু ঐ লম্পটদের বাড়ি আর যেতে চাই না ।
সেকথা বললে হবে না মা । সমস্যা সৃষ্টির মূলে তুমি । সুতরাং সমস্যা মোকাবিলা তোমাকেই করতে হবে । আমি কিন্তু সাগরকে অত সহজে ছেড়ে দেবো না । আমার মেয়েকে যে বা যারা তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের আমি যতক্ষণ উচিত শিক্ষা দিতে না পারছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই । আমার নাম কঙ্কাবতী । কঙ্কাবতী কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না । অন্যায়ের সঙ্গে আপোশ করা আমার ধাতে নেই । আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সুতরাং তাদের সারাজীবন মেয়েকে ভরণপোষন দিতে হবে । নতুবা আমি আইনের দ্বারস্থ হব । দেশ থেকে এখনও আইন শৃঙ্খলা উঠে যায়নি । প্রয়োজন হলে আমি আইনি সাহায্য নেবো ।
সাগরদের বাড়ি পড়েছে বলরামপুর থানার অধীনে । থানায় ছুটলো কঙ্কাবতী । সঙ্গে অনিন্দ । বড়বাবু থানায় উপস্থিত ছিলেন । কঙ্কাবতী বড়বাবুর চেম্বারে সোজা ঢুকে গেলো ।
“স্যার, আমার মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে ।“ কঙ্কাবতী কথাগুলি বলেই মেয়ের পিঠের কাপড় সরিয়ে এবং ব্লাউজের হুক খুলে বড়বাবুকে মারের আঘাতের চিহ্নগুলো দেখালো । আঘাতের চিহ্নগুলি দেখিয়ে চোখ লাল করে বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, এটা কী সুস্থ মানবিকতার লক্ষণ ?”
বড়বাবু ঐ দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না । তাই অস্বস্তিবোধ করছিলেন । তিনি মৃদু স্বরে কঙ্কাবতীকে আপত্তি করে বললেন, “প্লীজ আপনারা বসুন । আমাদের মহিলা পুলিশ আধিকারিক চেম্বারে ঢুকলে তাঁর সামনে ক্ষত চিহ্নগুলি দেখাবেন ।“ বড়বাবু উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে মহিলা পুলিশ চেম্বারে ঢুকলেন । তাঁকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ম্যাডামের ঘটনাটা নোট করুন ।“
“উঁহু স্যার ! ঘটনাটা নোট করলে হবে না । এফ-আই-আর নিতে হবে ।“ কঙ্কাবতী বড়বাবুকে অনুরোধ করলো ।
“আপনি কাদের বিরুদ্ধে এফ-আই-আর করতে চান ?” মহিলা পুলিশ আধিকারিক জানতে চাইলেন ।
“মেয়ের স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ।“
গৃহবধূ নিগ্রহের ঘটনাটা শুনে বড়বাবু দৃশ্যত ক্ষুব্ধ । যার জন্য তিনি মহিলা পুলিশ আধিকারিককে নির্দেশ দিলেন, “এফ-আই-আর হয়ে গেলে আপনি ও মেজবাবু আমার সঙ্গে মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি চলুন । এই জাতীয় ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা সত্বর করা আশুকর্তব্য । অমানবিক কী ভয়ঙ্কর নিগ্রহ, দেখলেন ম্যাডাম ! অল্প বয়সের বৌকে কীভাবে মেরেছে । পিঠের দাগগুলি দেখে মনে হচ্ছে বাঁশ দিয়ে বলদ গরুকে ঠাঙাবার মতো ।“ মহিলা পুলিশ আধিকারিক মাথা নেড়ে বড়বাবুর কথার সম্মতি জানালেন ।
“সাগরবাবু, বাড়ি আছেন ?” বড়বাবু কঙ্কাবতীর জামাইকে ডাকলেন ।
বাড়িতে পুলিশ দেখে সাগর ভয় পেয়ে গেলো । বিপদ আসন্ন ভেবে পুলিশ দেখা মাত্র সাগর বাড়ির পেছন দিয়ে উধাও । শ্বশুর মশাই পুলিশের হ্যাপার খপ্পড় থেকে দূরে থাকতে তিনিও বাড়ি থেকে উধাও । শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বড়বাবু নিশ্চিত, শ্বশুর বাড়ির লোকজন তানিশাকে অমানুষিকভাবে মেরে তাড়িয়েছে । সাগর ও তানিশার শ্বশুরকে সত্বর থানায় দেখা করতে শাশুড়িকে নির্দেশ দিয়ে বড়বাবু থানায় ফিরে গেলেন ।
কঙ্কাবতী মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ।
বড়বাবু রাতে হঠাৎ হানা দিয়ে সাগরকে না পেয়ে তার বাবাকে বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করলেন । তারপর সোজা থানার লক আপে । থানার বড়বাবুর ধারণা, বাবাকে ধরলেই ছেলে ধরা দিতে বাধ্য । পালিয়ে বেশীদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে না । পুলিশের বক্তব্য, “কান টানলে মাথা আসবেই ।“
অ্যারেস্ট করার আগে সাগরের বাবা থানার বড়বাবুকে চেপে ধরলেন, “আমাকে অ্যারেস্ট করার অপরাধ ?”
“ছেলের বৌকে নিগ্রহ এবং তাকে ‘অ্যাটেম্প টু মার্ডার’ করার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল ।“
এর প্রমাণ কী ?
অভিযোগকারী আপনার বৌমা, তানিশা । সাক্ষী দিয়েছেন কঙ্কাবতী ও আপনাদের গাঁয়ের মাতবর সুফল তরফদার ।
মায়ের কাছে সমস্ত ঘটনা শোনার পর ঘোতন রেগে আগুন ! তার বড় বোন তানিশাকে মেরে পিঠে রক্ত বের করে দিয়ে কিনা প্রমাণ চাইছে ? নিজের মনে স্বগতোক্তি করে ক্রদ্ধ স্বরে বলল, “এবার সাগরকে গণধোলাই না দিতে পারলে তার শান্তি নেই ।“ ঘোতন সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে সাগরের ঠিক হদিস পেলো । তাকে খুঁজে বার করলো । কলার চেপে ঘর থেকে বের করে রাতের অন্ধকারে বেদম প্রহার । রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ঘোতন বলল, “তানিশাকে মেরেছিস, এবার তোকে কে বাঁচাবে ?” তারপর ভ্যানে চাপিয়ে তার হাত পা বেঁধে থানায় পৌঁছে বড়বাবুর চেম্বারের সামনে রেখে ঘোতন উধাও । সাগরকে কে মেরেছে তার কোনো প্রমাণ রইল না । ঘোতন এইভাবে বড় বোনের মার খাওয়ার বদলা নিলো ।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাগর অল্প বয়সের একটি মেয়েকে আবার বিয়ে করলো ।
বড় মেয়েটা বাড়িতে থাকার কারণে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, সব জায়গায় কঙ্কাবতী উত্তর দেয় তার চারটি মেয়ে । চারটি মেয়েই বড়, ডাগর-ডোগর ।
অন্যদিকে তানিশার কঙ্কাবতীর বাড়িতে স্বাভাবিক জীবন যাপন । কঙ্কাবতীর নির্দেশমতো টেলারিং শিখতে লাগল তানিশা । এইজন্য সপ্তাহে তিনদিন বহরমপুরে যেতে হচ্ছে তানিশাকে । এক বছরের কোর্স । তবে একবছরের মধ্যে কোনো বড় টেলারিং দোকানে তাকে হাতে কলমে এক মাস শিখতে হবে । টেলারিং কাজটা তানিশার খুব মনে ধরেছে । কাজটা তার ভাল লাগে । তাই খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটা শিখছে তানিশা । কঙ্কাবতীর বক্তব্য, কাজটা শিখলে তানিশা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে । বাবা-মা সারাজীবন বাঁচবে না । সুতরাং জীবনে চলার পথে অসুবিধা ঘটলে উপার্জনের জন্য চিন্তা থাকবে না । এক মুঠো ভাতের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে ।
মিঁয়া হল্ট স্টেশন বাজারে একটা ঘরের সন্ধান পেলো কঙ্কাবতী । ছোট্ট একফালি জায়গার উপরে ছোট্ট একটি ঘর । যার পান-বিড়ির দোকান ছিল, তিনি তার একমাত্র মেয়ের কাছে জলপাইগুড়ি চলে গেছে । স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন । যার জন্য জায়গাটা খুব অল্প দামে পাওয়া গেলো । গুমটি কুঠুরি বটে, কিন্তু বাজারের মাঝখানে । যারজন্য তানিশার টেলারিং সকলের নজরে পড়বে এবং তার টেলারিং ব্যবসা ভাল চলবে । কঙ্কাবতীর দূরদর্শিতা ভীষণ গঠনমূলক । যার জন্য মেয়েদের স্বাবলম্বী করার দিকে কঙ্কাবতীর ঝোঁক ।
তানিশার বহরমপুরের টেলারিং কোর্স শেষ । সেই কারণে তানিশার টেলারিং ব্যবসা খোলার উদ্যোগ নিলো কঙ্কাবতী । সত্বর দোকানটা খোলার একটাই কারণ, সামনে দুর্গা পুজা । দুর্গা পুজার মার্কেট ধরতে মরিয়া কঙ্কাবতী । ধার-দেনা করে একটা সেলাই মেশিন কিনলো । শুভ জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার দিন দোকান উদ্বোধন করার মনস্থির করলো । সেই মতো গুমটি ঘরটি সাজালো । উদ্বোধনের দিন নিয়ামতপুর ব্লকের বি-ডি-ও ম্যাডামকে উপস্থিত থাকতে নিমন্ত্রণ জানালো কঙ্কাবতী । ম্যাডাম কথা দিলেন, রথের দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন ।
কঙ্কাবতীর বিপদ পদে পদে । রথের আগের রাত্রিতে দোকান ঘর সাজানো শেষ । তানিশা ও কঙ্কাবতী দোকানের সাটার বন্ধ করে বাইরেটা ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজালো । বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা দোকান ঘর সাজানোর তারিফ করলেন । তারপর তারা বাড়ি ফিরে খেতে বসেছে, এমন সময় তাদের দোকানের উল্টোদিকে মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের ভম্বলের টেলিফোন, “তোমাদের দোকানের বাইরের সাজানো ফুল ছিঁড়ে ফেলছে । শিগ্গির না এলে সাটার ভাঙতে পারে ।“
“কারা ফুল ছিঁড়ছে, তাদের চিনতে পারলি ?” জানতে চাইল কঙ্কাবতী ।
“না । গামছা দিয়ে তাদের মুখ ঢাকা ।“ মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারী ভম্বল জানালো ।
ঘোতন শুনতে পেয়ে খাওয়া ফেলে ছুটলো দুর্বৃত্তদের ধরতে । ঘোতন পৌঁছানোর আগে তারা পালিয়েছে । কিন্তু ঘোতন হাল ছাড়বার পাত্র নয় । ভম্বলের কাছে জানতে পারলো তারা সংখ্যায় তিনজন এবং সাইকেলে তারা পূর্ব দিক দিয়ে পালিয়েছে । ঘোতনের অনুমান তারা বেশীদূরে পালাতে পারেনি । যেদিক দিয়ে পালিয়েছে সেইদিকে মনু ময়রার মোটর বাইক নিয়ে ছুটলো ঘোতন । বাবলা নদীর কিনারের রাস্তা দিয়ে তারা তখন প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল ছোটাচ্ছে ! ঘোতন মোটর বাইক নিয়ে তিনজনের সামনে দাঁড়ালো । দুর্বৃত্তরা তখন মারমুখী । প্রচণ্ড আক্রোশে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন তেজী জওয়ান । নিমেষের মধ্যে তিনজনকে ঘায়েল করে ফেললো । তিনটিই তখন রাস্তার উপর গড়াগড়ি । তারপর দুর্বৃত্তদের কাছে ঘোতনের প্রশ্ন, “দোকান ঘর কেন ভাঙলি ?” কিন্তু কিছুতেই উত্তর দিতে চাইছে না । তাদের মুখে কুলুপ আঁটা । ঘোতন জানে, কীভাবে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে হয় । একজন দুর্বৃত্তের বুকের পা রেখে বলল, এবার না বললে একে একে তিনটিকেই জাহান্নামে পাঠাবো । ততক্ষণে ভম্বল ও তানিশার মেজ বোন মনীষা স্পটে হাজির । অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল, “তাদের পাঠিয়েছিল সাগর !” ঘোতনের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার । রাগ মেটাতে তানিশার টেলারিং দোকান খোলা বানচাল করার ধান্দা !
