Categories
গল্প প্রবন্ধ

ভাদু উৎসব, একটি বিশেষ পর্যালোচনা : দিলীপ রায়।

আমরা জানি,  বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ । আর এই তেরো পার্বণের অন্যতম পার্বণ হচ্ছে  ভাদু উৎসব । ভাদু হল ভাদ্র মাসের উৎসব । পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর এই জেলাগুলিতেই প্রধানত এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । তবে ইদানীং রাজ্যের অন্যান্য জেলায়ও এই অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি দেখা যায় । যেমন মুর্শিদাবাদ জেলায় সালার শহরের কাছে ঝামটপুরে ভাদু উৎসব দেখা যায় । বিশেষ করে ভাদ্র মাসের শেষদিন বড় উৎসব যেটা মেলার আকার নেয় । এই অনুষ্ঠানকে অন্য কথায় মেয়েলি ব্রত বলা যেতে পারে   ।  অনেকে মনে করেন  ভাদ্র মাস থেকেই ‘ভাদু ‘ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে । আবার অনেকে মনে করেন,  ভাদু মানে  লক্ষ্মী । বিভিন্ন মাসে লক্ষ্মী বিভিন্ন রূপে যেহেতু  পুজিত হন, তাই ভাদ্রমাসেও ভাদু উৎসবের মাধ্যমে লক্ষ্মীদেবী  পুজিত হন । তবে এই উৎসবের অনেক মতান্তর রয়েছে । পুরুলিয়া  জেলার কাশীপুর রাজপরিবারের  ভাদু বা ভদ্রেশ্বরী নামক এক রাজকন্যার কাহিনী থেকে এর উদ্ভব । শোনা যায়, কাশীপুর রাজের কন্যা ভাদুর এক রাজকুমারের সাথে বিয়ে ঠিক হয় । কিন্তু বিয়ের দিন বর বেশে বিয়ে করতে আসার সময় তিনি মারা যান । এরপরই ভাদু মৃত্যুবরণ করে । ভাদু উৎসব নিয়ে মানভূম অঞ্চলে বেশ কিছু লোককাহিনী প্রচলিত । আবার আরও একটি জনশ্রুতি, পঞ্চকোট রাজ পরিবারের নীলমণি সিংদেও’এর  তৃতীয়া কন্যা ভদ্রাবতী বিবাহ স্থির হওয়ার পর তার ভাবী স্বামীর অকালমৃত্যু হলে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন, এই কাহিনী মানভূম অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচারিত ।

 

 

বিয়ে করতে আসার সময় ভদ্রাবতীর হবু স্বামী ও তার বরযাত্রী ডাকাতদলের হাতে খুন হলে ভদ্রাবতী চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন বলে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার পুরুলিয়া গ্রন্থে প্রকাশিত হয় । ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীলমণি সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন ।  অনেকেই তার সাথে কৃষ্ণভক্তি পরায়ণা মীরার মিল খুঁজে পান । তবে রাজকন্যা ভাদুকে নিয়ে অনেক মতান্তর রয়েছে । রাজকন্যার স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশে ভাদু উৎসব  প্রচলিত  । এমনকি ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীল সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন ।
ভাদু উৎসব কৃষি প্রধান উৎসবও বটে । মাঠজুড়ে তখন  নতুন ধান রোপণ করা হয় । তবে এই উৎসবের অন্যতম বিষয় হল এই পুজোয় কোনো মন্ত্রের প্রয়োজন নেই  । ভাদু উৎসবে পূজারীরা ভদ্রেশ্বরীর একটি মূর্তি তৈরি করে এবং সারা মাস ধরে তার সম্মুখে নৃত্যগীত পরিবেশন করে । ভদ্রেশ্বরী কখনও কন্যা আবার কখনও জননীরূপেও পুজিত  হন । পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা গ্রামের কোন বাড়ীর কুলুঙ্গী  পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন । আগে ভাদুর কোনো মূর্ত রূপ ছিল না ।  একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে তারা সমবেত কন্ঠে ভাদু গীত গেয়ে থাকেন । পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকমের মূর্তির প্রচলন হয়েছে ।  ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদুর মূর্তি ঘরে নিয়ে আসা হয় । শোনা যায়, মূর্তিগুলি সাধারণত হংস বা  ময়ূর বাহিনী বা পদ্মের ওপর উপবিষ্টা মূর্তির গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুল, গলায় পদ্মের মালা ও হাতের তলায় আলপনা থাকে । কখনো মূর্তির কোলে কৃষ্ণ বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি থাকে ।  ভাদ্র সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রিতে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়ে থাকে । মাইক বাজিয়ে গান শুনে খাবার তৈয়ারী করে নিজেদের মতো করে জাগরণের রাত পাড়ার ছেলেরা সমবেতভাবে অতিবাহিত করে । এর মাধ্যমে সামাজিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ উন্মেষ হয় । যা সমাজ থেকে বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে ।  এই লৌকিক ও সামাজিক উৎসব সমাজে বেঁচে থাক । সমাজে টুসু, ঝুমুর, ভাদু গানের কদর বাড়ুক  । সুতরাং ভাদু জাগরণের আরও ব্যাপ্তি ঘটুক ।   এই রাত্রে রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘর তৈরী করে এই মূর্তি স্থাপন করে তার সামনে মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখা হয় । এরপর রাত্রিতে ভাদু গীত গাওয়া হয় । কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা গ্রামের প্রতিটি মঞ্চে গেলে তাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ও  তারা এই সব মঞ্চে ভাদু গীত পরিবেশন করে থাকেন ।

 

‘ভাদু ভাসান’ পর্ব অত্যন্ত বিষাদময় । ভাদ্র-সংক্রান্তিতে উপাসকরা মূর্তিসহ নদীর তীরে সমবেত হয়ে মূর্তি বিসর্জন দেন । এই উৎসবের অন্যতম লোকসংস্কৃতি হল ভাদু গান । সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানভূমের লোকসংস্কৃতি পুরুলিয়ার ভাদুগানেও পরিবর্তন হয়েছে । এই উৎসব উপলক্ষে মিষ্টির দোকানগুলিতে নানা রকমের মিষ্টি তৈরী ও  বিক্রি হয় ।
টুসু ও ঝুমুর গানের বিপরীতে ভাদু গানগুলিতে প্রেম এবং রাজনীতি সর্বতোভাবে বর্জিত । সাধারণতঃ গৃহনারীদের জীবনের কাহিনী এই গানগুলির মূল উপজীব্য । পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয় । বর্তমানে সচেতনামূলক ভাদু গান পরিবেশিত হচ্ছে ।
ভাদু উৎসবের উৎপত্তি নিয়ে বহু মতান্তর রয়েছে । কবে থেকে এবং কীভাবে এই অনুষ্ঠান শুরু তার সঠিক তথ্য আজও  অজানা  । পরিশেষে  ভাদু দেবীর কাছে  প্রার্থনা,  চাষের   জমি ফসলে   ভরে  উঠুক ও  মানুষের মধ্যে শান্তি বিরাজ করুক ।

 

(তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত)

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন, শ্রীজগন্নাথের কপালে কিভাবে এল হীরে : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

