Categories
গল্প প্রবন্ধ রিভিউ

ভ্রমণ শব্দটির উৎস ও ইতিহাস – একটি বিশেষ পর্যালোচনা।

ভ্রমণ শব্দটির উৎস ইতিহাসের কালে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে । ভ্রমণ বা ট্রাভেল শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে আদি ফরাসি শব্দ travail থেকে । ফরাসি শব্দ travail  অর্থ শ্রম, পরিশ্রম, (labor, toil, ) ইত্যাদি । আবার travailler অর্থ হচ্ছে কাজ, পরিশ্রম, শ্রম, যন্ত্রণা, কষ্ট,  (Work, labor, toil, suffering from painful efforts, troubles, ) ইত্যাদি । অনেকের মতে প্রাচীনকালে ভ্রমণ ছিল ভীষণ কষ্টকর । তাই travailler  শব্দটা কষ্টকর জ্ঞাতার্থে ব্যবহৃত হতে পারে ।  তবে বর্তমান ডিজিটাল যুগের কষ্টকর  ভ্রমণ নির্ভর করছে  গন্তব্যস্থলের উপর । যেমন মাউন্ট এভারেস্টে ভ্রমণ ঝুঁকির ও কষ্টের ।
এবার আসছি, ভ্রমণ বলতে আমরা কী বুঝি ?  ভ্রমণের ব্যবহারিক অর্থ নানানরকম । যেমন প্রাতকালীন ভ্রমণ, বৈকালিন ভ্রমণ, নদীর পারে ভ্রমণ, জ্যেৎস্নার আলোয় ভ্রমণ, ট্রেনে-বাসে-উড়োজাহাজে-জলযানে ভ্রমণ, ইত্যাদি । যদি ভ্রমণের মাধ্যম ধরি তাহলে ভ্রমণ হতে পারে হাঁটা, কিংবা সাইক্লিং’এর মাধ্যমে  অথবা গাড়িতে যেমন পাবলিক পরিবহন, প্রাইভেট গাড়ি, রেল এবং বিমান ।   আক্ষরিক অর্থে আমরা যেটা বুঝি ভ্রমণ অর্থ বেড়ানো, ঘোরাঘুরি, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া, অর্থাৎ পর্যটন করা । অন্য অর্থে দেশ ভ্রমণ । এছাড়া ভ্রমণ অর্থ যেটা বুঝি, সেটা হচ্ছে চিত্তবিনোদন, পর্যটন ও অবকাশ যাপন ।  ভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহত্তের আহ্বান । আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ । অচেনার সান্নিধ্য মানুষ পায় বিষ্ময়ের শিহরণ । তাই ভ্রমণ শুধুমাত্র দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিদেশ ভ্রমণও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য । তবে এটাও ঘটনা, মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আবশ্যিক দিক নিজের দেশকে জানবার, বোঝবার, দেখার । কিছু মানুষ তথ্য জোগাড়ের জন্য গবেষণা ভ্রমণও করেন । নিজের জন্মস্থানের গাঁ-গঞ্জ-শহর-নগর থেকে বেরিয়ে দেশের ও বিদেশের দ্রষ্টব্য স্থানের ভৌগলিক অবস্থান, তার ইতিহাস, রাজনীতি বা তার নৃতত্ত্ব  জানাটা ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য ।  তা ছাড়া দিনের পর দিন একই পরিবেশের জীবন যাপন থেকে ক্ষণিকের মুক্তি । একটু বৈচিত্র্যের আস্বাদনের উপলব্ধি, যে বৈচিত্র্য আমাদের দেয় অপরিসীম আনন্দ ।
যদি নিজের দেশ ভারতবর্ষকেই ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে, একই দেশে বাস করা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারভেদ । নানান ধর্ম, নানান জাতির মানুষের বসবাস । বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন বর্ণের মানুষ । প্রত্যেকের জাতিসত্বা, ভাষার প্রয়োগ, ধর্মের আচরণ, এমনকি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা আলাদা । যার জন্য ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের ভ্রমণের মাধ্যমে দেশকে চেনার, দেশের মানুষদের জানবার আকাঙ্খা প্রবল । দেশের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে নানাবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও নতুন-নতুন জ্ঞান আহরণ সম্ভব । বিচিত্র আমাদের দেশ এবং বিচিত্র তার অধিবাসী । আরও বিচিত্র তাদের সাংস্কৃতিক জীবন যাপন এবং সামাজিক রীতিনীতি । আমদের দেশে কতো অরণ্য, সমুদ্র, পাহাড়, পর্বত । নিসর্গ প্রকৃতির কতো অফুরান বৈভব, কতো  পশু-পাখী, জীবজন্তু । ভ্রমণের মাধ্যমে সেগুলির পূর্ণভাবে উপলব্ধি ঘটে । এখানে বলা যেতে পারে, ভ্রমণ অন্য কথায় শিক্ষার একটি অঙ্গ ।
ভ্রমণের পরিধি নির্ধারণে অবশ্যই আর্থিক সঙ্গতির প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য । ভারতবর্ষ আমাদের উন্নয়নশীল দেশ । এখানে মাথাপিছু আয় প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম । ফলে মানুষের যতোটুকু আয় প্রায় ততোটুকুই সংসার নির্বাহের জন্য নিঃশেষিত হয়ে যায় । যার জন্য সংসার বাঁচিয়ে উদবৃত্তের পরিমাণ ভীষণ স্বল্প । তবুও ভ্রমণ পিপাসু মানুষ সংসারের  খরচা বাঁচিয়ে  ঐ নগণ্য আয় থেকে ভ্রমণের জন্য জমিয়ে রাখে । অভিজ্ঞতার নিরিখে এটা পরিস্কার, চাকুরিজীবিদের মধ্যে ভ্রমণের নেশা তুলনামূলকভাবে বেশী । ভ্রমণের প্রতি তাঁরা বেশী সংবেদনশীল । দেখা গেছে চাকুরিজীবি মানুষ একনাগাড়ে ছয় মাস অফিস করলে হাঁফিয়ে ওঠেন । তখন তাঁদের শরীর-মন ক্ষণিকের জন্য একঘেয়েমি জীবনের অবসান ঘটানোর নিরিখে কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে  ভরা স্থানে নিরিবিলিতে সময় কাটাতে চান । সামর্থ অনুযায়ী তখন ব্যস্ততম কর্মজীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য নিবৃত্তি । মুক্তির আস্বাদনের তাগিদে তাঁদের ভ্রমণ ।
ভ্রমণের  ক্ষেত্রে শারীরিক সুস্থতা ভীষণ জরুরি । আবার অনেকে ডাক্তারী পরামর্শ মতো হাওয়া বদলের জন্য ছোটেন । খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ বিশ্রাম নিতে বেড়ানোর দ্রষ্টব্যস্থানে বেড়াতে যান ।  কিছু ভ্রমণ পিপাসু মানুষের ধারণা, ভ্রমণের মাধ্যমে তাঁদের শরীরে তাজা অক্সিজেন ঢোকে । এইজন্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, রাজনীতিবিদ, বরিষ্ঠ নাগরিক, ইত্যাদি পেশার মানুষ সাময়িক বিশ্রামের তাগিদে বিভিন্ন দ্রষ্টব্যস্থানে ভ্রমণ করেন । সুতরাং ভ্রমণের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে দেখা যায়, ভ্রমণ শুধুমাত্র চিত্ত বিনোদনের জন্য নয় । ভ্রমণ মানুষের মধ্যে সংঘটিত হয় বিভিন্ন প্রয়োজনে । এছাড়াও শিক্ষামূলক ভ্রমণ, ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভ্রমণ, রোগ চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ, ধর্মীয়-ভ্রমণ,  সর্বজনবিদিত ।
ভ্রমণের স্থান, কাল, ইত্যাদির ব্যাপারে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের নিজস্ব চিন্তাভাবনাটা অগ্রগণ্য । কিছু মানুষের হিল  স্টেশনে ভ্রমণের প্রতি দুর্বলতা । তাই তাঁরা বিভিন্ন হিল এলাকা ভ্রমণের জন্য বেছে নেন । যেমন দার্জিলিং, সিমলা, উটি, কাশ্মীরের পহেল গাঁও-সোনমার্গ-গুলমার্গ, লে-লাদাখ,  মাউন্ট আবু,  কোহিমা, ইত্যাদি । শোনা যায়, হিল স্টেশনে বেড়ানোর আর একটা মজা সেটা হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । সমতলভূমি থেকে পাহাড়ে উঠবার সময় রাস্তার দুধারে প্রকৃতির অকৃত্রিম সবুজের ভাণ্ডার । বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছালির অফুরন্ত সমারোহ । যা দেখলে চোখ সরানো দায় ! তার উপর এক পশলা বৃষ্টি হলে রাস্তার দুইধারে বৃষ্টি স্নাত গাছ-গাছালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মনোমুগ্ধকর । পাহাড়ী এলাকাতে প্রাকৃতিক সমারোহের প্রাচুর্য এত থাকলে কী হবে, সেখানকার মানুষের দৈণ্যদশা প্রকট । তাঁদের  অর্থনৈতিক অবস্থা তথৈ-ব-চ । শোচনীয় তাঁদের দৈনন্দিন জীবন যাপন । ক্ষেতি জমিতে ফসল উৎপাদনের হালহকিকৎ দুঃখজনক । যার জন্য তাঁরা পর্যটকের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল । প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ পর্যটন ব্যবসার উপর নির্ভরশীল । কিছু কিছু পাহাড়ী এলাকায় পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম ।   উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকা যেমন কোহিমা, ইম্ফল, আইজল, ইত্যাদি । অথচ এইসব হিল স্টেশনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোনো অংশে কম নয় । ভ্রমণ পিপাসু মানুষের সংখ্যা ঐ সমস্ত এলাকায় বেশী মাত্রায় ভিড় করলে এলাকার জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়তো । সুতরাং ভ্রমণের  ক্ষেত্রে দ্রষ্টব্যস্থান বাছাটাও  গুরুত্বপূর্ণ ।
সমুদ্র তীরবর্তী শহরে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের চেয়ে বাঙালীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো । অনেক বাঙালী সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল হিসাবে প্রথমেই পুরী’কে  বাছেন । পুরীর সমুদ্রের উদ্দেশে ভ্রমণের আরও একটি কারণ পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শন । আবার পুরীতে রয়েছে ঐতিহাসিক কোনারক যেখানে প্রচুর মানুষ ভিড় করেন । ইদানীংকালে দীঘার  সমুদ্র সৈকতে মানুষের ভিড়  নজরকাড়া । কেননা দীঘার সমুদ্রের পার আধুনিক সজ্জায় সুসজ্জিত । সরকারি দৃষ্টির সৌজন্যে  দীঘার সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ এখন ভীষণ জনপ্রিয় । ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হচ্ছে  সমুদ্রের বীচ । সমুদ্রের বীচের বালিতে পর্যটকদের হেঁটে অফুরন্ত  আনন্দ  । যার জন্য চেন্নাইয়ে ম্যারিনা বীচ, গোয়ার ক্যারাঙ্ঘুটে বীচ, মুম্বাইয়ের জুহু বীচ, কন্যাকুমারীর তিনটি সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের বীচ, ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে আজও আকর্ষণীয় । তা ছাড়া সমুদ্রের সন্নিহিত অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের বাড়-বাড়ন্ত চোখে পড়ার মতো ।
মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, দর্শন ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য । অনেক ভ্রমণার্থী  মন্দির দর্শনের পাশাপাশি মন্দিরের দেবতার পুজো দিতে উৎসাহী । ধর্মের প্রতি অনুরাগ মানুষের মধ্যে কমবেশী বিরাজিত  । সেই আকাঙ্খা থেকেই ধর্মীয় স্থানে ভ্রমণের ঈপ্সা । তা ছাড়া জানারও আকাঙ্খা প্রবল । যেমন দক্ষিণ ভারতে তিরুমালায়  মন্দির (বেঙ্কটেশ্বর), অসমে কাম্রুপ কামাক্ষার মন্দির, আজমীরে মসজিদ, কোহিমায় ক্যাথিড্রাল চার্চ, পুরীতে জগন্নাথ মন্দির, মুম্বাইতে মাতা লক্ষ্মী মন্দির, জম্মুতে কাটরায় বৈষ্ণদেবী মন্দির, ইত্যাদিতে ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা প্রবল ।
ভ্যালী এলাকায় ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছুটছেন । শিমলা থেকে কিন্নর ভ্যালী, লাদাখে নুব্রা ভ্যালী,  মানুষের কাছে আজও আকর্ষণীয় । বড় দ্বীপ বলতে মাজুলি দ্বীপ । শোনা যায় মাজলি দ্বীপ এশিয়ায় বিখ্যাত । অসমের যোরহাট থেকে মাজুলি যাওয়া সহজ । বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের (ব্রহ্মপুত্র হচ্ছে পুরুষ নদী) মধ্যেখানে মাজুলি দ্বীপ । অনেকেই ছুটছেন মাজুলি দ্বীপ ভ্রমণে । এছাড়া আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অনেকগুলি দেখার মতো দ্বীপ রয়েছে । হ্যাভলক দ্বীপ তার মধ্যে অন্যতম ।  উত্তর-পূর্ব রাজ্যে চা-বাগান উল্লেখযোগ্য । যেমন ডিব্রুগড়  জেলা  জুড়ে চা-বাগান । তা ছাড়া দার্জিলিঙের চা-বাগান বিশ্বখ্যাত । এইসব চা বাগানে মনে হয় প্রকৃতি সবুজ গালিচা পেতে রেখেছে । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে জঙ্গলের সমারোহ ।  পশ্চিম বঙ্গের জলদাপাড়ার জঙ্গল, অসমের কাজিরাঙ্গার জঙ্গল উল্লেখযোগ্য ।  কাজিরাঙ্গার জঙ্গলের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে । পশু, পাখী, জীব-জন্তুতে ভরা । কাজিরাঙ্গা জঙ্গলে গন্ডারের বিচরণ অন্যতম ।
জানার ও দেখার স্পৃহার শেষ নেই । সেটা রাঁচীর পাগলা গারদ হোক বা কারগিলের যুদ্ধস্থান হোক বা অমৃতস্বরের স্বর্ণমন্দির হোক । ভ্রমণ পিপাসু মানুষ সতত ছুটছেন তাঁদের একটানা দম-বদ্ধ জীবন থেকে সাময়িক মুক্তির খোঁজে ।
মানুষের মধ্যে ভ্রমণের সময় নির্ধারণ করা বড্ড কঠিন । পরীক্ষা বা পড়াশুনার ব্যস্ত সময়ে ভ্রমণের ইচ্ছা প্রসমিত থাকে  । তেমনি চাষীদের চাষের মরশুম, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ধামাকার সময় যেমন দুর্গা  পুজা, ইত্যাদির সময়, চাকুরিজীবিদের চাকরিস্থলে ছুটি গ্রান্ট না হলে, ভ্রমণের ইচ্ছা নৈব-নৈব-চ । এত কিছুর মধ্যও ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ভ্রমণের তাগিদে দেশ বিদেশ ছুটছেন । কেননা ভ্রমণ মানুষকে সতেজ  ও  প্রফুল্ল রাখে  ।

