Categories
গল্প

অন্ধকারে লুকানো সত্য (রহস্য গল্প)।

(একটি পূর্ণাঙ্গ রহস্য গল্প)

১. প্রথম সতর্কবার্তা

পার্থ মুখার্জি কলকাতার এক পুরোনো বাড়িতে একা থাকে। বাড়িটা তার ঠাকুরদার সময়ের, প্রায় একশো বছরের পুরোনো। সেদিন সকালে ডাকবাক্স খুলতেই সে দেখতে পেল একটি হলুদ খামের চিঠি। খামের উপর কাঁপা হাতের লেখা —
“আজ রাত বারোটার আগে বাড়ির ঘড়ি থামিয়ে দিও। না হলে বিপদ আসবে।”

চিঠি পড়ে পার্থর শরীরে কাঁটা দিল। কে লিখল এই চিঠি? কেন লিখল? সে জানে তার বাড়ির দোতলায় ঝোলানো ঘড়িটা অনেক বছর ধরে বন্ধ।

দিনভর তার মাথায় এই রহস্য ঘুরপাক খেতে লাগল। সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির ভিতর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। পার্থ বারবার সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ছে।

২. অদ্ভুত শব্দ

রাত বাড়তে থাকল। ঠিক ১১টা নাগাদ হঠাৎ দোতলার দিক থেকে টিক-টিক শব্দ শোনা গেল।
পার্থ থমকে দাঁড়াল।
— “অসম্ভব! ওই ঘড়ি তো নষ্ট…”

টর্চ হাতে নিয়ে দোতলায় উঠতেই তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করেছে।

ঘড়ির কাচের ভেতরে তার নিজের মুখ দেখল, কিন্তু মনে হল আরেকটি ছায়া দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। টর্চের আলো ফেলতেই ছায়া মিলিয়ে গেল।

৩. দেয়ালের পেছনের ঘর

ঠিক তখনই দেয়ালের পেছন থেকে ফাঁপা শব্দ এল। পার্থ টর্চ দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে দেয়ালের একটা অংশ ঠুকল। হঠাৎ একটা গোপন দরজা খুলে গেল। ভেতরে ছোট্ট একটা ঘর, ধুলো জমে আছে, কিন্তু সেখানে রাখা একটি টেবিলের উপর পুরোনো ডায়েরি আর কিছু দলিল।

ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা —
“আমি এই বাড়ির আগের মালিক অমরেশ মুখার্জি। আমাকে আমার আপন ভাই খুন করেছে এই বাড়ির সম্পত্তির জন্য। আমার দেহ এই ঘরের মেঝের তলায় লুকানো আছে। আমার আত্মা মুক্তি চাই।”

পার্থর গলা শুকিয়ে গেল। সে সাথে সাথে পুলিশের খবর দিল।

৪. তদন্ত শুরু

পরের দিন সকালেই ইন্সপেক্টর সুদীপ সরকার এলেন। অভিজ্ঞ অফিসার, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
— “আপনি বলছেন ঘড়ি নিজে থেকে চলতে শুরু করেছে?”
পার্থ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ স্যার, আর এই ডায়েরিটা পেয়েছি।”

দলিল আর ডায়েরি দেখে সুদীপ গম্ভীর হলেন।
— “আমরা ঘরের মেঝে খুঁড়ব। যদি হাড়গোড় পাওয়া যায় তবে এটা খুনের মামলা।”

মেঝে খুঁড়তেই সত্যিই একটি কঙ্কাল পাওয়া গেল। বাড়ি হইচই পড়ে গেল। খবর ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায়।

৫. অতিপ্রাকৃত ইঙ্গিত

সেই রাতে পার্থ আবার সেই ছায়া দেখল। এবার ছায়াটি তাকে হাতের ইশারায় অন্য ঘরের দিকে ডাকল। পার্থ ভয় পেলেও সাহস করে গেল। সেখানে একটি ছোট কাঠের বাক্স পেল। বাক্সের ভিতরে পুরোনো নথি আর একটি রুপোর চেইন।

পরদিন ইন্সপেক্টরকে বাক্সটি দেখানো হল। নথির মধ্যে ছিল বাড়ির পুরোনো দলিল, যেখানে দেখা গেল অমরেশ মুখার্জির মৃত্যুর পর সম্পত্তি বেআইনি ভাবে তার ভাই অর্জুন মুখার্জির নামে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সুদীপ বললেন,
— “এখন স্পষ্ট, অর্জুন খুন করেছে। কিন্তু সে তো বহু বছর আগে মারা গেছে। খুনের পেছনে আর কেউ ছিল কি?”

৬. নতুন সন্দেহভাজন

তদন্তে জানা গেল অর্জুনের নাতি রাজীব মুখার্জি সম্প্রতি বাড়ির দখল নিতে চেয়েছিল। পার্থর কাছে চিঠি লিখে বাড়ি ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিল।

পার্থ মনে পড়ল— সেই চিঠির হাতের লেখা! চিঠি আর রাজীবের পুরোনো স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখতেই বোঝা গেল দুটোই এক।

সুদীপ পুলিশ টিম নিয়ে রাজীবকে গ্রেপ্তার করল। রাজীব স্বীকার করল যে সে জানত তার দাদু অমরেশকে খুন করেছে। সে এই সত্যিটা চিরতরে গোপন রাখতে চেয়েছিল, তাই পার্থকে ভয় দেখাতে চিঠি লিখেছিল।

৭. চূড়ান্ত মুখোমুখি

রাজীবকে নিয়ে বাড়িতে পুনর্নির্মাণ চলছিল। ঠিক তখনই ঘড়ি আবার বাজতে শুরু করল। হঠাৎ জানলা বন্ধ হয়ে গেল, ঘর অন্ধকার। সবাই দেখল এক ফ্যাকাশে ছায়ামূর্তি রাজীবের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজীব চিৎকার করে উঠল,
— “আমার দোষ নেই! আমি খুন করিনি!”

ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঠিক বারোটায় থেমে গেল। যেন আত্মা শান্তি পেল।

৮. ন্যায়বিচার

রাজীবকে আদালতে তোলা হল। ডায়েরি, দলিল আর পার্থর সাক্ষ্য মিলে মামলায় প্রমাণ হল অমরেশকে খুন করেছিল অর্জুন। আদালত পার্থর নামে বাড়ির সম্পত্তির অধিকার ফিরিয়ে দিল।

ইন্সপেক্টর সুদীপ পার্থকে বললেন,
— “আপনি কেবল বাড়ির মালিক নন, আপনি ইতিহাসের সাক্ষী। আপনি যদি সাহস না করতেন, অমরেশ মুখার্জির আত্মা আজও শান্তি পেত না।”

৯. সমাপ্তি

রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝলমল করছে। পার্থ দোতলায় দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ি থেমে আছে, কিন্তু বাড়ি আর অদ্ভুত নয়। যেন শান্তি ফিরে এসেছে।

পার্থ ভাবল,
— “এই বাড়ি শুধু আমার নয়। এখানে এক ইতিহাস আছে, এক রক্তাক্ত অতীত আছে। এখন আমি সেই অতীতের রক্ষক।”

সে টেবিলে ডায়েরিটা রাখল, যেন ভবিষ্যতের জন্য প্রমাণ হয়ে থাকে। বাইরে হাওয়ায় যেন একটুখানি ধন্যবাদসূচক ফিসফিসানি শুনল।

 

Share This
Categories
গল্প

শেষ ট্রেনের অপেক্ষা।

১. শুরুটা – এক ট্রেনস্টেশনের গল্প

রাত তখন প্রায় দশটা। শহরের শেষ ট্রেন ধরার জন্য ভিড় কমতে শুরু করেছে। হাওয়া ঠান্ডা, রেললাইনের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ধরনের বিষণ্ণ নীরবতা।
স্টেশনের বেঞ্চে বসে আছেন অনির্বাণ—চোখের সামনে কুয়াশা, হাতে এক কাপ চা। মনটা তার আজ বড় খারাপ। অফিসে আবারও প্রোমোশনটা পায়নি, তার ওপরে আজ ছিল বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। দিনভর ব্যস্ততার ভিড়ে মন খারাপটাকে চাপা দিতে পেরেছিল, কিন্তু এই ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে এসে হঠাৎ যেন সবটাই আবার মনে পড়ল।

ঠিক তখনই, পাশের বেঞ্চে বসে পড়ল এক মেয়ের ছায়া।
গায়ে হালকা নীল শাল, হাতে মোবাইল। চুলগুলো খোলা, যেন বাতাসে খেলা করছে। মেয়েটির চোখেমুখে একটা অদ্ভুত শান্তি, অথচ চাহনিতে ছিল গভীর কষ্ট।

অনির্বাণ খানিক তাকিয়ে আবার নিজের চায়ের দিকে মন দিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটিই কথা শুরু করল—
— “মাফ করবেন, শেষ ট্রেনটা ক’টায় আসে জানেন?”

অনির্বাণ একটু চমকে তাকাল।
— “দশটা পঞ্চাশে। তবে আজ ট্রেন লেট হবে শুনলাম।”

মেয়েটি হেসে মাথা নাড়ল।
— “আচ্ছা, ধন্যবাদ।”

এতটুকুই পরিচয়। কিন্তু অনির্বাণের মনে হল, সে মেয়েটির মুখের হাসিটা আবার দেখতে চায়।


২. পরিচয় – কথার সূত্রপাত

ট্রেন লেট হওয়ার কারণে, তারা ধীরে ধীরে কথায় জড়িয়ে গেল।
মেয়েটির নাম ইশানি। সে পাশের শহরে স্কুলশিক্ষিকা। আজ এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল, ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।

অনির্বাণ জানাল, সে এক আইটি কোম্পানিতে কাজ করে, অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে এখানে ট্রেনের অপেক্ষা করছে।

কথার পর কথায় তারা দু’জনের জীবন খুলে গেল যেন—
ইশানি জানাল, সে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার জন্য একাই থেকে এসেছে। বাবা-মা গ্রামে থাকেন। তার জীবনটা সোজাসাপ্টা, কিন্তু কখনও কখনও একাকিত্ব খুব কষ্ট দেয়।
অনির্বাণ বলল, তার মা অনেক বছর আগে মারা গেছেন, বাবার সঙ্গেই বড় হয়েছে। বাবাই তার জীবনের অনুপ্রেরণা ছিলেন।

দুজনেই অনুভব করল—কোনো এক অদ্ভুত মিল আছে তাদের মধ্যে।
যেন দুজনেই একই রকম শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে।


৩. বন্ধুত্ব – অজানা টান

ট্রেন এল, দুজনেই পাশাপাশি বগিতে উঠল।
স্টেশনে পৌঁছে তারা নম্বর বিনিময় করল না। কিন্তু দুজনেরই মনে হল—এটাই কি শেষ দেখা?

কিন্তু ভাগ্যও যেন চুপিচুপি হেসে ছিল।
কয়েকদিন পর অনির্বাণ আবার স্টেশনে ইশানিকে দেখতে পেল।
সেই থেকে তাদের পরিচয় গভীর হতে থাকল। ফোন নম্বরও বিনিময় হল, কখনও একসঙ্গে চা খেল, কখনও বইয়ের দোকানে গেল।

ধীরে ধীরে তারা একে অপরের জীবনের গল্পে ঢুকে গেল।
অনির্বাণের ক্লান্ত সন্ধ্যাগুলোতে ইশানির ফোন যেন আলো হয়ে এল।
ইশানির একাকী রাতগুলোতে অনির্বাণের মেসেজ তাকে হাসিয়ে তুলল।


৪. ভালোবাসা – অব্যক্ত অনুভূতি

এক সন্ধ্যায়, বৃষ্টি পড়ছে ঝরঝর করে।
স্টেশনের ছাদে দাঁড়িয়ে দুজনে ভিজে ভিজে গল্প করছে।
হঠাৎ ইশানি বলল—
— “তুমি কি কখনও কাউকে খুব মিস করো? এমন মিস, যা বুকের ভেতরটা ভারী করে দেয়?”

অনির্বাণ চুপ করে রইল।
তার মনে পড়ল তার বাবা-মা, তার একাকী ঘর।
কিন্তু আজ যেন মনে হল, এই মেয়েটির জন্যও এমন একটা মিস সে বোধ করছে।

— “হ্যাঁ,” ধীরে ধীরে বলল অনির্বাণ।
— “আর সেই মিসটা আজ তোমাকে দেখেই হচ্ছে।”

ইশানি অবাক হয়ে তাকাল, তারপর হেসে ফেলল।
কিন্তু চোখের কোণে ছোট্ট একটা অশ্রুবিন্দু চিকচিক করল।

সেই রাতে বাড়ি ফিরে ইশানি ডায়েরিতে লিখল—
“হয়তো এটাই প্রেম।”


৫. বাঁক – জীবনের পরীক্ষা

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।
হঠাৎ একদিন ইশানির বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ইশানিকে গ্রামে ফিরে যেতে হল। সে আর শহরে ফিরল না।

অনির্বাণ ফোন করত, কিন্তু ইশানি খুব কম উত্তর দিত।
দুজনের দূরত্ব যেন বাড়তে থাকল।

মাস কেটে গেল।
একদিন হঠাৎ খবর এল—ইশানির বিয়ে ঠিক হয়েছে।

সেদিন রাতে অনির্বাণ স্টেশনে বসে কেঁদে ফেলল।
যে প্ল্যাটফর্মে তাদের প্রথম দেখা, আজ সেইখানেই তার মনে হল সবকিছু ফাঁকা।


৬. সমাপ্তি – শেষ ট্রেনের অপেক্ষা

দিন যায়। ইশানির বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে।
অনির্বাণ চেষ্টা করেও দেখা করতে যায়নি।

বিয়ের আগের রাতে হঠাৎ অনির্বাণ ট্রেনস্টেশনে গেল।
এবারও রাত দশটা বেজে গেছে।
কিন্তু আজও সে মনে মনে চাইল—যেন একবার ইশানিকে দেখতে পায়।

ঠিক তখনই, প্ল্যাটফর্মের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ইশানিকে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
চোখে জল, কিন্তু মুখে এক আশ্চর্য হাসি।

— “আমার বিয়ে হচ্ছে ঠিকই,” বলল ইশানি।
— “কিন্তু জানো, আমি আজ এখানে এসেছি শুধু তোমাকে একবার দেখতে।
তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি।”

অনির্বাণ কিছু বলল না।
শুধু বলল—
— “তুমি সুখে থেকো।”

ট্রেন এল।
ইশানি উঠে গেল বগিতে।
অনির্বাণ তাকিয়ে রইল।
শেষ ট্রেন চলে গেল।

কিন্তু অনির্বাণ জানল—তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা, যদিও হারিয়ে গেল, তবুও তাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিয়ে গেল।


গল্পের সারমর্ম

ভালোবাসা সবসময় পেতে হয় না।
কখনও কখনও ভালোবাসা মানে কেবল সেই মানুষটির সুখের প্রার্থনা করা, দূর থেকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়া।
অনির্বাণের কাছে ইশানি রয়ে গেল সেই শেষ ট্রেনের মতো—যে ট্রেন হয়তো আর কখনও ধরা যাবে না, কিন্তু যার হুইসেল চিরকাল তার মনে বাজতে থাকবে।

