Categories
গল্প প্রবন্ধ

ফাগুরঙ্গে মাতল নাগর-নাগরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীশ্যামনাগর আজ নাগরিমণি শ্রীরাধাকে নিয়ে হোরীরঙ্গে মেতেছেন। ব্রজগোপিনীরা সে রঙ্গলীলায় অনুঘটক । রাধারমণ রমণীমনচোরা রাসবিহারী নওলকিশোর কানু, ফাগুয়া অঙ্গে মেখে ও মাখাতে মহানায়ক হয়েছেন । ব্রজসুন্দরীগণ তাঁকে মন্ডলী-মন্ডলী করে চতুর্দিকে ঘিরে রয়েছেন আর মধ্যখানে মনমোহনিয়া মুরলীমনোহর আজ সেই ব্রজরামাদের মনোভাব বুঝে ভরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের ঘনপরিরম্ভনে,চুম্বনে, সোহাগের পরশে-হরষে।

নটন বিভঙ্গে ফাগুরঙ্গে মাতল
নাগর অভিনব নাগরি সঙ্গ।
ঋতুপতি রীত চীত উমতায়ল
হেরি নবীন বৃন্দাবন রঙ্গ ৷৷
ফাগুয়া খেলত নওল কিশোর।
রাধারমণ রমণীমনচোর ।। ধ্রু॥
সুন্দরিবৃন্দ- করে কর মণ্ডিত
মণ্ডলি মণ্ডলি মাঝহি মাঝ ৷
নাচত নারিগণ ঘনপরিরম্ভণ
চুম্বন লুবধল নটবর রাজ॥
কানুপরশ রসে অবশ রমণিগণ
অঙ্গে অঙ্গে মিলি ঝাঁপি রহু।
পূরল সবহুঁ মনোরথ মনোভব
মোহন গোবিন্দদাসিয়া পহু।।

ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হোরীলীলা বা হোলিখেলা আদপে প্রেম প্রদানের উৎসব। প্রেমের বৈচিত্র্যময় ভাবের মূর্তিমন্ত রূপই হল যেন নানান রঙের আবীর আর ফাগ। মুঠো মুঠো ফাগ ছুঁড়ে ,রঙ মাখিয়ে যেন সেই প্রেমকেই নতুন করে নিবেদন করা মনের মানুষটিকে,কাছের জনকে । প্রাণ ভরে সারাদিন অক্লান্ত হোরি খেলে খানিক জিরিয়ে নিতে দোলনায় বসে দোল খান শ্রীরাধাকৃষ্ণ। তাই ,এ উৎসবের আর এক নাম দোলযাত্রা ,একথা মনে হলেও ,আদপে সেটি নয় । দোলযাত্রার ইতিহাস আরও হাজার হাজার বৎসর পূর্বে—সেই ঋকবেদের সময়কালের, অর্থাৎ সাত-আট হাজার বৎসর পূর্বের।

উত্তরায়ণের আগমনে নতুন বছরের সূচনা রূপে আর্য ঋষিরা এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বিষ্ণুর পূজা করতেন। পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চারকারী সূর্যকে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুরই প্রতিভূ মেনে তাঁরা সে পূজায় নারায়ণ শিলাকে উত্তর দক্ষিণে তিনবার ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোল দিতেন,যাতে আগামী বৎসরেও সূর্যের যাত্রা নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নকে মাধ্যম করে। আর তাই নাম দোলযাত্রা।

সাত-আট হাজার পূর্বের দোলোৎসব পূজাই পরবর্তীতে হয় হোলি বা হোরীলীলা । দোলযাত্রা হল বছরে একটি নয় দুটি— একটি দোল পূর্ণিমায় অপরটি শ্রাবণী পূর্ণিমায় হিন্দোলযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। দোল অর্থাৎ দোলন আর যাত্রা অর্থে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গমন । অতএব, দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা। যেমন রথযাত্রা বা ঝুলনযাত্রা। একটা কথা মনে দোলা দিতে পারে যে দেবী দুর্গাও তো যাত্রা করেন পতিগৃহ থেকে পিতারগৃহে কিছুদিনের জন্য । তবে কেন আমরা দুর্গাযাত্রা বলি না। আসলে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালির উৎসব এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে তা দুর্গোৎসব নামেই যথার্থতা পায়। আর, তাছাড়া যাত্রা শব্দটি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর গমনের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে। ফিরে আসি দোলযাত্রার কথায়,ব্রজের হোলিতে।