 

।।কলমে : দিলীপ রয়।।

 

(তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাদেবের স্বপ্নাদেশেই ১০৮ টি শিব মন্দির তৈরি করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রইল শিবনিবাসের অজানা তথ্য।

শিবনিবাস বাংলার ইতিহাস খ্যাত ও পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এক প্রাচীন স্থান। পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার শিবনিবাসকে বাংলার কাশী বলা হয়। দেবাদিদেব শিব মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের স্বপ্নে হাজির হয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মে মহা শিবরাত্রির মাহাত্ম্য অনেক। পুণ্যার্থীরা শিবের জন্যে ব্রত পালন করেন। দিনভর চলে নানা ধর্মীয় রীতি পালন। এমনকি অনেক জায়গায় শিবরাত্রি উপলক্ষে নানা মেলাও হয়। মন্দিরে তো বটেই, বাড়িতে বাড়িতেও পুজো হয় মহাদেবের। ‘হড় হড় মহাদেব’ উচ্চারণ করে তারকেশ্বর দেশের ভিন্ন প্রান্তে বাবার মাথায় জল ঢালতে ভক্তদের সমাগম হয়। প্রায় এক মাস আগে থেকে চলে প্রস্তুতি। শিবরাত্রির আগে, রইল পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলায় অবস্থিত ‘শিবনিবাস’ এর অজানা নানা কথা।শিবনিবাস বাংলার ইতিহাস খ্যাত ও পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এক প্রাচীন স্থান। পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার শিবনিবাসকে বাংলার কাশী বলা হয়। যদি এক্ষেত্রে কাশীর মতো গঙ্গা নদী বয়ে যায়নি। তবে এখানে এই মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চুর্ণী নদী। জনশ্রুতি আছে যে, দেবাদিদেব শিব মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নে হাজির হয়েছিলেন। তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি কাশি থেকে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করছেন। তাই মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে মহারাজা শিবনিবাসে তাঁর নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর সম্মানে ১০৮ টি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

তবে ইতিহাসবিদরা আরও কিছু যুক্তি দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, আঠারো শতকের মাঝামাঝি মহারাজা আক্রমণকারী মারাঠাদের হাত থেকে তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরকে বাঁচানোর জন্য এটিকে শিবনিবাসে স্থানান্তরিত করেন, যা চূর্ণী নদীর তীরে ঘিরে ছিল। ফলে আক্রমণকারীদের কাছ থেকে তিনি কিছুটা সুরক্ষিত থাকতেন। তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরে মহারাজা সম্ভবত এই জায়গাটির নাম ‘শিবনিবাস’-এ নামকরণ করেন। লোকেদের বিশ্বাস, এটি মহাদেব নিজেই করেছেন। আবার অনেকে বলেন, এই নামটি তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রের নামে রাখা হয়েছিল।মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭২৮-১৭৮২) বাংলায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল। তাঁর জ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি তাঁকে বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি অনন্য স্থান দিয়েছে। তাঁর নবরত্ন (নয়টি রত্ন) সভা এখনও বাংলার সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মন্দিরের ছাদ ধালু এবং গম্বুজ রয়েছে।তিহ্যবাহী বাঙালি কাঠামো অনুসরণ করে না।

এই মন্দিরে যেমন আছে পোড়ামাটি কাজ, তেমন ইসলামিক ও গথিক কাজও দৃশ্যমান। এখানের সবচেয়ে বড় শিব মন্দিরটি বুড়ো শিব নামে পরিচিত। চূড়া সমেত মন্দিরের উচ্চতা ১২০ ফুট। মন্দিরের ভেতরের শিবলিঙ্গের পূর্ব ভারতের সবচেয়ে উচ্চতম শিবলিঙ্গটি রয়েছে। শিবনিবাসের এখন যেই মন্দিরগুলো রয়েছে তার রয়েছে বিভিন্ন নাম। যেমন – রাজ রাজেশ্বর মন্দির, রগনিশ্বর মন্দির, রাম-সীতা মন্দির, বুড়ো শিব মন্দির।

যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে এখানে ১০৮ টির মধ্যে মাত্র তিনটি মন্দির রয়েছে। যার মধ্যে একটিতে পূর্ব ভারতের বৃহত্তম শিব লিঙ্গ রয়েছে। তাছাড়া এখানের রাম সীতা মন্দিরের সঙ্গে রয়েছে আরও দুটি শিব মন্দির এবং কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ শিবনিবাসের গৌরবময় অতীতের অবশিষ্টাংশ।