 

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

মূল্যবান মনুষ্য জীবন ও গণেশ পূজা : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।

ওঁ নমঃ শ্রী ভগবতে প্রণবায়….!
ওঁ গণ গণপতয়ে নমঃ,…

আমাদের সুন্দর মূল্যবান মনুষ্য জীবনে উৎসবমুখর ভারতবর্ষে পূণ্যভূমি পবিত্রভূমি এই তপভূমিতে জগৎ জননী মায়ের আসার আগেই শ্রী গণপতি বাপ্পা আসেন। সত্য সনাতন ধর্মে যে কোনো শুভকাজের শুরুতে তিনি পূজিত হন এবং সফলতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হন। গণেশ বা গজানন হলেন শিব ও পার্বতীর পুত্র। আগামী শুক্লাচতুর্থী বা গণেশচতুর্থী তিথিতে গণপতি বাপ্পার আগমন ঘটবে সেই *গণেশ পূজা* চলবে দশদিন অনন্ত চতুর্দশী পর্যন্ত। গণেশ বিঘ্ননাশকারী, বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা, শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক, এবং সৃষ্টি ও সৌভাগ্যের প্রতীক। সত্য সনাতন ধর্মে যে কোনো শুভকাজের শুরুতে তিনি পূজিত হন এবং সফলতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হন।

“গণেশ” নামটি গণ ও ঈশ শব্দ দুটির সমষ্টি। গণ শব্দের অর্থ গোষ্ঠী বা সমষ্টি এবং ঈশ শব্দের অর্থ ঈশ্বর বা প্রভু। ভগবান গণেশ এই মহাবিশ্বে শৃঙ্খলা আনেন এবং কোনও নতুন প্রচেষ্টা, বৌদ্ধিক যাত্রা বা ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু করার আগে সকলেই তাঁর উপাসনা করেন। তিনি সমস্ত বাধা বিঘ্ন দূরকারী ভগবান হিসাবে পরিচিত। গণেশ উৎসব বা গণেশ চতুর্থী ভগবান গণেশের জন্মোৎসব। তিনি বিঘ্ননাশক, জ্ঞান ও সমৃদ্ধির দেবতা, তিনি মর্ত্যে অবতীর্ণ করে ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। তিনি গণপতি, বিঘ্নেশ্বর, বিনায়ক, গজপতি, একদন্ত ইত্যাদি নামেও পরিচিত। এই উৎসবের মাধ্যমে গণেশের জন্মকে স্মরণ করা হয়। এটি একটি আনন্দময় ও পারিবারিক সামাজিক, সার্বজনীন সামাজিক অনুষ্ঠান। মন্ডপে গণেশের মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হয় এবং বিভিন্ন ধরনের মোদক ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়।

পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী দেবী পার্বতী যখন স্নান করতে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি নিজের শরীর থেকে ঘর্ষণের মাধ্যমে মাটি ও আবর্জনার মিশ্রণ থেকে গণেশকে সৃষ্টি করেন এবং তাকে নিজের বাড়ির পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। গণেশ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন, যখন তার পিতা শিব ঘরে ফিরতে চাইলেন গণেশ তাকে বাধা দেন। ফলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং শিব গণেশকে এমনভাবে আঘাত করেন যে তার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ঘটনার পর দেবী পার্বতী অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন এবং শিবকে গণেশকে পুনরুজ্জীবিত করতে বলেন। তখন শিব তার প্রথম যে প্রাণীটিকে দেখতে পান, তার মাথা কেটে গণেশের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। আর সেই প্রাণীটি ছিল একটি হাতি। তাই তিনি গজানন।

ভারতবর্ষে ১৮৯৩ সালে ব্যাপকভাবে গণেশ উৎসব বা গণপতি উৎসবের প্রচলন করেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী লোকমান্য তিলক বা বাল গঙ্গাধর তিলক। তিনি এই উৎসবকে জনগণের মধ্যে ঐক্যের প্রচার এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা কে উজ্জীবিত করার জন্য শুভারম্ভ করেন। যা পরবর্তীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া (জাভা এবং বালি), সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, ফিজি, গায়ানা, মরিশাস এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সহ বৃহৎ জাতিগত ভারতীয় জনসংখ্যার দেশগুলিতে গণেশ পূজার প্রথা বিস্তার লাভ করেছে।

ভাদ্র মাসের শুক্ল চতুর্থীতে শুরু হয় এবং উৎসবের সময়কালে গণেশের মূর্তি স্থাপন, পূজা ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে আনন্দ ও ভক্তির প্রকাশ ঘটে। উৎসবের মূল অনুষ্ঠানগুলো মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মতো রাজ্যগুলিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয়, যেখানে এই উৎসবকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, জাতীয় ঐক্য এবং ভক্তির একটি জীবন্ত উদাহরণও বটে। গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও এই উৎসব অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। এই বৎসর ২৭শে আগস্ট বুধবার গণেশচতুর্থীর দিন উৎসব শুরু হবে। এবং ৬ ই সেপ্টেম্বর শনিবার অনন্ত চতুর্দশীর দিন উৎসবের সমাপ্তি হবে। গণপতি বাপ্পা সকল বাধা বিঘ্ন নাশ করে সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। সুখ সমৃদ্ধি সৌভাগ্য বৃদ্ধি করুন এই প্রার্থনা করি। জগৎগুরু ভগবান স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের শুভ ও মঙ্গলময় আশীর্বাদ সকলের শ্রী বর্ষিত হোক।
*গণপতির প্রতিষ্ঠা মুহুর্ত:-*
২৭শে আগস্ট, ২০২৫, বুধবার গণেশ চতুর্থীর শুভ মুহূর্ত হলো সকাল ১১:০৬ থেকে দুপুর ১:৪০ পর্যন্ত, যা গণপতিকে বাড়িতে আনার এবং স্থাপনার জন্য সবচেয়ে শুভ সময় হিসাবে বিবেচিত হয়। এই সময়ে, বিশেষত দুপুরবেলা, সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্ম হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়, তাই এই সময়টি ‘মধ্যাহ্ন গণেশ পূজা’র জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলে, বুধবার সকালে সূর্যোদয় থেকে পুরো দিনটি শুভ। সুবিধামতো গণপতির প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সর্বাধিক শুভ মুহুর্ত- অভিজিৎ মুহুর্ত ২৭শে আগস্ট ১১.৪৫ থেকে ১২.৫৫ পর্যন্ত হবে। এই মুহুর্তে গণপতি মূর্তি স্থাপন সবচেয়ে শুভ হবে। এর পাশাপাশি, ২৭শে আগস্ট দুপুর ১.৩৯ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬.০৫ মিনিট পর্যন্ত মুহুর্তটিও শুভ।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ *পরিব্রাজক*

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

ত্রিলোকনাথ; তুমি আছ বিশ্বনাথ অসীম রহস্যমাঝে : শীলা পাল।।।।।।।

অনেক অনেকবছর আগে প্রায় চল্লিশ বছর তো হবেই ।তখন লাহুল স্পিতি উপত্যকা আমাদের কাছে একটা রহস্যময় অচেনা জগতের মতো ছিল।তবু ভবঘুরে মন আর পায়ের তলায় সরষে ।তাই বছরের কোনও না কোনও সময়ে হিমালয়ের ডাক কানে এসে পৌঁছতো আর আমরা ছয়জনের যে দলটি লোটা কম্বল নিয়ে  সব সময় রেডি থাকতাম বেরিয়ে পড়তাম।সেই বছর ত্রিলোকনাথ যেন আমাদের ডাক পাঠালেন।ব্যাস আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।সেপ্টেম্বর মাস এমনিতেই বাতাসে শারদীয়ার সুর
আমরা চললাম মানালির উদ্দেশ্যে ।ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে।সেই সময়ের মানালি যেন কুমারী সুন্দরী।কী তার রূপ সবুজে শ্যামলে পাহাড়ে নদীতে যেন রূপসী অপ্সরা।আর তেমন পথঘাট সেইরকম সুন্দর ওখানকার লোকজন ।চোখফেরানো যায় না এমন সব রমণীয় রমণীদের পথে ঘাটে দেখি আর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।আমাদের একসঙ্গী সবে কলেজে ঢুকেছে তার চোখে ঘোর ।ওকে নিয়ে কি মজাটাই করেছি আমরা দুই সখী স্বপ্না আর আমি।বিপাশার কলকল ধ্বনি প্রথম দিনেই আমাদের মন জয় করে নিল।কীভীষন ভালো লাগায় মন ভরে গেল যেন।প্রাথমিক কিছু রসদ কেনাকাটা করা হল।চাল ডাল ফল সব্জি ইত্যাদি এটা আমাদের পাহাড়ি পথে সবসময়ই মজুত রাখা হয়।অভ্যাস অনেক রকম অভিজ্ঞ।তা থেকে বুঝেছি এটা সঙ্গে থাকলে রাস্তাতেও দিন কাটানো যায় ।পাহাড়ের রাস্তা বড়ই খতরনক ।মানালী থেকে বাস ছাড়লো সকাল আটটায় ।বিপাশাকে বাঁয়ে রেখে যাত্রা শুরু ।পাহাড়ি পথে পাক খেতে খেতে বাস এগিয়ে চলে।উৎসুক মন কখন রোটাংপাস দেখবো।ভয়ংকর রোটাং  হিমশীতল রোটাং।কিন্তু রোটাংপাস এ পৌঁছে মন ভরলো না।রিক্ত রুক্ষ কঠোর কেমন যেন সর্বস্ব হারা রূপ ।রোটাংপাস থেকে অনেকটা পথ নেমে প্রায় বারোটার সময় এসে পৌঁছলাম চন্দ্র নদীর তীরে খোকসারে।এখানে হিমালয় যেন গৈরিক সন্ন্যাসী ।ভাবগম্ভীর প্রশান্তিময় মৌন গিরিরাজ।
খোকসার থেকে রাস্তা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে ।একটি চন্দ্র নদীর উৎস অভিমুখে অন্য টি আমরা যে পথে যাবো ত্রিলোকনাথ এর দিকে যে পথে আমরা যাবো।
খোকসারের প্রণাম জনপদ শিশু।শিশু নামের বিশেষত্ব ছড়ানো আছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ।কোন্ অদৃশ্য নিপুন হাতে রোপিত অজস্র শিশুগাছের শ্যামল বনানী ।বাস রাস্তার নীচে র দিকে অনেক বর্ধিষ্ণু পাহাড়ি গ্রাম ।ক্ষেতে ক্ষেতে সর্বত্র ই ফসল তোলার সাড়া ।আসন্ন শীতের জন্য এই তোড়জোড় ।শীত এদের কাছে বিভীষিকা ।তাই চাষবাস পশুপালন শীতের আগেই সঞ্চয় করার অভ্যাস বা রীতি নিয়ম সবকিছু ।ছোট ছোট অনেক জনপদ পেরিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছলাম তান্ডি তে।এখানে  ভাগা নদী মিলিত হয়েছে চন্দ্র নাম হয়েছে চন্দ্রভাগা।নদীর জল ঘন নীল ।পুরো রাস্তা টাই কাঁচা তান্ডি থেকে।সংকীর্ণ এবড়োখেবড়ো পথ তার মধ্যে ই বড়বড় লরি চলাচল করছে।বেশ ভয়ে ভয়ে এই রাস্তা পার হয়েছি ।থিরোট হুয়ে কীর্তিং প্রায় পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম ।রাস্তার ওপরেই লোকালয় ।জায়গা টি বেশ জনবহুল ।সামনেই চা আর পকৌড়ার দোকান।গোবিন্দ চেঁচিয়ে উঠল ফুলকাকা সামনেই চা আর পাকৌড়া নামুন  নামুন ।আমরা সবাই হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নামলাম। উফ্ একটানা বাসের গোঁ গোঁ আওয়াজ মাথা যেন কাজ করছে না ।মুক্ত হাওয়ায় চা টা খেয়ে বেশ ভালো লাগছে।এমন সময়  মি ঠাকুর নামে এক ভদ্রলোক পাশেই তার বাড়ি আমাদের ডাকলেন নিজের হাতে আপেল পাড়ার জন্য ।কী অপূর্ব তার বাগান।ওইটুকু সময়ের মধ্যে তাঁর বাড়ি বাগান ঘুরে এত্তো আপেল নিয়ে বাসে উঠলাম ।কি খুশী ওনার চোখে মুখে ।এরকম আন্তরিক মধুর ব্যবহার আমাদের চিরদিন মনে থাকবে।চলার পথে এগুলো ই পাথেয় ।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ধূলিধূসরিত আমরা এসে হাজির হলাম চন্দ্র ভাগা উপত্যকার উদয়পুরে।রাস্তার ওপরেই পি ডব্লিউ ডির সুন্দর সাজানো বাংলো।জায়গাটা যেমন সুন্দর তেমনি নির্জন ।সামনেই চন্দ্র ভাগা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে ।মনোরম এই পরিবেশ আমাদের সব ক্লান্তি কোথায় মিলিয়ে গেল।স্বপ্না কি সুন্দর করে গাইল -পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে ।সব অবসাদ মুহূর্তে মুছে গেল ।
পরের দিন সকালে ত্রিলোকনাথ দর্শন ।উদয়পুর থেকে প্রায়  নয় কিলোমিটার ।ভোরের পাহাড় যে কি স্নিগ্ধ হয় মনে যেন কি শাস্তি আসে।চন্দ্রভাগার উপর সেতু পার হয়ে শুরু পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথ।সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মনে হল যেন তুষার শৃঙ্গের মুকুট পরে চন্দ্রভাগা উপত্যকা যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য মেলে ধরেছে।একটা সরু নালার পাশ দিয়ে খুব পিচ্ছিল ভাঙাচোরা পথ।মাঝে মাঝে চড়াই ভেঙে দু তিনটে ছোট ছোট পাহাড় পেরিয়ে হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত ত্রিলোকনাথ মন্দির ।জায়গাটির নাম ত্রিলোকনাথ ।পাহাড়ের মাথায় জনবসতির একপাশে দেবালয় ।এখানে দেবতা রুদ্ধ দ্বারে বসে নেই একান্ত আপনজনের মতো সকলের সাথে মিশে রয়েছেন।মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা হল এখানকার অধিবাসীদের সাথে।পরদেশি দেখে সবাই  ভীড় করে এলো।কি হাসিখুশি সহজ সরল মানুষ গুলি মন্দিরের সামনেরঅংশটি ভেঙে গেছে।তিব্বতি ধাঁচের  মন্দির ।ভাঙা অংশ টি পেরিয়ে আমরা জুতো মোজা খুলে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম ।অসংখ্য প্রদীপের আলোয় মন্দির আলোকিত ।মৌণ মন্দির অভ্যন্তরে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত কয়েক জন পাহাড়ি মেয়ে।এখানে সকলেই বৌদ্ধধর্মালম্বী।বুদ্ধকে স্মরণ করেই ত্রিলোকনাথ দেবের পুজো নিবেদিত হয়।ত্রিলোকনাথের মাহাত্ম্য এবং কিংবদন্তী অনেক  আছে।এই মুর্তিটি  অনেকবার চুরি করার চেষ্টা করা হয়েছে ।একবার কুলুর রাজা সেনা পাঠিয়ে বিগ্রহ তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু কিছুতেই পারেন নি।এখনও নাকি মুর্তিটির ডান পায়ের নীচে তরোয়ালের দাগ দেখা যায় ।আমরা পুজো দেওয়ার জন্য পুরোহিতের খোঁজ করতে জানলাম উনি বাইরে আছেন ।পুরোহিতের ছেলে আমাদের পুজো নেবে।অর্ঘ্য  তো সামান্য ।কিছু ধূপের বান্ডিল আর নতুন কাপড়ের টুকরো।ভগবান বুদ্ধের চরণে এই সামান্য ডালি নিবেদন করে ডক্তিভরে সবাই  প্রণাম করলাম ।তারপর পুরোহিতের কানে কানে আমাদের মনোবাঞ্ছা জানালাম ।আমরা এক বিখ্যাত হিমালয়প্রেমীর কাছে যা জেনেছিলাম ।পুরোহিত একবার চকিতে চারিদিক দেখে নিল।মন্দির পুরো ফাঁকা ।ইসারায় আমাদের একদম বিগ্রহের সামনে নিয়ে গেল।অজস্র পাথর মনি মুক্তোর মালা তুলে উন্মোচন করলো পুরো মুর্তিখানি।কোথায় গেল সেই সৌম্য শান্ত বুদ্ধ এ যে ভুবন ভোলানো নৃত্যরত নটরাজ! এমন সৌম্য রূপের সঙ্গে সংহার রূপের মিলন ।আমরা বিমোহিত হতবাক।প্রতিটি আঙুলের মুদ্রা আর ভঙ্গিমা  এতো ছন্দময় এতো প্রাণবন্ত যেন স্বয়ং নটরাজ নৃত্যরত বালকের মতো আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন ।ধন্য আমরা।ধন্য আমাদের ত্রিলোকনাথ দর্শন ।জয় ত্রিলোকনাথ ।তুমি আছ বিশ্বনাথ অসীম রহস্য মাঝে।
একরাশ আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম উদয়পুর ।বেলা একটা নাগাদ ।চাল ডাল সামনের চায়ের  দোকানে দিয়ে সুন্দর খিচুড়ি আর ওখানকার সুস্বাদু আলু ভাজি আমাদের দুর্দান্ত লাঞ্চ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ এখানকার লোকজনদের সঙ্গে গল্প গুজব  করে বিশ্রাম  নিতে গেলাম বাংলোর ভিতর ।
পরের  দিন ভোরে মানালি ফেরা।সবাই খুব হৈ হৈ  করে দিনটা কাটালাম।তখনও বুঝি নি এই  অপূর্ব চাঁদের আলো এই উচ্ছল সন্ধ্যা গানে গানে মুখরিত রাত্রি ঢেকে যাবে কালোমেঘে।মাঝ রাতে শুনি বাইরে তান্ডবলীলা ।এমনিতেই এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা হঠাৎ যেন দশগুণ বেড়ে গেল।সারারাত কম্বলের তলায় ঠকঠক করে কেঁপেছি আর ফেরার কথা ভেবে আকুল হয়েছি ।ভোরবেলায় উঠে দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।আর উত্তুরে হাওয়া যেন সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে।একরাতের মধ্যে সামনের পাহাড় গুলো মুহূর্তে বরফে ঢেকে গেছে।বাস আসতেই উঠে বসলাম ।সব যাত্রীদের মুখে এক কথা এভাবে বরফ পড়তে থাকলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে ।রাহুল ও মানালির একমাত্র সংযোগ স্থল রোটাংপাস যদি বন্ধ হয়ে যায় আমরা এখানেই বন্দী হয়ে যাবো।বাস একটু একটু করে যায় আর থেমে যায় ।জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার বলে ডিজেল ফাঁস গিয়া।প্রচন্ড ঠান্ডাতে ডিজেল জমে যাচ্ছে । বাসের মধ্যে সবাই চুপচাপ বসে আছি।এত দুর্ভাবনার মধ্যে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সব ভুলে গেলাম ।কি হবে কি হতে পারে সব ভাবনা ভুলে দেখতে থাকি আকাশ থেকে ঝরে পড়া যেন মুঠো মুঠো শ্বেত টগরের পাপড়ির মতো তুষার বৃষ্টি ।আর চারিদিক সাদায় সাদা।ডিজেল ফাঁসতে ফাঁসতে অবশেষে বিকেল বেলা খোকসার এসে পৌঁছলাম ।চারিদিক অন্ধকার ।এরকম দুর্যোগে কোনও গাড়ি আর যেতে চাইছে না।সব লরি বাস বন্ধ ।আজ এখানেই রাত্রি বাস।স্থানীয় লোকজন বলছে এরকম আবহাওয়া চলতে থাকলে রোটাংপাস বন্ধ হয়ে যাবে।ছ দিন কি ছ মাস  কেউ বলতে পারবে না।উৎকন্ঠিত চিত্তে পি ডব্লিউ ডির  রেস্ট হাউসে রাত কাটানোর জন্য হাজির হলাম ।সেদিনের মতো পোড়া আলু আর পোড়া রুটি  ডিনারের জন্য চায়ের দোকানে পাওয়া গেল।এরপরে কি হবে জানা নেই।এর মধ্যে ই মলয় বললো কি আর হবে দিদি তোর মেয়েটা বড় হয়ে যাবে আর কাকীমার তোমার ছেলে এক ক্লাস এগিয়ে যাবে ।আর যত দিন কাফ সিরাপ আছে রুটি দিয়ে গুড়ের মত খেয়ে নেব।কি চিন্তা আমাদের ।উফ্ কি ছেলে রে বাবা ।আমরা একমনে বাবা ত্রিলোকনাথ কে ডেকে যাচ্ছি  আর প্রার্থনা করছি রক্ষা করো বাবা।রাত্রি নটার পর ঝড়ের বেগ একটু কমে গেল।বৃষ্টির আওয়াজ ও যেন কমেছে মনে হল।একটু রাতে হঠাৎ যেন কাঁচের জানালার ফাঁকে এক ঝলক আলো এসে পড়লো ।হৈ হৈ করে বারান্দায় বেরিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় তুষারাবৃত হিমালয় স্নান করছে।অবর্ণনীয় সেই আলো সেই সৌন্দর্য ।আলোর ঝর্ণা ধারায় আনন্দে চোখে জল এসে গেল।মলয় আনন্দের চোটে গান গাওয়া শুরু করল–প্রেমের জোয়ারে ভাসাব দোঁহারে বাঁধন খুলে দাও দাও দাও যতো হাসি আর বলি ওরে এ যে  শ্যামার গান  প্রেমের গান কে কার কথা শোনে হাসতে হাসতে আমরা বাঁধন খোলার আনন্দে ভেসে গেলাম ।পরদিন বেলা দশটা নাগাদ বাস ছাড়লো।বরফ কেটে কেটে মন্থর গতিতে সন্ধ্যা সাতটায় রোটাং পাসের ভয়ানক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যেন মানালি এসে গেলাম ।একশ আশি কিলোমিটার শুধু সাদা দেখে দেখে সবুজের ছোঁয়ায় মন ভরে গেলো।জয় ত্রিলোকনাথ ।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