রায়সেনগড়ের রাজার প্রধান সেনাপতি ছিলেন শ্রীঅঙ্গদ । তিনি আবার সম্পর্কে রাজার খুড়াও(কাকা) হতেন । অঙ্গদ তেমন ভক্ত  ছিলেন না । তবে তাঁর পত্নী অত্যন্ত ভক্তিমতী ছিলেন । অঙ্গদ  পত্নীকে ভীষণ ভালোবাসতেন । বলতে গেলে পত্নী-অন্ত-প্রাণ ছিলেন । পত্নীর সুখের জন্য তিনি যে কোন কিছু করতে রাজি । একদিন অঙ্গদের ভবনে পত্নীর গুরুদেব এলেন । সেসময় অঙ্গদ ছিলেন না । গৃহে ফিরে তিনি দেখলেন গুরুদেবের সেবায় ব্যস্ত  তাঁর পত্নী । মুহুর্তেই ক্রোধিত হলেন অঙ্গদ । পত্নীকে  তিরস্কার করে বসলেন এই বলে যে, অন্দরমহলে কীভাবে একজন বাইরের পুরুষ প্রবেশ করলো ! ভক্তিমতী রমণী প্রথমে বোঝাবার চেষ্টা করলেন , গুরু সম্পর্কে এমন প্রাকৃত, হীন ভাবনা মনে আনতে নেই । কিন্তু, পত্নীপ্রেমিক অঙ্গদ কিছুতেই কিছু বুঝতে চান না । ভীষণ ঈর্ষা হয়েছে মনে তাঁর । শান্ত প্রকৃতির, সুশীলা রমণী অত্যন্ত কষ্ট পেলেন যখন অঙ্গদ দু-চার কথা সেই গুরুদেবকেও শুনিয়ে দিলেন । রমণী স্থির করলেন, যে গৃহে আমার গুরুর অপমান হল, সেই গৃহে আমি আর থাকবোই না । কিন্তু , আমার স্বামী তো আমায় গৃহের বাইরে যেতেই দেবেন না । চারিদিকে প্রহরী । তাহলে আমি বরং চিরকালের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় নেব ।
মুখে কিছু পত্নী বলেন না, কিন্তু দিনের পর দিন অনাহারে থাকতে লাগলেন । প্রাণ ত্যাগের অভিসন্ধি  নিয়ে । অবশেষে রুগ্না, ক্লীষ্টা হলেন । অসুস্থ হয়ে পড়লেন । বৈদ্য দেখে শুনে বুঝলেন দীর্ঘদিন অনাহারে থাকার ফল এ । অঙ্গদ যখন জানলেন সব বৃত্তান্ত, ব্যথিত হলেন খুব । নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হল তাঁর । হাজার হোক  পত্নীই যে তাঁর জগৎ । পত্নীকেই নিজের দেবীরূপে দেখতেন তিনি । অভিমান ভুলে তাই মানিনী পত্নীর মান ভাঙ্গাবার চেষ্টা করলেন; বললেন, “তুমি আহার করো । অন্ন মুখে তোলো । কথা দিচ্ছি যা বলবে তাই আমি মাথা পেতে নেব । শুধু তুমি সুস্থ হয়ে আবার আগের মতন হও । খাবার খাও । আমি তোমায় চাই শুধু । আমি ভুল করেছি, মেনে নিচ্ছি । তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও দয়া করে । যা ইচ্ছে আদেশ করো ওগো অভিমানিনী ! দেখো, আমি শুনি কিনা ।” অঙ্গদের কাতর প্রার্থনায় হেসে ফেললেন রমণী , বললেন, “বেশ, তবে এতদিন যা বলেছি, কিন্তু করতে চাওনি , এবার সেটাই করতে হবে তোমাকে। যদি রাজী থাকো তবেই অন্ন মুখে নেব ।” অঙ্গদ—- “তুমি একবার শুধু বলে দেখো । আমি তো কথা দিয়েছি যে শুনবো ।” পত্নী—- “তবে তুমি আমার শ্রীগুরুদেবের থেকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নাও ।” অঙ্গদ এখন তাতেই রাজী । এতদিন শোনেননি, কিন্তু, এবার যে তার প্রিয়ার প্রাণসংশয় দেখা দিয়েছে । অগত্যা রাজী না হয়ে উপায় নেই যে !
শ্রীগুরুদেবকে আমন্ত্রণ করে আনানো হল অঙ্গদের ভবনে । অঙ্গদ ক্ষমাপ্রার্থনা করে দীক্ষা নিলেন । পত্নীও যার-পর-নাই আনন্দিতা হলেন স্বামীর সিদ্ধান্তে । গুরুদেব ছিলেন সদ্ গুরু । ফলে তাঁর কৃপা-আশীর্বাদে প্রকৃতই ভাবান্তর ঘটে গেল অঙ্গদের অন্তরে । মন্ত্রজপ করতে করতে, কৃষ্ণনাম নিতে নিতে প্রকৃত বৈষ্ণবে পরিণত হলেন তিনি । এখন তাঁর আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে চরিত্রে । এই অঙ্গদ অন্য এক মানুষ এখন । শ্রীরাধার প্রেমকে স্মরণ করতে-করতে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীজগন্নাথ-রূপে পরিবর্তিত হবার কথা ভেবে তিনি তন্ময় হয়ে যান । নিজের অন্তরের পত্নীপ্রেমকে অনুভব করে শ্রীকৃষ্ণের অন্তরে শ্রীরাধার প্রতি যে প্রেম—- তা অনুধাবন করার চেষ্টা করে নয়নাশ্রুতে বক্ষ ভাসান তিনি । শ্রীকৃষ্ণের প্রেমবিগলিত রূপ সেই ‘শ্রীজগন্নাথ’-এর প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ তিনি অনুভব করেন । প্রবল প্রেম জাগ্রত হয় জগন্নাথের জন্য ভক্ত শ্রীঅঙ্গদের হৃদয়ে । ভক্ত যখন আপন হৃদমন্দিরে ভগবানকে বসিয়ে নিজের নয়নবারি দিয়ে ভগবানের শ্রীচরণ ধৌত করে দেন আবেগে, আবেশে, ভক্তিতে, প্রেমে —-তখন ভগবানেরও আসন টলে, তিনিও সেই ভক্তের জন্য আকুল হন । তিনি যে ভক্তাধীন —-ভক্তের অধীন ! ভক্তের ভালোবাসায় বাঁধা পড়তে তাঁর বড় ভালো লাগে । বা বলা ভালো ,  তিনি আপনা হতেই বাঁধা পড়ে যান ভক্তের প্রেমরজ্জুতে ।
অঙ্গদ নয়ন জলে ভাসেন আর নিজের পত্নীকে কৃতজ্ঞতা জানান এই বলে যে, “প্রিয়া ! তোমার কাছে আমি জন্ম-জন্মান্তরের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ হয়েছি । তুমি যদি আমায় কৃষ্ণভজনের এমন সুন্দর পথের পথিক না করতে, তবে তো আমি এত আনন্দের, এত সুখের সন্ধানই পেতাম না ! সত্যিই তুমি আমার প্রথম গুরু গো, প্রিয়ে !” পত্নী শুনে বলেন—- “না, না, এ তুমি কী বলছো ! বলো না এমন ! তোমার পূর্ব জন্মের সুকৃতি বশেই তুমি যা পাবার পেয়েছে । আমার কী সাধ্য বলো ! আমি তো নিমিত্ত মাত্র ! আর কখনো এমন বলো না যে আমি গুরু !” তখন অঙ্গদ বলেন কেন তুমি কী শোনোনি যে—-
“স্ত্রী কিংবা পুত্র কিংবা পশু কেনে নয় ।
কৃষ্ণে মতি যাহা হৈতে সেই গুরু হয় ।।
বিপ্র কিংবা ন্যাসী কিংবা শূদ্র কেনে নয় ।
যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা সেই গুরু হয় ।।”
অর্থাৎ, স্ত্রী, পুত্র বা পশু —-সে যেই হোক না কেন, যার থেকে কৃষ্ণে মতি আসে তিনিই গুরু । আবার ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী কিংবা শূদ্র বলে কোন কথা নেই —- কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা হলেই তিনি গুরুপদবাচ্য হন ।
এরপর পতি-পত্নীতে তাঁদের শ্রীগুরুদেবের চরণ স্মরণ করেন । প্রকৃতই তো গুরুদেব সদ্গুরু একজন । তাইতো তাঁর প্রদত্ত মন্ত্রে এত তেজ, এত কৃপা যে সেই মন্ত্র জপতে জপতে হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেম জাগ্রত হয়েছে । অঙ্গদ গভীরভাবে শ্রীকৃষ্ণভজনে ডুবলেন । রাজবিষয় বা জাগতিক ব্যাপার আর তাঁর ভালো লাগে না । যেতে হয় যান রাজসভায় । গ্রাম্য কথায় আর মন বসে না ।  মাঝে মধ্যেই অনুপস্থিত থাকেন সভায় ।
একদিন অঙ্গদ বাড়ীতে আছেন, এমন সময় রাজপেয়াদা হাজির । রাজা মহাশয় ডেকে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধে যেতে হবে । যুদ্ধের কথা শুনেই অঙ্গদ তৎক্ষণাৎ ‘না’ বলে দিলেন, বললেন—- “না, না, যুদ্ধ-টুদ্ধ আমার দ্বারা আর হবে না । জীবহিংসা আমি করতে পারবো না । তুমি গিয়ে রাজাকে বলে দাও ।” অঙ্গদ যে আর আগের মানুষ নেই—- সে খবর তো রাজা অনেক দিন আগেই পেয়েছেন, অনুভবও করেছেন তাঁর আচরণে । কিন্তু, এখন যে তাঁকে ভীষণভাবে প্রয়োজন রাজার । যুদ্ধে-অভিজ্ঞ অঙ্গদ ছাড়া জয় অনিশ্চিত । রাজা তাই পেয়াদাকে দিয়ে খবর পাঠালেন—- জীবহিংসা করে প্রাণনাশ তাঁকে করতে হবে না নিজের হাতে । কিন্তু, সেনাদের উপযুক্ত পরিচালনার জন্য তাঁর উপস্থিতি একান্ত আবশ্যক । না হলে এ যাত্রায় রক্ষা নেই । রাজ্যের পরাজয় নিশ্চিত । এভাবে অঙ্গদ নিজের দায়িত্ব এড়াতে কোন মতেই পারেন না । রাজ-আজ্ঞা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেই হবে ।
অগত্যা অঙ্গদ সবদিক বিচার বিবেচনা করে যুদ্ধে উপস্থিত থাকলেন । যুদ্ধ-বিজ্ঞ অঙ্গদের সুনিপুণ পরিচালন গুণে শত্রু রাজা হার স্বীকার করে নিজের সব সম্পদ অর্পণ করে দিয়ে সে যাত্রায় পার পেলেন । যুদ্ধের নিয়মানুযায়ী  নিজের মাথার পাগড়িটিও দিয়ে দিলেন । সেই পাগড়িতে ছিল নির্মল সুন্দর সুদুর্লভ এক মহা-মূল্যবান হীরকখণ্ডক । নজরে পড়লো সেই হীরে অঙ্গদের । দেখামাত্র তাঁর মনে হল, এই হীরে শুধু বহু মূল্যের  নয়, অতি দুর্লভও । চাইলে মূল্য দিয়েও এমন হীরে লব্ধ করা যায় না । নাহ্, এই হীরের যোগ্য অধিকারী তো কেবল শ্রীজগন্নাথ ! আহা ! এ হীরে যদি তাঁর মস্তকে বা কপালে থাকতো তবে কেমন হত ! না, না, এ হীরে আমি বরং নিজের হাতে জগন্নাথকে দিয়ে আসবো ।
অঙ্গদ দেশে ফিরে লুটে আনা সব সম্পদ রাজাকে দিয়ে দিলেন, কেবল দিলেন না সেই অত্যাশ্চর্য অদ্ভুত সুন্দর হীরেটি । নিজের কাছে গোপনে যত্ন করে রেখে দিলেন জগন্নাথকে দিতে যাবেন বলে । এদিকে রাজা লোক মারফৎ জানতে পারলেন যে, পরাজিত রাজার পাগড়িতে হীরে বসানো ছিল, যা সেনাপতি  অঙ্গদ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন ।
রাজধন আত্মসাৎ করেছে জেনে রাজার ভীষণ ক্রোধ হল । কিন্তু, যেহেতু অঙ্গদ তাঁর সম্পর্কে খুড়ো হন, এবং মনে মনে শ্রদ্ধা করেন তিনি তাঁকে , তাই শাস্তি না দিয়ে, কেবল হীরেটি ভালো মুখে ফেরৎ চাইলেন । কিন্তু, অঙ্গদ দিতে নারাজ । রাজা বারংবার চেয়েও যখন পেলেন না, তখন তাঁর (অঙ্গদ) ঘরবাড়ি ঘেরাও করলেন । তবু ভয় পেলেন না অঙ্গদ সাধু । মনে মনে ভাবলেন প্রাণ যায় যাক তিনি জগন্নাথকে হীরে পরিয়েই ছাড়বেন । আর তাই বেশ কয়েকজন ঘোড়সওয়ার নিয়ে নিজের পাগড়িতে সযত্নে হীরেটিকে লুকিয়ে রেখে যাত্রা করলেন পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের দিকে । রাজা এহেন চাতুরীর কথা শুনে পাঁ‍চশ সেপাহীসহ  পাত্রকে পাঠিয়ে ধাওয়া করালেন অঙ্গদের পিছনে । বললেন, “অঙ্গদকে প্রাণে প্রথমেই মারবে না । হীরে চাইবে কেবল । হীরে যদি ভালো কথায় দিয়ে দেয় তো ভালো । হীরে নিয়ে ওকে ছেড়ে চলে আসবে । কিন্তু, যদি তা না দিতে চায়, তবে মুণ্ডচ্ছেদ করে ফেলবে । ওই হীরে আমার চাই, যার জন্য অঙ্গদ এতখানি সাহসী হয়ে উঠলো যে আমার বিরুদ্ধে যেতেও  কুণ্ঠাবোধ করলো না !”
যথারীতি সেনারা একসময় নাগাল পেয়ে গেল অঙ্গদ ও তাঁর ঘোড়সওয়ারদের । সেনারা রাজার হুকুমের কথা জানালো, হীরে না  দিলে এবার কিন্তু মস্তক ছেদন করা হবে । অঙ্গদ ভাবলেন এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল ! কী করা যায় এখন  ! আর তো তবে জগন্নাথের কাছ অবধি পৌঁছানোই গেল না । হীরে দেবো কেমন করে ! তিনি বললেন, “আমি হীরে দিয়ে দেবো তোমাদের । কিন্তু, তার আগে আমি পাশের এই পুষ্করিণীতে স্নান-পূজা করে আসি । সেনারা রাজি হয়ে গেল  । অঙ্গদ স্নান করে উঠে জলে দাঁড়িয়েই শ্রীজগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে অনেক স্তব-স্তুতি করলেন, পূজা দিলেন নিজের মত করে । এবার হীরাখানি সৈন্যদের ফিরিয়ে দেবার সময় । তিনি হীরা হাতে নিয়ে নয়ন বন্ধ করে শ্রীজগন্নাথের চরণ কমল ধ্যান করে মনে মনে নিবেদন করলেন, “হে পুরুষোত্তম জগন্নাথ ! আমি অতি অভাগা যে এই হীরা তোমার কপালে পরাতে চেয়েও পেরে উঠলাম না । এ হীরা কী অন্যের কপালে সাজে ! এ যে একমাত্র তোমাকেই মানায় । কত ভালোবেসে তোমার জন্য আনলাম, কিন্তু পারলাম না দিতে । হে জগন্নাথ আমি তোমাকে উদ্দেশ্য করেই এই হীরা জলে ফেলে দিচ্ছি । এবার তোমার যদি মন চায়, তবে তুমি গ্রহণ করো । আর, আমার কিছু বলার নেই । এই নিবেদন শুধু করলাম । যা ভালো মনে হয় করো ।” —এরপর হীরা নিয়ে অগাধ জলের মধ্যে ফেলে দিলেন অঙ্গদ । বক্ষ তাঁর নয়নের বারিতে ভেসে যাচ্ছে তখন । কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে । দেহে বল নেই । অতি অবসন্ন মনে হচ্ছে নিজেকে । এবার সেনারা তাঁকে নিয়ে যা ইচ্ছে করে করুক । মুণ্ড ছেদন করলে করুকগে যাক ।
এদিকে এতক্ষণ সেনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অঙ্গদের স্নান-পূজা সব নজরে রাখছিল, যাতে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সুযোগ বুঝে সেনাপতি অঙ্গদ পালাতে না পারেন । কিন্তু, তিনি যে এমন কাণ্ড করে বসবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি । যখন অঙ্গদ ছুঁড়ে ফেললেন হীরাটি, সকলে একসঙ্গে ‘হায় ! হায় ! এ কী করলেন’ বলে সমস্বরে চীৎকার করে উঠেছিল । আর তারপরই সকলে একসাথে জলে ঝাঁপ দেয় হীরা পাবার লোভে । তারা ভাবলো, অঙ্গদ যায় যাক, হীরা যদি হাতে আসে, অনেক লাভ হবে ।
অঙ্গদ যাত্রা করলেন শ্রীক্ষেত্রের দিকে । ওদিকে  নদীর পাক উঠিয়ে অনেক তল্লাশি করেও হীরার দেখা মিলল না । কেউই পেল না হীরা । রাজাকে জানানো হল । রাজা সব শুনে মৌন হয়ে গেলেন । অনুভব করলেন হীরা জগন্নাথের কপালে পড়াবে বলে অঙ্গদের তীব্র বাসনার কথা ।
ওদিকে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে জগন্নাথের মন্দিরে ঘটলো এক আশ্চর্য ব্যাপার । পাণ্ডারা হঠাৎ দেখলেন জগন্নাথের কপালে একটি বৃহদাকার অপূর্ব সুন্দর হীরকখণ্ড জ্বলজ্বল করছে । তাঁরা ভেবে কুলকিনারা পেলেন না । এই হীরা এল কোথা থেকে !  শিঙ্গারের সময় তো তাঁকে পরানো হয়নি । অদ্ভুত কাণ্ড ! মন্দিরে এ নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল । জগন্নাথ  রাত্রে প্রধান পাণ্ডাকে স্বপ্নাদেশ দিলেন—- “আমার কপালের হীরক যে দিয়েছে —-সে আমার ভক্ত ‘অঙ্গদ’ । তার পদার্পণ হবে কাল শ্রীক্ষেত্রে । তোমরা যত্ন করে তাকে দর্শন করাবে সব ।” পরদিন প্রভাত হতেই সন্ধান শুরু হয়ে গেল অঙ্গদ নামের কোন ভক্ত মন্দিরে প্রবেশ করলো কিনা । অপেক্ষার অবসান হল একসময় । অঙ্গদ এলেন জগন্নাথ দর্শনে । পাণ্ডারা তাঁকে যত্ন করে জগন্নাথ দর্শন করালেন । হ্যাঁ, দেখলেন জগন্নাথের মুখে মৃদু-মৃদু হাসি আর মস্তকে ভক্তের ভালবাসার চিহ্ন সেই হীরা—- যা ভগবান সাদরে গ্রহণ করেছেন । অঙ্গদের অন্তর তখন আকুতি ভরা প্রেমে জরজর থরথর । জগন্নাথ তাহলে তাঁর উপহার স্বীকার করেছেন ! এমন যে সৌভাগ্য সত্যই হবে তা তো বিশ্বাসই করতে পারছেন না  অঙ্গদ !
এখনও পর্যন্ত জগন্নাথের বিশেষ বিশেষ শিঙ্গারের দিনে সেই হীরা পরানো হয় তাঁকে।
————–নম্রানতা
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ রিভিউ

লুকিয়ে থাকা একটি স্মৃতি : শীলা পাল।

জায়গাটার নাম লুকলা।নেপালের বিশাল বিশাল পাহাড়ের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা গ্রামের এটি একটি ছোট্ট গ্রাম।কিখেয়াল হলো কাঠমান্ডু তো অনেক বার ঘোরা হলো এবারে ছোট ছোট ফ্লাইটে এই গ্রাম গুলো ঘুরে দেখার। একঘন্টা ও লাগলো না আমরা একেবারে হিমালয়ের গহনে চলে এলাম ।দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দশ বারো জন যাত্রী নিয়ে ছোট ছোট প্লেনগুলো
আসে।দিনে দু তিন বার। এতো সরু নামার পথ ভয় হয় এইবুঝি পাহাড়ের ধাক্কা লেগে যাবে ।কিন্তু নিয়মিত এই পরিবহণ ব্যবস্থা চলেছে।যেমন কাঠমান্ডু থেকে পোখরা বা জুমসুং এটিও তাই।প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা বলছি।শুনেছি ওখান থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যাওয়া শুরু হয়। তখন আমার একান্ত প্রিয় মানুষ টি আমার সঙ্গী ছিলেন ।আমরা দু জনে থাকলে পৃথিবীর যে কোন জায়গাতেই ইচ্ছে হলে চলে যেতাম। তখন লুকলার সন্ধান পেয়ে ঐখানে যাওয়া ই মনস্থ করলেন ।অনেক অনেক পাহাড়ে ঘুরেছি এতো নির্জন বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে কখনও যাই নি।তখন দুটি হোটেল ছিল নাম মনে নেই।একদম খালি ।সব অভিযাত্রী দল বেরিয়ে গেছে।ওরাই হোটেল দুটিতে থাকেন ।সবাই চলে গেছে অভিযানে।আমরা খুব সহজেই সুন্দর আপ্যায়ন পেলাম।ম্যানেজার আমাদের মতো ট্র্যাভেলার পেয়ে ভীষণ খুশী ।সাধারণত এরকম ট্র্যাভেল কেউ করে না।ওনার সাথে সারাদিন বসে কতো গল্প শুনে আমাদের এই নির্জন পাহাড়ের দিনগুলো এতো মোহনীয় হয়ে উঠেছিল আজ এতোবছর পরেও স্মৃতি অম্লান হয়ে আছে ।
এতো সুন্দর পাহাড়ের রূপ আগে দেখিনি ।যেন বিশাল হিমালয়ের একদম
অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লাম।চারিদিক পাহাড়ে পাহাড়ে ঘেরা তার মাঝে ছোট্ট একটি গ্রাম ।লুকলা এয়ারপোর্টে বললে
ঠিক বলা হবে না।ছোট্ট প্লেনটি কোনমতে হেলে দাঁড়িয়ে পরে।ওই ঝুলন্ত
অবস্থায় যাত্রীরা নামা ওঠা করে।চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না ।বিশ্বের
একমাত্র বিপজ্জনক এয়ারপোর্টে নামে খ্যাত এই লুকলা এয়ারপোর্টে ।
।এখানে সাধারণত
গ্রামবাসী আর এভারেস্ট অভিযাত্রী রাই আসেন ।এখান থেকেই শুরু হয় এভারেস্ট বেস ক্যাম্প যাত্রা । অভিযাত্রীরা এখান থেকেই ট্রেকিং শুরু করেন।এখন অবশ্য এয়ারপোর্ট হয়ে গেছে ‘তেনজিং নোরগে এয়ারপোর্ট’। আমি পঁচিশ তিরিশ বছর আগের কথা বলছি।যখন শুধুই নাম শুনেছি।গুগুল ছিল না ইন্টারনেট ছিল না কেবল ম্যাপ দেখে দেখে ঘুরে বেড়িয়েছি।একটা নেশার মতো পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে এতো আনন্দ পেতাম আজ এই স্মৃতি যে কী মধুর বুঝতে পারছি।
আমার লেখা কিন্তু অন্য প্রসঙ্গে চলে যাবে এখুনি ।যার জন্য এতো রাতে কলম ধরেছি।বেশ মধুর আতিথেয়তা তে দিন কটি কাটছে।নেপালী মালিক আমাদের দু জনের জন্য তাঁর হোটেলের সেরা সেরা পদ রান্না করে খাওয়াচ্ছেন।কী যে যত্ন করেছিলেন তা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা চলে আসার আগের দিন একটি মহিলা অভিযাত্রী দল ফিরলো।আমরা আমাদের ঘর থেকেই দেখলাম শ্রান্ত বিধ্বস্ত দলটি সামনের সবুজ লনে হাত পা ছড়িয়ে অনেক ক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইলো।ঘোড়াওলা কুলীরা সব মালপত্র রেখে কোথায় চলে গেল ।সুইস অভিযাত্রী ।সব মেম সাহেব ।আমার খুব ওদের দেখতে ভালো লাগছে ।কী সুন্দর সব দেখতে।তখনও অভিযানের পোষাক গড়া।আমি অবাক হয়ে দেখছি।তুমি এসে বললে এই পাগলী এখনও দাঁড়িয়ে আছো।ব্রেকফাস্ট করতে হবে তো।না এদের দেখেই পেট ভরে যাবে ।চলো ম্যানেজার ডাকছে।আজ নতুন কি একটা খাওয়াবে।আমি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ওর সঙ্গে ডাইনিংহলে গেলাম।কিন্তু চোখে ওই পরিশ্রান্ত সুন্দর মুখগুলো লেগে রইলো ।
তারপর আর ওদের দেখিনি।বিকেল বেলা চা দিতে এসে বেয়ারা বললো ম্যানেজার সাব আপনাদের ডেকেছেন । চা খেয়ে আমরা ওনার ঘরে গেলাম ।বিশাল ঘরে চারিদিকে কাচের বড় বড় জানালা ।সামনে পাহাড়ের নীচে বিস্তৃত সবুজের ময়দান। একঝলক দেখে মনে হলো এতো সুন্দর ও হতে পারে! উনি বসেছিলেন । আমরা ঢুকতেই আইয়ে দিদি আইয়ে দাদা বলে উঠে এসে ভেতরে জানালার ধারে সোফাতে বসালেন ।আমাকে বললেন দিদিকে দেখে আমার মনে হয়েছে দিদির মনে অনেক প্রশ্ন আছে এই মহিলা অভিযাত্রীদের নিয়ে।আমার তাই মনে হলো এটা দিদিকে দেখাই।পরে বুঝলাম এবারেগাইড পোর্টারদের সঙ্গে অভিযাত্রীনীদের বিদায়ের পালা।সে যে কী বিরল দৃশ্য ।সবাই কাঁদছে জড়াজড়ি করে।একটি খুব সুন্দরী বয়সও সবার থেকে কম ও তো ওর গাইডকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরে দিচ্ছে ।সবার বিদায়।পালা শেষ হয়ে গেল । ওর আর শেষ হয়না।যেন অনন্ত কাল এই ভাবেই থাকবে।আর তার সঙ্গে কান্না ।চোখের জলে দুজনেই ভেসে যাচ্ছে । এরকম একাত্ম হয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে সমস্ত বিশ্ব পৃথিবী ভুলে। আমি অবাক হয়ে দেখতে দেখতে ভাবছি এই কালো রোগা ছেলেটির মধ্যে কী পেল এতো কষ্ট ছেড়ে যেতে ! আমার মনটা ও কেমন খারাপ হতে লাগলো ।তখন ঐ দাদা বললেন অনেক দিন ভয়ংকর পরিবেশে পাশাপাশি থাকতে থাকতে কতো বিপদের মুহূর্তে প্রান দিয়ে যখন ওদের আগলে রাখে সেই মুহূর্ত গুলো ওরা ভুলতে পারে না ।ওদের ওপর অগাধ ভরসা আর বিশ্বাস করতে করতে কখন যে ভালোবেসে ফেলে বুঝতেও পারে না।এই ছেড়ে যাওয়ার সময়ে ওদের প্রচন্ড কষ্ট হয় দিদি। আমি তো অনেক দেখেছি কী পুরুষ কী মহিলা কদিনের সফরে ওরা অভিন্ন হৃদয় হয়ে যায়।তাই এই চলে যাওয়াটা বড়োই বেদনার দিদি।আমি চুপ করে বসে থাকি ।তখনও ওরা দুজন দুজনকে এক ভাবে ধরে আছে।আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট হতে লাগলো ।যেন আমার কোনও প্রিয়জন ছেড়ে চলে যাচ্ছে । যার সঙ্গে আর জীবনে কোনও দিন দেখা হবে না।
কতো কী জানা ছিলো না দেখা ছিলো না।এই লুকলা একটা সম্পূর্ণ অচেনা জগতের ছবি উপহার দিয়েছিল। আমার প্রিয় মানুষ টি আজ আমার কাছে নেই।অনেক দূরে আমায় রেখে চলে গেছে।আমি জানি এখন সে আমার সাথে লুকলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে সেই বিদায়বেলার করুণ দৃশ্য টি দেখতে দেখতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কান্নার শেষ হয় কি? আমার জানা নেই। ।