।। নদীয়া।।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

হারিয়ে যাওয়া নব্বইয়ের শৈশব ও ডিসেম্বরের দিনগুলো : বব চৌধুরী।

শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে মধুর সময়। শৈশবকালে মাথায় চেপে বসে থাকে না কোনো চিন্তাভাবনা; শুধু খুশি, আনন্দ আর হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে সমগ্র ছোটবেলা কখন অতিবাহিত হয়ে কৈশোর পেরিয়ে আমরা যৌবনে প্রবেশ করি, তা বুঝতে পারি না। বুঝতে যখন পারি, তখন সেই সারল্যমাখা দিনগুলো হারিয়ে গেছে মহাকালের গভীরে।
শৈশবের একেকটা দিন আমাদের জীবনে একেকটা জাদুঘর হয়ে থাকে যে জাদুঘরে জমে থাকে হাজারো স্মৃতি।
সন্ধ্যা হতেই ঘরে ফিরে পড়তে বসা, হারিকেনের আলোতে অথবা কুপি জ্বালিয়ে রাতে একসঙ্গে মেঝে বসে খাবার খাওয়া। শৈশবের সেই নানুবাড়ির দিনগুলো; সেই ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা, এক টাকা ও দুই টাকার গল্প; সেই শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে খেজুরের রস খাওয়া সেই লুকোচুরি খেলা।🧡 দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকতাম কেউ এলে চমকে দেব বলে। সে আসতে দেরি করছে বলে অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে আসতাম পূর্ণিমার রাতে চাঁদের সঙ্গে হাঁটতাম আর বলতাম, চাঁদও আমাদের সঙ্গে হাঁটছে। স্কুলে যাওয়ার সময় সবাই একসঙ্গে দৌড়ে যেতাম। ক্লাসে কলম–কলম খেলা, খাতায় ক্রিকেট খেলা, চোর-ডাকাত-বাবু-পুলিশ খেলা। এক টাকার রঙিন বা নারকেলি আইসক্রিম, চার পিস চকলেট, হাওয়াই মিঠাই খেতে না পারলে মন খারাপ হয়ে যেত। হঠাৎ আকাশপথে হেলিকপ্টার গেলে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। শুক্রবার সন্ধ্যার পর আলিফ লায়লা, সিন্দবাদ, রবিনহুড ও ম্যাকগাইভার দেখার জন্য পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করা। ফলের বিচি খেয়ে ফেললে দুশ্চিন্তা করতাম, পেটের ভেতর গাছ হবে কি না; মাথায় মাথায় ধাক্কা লাগলে শিং গজানোর ভয়ে আবার নিজের ইচ্ছায় ধাক্কা দিতাম; আমাদের কারও দাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্তে দাঁতটা দিয়ে আসতাম, নাহলে আমাদের দাঁত গজাবে না। কেউ বসে থাকলে তার মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁপ দিতাম, যাতে সে আর লম্বা হতে না পারে। বিকেলে কুতকুত, কানামাছি ও গোল্লাছুট না খেললে বিকেলটা যেন মাটি হয়ে যেত।মারবেল, লুডু না খেললে কি হয়!রাতে ঘরের কোণে বাঁশবাগানে অথবা আমগাছের ডালে বসে থাকা হুতোম প্যাঁচার ডাক যেন এখনো কানে ভেসে ওঠে। আহা, ডাক শুনে ভয়ে কতই–না মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যেতাম॥ কি করে ভুলে যাই সেই ডিসেম্বর মাসের কথা॥ এ ছাড়া সঙ্গে ছিল আমাদের কালার ফুল ডিসেম্বর যে ডিসেম্বর পাওয়ার আশায় আমাদের অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘ ১১ মাস। বার্ষিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হতো আমাদের ডিসেম্বর। বার্ষিক পরীক্ষার শেষ দিন আমরা ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিল না কোনো জীবনের চাওয়া, না পাওয়ার হিসাব ছিল না কোনো পিছুটান। দুরন্তপনায় ছুটতাম ডিসেম্বরের শেষের দিনগুলো; হিসাব ছিল শুধু একটাই, বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আর জানুয়ারির ১ তারিখে নতুন বইয়ের ছোঁয়া পাওয়ার।
পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতেই দৌড় দিতাম খেলার মাঠে; কোদাল, পিঁড়ি, কাঠি নিয়ে উইকেট বানাতাম। সবার কাছ থেকে টাকা তুলে বল আর স্কচটেপ কিনতাম। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, খেলার মধ্যেই ডুবে থাকতাম। কখনো ভাত খেতে দুপুরে বাড়িতে যাওয়া হতো, কখনো যাওয়া হতো না।সন্ধ্যার পর আবার আমরা বেরিয়ে পড়তাম। তীব্র শীতে রাত জেগে আগুনের পাশে বসে মা-চাচিদের ধান সেদ্ধ করা দেখা এক অন্যরকম অনুভূতি। চারদিকে খড়ের স্তূপ আর তার মধ্যে লুকোচুরি খেলা ছিল অন্যতম। কখনো কখনো কম্বলের নিচে লুকিয়ে গল্পের বই পড়া হতো। আবার কখনো খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাতাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন, গোল্লাছুট, বউচি খেলে ঘরে ফিরতে হতো। একটু দেরি হলে বকা শুনতাম।আমাদের সেই ডিসেম্বরের দিনগুলো এখন হারিয়ে গেছে। এখন ডিসেম্বরেও ক্লাস থাকে, পরীক্ষা থাকে, থাকে অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের ডেডলাইন, থাকে অফিস। জীবনের প্রয়োজনে ব্যস্ত হয়েছে সবাই। এখন আমাদের ডিসেম্বরের সকালগুলো কাটে ঘুমে, ক্লাসে অথবা অফিসে। এখন আর ঘুম থেকে উঠে আমরা আম্মুর হাতের শীতকালীন পিঠা খেতে পারি না এমনকি এখন সকালে উঠে আম্মুকে দেখি না। বিকেলগুলোতে আমরা আগের মতো মাঠে যেতে পারি না, যেতে হয় প্রাইভেটে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আমরা চার দেয়ালে কাটিয়ে দিই। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা, ছুটছি তো ছুটছি।
সময়ের পরিক্রমায় পার হয়ে গেছে আমাদের শৈশব। ব্যস্ততা বেড়েছে গ্রাম এখন নগরায়ণ হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে হারিয়ে গেছে সেই আলোবিহীন শৈশব, হারিয়ে গেছে সেই ডিসেম্বরের দিনগুলো! এখনকার প্রজন্মের কাছে নব্বইয়ের শৈশব হয়তো রূপকথার গল্প মনে হবে। সেই দিনগুলি আমাদের পাড়ার বন্ধু গুলো এক সঙ্গে অনেক সবাই কাটিয়েছে কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই তাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই কোথায় কে হারিয়ে গেছে কেউ জানে না॥ হয়তো কেউ কোনো একদিন কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে ডিসেম্বরের কোনো এক বিকেলে অফিসের বারান্দায় বসে কফির চুমুতে লেখাটি পড়তে পড়তে হারিয়ে যাবে তার সেই ছেলেবেলায়, সেই হারিয়ে যাওয়া।শৈশবে সে মুহূর্তে নস্টালজিক হয়ে হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুটি লাইন আক্ষেপে বলে উঠব দিন গুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। আমরা প্রায় সকলেই একমত যে ছাত্রজীবন বা স্কুল লাইফ হল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সাংসারিক জটিলতাও জীবনের বাস্তবিক খুঁটিনাটি থেকে চিন্তামুক্ত চিত্ত এই ছাত্রজীবন । স্নিগ্ধ বাতাসের মতোই নির্মল এই ছাত্রর জীবন।স্কুল লাইফ বা ছাত্রজীবনে কাটানো সময়গুলো তাই প্রায় অধিকাংশ মানুষের কাছেই সবথেকে আনন্দঘন মুহূর্ত সময় সাথে সাথেচাস্ত ভাই মামাতো ফুপাতো ভাই সবাই যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাইকে যার যার নিজ নিজ সাংসারিক জীবন নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে তবে এখনকার জীবনটা অনেক ভিন্ন রকম কিছু স্কুলের বন্ধু এখনো বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে তার মধ্যে দুজনের নাম স্মরণ করতে পারি একজন হল আবুল হোসেন এর জন্য শহিদুল ইসলাম এখনো আমার সাথে তাদের যোগাযোগ আছে প্রতিনিয়ত কথা হয় আবুলের সাথে বছর কয়েকের মধ্যে কয়েকবার দেখা হয়েছে কিন্তু ছোট শহিদুল ইসলামের সাথে দেখা হয়নি। লেখাটি শেষ করব হেমন্ত দার গানের দুটো লাইন দিয়ে ভাবছিলাম শুধু ভাবছিলাম ভাবনার হাতে ভর দিয়ে ভাবনা গুলো কাছে নিয়ে আমি ভাবছিলাম শুধু ভাবছিলাম॥

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

সন্ন্যাসী সেইন্ট নিকোলাসের বড়দিনের সান্টা হয়ে ওঠার গল্প : সৌগত রাণা কবিয়াল।।।

চোখের সামনে একটি রক্তাক্ত ক্রুশবিদ্ধ মানুষের নিথর শরীর এড়িয়ে এক পবিত্রময় আলোর প্রশান্তি, সেই দুঃখী মানুষটির মুখ জুড়ে! শান্ত স্থীর মোমবাতির আলোয় সমস্বরে প্রার্থনা সুর, অদ্ভুত এক মায়াজালের মতো সুখ ছড়াতো মনে!
চারিদিকে ঝকঝকে ব্যস্ত পথ- পথের মানুষ.. সব ঠেলেঠুলে পাড়ার স্কুল গীর্জায় চুপচাপ ঢুকে যেতাম প্রার্থনা গৃহে!
পুরোনো শহরের ৪৭ নম্বর বাড়িটিতে যখন আমার ছেলেবেলা, বলতে গেলে ষোলআনা বাঙালি পরিবারে বেড়ে  আমার উৎসুক শিশু চোখে তখন ‘বড়দিন’ মানে একটি বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন! আমাদের পাশাপাশি কিছু খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী পরিবারের উৎসব উৎযাপনটা তখন আমার শিশুমনে বেশ আকর্ষণীয় ও লোভনীয় মনে হতো!  সারাবছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম, সকাল হলেই স্কুল ছুটির দিনে মজার মজার বাহারী কেক-মিষ্টি-চকলেট-কমলা লেবুর জন্য। মা বলতেন, “আজ থেকে বছরে দিন বড় আর রাত ছোট হতে শুরু হলো, বুঝলি”।
দিনের এই ছোট বড় হওয়া নিয়ে তখন আমার তেমন কোন মাথা ব্যথা ছিলো না, যতোটা ছিলো সন্ধ্যে হলে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীর সমস্বরে প্রার্থনা গান নিয়ে। বিশাল বাড়িটাতে আমরা সব শিশুরা মিলে বারান্দার গ্রিল ধরে ভিড় করে নিচের পাকা দূয়ারে মুগ্ধ হয়ে গান শুনতাম। সব মিলিয়ে “বড়দিন” ব্যাপারটাই ছিলো অসাধারণ এক আনন্দের। আমার কাছে কোথায় যেন “বড়দিন” কে মনে হতো পৃথিবীর সব মানুষের মন ভালোর দিন।

প্রায় দুহাজার বছর আগে রোমীয় সম্রাটের আদেশে নাসরত শহর থেকে পরিপূর্ণ বেথলেহেম শহরে গিয়ে আশ্রয়হীন হলেন এক দম্পতি, কাঠুরে যোসেফ আর তার স্ত্রী মেরি । যাত্রার মাঝপথেই এক গোয়ালঘরে মাতা মেরীর প্রথম সন্তান হিসেবে জন্ম নিলেন বিশ্বে শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে
খ্রিষ্ট ধর্মের প্রবর্তক, ইতিহাসে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ নামে খ্যাত ভগবান ‘যিশু খ্রিষ্ট’!
যাকে জন্মক্ষণে পান্থশালায় স্থান না পেয়ে যাবপাত্রে শুইয়ে রেখেছিলেন তার মাতা মেরি! ভগবান যিশুর জন্ম-সংক্রান্ত প্রথম দিকের চিত্রগুলিতে গবাদি পশু ও যাবপাত্র পরিবৃত একটি গুহায় যিশুর জন্মদৃশ্য বহুল প্রচলিত।
ধারণা অনুযায়ী, এটি বেথলেহেমের চার্চ অফ দ্য নেটিভিটির অভ্যন্তরে। কথিত যে এক স্বর্গদূত বেথলেহেমের চারিপার্শ্বস্থ মাঠের মেষপালকদের যিশুর জন্ম সম্বন্ধে অবহিত করেন, এই কারণে তাঁরাই সেই দিব্য শিশুকে প্রথম দর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেন!
মথিলিখিত সুসমাচার অনুসারে,
‘বেথলেহেমের তারা’ নামে পরিচিত একটি রহস্যময় তারা কয়েকজন ম্যাজাইকে (জ্যোতিষী) পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন শিশু যিশুর কাছে, যারা স্বর্ণ, গন্ধতৈল ও ধূপ নিয়ে ঈশ্বরের পুত্রকে দর্শন করতে যান।

ক্রিসমাস অলঙ্কারে ক্রিসমাস ট্রি (পাইন গাছ) বড়দিনের ঘর সাজানো বড়দিনের উৎসবকে পূর্ণতাএনে দেয়। পাশাপাশি
আলোর মোমবাতি যা কিনা মানুষের কাছে প্রেম, প্রার্থনা, আবেগের প্রতীক! বড়দিনের দিন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে মোমবাতি  ‘খ্রীষ্টের আলো’ হিসাবে পবিত্র । আগের রাতে নানান রংচঙয়ে ছোট ছড়া বাতি দিয়ে সাজানো ক্রিস্টমাস ট্রি, ছোট ছোট ক্রিসমাস বেল দিয়ে সাজানো হয়,  এই ঘণ্টাটি আভাস দেয় “বড়দিন” এসে গেছে।
বড়দিনে সান্টার লাল টুপি আজকের শিশুদের খুব মন-প্রিয়।
আজকের আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বেও ‘বড়দিন’ প্রকৃতিগতভাবে একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, একাধিক অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মহাসমারোহে উৎসবটি পালন করে থাকে! উপহার প্রদান, সংগীত, বড়দিনের কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ, এবং বড়দিনের বৃক্ষ, আলোকসজ্জা, মালা, মিসলটো, যিশুর জন্মদৃশ্য, এবং হলি সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে আমাদের শহরে বড়দিন উৎসব উৎযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ যা কিনা বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দিনের অর্থনৈতিক প্রভাবটিকে ধীরে ধীরে প্রসারিত করেছে ।

ইতিহাস বিখ্যাত চিত্রশিল্পে যিশুর জন্মদৃশ্যটিতে মেরি, জোসেফ, শিশু যিশু, স্বর্গদূত, মেষপালক এবং যিশুর জন্মের পর বেথলেহেমের তারার সাহায্যে পথ চিনে তাঁকে দর্শন করতে আসা বালথাজার, মেলকোয়ার ও ক্যাসপার নামক তিন জ্ঞানী ব্যক্তির চরিত্র দেখা যায়।

পৃথিবীতে এসে মানুষের প্রতি এক অদ্ভুত ভালোবাসার দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই ভগবান যিশুর আগমন হয়েছিল !