ঘোতন এবার দুর্বৃত্তদের কড়া ভাষায় বলল,”ভাল চাস্ তো দোকান ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনি করে সাজিয়ে আয় । নতুবা তোদের সাগরের মৃত্যু আমার হাতে !”
পরেরদিন সকাল দশটায় ব্লক আধিকারিকের উপস্থিতিতে তানিশার টেলারিংয়ের দোকান উদ্বোধন হয়ে গেলো । মিঁয়াগ্রাম বাজারে এই প্রথম মেয়েদের টেলারিং দোকান । যার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো । কঙ্কাবতী খুশী, কেননা বড় মেয়ের অন্তত নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা হিল্লে হল ।
************************
গাঁয়ের কাকু ষষ্টীকমলকে নিয়ে কঙ্কাবতী পড়েছে মহা ফাঁপরে । মনীষা জানিয়েছিল, বিপাশা নাকি রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় ষষ্টীকমলকাকুর বাসায় যায় এবং সেখানে কিছু সময় দাদুর সাথে কাটায় । বিপাশার দাদু অর্থাৎ ষষ্টীকমল বিপাশাকে খুব ভালবাসে । গেলেই লজেন্স, চকলেট এবং আরও ভাল ভাল লোভনীয় খাবার খাওয়ায় । দশ মিনিট মতো দাদুর সঙ্গে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে । এটা নাকি এখন বিপাশার নিত্য রুটিন । কঙ্কাবতীর এতে কোনো আপত্তি ছিল না । ষষ্টীকমলকে কঙ্কাবতী অনেক আগে থেকেই কাকু সম্বোধনে ডাকে । তেমনি কাকু কঙ্কাবতীর পারিবারের এবং ব্যবসার খোঁজখবর নেয় । গাঁয়ের একজন বয়স্ক মানুষ তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছে, এতে কঙ্কাবতী খুশী । কেননা গাঁয়ে অনেক মানুষের বসবাস, অথচ ঘুণাক্ষরেও তাঁরা কঙ্কাবতীদের দিকে ফিরেও তাকায় না । সেই নিরিখে ষষ্টীকমলকাকা তাদের পরিবারের একজন হিতাকাক্ষী মানুষ । তাই তাঁকে কঙ্কাবতী শ্রদ্ধা করে । তা ছাড়া তাঁর একমাত্র ছেলে ও বৌ দুইজনেই খুব শিক্ষিত । ছেলেটা সরকারি উচ্চপদে চাকুরিরত এবং বৌমা রেলওয়েতে কর্মরত । দুইজনেরই শহরে পোস্টিং । খুব সকালে তারা অফিসে বেরিয়ে যায়, আর ফেরে রাত্রিতে । ষষ্টীকমলকাকুর একটাই মেয়ে । তার বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ে জামাই থাকে বেনারসে । ষষ্টীকমলকাকুর গিন্নি আবার বছরের বেশীর ভাগ সময় মেয়ের কাছে থাকে । কারণ মেয়ের সন্তানকে দেখাশোনা করতে হয় । জামাই বড় মাপের ডাক্তার । মেয়ে সরকারি দপ্তরে আধিকারিক । দায়িত্বপূর্ণ কাজ । ফলে সেখানে কাকীমাকে বাচ্চা আগলাবার জন্য থাকতে হচ্ছে । তাই ছোট মেয়ের কাকুর বাড়ি যাওয়া-আসায় কঙ্কাবতীর আপত্তি নেই ।
কিন্তু মনীষা খবর দিলো, বিপাশা আজকাল ষষ্টীকমলকাকুর বাড়ি বেশী সময় কাটাচ্ছে । এটা চোখে লাগছে । দাদুর সাথে এমন কী কথা, যার জন্য বিপাশাকে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট কাটাতে হচ্ছে । এটা মনীষার ভাল লাগছে না । তাই মনীষা মাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছে ছোট বোনটার দাদু-প্রীতি কমাতে ।
ষষ্টীকমলকাকু ভাল সরকারি চাকরি করতেন । শোনা গেছে তিনি প্রচণ্ড ঘুষ খেতেন । সেটা দপ্তরের কয়েকজনের চোখে ভাল লাগে না । তাঁরা ফঁন্দি পেতে ঘুষের টাকা নেওয়াটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে দেন । এমনকি কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা সংস্থা ষষ্টীকমলকাকুকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেন । তারপর যা হওয়ার সেটাই হয়েছে । প্রথমে বিভাগীয় তদন্ত । তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত ! সেই কারণে অবসরের ষাট বছর হওয়ার আগে চাকরি জীবন থেকে তাঁর ছুটি । এখন তাঁর অবসরকালী জীবন । কিন্তু তিনি যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ । যার জন্য চেহারা ধরে রেখেছেন । কেউ তাঁকে দেখলে বলবে না, তিনি রিটায়ার্ড ।
স্কুল ছুটি হলে বিপাশা পা টিপে টিপে চুপি চুপি দাদুর ঘরে ঢোকে । দাদু আগেভাগেই বাড়ির সদর দরজা খোলা রাখেন । বিপাশার স্কুল শুরু হয় সকাল সাতটায় এবং শেষ হয় বেলা সাড়ে-এগারোটায় । স্কুল থেকে হাঁটা পথে দাদুর বাড়ি পনের মিনিট । তাই বিপাশা সাধারণত দুপুর বারোটা নাগাদ দাদুর বাড়িতে ঢোকে । দাদু তখন সেজেগুজে ফিটফাট । নাতনীর জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন । বিপাশার জন্য নিত্যদিন চকলেট বাধা । এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল রেডি রাখে । ঠিক ঐ সময় দাদুর বাড়ি ফাঁকা । ছেলে-বৌমা তখন অফিসে । সকাল দশটার মধ্যে কাজের মাসি কাজ সেরে চলে যায় । কাকীমা দীর্ঘদিন মেয়ের বাড়ি বেনারসে । বাড়িতে তখন দাদু ছাড়া কেউ থাকে না । ফাঁকা বাড়ি পেয়ে বিপাশা মহা আনন্দে সারা বাড়ি ধেইধেই ঘুরে বেড়ায় ।
ষষ্টীকমলকাকু তখন বিপাশার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন । বিপাশা সদ্য মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে পাঠরত । হাপালো মেয়ে । ডাগর-ডোগর । বিপাশাকে দেখলে মনে হবে সে কলেজে ফাইনাল ইয়ার । সুতরাং বিপাশা যখন এঘর-সেঘর দৌড়-ঝাঁপ করে, তখন তার পুরো শরীরটা নড়াচড়া করে । সেটা দেখতে ষষ্টীকমলকাকুর খুব ভাল লাগে । বিপাশা দাদুর ঐরকম তাকানোতে খুব মজা পায় । এইজন্য অনেক সময় দাদুর ঠিক সামনে স্কিপিং করার মতো লাফায়, আর হাসে । তখন দাদুরও চোখে-মুখে প্রশান্তির হাসি ।
বেলা বারোটা পার হয়ে গেলে ষষ্টীকমলবাবু উতলা হয়ে উঠেন । যতক্ষণ বিপাশা ঘরে না ঢুকছে ততক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন । ষষ্টীকমলবাবু নিজেও জানেন না, বিপাশার জন্য তাঁর মন কেন আনচান করে ?