আমার পাহাড়ের একটি স্মৃতি সবার সাথে শেয়ার করলাম ।

Share This
Categories
গল্প

অভিমান : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

ব্যস্তভাবে চ্যানেল বদলাচ্ছিল সুব্রত। আজ আইপিএলের একটা ভালো ম্যাচ আছে। সুব্রত ক্রিকেটের অন্ধ ভক্ত। বলা যায় ক্রিকেট পাগল। আজ এমনিতে অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছিল তখনই টিভিটা খুলে বসে। কিন্তু অর্পিতা বাড়ি থাকলে সেটা সম্ভব নয়। অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে আগে ফ্রেশ হওয়া চাই। তারপর অন্য কাজ। আর তা করতে গিয়ে ইতিমধ্যে খেলা শুরু হয়ে গেছে।
চ্যানেল বদলাতে বদলাতে সহসা একটা খবরে থমকে যায় সুব্রত। ব্যাক করে আগের চ্যানেলটায় ফিরে আসে। সেখানে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেখাচ্ছে মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর খবর। খবরটা দেখে অর্পিতাকে হাঁক দেয় সুব্রত, ‘অর্পিতা একবার এঘরে এসো।’
রান্নাঘর থেকে অর্পিতা বলে, ‘আমার এখন অনেক কাজ। যাওয়া সম্ভব নয়। যা বলার ওখান থেকে বলো।’
‘আরে এস না।’
‘কেন?’
‘টিভিতে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে।’
কথাটা শেষ হয়েছে কী হয়নি, অর্পিতা ছুটে এ-ঘরে চলে আসে। শোফায় বসে চোখ রাখে খবরে। একই লেখা বার বার করে পর্দায় দেখাচ্ছিল। তবুও চোখ সরায় না অর্পিতা। একটু পরে বিজ্ঞাপন শুরু হতেই সুব্রত টিভিটা বন্ধ করে দেয়। খেলা দেখার আর তেমন আগ্রহ পায় না।
‘চারদিন পর মাধ্যমিকের রেজাল্ট। শুনেই তো আমার বুক কাঁপছে।’ উত্তেজনামাখা সুরে বলে অর্পিতা।
‘তোমার বুক কাঁপার কী হল! এত টেনশন করো না। দেখো, সায়ন ভালো রেজাল্টই করবে।’
‘সে আমি জানি। তবুও…।’
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুব্রত বলে, ‘টেনশন করো না। বরং এক কাজ করো। সায়নকে একবার ফোন করো। ও হয়তো খবরটা জানে না। ওকে বলো কাল বা পরশুর যেন মাসিবাড়ি থেকে ফিরে আসে।’
‘ঠিক বলেছ।’ অর্পিতা যাবে বলে সবে ঘুরেছে এমন সময় তার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘মনে হয় সায়নের ফোন। ও বোধহয় খবরটা জেনে গেছে।’
কিন্তু মোবাইলটা হাতে নিয়ে অর্পিতা একটু হতাশ হয়। দেখে অজানা নম্বর। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে এক বয়স্কা মহিলার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘অপু বলছিস?’
চমকে ওঠে অর্পিতা। ‘অপু…! এ নামে তো…!’ ভাবনাগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। কিছু জবাব দিতে পারে না। ওপাশ থেকে আবারও কাঁপা কাঁপা সুর ভেসে আসে, ‘অপু, আমি তোর মা বলছিরে।’
‘মা!’ আবারও একবার জোর চমক খায় অর্পিতা। মা তাকে ফোন করেছে, যেন বিশ্বাস হয় না। দীর্ঘ্য প্রায় কুড়ি বছর পর মা তাকে ফোন করেছে। ব্যাপারটা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করে। মনটা আবেগে ভেসে যেতে চায়। কিন্তু সেই আবেগে ভাগ বসায় পুঞ্জীভূত অভিমান। নিজেকে সামলে নেয় সে। একবার ভাবে কোনো কথা বলবে না। ফোনটা কেটে দেবে। পরমুহূর্তে ভাবে, মায়ের তো কোনো দোষ নেই। মা তো অসহায়। একজন মানুষের অন্ধ বিশ্বাস আর জেদের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে। তাই সিদ্ধান্ত বদলায়। তবে আবেগ দমন করে, সংযত গলায় বলে, ‘তুমি আমার নম্বর পেলে কী করে?’
‘সে কথা পরে বলব। তোকে একটা কথা বলব।’ বলেও কিন্তু সহসা কিছু বলতে পারেন না। আমতা আমতা করতে থাকেন। অর্পিতার কিছুটা হতভম্ভ অবস্থা। পাশাপাশি অদ্ভুত কিছু শব্দ তাকে কৌতূহলী করে তোলে। নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? তোমার আশেপাশে কীসব শব্দ শোনা যাচ্ছে! তুমি এখন কোথায়?’
‘নার্সিংহোমে।’
‘নার্সিংহোমে!’ চমকে ওঠে অর্পিতা। উদ্বেগমাখা সুরে বলে, ‘তুমি নার্সিংহোমে কেন? কী হয়েছে তোমার?’
ইতস্তত করে মহিলা জবাব দেন, ‘আমার কিছু হয়নি। তোর বাবা খুব অসুস্থ।’
কথাটা শুনে সহসা বুকে একটা ধাক্কা অনুভব করে অর্পিতা। কিন্তু পরমুহূর্তে সে গম্ভীর হয়ে যায়। কোনো জবাব দেয় না সে। এদিকে তাকে একবারে চুপ করে যেতে দেখে তার মা উদ্বেগ আর উত্তেজনামাখা সুরে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করতে থাকে। অর্পিতা গম্ভীর সুরে বলে, ‘শুনছি, বলো।’
‘শোন না, তোর বাবা খুব অসুস্থ।’
‘তা আমি কী করব?’
অর্পিতার কঠোর জবাবে তার মা একটু যেন হতচকিত হয়ে যান। একটু থেমে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে চলেন, ‘আজ বিকেলে তোর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পাড়ার কয়েকজন গাড়ি করে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়ে গেছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না। তোর দাদারা কেউ এখানে নেই। এদিকে ডাক্তার বলেছে ভালোই টাকা-পয়সা লাগবে। আমার কাছে বিশেষ কিছু নেই। আমি একা মেয়েমানুষ, কী করব ভেবে পাচ্ছি না। অপু, একটিবার আসবিরে মা?’
মায়ের কথার সহসা কোনো জবাব দিতে পারে না অর্পিতা। বাবার অসুস্থতা তার মনেক একটু নাড়িয়ে দেয় ঠিকই, তবে তা সাময়িক। মনকে শক্ত করে ফেলতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু মায়ের করুণ আর্তি আর কান্না তার বুকে আলোড়ন তোলে। পরমুহূর্তে তার অভিমানী মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে, সে কেন ওদের কথা ভাবতে যাবে! সে তো ওদের কেউ নয়! কিছুই জবাব দেয় না অর্পিতা। বৃদ্ধা বেশ কয়েকবার একই আর্জি জানানোর পর কোনো জবাব না পেয়ে হতাশায় ফোনটা কেটে দেন! শোফায় ধপাস করে বসে পড়ে অর্পিতা।
মোবাইলের কথোপকথন শুনে সুব্রত আন্দাজ করতে পেরেছিল খারাপ কিছু একটু ঘটেছে। অর্পিতা ফোনটা কাটতেই সুব্রত জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে? কে অসুস্থ?’
অর্পিতা সুব্রতকে বলে কী ঘটেছে। সব শুনে সুব্রত বলে, ‘তোমার এক্ষুনি নার্সিংহোমে যাওয়া উচিৎ।’
সুব্রতর দিকে অবাক চোখে তাকায় অর্পিতা। অবিশ্বাসমাখা সুরে বলে, ‘তুমি বলছ এ-কথা! আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। তোমার নিজের কথা কি তুমি ভুলে গেছ? রাস্তার কুকুরের চেয়েও তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল! মনে নেই?’
প্রসঙ্গটা গায়ে না মেখে সুব্রত বলে, ‘শোনো, একটা লোক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। এখন ওসব কথা ভাবতে আছে! হাজার হোক উনি তোমার বাবা।’
‘বাবা!’ সুব্রতর কথাটা শেষ হওয়ামাত্র ফুঁসে ওঠে অর্পিতা, ‘কে বাবা? উনি আমার বাবা নন। সেই সম্পর্ক উনি অনেক আগে মুছে দিয়েছেন।’
শান্ত সুরে সুব্রত বলে, ‘উনি যাই বলে থাকুন বা করে থাকুন, এটা তো অস্বীকার করতে পারো না যে উনি তোমার বাবা, তোমার জন্মদাতা?’
‘যে বাবার কাছে তার কন্যা মৃত, যে বাবা গত কুড়ি বছরে আমার সঙ্গে দেখা করা দূরে থাক, কথাও বলেনি, তাকে আমি কী করে বাবা বলে স্বীকার করে নেব!’
‘এসব তোমার রাগের কথা।’
‘না, রাগের কথা নয়। আমি যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করে কথাগুলো বলছি। আমি কিছু ভুলে যাইনি। কুড়িটা বছর ধরে আমি যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। অতীতটা আমি ভুলব কী করে!’
‘আমি সব জানি। কিন্তু মেয়ে হিসেবে তোমার ওনার পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
‘মেয়ে হলে নিশ্চয়ই পাশে দাঁড়াতাম। কিন্তু ওর কাছে আমি মৃত।’
‘শোনো…।’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আগের সুরেই অর্পিতা বলে চলে, ‘কোনো দোষ না করেও একটা লোকের মিথ্যা জাতপাতের অহংকার আর জেদের জন্য এত বছর আমি যন্ত্রণার জীবন কাটাচ্ছি। এতদিনে উনি তো আমাদের ওপর কোনো কর্তব্য করেননি। আজ তুমি আমাকে কর্তব্য পালন করতে বলছ?’
জেগে ওঠা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো লাভা উদগীরন করতে থাকে অর্পিতা। তাকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে সুব্রত বলে, ‘তোমার বাবার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের কথা ভাবো। উনি তো কোনো দোষ করেননি? অন্তত তোমার মায়ের কথাটা একটু গভীরভাবে ভাবো। কতটা অসহায় উনি। তোমার বিপর্যস্ত অবস্থায় অন্তত আমি তোমার পাশে ছিলাম। কিন্তু আজ তোমার মায়ের পাশে কেউ নেই। ভাবো, এই বৃদ্ধ বয়সে কতটা বিপর্যস্ত অবস্থা তার! এই সময় তুমি-আমি যদি ওর পাশে না দাঁড়াই তাহলে উনি আর কার কাছে যাবেন?’
মায়ের কথায় মনটা কিছুটা নরম হয় অর্পিতার। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে মায়ের অসহায় কান্না আর করুণ আর্তি। বুকের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয় তার। কর্তব্য সম্পাদন আর আত্মমর্যাদার দ্বন্দ্বে একটা টানাপোড়েন শুরু হয় অর্পিতার মধ্যে। সে ভেবে পায় না কী করবে।