আর বড়দিন বলতে ঈশ্বরের পুত্র ভগবান যিশুর পাশাপাশি আজকের পৃথিবীতে আরেকটি বহুল জনপ্রিয়  চরিত্র “সান্টা দাদু”!

ছোটোদের বড়দিন মানেই  সান্টাক্লজ(সান্টা দাদু), যার কাঁধে থাকে ঝোলা ভর্তি ব্যাগ, পরনে লাল রঙের পোশাকের পাশাপাশি মাথায় লাল টুপি, চোখে চশমা ও এক গাল সাদা দাঁড়ি । যিনি ছিলেন  তুরস্কের পাতারা নামক অঞ্চলে জন্ম নেয়া সেইন্ট নিকোলাস নামের একজন সন্ন্যাসী, শিশুদের প্রতি পবিত্রতা ও উদারতার জন্য তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন ।
২৪ শে ডিসেম্বর গভীর রাতে থলে ভর্তি করে উপহার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সান্টার দাদুর কাছ থেকে চকলেট ও উপহার যেন বাচ্চাদের জন্য দারুণ আনন্দের দিন…! আগের দিন রাতে বিছানায় ঘুমোতে যাওয়ার আগে দাদু সান্টার কাছে কি কি চাইবার চেয়ে টুপ করে ঘুমিয়ে পরে সকালে সেই গিফটের জন্য অপেক্ষা করা!
খ্রিষ্টীয় ধর্মের অন্তর্গত না হলেও সান্টা নামটি খুব গুরুত্বপূর্ণ “বড়দিন” এর উৎসবের সাথে!
২৪ শে ডিসেম্বর গভীর রাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের উপহার দেওয়ার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন ।
সান্টাকে নিয়ে বাচ্চাদের মনে মাতামাতির শেষ নেই । সান্টার বসবাস বরফে ঢাকা উত্তর মেরুতে!
১৮৮১ সালে থামস নামে একজন আমেরিকান কার্টুনিস্টের আঁকা ছবিতে ক্রিসমাসের সন্ধ্যাবেলায় নর্থ পোল থেকে আটটি বলগা  হরিণ টানা স্লেজ গাড়িতে আকাশে চড়ে বাচ্চাদের বাড়ির চিমনি দিয়ে ঢুকে উপহার রেখে যেতেন সান্টা দাদু..!

পৃথিবীতে ভালোবাসার কথা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইতিহাসের পাতায় কোন চরিত্রে সংখ্যার সীমাবদ্ধতা নেই।
একজন যীশু, যিনি তার যন্ত্রণাময় মৃত্যুতেও তার হত্যাকারীদের মানবিক ভালোবাসার কথা অকপটে বলে গেছেন রক্তাক্ত আহত ঠোঁটে…!
আরেকজন সাধারণ মানুষ সন্ন্যাসী
সেইন্ট নিকোলাস (সান্টা দাদু), মানুষের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও শিশুদের পবিত্রতায় মানুষকে ভেদাভেদহীন ভালোবাসার বাঁধনের কথা রেখে গেছেন ইতিহাসের পাতায়।

আসলে সেইন্ট নিকোলাস (সান্টা দাদু) – কিংবা ঈশ্বর পুত্র যিশু…..

সব মিলিয়ে “বড়দিন” শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীর উৎসব নয়, এটি একটি ভালোবাসার দিনের গল্প..একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার গল্প।

সবাইকে বড়দিনে শুভেচ্ছা। ভালোবাসাই হোক পৃথিবীর একমাত্র অনুশাসন।

সৌগত রাণা কবিয়াল
(কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট)

Share This
Categories
উপন্যাস গল্প

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, অষ্টাদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

সেই আলাপ ঘনীভূত হলো । সম্পর্কের স্থায়ীকরণে বাদ সাধলো প্রদীপ্তের পরিবার । প্রদীপ্তের বাবার একটাই কথা, “তিনি কোনো অ-ব্রাহ্মণ মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন না ।“ পুবালী পড়ে গেলো মহা ফাঁপড়ে । বিয়ের ব্যাপারে প্রদীপ্তের বাড়ির গড়িমসি অবলোকন করে, পুবালীর বাবা তাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগলেন । পুবালীও নাছোড়বান্দা, “নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না ।“ মন ভেঙ্গে গেলো পুবালীর । কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় দিশাহারা । পুবালী বাড়িতে অথচ সব সময় দুশ্চিন্তায় মনমরা । পুবালীর দিনগুলি খুব হতাশায় কাটছিল । পারিবারিক মতবিরোধের কারণে তাদের পবিত্র দুটি জীবন ছন্নছাড়া ! দুজন একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলো ।
অন্যদিকে প্রদীপ্তের মানসিক স্থিতি তথৈবচ ! পুবালীকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণায় পুবালীর মতো সেও দিশেহারা । অমানসিক বিড়ম্বনায় মুষড়ে পড়লো প্রদীপ্ত । পুলিশের চাকরির আবেদন করলো না । বাড়িতে থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের কথা বেমালিম ভুলে গেলো । বাবার পরিষ্কার নির্দেশ, “পুবালীকে বিয়ে করলে বাড়ির মায়া তাকে ত্যাগ করতে হবে ।“ কয়েকদিন ভাত জল খাওয়া বন্ধ । মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লো । বেশ কিছুদিন পর ফন্দি আঁটতে লাগল, “অতঃপর কী করা যায় ?” তারপর গোপন সূত্রে খবর পায়, কোচবিহারের এই আশ্রমে সব সময়ের জন্য শিক্ষিত লোক দরকার । খবর পেয়ে মনে মনে প্রদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিলো, বাকী জীবন সে আশ্রমেই কাটিয়ে দেবে । আর তা ছাড়া তাকে বিরক্ত করতে কেউ খুঁজে পাবে না । খবরটি জানার পর কাউকে খবরটি শেয়ার করেনি । এমনকি পুবালীকেও জানায়নি । প্রদীপ্তের ধারণা, খবরটি পাঁচ-কান হলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেতে পারে ! তাই ইচ্ছাকৃত কাউকে জানায়নি ।
একদিন খুব ভোরে সকলের অগোচরে প্রদীপ্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা কোচবিহার ।
************************************************
তারপর কোচবিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই আশ্রমের মহারাজ । আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী, প্রদীপ্ত জীবনে কোনোদিন স্থায়ীভাবে জীবন সঙ্গিনী নিয়ে ঘর সংসার বাঁধতে পারবে না বা আশ্রমে জীবন সঙ্গিনী নিয়ে বাকী জীবন কাটাতে পারবে না । তাঁকে ঘর সংসারের চৌকাঠ মাড়ানো যাবে না । সাংসারিক জীবনের চৌহদ্দির অনেক দূরে থাকতে হবে । আশ্রমে এই রকম একটি ধরাবাঁধা জীবনের মধ্যে দিব্যি ছিল প্রদীপ্ত ! দিনগুলি ভালই কাটছিল । কিন্তু হঠাৎ পুবালীকে দেখে প্রদীপ্ত রীতিমতো অবাক ! অবাক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ পুবালীর দিকে তাকিয়ে রইলো । মুখের ভাষা বন্ধ । কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না ! মনের ভিতর তোলপাড় ! পুবালীকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন প্রদীপ্তের মনে আবার চাগাড় দিলো । এখন কী করবে ? পুবালীকে নিয়ে ঘরবাঁধার স্বপ্ন মন থেকে একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারছে না । অথচ পুবালীকে আপন মানুষের মতো কাছে টেনে নিতেও দ্বিধা-দ্বন্দ ! খুব অসহায়ের মধ্যে প্রদীপ্তের মানসিক অবস্থা !
কুহেলি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে দুজনের মাঝখানে ঢুকে পুবালীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি টিফিন খেয়ে নে । আবার বেরোতে হবে ।“
“এবার কোথায় যেতে হবে ?” জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলো পুবালী ।
“দেখা যাক । তুই তাড়াতাড়ি টিফিন খেয়ে বাইরে বেরিয়ে আয় ।“ পুবালীকে কথাটা বলে কুহেলি বাইরে বেরিয়ে যাবে এমন সময় প্রদীপ্ত বলল, “আজ আপনাদের অন্য কোথাও না গেলে বরং ভাল হয় ।“
কেন ? আশ্রমে আমাদের কোনো কাজ আছে কী ? কাজ থাকলে জানাবেন । সেই ক্ষেত্রে আমরা আর বাইরে বের হবো না ।
দরকার নেই । তবে অনেকদিন পর পুবালীর সঙ্গে দেখা হলো, তাই তার সাথে দুদণ্ড বসে কথা বলতে চাই ।
বেশ তো ! সেক্ষেত্রে পুবালী আশ্রমে থাক । আমরা বরং অন্য কাজ সেরে আসি । এখন বের না হলে খাওয়ার আগে ফিরতে পারব না ।
এই কথা শুনে পুবালী একবার প্রদীপ্তের দিকে আর একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল, “না, তা হয় না । আমিও তোমাদের সাথে যাবো ।“
পুবালীর কথা না শোনার ভান করে কুহেলি ঘর থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় । তারপর ভাবছে অতঃপর তার কী করণীয় ! ভেবেছিল বাজারের দিকে গিয়ে এলাকা সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেবে । কুহেলির পক্ষে একা একা সেটা আর হবে না । তাই নিছক পায়ে হেঁটে আশেপাশের মানুষজনের খোঁজ খবর নিতে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো । কিছুটা হাঁটার পর কুহেলির চোখে পড়লো রাস্তার পাশে একটা প্রকাণ্ড বট গাছ ! তার মনে হচ্ছে গাছটির বয়স দুই শতাধিক হবে ! বট গাছের ডাল থেকে শিকড় মাটিতে ঝুলে পড়েছে । গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সেই শিকড় ধরে ঝুলছে । বট গাছটার নীচে অনেক ছেলেমেয়ের আনাগোনা । বট গাছটার গোড়ায় বাঁশ দিয়ে বসার জায়গা । সেখানে গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বসে রয়েছেন । তাঁরা একে অপরের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত । জায়গাটার পরিবেশ দেখে কুহেলির খুব ভাল লাগলো । বট গাছ ঘিরে গ্রামের মানুষের অবসর বিনোদনের সুন্দর একটি পরিবেশ । দূরে বিশাল জলাশয় । আশপাশে চাষের জমি । বটগাছের উল্টোদিকে একটা টিউবওয়েল । সেখানে জল নিতে গ্রামের বধূদের ভিড় । কল পাড়ে দাঁড়িয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যে গোপন কথার আদান প্রদান । সংসারের কিছু কথা ব্যক্ত করার জন্য বধূরা মুখিয়ে রয়েছেন । কতক্ষণে তাঁদের কথা ব্যক্ত করবেন, তার একটা টানাপোড়েন নিজেদের মধ্যে চলে । কাখের কলসীতে জল ভড়ে গেলে নিজ নিজ গন্তব্যে তাঁরা আবার ফিরে যাচ্ছেন । দৃশ্য দেখে কুহেলির খুব ভাল লাগল । মনটায় একটা অভূতপূর্ব আনন্দ !
হঠাৎ ! হঠাৎ পেছন থেকে উস্কোখুস্কো চুল ও নোংরা ড্রেসের বয়স্ক একজন মানুষ এসে কুহেলিকে বললেন, “আপনি কী এখানে নতুন ?”
ঐরকম অদ্ভূত ধরনের মানুষ দেখে কুহেলি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো । তাই কালবিলম্ব না করে হনহন করে হেঁটে সোজা আশ্রমের দিকে । দ্রুত পায়ে হাঁটার সময় বারংবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখছে, পাগল মানুষটা তাকে অনুসরণ করছে কিনা ? একরকম হাঁপাতে হাঁপাতে গেট দিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করলো ।
কুহেলিকে হাঁপাতে দেখে মাসি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি এ্যাতো হাঁপাচ্ছো কেন বাছা ?”
“গাঁয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলাম । বটগাছ তলা যেতেই একটি পাগল মানুষ আমার দিকে বিশ্রিভাবে তাকাচ্ছিল । পাগল মানুষটাকে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে আমি সোজা আশ্রমে ফেরার রাস্তায় এসে উঠলাম । তারপর একরকম ছুটতে ছুটতে আশ্রমে ফিরে এলাম ।“ কথাগুলি বলে কুহেলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ।
মাসি কুহেলিকে ঘরে নিয়ে বসালো । চা বানিয়ে কুহেলির দিকে ধরে বললেন, “চা খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো । আমি পাগল সম্বন্ধে তোমাকে সব জানাচ্ছি । পাগলের জীবনের মর্মান্তিক কথাগুলি শুনলে তাঁর উপর তোমার হৃদয়ের মমতা জাগ্রত হতে বাধ্য ।“
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে নড়েচড়ে বসলো কুহেলি ।
মাসি জানালেন, “পাগল মানুষটি আসলে পাগল নয় । দীর্ঘদিন নাওয়া-খাওয়া না হওয়ার দরুন চেহারায় তার প্রভাব পড়েছে । কিন্তু তিনি একজন সজ্জন মানুষ । শোনা যায়, বাড়িতে নিজের স্ত্রী তাঁকে ঠকিয়ে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে লোক দিয়ে তাড়িয়ে দেয় । এই মহিলার প্রেমে পাগল হয়ে নাকি ভদ্রলোক আগের স্ত্রী-সন্তানদের ত্যাগ করে কোচবিহারে পালিয়ে আসেন এবং এই মহিলার সাথে ঘর বাঁধেন । এই স্ত্রীর বোন কোচবিহার
এলাকার ডানপিটে মহিলা । তার প্ররোচনায় ভদ্রলোকের বর্তমান বৌ দিনরাত তাঁকে জ্বালাতন করতো । মানসিক যন্ত্রণা দিতো । বৌয়ের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে একসঙ্গে বাঁচার আশা নিরাশায় পরিণত হয় । তাই লজ্জায় বাড়ি ফিরে না গিয়ে, এই গাঁয়ের বটগাছ তলায় আশ্রয় নেয় । গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে কাজকর্ম করে । খড়ের ঘরের ছাউনী বাঁধে । কারও জমিতে কাজ করে । তবে তাঁর সততা দেখে গ্রামের মানুষেরা ভদ্রলোককে গ্রামের শেষ মাথায় এক ফালি বসত বাড়ির জমি ঠিক করে দিয়েছে । ঘর বানিয়ে তিনি এই গ্রামে পাকাপাকিভাবে বাস করতে চান । যতদিন ঘর বানানো সম্ভব হচ্ছে, ততদিন এই বটগাছ তলায় কাটিয়ে দিতে চান ।
ভদ্রলোকের বর্তমান স্থিতির কথা শুনে কুহেলির চোখে জল । ঠিক সেই মুহূর্তে পুবালী এসে বলল, “তুমি কোথায় বের হবে, বলছিলে ?”
এইমাত্র গ্রাম থেকে ঘুরে এলাম । একটু পরে আবার বের হওয়া যাবে । আশ্রমের আশেপাশের লোকজনদের দেখা এবং এলাকা সম্বন্ধে অবগত হওয়া !
ঠিক আছে । তবে পরেই বের হওয়া যাবে ।
তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে কুহেলি ভাবলো, পাগল লোকটাকে একবার দেখে আসা যাক । যেই ভাবনা, সেই আশ্রম থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তায় । আশ্রমের মহারাজ কুহেলিকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে তার কাছে এলো এবং বলল, “এভাবে যখন খুশি আশ্রম থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না । আপনাদের পেছনে কিন্তু অজানা আগন্তুকেরা ঘোরাফেরা করতে পারে । সেক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা ! সুতরাং যখন কোথাও বের হবেন, একা একা যাবেন না প্লিজ । সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবেন । কাউকে না পেলে, আপনার বান্ধবীকে অন্তত সঙ্গে রাখবেন । তাহলেও অনেকটা নিরাপদ অনুভব করতে পারবেন ।“ বলেই মহারাজ আশ্রমে ঢুকে গেলেন ।
তবুও পাগল মানুষটাকে নিয়ে কুহেলির অহেতুক কৌতুহল থামছে না । অথচ মহারাজের কথাটা ভাববার বিষয় !
( ক্রমশ )