মায়ের নীরবতা লক্ষ্য করে মানষী ভাবলো, সে একদিন সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে বিপাশা দাদুর বাড়িতে ঢুকে ঠিক কী কিরে ? তার এত সময় কাটানোর কারণ কী ? মানষীর ধন্দে কিছুতেই কাটছে না, দাদুর বাড়িতে যাওয়ার বিপাশার এত উৎসাহ কেন ? মানষী সুযোগ বুঝে ষষ্টীকমলদাদুর বাড়ি হানা দেওয়ার অপেক্ষায় রইল ।
********************
এদিকে কঙ্কাবতীর তৃতীয় মেয়ে অনীশা ও অনিন্দ ঠিক করলো, মিঁয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে তারা চায়ের দোকান খুলবে । অনীশা খুব পরিশ্রমী । পড়াশুনায় বেশীদূর এগোতে পারেনি, কিন্তু পরিশ্রম করার ক্ষেত্রে তার কোনো অলসতা নেই । অনিন্দ অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তারা বাপ-বেটী চায়ের দোকান খুলবে । মিঁয়াগ্রামের নাসিরুদ্দিনের দু-কাঠার জমির উপর একটা ভাঙাচোরা ঘর স্টেশনে যাওয়ার রাস্তার উপরেই পড়ে রয়েছে, খানিকটা পরিত্যক্তভাবে । নাসিরুদ্দিন সাম্প্রতিককালে তার একমাত্র ছেলের কাছে নিমতিতাতে (মুর্শিদাবাদ জেলা) বাস করছে । ছেলে নিমতিতার একটি নামজাদা হাই স্কুলের শিক্ষক । ছেলে একরকম জোর করে নাসিরুদ্দিনকে নিমতিতায় তাদের কাছে নিয়ে রেখেছে । ফলে ঐ জায়গাটায় তাঁর প্রস্তাবিত দোকান ঘর আর খোলা হয়নি । নাসিরুদ্দিনের ইচ্ছা ছিল ঐ জায়াগায় খাওয়ার রেঁস্তরা খোলার । তবে এই মুহূর্তে জমি সমেত ভাঙা বাড়িটা নাসিরুদ্দিনের বেচার ইচ্ছা ছিল না । কঙ্কাবতী তাঁকে চেপে ধরায় নাসিরুদ্দিন অমত করতে পারেনি । একরকম জলের দামে জায়গাটা কঙ্কাবতী কিনেছে । এটা কেনার ক্ষেত্রে অনিন্দ মধ্যস্থতা করলে জায়গাটা হাত ছাড়া হয়ে যেতো । জমিটা কেনার প্রতি দৃষ্টি মিঁয়ার অনেক ব্যবসায়ীর ছিল । তাই অতি সন্তর্পণে সুযোগ বুঝে কঙ্কাবতী সোজা নিমতিতায় হাজির । ট্রেনে পৌঁছে গিয়েছিল কঙ্কাবতী এবং সে একা গিয়েছিল । পাছে জানাজানি হয়ে যায়, এইজন্য বাড়ির কাউকে সঙ্গে নেয়নি । নিমতিতা স্টেশনের কাছাকাছি ভাগীরথী গঙ্গা । সবাই জানে, ভাগীরথী গঙ্গা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে এসেছে । আরও একটা মজার ব্যাপার, নিমতিতার উল্টোদিকে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা । ভাগীরথী গঙ্গা রাজশাহী জেলা দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশে পদ্মা নামে খ্যাত । সেই হিসাবে পদ্মা নদী ভাগীরথীর প্রধান শাখা নদী । সেই নিমতিতায় নাসিরুদ্দিনের ছেলের বাড়িতে বসে জায়াগাটা কেনাবেচা এবং চুক্তিপত্রের কাগজপত্রের কাজকর্ম সম্পন্ন হয় । নাসিরুদ্দিনের সেই জায়গার উপর অনিন্দ ও অনীশা চায়ের দোকান খোলার মনস্থির করলো ।
( ক্রমশ )
রাত হচ্ছে । অথচ কঙ্কাবতী বাড়ি ফিরছে না । চঞ্চল হয়ে উঠলো অনিন্দ । কঙ্কাবতী সাধারণত বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার আগে ঘরে ঢোকে । আজ সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে চলল, অথচ তার বাড়ি ফেরার নাম নেই । অনিন্দ বিচলিত হয়ে পড়ল । ঝড়-বৃষ্টি প্রচণ্ড হয়েছে । যদিও বৃষ্টি এখন কমতির দিকে । অথচ কঙ্কাবতীর বাড়ি ফেরার হদিস নেই । উদ্বিগ্ন অনিন্দ ছোট ছেলে ঘোতনকে ডাকলো ।
ঘোতন বাবার কাছে চটজলদি পৌঁছেই জিজ্ঞাসা করল, “ডাকছিলে বাবা ?”
“মা ফেরেনি । সম্ভবত বৃষ্টিতে আটকে গেছে । তুই শিগ্গির খোঁজ নিয়ে আয় । হরিবল্লভপুরের দিকের রাস্তাটাতে আগে খোঁজ নিবি । কেননা তোর মা সাধারণত সব্জি বিক্রি না হলে হরিবল্লভপুর গাঁয়ে ঢোকে । শিগ্গির যা বাবা ।“ বিচলিত অনিন্দ ছোট ছেলেকে মায়ের খোঁজ নিতে বলল ।
ঘোতন এদিক-সেদিক না গিয়ে সোজা হরিবল্লভপুরে যাওয়ার রাস্তার দিকে রওনা দিলো । কেননা বাবার কথাই সঠিক, কাছাকাছি গ্রামে থাকলে বৃষ্টিতে ভিজে মা নিশ্চয় বাড়ি ফিরতো । দ্রত পা চালালো ঘোতন । বেশী রাত্রি হলে ভাঙাচোরা রাস্তায় হাঁটাচলায় বিপত্তি । একরকম ছুটে এগিয়ে যাচ্ছে ঘোতন । হাঁটতে হাঁটতে ঘোতন গভীরভাবে নিজের জীবনের বেদনার দিনগুলির কথা ভাবতে লাগলো । ঘোতন ভাবছে, মা তাকে খুব একটা পছন্দ করে না । তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে । কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আতিয়ার প্রেমে জড়িয়ে পড়ল । আতিয়া শহরের প্রভাবশালী ধনী পরিবারের মেয়ে । প্রথটায় ঘোতন বুঝতে পারেনি । আতিয়ার বেশভূষা, চালচলন ছিল অতি সাধারণ ! ঘূণাক্ষরেও ঘোতন টের পায়নি আতিয়া ধনী পরিবারের আদরের একমাত্র কন্যা, যদিও তার দাদা রয়েছে । আতিয়াও তেমনি, ঘোতনের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার মাঝে কখনও নিজেকে প্রকাশ করেনি । কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় আতিয়ার আসল রূপ প্রকাশ্যে এলো । ততদিনে ঘোতন আতিয়ার ভালবাসায় মোহিত । আতিয়ার প্রেমে হাবুডুবু ।
অনেকদিন থেকেই ঘোতনের আতিয়ার সাথে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা ! তাই আতিয়াকে নিয়ে একান্তে ঘুরতে যাওয়ার আবদার ধরলো ঘোতন । গ্রামের দিকে ঘোতনের বাড়ি । কিন্তু কলেজ অনেকটা দূরের শহরে, সালার । ট্রেনে যাতায়াত । কিন্তু আতিয়ার বাড়ি সালারে । তাই ঘোতন চেয়েছিল সালার থেকে বাসে অজয় নদীর তীরে ঘুরতে যেতে । কিন্তু আতিয়া কিছুতেই রাজী হল না । আতিয়ার বক্তব্য, ঘোতনের সাথে ঘুরতে গেলে তার বাড়ির লোকজন তাদের ভাব-ভালবাসার কথা জেনে ফেলবে । তাতে হিতে বিপরীত হবে । তার চেয়ে বরং যেভাবে তাদের মেলামেশা চলছে চলুক । সময়মতো আতিয়া বাড়িতে ঘোতনের সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসার কথা জানিয়ে দেবে । তখন দুজনে ঘুরতে যেতে কোনো বাধা থাকবে না ।
কিছুদিন চুপচাপ । তারপর ঘোতন মনে মনে ভাবছে, ঘুরতে যেতে আতিয়ার আপত্তি উঠলো কেন ? দুজন-দুজনকে ভালবাসে । সুতরাং তারা শুধু নদীর পারে ঘুরতে যাবে । এতে আতিয়ার আপত্তি কেন ? সেই কারণে আতিয়ার আপত্তি অবলোকন করে ঘোতনের মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটলো । ঘোতনের মনে বারংবার একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, আতিয়া কী তাকে সত্যিই ভালবাসে ? তাদের ভালবাসাটা দুই-একদিনের নয় । পুরো কলেজ লাইফ তাদের সালার শহরে একসঙ্গে ঘোরাফেরা । তাদের ঘোরাফেরায় সন্দিহান প্রকাশ করে কলেজের কিছু বন্ধু-বান্ধব ঘোতনকে আতিয়ার থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু সেসব কথার তোয়াক্কা না করে আতিয়ার সঙ্গে ঘোতন প্রেম-ভালবাসা চালিয়ে যাচ্ছে । আতিয়ার প্রতি তার ভালবাসা নির্ভেজাল । তাহলে ঘোতনের সাথে কলেজ কামাই করে ঘুরতে যাওয়াতে আতিয়ার কেন আপত্তি ?