এই প্রেমের উৎসবের আগমণী সুর কিন্তু ফুলেরা দুজের দিনই ধ্বনিত হয়ে যায় বৃন্দাবন আর মথুরায় । ‘ফুলেরা দুজ’ হল শ্রীরাধাকৃষ্ণের দোলযাত্রা-মঞ্চের তথা দোলনা প্রস্তুতির সূচনা দিবস ;যা ফাল্গুনের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে পালিত হয়। এদিন ফুলের নয়নাভিরাম সাজে সজ্জিত হন বিগ্রহগণ। মন্দিরচত্বর থেকে শুরু করে সর্বত্র ফুলের সজ্জা।মন্দিরে-মন্দিরে ,গৃহে-গৃহে হোলির গীত,নৃত্য ,নাটকের অপূর্ব উপস্থাপনা শুরু হয়ে যায় এদিন থেকেই। এরপর চতুর্থীর দিন পালিত হয় লাড্ডু হোলি‌।

মথুরার রাভেলের ভূস্বামী তথা রাধারাণীর পিতা ‘বৃষভানু’ কংসের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে পাহাড়ের মাথায় সুউচ্চ স্থানে প্রাসাদ গড়লেন । নতুন জনপদ ‘বৃষভানুপুর’(এরই অপভ্রংশ বর্ষাণা)-এর পত্তন হল।সেসময় কংসের নানান অত্যাচারে একইভাবে অতিষ্ঠ নন্দগ্রামবাসীরাও।রাজা বৃষভানু আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বন্ধু নন্দরাজা তথা শ্রীকৃষ্ণের পিতাকে; বললেন, নন্দগ্রামবাসীসমেত বৃষভানুপুরে এসে বাস করতে ।এই বসন্ত চতুর্থীর দিনেই নাকি গোপীগণের চিত্তহারী-চপল-চটুল- নওলকিশোর নন্দকুমার কৃষ্ণ তাঁর গ্রাম নন্দগাঁও থেকে রাধারাণীর গ্রাম বর্ষাণায় এসেছিলেন ।তখন তাঁদের আতিথেয়তা করা হয়েছিল লাড্ডু খাইয়ে।আর তাই,সেদিনের সেই আনন্দ দিবসের স্মরণে আজও বর্ষাণায় লাড্ডু তো খাওয়া হয়ই,তার সাথে চলতে থাকে একে অপরকে লক্ষ্য করে লাড্ডু ছোঁড়াছুঁড়ির পালা;যা লাড্ডু হোলিতে পর্যবসিত হয়। সত্যি,এহেন মিষ্টিমধুর আনন্দময় উৎসব ভারতভূমিতেই বুঝিবা সম্ভব।

ঠিক পরদিন, বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে বর্ষাণায় পালিত হয় লাঠমার হোলি , অর্থাৎ লাঠি দিয়ে মারের হোলি। পড়তে অদ্ভুত লাগছে তাই না! যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে পুরুষরা কোন বিশেষ কার্যে গ্রামে নেই, আর হঠাৎ,কংসের অত্যাচারী দুষ্টু পেয়াদারা এল বর্ষাণায়। তখন মহিলারা আত্মরক্ষা করবেন কীভাবে(!) –তার মহড়া শুরু হল সেখানে। গোপিনীরা লাঠি দিয়ে মেরে শক্তি প্রদর্শন করলেন ,আর মার খেলেন মাথায় বালির বস্তা ,হাতে ঢাল নিয়ে গোপেরা dummy সেজে। মহিলাদের সেই লাঠিখেলা আজও অব্যাহত হয়ে পালিত হয় এই লাঠমার হোলির দিন।তবে তাতে লেগেছে উৎসবের আবেশ,আমেজ আর আনন্দ। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সখারা জোর করে রঙ মাখিয়েছিলেন শ্রীরাধাসহ তাঁর সখীদের। ছদ্ম প্রণয়কোপ প্রকাশ করতে প্রফুল্লিত গোপিনীরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন লাঠি। সেই স্মৃতিতেই তো আজও নন্দগ্রাম থেকে পুরুষরা রঙ মাখাতে আসেন বর্ষাণার মহিলাদের। আর মহিলারা লাঠমার দেন মাথায় ছোট বস্তা বাঁধা,মাটির ঢাল হাতে সজ্জিত পুরুষদের। লাঠির ঘায়ে একজনের ঢাল ভেঙ্গে গেলে,অপরেরটা কেড়ে আত্মরক্ষা করে সে। এভাবে চরম হাসাহাসি,আনন্দ,উৎফুল্লতার মধ্য দিয়ে এই হোলি পালিত হয়।