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ রিভিউ

২৫০ বছরের প্রাচীন মহিষাদল রাজবাড়ির পুজোয় আজও মানুষের ঢল নামে।

বর্তমান সময়ে থিমের রমরমা। মন্ডপ থেকে প্রতিমা সবেতেই থিমের ছোঁয়া। দর্শনার্থীদের ভীড় জমলেও কমেনি প্রাচীন রাজবাড়ির পুজোয় ভীড়। আগেকার সেই জৌলুস, আড়ম্বর আজ অনেক টাই কমে গিয়েছে। কিন্তু নিয়ম মেনেই প্রতিপদে ঘট স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই দুর্গাপুজো দেখতে আজও ভিড় জমান দূর দূরান্তের পাশাপাশি  স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রতিমা দর্শন করতে আসেন ভিন জেলা, রাজ্যের দর্শনার্থীরাও।
রানি জানকীর আমলে আনুমানিক ১৭৭৬ সালে মহিষাদল রাজ বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয়। সেই সময় থেকেই রাজ বাড়ির ঠাকুর দালানে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। রাজত্ব চলে যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর জৌলুস কমেছে। কিন্তু, নিয়ম-আচারে ছেদ পড়েনি। তাই প্রথা অনুযায়ী মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ প্রতিপদের দিন ঘট স্থাপন করে মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। ‘মহালয়ার পরের দিন রাজবাড়ির দুর্গা মণ্ডপ লাগোয়া অশ্বত্থ গাছের তলায় নটি ঘট ওঠে। ষষ্ঠী থেকে প্রতি দিনই ঘটপুজো হবে। সপ্তমী থেকে মূর্তি পুজো হয়। প্রতিমার এক পাশে ঘট, অন্য পাশে ধান রাখা হয়। এই দুর্গাপুজো করার পরই শুষ্ক গ্রামে ধান ফলে ছিল। তাই ভালো ফসলের আশায় আজও দেবীর পাশে ধান রাখা হয়। এই ধনের বীজের অঙ্কুর থেকেই পূর্বাভাস পাওয়া যায় এলাকায় ফসল কেমন হবে। পুজোয় ১০৮টি নীলপদ্ম দেওয়ার চলও রয়েছে, যা আসত উত্তর প্রদেশ থেকে। কিন্তু এখন তা আর হয় না, সাদা পদ্মে মায়ের পুজো হয়। আগে মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় যাত্রাপালা, ভোগ বিতরণ, কামান দেগে সন্ধিপুজো, বিসর্জনের শোভাযাত্রা সবই হত। পুজোর দিন গুলিতে ঠাকুর দালানেই যাত্রা হত। রাজবাড়ির মহিলারা পর্দার আড়াল থেকে যাত্রা দেখতেন। পুজোর দিন অনুযায়ী ভোগ রান্না হত। যেমন, ষষ্ঠীতে ছয় মন, সপ্তমীতে সাত মন, অষ্টমীতে আট মন, নবমীতে নয় মন চালের প্রসাদ তৈরি করে বিতরণ করা হত। এখন তা আর সম্ভব হয় না। অষ্টমীর সন্ধ্যায় কামান দেগে রাজবাড়ি সহ আশপাশের এলাকার পুজোমণ্ডপে সন্ধি পুজো শুরু হত। দশমীতে বড় নৌকায় করে শোভাযাত্রা বেরতো এবং রাজবাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া হিজলি টাইডাল ক্যানাল হয়ে গেঁওখালিতে রূপনারায়ণ নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হত। এখন সে সবই অতীত। রাজত্ব ঘোচার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রাপালা বন্ধ হয়েছে। পুজোর দিন গুলিতে অবশ্য এখনও ভোগ রান্না করা হয়। কিন্তু তা যৎসামান্য। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবি গান হলেও এখন আর হয় না চাত্রাপালা। কামানের পরিবর্তে আতশবাজি এদিকে সরকার কামান দাগায় নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেটাও ইতিহাসের খাতায় চলে গিয়েছে। এখন কামান দাগার পরিবর্তে আতস বাজির রোশনাইয়ের মধ্যে দিয়ে সন্ধিপুজো করা হয়। বিসর্জনের শোভা যাত্রাও অতীত। রাজবাড়ি লাগোয়া রাজদিঘিতেই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। তবে আড়ম্বর কমলেও ঐতিহ্যের টানে আজও বহু মানুষ মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় সামিল হন। দর্শনার্থীদের যাতে কোনও রকম অসুবিধে না হয়, তার জন্য বর্তমান রাজ পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি নজরে রেখেছেন। পুজোয় আগত দর্শনার্থী বা পর্যটকদের পরিষেবা দিতে রাত্রীযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মূল্য দিয়ে থাকতে হবে। মহিষাদল রাজবাড়ির বর্তমান প্রজন্ম হিসাবে রাজবাড়ি দেখা শোনা করে থাকেন শংকরপ্রসাদ গর্গ ও হরপ্রসাদ গর্গ। রাজবাড়ির পুজো দেখতে এবং রাজ বাড়ির অপরূপ পরিবেশের অনুভূতি নিতে হলে আস্তে হবে মহিষাদলে। প্রাচীন মহিষাদলের ঠাকুর দালান ভগ্নদশায় পরিনত হয়। পুজোর সময় ভীষণ সমস্যা হত। দর্শনার্থীদের কথা ভেবে স্থানীয় বিধায়ক তিলককুমার চক্রবর্তীর উদ্যোগে সেই ঠাকুরদালান নতুন করে নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে। রাজ্যের পাশাপাশি ভিন রজ্যের বহু মানুষ এখানে রাজবাড়ি ও রাজবাড়ির পুজো দেখতে আসেন তাদের কথা ভেবে রাজ পরিবার ও স্থানীয় প্রশাসন রাজবাড়িকে সাজি তোলার কাজ চলছে।।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন, বাঘের সেবা কেমন করে করলেন কৃষ্ণদাস ! : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