সমুদ্র মন্থনের বিষ ও নীলকণ্ঠ মহাদেব : শ্রাবণের পুরাণকথা ও তাৎপর্য।

প্রস্তাবনা

ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চায় প্রতিটি ঋতু, মাস, দিন, এমনকি মুহূর্তেরও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সেই পরম্পরায় শ্রাবণ মাস (জুলাই-আগস্ট) হল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ এক মাস। এটি চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী হিন্দু বর্ষপঞ্জির পঞ্চম মাস, এবং বর্ষার পূর্ণ মৌসুমি রূপে আবির্ভাব ঘটে এই সময়। শ্রাবণ শব্দটি এসেছে ‘শ্রবণ’ নক্ষত্র থেকে, যা এই মাসের পূর্ণিমার দিনটিকে নির্দেশ করে। এই মাস মূলত ভক্তি, তপস্যা ও আত্মশুদ্ধির মাস। এই সময়টা দেবাদিদেব মহাদেবের পূজা-অর্চনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।

শ্রাবণ মাস ও দেবাদিদেব মহাদেবের সম্পর্ক

শ্রাবণ মাস প্রধানত শিব ভক্তদের জন্য এক বিশেষ পূণ্যকাল। পুরাণ অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় যখন হলাহল বিষ উৎপন্ন হয়, তখন সমস্ত দেবতাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। সেইসময় ভগবান শিব তা নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন যাতে সৃষ্টির কোনো ক্ষতি না হয়। এই ঘটনার পর থেকেই শিবকে নীলকণ্ঠ বলা হয়।
বিশ্বাস করা হয়, সেই সময় ছিল শ্রাবণ মাস। ভগবান শিবের গলায় ধারণ করা বিষের তাপ প্রশমনের জন্য দেবতারা তাঁকে গঙ্গাজল, বেলপাতা ও দুধ নিবেদন করেন। সেই থেকেই শুরু হয় শ্রাবণ মাসে শিবের আরাধনা এবং শিবলিঙ্গে জল ও দুধ নিবেদন করার প্রথা।

শ্রাবণ মাসে উপবাস ও ব্রত

শ্রাবণ মাসে উপবাস রাখার প্রচলন অত্যন্ত প্রাচীন। এই মাসে প্রতি সোমবার ‘শ্রাবণ সোমব্রত’ পালন করা হয়। সাধারণত অবিবাহিতা কন্যারা উপযুক্ত বর প্রাপ্তির আশায় এই ব্রত পালন করেন, আর বিবাহিত নারীরা স্বামীর দীর্ঘ জীবন কামনায় এই ব্রত নেন।
সোমবার ব্রত পালনের নিয়ম:

ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করা।

শিবলিঙ্গে জল, দুধ, ঘৃত, মধু, চন্দন, বেলপাতা, ধুতুরা, আকাশবেল ইত্যাদি নিবেদন।

“ওঁ নমঃ শিবায়” মন্ত্র জপ করে আরতি এবং প্রার্থনা।

সারাদিন উপবাস রাখা বা ফলাহার গ্রহণ করা।

বিশেষ ব্রত ও পূজার ধরন:

মঙ্গলা গৌরী ব্রত: মহিলারা মঙ্গল কামনায় প্রতি মঙ্গলবার পালন করেন।

নাগ পঞ্চমী: নাগদের পূজার দিন; শিবের গলায় বাস করা বাসুকি নাগকে স্মরণ করে।

রক্ষাবন্ধন ও শ্রাবণী পূর্ণিমা: ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্ক উদযাপন।

শ্রাবণ মাসে পবিত্র তীর্থযাত্রা ও কাওয়ার যাত্রা

শ্রাবণ মাসে ভারতজুড়ে লক্ষ লক্ষ শিবভক্ত “কাঁওয়ারিয়া” হন। তাঁরা গঙ্গার পবিত্র জল সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট শিবমন্দিরে তা নিবেদন করেন। বিশেষ করে উত্তর ভারতের হরিদ্বার, গোমুখ, গঙ্গোত্রী, বারাণসী, বৈদ্যনাথধাম, কেদারনাথ প্রভৃতি স্থান থেকে জল সংগ্রহ করে দীর্ঘ পথ হেঁটে ভোলেনাথকে অর্ঘ্য দেন। এটি একটি কঠোর ব্রত; কাঁওয়ারিয়ার দল নিরামিষ আহার করেন, অনেকে নিদিষ্ট দিনে উপবাস পালন করেন এবং কঠোর নিয়ম পালন করেন।

পৌরাণিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব

শ্রাবণ মাসে দেবতা, ঋষি ও অন্যান্য মহাপুরুষের অনেক ঘটনাও এই মাসের সঙ্গে যুক্ত।

সমুদ্র মন্থন ও নীলকণ্ঠ রূপ
বিষ পান করে শিব পৃথিবীকে রক্ষা করেন। শ্রাবণ মাস সেই আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে।

শিব ও পার্বতীর পুনর্মিলন
শ্রাবণ মাসেই দেবী পার্বতী দীর্ঘ ব্রতের পর মহাদেবকে লাভ করেন।

শ্রীবিষ্ণুর যোগনিদ্রা থেকে জাগরণ
দেবশয়ন একাদশীতে শ্রীবিষ্ণু যোগনিদ্রায় যান এবং শ্রাবণ মাসে উত্থান একাদশীতে জেগে ওঠেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম মাস
শ্রাবণ মাসেই কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী পালিত হয়।

আয়ুর্বেদ ও প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রাবণ মাস

আয়ুর্বেদ অনুসারে, শ্রাবণ মাসে শরীর ও মন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, কারণ বর্ষার কারণে পরিপাক শক্তি দুর্বল হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই এই সময় উপবাস ও সাদামাটা খাদ্যাভ্যাস শরীরকে বিশ্রাম দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও জলবাহিত রোগ, সর্দি-কাশি, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি এই সময়ে বেশি দেখা যায়। তাই ফলাহার, নিরামিষ ভোজন, নিয়মিত যোগাভ্যাস এবং প্রার্থনা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।

মানসিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

শ্রাবণ মাস শুধু বাহ্যিক পূজা-অর্চনার জন্য নয়, এটি introspection বা আত্মসমীক্ষণের জন্যও উপযুক্ত সময়। এই মাসে তপস্যা, জপ, ধ্যান ও উপবাসের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মধ্যে শুদ্ধতা আনতে পারে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে—

“যঃ শ্রাবণমাসে শিবং ভজেত্, তস্য পাপানি নাশ্যন্তি ইহলোক পারত্র চ।”
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি শ্রাবণ মাসে ভগবান শিবের উপাসনা করেন, তার সব পাপ নাশ হয় – এই লোকেও, পরলোকেও।

শ্রাবণ মাসে পালনীয় কিছু নিয়ম

ব্রহ্মচর্য পালন করা।

নিষিদ্ধ দ্রব্য যেমন পেঁয়াজ, রসুন, মাংস-মদ ইত্যাদি পরিহার করা।

প্রত্যেক সোমবার উপবাস ও শিবপূজা।

কাঁওয়ার যাত্রায় অংশগ্রহণ করা অথবা অন্ততপক্ষে গৃহস্থ পর্যায়ে গঙ্গাজল নিবেদন।

দান-ধ্যান ও গরিবদের সাহায্য করা।

আধুনিক সমাজে শ্রাবণ মাসের তাৎপর্য

আজকের ব্যস্ত জীবনে শ্রাবণ মাস আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও পরিবেশ সচেতনতার বার্তা নিয়ে আসে। শিবের আরাধনা মানে কেবল পূজা নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও জীবনের ভারসাম্য খোঁজাও। বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণ, মানসিক চাপ, মূল্যবোধের অবক্ষয় যখন মানুষের জীবনে নৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে উঠেছে, তখন শ্রাবণ মাসের ব্রত ও অনুশাসন ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পারে।