তারপর ,মূল হোলির উৎসব আগত হয় ; বসন্ত পূর্ণিমার শেষলগ্নের দিন তা পালিত হয়। তবে তার আগের দিন পালিত হয় হোলিকাদহনোৎসব । দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র বালক প্রহ্লাদ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। অনেক প্রকার চেষ্টা করেও , অনেক শিক্ষা দিয়েও যখন প্রহ্লাদের মতিগতির পরিবর্তন করা গেল না , তখন ক্ষুব্ধ হিরণ্যকশিপু স্থির করলেন দুষ্ট গোরুর থেকে শূণ্য গোয়াল ভালো— অর্থাৎ, প্রহ্লাদকে প্রাণে নিধন করবেন। কিন্তু প্রাণে মারার নানান রকম প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল । হতাশ হিরণ্যকশিপুকে দেখে শেষে ভগ্নী হোলিকা বলে বসলেন তিনি এবার হাল ধরবেন‌ । হোলিকা বরপ্রাপ্তা ছিলেন যে তাঁর অঙ্গকে অগ্নি স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি তাই প্রহ্লাদকে কোলে বসিয়ে অগ্নিসংযোগ করিয়ে দিতে বললেন তাঁকে চতুর্দিক থেকে। জ্বলন্ত অগ্নির দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠা গ্রাসে ফল হল বিপরীত। দুষ্ট অভিসন্ধি নিয়ে স্বেচ্ছায় অঙ্গে অগ্নিসংযোগ করায় , প্রাপ্ত বর কাজে লাগলো না । হোলিকা জ্বলেপুড়ে ভস্মীভূত হল আর বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কোন ক্ষতি হল না। কথায় আছে রাখে হরি মারে কে ! আসুরী শক্তির , অশুভ উল্লাসের পরাজয় যে সর্বদা হয়— তা স্মরণ করতে ও করাতে এবং আর্য ঋষিদের দ্বারা কৃত উত্তরায়ণের নব বৎসরের দোলযাত্রা উৎসবের আগের দিন পুরাতন আবর্জনা পুড়িয়ে পরিবেশ পরিষ্কার করার ও আগত নব বৎসরের আনন্দের দ্যোতক রূপে পালিত হয় এই হোলিকাদহন উৎসব । প্রচলিত নাম চাঁচর । চাঁচর শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার চর্চরী শব্দ থেকে। অর্থ— উৎসবের হর্ষধ্বনি। খড়, বাঁশ, শরপাতা, পুরানো গাছের ডাল, তালপাতা , নারকেল পাতা—- এসব দিয়ে তৈরী করা হয় ঘরের মত করে স্তূপ। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সেই স্তূপে অগ্নিসংযোগ করে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে হোলিকাদহনোৎসব পালন । এর অপর একটি প্রচলিত নামও আছে —-মেড়াপোড়া । আসুরী শক্তির প্রতীকী রূপে পিটুলি দিয়ে তৈরি একটি ভেড়াকে (যার নাম মেন্ডাসুর) ওই খড়ের ঘরের মধ্যে রেখে দেওয়া হতো। এই অসুর মেন্ডাকে পোড়ানো থেকেই হয় মেড়াপোড়া, যা আরও অপভ্রংশ হয়ে হয় নেড়াপোড়া। মনে পড়ছে , নেড়াপোড়ার সময় আমাদের বাংলায় প্রচলিত এক ছড়া—-আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল , পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল। উল্লেখ্য যে, সম্ভবতঃ হোলিকার নাম থেকেই হোলি উৎসব হয়েছে।