বৃন্দাবনের গোবর্দ্ধনে বাস করতেন শ্রীকৃষ্ণদাস নামক এক সাধু ।  তিনি গোফার মধ্যে ভজন করতেন । দিবানিশি কৃষ্ণ নাম অতি উচ্চঃস্বরে করতেন। নাম নিতে নিতে এমন হতো যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা,  আহার-বিহার সব ভুলে যেতেন । নামানন্দে বিভোর হয়ে থাকতেন সর্বদা । কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে এমন করে করুণ সুরে ডাকতেন যে,  শুনলে প্রাণ কেমন করে উঠতো ।  কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত সাধু কৃষ্ণদাস প্রেমানন্দে মজে থাকতেন সদা সর্বদা।

একদিন কৃষ্ণ দাসের গোফার দ্বারে বিশাল আকারের এক বাঘ এসে দাঁড়ালো। ভয়ংকর উগ্র মূর্তি সেই বাঘের। দেখলেই ভয় লাগবে এমন। তবে কৃষ্ণদাস কিন্তু একটুও ভীত হলেন না। মনে মনে বাঘটিকে অতিথি ভাবলেন তিনি । বহু সম্মান দেখিয়ে একটি আসন গোফার দ্বারে পেতে বাঘটিকে আদরের সুরে বসতে বললেন ‌ । আর , বাঘটিও সুরসুর করে আসনের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে বসে পড়লো যেন।

যত্ন করতে হবে বাঘটিকে । কৃষ্ণদাস ভাবতে থাকলেন অতিথি এসেছে,  কী খেতে দেই তাকে ? ঘরে কী আছে ?  কিন্তু , কিছু তেমন  নেই তো ! কৃষ্ণদাস নিজেই মাধুকরী করে এনে প্রসাদ পান। ঘরে তো সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না !  তার ওপর বাঘ আবার মাংসাশী প্রাণী। মাংস এখন কোথায় পাই ? অতিথিকে তুষ্ট করার কথা ভাগবতেও আছে। বলা হয়েছে , ক্ষমতা না থাকলে নিদেনপক্ষে বসার আসন আর পানের জল দিয়েও অতিথি সৎকার করা উচিৎ। কিন্তু, মাংস ভিন্ন অপর কিছু দিয়ে তো আর বাঘ অতিথিকে খুশী করা যাবে না ! —–এইসব নানান ভাবনার উদয় হল কৃষ্ণদাসের  মনে। পরক্ষণেই কৃষ্ণদাস ভাবলেন , আমার নিজের অঙ্গের মাংসতেই যদি বাঘকে সম্মান জানাই,  তবে কেমন হয় ?  সেটাই বরং ভালো হবে।  আর তাই কৃষ্ণদাস নিজের অঙ্গের নানান জায়গায় ছুরি চালিয়ে টুকরো টুকরো মাংস কেটে বের করে আনলেন। কষ্ট , যন্ত্রনা কী হচ্ছিল না তাঁর ? হচ্ছিল , অবশ্যই হচ্ছিল । কিন্তু, নিজের মনকে তিনি শ্রীমন্ মহাপ্রভুর মুখবাক্যের কথা ভেবেই বোঝাচ্ছিলেন যে , “সর্বজীবে দিবে সম্মান । জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।।” অর্থাৎ, প্রতিটি জীবের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ অবস্থান করেন । তাই প্রতিটি জীবকে সম্মান দিতে হয় । জীবসেবার চেষ্টা করতে হয়।

বাঘের সম্মুখে পাতায় করে কৃষ্ণদাস রেখেদিলেন নিজের শরীরের কয়েকটি ছোট মাংসখণ্ড । বাঘ  তৃপ্তি ভরে খেল। আর তারপর চুপচাপ চলে গেল। কৃষ্ণদাস তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মনে তৃপ্তি পেলেন এই ভেবে যে , যাক অতিথি আপ্যায়নটুকু তো কোনমতে হল !

কৃষ্ণ ভক্তের স্বভাব যে এমনই হয়।  নিজের দুঃখ বা লাভালাভে কোন আকর্ষণ থাকে না তাঁদের । অপরকে সুখী করেই তাঁরা আনন্দ পান।

—- ভক্তকৃপা ভিখারিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ রিভিউ

করম পুজা নিয়ে দুটি কথা : দিলীপ  রায়।

করম প্রধানত সৃষ্টির উৎসব, সৃজনের উৎসব । শরতের আগমনে শস্য ও সমৃদ্ধি কামনায় করম পরব বা করম উৎসব । ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী বা পার্শ্ব একাদশীতে করম উৎসব পালিত হয় । এই বছর অনুষ্ঠিত হলো ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ । এই পরবের মূল আকর্ষণ হলো জাওয়া গান । বলা চলে, গানগুলো লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গ ।
এবার আসছি করম পরব প্রসঙ্গে ।
করম পরব ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়,  আসাম, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশ ও নেপালে একটা ফসল কাটার উৎসব । এই উৎসবে করম দেবতার উপাসনা করা হয় । যিনি শক্তি, যুব ও যৌবনের দেবতা । করম পরব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা , ঝাড়্গ্রাম জেলা, বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কুড়মি, ভূমিজ, রাজপুত, সরাক, লোহার বাউরি, বীরহড়, বীরনিয়া, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, কোড়া মাহালি, পাহাড়িয়া, হাড়ি, বাগদি, বেদে, ঘাসি, লোধা ও বৃহৎ জনগোষ্ঠী সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, প্রভূতি সম্প্রদায়ের জঙ্গলভিত্তিক ও কৃষিভিত্তিক লোক উৎসব ।
প্রকৃতির পুজা ও উর্বতার উৎসব । এই করম পরব প্রায় সাতদিন ধরে উদযাপন  হয় । কুমারী কন্যারা নিষ্ঠার সঙ্গে সাতদিন ধরে ব্রত পালন করেন, করম গাছের ডাল পুজা করেন এবং বপন করা হয় ভুট্টার বীজ । অঙ্কুরিত ভুট্টার চারা বা ‘জাওয়া’কে  উর্বতার প্রতীক হিসাবে দেখা হয় । মূলত এই করম উৎসবটি আদিবাসী ও সাঁওতাল জনজাতিদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ।
মূলত গ্রামের অবিবাহিত কুমারী মেয়েরাই এই ‘করম’ ঠাকুরের উপাসক । শুক্লা একাদশীর সাতদিন আগে কুমারী মেয়েরা একত্রে বাঁশের বোনা ‘টুপা’ (ডালা) এবং বিভিন্ন ধরনের শস্যবীজ নিয়ে জড়ো হয় পার্শ্ববর্তী কোনো নদী, পুকুর বা জলাশয়ে  । সেখানে প্রত্যেকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে সদ্যস্নাত ভিজে কাপড়ে নিজের নিজের টুপায় নদী  খাতের বালি ভর্তি করে বাড়ি থেকে আনা সেই শস্যবীজগুলো বোনে । তারপর পরস্পরের হাত ধরে টুপা’কে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী গান গাইতে থাকে ।
এরপর শুরু হয় এই জাওয়া টুপাগুলোর পরিচর্যা । দিন দুয়েক পরেই বীজগুলির অঙ্কুরোদম হয় । জাওয়া পাতানো কুমারী মেয়েরা, জাওয়ার শুদ্ধতা বজায় রাখার নিরিখে সারা সপ্তাহ ধরে পালন করে কিছু রীতি নীতি । যেমন – একদিন তারা শাক খায় না, খাটিয়ায় ঘুমোয়  না, মাথায় তেল দেয়  না, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় না, । এছাড়াও প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা নিজ নিজ ডালাসহ গ্রামের এক জায়গায় জড়ো হয় । জাওয়াকে কেন্দ্র করে সারা সন্ধ্যা চলে করম গান ও নাচ ।
সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের লায়া (পুরোহিত) এক জায়গায় করম ডাল পুঁতে করম ঠাকুরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন  । তৈরি হয় পুজোর বেদী । গ্রামের ব্রতকারী কুমারী মেয়েরা “করম ডালায়” পুজোর অর্ঘ্যরূপে ঘি, গুঁড়, আতপ চাল, মধু, ধূপ, একগাছি ধান আর ‘কাঁকুড়’, ইত্যাদি নিয়ে সমবেত হয়ে পুজো করে পরম ঠাকুরের । কামনা করে সোহাগী স্বামী পাওয়ার ও সন্তানবতী হওয়ার ।
এবার আসছি করম পুজার প্রচলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে । এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, করম পুজা প্রচলনের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে । এখানে দুইটি মতের উল্লেখ করা হলোঃ-
এক সময় সাত ভাই ছিল যারা কৃষিকাজে কঠোর পরিশ্রমী । এমনকি তাঁদের  দুপুরের খাওয়ারও সময় থাকতো  না । তাই, স্ত্রীরা প্রতিদিন তাঁদের  দুপুরের খাবার  মাঠে নিয়ে যেতেন ।  একবার এমন হয়েছিল,  তাঁদের স্ত্রীরা দুপুরের খাবার নিয়ে মাঠে যাননি  । সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত ছিলেন তাঁরা । সন্ধ্যায়  বাড়ি ফিরে দেখেন তাঁদের স্ত্রীরা বাড়ির  উঠোনে করম গাছের ডালের পাশে নাচ-গান করছেন  । এটা দেখে তাঁরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা  । এক ভাই তাঁর মেজাজ হারিয়ে ফেলে করমের ডাল ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিলেন । করম দেবতাকে অপমান করা হয়েছিল  ।  ফলে তাঁদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে এবং  অনাহারে তাঁদের দুর্দশা অবস্থা  । একদিন একজন ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) তাদের কাছে এলেন এবং সাত ভাই  পুরো ঘটনাটা তাঁকে  খুলে বললেন । এরপর সাত ভাই করম রানীর খোঁজে গ্রাম ছেড়ে চলে যান। তাঁরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে থাকেন  এবং এইভাবে খোঁজার পর  একদিন তাঁরা করম গাছের সন্ধান পান । পরবর্তীকালে, করম ঠাকুরের পুজো করেন ।  তারপর তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটতে থাকে । সুখ ও শান্তি ফিরে আসে ।
আর একটি মত হচ্ছে নিম্নরূপঃ
কথিত আছে, কর্ম ও ধর্ম দুই ভাই । দু’জনেই খুব পরিশ্রমী ও দয়ালু । কিছু দিন পর কর্মের বিয়ে হয়ে গেলো । তাঁর স্ত্রী ছিল অধার্মিক এবং অন্যদের বিরক্ত  করার মানসিকতা ।  আর এতে রাগান্বিত হয়ে কর্ম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
তিনি চলে যেতেই সকলের কর্মফল ও ভাগ্যও  চলে গেলো এবং  মানুষের দুঃখ দুর্দশা বাড়তে লাগলো ।  মানুষের সমস্যা সহ্য করতে না পেরে ধর্ম  ভাইয়ের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন  । কিছু দূর হাঁটার পর তাঁর জল তেষ্টা পেলো  এবং দেখলেন  আশেপাশে কোথাও জল নেই । দূরে  একটা নদী দেখতে পেলেন এবং  সেখানে গিয়ে দেখলেন, তাতেও জল নেই ।
নদী ধর্মকে বলল, তোমার ভাই এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের কর্মফল নষ্ট হয়ে গিয়েছে । গাছের সব ফল নষ্ট ! খুঁজে পেলে বলো, তাঁর কাছে আমাদের এই সমস্যার সমাধান চাই ।   তারপর  আরও একজন মহিলার সঙ্গে তাঁর দেখা  এবং তিনি বললেন, কর্ম চলে যাওয়ার পর থেকে রান্নার পরে পাত্রগুলি হাতে লেগে যেতে শুরু করে, এর সমাধান কী ?  আপনি কর্মকে জিজ্ঞাসা করুন এবং  তাঁকে বলতে বলুন ।
ধর্ম আরও এগিয়ে গেলেন  । একটি মরুভূমিতে পৌঁছালেন । সেখানে তিনি দেখলেন,   কর্ম গরমে অস্থির । তাঁর শরীরে ফোসকা পড়েছে এবং তিনি যন্ত্রণায় কাতর । তাঁর অবস্থা অসহনীয় । ধর্ম কর্মকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন । কর্ম বললেন, “যে বাড়িতে আমার স্ত্রী মাটিতে কাদা ছুঁড়েছে  সেখানে আমি কীভাবে যাবো ?”  তখন ধর্ম প্রতিশ্রুতি দেন, আজকের পরে সে আর কখনও মাটিতে কাদা ফেলবে না । তখন উভয় ভাই বাড়ি ফিরে যেতে লাগলেন  ।
ফেরার সময়   সেই মহিলার সঙ্গে দেখা  । কর্ম তাঁকে বললেন, ঐ মহিলা কখনও কোনও ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াননি, তাই তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে । সুতরাং এটি তাঁর কর্মফল।
একইভাবে সকলকে নিজের কর্মফলের কথা জানানোর পর কর্ম বাড়িতে এসে পুকুরে কর্মফলের ডাল লাগিয়ে পূজা করেন । তারপর সমগ্র এলাকার লোকেরা আবার সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন  এবং সমৃদ্ধি ফিরে আসল ।  সেই স্মরণে করম পরব  পালিত হয় । বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে করম পার্বণ একটি অন্যতম । এটি গ্রাম বাংলার এক অজানা অথচ বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠী,  কুড়মিদের চা-বাগানের মানুষদের  সু-প্রচলিত করম পরব বা করম পুজা । এই বছর করম পুজাকে গুরুত্ব দিয়ে রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করেছেন ।
পরিশেষে বলা যায়, করম পরব আদিম জনগোষ্ঠীর ধারক ও বাহক । এর মধ্যে অন্যতম কুড়মি, সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, ওঁরাও, রাজোয়াড়, ডোম, ঘাসি প্রভৃতি  জনগোষ্ঠী । তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় কুড়মি সমাজের মধ্যে এর স্বীকৃতি, মান্যতা ও ব্যপকতা অবর্ণনীয় । আদিম জনগোষ্ঠী প্রায়  সকলেই প্রকৃতির পুজারী ।  ভাল করে এই উৎসবের  পুজানুষ্ঠান  ও পালনবিধি  লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,  এটা একটা  বৃক্ষ পুজার অনুষ্ঠান । বৃক্ষকে জীবন্ত আত্মার অধিকারী হিসাবে স্বীকার করে  এবং তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বাস-সংস্কার,  আচার-অনুষ্ঠানের  এক বিস্ময়কর সমাবেশ এবং শুদ্ধ ভক্তির পরম্পরা  !  (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী (পিন-৭৪১২৩৫) / ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