২.
কলেজে পড়ার সময় থেকেই একে-অপরকে ভালোবাসত অর্পিতা আর সুব্রত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বাড়িতে তাদের সম্পর্কের কথা বলতে পারেনি অর্পিতা। এদিকে বাড়িতে তার বিয়ের আলোচনা চলতে থাকে। চাকুরির দোহাই দিয়ে সে আটকে রাখে। অর্পিতা অপেক্ষা করছিল তাদের দুজনের কেউ একজন চাকুরি পেলে সে বাড়িতে তাদের কথা জানাবে। তার রেজাল্ট ভালো কিন্তু কিছুতেই চাকুরি জুটছিল না। ফলে বিয়ের চাপ বাড়ছিল। অবস্থা যখন প্রায় হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সুব্রত একটা ভালো চাকুরি পেয়ে যায়। তখন অর্পিতা বাড়িতে জানায় তাদের সম্পর্কের কথা। কিন্তু বাড়িতে কেউ তাদের সম্পর্ক মেনে নেয় না। কারণটা তেমন কিছু না। অর্পিতারা ব্রাহ্মণ আর সুব্রত সিডিউল কাস্ট। অর্পিতার বাবা শিক্ষিত হলেও প্রাচীনপন্থী। তিনি কোনোমতেই এ-সম্পর্ক মেনে নেন না। অর্পিতা আশা করছিল তার দাদারা অন্তত ব্যাপারটা বুঝবে। কিন্তু সে অবাক হয়ে যায় দেখে যে, উচ্চ-শিক্ষায় শিক্ষিত দুই দাদাও বাবার সুরে সুর মেলায়। একমাত্র তার মা কিছুটা তার পক্ষে ছিল। কিন্তু বাবার প্রতাপের কাছে মা কোনোদিনই মুখ ফুটে নিজের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারেনি। বললেও বাবার না কে কখনও হ্যাঁ করতে পারেনি।
অর্পিতা বোঝায়, আজকালকার দিনে জাত-পাত নিয়ে ভাবনাটাই অবান্তর। সুব্রত সবদিক দিয়ে একজন আদর্শ পুরুষ। যেমন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তেমনি মানুষ হিসেবেও সে উন্নত মনের। তার থেকেও বড়ো কথা, তারা একে আপরকে ভালোবাসে। কিন্তু অনেক বুঝিয়েও সে বাবা-দাদাদের রাজি করাতে পারে না। বাবা সরাসরি বলে দেয়, ওই ছেলেকে বিয়ে করলে তিনি তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।
ছোটোবেলা থেকে বাবার কখনও অবাধ্য হয়নি অর্পিতা। কিন্তু সেদিন বাবার অন্যায় জেদকে মেনে নিতে পারেনি। সে শিক্ষিতা। নিজের জীবন নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তা আছে। সে যদি খারাপ কিছু করত, বাড়ির লোকেদের সম্মান হানিকর কিছু করত, তাহলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু মিথ্যা জাতপাতের অহংকারের আর অন্ধবিশ্বাসের কাছে নিজের ভালোবাসা আর আত্মমর্যাদাকে বলি দিতে চায়নি। বাধ্য হয়ে বাড়ির অমতে তারা রেজিস্ট্রি করে।
রেজিস্ট্রি করার পর বাড়িতে গিয়েছিল অর্পিতা। সুব্রতকে নিয়েই। কিন্তু বাবা তার মুখ দর্শন করেনি। পিছু ফিরে কঠোর কন্ঠে বলে দিয়েছিল, ‘আজ থেকে আর কোনোদিন এ-বাড়িতে পা রাখেব না তুমি। আমি তোমায় ত্যাজ্য করলাম। আজ থেকে মনে করব, আমার মেয়ে মরে গেছে।’
সেদিন অনেক কান্নাকাটি করেছিল অর্পিতা, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। কষ্ট, যন্ত্রণা আর একরাশ অপমান নিয়ে ফিরে এসেছিল সে। কিন্তু মন মানেনি। হাজার হোক তার বাবা। বার বার ফোন করলেও বাবা ফোন কেটে দিত। তবে একদিন কথা বলেছিল। কিন্তু তা সুখকর ছিল না। বাবা বলেছিল, ‘ঠিক আছে, আমি সব ভুলে যেতে পারি। তোমাকেও স্বীকার করতে পারি। তবে তোমাকে ওই ছেলেকে ছেড়ে ফিরে আসতে হবে।’
বাবার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিল অর্পিতা। মনের ঝড় সামলে অনেক কষ্টে বলেছিল, ‘সরি বাবা, তোমার শর্ত মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন তোমায় বিরক্ত করব না। তোমার মনে আমি মৃত হয়েই বেঁচে থাকব।’
সুব্রত বুঝত অর্পিতার যন্ত্রণার কথা। তাকে না জানিয়ে একিদন সে তার বাবার সঙ্গে দেখা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। চরম অপমান করে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল অর্পিতার বাবা।
তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। অনেক কিছু ঘটে গেছে এই কয়েক বছরে। অর্পিতা এসএসসি দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে। একসময় সংসারে আসে সায়ন। দেখতে দেখতে সে এবার মাধ্যমিক দিয়ে দিয়েছে। সামনে তার রেজাল্ট। এখন তাদের যতকিছু স্বপ্ন ছেলেকে ঘিরে।
যোগাযোগ না থাকলেও বাবারবাড়ির বেশ কিছু খবর তার কানে আসে। অর্পিতার বড়দা বিদেশে পাকাপাকি আস্তানা গেড়েছে। ছোড়দা মুম্বইতে। প্রথম প্রথম তারা বাড়ি আসত। এখন আর আসে না। বাবা-মায়ের তেমন করে খোঁজখবরও নেয় না। সবথেকে আশ্চর্যের অর্পিতার সঙ্গেও তারা একবারও যোগাযোগ করেনি। অর্পিতার বাবা বেশ কয়েক বছর আগে রিটায়ার্ড করেছেন। প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। যা উপার্জন করেছেন সংসার চালাতে আর ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে খরচ করেছেন। সঞ্চয় দূরে থাক, উল্টে ধারও করতে হয়েছে তাকে। এখন সেই ছেলেরাই পর হয়ে গেছে। নিজের সামান্য পেনশনই ভরসা। বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রী এটা-ওটা অসুস্থতা নিত্যসঙ্গী। কোনোরকমে জীবন কাটছিল তাদের। কিন্তু এতসবের মাঝেও নিজের জেদ আর মিথ্যা জাতপাতের দম্ভ থেকে একচুলও নড়েননি অর্পিতার বাবা।

৩.
তিনদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর জ্ঞান ফেরে অর্পিতার বাবার। তবে ডান হাত প্যারালাইজড হয়ে গেছে, সঙ্গে মুখের ডানদিকটাও বেঁকে গেছে। দিন সাতেক নার্সিংহোমে কাটানোর পর তিনি বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে শরীর খুব দুর্বল। নিজে থেকে চলাফেরার ক্ষমতা নেই। নিয়মিত ঔষধ ছাড়া ফিজিওথেরাপি চলছে। ডাক্তার বলেছে প্যারালাইজড অংশের কিছুটা উন্নতি হলেও হতে পারে। মায়ের বয়স হয়েছে। বাড়িতে বাবার দেখাশোনো করার জন্য একজন নার্স ঠিক করে দিয়েছে অর্পিতা।
এই কদিনে বিস্তর টাকা খরচ হয়েছে এবং সেটা করেছে অর্পিতা আর সুব্রত। সুব্রতর বোঝানোয় অর্পিতা শেষমেষ বোঝে, নার্সিংহোমে আসে। অর্থের কথা ভাবেনি। বাবাকে সারানোর জন্য যা যা করা দরকার বাকি রাখেনি। তার গুণী দাদারা কেউ আসেনি। না, অর্পিতা তাদের ফোন করেনি। মা যোগাযোগ করেছিল। বড়ছেলে জানিয়ে দিয়েছে তার পক্ষে বিদেশ থেকে আসা এখনই সম্ভব নয়। ছোটছেলে বাবার অ্যাকাউন্টে হাজার পঁচিশ টাকা পাঠিয়ে দায় সেরেছে। তারও নাকি আসার সময় নেই। ছোড়দার টাকা অবশ্য তোলেনি অর্পিতা। যা খরচ হয়েছে সে আর সুব্রত মিলে করেছে। তবে এতকিছু করলেও মন থেকে ক্ষতের চিহ্নটা মুছে ফেলতে পারেনি।
হাসপাতালে পৌঁছে মাকে দিয়ে সে একটা শর্ত করিয়ে নিয়েছিল, তারা যে বাবাকে সারিয়ে তোলার জন্য এই খরচাপত্র করেছে তা যেন বাবাকে কোনোদিন না বলে। এমনকি তারা যে হাসপাতালে এসেছিল এই ব্যাপারটাও বাবার কাছে গোপন রাখতে বলে। তা না করলে সে আসবে না বলে জানায়। মন না চাইলেও অর্পিতার মা সে শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়।

৪.
কীভাবে অনুষ্ঠানটা করবে তা নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারছিল না সুব্রত আর অর্পিতা। সুব্রত চায় বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে। ওদিকে অর্পিতার একদমই ইচ্ছা নয় বাড়িতে ঝামেলা বাড়াতে। আর সেটা নিয়েই দুজনের মধ্যে মতিবিরোধ হচ্ছিল।
পার্টিটা সায়নের রেজাল্ট উপলক্ষ্যে। মাধ্যমিকে অসাধারণ রেজাল্ট করেছে সে। জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। বাবার অসুস্থতার সময়েই রেজাল্ট বেরিয়েছিল। বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ছেলের রেজাল্টের আনন্দটা উপভোগ করার সুযোগ ছিল না। এদিকে সুব্রতর অফিসের কলিগ, অর্পিতার স্কুলের কলিগরা ধরেছিল ছেলের এতো ভালো রেজাল্টের পর একটা পার্টি দিতে। ব্যাপারটা তাদেরও মাথায় ছিল। ছেলের রেজাল্ট সেলিব্রেট করার ইচ্ছে ছিল তাদের। কিন্তু সেসব নিয়ে তখন ভাবার সময় পায়নি। আজ রবিবার। দুজনের ছুটি। সায়নও পড়তে গেছে। ওদিকে বাবার অসুস্থতার ঝামেলাটাও কমেছে। তাই দুজনে বসেছে পার্টিটা কীভাবে করা যায় সেই আলোচনায়।
অর্পিতার বাবার আসুস্থতার পর প্রায় দিন কুড়ি কেটে গেছে। তার বাবা এখন আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ। একটু-আধটু চলাফেরাও করতে পারে। তবে ডান হাত আর মুখের ব্যাপারটার কোনো উন্নতি হয়নি প্রায়। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চলছে। এসব খবর তার মা ফোন করে জানিয়েছে। তবে বাবার ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামায়নি অর্পিতা। সে নিয়ে মাথাব্যাথাও আর নেই। কেবলমাত্র মায়ের কথা ভেবে সে এতকিছু করেছে। এ নিয়ে আর বেশি ভাবতেও চায় না।
সহসা তাদের কথাবার্তার মাঝে অর্পিতার মোবাইল বেজে ওঠে। এসময় ফোন আসায় একটু বিরক্ত হয় অর্পিতা। তবুও কলটা ধরতে হয়। সবুজ বাটন টিপে ‘হ্যালো’ বলে ফোনটা কানে চেপে ধরে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব নেই। আরও দুবার ‘হ্যালো’ বলার পরও যখন ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না তখন অর্পিতা বেশ বিরক্তির সুরে বলে, ‘কে বলছেন? কথা বলছেন না কেন? কিছু বলার থাকলে বলুন না হলে ফোনটা কেটে দিন।’
তবুও কোনো জবাব আসে না। মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে অর্পিতা প্রায় লাইনটা কেটে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় ওপাশ থেকে একটা ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘অপু…!’
একটু চমকে ওঠে অর্পিতা। তার সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। কন্ঠস্বর মহিলার নয়। তাহলে…! কিন্তু আবেগ সংযত করতে বেশি সময় লাগে না তার। তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে সে।
ওপাশ থেকে ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসে। ‘অপু, আমি বাবা বলছি।’
অর্পিতা কোনো জবাব দেয় না। তার চোখ-মুখ আরও দৃঢ় হয়। অর্পিতার বাবা ক্ষীণ কন্ঠে বলে চলেন, ‘অপু, আমি সব জেনে গেছি। তোর মা তোকে কথা দিয়েছিল। কিন্তু ওর কোনো দোষ নেই। আমার জেদে বাধ্য হয়েছে সত্যিটা বলতে।’
অর্পিতা কঠিন সুরে বলে, ‘এসব কথা ছেড়ে কীজন্য ফোন করেছ সেটা তাড়াতাড়ি বলো। আমার অনেক কাজ আছে।’
‘জানি, তুই আমার ওপর রেগে আছিস। সেটা স্বাভাবিকও। তবুও না ফোন করে পারলাম না।’
‘না করলেই পারতে। তাহলে আমি বেশি খুশি হতাম। তুমি যদি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাও, তাহলে ভুল করছ। ওসব কথা আমি শুনতে চাই না।’
‘না না, সেজন্য ফোন করিনি।’
‘তাহলে…!’
‘একটা অনুরোধ ছিল। রাখবি?’
‘অনুরোধ! কী অনুরোধ?’
‘একবার তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।’
‘আমাকে দেখতে চাও!’ অর্পিতার গলায় কিছুটা ব্যঙ্গের সুর! ‘তুমি কী করে ভাবলে তুমি ডাকলেই আমি চলে যাবো’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘না না, তোকে আসতে বলছি না। আমি একবার তোর বাড়ি যেতে চাই।’
‘অসম্ভব।’ প্রতিবাদের সুরে বলে ওঠে অর্পিতা। ‘সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার বাড়িতে তুমি আসতে চাইছো কেন? কী দরকার তোমার আমার কাছে?’
‘তোদের প্রতি অনেক অন্যায় করেছি, অবিচার করেছি। একবার তোর মুখোমুখি হয়ে মাফ চাইতে চাই।’
‘আজ এত বছর পর তোমার মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর আন্যায় করেছ, অবিচার করেছ! হঠাৎ তোমার এমন মনে হল কেন? মনে রেখ তোমার চোখে আমি মৃত। আর যে কারণে আজ বেঁচে থেকেও আমি তোমার চোখে মৃত, সেই অবস্থার কোনো হেরফের ঘটনি। তাহলে তোমার এমন মনে হওয়ার তো কারণ নেই।’
অর্পিতার বাবা কোনো জবাব দিতে পারেন না। অর্পিতা কঠিন সুরে বলে চলে, ‘এই দীর্ঘ্য কুড়ি বছরে কিন্তু তোমার মনে হয়নি তুমি অন্যায় করেছ। আমিও বলছি না তুমি অন্যায় করেছো। তোমার দৃষ্টিভঙ্গীতে তুমি ঠিক। আমার ভাবনায় আমি। আর আমাদের মতবিরোধের কারণের কোনো পরিবর্তন যখন ঘটেনি তখন আর ভুল বোঝাবুঝির প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?’
একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যায় অর্পিতা। বৃদ্ধ ক্ষীণ সুরে আমতা আমতা করে বলেন, ‘তোর কথার কোনো জবাব নেই আমার কাছে। আমি যে ব্যবহার করেছি তাতে এসব কথা বলা তোর ন্যায়সঙ্গত। তোর রাগ করাটা স্বাভাবিক।’
‘রাগ!’ ফুঁসে ওঠে অর্পিতা, ‘আমি রাগের কথা বলছি না। রাগ-আবেগ সরিয়ে আমি যুক্তিপূর্ণভাবে কথা বলছি। বলতে পারো কোন যুক্তিতে একটা মরা মানুষ তোমার সামনে জীবন্ত হয়ে ফিরে আসবে!’
বৃদ্ধ কোনো জবাব দেয় না। অর্পিতা বলে চলে, ‘এতিদন তোমার মনে হয়নি তুমি ভুল করেছ। এতদিনে তুমি আমাদের কোনো খোঁজখবর নাওনি। আজ আমার জন্য হঠাৎ আবেগে তোমার প্রাণ কেঁদে উঠছে কেন? আমি টাকা খরচ করে তোমাকে সারিয়ে তুলেছি বলে? তুমি কি ভাবো আমি অর্থ দিয়ে সম্পর্ক কিনতে গিয়েছিলাম?’
এত কঠিন কথা অর্পিতা বলবে বৃদ্ধ ভাবতে পারেননি। কিছু বলতে পারেন না তিনি। অর্পিতা বলে চলে, ‘তুমি যদি তাই ভাবো, তাহলে ভুল করছ। আমি অর্থের বিনিময়ে সম্পর্ক গড়তে যাইনি। অর্থের দম্ভও দেখাতে চাইনি, তোমার ওপর করুণা দেখানোরও কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আরও স্পষ্ট করে বলি তোমার প্রতি কর্তব্যবোধেও আমি এসব করিনি।’
একটু থামে অর্পিতা। নিজের মধ্যেকার যন্ত্রণার ঝঞ্ঝাটাকে একটু সামলে নিয়ে বলে, ‘সত্যি বলতে কী কর্তব্যবোধের প্রশ্নই আসে না। যে মরে গেছে সে কী করে কর্তব্য করবে? আমি তা করতেও চাইনি। আমি যা করেছি তা শুধু একটা অসহায় নারীর কথা ভেবে। মায়ের চোখের জল, মাথার সিঁদূর আর ভালোবাসার কাছে নিজেকে পাষাণ রাখতে পারিনি।’
একটু থামে অর্পিতা। ফোনের ওপাশে কোনো কথা নেই। তবে নীরব অশ্রুপাতের শব্দ শুনেত পায় অর্পিতা। তাতে তার মন গলে না। আগের মেজাজে বলে চলে, ‘একটা কথা ভেবে দেখো, জীবনের প্রায় সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া এক মহিলা সিথির সিঁদূর আর ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে সেদিন পাগলের মতো কান্নাকাটি করেছিল। আর সদ্য বিয়ে করা আমাকে তুমি বলেছিলে সেই সিঁদূর আর ভালোবাসাকে বলি দিতে। ভালোবাসা কী তা তুমি কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করো না, আজও বোঝো না।’
আর বৃদ্ধ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কান্নাভেজা সুরে বলেন, ‘আমি বিরাট ভুল করেছি মা। আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি অনুতপ্ত। আমাকে একটিবার তোর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দে।’
‘না, আমি তা মোটেও চাই না। ভুল যদি তুমি সত্যি বুঝতে পারতে সেটা তোমার অনেক আগে বোঝা উচিত ছিল। তা তুমি পারোনি। এখন যেটাকে তুমি ভুল বুঝতে পারা বলছে, সেটা আসলে তোমার অসহায়ত্ব, একাকীত্ব আর দুর্বলতা। তোমার ছেলেরা এখন যদি তোমার পাশে থাকত তাহলে হয়ত এই ভুল বোঝার উপলব্ধি তোমার মধ্যে আসত না। আমার কথা খারাপ লাগতে পারে, তবে এটাই সত্যি।’
অর্পিতা চুপ করে। বৃদ্ধ ক্ষীণ সুরে বলেন, ‘একটিবার কি মুখোমুখি হতে পারি না?’
‘না। যেমন আছি সেটাই ভালো। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে শিখে গেছি। আর, এতিদন তোমার চোখে মৃত হয়ে যখন বেঁচে থাকতে পেরেছি, ভবিষ্যতেও তা পারব। তাই বলছি, মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা মন থেকে সরিয়ে দাও। তাতে তোমারও জেদ বজায় থাকবে। আমাকেও হেরে যেতে হবে না।’
ওপাশের কন্ঠস্বর চূপ। শুধু নীরব কান্নার সুর ভেসে আসে। অর্পিতা নিজেকে সংযত করে শান্ত কন্ঠে বলে, ‘নিজের শরীরের খেয়াল রেখো। আর কোনোদিন আমাকে ফোন করো না। তাহলে আমিও ভালো থাকব।’
লাইনটা কেটে দেয় অর্পিতা। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার দুচোখ দিয়ে বন্যার স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়ে। হতবাক সুব্রত কী বলবে ভেবে পায় না।