উপসংহার

শ্রাবণ মাস সনাতন ধর্মের এক অমূল্য রত্ন। এটি শুধুমাত্র এক মাস নয় – এটি আত্মবিশ্লেষণ, আত্মত্যাগ, পরোপকার, সংযম, এবং ভক্তির এক দীর্ঘ সাধনার সময়। এই মাসে শিব ভক্তরা যেমন শারীরিক ও মানসিক তপস্যা করেন, তেমনি সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগও পান।
ভক্তি, শুদ্ধতা ও ধার্মিক চেতনার এই অনন্য উৎসবমুখর মাস নতুন করে মনে করিয়ে দেয় – “শিবেই সর্বস্ব”, “শিবই অনন্ত”, আর তাঁর চরণেই লুকিয়ে আছে মোক্ষের দ্বার।
শেষ কথা: শ্রাবণ মাসে অন্তত কিছু সময় ভগবান শিবের নাম জপ, নিঃস্বার্থ সেবা, এবং আত্মিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলা – এটাই এই মাসের প্রকৃত পালন।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ রিভিউ

করম উৎসব – লোকসংস্কৃতির অঙ্গ কলমেঃ দিলীপ রায়

করম উৎসব – লোকসংস্কৃতির অঙ্গ
কলমেঃ দিলীপ রায় ( ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)
করম প্রধানত সৃষ্টির উৎসব, সৃজনের উৎসব । শরতের আগমনে শস্য ও সমৃদ্ধি কামনায় করম পরব বা করম উৎসব । ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী বা পার্শ্ব একাদশীতে করম উৎসব পালিত হয় । এই বছর অনুষ্ঠিত হবে ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ । এই পরবের মূল আকর্ষণ হলো জাওয়া গান (অনেকে ‘জাওয়া’ বানান ‘যাওয়া’ লিখে থাকেন) । বলা চলে, গানগুলো লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গ ।
এবার আসছি জাওয়া কি ? সেটা আমাদের জানা দরকার । “জাওয়া শব্দটা নাকি ‘জাত’ শব্দ থেকে এসেছে । বীজের অঙ্কুরোদ্‌গম বা চারার ‘জাত’ বা জন্ম থেকে এইরকম নামকরণ হয়ে থাকতে পারে । শব্দটি “জাওয়া” হবে, নাকি “যাওয়া” হবে , সেটা নিয়েও মতোভেদ রয়েছে । যাই হোক “জাওয়া” হচ্ছে একটি শস্য উৎসব । আবার শস্য বীজের অঙ্কুরোদ্‌গমেরও অনুষ্ঠান বলা চলে । একমাত্র কুমারী মেয়েরাই এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে । ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশীর এক সপ্তাহ আগে এই অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে ।
এবার আসছি করম পরব প্রসঙ্গে ।
করম পরব ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, আসাম, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশ ও নেপালে একটা ফসল কাটার উৎসব । এই উৎসবে করম দেবতার উপাসনা করা হয় । যিনি হচ্ছেন কিনা শক্তি, যুব ও যৌবনের দেবতা । করম পরব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা, ঝাড়্গ্রাম জেলা, বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কুড়মি, ভূমিজ, বৈবা, মুণ্ডা, রাজোয়াড়, সরাক, লোহার বাউরি, বীরহড়, বীরনিয়া, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, কোড়া মাহালি, পাহাড়িয়া, হাড়ি, বাগদি, বেদে, ঘাসি, লোধা ও বৃহৎ জনগোষ্ঠী সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, প্রভূতি সম্প্রদায়ের জঙ্গলভিত্তিক ও কৃষিভিত্তিক লোক উৎসব । তবে কুড়মি সমাজে এর স্বীকৃতি, মান্যতা ও ব্যাপকতা উল্লেখযোগ্য ।
প্রকৃতির পুজা ও উর্বতার উৎসব । এই করম পরব প্রায় সাতদিন ধরে উদযাপন হয় । কুমারী কন্যারা নিষ্ঠার সঙ্গে সাতদিন ধরে ব্রত পালন করেন, করম গাছের ডাল পুজা করেন এবং বপন করা হয় ভুট্টার বীজ । অঙ্কুরিত ভুট্টার চারা বা ‘জাওয়া’কে উর্বতার প্রতীক হিসাবে দেখা হয় । মূলত এই করম উৎসবটি আদিবাসী ও সাঁওতাল জনজাতিদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় । করম পুজা ঝুমুর গান, “আজরে করম রাজা ঘরে দুয়ারে, কালরে করম রাজা কাশ নদীর পারে” ।
ভাই বোনের গভীর ভালবাসার কথা জাওয়া গান গুলোতে বারবার ফুটে উঠে । দাদা ও ভাইয়ের সঙ্গে কাটানো সুখের মিহূর্তগুলো বোনকে খুব পীড়া দেয় । তাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হলে, মিথ্যাই সাত্ত্বনা দিতে বধূটি বলে ওঠে – “আমারি জনম পরের ঘর ।“ ভাই তখন সান্ত্বনা দেয় । সেই গান মেয়েরা গেয়ে ওঠে —
“আমি কি লিখ্যেছি বহিন বিধাতা লিখ্যেছে রে
বিধাতা লিখেছে পরের ঘর ।
পরেরই ঘরে বহিন খাটি লুটি খাও রে
রাখি দিহ বাপের ভায়ের নাম ।“
মূলত গ্রামের অবিবাহিত কুমারী মেয়েরাই এই ‘করম’ ঠাকুরের উপাসক । শুক্লা একাদশীর সাতদিন আগে কুমারী মেয়েরা একত্রে বাঁশের বোনা ‘টুপা’ (ডালা) এবং বিভিন্ন ধরনের শস্যবীজ নিয়ে জড়ো হয় পার্শ্ববর্তী কোনো নদী, পুকুর বা জলাশয়ে । সেখানে প্রত্যেকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে সদ্যস্নাত ভিজে কাপড়ে নিজের নিজের টুপায় নদী খাতের বালি ভর্তি করে বাড়ি থেকে আনা সেই শস্যবীজগুলো বোনে । তারপর পরস্পরের হাত ধরে টুপা’কে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী গান গাইতে থাকে ।
এরপর শুরু হয় এই জাওয়া টুপাগুলোর পরিচর্যা । দিন দুয়েক পরেই বীজগুলির অঙ্কুরোদ্‌গম হয় । জাওয়া পাতানো কুমারী মেয়েরা, জাওয়ার শুদ্ধতা বজায় রাখার নিরিখে সারা সপ্তাহ ধরে পালন করে কিছু রীতি নীতি । যেমন – একদিন তারা শাক খায় না, খাটিয়ায় ঘুমোয় না, মাথায় তেল দেয় না, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় না, । এছাড়াও প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা নিজ নিজ ডালাসহ গ্রামের এক জায়গায় জড়ো হয় । জাওয়াকে কেন্দ্র করে সারা সন্ধ্যা চলে করম গান ও নাচ ।
সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের লায়া (পুরোহিত) এক জায়গায় করম ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন । তৈরি হয় পুজোর বেদী । গ্রামের ব্রতকারী কুমারী মেয়েরা “করম ডালায়” পুজোর অর্ঘ্যরূপে মাটির প্রদীপ, শাল পাতার তৈরি থালায় নদীর বালি, ঘি, গুড়, আতপ চাল, মধু, ধূপ, সিঁদুর, একগাছি ধান আর ‘কাঁকুড়’, ইত্যাদি নিয়ে সমবেত হয়ে পুজো করে পরম ঠাকুরের । কামনা করে সোহাগী স্বামী পাওয়ার ও সন্তানবতী হওয়ার ।
এবার আসছি করম পুজার প্রচলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে । এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, করম পুজা প্রচলনের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে । একটি মত সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
কথিত আছে, কর্ম ও ধর্ম দুই ভাই । দু’জনেই খুব পরিশ্রমী ও দয়ালু । কিছু দিন পর কর্মের বিয়ে হয়ে গেলো । তাঁর স্ত্রী ছিল অধার্মিক এবং অন্যদের বিরক্ত করার মানসিকতা । আর এতে রাগান্বিত হয়ে কর্ম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
তিনি চলে যেতেই সকলের কর্মফল ও ভাগ্যও চলে গেলো এবং মানুষের দুঃখ দুর্দশা বাড়তে লাগলো । মানুষের সমস্যা সহ্য করতে না পেরে ধর্ম ভাইয়ের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন । কিছু দূর হাঁটার পর তাঁর জল তেষ্টা পেলো এবং দেখলেন, আশেপাশে কোথাও জল নেই । দূরে একটা নদী দেখতে পেলেন এবং সেখানে গিয়ে দেখলেন, জল নেই । নদী ধর্মকে বলল, তোমার ভাই এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের কর্মফল নষ্ট হয়ে গিয়েছে । গাছের সব ফল নষ্ট ! তাঁকে খুঁজে পেলে বলো, তাঁর কাছে আমাদের এই সমস্যার সমাধান চাই । তারপর আরও একজন মহিলার সঙ্গে তাঁর দেখা এবং তিনি বললেন, কর্ম চলে যাওয়ার পর থেকে রান্নার পরে পাত্রগুলি হাতে লেগে যেতে শুরু করে, এর সমাধান কী ? আপনি কর্মকে জিজ্ঞাসা করুন এবং তাঁকে সমাধান বলতে বলুন । ধর্ম আরও এগিয়ে গেলেন । একটি মরুভূমিতে পৌঁছালেন । সেখানে তিনি দেখলেন, কর্ম গরমে অস্থির । তাঁর শরীরে ফোসকা পড়েছে এবং তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন । তাঁর অবস্থা অসহনীয় । ধর্ম কর্মকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন । তখন উভয় ভাই বাড়ি ফিরে যেতে লাগলেন । ফেরার সময় সেই মহিলার সঙ্গে দেখা । কর্ম তাঁকে বললেন, ঐ মহিলা কখনও কোনও ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াননি, তাই তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে । সুতরাং এটি তাঁর কর্মফল । একইভাবে সকলকে নিজের কর্মফলের কথা জানানোর পর কর্ম বাড়িতে ফিরে এসে পুজা করেন । তারপর সমগ্র এলাকার লোকেরা আবার সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন এবং সমৃদ্ধি ফিরে আসল । সেই স্মরণে করম পরব পালিত হয় ।
# আর একটি মত হচ্ছেঃ
এক সময় সাত ভাই ছিল যারা কৃষিকাজে কঠোর পরিশ্রমী । এমনকি তাঁদের দুপুরের খাওয়ারও সময় থাকতো না । তাই, স্ত্রীরা প্রতিদিন তাঁদের দুপুরের খাবার মাঠে নিয়ে যেতেন । একবার এমন হয়েছিল, তাঁদের স্ত্রীরা দুপুরের খাবার নিয়ে মাঠে যাননি । সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত ছিলেন তাঁরা । সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখেন তাঁদের স্ত্রীরা বাড়ির উঠোনে করম গাছের ডালের পাশে নাচ-গান করছেন । এটা দেখে তাঁরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা । এক ভাই তাঁর মেজাজ হারিয়ে ফেলে করমের ডাল ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিলেন । করম দেবতাকে অপমান করা হয়েছিল । ফলে তাঁদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে এবং অনাহারে তাঁদের দুর্দশা অবস্থা । একদিন একজন ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) তাদের কাছে এলেন এবং সাত ভাই পুরো ঘটনাটা তাঁকে খুলে বললেন । এরপর সাত ভাই করম ঠাকুরের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। তাঁরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে থাকেন এবং এইভাবে খোঁজার পর একদিন তাঁরা করম গাছের সন্ধান পান । পরবর্তীকালে, করম ঠাকুরের পুজো করেন । তারপর তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটতে থাকে । সুখ ও শান্তি ফিরে আসে ।
এলাকার মানুষ সহ কর্ম ও ধর্ম সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন এবং সমৃদ্ধি ফিরে আসল । সেই স্মরণে করম পরব পালিত হয় । বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে করম পার্বণ একটি অন্যতম । এটি গ্রাম বাংলার এক অজানা অথচ বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, কুড়মিদের চা-বাগানের মানুষদের সু-প্রচলিত করম উৎসব । এই বছরও করম পুজাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজ্য সরকার ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ছুটি ঘোষণা করেছেন ।
পরিশেষে বলা যায়, করম পরব আদিম জনগোষ্ঠীর ধারক ও বাহক । এর মধ্যে অন্যতম কুড়মি, সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, ওঁরাও, রাজোয়াড়, ডোম, ঘাসি প্রভৃতি জনগোষ্ঠী । যদিও উল্লেখিত, কুড়মি সমাজের মধ্যে এর স্বীকৃতি, মান্যতা ও ব্যাপকতা অবর্ণনীয় । আদিম জনগোষ্ঠী প্রায় সকলেই প্রকৃতির পুজারী । ভাল করে এই উৎসবের পুজানুষ্ঠান ও পালনবিধি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এটা একটা বৃক্ষ পুজার অনুষ্ঠান । বৃক্ষকে জীবন্ত আত্মার অধিকারী হিসাবে স্বীকার করে এবং তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-অনুষ্ঠানের এক বিস্ময়কর সমাবেশ এবং শুদ্ধ ভক্তির পরম্পরা ! (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী (পিন-৭৪১২৩৫) / ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

চার ধাম : এক মহাপবিত্র তীর্থযাত্রার ইতিহাস ও তাৎপর্য।

🔶 ভূমিকা

ভারতবর্ষের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরম্পরায় চার ধামের গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দু ধর্মে “চার ধাম” বলতে বোঝায় চারটি পবিত্র স্থান, যেখানে একবার তীর্থ করে আসা মানুষের পাপ মোচন হয় এবং মোক্ষ লাভের পথ প্রসারিত হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। এই চারটি তীর্থক্ষেত্র হল—বদ্রীনাথ (উত্তরে), দ্বারকা (পশ্চিমে), জগন্নাথ পুরী (পূর্বে) এবং রামেশ্বরম (দক্ষিণে)।
এই তীর্থযাত্রা শুধুমাত্র ভ্রমণ নয়, বরং আত্মশুদ্ধির এক অনন্য উপলক্ষও বটে।

🕉️ চার ধামের উৎপত্তি ও ধারণা

চার ধামের ধারণা প্রচলন করেন মহান আচার্য শংকরাচার্য। তিনি অষ্টম শতকে সারা ভারতে ধর্মীয় সংস্কার ও আধ্যাত্মিক জাগরণ আনতে চারটি প্রান্তে চারটি ধামের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ধর্মের মূল মন্ত্রকে দেশজুড়ে বিস্তার করা এবং মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ঐক্য ও আত্মিক উত্তরণ ঘটানো।

📍 চার ধামের পরিচিতি

১. বদ্রীনাথ ধাম (উত্তর ভারত)

অবস্থান: উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় হিমালয়ের নরনারায়ণ পর্বতের কোলঘেঁষে অবস্থিত।

প্রধান দেবতা: ভগবান বিষ্ণু (বদ্রীনারায়ণ রূপে)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: এখানে শংকরাচার্য আধ্যাত্মিক তপস্যার আশ্রম স্থাপন করেছিলেন। পুরাণ অনুযায়ী, বদ্রীনাথ হল সেই স্থান যেখানে নারায়ণ তপস্যা করেছিলেন এবং লক্ষ্মী দেবী বাদামের গাছ (বদ্রি) হয়ে তাঁকে রোদ থেকে রক্ষা করেছিলেন।