কথিত আছে, নব-নীরদ-বরণ শ্রীকৃষ্ণকে সান্ত্বনা দিতে মা যশোদা তাঁর হাতে রঙ দিয়ে বলেছিলেন, গৌরবর্ণা রাধার গাত্রে লেপন করে তাঁকে নিজের মত এক বর্ণের করে নিতে। সবান্ধব শ্রীকৃষ্ণ লুকিয়ে ছুঁড়লেন রঙ রাধা ও তাঁর সখীদের লক্ষ্য করে। গোপিনীরাই বা দমবেন কেন! তাঁরাও কলসে কাদামাটি গুলে তৎক্ষণাৎ দিলেন ঢেলে কানু আর তার গোপসখাদের মাথায়। ব্যস,মাখামাখি ,হাতাহাতি আনলো হাস্য-পরিহাস আনন্দের বন্যা। সেই থেকে রঙ দেওয়া-নেওয়া খেলার শুরু হয়ে গেল।
ফাগু খেলিতে ফাগু উঠিল গগনে।
বৃন্দাবনের তরুলতা রাতুল বরণে ।।
আবীর ,রঙ,ফাগের স্নানে সমগ্র বৃন্দাবন রেঙে ওঠে । রঙ তো নয় ,যেন হাতভর্তি মুঠো মুঠো ভালোবাসা অর্পিত হয় একে অপরের প্রতি। বর্ণবিদ্বেষকে যেন এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেবার দ্যোতক এই দোল উৎসব। মানবের মহামিলনের ,মহানন্দের হাট বসে যেন। আবার ,এই ফাল্গুনী পূর্ণিমাতেই তো শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ তথা মধ্যযুগের বাঙলার নবজাগরণের নায়ক শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মহাবির্ভাব মর্ত্য মাঝে। সে দিন ছিল ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ,শনিবার সন্ধ্যাবেলা।

কৈছন মধুরিমা, কৈছন রাধাপ্রেম, কৈছন প্রেমে তিঁহ ভোর——অর্থাৎ, রাধার প্রেমের মাধুর্য কেমন, রাধার প্রেমই বা কেমন আর সেই প্রেম আস্বাদন করে রাধা কী জাতীয় সুখ আস্বাদন করেন— এই তিন বাসনা পূরণ করতে তথা জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে শ্রীরাধার ‘ভাব’ কে নিজের হৃদয়ে ধরে , শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি অঙ্গে মেখে শ্রীশ্যামসুন্দর আবির্ভূত হলেন অবনী মাঝে শ্রীগৌরাঙ্গ হয়ে। দোল পূর্ণিমা এবার নবনামে আরো বেশী উজ্জ্বল ও ভাস্বর হল । আরও মহিমাময় হল। গৌরচন্দ্রের গৌরববোজ্জ্বল উদয় হয়েছে যে এই তিথিতে ! তাইতো ‘গৌরপূর্ণিমা’ হল। আহা , কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে -চারিপার্শ্বে ! বসন্ত রাগে শ্রীল নরহরি চক্রবর্তীপাদ গেয়ে উঠলেন তাঁর শ্রীভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে—-
জয় জয় জয় মঙ্গলরব ফাল্গুন পূর্ণিমা ফাল্গুন নিশি নবশোভিত
শচী-গর্ভে প্রকট গৌর বরজ (ব্রজ) রঞ্জনা
ঝলকতবর কনক তনু, কুঙ্কুম থির দামিনী ভানু,
চমকত মুখচন্দ মধুর ধৈরজভর ভঞ্জনা…
গায়ত কিন্নর সুধঙ্গ, বায়ত মৃদুতর মৃদঙ্গ
ধা ধি ধি ধিকিতা ধিক্ ধিক্ ধিক্কট তক ধিন্নানা।

তাই, সব মিলিয়ে ফাল্গুনী পূর্ণিমা এক বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ মধুময় তিথি ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই ঋক্ বেদের সময়কাল থেকে।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