Share This
Categories
গল্প

খুঁটি : দিলীপ রায়।

দুলি সমীরনকে চেপে ধরলো । যেভাবে হোক তাকে বিয়ে করতে হবে । নতুবা দুলির বাবা চৌরিগাছার নিতাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন । সমীরন ছাড়া অন্য নিতাই, বেতাই, খেতাই, কেতাই, কাউকে দুলির পছন্দ না । সমীরনকে দুলির সাফ কথা, “এখনি তাকে বিয়ে করতে হবে ।“ সমীরন পড়ে গেলো মহা ফাঁপরে । দুলিকে অন্তর দিয়ে ভালবাসে এটা ঠিক, কিন্তু এই মুহূর্তে দুলিকে বিয়ে করা সমীরনের ভাবনার বাইরে । স্বাভাবিকভাবে সমীরন পড়লো দুশ্চিন্তায় । কী করবে, সিদ্ধান্তে দোদুল্যমান ?
তাদের ভালবাসা, হাই স্কুল থেকে । অনেকদিন এমন হয়েছে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুজনে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে ঠিক স্কুল ছুটির সময় বাড়ি ফিরেছে । কেউ কিচ্ছুটি টের পায়নি । একমাত্র জানতো যুথিকা । যুথিকা দুলির কাছের বান্ধবী । সমীরন ও দুলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যুথিকা জানলেও, ঘুণাক্ষরে কখনই তাদের বাড়িতে জানিয়ে দিতো না । অন্যদিকে দুলির মা-বাবা শুধুমাত্র জানতেন, যুথিকার সাথে দুলির প্রগাঢ় বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের ।
বিয়ের সম্বন্ধটা দুলির বাবার মতে, রাজযোটক । নিতাই নিজের গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক । বাবার একমাত্র ছেলে । নিতাইয়ের কোনো বোন নেই । নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার । তা ছাড়া চাষের জমি জায়গা যথেষ্ট । গাঁয়ে সচ্ছল পরিবার । হালের বলদ ছাড়া গাই গরু তিনটে । দুধ কিনে খেতে হয় না । বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন রকমের ফলের গাছে । আম, জাম, কাঠাল, লিচু, পেয়ারা, ছাড়া নারিকেল, পাতিলেবু, জামরুল, ইত্যাদি ফলের গাছ । তাই দুলির বাবা এই বিয়ের সম্বন্ধটা কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাইছেন না । দুলির টালবাহানা লক্ষ করে দুলির বাবা ঝুঁকি নিলেন না । সেই কারণে, দুলির প্রিয় বন্ধু যুথিকাকে বাড়িতে ডাকলেন এবং দুলিকে বিয়েতে রাজী করাতে বললেন ।
সমীরন দুশ্চিন্তায় ছটফট ! সদ্য তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী । দুলি বি-এ পাশ । অথচ কেউ চাকরি পাওয়ার মতো অবস্থায় নেই । চাকরি না পেয়ে বিয়ে করলে সমীরনের বাবা তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন । সমীরনের বাবা রাশভারি মানুষ । একদম ধানাই পানাই পছন্দ করেন না । তাঁর মোদ্দা কথা, “চাকরি পেলেই তবে বিয়ে !” ভীষণ দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন সমীরন ।
বিয়ে করার ব্যাপারে সমীরনের অযথা ঢিলেমি অবলোকন করে দুলি ভীষণ উতলা হয়ে উঠলো । দুলি সর্বদা চনমনে । যার জন্য দুলির ঢাকঢাক গুড়গুড় একদম নাপসন্দ । দুলির নিজের উপর অগাধ আস্থা । তার আত্নবিশ্বাস ষোলোআনা । যার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে দুলি এক-মিনিটও সময় নষ্ট করে না ।
( ২ )
তাই সমীরনকে ডাকলো দুলি ।
হঠাৎ জরুরি তলব ?
“আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবলে ?” দুলি সোজাকথা সোজাভাবে সরাসরি সমীরনকে জিজ্ঞাসা করলো ?
“কয়েকটা দিন সময় দাও ?” সমীরনের কন্ঠে শৈথিল্যের সুর ।
তোমার সময় চাওয়ার অজুহাত আমার ভাল লাগছে না । তোমার অযথা ঢিলেমির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না ! তুমি আমাকে ভালবাসো, আমি তোমাকে ভালবাসি । এটাই যথেষ্ট ! সুতরাং বিয়েতে তোমার গড়িমসি কেন ?
“কিন্তু বিয়ের পরে পেট্‌ চলবে কী করে ?” উদ্বিগ্ন মুখে সমীরন দুলির দিকে তাকিয়ে বললো ।
সেই চিন্তায় বসে থাকলে তোমার দুলি হাত-ছাড়া হয়ে যাবে । বেপাড়ার নিতাই এসে দুলিকে বিয়ে করে পালাবে । তখন বুঝবে মজা ! গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ।
“তাই বলে বিয়ের পরে তোমাকে নিয়ে ভিক্ষা করবো ?”
মহা আহাম্মকের পাল্লায় পড়লাম ! এতই যখন ভীতু কার্তিক, তাহলে উপার্জনের ভাবনা আমার উপর ছেড়ে দাও ?
সমীরন মৃদু হেসে বলল, “তুমি আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবে !”
সবাই জানে, বিয়ে করাটাই ফাঁসিকাঠে ঝোলার ন্যায় । দায়িত্বের বোঝা কাঁধে চাপে । তুমি কী সেটা বোঝো না, নাকি ‘না-বোঝার’ ভান করো ?
( ৩ )
তারপর নিতাইয়ের সাথে দুলির বিয়ের কথা পাকা । বিয়ের দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে । দুলি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তার বাবা একরোখা । মেয়ের বিয়ে তিনি নিতাইয়ের সঙ্গে দেবেন । দুলির নিষেধ করার পেছনে যুক্তি ছিলো যথেষ্ট । কেননা সে চেয়েছিলো এম-এ পাশ করার পর নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে । কিন্তু কে শোনে কার কথা ! বাবা তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে অটল ।
তারপর সমীরনের ঢিলেঢালা মনোভাব অবলোকন করে সাহসী দুলি বিয়ের আগের রাত্রে বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা সমীরনের শোওয়ার ঘরে !
দুলিকে অতো রাত্রিতে নিজের ঘরে দেখে সমীরন ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা ! আতঙ্কে দিশেহারা । সমীরন ভাবছে, বাড়িতে কেউ দুলিকে তার ঘরে দেখলে বিপদের শেষ নেই । সমীরনের বাবা কোনোরকমে জানতে পারলে তাকে আস্ত রাখবেন না । ভীষণ কড়া মেজাজের মানুষ ।
দুলি আর সাতপাঁচ না ভেবে সমীরনের ডান হাত ধরে বললো, “চলো ।“
“কোথায় ?” তখনও সমীরন কিংকর্তব্যবুমূঢ় । সিদ্ধান্তে দিশাহারা !
‘কোথায় যাবো জানা নেই, তবুও আমার সঙ্গে চলো । তোমার মুরোদ আমার বোঝা হয়ে গেছে । তুমি একটা ভীতু ক্যাবলা-কার্তিক ! সুতরাং সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে । আমার উপর ভরসা রাখো ।
“বলবে তো, কোথায় গিয়ে উঠবো ?” সমীরনের ভয়ার্ত কন্ঠ !
“জাহান্নামে … ?” রাগের সুরে ধমক দিলো সমীরনকে । তাকে কথা বলার সুযোগ দিলো না । সমীরনের ডান হাতটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে দুলি বললো, “ চোখ বুজে আমার সাথে চলো ।“
দুলির জেদে ঐ রাত্রিতে দুজন অজানা পথে পাড়ি দিলো । সমীরন তখনও সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্থ ! দুলির তাড়নায় বাড়ি থাকে বের হয়ে দূরপাল্লার বাসে উঠে বসলো । ভোর বেলায় দুজনে, পলাশীতে ।
( ৪ )
অজানা, অচেনা জায়গা । গাঁয়ে গঞ্জের মাঝখানে পলাশী শহর ।
অগত্যা তারা পলাশী রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে আশ্রয় নিলো ।
সমীরনের শরীর কূঁড়েমিতে ভরা । কাজে কর্মে ঢিলা । গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপারেই তার আঁটোসাঁটো মনোভাব নেই । বড় বড় কথা, অথচ কথার বাস্তবায়নে অপারগ । তাই দুলি নিজেই নিজেদের বেঁচে থাকার পথ ভাবতে লাগলো, অতঃপর কী করা যায় ?
হাতে মাত্র জমানো কয়েকটা টাকা ।
সমীরনের উপর ভরসা না করে দুলি পলাশী স্টেশনের ১নম্বর প্লাটফর্মে আটার রুটি ও তরকারির দোকান খুললো । স্বল্প পুঁজিতে দোকানের শুভযাত্রা । মাথার উপর বড় ছাতা টাঙিয়ে তাদের দোকানের শুভারম্ভ । নিমেষেই, বলা চলে, এক সপ্তাহের মধ্যে দোকানের হালহকিকৎ চাঙা ! দোকানের জনপ্রিয়তা দেখে সমীরন অবাক ! তাই অবাক বিস্ময়ে দুলিকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো, “তোমার এতটা আত্নবিশ্বাসের রহস্য কী ?”
সবটাই মা । মা আমাদের শিখিয়েছেন, “আত্ননির্ভরতা মানুষকে কীভাবে বাঁচতে শেখায় ! আত্নবিশ্বাস কতো বড় পথ চলার খুঁটি ।“
———–০———-

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর বিশ্বরূপ দর্শন দান : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