মুখ্য আর্কিটেকচার: পাহাড়ের মাঝে কাঠ ও পাথরের মিলিত রীতিতে তৈরি মন্দির।

তীর্থকাল: এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, কারণ শীতকালে তুষারপাতের কারণে বন্ধ থাকে।

২. দ্বারকা ধাম (পশ্চিম ভারত)

অবস্থান: গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে আরব সাগরের তীরে।

প্রধান দেবতা: শ্রীকৃষ্ণ (দ্বারকাধীশ রূপে)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: কৃষ্ণ এখানে Mathura থেকে স্থানান্তর করে রাজ্য স্থাপন করেন। এটি তাঁর রাজ্যপাটের স্থান। মহাভারতের বহু কাহিনি এই শহরকে ঘিরে আবর্তিত।

দ্বারকাধীশ মন্দির: এটি চৌহান শাসকের দ্বারা নির্মিত, ৭-তলা বিশিষ্ট বিশাল মন্দির।

তীর্থকাল: সারা বছরই ভক্তদের আনাগোনা দেখা যায়, বিশেষ করে জন্মাষ্টমীতে।

৩. জগন্নাথ পুরী (পূর্ব ভারত)

অবস্থান: ওড়িশার পুরী শহরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে।

প্রধান দেবতা: ভগবান জগন্নাথ (কৃষ্ণ রূপে), বলভদ্র ও সুভদ্রা।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: এটি কৃষ্ণের এক বিশেষ রূপ। এই মন্দিরে একমাত্র স্থানে কৃষ্ণের কাঠের মূর্তি বিরাজমান। এখানেই অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত ‘রথযাত্রা’ উৎসব।

জগন্নাথ মন্দির: ১২ শতকে নির্মিত এই মন্দিরটি হিন্দু স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন।

বিশেষত্ব: “মহাপ্রসাদ”, রাঁধার নিয়ম ও বিতরণ পদ্ধতি এক অলৌকিক ঘটনা।

৪. রামেশ্বরম ধাম (দক্ষিণ ভারত)

অবস্থান: তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম জেলায়, পাক প্রণালীতে অবস্থিত।

প্রধান দেবতা: শিব (রামনাথস্বামী রূপে)।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: রামায়ণ অনুযায়ী, ভগবান রাম এখানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পুজো করেন লঙ্কা যাত্রার পূর্বে। সেই কারণে এই স্থান অত্যন্ত পবিত্র।

রামনাথস্বামী মন্দির: বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ করিডোর বিশিষ্ট দক্ষিণী শৈলীতে নির্মিত মন্দির।

অন্য নাম: হিন্দু ধর্মে এটি “বেণারসের পরে সর্বোচ্চ পুণ্যক্ষেত্র” হিসেবেও ধরা হয়।

🙏 চার ধামের তীর্থযাত্রার গুরুত্ব

◾ মোক্ষ লাভের আশ্বাস

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, জীবনে একবার চার ধাম দর্শন করলে মোক্ষ লাভ হয়, আর পুনর্জন্মের আবর্ত থেকে মুক্তি মেলে।

◾ পাপ মোচন

শাস্ত্রে বলা হয়েছে, এই ধামে পবিত্র স্নান, দান, পূজা ও জপ-তপ করলে মানুষের জন্মজন্মান্তরের পাপ ধুয়ে যায়।

◾ আত্মিক পরিশুদ্ধি

চার ধামের প্রত্যেকটির নিজস্ব পরিবেশ, অনুভব, ও আত্মিক প্রভাব আছে। পাহাড়, সমুদ্র, নদী ও উপকূলের মিশ্র পরিবেশ আত্মাকে শুদ্ধ করে।

🚩 আধুনিক যুগে চার ধাম যাত্রা

বর্তমানে সরকার চার ধাম যাত্রাকে অনেক সহজতর করে তুলেছে। “চার ধাম মহামার্গ” প্রকল্পের মাধ্যমে একাধিক হাইওয়ে নির্মাণ হয়েছে। পাশাপাশি হেলিকপ্টার পরিষেবা, ট্রেন, বাস, ও অনলাইন বুকিংয়ের সুযোগ বাড়ানো হয়েছে।

🔍 কিছু চমকপ্রদ তথ্য

বদ্রীনাথ ধামে একমাত্র ঠাণ্ডার মরসুম বাদে পূজা হয়।

রামেশ্বরমে রামের স্থাপন করা শিবলিঙ্গের পাশে অন্য এক শিবলিঙ্গ নেপাল থেকে আনা হয়েছিল।

জগন্নাথ মন্দিরে পতাকা প্রতিদিন উল্টো দিক থেকে ওড়ে।

দ্বারকায় এখনও সমুদ্রের নিচে ডুবে যাওয়া প্রাচীন শহরের নিদর্শন পাওয়া যায়।

🌿 উপসংহার

চার ধাম তীর্থ শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক এক সফর নয়, এটি আত্মিক উৎকর্ষের এক গভীর অনুশীলন। শংকরাচার্যের প্রতিষ্ঠিত এই তীর্থগুলি আজও হিন্দু ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী হৃদয়ে এক গভীর ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করে চলেছেন।
জীবনে অন্তত একবার চার ধামের দর্শন জীবনের উদ্দেশ্য, কৃতজ্ঞতা, আত্মবোধ ও ঈশ্বর ভাবনার নব দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়।
‐——————–
—‐‐-‐-‐————–‐-

Share This
Categories
গল্প

শেষ ট্রেনের যাত্রী।

পর্ব ১: রাতের ট্রেন

সেদিন রাত সাড়ে দশটা। কুয়াশায় ঢাকা শীতের রাত। তরুণ সাংবাদিক ঋষি সরকার কলকাতা থেকে বর্ধমান ফিরছিলেন।
অফিসের কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা স্টেশন থেকে শেষ লোকাল ট্রেন ধরা ছাড়া উপায় ছিল না।
ট্রেনটা যখন আসল, প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লাল বাতির নিচে কাঁপছিল এক ছায়া। ঋষি খেয়াল করল—একজন মহিলা। খুব ধীরে ধীরে ট্রেনের দিকে এগোচ্ছেন। মুখ ঢাকা লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে। বড্ড নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছিল।
ঋষি নিজের কামরায় উঠল। সে ছাড়া পুরো কামরায় আর কেউ নেই। একটা জানলার পাশে বসে সে মোবাইলে হেডফোন গুঁজে সংবাদ সম্পাদনা শুরু করল।

পর্ব ২: ছায়ার সঙ্গী

ট্রেন ছেড়ে দিলো।
কুয়াশা গিলে ফেলছে রেললাইনের দুই দিক। ট্রেনের আলোতে মাঝে মাঝে জ্বলজ্বল করে উঠছে কোনও পুরনো সিগন্যাল পোস্ট বা গাছের ছায়া।
হঠাৎ ট্রেনের ভিতর একটা শব্দ হলো—টিক…টিক…টিক…
ঋষি প্রথমে ভাবল মোবাইলের শব্দ। কিন্তু না—এটা যেন কারও চুড়ির শব্দ। পাশের কামরায় কেউ কি উঠল?
ঋষি উঠে গিয়ে দেখতে পেল—সেই সাদা শাড়ির মহিলা। তিনি কামরার একেবারে কোণার আসনে বসে জানালার দিকে মুখ করে আছেন। আলোতে মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
ঋষি একটু অস্বস্তি বোধ করল, কিন্তু কিছু বলল না।
তখনই মহিলা মুখ ঘুরিয়ে বললেন—
“এই কামরাটা কি শুধু আপনার?”
ঋষি অবাক হয়ে বলল, “না তো! ট্রেন তো পাবলিক…”
মহিলা ধীরে ধীরে হেসে বললেন,
“তাহলে আপনি জানেন না, রাত সাড়ে দশটার পর এই ট্রেন আমার একার হয়।”
ঋষির বুকের মধ্যে শীতল কিছু জমে উঠল।

পর্ব ৩: মুখহীন গল্প

ঋষি সেই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারছিল না, মজা করা হচ্ছে না কি…?
মহিলার মুখটা এখনও স্পষ্ট নয়। যেন কুয়াশায় আবৃত।
সে আবার বলল—
“এখানে কেউ বেশিক্ষণ থাকে না। যাঁরা থাকেন, তাঁদের আর কোথাও ফিরতে হয় না।”
ঋষি হাসল, “আপনি লেখিকা নাকি অভিনেত্রী? খুব অভিনয় করছেন মনে হচ্ছে।”
মহিলা হঠাৎ একটানা বললেন—
“১৯৭৮ সালের জানুয়ারির এক রাত ছিল। এই ট্রেনেই আমি ফিরছিলাম। ঠিক এই কামরায়, এই জানালার পাশে। একদল লোক এসে আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কারণ আমি বিধবা হয়েও মঞ্চে গান গাইতাম। সমাজ মেনে নেয়নি।”
ঋষির হাসি মুখে জমে গেল। সে সামনে তাকিয়ে দেখল—মহিলার মুখে মাংস নেই। কেবল পুড়ে যাওয়া চামড়া আর একটা গলিত চোখ।
সে চিৎকার করে উঠতে গেল, কিন্তু শব্দ বের হলো না। গলা শুকিয়ে কাঠ।

পর্ব ৪: ছেঁড়া টিকিট

ঋষি জ্ঞান হারাল না, বরং হঠাৎই নিজেকে খুঁজে পেল সেই পুরনো দিনের ট্রেনে। যেন টাইম মেশিনে ঢুকে গেছে।
এখন কামরায় বেশ কিছু যাত্রী। সবাই পুরনো ধাঁচের পোশাক পরা। কেউ রেডিও শুনছে, কেউ বিড়ি টানছে।
ঋষি তাকিয়ে দেখে—সেই মহিলা মঞ্চে গান গাইছে, “আমারে ছাড়িয়া বন্ধু…”
কিন্তু তখনই হঠাৎ তিনজন লোক এসে ওর উপর চড়াও হলো। কেরোসিন ঢালা, চিৎকার…আর তার পর আগুন!
ঋষি চিৎকার করে উঠল—
“না! কেউ ওকে বাঁচাও! বাঁচাও!!”
চোখ মেলে দেখে সে ট্রেনের সিটে বসে। গলা ভিজে গেছে ঘামে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই।
শুধু তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা ছেঁড়া টিকিট—১৯৭৮ সালের বর্ধমান লোকালের।

পর্ব ৫: শেষ স্টেশন

বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন ঢুকতেই ঋষি নেমে পড়ল। রাত তখন প্রায় ১টা।
প্ল্যাটফর্মে একজন বৃদ্ধ হকার চা বিক্রি করছিল। ঋষি ছুটে গেল ওর কাছে।
“এই ট্রেনে একটা মহিলা ছিল, সাদা শাড়ি পরা, পুড়ে গেছিল নাকি… এমন কেউ কি ছিল?”
চাওয়ালা তাকিয়ে বলল,
“আপনি ওনার কামরায় ছিলেন? ভাগ্য ভালো, ফিরে এসেছেন। সবাই তো ফেরে না। উনি গান পছন্দ করতেন, কিন্তু ওর গান সমাজ মেনে নেয়নি।”
“কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
চাওয়ালা বলল,
“কারণ আমি সেই রাতে ট্রেনেই ছিলাম। তখন আমি কেরোসিন নিয়ে এসেছিলাম…”
ঋষি হতভম্ব!
বৃদ্ধ হঠাৎ হেসে বলল,
“এখন আমিও মরেছি, আপনি বেঁচে থাকুন। এটাই অনেক।”
চাওয়ালা হঠাৎ মিলিয়ে গেল কুয়াশায়।
ঋষি মাথা ধরে স্টেশনের বেঞ্চে বসে পড়ল।

শেষ ভাগ: শিরোনাম ও পুনর্জন্ম

ঋষি বাড়ি ফিরে সেই কাহিনি লিখল।
নাম দিল—“শেষ ট্রেনের যাত্রী”
কোনও সম্পাদক সাহস পেল না ছাপাতে।
এক বছর পর, সেই স্টেশনের গায়ে একটা নামহীন কবরে সে একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি রাখল। আর লিখল—
“তোমার গান আমি শুনেছি, এবার তুমি শান্তিতে ঘুমাও।”

Share This
Categories
গল্প

গল্পের নাম: শেষবার দেখা।

🌇 ১. পরিচয়

শ্রেয়া আর ঋষভ।
কলেজ লাইফের বন্ধুত্ব থেকে গড়ে ওঠা এক নিঃশব্দ ভালোবাসার গল্প।
শ্রেয়া – শান্ত, বইপ্রেমী, রবীন্দ্রসংগীতপসন্দ।
ঋষভ – চঞ্চল, ক্যামেরার পেছনে থাকা ছেলেটা, স্বপ্ন দেখত সিনেমা বানানোর।
প্রথম দেখা হয়েছিল কলেজ ফেস্টে, ক্যাম্পাসের পুরনো অডিটোরিয়ামে। শ্রেয়া রবীন্দ্রসংগীত গাইছিল আর ঋষভ ভিডিও করছিল। ক্যামেরার লেন্স越 যতই ফোকাস করছিল, ঋষভের হৃদয়ও যেন ততটাই জুম ইন করছিল তার গলার দিকে, চোখের দিকে।

🍂 ২. কাছে আসা

তাদের মধ্যে কোনোদিন ভালোবাসা বলে কিছু উচ্চারিত হয়নি।
তবু শ্রেয়ার প্রতিটি সকালে “সুপ্রভাত ঋষভ”, আর ঋষভের প্রতিটি রাত “ঘুমোও ভালো করে, শ্রেয়া”— এসব যেন বলেই দিত কিছু একটা আছে।
বৃষ্টির দিন তারা একসাথে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজত,
চায়ের কাপে ভাগ বসাত,
বইয়ের পাতা টেনে বলত, “এই গল্পটা আমাদেরও হতে পারত।”

🕯️ ৩. ভুল বোঝাবুঝি

কিন্তু প্রেম যত গভীর হয়, Ego তত বড় হয়ে দাঁড়ায়।
ঋষভ একদিন বলল — “তুই তো আমায় কখনও ভালোবাসিস না। শুধু ব্যবহার করিস।”
শ্রেয়া কেঁদে ফেলেছিল। তাও ঋষভ ফিরল না।
তারা কথা বলা বন্ধ করল।
নীরবতা ছিন্ন করল তাদের সব স্মৃতি।

🌒 ৪. অনেক বছর পর…

৫ বছর কেটে গেছে।
শ্রেয়া এখন প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি করে।
ঋষভ নামী ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার।
তাদের কেউ একে অপরের খোঁজ রাখত না, কিন্তু মনে ঠিকই করত।
একদিন, শ্রেয়া অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ির কাচের ওপারে এক চেনা মুখ। ঋষভ।
চোখাচোখি…
একটা হাসি…
এবং তারপর আবার ছুটে আসা দিনগুলোর স্মৃতি।