কল্যাণীর সতীমার দোল মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

যতদূর জানা যায়, আনুমানিক দুশো বছর আগে আউলিয়া সম্প্রদায়ের সতীমা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী এই মেলার প্রবর্তন করেন । এপার বাংলা- ওপার বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষপাড়ার সতীমার দোল মেলা । খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষদয়ের নিয়ে গড়ে ওঠে আউলচাঁদ সমাজ । এই সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিলেন আউলচাঁদ । তাঁর মৃত্যুর পর আউল সমাজের কর্তাপদ লাভ করেন রামশরণ পাল । তাঁরই স্ত্রী ছিলেন সরস্বতী দেবী যিনি পরবর্তীকালে সতী মা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন ।
বাউল, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লীগীতির সুরে মেলা জমে ওঠে । আখড়ায় আখড়ায় সারা রাত ধরে বসে গানের আসর । শ্রোতারা অধিকাংশই গ্রাম ও মফঃস্বলের । বিভিন্ন জায়গায় তৈরী হয় লালন মঞ্চ । গানের পাশাপাশি বিশাল উনুন জ্বালিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হয় ঐ আখড়াগুলিতে । দূরদূরান্তের যাত্রীদের আশ্র্যস্থল এই আখড়াগুলি ।


এবার আসছি কর্তাভজা সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদ থেকে বিকশিত একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় । এই সম্প্রদায়ের মূল গুরু আউল চাঁদ ।
প্রথমেই বলি, আউল চাঁদ হলেন একজন বাঙালি ধর্ম প্রচারক ও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু । কিংবদন্তি বা লোকবিশ্বাস যে, গোরাচাঁদ অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যদেব আউল চাঁদ রূপে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন । গৃহী মানুষকে বৈরাগ্য ধর্ম শেখাতে শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হন আউল চাঁদ ফকির হয়ে । এখানে তাই কোনো জাতিভেদ নেই ।
আউল চাঁদের জন্ম খ্রিষ্টাব্দ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে । শোনা যায়, তিনি হিন্দু না মুসলমান সেটা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি । তবে প্রচলিত লোক কাহিনী অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার উলা গ্রামের ( অনেকের মতে, নদীয়া জেলার প্রাচীন জনপদ উলা বীরনগর ) পান ক্ষেত থেকে একটি নবজাতক শিশু পাওয়া যায় । ক্ষেতের মালিক মহাদের বারুই ভগবানের আশীর্বাদ ভেবে তাঁকে লালন-পালন শুরু করেন । বড় হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন । আউল চাঁদের পুরানো নাম পূর্ণচন্দ্র । সংস্কৃত ভাষা শেখানোর জন্য তাঁকে পাঠানো হয় সে সময়কার বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য হরিহরের কাছে । বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং নানাভাবে শিক্ষালাভ করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধিলাভ করেন । তাঁর নতুন নাম হয় ফকিরচাঁদ বা আউল চাঁদ । বহু দেশ ঘোরার পর নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় রামশরণ পাল নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি তাঁকে আশ্রয় দেন । আউল চাঁদের ২২জন শিষ্যের মধ্যে অন্যতম শিষ্য রামশরণ পাল । ২২জনের মধ্যে রামশরণ পাল আউল চাঁদের মৃত্যর পর গুরুপদ প্রাপ্ত হন । যারজন্য তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্তাভজা ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান, যা পরবর্তী সময়ে সতী মায়ের মন্দির নামে সবার কাছে পরিচিত । রামশরণ পালের স্ত্রীর নাম সরস্বতী, যার নামেই এই মন্দির—-সতী মায়ের মন্দির । কথিত আছে, সরস্বতীর প্রথম অক্ষর “স” আর শেষ অক্ষর “তী” অনুসারে সতী । আউল চাঁদের শিষ্য রামশরণ পাল গুরুর ভাবাদর্শকে ভিত্তি করে কর্তাভজা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন । এইজন্য ভক্তের নিকট তিনি “কর্তা” এবং তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী “কর্তামা” নামে অভিহিত । রামশরণ পালের পর সরস্বতী দেবী এই সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেন । রামশরণ পালের স্ত্রী কর্তাভজা সম্প্রদায়কে দিশা দেখান । রামশরণের স্ত্রী সরস্বতী দেবী ছিলেন অতীব ধর্মপরায়ণা । শোনা যায়, আউল চাঁদ হিম সাগরের জল ও ডালিম গাছের তলার মাটির সাহয্যে সরস্বতী দেবীকে অলৌকিক উপায়ে মৃত্যের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন । আরও শোনা যায়, আউল চাঁদই রামশরণ পাল ও সরস্বতী দেবীর সন্তান হয়ে পরবর্তীতে জন্ম নেন দুলাল চাঁদ নামে । দুলাল চাঁদ (১৭৭৬-১৮৩৩) কর্তাভজা সম্প্রদায়কে সাংগঠনিক রূপ দেন । তিনি বহু পদ রচনা করে কর্তাভজা ধর্মমতকে একটা তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত করেন । পদগুলি ভাব-গীত-রূপে ভক্তদের নিকট সমাদৃত । কর্তাভজারা কোনো জাতিভেদ মানেন না । তাঁরা লোভ-মোহ-কাম-ক্রোধকে নৈতিক পাপ বলে মনে করেন । সৎ পথে থেকে এবং মিথ্যা কথা পরিহার করে নৈতিকভাবে ধর্মকর্ম করা তাঁদের প্রধান লক্ষ্য । তাঁর সময়ে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত গড়ায় । মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় । এরপর তাঁর মা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী কর্তা মা বা সতীমা নামে খ্যাতিলাভ করেন ।
নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ার রামশরণ পালের আদি ভিটেটুকু ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র । ভিটের পাশেই ডালিম গাছ । এই গাছের নীচেই যেহেতু সতীমা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেই হেতু ভক্তরা ডালিম গাছের ডালে ঢিল বেঁধে মানত করেন । বাতাসা, কদমা, চিড়ে, মুড়কি দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তদের সতীমাকে পুজো দেওয়ার রীতি ।