সর্বাবতারী নদিয়াবিহারী শ্রীশ্রীগৌরহরি নদীয়ার নবদ্বীপে সর্বদা কীর্তনবিলাস করে চলেছেন । নগরে, চত্বরে, জলে, বনে—-যেখানেই তিনি কৃষ্ণনাম শ্রবণ করেন অমনি নিরবধি তাঁর শ্রীনয়ন দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যায় । নবদ্বীপের ভক্তসমাজ তাঁর দশা দেখে বলেন, বিশ্বম্ভর রায় যে ভক্তিরসময় হয়ে গেছেন ! নিমাই পণ্ডিত কারোর মুখে ‘হরি’ শব্দ শ্রবণ করলেই নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না আর । অশ্রু-কম্প-পুলক-বৈবর্ণ‍্য আদি অষ্ট সাত্ত্বিক ভাবের প্রকাশ হয় সর্বাঙ্গে তাঁর । ধূলায় বিলুন্ঠিত হন, গড়াগড়ি যান । যে আবেশ দর্শন করলে ব্রহ্মাদি দেবতারা পর্যন্ত ধন্য হন —-সেই দেবদুর্লভ দর্শন সৌভাগ্যবান নদীয়াবাসী লাভ করেন ।
একদিন কীর্তনবিলাসী গৌরের ভাবেতে মূর্ছাগ্রস্ত অবস্থা এমন । পার্ষদরা তাঁকে নিয়ে চলে এলেন তাই গৃহে । দ্বার দিয়ে শুরু করলেন কীর্তন । অনন্ত ভাব প্রকট তখন তাঁর অন্তরে । নির্দিষ্ট কোন রসে, কোন ভাবে তিনি যে বিহ্বল হয়ে আছেন —-তা কেউ অনুধাবন করতে পারেন না । কখনও তিনি বলছেন —-“আমিই তো মদনগোপাল,” কখনও বলছেন—- “আমি সর্বকালের কৃষ্ণদাস,” আবার কখনও “গোপী !গোপী !গোপী!” বলে জপ করেন । কখনও কৃষ্ণের নাম শ্রবণ করে কেঁপে ওঠেন তেজে ; বলতে থাকেন—- “কোথাকার কৃষ্ণ তোর ! সে তো মহাদস্যু ! শঠ, ধৃষ্ট কৈতব একজন ! কে তাকে ভজনা করবে শুনি ! নারী মন জয় করে নারীদেরই নাক কান কেটে দেয় ! লোভীর মতো বালির প্রাণ কেড়ে নিল ! আমার কোন দরকার নেই চোরের কথায় !” এরপর যদি কারোর মুখে পুনরায় কৃষ্ণ শব্দ শোনেন তো ক্রোধে তাঁকে তিরস্কার করতে থাকেন । আবার “গোকুল গোকুল” বলতে থাকেন ক্ষণে ক্ষণে । কোনদিন বলেন “বৃন্দাবন, বৃন্দাবন” । কখনও বা আনন্দকন্ঠে “মথুরা মথুরা” বলেন । আবার মৃত্তিকায় শ্রীকৃষ্ণের ত্রিভঙ্গ আকৃতি এঁকে, সেদিকে চেয়ে রোদন করতে থাকেন । কখনো বলেন, “এ কী চারিদিকে যে অরণ্য ! এই দেখো অরণ্যে সিংহ, ব্যাঘ্র, ভাল্লুকের গণ সব ।” দিনের বেলাকে রাত্রি বলেন, আবার রাত্রিবেলাকে দিন । —-এমন আবেশ সর্বক্ষণ তাঁর শরীরে ; ভক্তিবশ হয়েছেন বিদ্যাহঙ্কারী নিমাই পণ্ডিত এখন । ভক্তরা তাঁর কৃষ্ণপ্রেমাবেশের এমন দশা দেখে ক্রন্দন করতে থাকেন গলা জড়াজড়ি করে । যে আবেশ দর্শন করা ব্রহ্মাদিদেবের অভিলাষ —-সে আবেশ দর্শন করেন নবদ্বীপের বৈষ্ণবের দাসেরা ।
গৌরহরি নিজগৃহে আর কতক্ষণই বা থাকেন ! তিনি দিনের বেশীরভাগ সময়ে ভক্তদের গৃহেই পড়ে থাকেন । গৃহে যেটুকু সময় ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন —-তা কেবল তাঁর জননীকে প্রবোধ দিতে চেয়ে, মাতৃসুখ প্রদানের কারণে । ওদিকে তাঁকে নিয়ে বৈষ্ণবদের আনন্দ আর ধরে না । এ কী অপরূপ কৃষ্ণপ্রেম ! অনির্বচনীয় ! অদ্বিতীয় ! অভাবনীয় ! এমন ভগবদ্ প্রেম কোন মানুষের মধ্যে হতে পারে তা জানা ছিল না কারোর । ঈশ্বরাংশ না হলে শরীরে এমন প্রেম প্রকট হওয়া তো অসম্ভব !
গৌরহরির অভিন্ন প্রাণ নিত‍্যানন্দ তো মত্ত সিংহ এক ! তিনি সর্বদা ছায়ার মত গৌরাঙ্গের পাশে থাকেন । তাঁকে নিয়ে গোরা রায় অনন্ত লীলায় ঘরে ঘরে মেতে থাকেন । আর থাকেন গদাধর পণ্ডিত, আচার্য অদ্বৈত ও অন‍্যান‍্য ভক্ত মহাজনেরাও ।
একদিনের ঘটনা । গোপীভাব নিয়ে অদ্বৈত নৃত‍্য করছেন শ্রীবাস প্রাঙ্গণে। আর, সকলে মহা অনুরাগের সঙ্গে কীর্তন করছেন । আহা ! অদ্বৈতের নৃত‍্যে সে কী ভাব ! কী আর্তি ! তিনি বারংবার দন্তে তৃণ ধরে দৈন্য করতে করতে বিবশ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন । আর তাঁর দশা দেখে ভক্তরা আরও আবেগসহ গীত গাইছেন । দুই প্রহরেও নৃত‍্যের বিরাম হচ্ছে না । অবশেষে ভক্তরা শ্রান্ত হলেন । সকলে মিলে আচার্যকে স্থির করলেন । নৃত্যের বিশ্রাম হল । অদ্বৈতের চারপাশে ভক্তগণ ঘিরে বসলেন । ধীরে ধীরে অদ্বৈত শান্ত হলেন । সবকিছু স্বাভাবিক হলে শ্রীবাস, রামাই আর সকলে গেলেন গঙ্গাস্নান করতে । একলা অদ্বৈত বসে রইলেন শ্রীবাস গৃহেই । কিন্তু, বাইরে তাঁকে স্থির মনে হলেও ভিতরে-ভিতরে, অন্তরে-অন্তরে তাঁর আর্তির এতটুকুও কম হয় নি, বরং বেড়ে চলেছে তা। সে সময় শ্রীগৌরহরি সেখানে ছিলেন না । তিনি ছিলেন নিজের গৃহে অথচ অন্তর্য‍ামী গৌরহরি অন্তরে অনুভব করলেন অদ্বৈতের আর্তি । ভক্ত-আর্তি পূর্ণকারী সদানন্দ রায় চলে এলেন শ্রীবাস গৃহে যেখানে অদ্বৈত এতক্ষণ ধরে গড়াগড়ি দিয়ে এখন বসে আছেন খানিক শান্ত-ভাব দেখিয়ে । প্রাণনাথকে, ইপ্সিত ধনকে নয়ন সম্মুখে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না আচার্য‍ের যেন । হৃদয়ের ভাবতরঙ্গ উথলে উঠলো । নয়ন আবেগে অশ্রুপূর্ণ হল । মহাপ্রভু অদ্বৈতের মন বুঝে তাঁকে নিয়ে এলেন শ্রীবাসের বিষ্ণুমন্দিরে । দ্বার ভেজিয়ে দিলেন । তারপর নিজপ্রিয় ভক্তের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন—- ”বলো গো আচার্য‍ ঠাকুর ! কি তোমার ইচ্ছা ? কি তুমি চাইছো বলো তো ? আমার থেকে তোমার কি প্রত্যাশা ?”
অদ্বৈত বললেন, “আমি আর কী চাইবো প্রভু ! আমার সবই তো তুমি ! আমি শুধু তোমাকেই চাই । তুমিই তো সর্ব দেব-সার, সর্ব বেদ-সার ।”
মহাপ্রভু—- “আমি তো তোমার সম্মুখে সাক্ষাৎ আছি, এই দেখো । আর কি চাও, সত্য করে বলো তো !”
অদ্বৈত—- “হ্যাঁ, প্রভু ! তুমি ঠিকই ধরেছো ! আমার আরও কিছু অভিলাষ আছে । সুসত‍্য বচন তোমায় বলছি এবার শোনো । আমি জানি এ তত্ত্ব যে তুমিই সর্ব বেদ-বেদান্তের সার । তবু আমি তোমার কিছু বৈভব দর্শন করতে চাই ।”
মহাপ্রভু—- “কী চাইছো এবার খুলে বলো ।”
অদ্বৈত—- “প্রভু, তুমি অর্জুনকে পূর্বে যা দেখিয়েছিলে, আমি তা দেখতে চাই । তুমি নিশ্চয়ই এবার বুঝে গেছ আমার হৃদয়ের অভীপ্সা ! আমি তোমার বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাই । তুমি কী আমার এই বাসনা পূরণ করবে না প্রভু !”
অদ্বৈতের কথা শেষ হতে না হতে তিনি দেখলেন তাঁর সম্মুখে বিশাল এক রথ । চতুর্দিকে সৈন্যদল মহাযুদ্ধে রত হয়ে আছে — সমরক্ষেত্র। আর রথের উপর গৌরাঙ্গ র‍য়েছেন শ্যামল সুন্দররূপে । তাঁর চতুর্ভুজ । শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারণ করে আছেন চার ভুজে । মহাপ্রভুর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখতে পেলেন অদ্বৈত। চন্দ্র, সূর্য, সিন্ধু, গিরি, নদী, বন-উপবন দেখতে পেলেন তাঁর শরীরে । কোটি কোটি চক্ষু , বহু-বহু মুখ পুনরায় পুনরায় দেখছেন । দেখলেন শ্যামল সুন্দরের চরণের কাছে বসে তাঁকে দর্শন করছেন বিস্মিত নয়নে অর্জুন ও স্তুতি করছেন । প্রভুর মুখে মহা অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে রয়েছে । সেই অগ্নির তেজে সকল পাষণ্ড, দুষ্টগণ পতঙ্গের ন্যায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে । যে পাপীষ্ঠ অপরকে নিন্দা করে, অপরের প্রতি দ্রোহ আচরণ করে—-শ্যামল সুন্দর শ্রীচৈতন্যের মুখাগ্নিতে পুড়ে মরছে তারা সকলে ।
“বলিতে অদ্বৈত মাত্র দেখে এক রথ।
চতুর্দিকে সৈন্য দল মহাযুদ্ধ পথ।।
রথের উপরে দেখে শ্যামল সুন্দর।
চতুর্ভুজ শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধর।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখে সেই ক্ষণে।
চন্দ্র সূর্য সিন্ধু গিরি নদী উপবনে ।।
কোটি চক্ষু বহুমুখ দেখে পুনঃ পুনঃ ।
সম্মুখে দেখেন স্তুতি করয়ে অর্জুন।।
মহা অগ্নি যেন জ্বলে সকল বদন।
পোড়য় পাষণ্ড পতঙ্গ দুষ্টগণ।।
যে পাপিষ্ঠ পর নিন্দে পর দ্রোহ করে।
চৈতন্যের মুখাগ্নিতে সেই পুরি মরে।।
এই রূপ দেখিতে অন্যের শক্তি নাই ।
প্রভুর কৃপাতে দেখে আচার্য গোঁসাই।।”
(চৈতন্য ভাগবত , মধ্য, ২৪)
এমন দর্শন করার শক্তি কার আছে ! একমাত্র মহাপ্রভুর কৃপা শক্তিতেই আচার্য গোসাঞি দেখতে সমর্থ‍্য হয়েছিলেন । প্রেমসুখে, অচিন্ত‍্যনীয় দৃশ্য দর্শন করে অদ্বৈত তখন ক্রন্দন করছেন । তিনি দন্তে তৃণ ধারণ করে পুনরায় পুনরায় মহাপ্রভুর প্রতি দাস‍্য ভক্তি প্রার্থনা করতে থাকলেন ।
ওদিকে শ্রীনিত্যানন্দ সেসময় পর্য‍্যটন সুখে নদীয়ায় ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন । মহাপ্রভুর প্রকাশ তাঁর তো অজানা নয় । তিনি অনুভব করে ফেলেছেন যে, প্রাণগৌর তাঁর, বিশ্বরূপ ধারণ করেছেন । তিনি বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ হাজির হলেন শ্রীবাস গৃহের বিষ্ণুমন্দিরে । এসেই মত্ত হস্তীর ন্যায় দ্বারে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে থাকলেন । ভিতরে মহাপ্রভু অনুধাবন করে ফেললেন তাঁর অভিন্ন স্বরূপ, প্রাণের দোসর নিত‍্যানন্দ এসে দাঁড়িয়েছেন । তিনি সত্ত্বর দ্বার উন্মুক্ত করলেন । নিত‍্যানন্দ গৌরাঙ্গের অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দর্শন করেই দণ্ডবৎ হয়ে পড়ে গেলেন । আবেশে, আনন্দে তাঁর আঁখি বুজে গেছে । কম্পিত কলেবর । পুলকিত প্রাণ ।
মহাপ্রভু—- “ওঠ নিত‍্যানন্দ ! ওঠো ! আমার সকল আখ্যান তোমার তো অজানা নয় কিছুই । তুমি তো সবই জানো ! তবে কেন এমন দৈন্য করছো ! তুমি তো আমার প্রাণ ! যে ব‍্যক্তির তোমাতে প্রীতি—- সে আমায় পায় । তোমার থেকে প্রিয়তম আমার যে আর কিছুই নেই । যে তোমাতে আর অদ্বৈতে ভেদ বুদ্ধি করে —-তার অবতারবাদ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান নেই । সে মূর্খ ।”
নিত‍্যানন্দ ও অদ্বৈতকে একসাথে পেয়ে বিশ্বম্ভর বিষ্ণু গৃহের অভ‍্যন্তরে আনন্দে নৃত‍্য করতে থাকলেন । হুঙ্কার গর্জন করছেন আর বলছেন—- “দেখ ! দেখ !” আর অদ্বৈত ও নিত‍্যানন্দও প্রভুর বিশ্বরূপ দর্শন করে বিহ্বল বদনে বলছেন, “প্রভু ! প্রভু গো !” এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল শ্রীবাস ভবনে অথচ শ্রীনিত‍্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈত ভিন্ন কেউ টেরও পেলেন না । কারণ, সে কৃপাশক্তি মহাপ্রভু কাউকে দেননি । ওঁনাদের দু’জনকেই শক্তি সঞ্চার করেছিলেন দর্শন করার ।
পরবর্তীতে এসব কথা আচার্য‍ অদ্বৈত সকলকে জানিয়েছিলেন । মনে রাখতে হবে, যার এতে অবিশ্বাস আছে—- সে নিশ্চয়ই দুষ্কৃতি, অভক্ত । যে গৌরচন্দ্রকে সর্বমহেশ্বর রূপে না মানে —-সে সর্বকালের পাপী । বৈষ্ণবের অদৃশ‍্য সে ।
এরপর মহাপ্রভু নিজের বিশ্বরূপ সম্বরণ করে নিলেন । ততক্ষণে স্নান সেরে সকল ভক্তরা অঙ্গনে এসে হাজির । গৌরাঙ্গ তাঁদের নিয়ে নিজ বাসায় গেলেন । আর এদিকে বিশ্বরূপ দর্শনের আবেশ অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে তখনও মত্ত করে রেখেছে । বৈভব দর্শন সুখে দু’জনাই গরগর তনু তখনও । ধূলায় গড়াগড়ি যাচ্ছেন, কখনও করতালি দিয়ে হাসছেন, কখনও বা নাচছেন, গান করছেন । দুই মহাবলী মহাজন ঢুলে ঢুলে পড়ছেন একে অপরের শ্রীঅঙ্গে । তারপর শেষে একসময় দু’জন গালি দিয়ে কলহ শুরু করলেন । অদ্বৈত বললেন—- “এই অবধূত মাতালিয়া কোথাকার ! এখানে কে তোকে ডেকে এনেছে যে তুই এলি ! দুয়ার ভাঙ্গার অবস্থা করে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করলি কেন, শুনি ? কে তোকে বলে রে সন্ন্যাসী ! তুই কোথাকার সন্ন্যাসী ! এমন কোন জাতি আছে, যার ঘরে তুই আহার করিস নি ! তাহলে তুই কি করে সন্ন্যাসী হলি রে ! মাতোয়াল এক চলে এসেছে বৈষ্ণব সভায় ! চলে যা, বলে দিচ্ছে এখুনি । পালা এখান থেকে ।”
অদ্বৈতের গালমন্দ দেওয়া শেষ হলে এবার নিত্যানন্দ বলা শুরু করলেন । এতক্ষণ তিনি সব শুনছিলেন বড় বড় চোখ করে । এবার বললেন, “আরে নাড়া ! বসে থাকো চুপ করে । পড়ে কিলাবে । আগে তোমায় আমার প্রতাপ দেখাই ! বুড়ো বামনা ! ভয় করে না, না তোমার ! জানো ,আমি কে ? আমি ঠাকুরের ভাই, মত্ত অবধূত । আর তুমি হলে গিয়ে স্ত্রী-পুত্র সমেত সংসারী মানুষ । জানো, আমি পরমহংসের পথের অধিকারী জন । আমি তোমায় যদি মারিও তাও তোমার অধিকার নেই কিছু বলার । কেন অকারণে আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে এসেছো ? বৃথা গর্ব দেখাচ্ছো ! আস্ফালন করছো ! কী ক্ষমতা তোমার !”
নিত্যানন্দের কথা শুনেই অদ্বৈত যেন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন । বললেন, “দিগম্বর হয়ে থাকো ! মৎস খাও, মাংস খাও—- কোথাকার সন্ন্যাসী এমন করে শুনি ! কোথায় তোমার পিতা, কোথায় মাতা, কোন দেশেই বা তোমার বসতি ? কেউ কী জানে তোমার ব্যাপারে কিছু, কেউ জানে না ! কোথা থেকে এক চোর এসেছে ! —-সর্বক্ষণ খাব, গিলবো, সংহার করবো এসব বলে চলেছে ! আরে সন্ন্যাসী তো তাকে বলা হয় যে কিছু চায় না । আর তুমি তো এমন যে একবেলায় তিন-তিনবার খাও। শ্রীবাস পন্ডিতের জাতি-জ্ঞান সব গেছে, কোথাকার এক অবধূতকে ঠাঁই দিয়েছে নিজের গৃহে ! এই অবধূতই সকল জাতি নাশ করলো ওর । কোথা থেকে মদ‍্যপ এসে বসে পড়েছে !” —-এভাবে কৃষ্ণপ্রেম সুধারসে কলহমত্ত হলেন দু’জন ।
কলহ করেন সর্বক্ষণ দু’জন–নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত । অথচ এঁনাদের একজনের পক্ষ হয়ে কিছু বললে, অন্য জনের নিন্দা করলে তার ভক্তি ক্ষয় হয়—- পতন হয় তার । নিত্যানন্দ-অদ্বৈতের কলহ হচ্ছে প্রেমকলহ । এই প্রেমকলহের মর্ম না জেনে একজনের প্রশংসা, অপরজনের বন্দনা করলে—- সে পুড়ে মরে নরকে । আবার শুধু তাই নয়, যদি এমনও হয় যে, অদ্বৈতের পক্ষ হয়ে বললো আর গদাধরের নিন্দা করলো —-সেক্ষেত্রেও একই ব‍্যাপার ঘটে । সে কখনও অদ্বৈত-কিঙ্কর হতে পারে না । ঈশ্বর ঈশ্বরেরই কলহের পাত্র —-এখানে । এসবই তো বিষ্ণু-বৈষ্ণবের বৈভবের লীলা । বিষ্ণু ও বৈষ্ণব সমান দুই । অথচ পাষণ্ডী নিন্দুক যারা, তারা এই বৈভবকে বিপর্য‍য় ভাবে । যাঁরা সকল বৈষ্ণবের প্রতি অভেদ দৃষ্টি দিয়ে শ্রদ্ধা করে তারাই তো ভবতরণী তরতে পারে ।
শ্রীমন্ মহাপ্রভুর এই বিশ্বরূপ দর্শন দান লীলা যাঁরা শোনেন, পাঠ করেন, বিশ্বাস করেন—- তাঁরা কৃষ্ণধন প্রাপ্ত হন ।
(সংকলিত)
গ্রন্থ – মহাপ্রভুর মধুময় কথা
প্রকাশক – তথাগত
প্রাপ্তি–8100673093 তে হোয়াটসঅ্যাপ