🍁 ৫. শেষবার দেখা

রবিবার, কলেজের পুরনো ক্যাম্পাসে তারা দেখা করল।
শ্রেয়ার চোখে জল, ঋষভ বলল — “ভুলগুলো আমার ছিল, ক্ষমা করিস।”
শ্রেয়া একবার ঋষভের কাঁধে মাথা রাখল। অনেকদিন পর…
“আমরা কি আবার শুরু করতে পারি?” — প্রশ্ন করল ঋষভ।
শ্রেয়া বলল, “তোমার ক্যামেরার লেন্সে আমায় আজও স্পষ্ট দেখা যায়?”
ঋষভ মুচকি হাসল —
“আজও, প্রথম দিনের মতোই, পরিষ্কার।”

🌸 শেষ কথা

ভালোবাসা কখনও মরে না।
কখনও কখনও শুধুই একটা দেখা, একটা হাসি — অনেক কিছু ফিরিয়ে আনে।
তাদের গল্পটা শেষ হয়নি, শুধু আবার শুরু হয়েছে… একটু দেরিতে।

ধরন: আবেগঘন প্রেমকাহিনি
সময়কাল: আধুনিক শহর কলকাতা
শব্দসংখ্যা: প্রায় ২০০০

Share This
Categories
উপন্যাস গল্প

চিঠিতে লেখা প্রেম।

🧩 গল্পের সারাংশ:

এই গল্প একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক অসম্ভব প্রেমের, যেখানে দু’জন অচেনা মানুষ — ঋদ্ধি ও আকাশ — এক ভুল ঠিকানায় পৌঁছানো চিঠি থেকে শুরু করে, এক গভীর আত্মিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সময়, দূরত্ব, পরিবার ও সমাজের বাস্তবতা তাদের পরীক্ষা নেয়, কিন্তু ভালোবাসা বারবার ফিরে আসে… কখনো চিঠিতে, কখনো নীরবতায়।

🎭 প্রধান চরিত্র:

ঋদ্ধি সরকার: কলকাতার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে, সাহিত্যে আগ্রহী, আবেগপ্রবণ, অন্তর্মুখী।

আকাশ দত্ত: এক গ্রাম্য ডাকঘরের কর্মচারী, শান্ত স্বভাবের, কবিতা ভালোবাসে, দায়িত্বশীল।

কাকলি (ঋদ্ধির বন্ধু), মিস্টার মুখার্জি (আকাশের ডাকঘরের বস), ঋদ্ধির বাবা-মা, আকাশের দিদি মালবিকা — সহায়ক চরিত্র।

🗂️ গল্পের কাঠামো (২৫ পর্ব):

ভুল ঠিকানায় পাঠানো চিঠি

আকাশের আগ্রহে প্রথম উত্তর

চিঠির উত্তর-পত্র চলতে থাকে

নামহীন পরিচয়ের টান

ঋদ্ধির কাকলির সন্দেহ

আকাশের ব্যক্তিজীবন প্রকাশ

ঋদ্ধির কলেজে নাটক, প্রথম কবিতা পাঠ

আকাশের ডাকঘরের গোলমাল

ঋদ্ধির অভিমান

এক দীর্ঘ চিঠিতে ক্ষমা

আকাশের দিদির দেখা মেলানো চেষ্টা

পুজোর সময় কলকাতায় দেখা হতে পারত

দেখা হয়নি, বেড়ে যায় দুরত্ব

ঋদ্ধির বাবা অন্যত্র বিয়ের প্রস্তাব দেন

আকাশের ভেতর যুদ্ধ

কাকলির সাহসী পদক্ষেপ

ঋদ্ধির বিদ্রোহ

প্রথম ফোনালাপ

একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে

আকাশ কলকাতা আসে

মুখোমুখি দেখা

পরিবার জানে সব

সম্পর্কের স্বীকৃতি চাওয়া

চিঠির শেষ পাতা

নতুন ঠিকানা — একই নামে

এখন নিচে এই কাহিনির জন্য একটি কল্পচিত্র তৈরি করছি, যাতে পুরো সিরিজটির অনুভব উঠে আসে।

📖 চিঠিতে লেখা প্রেম

পর্ব ১: ভুল ঠিকানায় পাঠানো চিঠি
কলকাতার একটি মেঘলা বিকেল। ঋদ্ধি তার জানালার ধারে বসে ছিল, এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে একটি সাদা খাম। চোখে চিন্তা — চিঠিটা লিখেছে সে, কিন্তু পাঠাবে কি পাঠাবে না, তা বুঝে উঠতে পারছে না।
চিঠিটা সে লিখেছে একজনকে, যার নাম অনিরুদ্ধ — তার কলেজের সিনিয়র, যাকে সে অনেক দিন ধরে পছন্দ করে। কিন্তু সাহস হয়নি মুখোমুখি বলার। সে ভেবেছিল, একটা চিঠি পাঠালে হয়তো মনের কথা কিছু বলা যাবে।
অবশেষে, খানিক সাহস করে সে পিন কোড, এলাকা সব লিখে দিয়ে পোস্টবক্সে ফেলে দেয় চিঠিটা।
তবে ভুলটা সেখানেই ঘটে।
ঋদ্ধি ভুল করে পিন কোডে দুটি সংখ্যা উল্টে লিখে ফেলে। চিঠিটা পৌঁছে যায় ৭০০০১৬ নয়, ৭০০০৬১-তে — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক ছোট ডাকঘরে।
অন্যদিকে —
সেই ছোট্ট ডাকঘরের ভিতরে এক তরুণ কর্মচারী — আকাশ দত্ত। ছুটির শেষে একটা অদ্ভুত চিঠি তার হাতে এসে পড়ে। প্রাপক যাকে লেখা, সেই ঠিকানায় এমন কেউ নেই।
কিন্তু চিঠির কাগজে এমন শব্দ, এমন আন্তরিকতা — যেন সেটা কারোর ব্যক্তিগত কবিতা।
“তুমি জানো না আমি কে, কিন্তু আমি তো তোমায় প্রতিদিন দেখি…” — এমন এক চিঠির পংক্তি পড়ে আকাশ অবাক হয়।
সে ভাবে: “এই চিঠির উত্তর যদি দিই? যদি তার লেখার মতো করে লিখি কিছু? সে কি উত্তর দেবে?”
সেই সন্ধ্যায়, আকাশ লেখে তার জীবনের প্রথম চিঠি — যা ঠিক প্রেরকের নামে নয়, বরং এক অচেনা হৃদয়ের খামে।

 

📖 চিঠিতে লেখা প্রেম

পর্ব ২: (আকাশের আগ্রহে প্রথম উত্তর)

আকাশ দত্তর জীবন ছিল একরকম ছন্দে বাঁধা — সকালে অফিস, দুপুরে চা, বিকেলে কাগজপত্রের ঝাঁপি গুছিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা।
কিন্তু সেই একটি ভুল ঠিকানায় পৌঁছনো চিঠি যেন তার ছন্দে এক নতুন সুর এনে দিল।
চিঠিটা সে অন্তত দশবার পড়েছে।
লেখা ছিল —
“তুমি জানো না আমি কে, তবু প্রতিদিন তোমার চোখে কিছু দেখার ইচ্ছে হয় আমার। যদি জানত তুমি, কীভাবে আমি তোমায় অনুভব করি — হয়তো হাসতে, হয়তো কাঁদতে।”
চিঠির লেখার ভঙ্গি আকাশকে অভিভূত করেছিল। এই যে কেউ একজন, এই শহরের কোথাও, এমন নিঃশব্দে কারো দিকে তাকিয়ে প্রেম করছে — একরকম সাহস আর নরম আবেগের সংমিশ্রণ ছিল তাতে।
সেই রাতে আকাশের ঘরে ছিল কেরোসিনের আলো।
সে টেবিলে বসে প্রথমবার কাগজে কলম রাখে, অনেক ভেবে লিখে ফেলে:

“প্রিয় অচেনা তুমি,
তোমার লেখা পড়ে আমি ভীষণ চমকে গেছি। চিঠিটা কাকতালীয়ভাবে আমার হাতে পড়েছে।
জানি, তুমি যাকে চিঠি লিখেছো, আমি সে নই। তবু তুমি যা লিখেছো, তা এতটা সত্য আর আন্তরিক, যে আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি।
আমি জানি না, তুমি আমাকে উত্তর দেবে কিনা, কিংবা আদৌ পড়বে কিনা আমার চিঠি।
তবু যদি উত্তর দাও, তবে আমি খুশি হব।
— আকাশ”

চিঠিটা শেষ করে সে লিখে দেয় খামের গায়ে প্রেরকের ঠিকানা — ঋদ্ধি সরকার।
তারপর পোস্ট করে দেয় পরদিন সকালে।
কলকাতার অন্যপ্রান্তে, দুদিন পরে, ঋদ্ধি ডাকঘর থেকে ফেরার পথে চিঠি হাতে পায়। প্রথমে অবাক হয়ে ভাবে — “আকাশ? কে?”
চিঠি খুলে পড়ে সে অবাক হয়ে যায় —
“তার মানে… আমার চিঠি… সে পেয়েছে? কিন্তু সে তো অনিরুদ্ধ না!”
তবু, চিঠির একেকটা বাক্য তার মনে নরম স্পর্শ ছুঁয়ে যায়।
একটা অচেনা নাম, এক অচেনা ভাষা — কিন্তু তাতে এক অদ্ভুত টান।
চোখে যেন ধরা পড়ে এক স্বীকারোক্তি —
“ভুল ঠিকানায় পাঠানো ভালোবাসা যদি উত্তর পায়, তবে সেটা কি সত্যিই ভুল থাকে?”

 

পর্ব ৩: (চিঠির উত্তর-পত্র চলতে থাকে)

ঋদ্ধি চিঠিটা পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। জানালার কাঁচে ধেয়ে আসা হালকা বৃষ্টি আর দূরের কাকের ডাক যেন চুপচাপ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার ভেতরের আলোড়নের।
চিঠিটা সে বারবার পড়ে। কে এই আকাশ? ডাকঘরের কর্মচারী, কিন্তু কী সুন্দরভাবে লিখেছে! কোনো অভিযোগ নেই, কৌতূহলও কম — তবু কোথাও যেন একটা ভদ্রতা মেশানো আন্তরিকতা।
তারপর হঠাৎ যেন একটা কিশোরীর হাসি ঝরে পড়ে ওর ঠোঁটে।
“চলো, এই খেলাটা দেখি কতদূর যায়। চিঠিতে চিঠির জবাব দেওয়া — এটাও তো একরকম প্রেম নয় কি?”
সেই রাতে সে লিখে ফেলে তার উত্তর।

প্রিয় আকাশ,
তোমার চিঠি পেয়ে বিস্ময় আর আনন্দ একসাথে কাজ করেছে।
হ্যাঁ, এই চিঠি আমি অনিরুদ্ধ নামে একজনকে লিখেছিলাম, যে হয়তো কোনোদিনই পড়বে না। তুমি পড়েছো, তাতে খারাপ লাগেনি। বরং ভালোই লেগেছে।
তুমি যদি লেখো, আমিও লিখব।
নাহ, আমরা কোনোদিন দেখব না হয়তো, তবু কয়েকটা পৃষ্ঠা থাক আমাদের মাঝে।
তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি কে — আমার নাম ঋদ্ধি, সাহিত্যে স্নাতক করছি। কবিতা পড়ি, সিনেমা দেখি, আর মাঝে মাঝে এমন চিঠি লিখি…
তুমি লিখতে পারো, আকাশ। ঠিকানাটা তো এখন জানো।
— ঋদ্ধি

চিঠিটা পাঠিয়ে দিয়ে সে একরকম অপেক্ষা করতে থাকে।
প্রথমে ১ দিন, তারপর ২ দিন, ৩ দিন…
৪র্থ দিনে এক বিকেলে আবার এক খাম আসে।
আকাশের লেখা — নীল কালিতে।
এবার লিখেছে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ছোটবেলার গল্প, কীভাবে সে প্রতি সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে কবিতা পড়ে…
আর শেষে লিখেছে:

*”তুমি বলেছিলে, আমরা দেখা করবো না।
আমি বলছি, চিঠিতে যদি একদিন চোখে দেখা পাওয়া যায় — তবে আর বাইরে দেখা না হলেও চলবে।”*

ঋদ্ধির মুখে এক শান্ত হাসি।
এইভাবে শুরু হয় চিঠির যাত্রা —
সপ্তাহে একবার করে।
কখনো কবিতা, কখনো গল্প, কখনো নিঃশব্দ যন্ত্রণার কথা — তারা সব বলে, শুধু লিখে।

 

পর্ব ৪: (নামহীন পরিচয়ের টান)

চিঠির খামে কখনো নাম থাকত না — শুধু “প্রিয় তুমি” আর “তোমার আকাশ”।
সপ্তাহের সেই নির্দিষ্ট দিনে ঋদ্ধি ডান হাতের কড়ে আঙুলে মেহেদির মতো অপেক্ষা বয়ে বেড়াত — আজ চিঠি আসবে।
আর আকাশ? সে প্রতিদিন ডাকঘরের ব্যাগ থেকে একটা খালি জায়গা রেখে দিত — ওখানে থাকত ঋদ্ধির চিঠির জন্য আলাদা জায়গা।
তাদের মধ্যে কোনো মোবাইল নম্বর নেই, ছবি নেই, সোশ্যাল মিডিয়াও না।
তবু এই অদ্ভুত অদৃশ্য যোগাযোগ — একটা অদেখা মানুষের জন্য এমন করে অপেক্ষা?
প্রথমে কাকলি — ঋদ্ধির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী — কিছু না বুঝে জিজ্ঞেস করেছিল,
— “তোকে কি সত্যিই চিঠিতে ভালো লাগা শুরু হয়েছে? নাম জানিস, পেশা জানিস, ছবি জানিস না। তার মানে কি?”
ঋদ্ধি শুধু হেসে বলেছিল,
— “কিছু কিছু সম্পর্ক জানার নয়, অনুভব করার। ওর নাম তো আকাশ — সীমাহীন, অথচ ধরা যায় না।”
অন্যদিকে আকাশও এক সন্ধ্যায় লিখে ফেলে:

“প্রিয় তুমি,
আজ সকাল থেকে অফিসে খুব চাপ, কিন্তু মাথার ভিতরে শুধু একটা কথাই ঘুরছে —
তোমার চোখ কেমন? তুমি বৃষ্টিতে ভেজো? চায়ের কাপ ধরে গাল ভিজে যায় তোমার?
কেমন অদ্ভুত না, আমি এসব জানি না, তবু মনে হয় জানি।
তুমি কি আমায় দেখতে চাও?
নাকি এই না-দেখা, না-জানা ভালোবাসাটাই আমাদের গল্প?”
— তোমার আকাশ

ঋদ্ধি উত্তর দেয় না সোজাসুজি। পরের চিঠিতে সে শুধু লিখে —

“বৃষ্টিতে ভেজা চোখের ছবি ভালোবাসি। দেখা নয়, অনুভব — সেটাই সবচেয়ে সত্যি।”

তারা নিজেরা যেন এক ছায়ায় ছায়া খুঁজছিল। এক অচেনা টান, এক নামহীন গভীরতা তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক এমন জগতে, যেখানে পরিচয় মুখ নয়, আত্মা।
এইভাবে কেটে যায় কয়েকটি মাস।
শহরের মাঝে, ছেলেমেয়ের গলার সুরে, বইমেলার ভিড়ে, তারা আলাদা আলাদা থেকেও যেন একসাথে হাঁটছিল।
তাদের নাম ছিল না একে অপরের ঠোঁটে, কিন্তু হৃদয়ের পৃষ্ঠায় একেকটা চিঠি হয়ে লিখে যাচ্ছিল —
ভালোবাসার অপরিচিত গল্প।

অসাধারণ! নিচে আমি তোমার জন্য পর্ব ৫ থেকে ১০ পর্যন্ত গল্পটি পরপর সাজিয়ে দিচ্ছি। প্রতিটি পর্ব ছোট ছোট করে হলেও আবেগ, টান ও নাটকীয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।

পর্ব ৫: (কাকলির সন্দেহ)।

কাকলি এখন আর চুপ করে নেই।
একদিন চিঠিগুলো দেখে বলে বসলো,
— “দেখ, ঋদ্ধি, অচেনা কারও সঙ্গে এমন আবেগ দিয়ে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। হয়তো ও বিবাহিত, কিংবা…”
— “তুমি ওকে চেনো না, কাকলি,” বলে ঋদ্ধি শান্তভাবে চিঠিগুলো গুছিয়ে রাখে।
— “তুইও কি চাস না, একবার ওকে দেখতে?”
— “না কাকলি। আমি চাই চিঠিগুলো থাকুক… ওকে না দেখেই এই অনুভবটা সত্যি।”
কিন্তু কাকলির মনে একটা অস্থির সন্দেহ বাসা বাঁধে — আর সে চুপচাপ কিছু খোঁজ নিতে শুরু করে…

পর্ব ৬: (আকাশের ব্যক্তিজীবন প্রকাশ)।

ঋদ্ধির চিঠির উত্তরে আকাশ এবার নিজের কিছু ব্যক্তিগত কথা জানায়।

“তুমি জেনো, আমি ছোটবেলা থেকে বইয়ের মধ্যে থাকতাম। মা মারা যান যখন আমি দশ বছরের, বাবা এরপর আর নতুন সংসার করেননি। এখন আমি আর দিদি — আমাদের দুইজনের ছোট সংসার।
আমি চিঠিগুলোর মধ্যে যেন একটা বন্ধ দরজার ওপাশে আলো দেখি — সেই আলো তুমি।
তুমি কেমন? তোমার মা-বাবা? কাউকে বলেছো আমার কথা?”