জনশ্রুতি, শেষ বয়সে সরস্বতী দেবী সন্তানহারা হলে দোলপূর্ণিমার দিন গুরু পুজার আয়োজন করেন । সেই থেকে দোল পূর্ণিমার সূচনা । হাজার হাজার মানুষের সঙ্গেও বাউলেরা আসেন । তাই সতী মায়ের মেলাটা আউল-বাউলের মেলা বা আখড়া নামে পরিচিত ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় মূর্তিপুজা এবং সকল প্রকার আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী । কর্তাভজা প্রচারক দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান, সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান ।“ উক্ত ভাবের গীত থেকে বোঝা যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজনে মানব সেবার প্রসঙ্গটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । এই প্রসঙ্গে ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “মানুষ ভজ, মানুষ চিন্ত, মানুষ কর সার, সকলি মানুষের খেলা মানুষ বই নাই আর” ।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য । এই সম্প্রদায়ে নারী পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না । এই কারণে গুরুদেবের ভূমিকায় নারী পুরুষ উভয়কেই দেখা যায় । একই ভাবে তাঁরা বাউল সম্প্রদায়ের মতো জাতিভেদ প্রথা মানেন না । দুলাল চাঁদের ভাবের গীতে তাই বলা হচ্ছে—- “ভেদ নাই মানুষে মানুষে, খেদ কেন ভাই এদেশে ।”
সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ে । এ বিষয়ে কবি নবীন চন্দ্র সেনের বক্তব্য অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য । তাঁর মতে, “কর্তাভজা সম্প্রদায়ে কোন জাতিভেদ নেই । সকলেই এক রন্ধনশালার পাক গ্রহণ করে । ছোঁয়াছুয়ির দোষ এদের কাছে মুখ্য নয় । মানুষ সেবা তাঁদের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় ।“
কর্তাভজাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গুরুদেবের পুত্র অযোগ্য হলে তাঁরা তাকে গুরু নির্বাচন করতে চান না । তাঁদের নিয়মাবলী নামক ভাবের গীতে এই প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করে বলা হয়েছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিই গুরুদেব হবার অধিকারী । এই জায়গায় কর্তাভজা সম্প্রদায় বর্ণবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন ।
আজও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীমায়ের কৃপা পাওয়ার নিরিখে যথেষ্ট উন্মাদনা । তাঁদের মধ্যে সরল বিশ্বাস ও ভক্তি আজও উজ্জীবিত । যার জন্য দোল পূর্ণিমার দিন সতী মায়ের মেলায় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে । এদেশ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকেও মেলাপ্রাঙ্গনে অনেক মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো । বাউলদের সমারোহ আলাদা মাধুর্যে ভরপুর থাকে ঘোষপাড়ার এই মেলা । (তথ্যঃ সংগৃহীত) ।
—————-০———–
লেখক কথা সাহিত্যিক (ভারত) / +৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন , জগন্নাথের প্রসাদ আস্বাদন করার সময় মহাপ্রভুর কী হয়েছিল? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