ভাবনা তার অমূলক নয় ! সেটা টের পেলো পরীক্ষার কিছুদিন আগে । কলেজ শেষে খুব খিদে পেয়েছিল ঘোতনের । সকালবেলায় সেরকম কিছু বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে পারেনি । বৌদি তাকে টিফিন বানিয়ে দিতে চেয়েছিল । কিন্তু ঘোতনের টিফিন নিয়ে কলেজে আসতে ঘোরতর আপত্তি । তাই সারাদিন পর কলেজ শেষে তার খুব খিদে ! সালারে তেমন কোনো বড় রেস্টুরেন্ট নেই । তবুও সালামুদ্দিনের রেস্টুরেন্ট তুলনামূলকভাবে ভাল । ভাল না বলে, বলা চলে চলনসই । সেখানে বিকেলবেলায় হরেকরকম খাবার মেলে । সালামুদ্দিনের হাল্কা বয়স । রেস্টুরেন্টে পৌঁছে সালামুদ্দিনকে বলল ডিম দিয়ে চাউমিন বানিয়ে দিতে । ঘোতনের মতে, ডিম চাউমিন সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য । কাঁটা-চামচে করে কিছুটা খেয়েছে, তারপর হঠাৎ রেস্টুরেন্টে আতিয়াকে দেখে অবাক ! আতিয়ার সাথে হাত ধরে ঢুকছে তার বয়ফ্রেণ্ড । পরে নাম জানতে পারলো, পল্লব ।
ঘোতন এমন ভাব করলো,যেনো আতিয়াকে সে দেখতে পায়নি ।
ঘোতন মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে এবং আতিয়ার দিকে তাকাচ্ছে । ঘোতন বোঝার চেষ্টা করছে, পল্লবের সাথে আতিয়ার কীরকম সম্পর্ক ! রেস্টুরেন্টে ঢুকে তাদের কী ধরনের খাবার অর্ডার ! কিন্তু ঘোতন কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো, তাকে ইঙ্গিত করে আতিয়া পল্লবকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে । ঘোতন অতশত না ভেবে, চাউমিন খাওয়ায় মন দিলো । ঘোতন আরও ভাবছে, হয় তো আতিয়া তাকে ইঙ্গিত করে তাদের প্রেম-ভালবাসার কথা শোনাচ্ছে ।
খাওয়া শেষ !
পল্লব ধীরে ধীরে ঘোতনের খুব কাছে এসে বলল, “তুই কী ঘোতন ?”
“হ্যাঁ, আমি ঘোতন । কী হয়েছে বলুন ?” উত্তর দিলো বটে, কিন্তু পল্লবের কথা বলার ধরন বা শারীরিক ভাষা ঘোতনের কাছে মোটেই সুবিধার লাগলো না ।
শোনামাত্র পল্লব ঘোতনের জামার কলার চেপে ধরে বিশ্রি আওয়াজ করে বলল, “বড় লোকের মেয়ের সাথে পীড়িত করার শখ, তোকে আমি ঘোচাচ্ছি ! এবার তোকে কে বাঁচায়, দেখবো ?”
কিছু বোঝার আগেই পল্লব ঘোতনকে মারতে শুরু করল । বেধড়ক মার !
প্রথমটায় ঘোতন শুধুই মার খেলো । কিচ্ছু বলল না । তারপর আতিয়ার দিকে তাকিয়ে লক্ষ করল, ঘোতনকে পল্লবের হাতে মার খাওয়া দেখে দূরে দাঁড়িয়ে আতিয়া মুচকী মুচকী হাসছে । মজা লুটছে ! পল্লবকে ছাড়াবার কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না । বরং মারের দৃশ্য দেখে সে উৎফুল্ল ! আতিয়ার আনন্দোচ্ছ্বাস দেখে ঘোতন অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারলো তাকে হেনস্থা করার আতিয়ার একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত । নিজেকে শক্ত করলো ঘোতন । এতক্ষণ আতিয়ার কথা ভেবে পল্লবকে কিচ্ছু বলেনি । নীরবে মার খেয়েছে, অথচ প্রতিবাদে পল্লবকে কয়েক ঘা দেওয়া তো দূরের কথা তাকে গালি পর্যন্ত দেয়নি । একটাই কারণ, পাছে আতিয়া অসন্তুষ্ট হয় । ঘোতন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না । জোয়ান মর্দ গাঁয়ের খাটিয়া ছেলে । এইসব ছা-পোষা শহরের ছেলেদের কীভাবে টাইট দিতে হয় ঘোতনের ভালভাবে জানা । ডান হাতের মুঠি দিয়ে কয়েক ঘা মারতেই শুয়ে পড়ল পল্লব । তারপর ডান পায়ের লাথি মেরে তাকে একেবারে আতিয়ার কাছে । এবার ঘর্মাক্ত শরীরে আতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এত নেমক হারাম আগে এতটুকু টের পাইনি । এখন তোমার ছায়া মারাতে ঘৃণা হচ্ছে । ছি আতিয়া ! শেষে কিনা একটা পঙ্গু ছেলেকে দিয়ে আমাকে মার খাওয়ালে, যার কিনা তোমার হাত ধরার গুণ নেই ?”
“এই পঙ্গু ছেলেটাই আমার আসল বয়-ফ্রেণ্ড ! তুমি কাজটা ভাল করলে না । এর মাশুল তোমাকে গুণতে হবে ।“ আতিয়া শাসালো ঘোতনকে ।
ঘোতনও তেমনি স্পষ্ট জবাবে বলল, “তোমাদের মতো সুবিধাবাদী কুচক্রী অসভ্য মেয়েদের আমার চেনা আছে । যাদের এতটুকু শারীরিক ক্ষমতা নেই, সেইসব মস্তান দিয়ে আমাকে মারার হুমকি । আমিও ভবিষ্যতে দেখতে চাই, কার এত হিম্মৎ আমার গায়ে হাত তোলে ? এটা আমার চ্যালেঞ্জ !”
পরেরদিন সালার স্টেশনে নামতেই আতিয়া ঘোতনকে ডাকলো ।
কিন্তু আতিয়ার ডাকে সাড়া না দিয়ে ঘোতন আপন মনে স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো ।
আবার আতিয়া ডাকলো, “ঘোতন, আমি তোমাকে ডাকছি ?”
এবার মুখ খুললো ঘোতন । আমাকে ডাকা মানে, তোমার নিত্য নতুন নাগর দিয়ে আমাকে পেটানো । তোমার আসল চরিত্র আমার কাছে পরিষ্কার ! তুমি পরষ্কার করে বলো, “তোমার কতগুলি নাগর ?”
ক্ষেপে গেলো আতিয়া । কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো । তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ঘোতনের কাছে এসে মিষ্টি কন্ঠে বলল, “সেদিনের ঘটনার জন্য আমি খুব দুঃখিত । আমি তোমাকেই ভালবাসি ।“ এই কথা বলার পর আতিয়া ঘোতনের হাত তার বুকের কাছে নিয়ে কী যেনো বলতে চাইছিল, ঠিক সেই সময় আতিয়ার দাদা ফিরিকি এসে হাজির । চিল্লিয়ে ঘোতনকে বলল, “আমার প্রিয় বোনের সঙ্গে বেলেল্লাপনা । প্রকাশ্য রাস্তায় বোনের হাত ধরে টানাটানি ।“
কাঁদো কাঁদো স্বরে ফিরিকির দিকে তাকিয়ে আতিয়া বলল, “দ্যাখ্ দাদা । এই বকাটে ছেলেটা কারণে-অকারণে রাস্তার উপরে আমাকে উত্ত্যক্ত করে । ছেলেটার চরম শাস্তি হওয়া উচিত !”
আতিয়ার কথা শুনে ফিরিকি তার গুণ্ডাবাহিনীকে অর্ডার দিলো মুহুর্তের মধ্যে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ।
ততক্ষণে স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে তারা রিক্সা স্ট্যাণ্ডে ।
ইত্যবসরে ফিরিকির গুণ্ডাবাহিনী ঘোতনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন সর্বশক্তি দিতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালালো । অনেক গুলি মস্তান গুণ্ডাবাহিনী । তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির সাথে এঁটে ওঠতে পারছিল না ঘোতন । হয়রান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ঘোতন । সেই সময় থানা থেকে বিরাট পুলিশ বাহিনী স্পটে হাজির । পথ চলতি কোনো মানুষ মারামারির ঘটনাটা থানায় রিপোর্ট করে দেওয়ার জন্য বিরাট পুলিশ বাহিনীর আগমন । পুলিশ দেখে ঐ গুণ্ডাবাহিনী ততক্ষণে স্পট থেকে উধাও ।
কিন্তু পুলিশের কাছে আতিয়া মরা কান্না শুরু করলো । ইনিয়ে-বিনিয়ে পুলিশকে বোঝালো, ইচ্ছার বিরূদ্ধে ঘোতন তার শ্লীলতাহানি করেছে । তারপর আতিয়া ও ফিরিকির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ঘোতনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে থানার লক আপে ঢুকিয়ে দিলো ।
থানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঘোতন আর কলেজ মুখো হয়নি । পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন গুম হয়েছিল ঘোতন । তারপর হঠাৎ একদিন ঘোতনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না । চারিদিকে খোঁজখবর নিয়ে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তার বন্ধু নিতাই এসে খবর দিলো ঘোতন বাড়ির বাইরে গেছে । দুদিন পরে ফিরবে । কীজন্য বাড়ির বাইরে থাকবে, কোথায় থাকবে, নিতাইকে কিচ্ছু জানায়নি ।
পরেরদিন সালার থানা ও নিয়ামতপুর থানার পুলিশ, একসঙ্গে বাড়িতে এসে হাজির । বাড়িতে পুলিশ দেখে কঙ্কাবতী ঘাবড়ে গেলো । সরাসরি পুলিশকে জিজ্ঞাসা কঙ্কাবতীর, “বাড়িতে আপনারা ! তাদের অপরাধ !”