ঋদ্ধির চোখে জল আসে। সে ভাবে, একজন ছেলে, এতটা ভেতর খুলে দেয় কাউকে — শুধু চিঠিতে?
এই গভীর আত্মার ছোঁয়া যে খুব কম পাওয়া যায়।

পর্ব ৭: (ঋদ্ধির কলেজে নাটক, প্রথম কবিতা পাঠ)।

ঋদ্ধির কলেজে বসন্তোৎসব। সে এবার নিজের লেখা কবিতা পাঠ করবে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার চোখ বারবার খোঁজে সেই একজনকে, যে আসবে না, তবু তার সব কবিতার উৎস।
সে পড়ে তার নিজের লেখা কবিতা:

“চিঠির কাগজে আঁকা নামহীন মুখ,
প্রতিটি অক্ষরে তুমি ছিলে, তবু চেনা হলে না।
তুমি এসোনি কোনো সন্ধ্যায়,
কিন্তু আমার প্রতিটি সকাল, তোমায় দিয়েই শুরু।”

বন্ধুরা প্রশংসা করে, কিন্তু সে জানে কবিতার মূল শ্রোতা আজ নেই।
পরদিন সে চিঠির সঙ্গে কবিতার কপি পাঠিয়ে দেয় আকাশকে।

পর্ব ৮: (আকাশের ডাকঘরের গোলমাল)।

ডাকঘরে হঠাৎ চিঠি হারানোর অভিযোগে একটা তদন্ত হয়।
আকাশকে প্রশ্ন করা হয় — সে কি ব্যক্তিগত চিঠি খুলে পড়ে?
কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। ঋদ্ধির চিঠির কথা কাউকে না বলে কেবল নিজের সততা প্রমাণ করে।
বস, মিস্টার মুখার্জি, পরে বলে,
— “তোকে জানি বেটা, কিন্তু সাবধান। আজকের দিনে কেউ কাউকে চিঠি লেখে?”
আকাশ একভাবে হেসে ফেলে।
সে জানে, আজও কেউ কেউ হৃদয়ের খামে ভালোবাসা ভরে পাঠায়…

পর্ব ৯: (ঋদ্ধির অভিমান)।

এক সপ্তাহ চিঠি আসে না।
ঋদ্ধি ঘুমাতে পারে না, চোখে কালি পড়ে যায়।
সে ভাবে —
“তাহলে কি আকাশও চলে গেল? সেও কি এখন বাস্তবের দিকে ফিরে গেল?”
চিঠির প্রতীক্ষায় দিন কেটে যায়।
অবশেষে চতুর্থ সপ্তাহে চিঠি আসে, কিন্তু অল্প কথায় লেখা:

“কিছুদিন ডাকঘরের ঝামেলায় মন ছিল না, দুঃখ দিয়েছি।
তবে বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে লেখা বন্ধ করিনি — শুধু একটু হারিয়ে গিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করো?
তুমি কি এই চিঠির উত্তর দেবে, নাকি আমায় ক্ষমা করবে না আর?”
— তোমার আকাশ

ঋদ্ধি ভেতরে কেঁপে ওঠে।
তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ে — সে রাগ করতে পারেনি, শুধু মন খারাপ করেছিল।
সে উত্তর লেখে —

“আমি চিঠি পাওয়ার অপেক্ষা করি, রাগ করি না। আমি আজকাল তোমার শব্দেই বাঁচি আকাশ…”

পর্ব ১০: (এক দীর্ঘ চিঠিতে ক্ষমা)।

এই পর্বে আকাশ নিজের সমস্ত অনুশোচনা এক চিঠিতে লেখে।

“ঋদ্ধি, তুমি জানো, চিঠি না পাঠিয়ে আমি নিজেকেই যেন ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি এখন বুঝি, এই চিঠিগুলো শুধু লেখা নয় — এটা আমাদের অস্তিত্ব।
আমি তোমায় না দেখে ভালোবেসে ফেলেছি, হয়তো অযৌক্তিক, কিন্তু এর চেয়ে সত্য আর কিছুই নেই।
যদি পারো, আমাকে ক্ষমা কোরো।
আমি আর কখনো হারিয়ে যাবো না।”

চিঠির শেষে ছিল একটা প্রশ্ন —
“তুমি কি আমাকে ঠিকঠাক ভালোবাসো, ঋদ্ধি?”
ঋদ্ধি উত্তর দেয় না সাথে সাথে।
সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে… তার ভিতরটাও মেলে ধরা।
তার চোখে তখন মেঘ জমে —
“ভালোবাসা কি সত্যিই হয় চিঠিতে?
না কি… এটাও একটা গল্প মাত্র?”

অসাধারণ! নিচে আমি তোমার জন্য পর্ব ৫ থেকে ১০ পর্যন্ত গল্পটি পরপর সাজিয়ে দিচ্ছি। প্রতিটি পর্ব ছোট ছোট করে হলেও আবেগ, টান ও নাটকীয়তা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।

📖 চিঠিতে লেখা প্রেম

পর্ব ৫–১০

পর্ব ৫: কাকলির সন্দেহ

কাকলি এখন আর চুপ করে নেই।
একদিন চিঠিগুলো দেখে বলে বসলো,
— “দেখ, ঋদ্ধি, অচেনা কারও সঙ্গে এমন আবেগ দিয়ে জড়িয়ে পড়া ঠিক নয়। হয়তো ও বিবাহিত, কিংবা…”
— “তুমি ওকে চেনো না, কাকলি,” বলে ঋদ্ধি শান্তভাবে চিঠিগুলো গুছিয়ে রাখে।
— “তুইও কি চাস না, একবার ওকে দেখতে?”
— “না কাকলি। আমি চাই চিঠিগুলো থাকুক… ওকে না দেখেই এই অনুভবটা সত্যি।”
কিন্তু কাকলির মনে একটা অস্থির সন্দেহ বাসা বাঁধে — আর সে চুপচাপ কিছু খোঁজ নিতে শুরু করে…

পর্ব ৬: আকাশের ব্যক্তিজীবন প্রকাশ

ঋদ্ধির চিঠির উত্তরে আকাশ এবার নিজের কিছু ব্যক্তিগত কথা জানায়।

“তুমি জেনো, আমি ছোটবেলা থেকে বইয়ের মধ্যে থাকতাম। মা মারা যান যখন আমি দশ বছরের, বাবা এরপর আর নতুন সংসার করেননি। এখন আমি আর দিদি — আমাদের দুইজনের ছোট সংসার।
আমি চিঠিগুলোর মধ্যে যেন একটা বন্ধ দরজার ওপাশে আলো দেখি — সেই আলো তুমি।
তুমি কেমন? তোমার মা-বাবা? কাউকে বলেছো আমার কথা?”

ঋদ্ধির চোখে জল আসে। সে ভাবে, একজন ছেলে, এতটা ভেতর খুলে দেয় কাউকে — শুধু চিঠিতে?
এই গভীর আত্মার ছোঁয়া যে খুব কম পাওয়া যায়।

পর্ব ৭: ঋদ্ধির কলেজে নাটক, প্রথম কবিতা পাঠ

ঋদ্ধির কলেজে বসন্তোৎসব। সে এবার নিজের লেখা কবিতা পাঠ করবে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার চোখ বারবার খোঁজে সেই একজনকে, যে আসবে না, তবু তার সব কবিতার উৎস।
সে পড়ে তার নিজের লেখা কবিতা:

“চিঠির কাগজে আঁকা নামহীন মুখ,
প্রতিটি অক্ষরে তুমি ছিলে, তবু চেনা হলে না।
তুমি এসোনি কোনো সন্ধ্যায়,
কিন্তু আমার প্রতিটি সকাল, তোমায় দিয়েই শুরু।”

বন্ধুরা প্রশংসা করে, কিন্তু সে জানে কবিতার মূল শ্রোতা আজ নেই।
পরদিন সে চিঠির সঙ্গে কবিতার কপি পাঠিয়ে দেয় আকাশকে।

পর্ব ৮: আকাশের ডাকঘরের গোলমাল

ডাকঘরে হঠাৎ চিঠি হারানোর অভিযোগে একটা তদন্ত হয়।
আকাশকে প্রশ্ন করা হয় — সে কি ব্যক্তিগত চিঠি খুলে পড়ে?
কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। ঋদ্ধির চিঠির কথা কাউকে না বলে কেবল নিজের সততা প্রমাণ করে।
বস, মিস্টার মুখার্জি, পরে বলে,
— “তোকে জানি বেটা, কিন্তু সাবধান। আজকের দিনে কেউ কাউকে চিঠি লেখে?”
আকাশ একভাবে হেসে ফেলে।
সে জানে, আজও কেউ কেউ হৃদয়ের খামে ভালোবাসা ভরে পাঠায়…

পর্ব ৯: ঋদ্ধির অভিমান

এক সপ্তাহ চিঠি আসে না।
ঋদ্ধি ঘুমাতে পারে না, চোখে কালি পড়ে যায়।
সে ভাবে —
“তাহলে কি আকাশও চলে গেল? সেও কি এখন বাস্তবের দিকে ফিরে গেল?”
চিঠির প্রতীক্ষায় দিন কেটে যায়।
অবশেষে চতুর্থ সপ্তাহে চিঠি আসে, কিন্তু অল্প কথায় লেখা:

“কিছুদিন ডাকঘরের ঝামেলায় মন ছিল না, দুঃখ দিয়েছি।
তবে বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে লেখা বন্ধ করিনি — শুধু একটু হারিয়ে গিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করো?
তুমি কি এই চিঠির উত্তর দেবে, নাকি আমায় ক্ষমা করবে না আর?”
— তোমার আকাশ

ঋদ্ধি ভেতরে কেঁপে ওঠে।
তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ে — সে রাগ করতে পারেনি, শুধু মন খারাপ করেছিল।
সে উত্তর লেখে —

“আমি চিঠি পাওয়ার অপেক্ষা করি, রাগ করি না। আমি আজকাল তোমার শব্দেই বাঁচি আকাশ…”

পর্ব ১০: এক দীর্ঘ চিঠিতে ক্ষমা

এই পর্বে আকাশ নিজের সমস্ত অনুশোচনা এক চিঠিতে লেখে।

“ঋদ্ধি, তুমি জানো, চিঠি না পাঠিয়ে আমি নিজেকেই যেন ভুলে গিয়েছিলাম।
আমি এখন বুঝি, এই চিঠিগুলো শুধু লেখা নয় — এটা আমাদের অস্তিত্ব।
আমি তোমায় না দেখে ভালোবেসে ফেলেছি, হয়তো অযৌক্তিক, কিন্তু এর চেয়ে সত্য আর কিছুই নেই।
যদি পারো, আমাকে ক্ষমা কোরো।
আমি আর কখনো হারিয়ে যাবো না।”

চিঠির শেষে ছিল একটা প্রশ্ন —
“তুমি কি আমাকে ঠিকঠাক ভালোবাসো, ঋদ্ধি?”
ঋদ্ধি উত্তর দেয় না সাথে সাথে।
সে জানে, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মানে… তার ভিতরটাও মেলে ধরা।
তার চোখে তখন মেঘ জমে —
“ভালোবাসা কি সত্যিই হয় চিঠিতে?
না কি… এটাও একটা গল্প মাত্র?”

 

পর্ব ১১: (আকাশের দিদির দেখা মেলানোর চেষ্টা)।

আকাশের দিদি মালবিকা অনেক দিন ধরেই ছোট ভাইয়ের এই “চিঠি প্রেম” নিয়ে চিন্তিত।
একদিন রাতে আকাশ যখন রান্নাঘরে, তখন মালবিকা ওর ড্রয়ার থেকে কয়েকটা চিঠি দেখে ফেলে।
চোখে পড়ে —

“ঋদ্ধি সরকার, কলেজ স্কোয়ার, কলকাতা…”

মালবিকা ঠিক করে, ছেলেটাকে বাঁচাতে হলে, মেয়েটার বাস্তব অস্তিত্ব জানা দরকার।
সে নিজের একজন পরিচিতের মাধ্যমে কলেজ স্কোয়ার এলাকায় খোঁজ শুরু করে…
পায় একটা সূত্র —
“ঋদ্ধি, কলকাতার সিটি কলেজে পড়ে, সাহিত্যের ছাত্রী।”
মালবিকা আর আকাশকে কিছু না বলে চুপচাপ একদিন কলকাতা রওনা দেয়…

পর্ব ১২: (পুজোর সময় কলকাতায় দেখা হতে পারত)।

এদিকে শরৎ এসেছে। দুর্গাপূজার ঢাকে শহর ভরে গেছে।
ঋদ্ধি আকাশকে চিঠিতে লিখে —

“পুজোর সময় যদি তুমি কলকাতায় আসো, আমি কলেজ ফেস্টিভ্যালে কবিতা পাঠ করব।
দেখা না হলেও, crowd-এর মধ্যে একটা অচেনা চোখ যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে… জানব, তুমি এসেছো।”

আকাশ খুব করে চায় যাওয়া, কিন্তু অফিস থেকে ছুটি মেলে না।
তার দিদি তখনো শহরে… এবং সে গিয়ে দেখে ঋদ্ধিকে ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করতে।
এক মুহূর্ত, মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সাদা-শাড়ি-পরা মেয়েটার চোখে একরাশ গভীরতা দেখে মালবিকা থমকে যায়।
সে ভাবে,
“এই মেয়েটাই কি আমার ভাইয়ের চিঠির নায়িকা?”
কিন্তু সে সামনে গিয়ে কিছু বলে না। শুধু দূর থেকে দেখে যায়।

পর্ব ১৩: (দেখা হয়নি, বেড়ে যায় দূরত্ব)।

পূজোর পর চিঠিতে ঋদ্ধি লেখে:

“তুমি এলে না কেন? আমি ওইদিন একটু একটু করে তোমাকে খুঁজছিলাম।
crowd-এ অনেক চোখ, কিন্তু কোনোটাই ছিল না আমার আকাশ…”

আকাশ কেবল লিখে:

“তুমি বলেছিলে দেখা না হলেও চলবে… এখন তুমি কাঁদছো কেন?”