Share This
Categories
গল্প নারী কথা প্রবন্ধ

জানুন , সেবা করার সময় মন অন্য দিকে যাওয়ায় ভক্ত কি শাস্তি দিলেন নিজেকে : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

একদিন অভিরাম ঠাকুর পথ দিয়ে যাচ্ছেন। সেসময় কৃষ্ণদাস নামক এক ভক্ত এসে তাঁর চরণে পড়লেন। ইতিপূর্বে লোকমুখে অভিরামের গুণের কথা অনেক শুনেছেন কৃষ্ণদাস। অন্তরে বড় সাধ অভিরামের চরণেই আত্মনিবেদন করবেন, দীক্ষা নেবেন তাঁর থেকে। আর আজ যখন জানলেন , পথ দিয়ে সুদীর্ঘঅভিরাম ঠাকুর হেঁটে যাচ্ছেন, তখন আর এক মূহুর্তও বিলম্ব করতে রাজী নন কৃষ্ণদাস। পথের মধ্যেই তাই অভিরামের পদে পড়ে নিজের বাসনার কথা ব্যক্ত করলেন। অভিরামও প্রসন্ন হলেন আগুন্তুকের আগ্রহ দেখে।

নির্দিষ্ট দিনে কৃষ্ণদাসকে দীক্ষা দিলেন অভিরাম। কৃষ্ণদাসকে সকলে ‘বাঙ্গাল কৃষ্ণদাস’ বলে সম্বোধন করত। কারণ, তিনি বাঙ্গাল দেশবাসী   অর্থাৎ বঙ্গদেশবাসী  ছিলেন। কিন্তু, অভিরাম তাঁকে আদেশ দিলেন শ্বোঙালুতে গিয়ে গোপীনাথ বিগ্রহ স্থাপন করে সেবাকার্য শুরু করতে। হাওড়া-তারকেশ্বর রেলপথে তারকেশ্বর নেমে বাসে চৌতারা হয়ে শ্বোঙালু যাওয়া যায়।

শ্রীগুরুদেবের আজ্ঞা পেয়ে প্রফুল্লিত হলেন শিষ্য। তিনি বললেন, “বাবা, আপনিই কৃপা করে শ্বোঙালুতে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে দিন । সেই বিগ্রহ তখন আমি সেবা করবো।” শিষ্যের বিনয়বচনে অভিরাম প্রীত হলেন। রাজী হয়ে তিনি কৃষ্ণদাসকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলেন। গ্রামবাসীরা সকল প্রয়োজন মেটালেন। মহামহোৎসবের মধ্য দিয়ে গোপীনাথ বিগ্রহ স্থাপন করে দিলেন ঠাকুর অভিরাম।

বৈষ্ণবের বেশভূষা ধারণ করে, দ্বাদশ অঙ্গে তিলকসেবা করে অপূর্ব দর্শন হয়ে কৃষ্ণদাস অনুরাগসহ নিষ্ঠাভরে গোপীনাথের সেবা করেন। সেবা ভিন্ন তিনি অপর কিছু জানেন না, জানতেও চান না। সদা সাত্ত্বিক মনোভাব তাঁর।

একদিন গোপীনাথের আরতি করছেন, এমন সময়ে এক নারী এসে আরতি দর্শন করতে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন। সে নারীর প্রতি দৃষ্টি পড়লো কৃষ্ণদাসের। তিনি মনে মনে ভাবলেন, ‘এ কেমন বিচার আমার মনের। সেবা ছেড়ে আমার চোখ অন্যদিকে পড়লো ! রতির চাঞ্চল্য হল ! তবে তো আমার দেহ শুদ্ধ নয়, তাই জন্যেই রতিও শুদ্ধ নয়। একারণেই সেবা থেকে মন সরে নারীর প্রতি গেছে। সেবার থেকেও বড় করে মন কিছু চায় নিশ্চয়। বেশ এ চোখের ক্ষিদে আমি মেটাবো। দুষ্ট গোরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভাল। তাই , ওই চোখের ব্যবস্থা আমি করছি !

আরতি শেষে নারী চলে গেলেন। কৃষ্ণদাসও তাঁর পিছু পিছু গেলেন। নারী যে গৃহে প্রবেশ করলেন, কৃষ্ণদাসও সে গৃহে ঢুকলেন। অন্যান্য যাঁরা ছিলেন সেই গৃহে তাঁরা অত্যন্ত আনন্দ পেলেন কৃষ্ণদাসকে দেখে। মহাসমাদর করে আসন পেতে বসতে দিলেন। কৃষ্ণদাস বললেন,  সেই নারীর সঙ্গে তাঁর কিছু প্রয়োজন আছে। তিনি নির্জনে তাই কথা বলতে চান। নির্জন গৃহে সেই নারীকে কৃষ্ণদাস বললেন, নগ্ন হয়ে দাঁড়াতে। নারী ভীতা হলেন। কৃষ্ণদাস বললেন, “ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমি কেবল দূর থেকে তোমায় দেখব। তোমার কোন ক্ষতি হবে না নিশ্চিন্তে থাকো।” পূজারী কৃষ্ণদাসের আশ্বস্ত বাক্যে নারী মনে বল পেলেন এবং বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়ালেন। নারীকে নিরীক্ষণ করলেন কৃষ্ণদাস দূর থেকে। তারপর গৃহে ফিরে গেলেন আর করলেন এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড।

গৃহে ফিরেই লৌহ শলাকা গেঁথে দিয়ে নিজের চোখ দুটি নষ্ট করে ফেললেন কৃষ্ণদাস। অন্ধ হয়ে গেলেন স্বেচ্ছায় বরাবরের মত। যে চোখ এমন দুষ্টতা করে তিনি তাকে চিরকালের মত শেষ করে দিলেন, যাতে আর কোনদিনও অনাচার না করতে পারে। গোপীনাথের সেবা ছেড়ে যে চোখ অন্য কিছু চায় তাকে এমনই শাস্তি দেওয়া উচিৎ ইচ্ছাপূরণ করানোর পর।
এদিকে ভক্ত দুঃখে সদা দুঃখী হন যিনি, সেই ভক্তবৎসল প্রভু গোপীনাথ তো আর স্থির থাকতে পারলেন না নিজ ভক্তের অমন করুণ অবস্থা দেখে। তিনি বাঙ্ময় হলেন। বললেন, “ওহে কৃষ্ণদাস, এ তুমি কী অঘটন ঘটালে আজ! কেন তুমি অন্ধ হতে গেলে? এমন দুর্দশাকে কেন আপন করলে? এখন এই অন্ধ অবস্থায় আমার পরিচর্যা কেমন ভাবে করবে! তোমার দেখাশোনা, তোমার সেবা করার জন্যই তো এখন লোকের দরকার হবে ! কী ছেলেমানুষি কাণ্ড করলে !”

স্বয়ং গোপীনাথ কথা বলেছেন ! গোপীনাথ তাঁর দুর্দশায় দুঃখী হয়েছেন—- এ কথা ভেবেই মহানন্দের প্রাবল্যে কৃষ্ণদাস মূর্ছিত হয়ে গেলেন। ওদিকে, অভিরাম জানতে পারলেন অনুভব করতে পারলেন নিজ শিষ্যের অঘটনের কথা। তিনি চলে এলেন শ্বোঙালুতে। তিনি কোলে তুলে নিলেন কৃষ্ণদাসের মাথা। গভীর স্নেহে বললেন, “কৃষ্ণদাস এমন কাণ্ড কেন ঘটালে?  নিজের হাতে নিজের নয়ন নষ্ট করে ফেললে !”