“আতিয়া নামে সালারের বড় ব্যবসায়ীর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । মেয়ের দাদার দাবী, আতিয়াকে ঘোতন গায়েব করেছে । এখন বলুন, ঘোতনকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ? আমরা তার সঙ্গে কথা বলতে চাই ?”
“ঘোতন এখন বাড়ি নেই । আর শুনুন, আমার ছেলে ঐ রকম জঘন্য কাজ কখনই করতে পারে না ।“ জোর গলায় কঙ্কাবতী পুলিশকে জানিয়ে দিলো ।
পুলিশ সম্ভবত নিয়ামতপুর থানায় ফিরে গেলো । নিয়ামতপুর থানা থেকে সালার থানা কাছে । তাই দুই থানার পুলিশ একযোগে আতিয়ার তল্লাশি চালাচ্ছে ।
অন্যদিকে ঘোতন আচমকা এবং অনেক কসরত করে আতিয়াকে তুলে নিয়ে সোজা সুন্দরবনের একটা অপরিচিত রিসোর্টে উঠলো । রাস্তায় আতিয়াকে এমনভাবে ধমকালো, কোনোরকম পালাবার ট্যাঁ-ফোঁ করলে তার বিপদ অনিবার্য । এমনকি আতিয়াকে বশে আনতে তার পিঠে দুই এক ঘা চড়-থাপ্পড় মারতে হয়েছিল । তারা দুইজন একঘরে দুটো রাত কাটাবার পর ঘোতন আতিয়াকে বুঝিয়ে দিলো, চালাকিতে গ্রামের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ঘোতন কোনো অংশে কম নয় । আতিয়াকে বড্ড বেশী ভালবাসে, তাই ঘোতন দয়াবশত আতিয়ায়াকে নিষ্কলুষ অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছে । সুযোগ পেয়েও ভালবাসার মানুষকে সে কখনও কলঙ্কিত করতে চায় না । এখানেই তাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ঘোতনের জীবন আলাদা ।
আতিয়া ঘোতনের চরিত্র সম্বন্ধে ষোলআনা ওয়াকিবহাল । তাই কাঁদতে কাঁদতে ঘোতনকে আতিয়া বলতে বাধ্য হল, “সে পল্লবের ফাঁদে পড়ে গেছে । সেখান থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই ! তাই ঘোতনকে তার জীবন থেকে সরাতে নাটক করতে বাধ্য হয়েছিল ।“
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, ঘোতন আতিয়ার খোঁজ নেয়নি । বাড়িতেই চুপচাপ দিন কাটছে । তবে ইদানীং ঘোতনের কথাবার্তার অনেক পরিবর্তন । কেউ কিছু কটু কথা বললে, চাঁছাছোলা ভাষায় উত্তর দিয়ে দেয় । হাটে-বাজারে তার সাথে নিত্য গণ্ডগোল । একদিন মুদিখানার দোকানদার হাসিচ্ছলে বলেছিল, তুমি নাকি নারী ঘটিত কারণে পুলিশ হেপাজতে জেল খেটেছো ?”
ঘোতন মুদিখানার দোকানদারকে সোজা থাপ্পড় । জামার কলার ধরে বলেছিল, আর যদি এইরকম কথা ফের শুনি তোমার টুঁটি টেনে ছিঁড়ে দেবো । আজ থেকে জেনে রাখবি, “আমি ঘোতন । বেশী ট্যাঁ-ফোঁ করেছিস, তো মরেছিস ।“
ঘোতনের রক্তচক্ষুর খবর চারিদিকে রটে যাওয়ার পর, এলাকার মানুষ ঘোতনকে সমীহ করে চলতে লাগলো । মারপিটে ওস্তাদ । ঘোতনের মারকুটে স্বভাব অবলোকন করে গাঁয়ের বয়স্ক মানুষেরা হতাশ । তাঁদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন, ভাল ছেলেটার এরকম কেন অবনতি ? বাড়িতে অনিন্দ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, তার ছোট ছেলেটার দ্বারা কাজকর্ম কিচ্ছু হচ্ছে না । উপার্জনের পথ না খুঁজলে ভবিষ্যতে খাবে কী ? যার জন্য কঙ্কাবতীও চিন্তিত । কাজকর্ম না করার জন্য ঘোতন মায়ের কাছে অহরহ বকা খাচ্ছে । তবুও কাজকর্ম করার ব্যাপারে ঘোতনের হেলদোল নেই । কঙ্কাবতী এমন কথা পর্যন্ত তার ছেলেকে বলল, কিছু করতে না পারলে ভ্যান রিক্সায় মাল টানলে সারাদিনের শেষে যা মজুরী জুটবে তাতে সংসারের সুরাহা হবে ।
***************************
ঘোতন খুব দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে । লম্বা চওড়া তাগড়াই চেহারার অল্প বয়সী যুবক, ঘোতন । তাই তার হাঁটার গতি সাংঘাতিক । রাতের অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে । ঘোতন চিন্তা করল, বেশী রাত হলে মায়ের বাড়ি ফিরতে কষ্ট হবে । তা ছাড়া ভ্যান রিক্সা তার টানা ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে । সেই সকালে দুটো খেয়ে কাজে বের হয়েছে । সারাদিন নিশ্চয় খাওয়া হয়নি । এদিকে মা বাড়ি না থাকলে বড় বৌদি সবাইকে আদর যত্ন করে খাওয়ায় । বলা চলে বড় বৌদি মায়ের ভূমিকা নেয় । কিন্তু মায়ের তো সারাদিন খাওয়া হয়নি । সংসারের সচ্ছলতার কথা ভেবে মায়ের রাত দিন খাটা । আবার ঘোতন উল্টে আবার নিজের কথাও ভাবছে, সে একজন জোয়ান মরদ ছেলে । অথচ উপার্জনের এক ফোঁটা তার নিজের মুরদ নেই । এইসব কথা ভাবতে ভাবতে, বিদ্যুতের চমকানো আলোতে ঘোতন দেখতে পেলো তার মায়ের ভ্যান রিক্সাটি রাস্তার উপর পড়ে রয়েছে । অথচ মাকে দেখতে পাচ্ছে না । ঘোতনের মনটা অজানা আশঙ্কায় চমকে উঠল । তাহলে মায়ের কী কোনো বিপদ !
রাস্তার আশপাশে তাকাচ্ছে ঘোতন । মাকে দেখতে না পেয়ে ঘোতনের চিৎকার, “মা তুমি কোথায় ?” রাস্তা সুনসান । আকাশে মেঘের আনাগোনা । কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেছে । ঝড়ো হাওয়া নেই । তবে চারিদিক অন্ধকার । ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার । তারপর বিদ্যুত চমকানোর সাথে সাথে ঘোতন দেখতে পেলো, রাস্তার একটু নীচে জঙ্গলা গাছের ডালে একটা শাড়ি ঝুলছে । এবার ঘোতনের কাছে পরিষ্কার, নিশ্চয় মা পড়ে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছে । তাড়াতাড়ি ছুটলো সেখানে ।
সেখানে গিয়ে ঘোতনের চক্ষু চড়কগাছ ! মায়ের মুখ বাঁধা । রক্ষিতবাবু মাকে জাপটে ধরে রয়েছে । অন্যদিকে রক্ষিতবাবুর কব্জা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কঙ্কাবতীর মরিয়া প্রয়াস । কিন্তু শয়তান রক্ষিতবাবুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না । ঐ দৃশ্য দেখে ঘোতনের মাথায় রক্ত উঠে গেলো । কালবিলম্ব না করে এক ঝটকায় ভ্যান রিক্সার হ্যাণ্ডেল খুলে নিয়ে সোজা রক্ষিতবাবুর মাথায় আঘাত ! পিঠে আঘাত ! পায়ে আঘাত ! রক্ষিতবাবু যন্ত্রণায় চিল্লাচ্ছে ! ছটফট করছে । কঙ্কাবতী ঘোতনকে বাধা দিলো । লোকটা মরে গেলে আরও বিপদ । রক্ষিতবাবুকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে মা-বেটা ছুটলো বাড়ির দিকে । অন্যদিকে কঙ্কাবতীকে খোঁজার জন্য অনিন্দ টর্চ নিয়ে হরিবল্লভপুর রাস্তার দিকেই হাঁটছিল । তারপর বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোতন বাড়ি ঢুকলো ।
শুয়ে রয়েছে কঙ্কাবতী । সারাদিনের ধকলের জন্য কঙ্কাবতী গভীর ঘুমে বিভোর । অন্যদিকে ঘোতনের ঘুম আসছে না । মায়ের দুঃসহ অবস্থা দেখে ঘোতন চিন্তান্বিত । মায়ের মতো মানুষের যদি ঐরকম অসহায়তার মধ্যে পড়তে হয় তাহলে তার অল্প বয়সী বোনদের অবস্থা কী দাঁড়াবে । মা এমনিতেই খুব সাহসী । তার ভয়ডর কম । তবুও তার অসহায়তার চরম পর্যায় দেখে ঘোতন ঘোর চিন্তান্বিত । এইসব ওলট-পালট ভাবনাতে ঘোতন আছন্ন । যার জন্য তার ঘুম আসছে না । ঘড়িতে তখন রাত দুটো ।
হঠাৎ দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ !