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

বৃন্দাবনের পথে শ্রীজাহ্নবার অদ্ভুত লীলা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীনিত‍্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবাদেবী প্রথম বার যখন বৃন্দাবন গমন করেন সেটা ছিল সম্ভবতঃ ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দের (১৪৮২ শকাব্দ) মাঘ মাস। সহযাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থরচনাকার নিত্যানন্দ দাস, উদ্ধারণ দত্ত প্রমুখ। আর দ্বিতীয়বার ব্রজে পদার্পণ করেন ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে (১৫০৪ শকাব্দ) খেতু্রীর উৎসবের পরে। সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন পদকর্তা গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস, ভাস্কর নয়ন মিশ্র, পরমেশ্বর দাস প্রমুখ। দ্বিতীয়বার যাত্রাপথে জাহ্নবা মাতা অনেক অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেন। পথের মধ্যে রাত্রিযাপন কালে এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন যখন, সেসময় স্থানীয় কিছু নিন্দুক গ্রামবাসী লক্ষ্য করেন যে, সঙ্গীরা সকলে এক রমণীর (জাহ্নবাদেবীর) চরণে প্রণত হচ্ছেন। এ ঘটনায় তাঁরা অত্যন্ত আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হলেন। কারণ চন্ডীদেবীর পরিবর্তে কোন মানুষীর চরণে শরণাগত হয়েছিল সঙ্গীরা সকলে। তাই তাঁরা গ্রাম মধ‍্যস্থ চন্ডীমন্ডপে চন্ডীমাতার কাছে নালিশ করলেন যে, যারা দেবীর পরিবর্তে মানুষের চরণে পতিত হয় তাদের যেন তিনি সংহার করেন অবিলম্বে। শাস্তি বিধান অত্যন্ত প্রয়োজন। এমন বলে যখন তাঁরা নিদ্রায় গেলেন তখন ক্রোধিত দেবী চণ্ডী তাঁদেরকে স্বপ্নাদেশ দিলেন –“জাহ্নবাকে নারীজ্ঞানে অবহেলা করছো তো, তোমাদের মুণ্ডছেদন করবো আমি ! মহিমা না জেনে ধিক্কার করছো তাঁর! মানুষী জ্ঞান করছো! কিন্তু তিনি আমারও প্রণম‍্য। কাল প্রভাতেই অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইবে তাঁর কাছে। না হলে, আমি তোমাদের সংহার করবো।” নিন্দুকেরা সকলে পরদিবস প্রভাতেই মাতার চরণে পড়লেন। দোষ স্বীকার করে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন। ঈশ্বরী জাহ্নবা সন্তান জ্ঞানে সকলকে কাছে টেনে নিয়ে কৃপা করলেন। প্রত‍্যক্ষদর্শী নিত্যানন্দ দাসের বিবরণ অনুযায়ী এমন আরও এক অলৌকিক লীলা করেন জাহ্নবা ঠাকুরাণী পথে।

কুতুবুদ্দিন নামক এক দস‍্যুদলপতি নিজের সঙ্গীদের নিয়ে রাতে ডাকাতি করতে আসেন যে গৃহে জাহ্নবা মাতা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই গৃহেই। কিন্তু, ডাকাতদল সারারাত ধরে ঘুরেও পথ খুঁজে পেলেন না গৃহে প্রবেশের। গৃহের চারিদিকে বিশালাকার ভয়ংকর সব সর্প ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গৃহের দিকে এগোতেই ছুটে আসছিল সর্পরা দংশন করতে। রাত্রি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু প্রতীক্ষা ব্যর্থ হল। কিছুই করতে পারলেন না তাঁরা। শেষরাত্রে দৈববাণী হল—-“ঠাকুরাণীই তোমাদের জব্দ করলেন।” কুতুবুদ্দীন তাঁর সঙ্গীসাথীসমেত মাতার চরণে শরণ নিয়ে ক্ষমা চাইলেন। জাহ্নবাদেবী নামপ্রেম দিয়ে তাঁদের অযাচিত কৃপা করলেন।
এভাবে, পথে নানা পতিত উদ্ধার লীলা করতে করতে জাহ্নবা মাতা গণসমেত শুভাগমন করলেন মথুরায়। সেখান থেকে ব্রজে। শ্রীজীব গোস্বামী জাহ্নবাদেবী ও তাঁর সঙ্গীদের বাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। ঈশ্বরীর আগমনে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দ যারপরনাই আনন্দিত হলেন। গোপাল ভট্ট, ভূগর্ভ গোস্বামী, লোকনাথ গোস্বামী, মধু পন্ডিত, কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী প্রমুখ মহাজনরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করলেন। জাহ্নবা মাতা যে কতখানি সম্ভ্রম-সম্মান নিজ গুণে বৃন্দাবনের গোস্বামীবৃন্দের থেকে অর্জন করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ দুটি উদাহরণ দেওয়া যায় –(১) ঈশ্বরীর দ্বিতীয়বার বৃন্দাবন আগমনের পূর্বে যখন শ্রীনিবাস আচার্য বৃন্দাবন থেকে গৌড়ে গমন করবেন, তখন শ্রীগোপাল ভট্ট তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তিনি যেন গৌড়ে ফিরে জাহ্নবা মাতাকে বৃদ্ধ গোপাল ভট্টের খেদোক্তির কথা জানান –“ঈশ্বরীর পদযুগ না দেখিনু আর।” (প্রেমবিলাস , ৬ বিলাস)। আসলে অসুস্থ গোপাল ভট্টের বয়স হয়েছিল। তাই তাঁর শঙ্কা ছিল যে জাহ্নবা মাতার চরণ দর্শনের সৌভাগ্য বোধহয় আর এ জীবনে হবে না তাঁর। তাই তিনি অমন বিলাপ করেছিলেন।
(২) যখন প্রথমবার জাহ্নবা মাতা ব্রজে যান তখন রাধাকুণ্ড নিবাসী রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পর্ব ঘটেনি। তাই তিনি দ্বিতীয়বার ব্রজে আসছেন শুনে চলচ্ছক্তিরহিত বৃদ্ধ দাস গোস্বামীজী নিজে প্রেরণ করেন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ও অন্যান্য বৈষ্ণববৃন্দকে , যাতে তাঁরা ব্রজ থেকে সসম্মানে জাহ্নবা মাতাকে রাধাকুণ্ডে নিয়ে আসেন। জাহ্নবাদেবী কৃপাদর্শন দান করে ধন্য করবেন দাস গোস্বামীজীকে তাহলে।
রন্ধন পটিয়সী দেবী জাহ্নবা বৃন্দাবনে আপন হস্তে ভোগ রন্ধন করে শ্রীগোবিন্দ, গোপীনাথ, মদনমোহন,রাধাদামোদর ও রাধারমণ –এই ছয় বিগ্রহকেই ভোগ নিবেদন করতেন। তারপর সেই প্রসাদামৃত ব্রজবাসীদের বিতরণ করে দিতেন। সকলেই সে সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করে ধন্য হতেন, তৃপ্ত হতেন।

ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবার রাতুল চরণে অধমা রাধাবিনোদিনীর ভক্তিপূর্ণ প্রাণের প্রণতি নিবেদিত হল ।

সমাপ্ত

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

সম্বন্ধ : রাণু সরকার।

এক ঘটক তার মেয়েকে বিয়ে দেবে পাত্রের ভীষণ দরকার, তার একটি মেয়ে আছে দেখতে বিশেষ ভালো না বলে অভাব হচ্ছে পাত্রের। তার স্ত্রী বলে বলে কানের পোকা বেরকরে দিচ্ছে- বলছে স্বামী মেয়ের বিয়ের দিন পার হচ্ছে কবে বিয়ে দেবে?
মেয়ে তো শেয়ানা হয়েছে এর পরে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে।
ছেলে একটা তো দেখে এলাম মাইনা একটু কম পায়,
ছেলেকে দেখে যখন বেরোলাম গিন্নী কি বলবো- পাশের বাড়ির একটি মেয়ে নাম তার টেপি সে এসে বললো হর দম নাকি নেশা করে কি করি বলতো গিন্নী।

আর মাস খানেক দেখবো ,তারপর যাকে পাবো তার সাথেই দেবো বিয়ে-
তুমি এতো চিৎকার করো গিন্নী তোমার ভয়ে ভয়ে মুখ বুঁজে থাকতে হয় আমার।
আর একটি দেখেছি ছেলে,মাইনা যদিও বা পায় একটু বেশি কিন্তু বংশটা একদমই ভালো না ভাবছি কি করা যায়।
শোন গিন্নী, বংশ মাইনা সব যদি ঠিকঠাক মিলে যায় তবেই দেবো বিয়ে।
আমাদের জমির কিছু অংশ দেবো বেঁচে কি বলো?
কেনো না ছেলে ভালো হলে পণ সোনা সবই চাইবে তাই না?
আর একটি ছেলে আছে,শুনেছি বংশটা ভালো ওর ভাগ্যে থাকলে রানী হয়ে থাকতে পারবে।
এখন ভালো সহজ সরল ছেলে কোথায় আছে বলো দেখি শুনি?
এখনের ছেলেরা-প্রেমের শিকারি মদ মাতাল আর কখনো খুন টুন ও করে শুনি।
জেনে শুনে দিতে পারি কিরবো বলো? মেয়ে আমাদের একটু কমজুড়ি দেখতেও ভালো না কি করে যে হলো এমন ভাবতেই পারিনা গিন্নী।

মেয়ে তো আমাদের একটু আবা প্রেমটেম ওসব কিছুই বুঝবে না তাই বলো স্বামী?
চালাক যদি হতো আজ অব্দি-একলা কি থাকতো বল গিন্নী? ঠিক একটা না একটা ছেলে পটিয়ে ফেলতো।

আমি আর গিন্নী মেয়ের পাত্রের আলোচনা করছিলাম
হঠাৎই দরজাতে টুট টুট শব্দ খুলে দেখি মেয়ের সাথে মাঝ বয়সি এক ছেলে,একদম হাঁদা,বোকা দাঁত কিছু আছে ওই ফোকলা দাঁতে হাসছে। দুজনার গায়ে
বিয়ের পোশাক কিজানি ওগো গিন্নী ভুল দেখছি নাতো।
মেয়ে বলছে এই তোমাদের জামাই মা- তোমরা মোটেও ভুল দেখনিকো।
দেখতে কত সুন্দর তাই না মা? মা একটু তাকি হু বললো, দেখেছো মা হাজার টাকা কামাই করে কিন্তু একটাও দাঁত নেই সবাই ছিছি বলে চলে গেলো।
হাজার টাকা মাইনে পায় শুনে-জ্ঞান হারালো গিন্নী স্বামী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
এর মধ্যেই পাড়া পড়শির কানে গেলো-সবাই এসে হাজির, বললো সবাই হাঁদা বোকা মেয়ে তোমার যা করেছে ঠিক করেছে, ভোজের জন্য করো সবাইকে আহ্বান।

Share This
Categories
গল্প

ভাগ্যহীনা : রাণু সরকার।

মেয়েটির সবে বড় বেলা হয়েছে সুরু, ঘুরে ঘুরে বেড়ায় যে যা দেয় তাই খায়,মাঝে মাঝে হোটেল বাসন মাজে ওখানেই থাকে। একদিন এক বৃদ্ধ এসেছে ঐ হোটেলে খেতে মেয়েটি টেবিল মুছছিলো দেখে ভীষণ কষ্ট হলো বৃদ্ধের।
বৃদ্ধের আবার দেখার কেউ থেকেও নেই। মেয়েটিকে দেখে বৃদ্ধের মায়া হওয়াতে মেয়েটিকে বললো আমার সাথে যাবি আমার বাড়ি? ভালো থাকবি খাওয়া পড়া পাবি আমার ঘরের সব কাজ করবি, মেয়েটি বললো যাবো তখন মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করলো তোর নাম কি?একটু হেসে বললো আমার নাম অভাগী বৃদ্ধ বললো এটা আবার কেমন নাম? হ্যাঁগো বাবু এটাই আমার নাম ।
আমার বাবটা মাটাকে ছেড়ে চলে গেলো সেই দুঃখে হয়তো মাটা মরে গেলো,
তখন থেকেই সবাই আমায় অভাগী বলে ডাকে,

থাক তোর কথা আর বলতে হবে না সব বুঝেছি তুই চল আমার সাথে।
অভাগী চলে এলো বৃদ্ধার বাড়ি বৃদ্ধা ভীষণ ভালোবাসতো মেয়েটিকে যা চাই তো সে তাই দিতো ধীরে ধীরে মেয়েটি বড় হলো। বৃদ্ধার একটু লোভ হলো মেয়েটির প্রতি। বৃদ্ধা ভীষণ অসুস্থ একরকম বিছানা নিয়েছে বলা চলে।মেয়েটির দোকান বাজার সব করতে হয় নিজের হাতে। এই দোকান বাজার যেতে আসতে একজনের সাথে তার ভালোবাসা হলো বৃদ্ধ সেটা জানতো না। একদিন বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে-এই অভাগী, তোর আগুন জোড়া হাত-
আমার বুকে একটু স্পর্শ করবি একটিবার কর না আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে
তোর উষ্ণতা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।
এই অভাগী,কোথায় গেলি আমার কাছে আয় না একবার।

উফ্! কুঁজোর সাধ জেগেছে চিৎ হয়ে শোবার,
আমার নারীত্বের এক টুকরোও ছিঁড়তে দেবোনা- আমি চলে যাবো এখান থেকে।
কোন চুলোয় যাবিরে মাগি? তুমি আমায় গাল দিচ্ছো? হ্যাঁ দিচ্ছি তো তোর জন্য এতো করলাম বড়ও করলাম আমার মুখে মুখে কথা?
তোর মুখে নুড়ো জ্বেলে দেবো,ছিলি তো রাস্তায়-এখানে তো হলি ডাগর ডুগোর কোন মরদ আছে তোর বল তো-আমায়?