তখন কৃষ্ণদাস বললেন সব ঘটনা। কি ভাবে গোপীনাথের সেবা দেবেন এই চিন্তায় তখন সে দিশাহারা। অভিরাম বললেন, “চিন্তা করো না, আমি বলে রাখলাম সেবার সময় তুমি গোপীনাথকে দর্শন করতে পারবে। তোমার হাতে গোপীনাথের শৃঙ্গার তিলক সজ্জা সব সুচারু রূপেই হবে। তুমি তাঁর নবঘন শ্যাম বদন দেখতে পাবে মানসে। তুমি এমন সুনিপুণ হবে সেবায় যে, সকলে তোমার যশগান গাইবে। পিতা যেমন পুত্রের দোষ দেখে না, গোপীনাথও তেমন তোমার  কোন ত্রুটি নেবেন না, নিশ্চিন্তে থাকো।”

সত্যই গোপীনাথ প্রকট হতেন কৃষ্ণদাসের সামনে। আর অন্ধ হয়েও কৃষ্ণদাস সুচারু সেবা দিতেন। এরপর একদিন, নিজের অন্ধ ভক্তের কষ্ট দেখে অভিরাম তাঁকে বললেন, “শোনো কৃষ্ণদাস, তোমাকে আর বৈধীভক্তি পালন করতে হবে না। তুমি এবার থেকে পঞ্চভাব যুক্ত হয়ে রাগানুগা পথে প্রেমসেবা দেবে। এই আমার আদেশ। মানসে সেবা করবে, সাক্ষাৎ-এ নয়। বুঝেছো তো ! কৃষ্ণদাস নতমস্তকে আজ্ঞা মেনে নিলেন।

বিনম্র প্রণতি জানাই এমন সেবানিষ্ঠ, সেবাপ্রাণ ভক্ত বাঙ্গাল কৃষ্ণদাস কে।
————-ভক্তকৃপা ভিখারিণী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক
____________

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানেন, বিশ্বকর্মাকে (Vishwakarma) কেন ‘দেবশিল্পী’ বলা হয়? রইল বিস্তারিত!

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- ইনি হলেন দেবশিল্পী। বিশ্বকর্মা (আক্ষরিক অর্থে: “সর্বস্রষ্টা”) হলেন একজন হিন্দু দেবতা।হিন্দু ধর্মে সব দেব -দেবীর পুজোর তিথি স্থির হয় চন্দ্রের গতি প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে। শুধুমাত্র বিশ্বকর্মা পুজোর তিথি স্থির করা হয়, সূর্যের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। পুরাণ মতে ব্রহ্মাপুত্র বিশ্বকর্মা, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নকশা তৈরি করেছিলেন। মনে করা হয়, তিনিই পৃথিবীর প্রথম ইঞ্জিনিয়ার। জানেন, বিশ্বকর্মাকে (Vishwakarma) কেন ‘দেবশিল্পী’ (Craftsman Deity) বলা হয়? রইল বিস্তারিত…
ঋগ্বেদ অনুযায়ী, তিনি পরম সত্যের প্রতিরূপ এবং সৃষ্টিশক্তির দেবতা। উক্ত গ্রন্থে তাকে সময়ের সূত্রপাতের প্রাক্‌-অবস্থা থেকে অস্তিত্বমান স্থপতি তথা ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য স্রষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  বিষ্ণুপুরাণের মতে, প্রভাসের ঔরসে বৃহস্পতির ভগিনীর গর্ভে বিশ্বকর্মার জন্ম হয়। বেদে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বকর্মা বলা হয়েছে। বিশ্বকর্মা মূলত সৃষ্টিশক্তির রূপক নাম। সেই অর্থে ইনি পিতা, সর্বজ্ঞ দেবতাদের নামদাতা। ইনি সর্বমেধ-যজ্ঞে নিজেকে নিজের কাছে বলি দেন। ইনি বাচস্পতি, মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা, বিধাতা। ঋগবেদের মতে- ইনি সর্বদর্শী ভগবান।

বিশ্বকর্মা পূজা বা বিশ্বকর্মা জয়ন্তী হচ্ছে একটি হিন্দুধর্মীয় উৎসব। হিন্দু স্থাপত্য দেবতা বিশ্বকর্মার সন্তুষ্টি লাভের আশায় এই পূজা করা হয়। তাঁকে স্বয়ম্ভু এবং বিশ্বের স্রষ্টা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিনি দেবতা কৃষ্ণের রাজধানী পবিত্র দ্বারকা শহরটি নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কা নগরী, পাণ্ডবদের মায়া সভা, রামায়ণে উল্লিখিত ব্রহ্মার পুষ্পক রথ, দেবতাদের বিভিন্ন গমনাগমনের জন্য বিভিন্ন বাহন, দেবপুরী এবং বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিব এর ত্রিশূল, কুবের এর অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকের শক্তি সহ দেবতাদের জন্য বহু কল্পিত অস্ত্রের স্রষ্টা।

 

বিশ্বকর্মার ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে তিনি এই বিশ্বের সব কর্মের সম্পাদক। তিনি সব ধরনের শিল্পের প্রকাশক। শিল্পবিদ্যায় বিশ্বকর্মার রয়েছে একচ্ছত্র অধিকার। তিনি নিজেই চতুঃষষ্টিকলা, স্থাপত্যবেদ এবং উপবেদ এর প্রকাশক। কথিত আছে, পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথমূর্তিও তিনিই নির্মাণ করেন। তাঁকে স্বর্গীয় ছুতারও বলা হয়।
হিন্দুদের অন্যান্য পূজার সময় চাঁদের গতি-প্রকৃতির উপর নির্ধারিত হলেও বিশ্বকর্মার পূজার সময় সূর্যের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়। এই নিয়ম অনুসারে সূর্য যখন সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে তখন উত্তরায়ন শুরু হয়। এই সময়েই দেবতারা নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এবং বিশ্বকর্মার পূজার আয়োজন শুরু করা হয়।
ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন বিশ্বকর্মার পূজা করা হয়। সূতার-মিস্ত্রিদের মধ্যে এঁর পূজার প্রচলন সর্বাধিক। তবে বাংলাদেশে স্বর্ণকার,কর্মকার এবং দারুশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি শিল্পকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণও নিজ নিজ কর্মে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশ্বকর্মার পূজা করে থাকেন।
প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে বিশ্বকর্মার পূজা হয়ে থাকে। প্রতিবছর একইদিনে এই পূজা হয়, এর কোনো পরিবর্তন হয় না বিশেষ।
বিশ্বকর্মা পূজা হয় ভাদ্র সংক্রান্তিতে অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিনে। আর এই দিনেই হয় রান্নাপুজো বা অরন্ধন যা কিনা মনসাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভাদ্রের আগে বাংলায় শ্রাবণ মাস চলে – এই মাস শিবের মাস, এই মাস মনসার মাস। পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে বর্ষা-প্লাবিত বাংলায় প্রাচীন কাল থেকেই সাপের প্রকোপ দেখা দেয় আর সেই সাপের দংশন থেকে রক্ষা পেতে সহায় হন দেবী মনসা। তাই বর্ষার শেষে ভাদ্র সংক্রান্তিতে তাঁরই উদ্দেশে করা হয় মনসা পূজা। তাহলে দেখা গেল, ভাদ্র সংক্রান্তির এই একটি মাত্র দিনেই একইসঙ্গে অরন্ধন, মনসাপূজা এবং বিশ্বকর্মা পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
বিশ্বকর্মার হাতে দাঁড়িপাল্লা থাকে। দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লা জ্ঞান ও কর্মের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। উভয়ের সমতা বজায় রেখেছেন তিনি। এছাড়া তিনি হাতুরী ধারণ করেন, যা শিল্পের সাথে জড়িত। তিনি যে শিল্পের দেবতা এই হাতুরী তারই প্রতীক।
হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী বিশ্বকর্মা পূজার দিনটি ‘কন্যা সংক্রান্তি’ তে পড়ে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে এটি সাধারণত প্রতি বছর ১৬ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উদযাপিত হয়। দিনটি ভারতীয় সৌর বর্ষপঞ্জি এবং বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসের শেষ দিন। সৌর ক্যালেন্ডারে ভারতীয় ভাডো মাসের শেষ দিন। বাংলাদেশ, ভারতের আসাম, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং ত্রিপুরা রাজ্যে সৌর বর্ষপঞ্জী অনুসারে দিনটি পালিত হয়। প্রতিবেশী দেশ নেপালেও এই উৎসব উদযাপিত হয়।
তবে কোন কোন অঞ্চলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দীপাবলির একদিন পর গোবর্ধন পূজার সাথেও বিশ্বকর্মা পূজা পালন করা হয়।
বিশ্বকর্মা পূজা মূলত কারখানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পালন করা হয়। প্রায়ই দোকানের মেঝেতে পূজার আয়োজন করা হয়। কখনো কখনো বিশ্বকর্মার মূর্তি স্থাপন করে কিংবা কখনও কখনও পটে আঁকা চিত্র সামনে রেখে তার পূজা করা হয়। এসময় দোকান কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মী একসাথে এক জায়গায় জড়ো হয়ে তার পূজা করে।
বিশ্বকর্মার সন্তুষ্টি অর্জন ও তার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কেবল প্রকৌশলী কিংবা স্থপতি সম্প্রদায় নয়, সব ধরনের কারিগর, সূতার, মিস্ত্রি, কামার-কুমার, স্বর্ণকার, শিল্প কর্মী, কারখানার শ্রমিক, ঢালাইকর সহ অনেক ধরনের পেশার মানুষ এদিন তাঁর পূজা করে। তারা আরও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য, নিরাপদ কাজের পরিস্থিতি এবং নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোপরি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে।  আবার শ্রমিকেরা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রার্থনা করে। কখনো কখনো কারিগরেরা এসব যন্ত্রপাতি বিশ্বকর্মার নামে সমর্পন করে এবং ওই সময় সেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিরত থাকে। আধুনিক ইলেকট্রনিক সার্ভারগুলিও যাতে সুষ্ঠুভাবে কাজ করে সে জন্যও কেউ কেউ তার উপাসনা করে।

 

ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে কলকারখানায় বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে বিশ্বকর্মার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য দেব-দেবীর মতোই মূর্তি গড়ে অথবা ঘটে-পটে বিশ্বকর্মার পূজা করা হয়। সূতার-মিস্ত্রিদের মধ্যে এঁর পূজার প্রচলন সর্বাধিক। তবে বাংলায় স্বর্ণকার, কর্মকার এবং দারুশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি শিল্পকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণও নিজ নিজ কর্মে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশ্বকর্মার পূজা করে থাকেন।

বিশ্বকর্মা লঙ্কা নগরীর নির্মাতা। তিনি বিশ্বভুবন নির্মাণ করেন। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিব এর ত্রিশূল, কুবের এর অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকেয়র শক্তি প্রভৃতি তিনি তৈরি করেছেন। শ্রীক্ষেত্রর প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মূর্তিও তিনি নির্মাণ করেছেন।
বিশ্বকর্মা পূজার দিন প্রত্যেকের ঘরে ঘরে বিশেষ খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা হয় এবং পূজার পরে কোন কোন এলাকায় সমবেতভাবে ঘুড়ি ওড়ানো হয়।

উন্নত ভবিষ্যৎ, নিরাপদ কাজের পরিস্থিতি এবং নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোপরি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে, বিভিন্ন ধরনের পেশার মানুষ এদিন বিশ্বকর্মার পুজো করেন। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি তিথিকে ‘কন্যা সংক্রান্তি’ বলা হয়। পুরাণ মতে এই তিথিতেই  বিশ্বকর্মার জন্ম হয়।

।।সংগৃহীত : উইকিপিডিয়া।।

Share This