“এত রাত্রিতে আবার কে ?” প্রশ্ন জাগলো ঘোতনের মনে ।
বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছিলো ঘোতন । কিন্তু কঙ্কাবতী দরজা নাড়ার শব্দে ঘুম থেকে উঠে ঘোতনকে বলল, “তুই ঘরে ঢোক । আমি দেখছি কে এলো ?” কঙ্কাবতীর মনে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত কু-গাইছিল, “রক্ষিতবাবু নিশ্চয় বদলা নিতে দলবল নিয়ে বাড়িতে হামলা করবে ।“ তাই বারংবার ভাবছে, “নচ্ছারটা নিশ্চয় বাড়ি এসে এখন হাজির ।“
দরজা খুলতেই পুলিশ । পুলিশ বাড়ি ঢুকেই বাড়ির সমস্ত ঘর তল্লাশি শুরু করল । ঘোতনকে হাতেনাতে ধরে হাতকড়া পড়িয়ে দিলো । থানার বড়বাবু কঙ্কাবতীকে বললেন, “আপনার ছেলে বিনা কারণে পঞ্চায়েত রক্ষিতবাবুকে বেধড়ক মেরেছে ! যার জন্য তিনি হাসপাতালে শয্যাশায়ী । মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন । পঞ্চায়েতকে অকারণে মারার জন্য আমরা আপনার ছেলেকে অ্যারেস্ট করলাম ।“
“আমার ছেলে রক্ষিতবাবুকে মেরেছে তার প্রমাণ ?” কঙ্কাবতী পাল্টা প্রশ্ন করলো থানার বড়বাবুকে ।
পেছন থেকে চড়ুইডাঙার মাতবর নকড়ি ও পল্লীদহ গ্রামের সুখহরি মোড়ল এগিয়ে এসে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা চাক্ষুষ দেখেছি । আমরা তার প্রত্যক্ষদর্শী ।“
এবার থানার বড়বাবু ধমকের সুরে বললেন, “আপনার যা কিছু বলার কোর্টে বলবেন । আমরা কাল সকালেই আপনার ছেলেকে কোর্টে চালান করে দেবো । সুতরাং আপনার যা সওয়াল করার কোর্টে গিয়ে করবেন ।“
ঘোতনের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে পুলিশ তাকে প্রিজন ভ্যানে তুললো । তারপর পুলিশ ছুটলো নিয়ামতপুর থানায় । চালাক কঙ্কাবতী খুব সহজে বুঝতে পারলো, ঐ দুজনকে টাকা দিয়ে রক্ষিতবাবু সাক্ষী বানিয়েছে । যার জন্য তাঁদের এখন ঘোতনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে সাহস ! মোড়লদের কাণ্ডকারখানা দেখে রাগে জ্বলছে কঙ্কাবতী । এদিকে কঙ্কাবতীর মেয়েগুলি মার কাছে বায়না ধরলো, দাদাকে ছাড়িয়ে আনতে । দাদাকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বোনদের চোখে জল । বড় বৌমা হাঁ করে তাকিয়ে অবস্থার প্রেক্ষাপট বোঝার চেষ্টা করছে । অনিন্দের দিকে তাকিয়ে কঙ্কাবতী বলল, এখন ঘুমোতে গেলে চলবে না । ঘোতনকে কীভাবে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে । নতুবা ছেলেটাকে কোর্টে চালান করে দিলে ঘোতনকে ছাড়ানো ভীষণ সমস্যা হবে ।
ভোর হতে দেরী নেই । ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের পাখির ডাক শুরু হয়ে গেছে । পূর্বদিকে রক্তিম আভা । গোয়ালা দুধের ক্যান নিয়ে গাঁয়ে ছোটাছুটি করছে । খুব ভোরে লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে গাঁয়ের চাষীরা মাঠে ছুটছে । গৃহবধূরা উঠোনে গবর দিচ্ছে । তার মধ্যে দিয়ে কঙ্কাবতী ও অনিন্দ পায়ে হেঁটে চললো মিঁয়া হল্ট স্টেশনের নিকট মিঁয়াগ্রামে । সেখানে নটহরি উকিলের কাছে । নটহরি উকিলের যথেষ্ট নামডাক । সকাল ন’টার ট্রেনে কোর্টে বেরিয়ে যান । নটহরি উকিলকে কঙ্কাবতী ভাল চেনে । কঙ্কাবতীর কাছ থেকে উকিলবাবুর বাড়ির জন্য উকিলবাবুর গিন্নি নিয়মিত সব্জি কেনেন । তাই উকিলবাবুকে বাড়িতে ধরার জন্য তাদের তাড়াহুড়ো ।
বাড়ি পৌঁছে দেখে উকিলবাবু কুড়ুল দিয়ে গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ চেরাচ্ছে । কাঠের ফালি জ্বালানীর জন্য ভীষণ উপযুক্ত । কঙ্কাবতী কৌতুহলবশত উকিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি নিজে কেন কাঠ চেরাচ্ছেন ?”
“কঙ্কাবতী, কুড়ুল দিয়ে গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ চেরানো একদিকে শরীর চর্চা, অন্যদিকে রান্নার জ্বালানীর কাঠ রেডি করা । মাত্র এক ঘন্টার কাজ !” হেসে হেসে কঙ্কাবতীর কথার উত্তর দিলেন । তারপর কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এত সকালে তোমরা কী মনে করে ?”
“দাদা আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে ।“ বলেই কঙ্কাবতী কাঁদতে লাগলো ।
আহা ! না কেঁদে ঘটনাটা খুলে সবিস্তারে বলো ?
“চেম্বারে চলুন বলছি ।“ কঙ্কাবতী উকিলবাবুকে ঘরের চেম্বারে যেতে বলল ।
নটহরি উকিলবাবু হাতমুখ ধুয়ে চেম্বারে এসে বসলেন ।
কঙ্কাবতী তার সব্জি বিক্রি, হরিবল্লভপুর যাওয়ার সময় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়লে রক্ষিতবাবুর আগমন, রক্ষিতবাবু তার সঙ্গে কীরকম আচরণ করেছিলেন, সমস্ত কিছু সবিস্তারে উকিলবাবুকে জানালো । উকিলবাবুকে জানানোর পরে তাঁর পায়ে ধরে বলল, “স্যার, আমার ছেলেটাকে থানা থেকে জামিনে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করুন ।“
“ঘাবড়াবে না কঙ্কাবতী । আমি দেখছি । তবে তোমরা ঠিক সময় মতো আমার কাছে এসেছো, নতুবা ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে চলে যেতো ।“ উকিলবাবু কঙ্কাবতীদের আশ্বস্ত করলেন ।
জামিনে থানা থেকে ছাড়া পেলো ঘোতন । তারপর থেকে ঘোতনের ব্যবহার, চালচলন স্বাভাবিক ছন্দ থেকে একটু অন্যরকম ! চোখে মুখে অহরহ বিরক্তির ছাপ । তার হৃদয়ের ভিতরে অনেক রাগ । কঙ্কাবতীর ধারণা, আতিয়ার কাছ থেকে প্রত্যাখানের ধাক্কা এবং মায়ের সঙ্গে রক্ষিতবাবুর ঐরূপ আচরণ দেখে, ঘোতন অপ্রসন্ন । সব কিছুতেই বিরাগভাজন । তবুও কঙ্কাবতীর আশা, কিছুদিন কেটে গেলে ঘোতন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে । কিন্তু কঙ্কাবতীর আশার গুড়ে বালি । ঘোতন যে কে তাই । বরং আরও ক্রমশ ডানপিটে হয়ে উঠছে ।
(ক্রমশ)
গাঁয়ের নাম চড়ুইডাঙা । তারপর একটু থেমে কঙ্কাবতী বলল,পোস্ট অফিসের নাম শিলাইদহ, থানা-নিয়ামতপুর, জেলা – মুর্শিদাবাদ । এবার আমার ভাতার টাকাটা দিন ?
এখানে টিপসই দিন ?
“আমি টিপসই দেওয়া পছন্দ করি না ।“ তারপর টেবিলের উল্টোদিকে বসা ষণ্ডা মার্কা চেহারার লোকটার হাত থেকে কলমটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে খাতায় স্বাক্ষর করে দিলো । সই করার সময় কঙ্কাবতী নিজের চোখে দেখতে পেলো, তার নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা । রেজিস্টারে লেখা দেখে কঙ্কাবতী নিশ্চিত, “নারী ভাতা বাবদ সে এক হাজার টাকা পাচ্ছে !”
ষণ্ডা মার্কা লোকটা কঙ্কাবতীর হাতে আটশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে লাইনে দাঁড়ানো অপরজনকে ডাকল ।
টাকা গণনা করার পর কঙ্কাবতির চোখ চড়কগাছ ! দুশো টাকা কম ! সঙ্গে সঙ্গে চোখ গরম করে কঙ্কাবতী কৈফয়িৎ চাইল, “হিতেনদা, আমি আটশ টাকা পেয়েছি ! এখনও দুশো টাকা বাকী ।“
ঐ টাকাই তোমার প্রাপ্য ।
“মানে, আপনি কী বলতে চাইছেন । আমি দুশো টাকা কম নিয়ে বাড়ি যাবো ? পুরো এক হাজার টাকা আমাকে বুঝিয়ে দিন । নতুবা আমি এখান থেকে নড়ছি না ।“ কঙ্কাবতী নাছোড়বান্দা !
আচ্ছা জ্বালাতন দেখছি ? তুমি আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছো ? আমাদের কাজে বাধা দিলে আমরা তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবো ?
হিম্মৎ থাকলে আমাকে টাকা বুঝিয়ে না দিয়ে এখান থেকে সরান, তবে বুঝবো আপনাদের গুণ্ডামির শক্তি ?
তুমি কী আমাদের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছো ?
আমার বাকী দুশো টাকা না দিলে ঠিক তাই, আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি ?
হঠাৎ হিতেনের একজন সাগরেদ কঙ্কাবতীর ডান হাত হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিল্লিয়ে অসভ্য ভাষায় বলল, “পালাবি ? না পালালে তোর কী হবে জানিস ? কেউ তোকে বাঁচাতে আসবে না ?”
হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কঙ্কাবতী চিল্লিয়ে বলল, “আমি না পালালে কী হবে তুই আগে সেই কথা শোনা, তারপর আমি কী করব সেটা শোনাচ্ছি !”
“তোর মেয়েদের তুলে নিয়ে জঙ্গলে ফুর্তি করবো ।“
শোনা মাত্র কঙ্কাবতী পায়ের চটি খুলে হিতেনের সাগরেদের গালে সজোরে কয়েক ঘা এমনভাবে মারলো, মারের আঘাতে বেচারা মাটিতে গড়াগড়ি !