মেয়েটি রাগ করে চলে যাচ্ছে, বলছে খাব না আর তোমার ভাত,এই আমি চললাম
তোমার মনে মনে এই ছিলো?
যাস নে অভাগী আমি এই আছি এই নেই-
আমার চাওটা কি খুব বেশি হলো?
উত্তর দে- কিনা দিয়েছি তোকে,যখন যা চাইছিস তাই পেয়েছিস।
অভাগী শুনোলো না চলে গেলো বুড়োকে একা রেখে-
তার নারীত্বের একটুরোও দেবে না,
মরদ ঠিক করা আছে যে তার।

কিছুদিন চললো মরদের সাথে ভরা যৌবন খেলা।মরদের সংসার আছে যে-মেয়টির নারীত্ব গেলো সে মা হতে চলেছে আর ভালো লাগছে না মরদের মারধর করে দিলো তাড়িয়ে।
এলো গর্ভবতী হয়ে বুড়োর দ্বারে,এসে দেখে বুড়ো মরে আছে, পাড়ার মানুষ তাকে থাকতে দেবে কেনো?
সেই আগের জায়গায় তাকে ফিরে যেত হলো।

Share This
Categories
উপন্যাস গল্প

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাসঃঅন্তিম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

তানিশা পল্লীদহ গ্রামের চয়ন হালদারকে বিয়ে করলো । গাঁয়ে চয়নের মুদিখানার দোকান । ভীষণ চালু দোকান । চয়নের সাথে তানিশার পরিচয় ছোটবেলা থেকে । কিন্তু মাঝখানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল । কিন্তু সাগরের সাথে বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর তানিশা নিয়মিত চয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো, যেটা বাড়িতে কেউ টের পায়নি । তানিশাকে অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে পেয়ে খুশীতে বিহ্বল । অন্যদিকে তানিশার বিয়ে হওয়ায় কঙ্কাবতী স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ।
তারপর …………?
তারপর তার মোবাইলে থানা থেকে হঠাৎ ফোন পেয়ে কঙ্কাবতী চমকে উঠলো । নিয়ামতপুর থানা থেকে স্বয়ং বড়বাবুর ফোন । ভয়ে ভীতিতে কঙ্কাবতী আমতা আমতা করে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আমাদের অপরাধ ?”
থানার বড়বাবু উত্তরে বললেন, “আপনি থানায় আসুন ! থানায় দেখা করলে টের পাবেন আপনার অপরাধ কী ?” থানার বড়বাবু আরও নির্দিষ্ট করে বললেন, “পরেরদিন সকাল এগারোটার মধ্যে আপনাকে থানায় আসার অনুরোধ রইল ।“
কঙ্কাবতী তার জামাইদের ডাকলো । সন্ধ্যায় কঙ্কাবতীর বাড়িতে চার মেয়ে ও চার জামাই এবং দুই ছেলে ও বৌমা উপস্থিত । কঙ্কাবতী সবাইকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করলো, তারা কোনো গর্হিত কাজ করেছে কিনা ? যার জন্য বড়বাবুর হঠাৎ তলব ! আলোচনায় কঙ্কাবতী বুঝতে পারলো, তার মেয়ে-জামাই এমনকি ছেলে-বৌমারা কেউ কোনো অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত নেই । সুতরাং কঙ্কাবতী নিশ্চিন্ত, তাদের পরিবারের কেউ কোনো অপরাধমূলক কাজ করেনি । এমনকি কোনো অপরাধমূলক কাজের ষড়যন্ত্রেও তারা যুক্ত নয় । তাই কঙ্কাবতী ঠিক করলো, পরিবারের সকলে দল বেঁধে থানায় যাবে । বিনা অপরাধে বড়বাবুর কেন তলব ?
পরেরদিন সকালবেলা । রুটি ও কুমড়োর তরকারি রেডি । সবাই রুটি তরকারি খেয়ে চায়ের জন্য অপেক্ষারত ! নতুন বৌ লতা চা বানালো । চায়ের চুমুক দিয়ে ঘোতন সকলের উদ্দেশে বলল, “আর দেরী করা যাবে না । পরের ট্রেনটা মিঁয়া হল্টে ঠিক নটা দশ মিনিটে । ঐ ট্রেন যেভাবে হোক পেতে হবে । নতুবা অনেক দেরী হয়ে যাবে ।“
মিঁয়া থেকে সালার । সালার স্টেশনে নেমে বাসে নিয়ামতপুর থানা ।
বাড়ি থেকে বের হতে যাবে ঠিক সেই সময় চঞ্চল বটব্যাল এসে হাজির । চঞ্চল বটব্যাল পাশের গ্রামে বাস করেন । তিনি পুলিশের বড় অফিসার । এতকাল উত্তরবঙ্গে পোস্টিংয়ে ছিলেন । খুব সম্প্রতি তিনি নিয়ামতপুর থানায় বদলী হয়ে এসেছেন । গাঁয়ে তাঁর অনেক জমি জায়গা । এলাকার মানুষ তাঁকে সমীহ করে চলেন । কঙ্কাবতী শুনেছে, চঞ্চল বটব্যাল নাকি নিয়ামতপুর থানার মেজবাবু । কিন্তু কঙ্কাবতী ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, তাঁর মতো নামজাদা পুলিশ অফিসার তার বাড়িতে আসবে । তাই চঞ্চল বটব্যালকে দেখে কঙ্কাবতী তাঁকে আপ্যয়ন করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো ।
কঙ্কাবতীর ব্যতিব্যস্ততা দেখে চঞ্চলবাবু বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না । বরং যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যাওয়ার প্রতি ধ্যান দিন ।“
“তা হয় নাকি ! আপনি জীবনে প্রথম আমাদের মতো গরীবের বাড়িতে পা রাখলেন । সুতরাং আপনাকে একটিবারের জন্য হলেও বসতে হবে । আপনাকে চা খেয়ে যেতে হবে । দরকার হলে, থানায় একটু পরে যাবো ।“
“উহুঁ ! থানায় যেতে দেরী করবেন না । সেই কথা বলতেই আমার আসা । থানায় আপনাকে আর্জেন্ট দরকার ।“ চঞ্চল বটব্যাল জোর দিয়ে কঙ্কাবতীকে বললেন ।
সাহস পেয়ে কঙ্কাবতী চঞ্চলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “থানায় কেন আমার মতো গরীব মানুষের হঠাৎ তলব ? আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না ! বিপদের কথা ভেবে গত রাত্রিতে আমার ঘুম হয়নি । থানায় আমাকে তলব কেন, জানালে আশ্বস্থ হতাম ।“
আমি কিচ্ছু জানি না । আমাকে বড়বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং আপনাকে থানায় সঠিক সময়ে পৌঁছানোর জন্য বলেছেন ।
কঙ্কাবতী পুনরায় চঞ্চল বটব্যালবাবুকে বলল, “স্যার, আমার বড্ড ভয় করছে ! জীবনে এভাবে থানা থেকে আমাকে কোনোদিন ডাকেনি । এমনকি কোনো প্রশাসনিক দপ্তর থেকেও এভাবে ডাক পাইনি ।“
“আপনি অযথা উতলা হবেন না । থানার বড়বাবু ভীষণ ভদ্র মানুষ । আপনাদের কোনোরকম অসুবিধা হবে না ।“ চঞ্চলবাবু কঙ্কাবতীকে আশ্বস্ত করলেন । তারপর তিনি বাড়ির দিকে রওনা দিলেন ।
আর কালবিলম্ব না করে কঙ্কাবতী তার চার মেয়ে ও চার জামাই এবং দুই ছেলে ও দুই বৌমা এবং স্বামী অনিন্দ্যকে নিয়ে নিয়ামতপুরের দিকে রওনা দিলো । পরিবারের সবাইকে নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, যদিও বিপদজনক কিছু ঘটে তবে সকলে মিলে থানার বড়বাবুর চেম্বারের বাইরে ধর্ণায় বসবে । নিরপরাধ মানুষকে ডেকে এনে কেন হুজ্জুতি ? কঙ্কাবতীর দূরদৃষ্টি সাংঘাতিক । বিপদে পড়লে নিজের লোকেরাই পাশে দাঁড়াবে । পাড়া প্রতিবেশীরা সমালোচনায় সিদ্ধহস্ত, অথচ বিপদে পড়লে তাঁরা বরং মুখটা ঘুরিয়ে নেয় । বেশী করে কটুকথা শোনায় । তাঁদের ভাবটা এমন, আমরা যতো বিপদে পড়বো ততো তাদের শান্তি !
সালারে পৌঁছে কী বিপদ ! নিয়ামতপুর যাওয়ার কোনো বাস নেই । বাস ধর্মঘট । সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত । সালার থেকে নিয়ামতপুর যাওয়ার রাস্তা খুব বেশী নয় । খুব বেশী সময় লাগলে, লাগবে আধা ঘন্টা । সকাল দশটা বাজে । কীভাবে পৌঁছাবে সেই চিন্তায় কঙ্কাবতী অস্থির । বাড়িতে এসে থানার মেজবাবু বলে গেছেন, ঠিক সময়ে থানায় পৌঁছাতে । অথচ যাতায়াতের কোনো যানবাহন নেই । সালার থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করলে, অনেক টাকা খরচ ! তারা সংখ্যায় অনেক । বড় গাড়ি দরকার ! কঙ্কাবতী ঠাহর করতে পারছে না, তারা এখন কীভাবে পৌঁছাবে ?
ইত্যবসরে বড়বাবুর টেলিফোন, “হ্যালো ! আমি কি কঙ্কাবতী ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলছি ?”
মায়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মনীষা পাল্টা জানতে চাইলো, “আপনি কে বলছেন ?”
“আমি নিয়ামতপুর থানার বড়বাবু বলছি ।“
“নমস্কার স্যার । আমি কঙ্কাবতীর মেয়ে বলছি । ট্রেন থেকে নেমে আমরা সালারে আটকে গেছি । বাস ধর্মঘট ! নিয়ামতপুর পৌঁছানোর কোনো যানবাহন নেই । কী করব, ঠিক বুঝতে পারছি না ।“
আপনারা একসঙ্গে কতোজন আছেন ?
আমরা পরিবারের সবাই আছি । সংখ্যায় ১৪জন । বড় বৌদি আবার সন্তান সম্ভাবনা । যার জন্য আরও চিন্তা !
বড়বাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “এই মুহূর্তে আপনারা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন ?”
আমরা স্টেশন লাগোয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি ।
“আপনারা সকলে সালার স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়ান । সালার থানা থেকে পুলিশের গাড়িতে আপনাদের নিয়ামতপুরে পৌঁছে দেবে ।“ বড়বাবু তারপর লাইন কেটে দিলেন ।
কঙ্কাবতী আরও শঙ্কিত, কী বিপদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ! পুলিশ নিজ দায়িত্বে তাদের থানায় নিয়ে যাচ্ছে । অনিন্দ্য যতোবার বোঝাবার চেষ্টা করছে, আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। সুতরাং ভয়ের কোনো কারণ নেই । তবুও কঙ্কাবতীর আশঙ্কার ধন্দে কাটছে না । ভয়ে বরং বলা চলে গুটিয়ে রয়েছে । অথচ থানার বড়বাবুর ডাককে উপেক্ষা করতে পারছে না । ঘোতনও মাকে বোঝাচ্ছে, “তুমি অযথা চিন্তা করছো ? নিশ্চয় বড়বাবু কোনো কাজের কথাবার্তার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন !”
ইতিমধ্যে সালার থানা থেকে পুলিশের দুখানি জিপ গাড়ি এসে হাজির ।
জেলার মধ্যে নিয়ামতপুর থানা একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরানো থানা । আশেপাশে অনেক লোকজন ও দোকানপাট । এলাকায় হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণীয় মানুষের বসবাস । তবুও মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট । এই ব্যাপারে থানার ভূমিকা অনস্বীকার্য । নিয়ামতপুরে রয়েছে ব্লক অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আরও অসংখ্য ছোট ছোট অফিস । যার জন্য মহাকুমার মধ্যে নিয়ামতপুরের গুরুত্ব অপরিসীম ।
থানায় নামার সাথে সাথে ভয়ে কঙ্কাবতীর বুক ধড়ফড় !
থানার সামনে নীল-লাল বাতি লাগানো বেশ কয়েকটা গাড়ি । গাড়ি দেখে কঙ্কাবতীর আরও ভয় পেয়ে গেলো । অনিন্দ্যকে বলল, “আমাকে এক গ্লাস জল খাওয়াও ।“
অনিন্দ্য তড়িঘড়ি দোকান থেকে দশ টাকা দিয়ে জলের বোতল এনে কঙ্কাবতীকে খাওয়ালো । তারপর তার তেষ্টা মেটে ।
চঞ্চল বটব্যাল হাসতে হাসতে কঙ্কাবতীর কাছে উপস্থিত । তিনি কঙ্কাবতীকে বললেন, “আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি ।“
কঙ্কাবতী তখনও ভয়ে জড়সড় । কঙ্কাবতীর আড়ষ্টতা অবলোকন করে চঞ্চলবাবু আবার বললেন, “ম্যাডাম, ভয়ের ব্যাপার নয় । আপনি আপনার কথা নির্ভয়ে বলবেন । এখন আমার সঙ্গে চলুন ।“
আপনার সঙ্গে কোথায় যাব ?
বড়বাবুর চেম্বারে ।
আমার স্বামী ও পরিবারের লোকজন কখন যাবে ?
আপনি ভিতরে ঢুকে স্যারকে বলবেন, “আপনার পরিবারের লোকজন আপনার সঙ্গে আলোচনায় থাকতে চায় ? তিনি সানন্দে সম্মতি জানাবেন । কিন্তু এই মুহুর্তে আপনি একা আমার সাথে বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকুন । কেননা সেখানে জেলার অনেক উচ্চপদস্থ আধিকারিকগণ বসে আছেন । বড়বাবুর অনুমতি ব্যতিরিকে পরিবারের লোকজন চেম্বারে ঢোকাটা শোভনীয় হবে না । আর সময় নষ্ট করবেন না । আমার সঙ্গে চলুন ।“
বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকে দুই হাত জড়ো করে কঙ্কাবতী বলল, “নমস্কার স্যার ।“
“বসুন ।“ হাত দিয়ে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন বড়বাবু । বড়বাবুর নির্দেশ মতো কঙ্কাবতী চেয়ারে বসলো ।
তারপর বড়বাবু আবার বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই । আপনার পাশে রয়েছেন এলাকার বি ডি ও সাহেব এবং একেবারে সামনে রয়েছেন মহাকুমা শাসক এবং বা-পাশে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলা শাসক । আপনাকে এখানে ডাকার কারণ এবার খুলে বলি ।
কঙ্কাবতী বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আলোচনার মধ্যে আমার পরিবারের লোকজন থাকলে ভাল হয় ।“
“অবশ্যই তারা থাকবেন ।“ বড়বাবু তারপর চঞ্চলবাবুকে বললেন, “কঙ্কাবতীর সাথে যারা এসেছেন, সবাইকে ডাকুন ।“
একদিকে জেলা প্রশাসনের মানুষজন বসেছেন এবং ঠিক তার উল্টোদিকে মুখোমুখি কঙ্কাবতীর বাড়ির লোকজন ।
বড়বাবু শুরু করলেন, “আপনার নাম কঙ্কাবতী ?”
হ্যাঁ স্যার ।
আপনার চার মেয়ে ও দুই ছেলে ?
“হ্যাঁ স্যার । কিন্তু স্যার, আমার বাড়ির এত খবর জানলেন কীভাবে ?” কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলো কঙ্কাবতী ।
“সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি । এবার আপনার সঙ্গে কয়েকটা জরুরি কথা সেরে নিই !” বড়বাবু হাসিমুখে কথাগুলি বলছিলেন । ঠিক তার মাঝখানে কঙ্কাবতী মুখটা ভার করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আমি জ্ঞানত কোনো অন্যায় করিনি । আবার কী ধরনের বিপদের কথা শোনাবেন, বুঝতে পারছি না ?”
অতিরিক্ত জেলা শাসক চঞ্চলবাবুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “আপনারা ম্যাডামকে কিছু জানাননি ?”
চঞ্চলবাবু সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বললেন, “স্যার, আমাদের বড়বাবু স্যারের নির্দেশ ছিল ‘ম্যাডামকে আগেভাগে কিছু না জানাতে’ । সেই মোতাবেক আমরা ম্যাডামকে কিছুই জানাইনি ।“
এবার বড়বাবু অতিরিক্ত জেলা শাসকের দিকে তাকিয়ে বল্লেন, “ম্যাডামকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য খবরটা জানাইনি ।“
তারপর অতিরিক্ত জেলা শাসক কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি বসুন ম্যাডাম । বড়বাবু একটা ভাল খবর শোনাবেন । যে খবরটার জন্য আমরা জেলার মানুষ গর্বিত ।“
বাড়ির সকলের দৃষ্টি এখন বড়বাবুর দিকে ।
বড়বাবু আবার শুরু করলেন, “ম্যাডাম, আপনি সমস্ত প্রতিকুলতা কাটিয়ে যেভাবে আপনার চার মেয়েকে মানুষ করেছেন এবং তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছেন, তার স্বীকৃতি স্বরূপ কেন্দ্রিয় সরকার আপনাকে “নারীশক্তি” সম্মাননা দিয়ে সম্মান জানাবেন । এটি একটা বিরল সম্মান । আমাদের রাজ্য থেকে একমাত্র আপনি সেটা পাচ্ছেন ।“
খবরটা জানানোর সাথে সাথে সকল প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে কঙ্কাবতীকে সম্মান জানালো । কঙ্কাবতী তখন তার চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না । স্পটেই কেদে দিলো । পরিবারের সবাই তখন কঙ্কাবতীকে জড়িয়ে ধরে আবেগে উচ্ছ্বাসে আনন্দাশ্রুতে বিহ্বল ।
————-০—————

Share This