ঋদ্ধি অভিমান করে চিঠির উত্তর দেয় না।
একটা সপ্তাহ, তারপর আরেকটা…
আকাশও কিছু লেখে না।
এক নীরবতা জমতে থাকে তাদের মাঝখানে —
যেন প্রতিটা না-পাওয়া শব্দ এক একটা শূন্য খাম হয়ে ফেরত যাচ্ছে…

পর্ব ১৪: (ঋদ্ধির বাবা অন্যত্র বিয়ের প্রস্তাব দেন)।

এক সন্ধ্যায় ঋদ্ধির বাবা বলেন,
— “একটা ভালো পরিবার থেকে প্রস্তাব এসেছে, ঋদ্ধি। ছেলে কলকাতায় চাকরি করে। দেখা করবি একবার?”
ঋদ্ধি চমকে ওঠে।
সে বলে না কিছু, শুধু নিজের ঘরে গিয়ে একটার পর একটা চিঠি বের করে বিছানায় ছড়িয়ে দেয়।
প্রত্যেকটা কাগজে যেন আকাশের ছোঁয়া —
তার না দেখা ভালোবাসা।
সে রাতটা ঘুমায় না। শুধু লেখে ডায়েরিতে —
“আমি যদি হেরে যাই, তাহলে কাগজের ভালোবাসা কি জিতবে কখনও?”

পর্ব ১৫: (আকাশের ভেতর যুদ্ধ)।

অন্যদিকে আকাশ মালবিকার মুখোমুখি।
মালবিকা বলে,
— “আমি ওকে দেখেছি। মেয়েটা খুব ভালো। কিন্তু ও তো জানে না তুমি কে। এক অদ্ভুত মোহ তৈরি হয়েছে তোমাদের মধ্যে।
এটা যদি একদিন ভেঙে পড়ে? ও কি সামলাতে পারবে?”
আকাশ চুপ করে থাকে।
তার মাথার ভিতর চলছে এক যুদ্ধ —
“আমি কি নিজে থেকেই দূরে সরে যাই?
নাকি ওকে জানাই আমি কে?
আমার ছবি পাঠাবো?
ও যদি আমাকে দেখে পছন্দ না করে? যদি…”
কিন্তু সেই রাতে, আকাশ একটা ছোট্ট খামে নিজের একটা পুরনো ছবি রেখে চিঠির সঙ্গে পাঠায়।
চিঠির শেষ লাইনে লেখে —

“ঋদ্ধি, আজ আমি তোমায় আমার মুখটা দিলাম।
দেখো, তুমি যদি ভালোবাসো আমাকে — চিঠির মতোই।”

পর্ব ১৬: (কাকলির সাহসী পদক্ষেপ)।

ঋদ্ধি আকাশের ছবি হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
না সে কাঁদে, না হাসে। কেবল দেখে। আর ভাবে –
“এই মানুষটাই? এই সেই আকাশ, যে আমার প্রতিটি দুঃখের ওষুধ হয়ে উঠেছিল?”
কিন্তু চিঠিতে সে কোনো উত্তর দেয় না।
দুদিন, চারদিন… এক সপ্তাহ কেটে যায়।
এদিকে কাকলি চুপচাপ সব লক্ষ্য করছিল।
একদিন সে বলে,
— “দেখ, তোদের গল্পটা কাগজে আঁকা, কিন্তু তাতে রং আছে। যদি তুই কিছু না বলিস, সব মুছে যাবে।
তোর যদি ভয় লাগে, আমি তোকে নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব।”
ঋদ্ধি চমকে যায়।
— “তুই জানিস কোথায়?”
— “না, কিন্তু আমরা বের করব। পিওনের খামে মোহর দেওয়া নাম আর এলাকা তো রয়েছেই।”
সেই শুরু —
কাকলি ঠিক করে, সে নিজেই একদিন চিঠি লেখবে আকাশকে।

পর্ব ১৭: (ঋদ্ধির বিদ্রোহ)।

ঋদ্ধির বাবা আবার বিয়ের ব্যাপারে চাপ দেন।
তিনি বলেন,
— “এই বয়সে কবিতা দিয়ে পেট চলে না। ভালো ছেলে, ভালো চাকরি — জীবন সহজ হবে।”
ঋদ্ধি শান্ত গলায় বলে,
— “বাবা, তুমি কি জানো, আমি কোনোদিন কারো সঙ্গে এতখানি মন খুলে কথা বলিনি?
তুমি যাকে পছন্দ করছো, সে আমাকে বুঝবে তো?”
রাগে-অভিমানে সেই রাতে সে নিজের ঘরে বসে চিঠি লেখে আকাশকে:

“আমি জানি না আমাদের শেষ কোথায়, কিন্তু আমি চাই না এটা চিঠির মাঝখানে আটকে থাকুক।
আমি তোমাকে ছুঁতে চাই না, আমি তোমার সত্যটা জানতে চাই।
তুমি যদি পারো, এসো দেখা করতে।
আমি থাকব কলেজের সামনে, আগামী শনিবার, দুপুর ৩টায়।
যদি না আসো, বুঝব — গল্পটা শেষ।”

পর্ব ১৮: (প্রথম ফোনালাপ)।

আকাশ এই চিঠি পড়ে কাঁপতে থাকে।
সেই মুহূর্তে প্রথমবার সে নিজের মনের ভয় ভেঙে দিদিকে বলে,
— “আমাকে ওর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। এখনই। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে আগে…”
দিদি একটা ফোন নম্বর জোগাড় করে দেয়। কাকলির মাধ‍্যমে।
রাতে, বহুদিনের পর, চিঠির শব্দ কণ্ঠে রূপ নেয়।
ঋদ্ধি ফোনটা তোলে:
— “হ্যালো?”
— “আমি… আকাশ।”
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর দু’পাশেই নিঃশ্বাস।
আরো কিছু না বলেও তারা সব বলে ফেলে।
শব্দের মাঝখানে শুধু কান্না আর হাসির সুর।
ঋদ্ধি শুধু ফিসফিসিয়ে বলে,
— “তুমি আসবে তো?”
— “আসব। এবার সত্যিই আসব।”

পর্ব ১৯: (একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে)।

শনিবার সকাল।
আকাশ ট্রেন ধরে কলকাতা আসছে। তার ব্যাগে কয়েকটি চিঠি, একটা পুরনো বই, আর একটা ছোট্ট উপহার।
কিন্তু সেই মুহূর্তে, মালবিকা রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়ে। হাসপাতালে ভর্তি।
আকাশ দ্বিধায় পড়ে যায় — সে কি যাবে দেখা করতে, নাকি থাকবে দিদির পাশে?
সে ফোন করে কাকলিকে —
— “ঋদ্ধিকে বলো, আমি কথা রেখেও রাখতে পারলাম না। আমি আসতে পারছি না…”
কাকলি ফোন রাখার পর ঋদ্ধিকে কিছু বলে না।
ঋদ্ধি বিকেলে কলেজ স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঘড়ির কাঁটা চলে যায় ৩টা, ৪টা, ৫টা…
সে জানে, হয়তো আকাশ আর আসবে না।
কিন্তু মন বলে —
“ভালোবাসা চলে যেতে পারে, কিন্তু প্রতীক্ষা কখনও মরে না…”

পর্ব ২০: (আকাশ কলকাতা আসে)।

তিনদিন পর মালবিকার অবস্থার উন্নতি হয়।
আকাশ সেই রাতেই একটি ট্রেন ধরে কলকাতা আসে।
সকাল ৬টা, সিটি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে…
সে দেখে — একজন মেয়ে মাধবীলতা ফুলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে ক্লান্তি, মুখে আলো।
ঋদ্ধি।
তারা চুপ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
নজর এড়িয়ে থাকা সেইসব চিঠির শব্দ যেন এবার হাওয়ায় ভাসে।
আকাশ ফিসফিস করে বলে —
— “তুমি চিঠিতে যেমন ছিলে, চোখেও ঠিক তেমনই…”
ঋদ্ধি শুধু বলে —
— “তুমি আসবে বলেছিলে। তুমি এসেছো। বাকিটা আমি মানি…”
এক মুহূর্ত, সময় থেমে যায়।
আর, একটা পুরনো প্রেম… কাগজের গন্ধ থেকে সত্যিকারের শ্বাসে রূপ নেয়।

পর্ব ২১: (মুখোমুখি দেখা)।

সিটি কলেজের সামনের সেই বেঞ্চ — যেখানে একসময় ঋদ্ধি একা বসে চিঠি লিখত, আজ সেখানেই বসে আকাশ।
দু’জনে একসাথে।
তারা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
পরে আকাশ বলে,
— “তুমি জানো? আমি ভেবেছিলাম দেখা হলে সবকিছু বদলে যাবে।
কিন্তু না… চিঠির ঋদ্ধি আর এই ঋদ্ধি — একদম এক!”
ঋদ্ধি হেসে বলে,
— “তুমি ঠিক বলেছো… চিঠিতে আমরা একে অপরের মধ্যে যা খুঁজেছি, চোখে সেটা হারাবে না। কারণ চিঠি তো শুধু কাগজ নয়, ওটা তো আত্মা।”
ওই বিকেলে, তারা আর কিছু চায় না — শুধু একটু পাশে থাকা, একটু চুপচাপ থাকাই যেন বহুদিনের পূর্ণতা।

পর্ব ২২: (পরিবার জানে সব)

ঋদ্ধি নিজের পরিবারকে সব বলে দেয়।
প্রথমে বাবা রেগে যান।
— “তুমি একজন সাধারণ ডাকঘরের কর্মচারীর সঙ্গে জীবন কাটাবে?”
মা বোঝাতে চেষ্টা করেন:
— “ওকে এতদিন তুমি জানো না, আর মেয়েটা তাকে ভালোবাসে… এতটাই গভীরভাবে।”
কিন্তু বাবা সহজে মানতে চান না।
তবু, আকাশের চিঠিগুলো পড়ে তাঁর মুখে একরকম নরমতা আসে।
তিনি বলেন,
— “ছেলেটার কলমে যা আছে, সেটা যদি তার হৃদয়ে থাকে — তাহলে আমি কিছু বলব না। কিন্তু জীবনটা কঠিন, ও পারবে তো?”
ঋদ্ধি জবাব দেয়,
— “যে মানুষ কথা না রেখেও ক্ষমা চাইতে জানে, সে কষ্ট এলেও পাশে থাকবে।”

পর্ব ২৩: (সম্পর্কের স্বীকৃতি চাওয়া)।

আকাশ এবার নিজের দিদিকে সব জানায়।
মালবিকা প্রথমে একটু চিন্তিত ছিল, কিন্তু তারপর বলে,
— “যদি ও তোমার সেই ঋদ্ধি হয়, তাহলে আর ভয় কিসে? এগিয়ে যা, ভাই।”
আকাশ এবং ঋদ্ধি এবার একসাথে দুই পরিবারের সামনে দাঁড়ায়।
আকাশ বলে,
— “আমি বড় কিছু দিতে পারব না, কিন্তু ওর প্রতিটি চিঠির মতোই প্রতিদিন ওর পাশে থাকব। ভুল করলেও চিঠির মতো ক্ষমা চাইব।”
বাবা একটু চুপ করে, তারপর বলেন,
— “আচ্ছা, এবার যদি আমার মেয়ের চোখের জল ফেলে রাখো — তখন কিন্তু আমি চিঠিতে নয়, সামনে দাঁড়িয়ে আসব!”
ঘরজুড়ে হাসি।
প্রেম এবার সত্যিকারের নাম পায় — “একটি সম্পর্ক”।

পর্ব ২৪: (চিঠির শেষ পাতা)।

বিয়ের ঠিক আগের রাতে আকাশ ও ঋদ্ধি আবার চিঠি লেখে —
একটি শেষ চিঠি, যেটা তারা একে অপরকে দেবে বিয়ের দিন সকালে।
চিঠিতে ছিল…
আকাশের চিঠি:

“আমার প্রিয় চিঠির মেয়ে,
আগামীকাল থেকে আমাদের আর কাগজে কাগজে দেখা হবে না।
তুমি আমার পাশে থাকবে, আমার হাতে হাত রাখবে, আর প্রতিটি কথা — সরাসরি হৃদয় থেকে কানে পৌঁছাবে।
তবুও এই শেষ চিঠি রাখো — যেন কোনোদিন ঝড় এলে, তুমি পড়ে নিতে পারো আমাদের শুরুটা।”

ঋদ্ধির চিঠি:

“আকাশ,
তুমি শুধু একজন চিঠির মানুষ ছিলে না, তুমি আমার নীরবতা ছিলে।
আমি জানি, একদিন আমাদের কথা কমে যাবে — দায়িত্বে, বাস্তবতায় হারিয়ে যাবে।
কিন্তু আমি প্রতিদিন অন্তত একবার তোমার নামের আগে ‘আমার’ শব্দটা বসিয়ে ভাবব — আর মনে করব, ‘আমার আকাশ’ তখনও আছে।”

পর্ব ২৫: (নতুন ঠিকানা — একই নামে)।

বিয়ের দিন।
ঋদ্ধি লাল বেনারসি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
আকাশ আশীর্বাদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে, চোখে জল।
পান্ডেল জুড়ে সবাই জানে — এই বিয়ে শুধু দুটি মানুষ নয়,
দুইটি আত্মা — যারা চিঠির অক্ষরে ভালোবেসেছিল।
বিয়ের পর প্রথম রাত।
আকাশ ঋদ্ধির হাতে একটা খাম দেয়।
ঋদ্ধি অবাক হয়ে বলে,
— “আবার চিঠি?”
আকাশ হাসে,
— “এটাই শেষ নয়।
এখন থেকে প্রতি বছর আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে আমি তোমায় একটা চিঠি লিখব…
ঠিক যেমন আমাদের শুরু হয়েছিল।”
ঋদ্ধি খামটা খোলে।
সেখানে লেখা ছিল —

“আমার নতুন ঠিকানা:
ঋদ্ধির হৃদয়ের ভেতরে,
চিরকাল আকাশ।”

✅ সমাপ্তি

চিঠিতে লেখা প্রেম —
একটি কাগজে আঁকা ভালোবাসা, যা কালজয়ী।

Share This