উপস্থিত সমস্ত মহিলারা একজোট হয়ে হিতেনের সাগরেদকে টাইট দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল । এতক্ষণ তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে কথা কাটাকাটির দৃশ্য দেখছিল আর প্রমাদ গুণছিল, কখন তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে সামিল হবে ! হিতেনের গুন্ডামি তারা মেনে নিতে পারছিল না । কিন্তু সাহস করে হিতেনের গুন্ডামির যোগ্য জবাবও দিতে পারছিল না । তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল । সুযোগ পেয়ে অন্যান্য মহিলারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল । তারা রীতিমতো টাকা ফেরতের জন্য সোচ্চার !
অবস্থা বেগতিক বুঝে হিতেন স্পটে এসে সমস্ত মহিলাদের উদ্দেশে হাত জোড় করে বলল, “যারা টাকা কম পেয়েছেন, ফেরত নিয়ে যান ।“
চড়ুইডাঙার বিনোদের মা এগিয়ে এসে কঙ্কাবতীকে পরামর্শ দিলেন, “রাত্রিতে সাবধানে থেকো । হিতেন একজন অসভ্য ও নোংরা মনের মানুষ । এলাকার মানুষের অনেক ক্ষতি করেছে । রাস্তা থেকে বয়স্থা মেয়েদের তুলে তাদের ইজ্জ্বত নিয়ে মজা করা তার এক ধরনের আনন্দ । রাজনৈতিক দলের ও কিছু মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় থাকার জন্য এহেন জঘন্য কাজ করেও সে পার পেয়ে যাচ্ছে । কেউ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না । এমনকি ভুক্তভোগী মেয়েদের অভিভাবকেরাও না ! সুতরাং তোমাকে তারা সহজে ছেড়ে দেবে না !” বিনোদের মা আরও জোর দিয়ে বললেন, “বদলা হিতেন নেবেই ।“
কঙ্কাবতীর দুঃসাহস যথেষ্ট । সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মহিলা না । ইতিপূর্বে তার নিজের মেয়েদের চলাফেরার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা কঙ্কাবতীকে শক্ত হাতে সামলাতে হয়েছে । তাই বিনোদের মাকে কঙ্কাবতী অভয় দিয়ে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না । হারামজাদাগুলোকে কীভাবে টাইট দিতে হয়, সেই কৌশল আমার জানা আছে । তা ছাড়া হারামজাদাগুলো আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না । গুণ্ডামি করে আমাদের হকের টাকা মারবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না । সেইজন্য আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না । তবে এটা ঠিক, হিতেনের সাগরেদকে গণধোলাই দেওয়ার জন্য আমরা টাকাটা ফেরত পেলাম । নতুবা এতগুলি টাকা গায়েব করে দিতো ।“
বাড়ি ফিরতে কঙ্কাবতীর সন্ধ্যা ।
বাড়ি ফিরে লক্ষ করলো তার ছোট মেয়ে বিপাশা হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিয়েছে । কঙ্কাবতীর হাতে মুরগির মাংস । ছোট মেয়ের উদ্দেশে কঙ্কাবতি বলল, “আজ রাত্রিতে মাংস ভাত হবে ।“ কঙ্কাবতীর ছোট মেয়ে সর্বদা মায়ের ন্যাওটা । মায়ের কাজে হাত লাগাতে সে সর্বদা চনমনে ।
মাংস-ভাতের কথা শুনে কঙ্কাবতীর ছেলেমেয়েরা খুশীতে টগবগ ।
ঘর থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল মুখে কঙ্কাবতীকে অনিন্দ বলল, “মাংস আনার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।“
কঙ্কাবতীর ভরা সংসার । তার নিজের বয়স অনেক । কিন্তু চেহারাখানা তার চৌকশ । যেমন এক মাথা চুল । তেমনি তার শারীরিক গঠন । তার চেহারা বা চালচলন দেখলে কেউ বলতে সাহস পাবে না, কঙ্কাবতী ছয় সন্তানের জননী । তাক লাগানো চেহারা । যে কোনো বয়সের পুরুষের চোখে পড়ার মতো তার শরীর-গতর । হৃষ্টপুষ্ট শারীরিক স্থিতি । লম্বা যেমনি, তেমনি তার তাগড়াই চেহারা । চলাফেরায় সাবলীল । কিছুটা স্বাধীনচেতা । ভয়ডর খুব কম । অল্প বয়সের ছেলেপুলে তাকে উত্ত্যক্ত করলে, সোজা কান ধরে শুনিয়ে দেয়, “সে তার মায়ের বয়সী ।“ কিন্তু কঙ্কাবতী পড়াশুনায় নবডঙ্কা ! অষ্টম শ্রণী পর্যন্ত । অল্প বয়সে অনিন্দের সঙ্গে বিয়ে । তারপর প্রথম দুটি ছেলে এবং পরপর চারটি মেয়ে । দুজন ছেলে হচ্ছে – যথাক্রমে রূপন ও ঘোতন । বড় মেয়ে তানিশা, মেজ মনীষা, সেজ অনীশা ও ছোট বিপাশা । বড় ছেলে তেমন লেখাপড়া শেখেনি । যার জন্য সংসারের কাজে বড় ছেলে নিয়োজিত । ছোট ছেলে ঘোতন । গাঁয়ে ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় তার অবাধ ঘোরাঘুরি । ঘোতনকে এলাকায় সবাই চেনে । বিনা কারণে যেখানে-সেখানে ঘোতনের অবাধ বিচরণ, অনিন্দের একেবারেই অপছন্দ ।
চার মেয়েই ডাগর-ডোগর । কঙ্কাবতীর চার মেয়ের চরিত্র চার রকমের ।
অনিন্দের উপার্জনের জায়গাটা শক্তপোক্ত নয়, নড়বড়ে । ট্রেনের হকারি । আর মাঠে আট বিঘে চাষের জমি । তা ছাড়া অনিন্দ শারীরিকভাবে দুর্বল । নানান অসুখে জর্জরিত । যার জন্য উপার্জনের কথা মাথায় রেখে কঙ্কাবতীকে বেশীর ভাগ সময় ভ্যান রিক্সায় সব্জি বিক্রি করতে গাঁয়ে বের হতে হয় । পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে তার সব্জি বিক্রি । সব খরচা বাদ দিয়ে দিনে মোটামুটি চারশ টাকা থাকে । বিয়ের প্রথম দিকে তাকে সংসারের খরচা নিয়ে ভাবতে হত না । অনিন্দ সব দিক সামলাতো । কিন্তু পরবর্তীতে কঠিন ব্যামোতে পড়েছিল অনিন্দ, যেখানে ছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন । ডাক্তারের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই সময় অনিন্দ প্রাণে বেঁচে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল । তখনই ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, অনিন্দকে দিয়ে পরিশ্রমের কাজ আর করানো যাবে না । সেই থেকে অনিন্দ ট্রেনের হকার । হকারিতে আয় খুব কম । অথচ বাড়িতে বড় বড় ছেলে মেয়ে । নিষ্কর্মার ঢেঁকি । অথচ তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচা এখন ঊর্ধ্বগতি ।
পড়াশুনায় কেউ আগ্রহী না । শুধুমাত্র ছোট মেয়ে বিপাশা স্কুলে যাচ্ছে । সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা ! বড় ছেলে রূপন বাবার অসুখের জন্য বেশীদূর পড়াশুনা করতে পারেনি । ঘোতন কলেজে উঠে নানান অশান্তিতে জড়িয়ে পড়ে । স্নাতক ডিগ্রি তার কপালে জোটেনি । রূপন বিবাহিত । রূপনকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে । রূপনের একটি ছেলে । রূপন এখন ঘোর সংসারী । মাঠে চাষবাস নিয়ে থাকে । রূপনের চেষ্টায় মাঠে এখন চাষের জমি বারো বিঘা । জমিতে শুধুমাত্র ধান চাষ । ফলে বছরের খাওয়ার চাল, চাষের জমি থেকে উঠে আসে । সংসার খরচের নগদ টাকার জন্য কঙ্কাবতীর নিরলস কসরত ।
রূপন সাদামাটা মানুষ । মাঠের জমিতে চাষ-আবাদ ছাড়া গাঁয়ের কোনো সাতেপাঁচে থাকে না । রূপনের বৌ তেমনি । ঘর সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে সামলায় । চারটে ননদ । কখনও সংসারের কাজে ননদদের বিরক্ত করে না । মুখ বুজে হেঁশেল সামলায় । তাই কঙ্কাবতী গাঁয়ের মানুষদের অহরহ বলে, “অনেক ভাগ্য করে আমরা বৌমা পেয়েছি যে কিনা পুরোপুরি ঘর সংসারী । ঘরের সমস্ত কাজ নিজে হাতে সামলায় ।“ বড় বৌমার প্রশংসা প্রসঙ্গে অনিন্দ আরও একটু বাড়িয়ে বলে, “তার বড় বৌমা বাড়ির লক্ষ্মী । শত খুঁজলেও দ্বিতীয়টি মেলা ভার !”
কঙ্কাবতীর হয়েছে জ্বালা ! নিজের তাগড়াই চেহারা । দৈহিক চাহিদা অত্যধিক বেশী । কিন্তু ঘরের হাঁদারাম মরদটা অকর্মার ঢেঁকি ! তবুও তার হা-পিত্যেশ নেই । ছোঁকছোঁক বাতিক নেই । গায়ে পড়ে কেউ ভাব জমাতে এলে, কঙ্কাবতীর হুমকি খেয়ে তারা পালিয়ে বাঁচে । কাউকে ডরায় না । রাতে অনিন্দের সাথে এক বিছানায় শুয়ে শান্তি না থাকায় খুব ভোরে কাজে বের হয়ে যায় । চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে স্টেশন অনেকটা দূর ! পায়ে হাঁটা রাস্তা । স্টেশন বলা ভুল, হল্ট । মিয়াগ্রাম হল্ট । ভোরের প্রথম ট্রেন ধরে সোজা সালার স্টেশন । সেখান থেকে পাইকারি দরে সব্জি কিনে পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরতে প্রায় সকাল আটটা । তারপর সেদ্ধ-ভাত খেয়ে ভ্যানে সব্জিগুলি সাজিয়ে গাঁয়ে বের হয় বিক্রি করার জন্যে । এগ্রাম-সেগ্রাম ঘুরে সব্জি বিক্রি । তাই বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায় । বাড়ি ফিরে বৌমার সাথে গাল-গপ্প । মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাসা ! গেরস্থালির কাজ । এসবের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । তবুও ধরাবাঁধা রুটিনের বাইরে কয়েকটা অঘটন তার জীবনে ঘটে গেছে, যেটা ভাবলে তার গা শিউরে উঠে ! গায়ে কাঁটা দেয় !
সেটা বৈশাখ মাসের সংক্রান্তি ।
কঙ্কাবতীর সব্জি বিক্রি প্রায় শেষ । আর কিছুটা সব্জি অবশিষ্ট রয়েছে । বিশেষ করে বেগুন, কলমি শাক, ঢেঁড়শ, পটল, একফালি কুমড়ো, টমাটো, কাঁচা লঙ্কা, ইত্যাদি । তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে । পাশের গ্রাম হরিবল্লভপুর । কঙ্কাবতী যে গাঁয়ে সব্জি বিক্রি করছিল, সেই গ্রাম থেকে হরিবল্লভপুর যেতে খানিকটা হাঁটা পথ ! তবে মাটির রাস্তা কিন্তু অনেকটা প্রশস্ত । ঐ রাস্তায় গরুর গাড়ির আনাগোনা বেশী । ভ্যান নিয়ে কঙ্কাবতী হরিবল্লভপুরের দিকে এগোচ্ছে । তার ধারণা, হরিবল্লভপুরে গেলে তার সমস্ত সব্জি বিক্রি হয়ে যাবে । এতগুলি সব্জি অবিক্রি অবস্থায় বাড়িতে ফেরত নিয়ে গেলে তার লোকসান । কেননা, সব্জিগুলি গরমে প্রায় শুকিয়ে গেছে । পরেরদিন ঐগুলি বিক্রি করা কঠিন । অবশেষে সব্জিগুলি জঙ্গলে ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না । তাই ছুটলো হরিবল্লভপুর গ্রামের দিকে । রাস্তা ধরে এগোচ্ছে । এমন সময় আকাশে কালো মেঘ । হঠাৎ মেঘ । নিমেষের মধ্যে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেলো । হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে কঙ্কাবতীর অর্ধেক রাস্তা তখনও বাকী । ঝড়ের পূর্বাভাস ! ভ্যান নিয়ে জোরে পা চালায় কঙ্কাবতী ।
শুরু হল বিদ্যুৎ চমকানো । আর প্রচণ্ড ঝড় । কঙ্কাবতীর মতে, নিঃসন্দেহে ঘূর্ণিঝড় ! লাগামছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ওলট-পালট অবস্থা । আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা । কালো মেঘ, তার উপর মেঘের গর্জনের দাপট ! অচিরেই চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো । তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, অথচ চারিদিকে অন্ধকার । ঝড়ের তীব্রতায় রাস্তা দিয়ে হাঁটা দায় ! ঝড়ের গতিবেগ এতটাই বেশী, যার জন্য ভ্যান রিক্সা ঠেলতে পারছে না কঙ্কাবতী । ঝড়ের দাপটে নিজেকে সামলানোও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে কঙ্কাবতীর পক্ষে । তার উপর ভ্যান রিক্সা সামলানো ! ঝড়ের সো-সো শব্দ ! ক্ষমতাশালী প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড ! রাস্তায় একটা লোক নেই । চারিদিক সুনসান । এই রাস্তা দিয়ে সাধারণত মানুষের যাতায়াত খুব কম । হরিবল্লভপুরের মানুষ পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে অভ্যস্ত । এই রাস্তাটা খুব একটা কাজে লাগে না । যার জন্য রাস্তাটার কোনো সংস্কার নেই । এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা । মাঠের ফসল তোলার সময় গরুর গাড়ির যাতায়াত যথেষ্ট । যার জন্য রাস্তাটা খানাখন্দে ভর্তি । প্রলয়ংকর ঘূর্ণীঝড়ে কঙ্কাবতীর ভ্যান রিক্সার উপরের সব্জি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি । এবার সে ভ্যান রিক্সা আর ঠেলতে পারছে না । অন্যদিকে পরনের শাড়ি ঠিক রাখতে পারছে না । ঝড়ো হাওয়ায় বুকের উপর থেকে অনেকক্ষণ আগেই শাড়ি উধাও । ঝড়ের তাণ্ডবে সে নিজেকে বাঁচাতে তটস্থ ! তার উপর ভ্যান রিক্সা আগলানো । এসবের মাঝে তার পরনের শাড়ি সামলানোর পরস্থিতি নেই ।
শুরু হল ঘূর্ণিঝড়ের সাথে ভারী বৃষ্টি ! ঝড়ের ধ্বংসলীলায় চারিদিকে গাছগাছালি ভেঙ্গে পর্যুদস্ত । সামনে রাস্তার উপরে কাটাজাতীয় একটি বাবলা গাছ পড়ে থাকতে দেখলো । কঙ্কাবতী কোনোরকমে গাছটা সরিয়ে এগিয়ে গেলো । এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই । হরিবল্লভপুর গাঁয়ে ঢুকে তবে রেহাই । কিন্তু হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে এখনও অনেকটা দূর ! ঢেলে বৃষ্টি । বৃষ্টিতে কঙ্কাবতীর শরীর ভিজে একশা !
ঝড় কিছুটা থিতিয়ে গেছে । কিন্তু বৃষ্টির বর্ষণ সমানে চলছে । কঙ্কাবতী বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে স্নান করার ন্যায় । তার শারীরিক গঠন এতটাই সুন্দর, যার জন্য বৃষ্টিতে ভেজার পর তার শরীরের দ্যুতির বিস্ফোরণ আকর্ষণীয় ।
উল্টোদিক থেকে নিয়ামতপুর থানা থেকে বাড়ি ফিরছে পঞ্চায়েতের রক্ষিতবাবু । তাঁর বয়স কঙ্কাবতীর কাছাকাছি । রক্ষিতবাবুর বাড়ি চড়ুইডাঙার পাশের গ্রাম পল্লীদহ গাঁয়ে । তিনি সেখানকার পঞ্চায়েত । পঞ্চায়েত হলে কী হবে ? কঙ্কাবতীর রূপে তিনি মুগ্ধ । কয়েকবার একথাটা বলা হয়ে গেছে । কঙ্কাবতী ঐসব কথার গুরুত্ব কোনোদিনও দেয়নি, সুতরাং রক্ষিতবাবুর কথারও গুরুত্ব দেয়নি । বরং দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে । এমনকি রক্ষিতবাবু কঙ্কাবতীকে পঞ্চায়েতের কাজে ঢোকানোর প্রলোভনও দেখিয়েছিল । কিন্তু চালাক কঙ্কাবতী ঐসব প্রলোভনে পা দেয়নি । কঙ্কাবতী জানতো, এইসবের পেছনে রক্ষিতবাবুর অন্য ধান্দা রয়েছে । কারণ রক্ষিতবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে কঙ্কাবতী ষোলোআনা অবগত । সেই কারণে রক্ষিতবাবুর ফাঁদে পা বাড়ায়নি । কঙ্কাবতী কানাঘুষো শুনেছে, পল্লীদহের শান্তি বিধবা বৌটার সঙ্গে রক্ষিতবাবুর কেলেঙ্কারির কেচ্ছা ! সেই খতরনাক লোকটাকে দেখে আতকে উঠল কঙ্কাবতী ! কঙ্কাবতী খুব দ্রুত তার পরনের শাড়ি গোছাতে শশব্যস্ত হয়ে উঠল ।
রক্ষিতবাবু প্রথমে বুঝতে পারেনি । কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো, শাড়ি পরিহিত একজন হৃষ্টপুষ্ট মহিলা ভ্যান রিক্সার আড়ালে বসে রয়েছে । আকাশে তখনও মেঘের গর্জন । বৃষ্টি অনবরত চলছে । বৃষ্টির জলের ফোঁটা ভীষণ ঠাণ্ডা ! সূর্য দেবতা কালো মেঘে ঢাকা । কাছাকাছি এসেই রক্ষিতবাবু হাঁক ডাকলো, “কে ? কে ওখানে ?”
সাড়া না পেয়ে রাস্তার পাশে কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে তার ঘোমটা খুলে দিলো । আচমকা কঙ্কাবতীকে দেখে রক্ষিতবাবু আনন্দে উচ্ছ্বসিত । কঙ্কাবতীর ঘোমটা খুলে তাকে দেখে আনন্দে তার মুখ থেকে বের হল, “আমার অনেকদিনের স্বপ্নের রানীকে আজ সে হাতের মুঠোতে পেয়েছে ?”
কঙ্কাবতী পালাতে ব্যস্ত । এতক্ষণ ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কঙ্কাবতী কিছুটা শারীরিকভাবে কাহিল ? যার জন্য ছুটে পালাতেও হোঁচট খাচ্ছে । তবুও সে পালাতে মরিয়া । নতুবা এই নির্জন জায়গায় রক্ষিতবাবুর খপ্পরে পড়তে বাধ্য । অনেক যত্নে বাঁচিয়ে রাখা তার নারীসত্তার ধ্বংস অনিবার্য ।
( ক্রমশ)