একদিন মহাপ্রভু গেছেন শ্রীজগন্নাথ দর্শন করতে, সিংহদ্বারে দ্বারপাল তাঁকে দেখেই এগিয়ে এসে চরণবন্দনা করলেন । অমনই মহাপ্রভু , “কোথায় আমার কৃষ্ণ ? আমার প্রাণনাথ কোথায় গো? তুমি আমার সখা ; আমায় দেখাও সখা ,আমার প্রাণনাথকে ।”—-বলে অনুনয় করার মত দ্বারপালের হাতখানা জড়িয়ে ধরলেন। দ্বারপাল বললেন, “আমি দর্শন করাচ্ছি আপনাকে , চলুন ।” শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর হাত ধরে মন্দিরের জগমোহনে নিয়ে গেলেন দ্বারপাল। আর তারপর , শ্রীপুরুষোত্তমকে দেখিয়ে বললেন, “ঐ যে তিনি ! আপনার প্রাণনাথ।”

গরুর স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করতেন মহাপ্রভু । তিনি কখনোই গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথ দর্শন করতেন না । প্রতিদিনের মত আজও দ্বারপাল নিয়ে তাঁকে গরুর স্তম্ভের পিছনে বাঁ দিকটায়(গরুড়ের বাম দিক) দাঁড় করালেন এবং সেখান থেকেই মহাপ্রভু দু’নয়ন মেলে জগন্নাথকে দর্শন করলেন । জগন্নাথ আজ এখন মুরলীবদন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ধরা দিলেন মহাপ্রভুর নেত্রে । —-এই লীলার কথা রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাঁর ‘শ্রীচৈতন্যস্তবকল্পবৃক্ষ’ গ্রন্থের সপ্তম শ্লোকে প্রকাশ করেছেন।

“ক্ক মে কান্তঃ কৃষ্ণস্ত্বরিতমিহ তং লোকয়
সখে ! ত্বমবেতি দ্বারাধিপমভিবদন্নুন্মদ ইব।।
দ্রুতং গচ্ছ দ্রস্টুং প্রিয়মিতি তদুক্তেন
ধৃততদ্ভুতজান্তর্গৌরাঙ্গো হৃদয় উদয়ন্মাং মদয়তি ।।”

এমন সময় গোপালবল্লভ ভোগ লাগলো জগন্নাথের । ভোগের পর শঙ্খ , ঘন্টা আদি সহ আরতি হল । ভোগ সরলে জগন্নাথের সেবকগণ প্রসাদ নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে এলেন। তাঁকে প্রসাদী মালা পরিয়ে প্রসাদ হাতে দিলেন। সেই প্রসাদের আঘ্রাণ নিলেন মহাপ্রভু আর বললেন, “বহুমূল্য প্রসাদ ! এ যে সর্বোত্তম বস্তু !” এর অল্প নিয়ে তিনি জিহ্বায় দিলেন আর বাকিটা সেবক গোবিন্দ দাস আঁচলে বেঁধে নিলেন। সেই কণিকা মাত্র প্রসাদের অমৃতাস্বাদ করে প্রভুর মনে যেন চমৎকার হলো, সর্বাঙ্গে পুলক তাঁর । আর নেত্র থেকে অশ্রুধারা বইতে থাকলো। তিনি আপন মনে বিস্মিত হয়ে বললেন , “এই দ্রব্যে এত স্বাদ কোথা থেকে এলো ! ওহ্‌, এতে তো কৃষ্ণের অধরামৃত সঞ্চারিত হয়েছে ! তাই বুঝি এই বস্তু এত মধুময় হয়েছে স্বাদে !”—- এ কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মধ্যে প্রেমাবেশ হলো । কিন্তু পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সম্বরণ করে নিলেন জগন্নাথের সেবকরা তাঁর সামনে আসায় ।

মহাপ্রভু বারবার ‘সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত’ বলতে থাকলেন। জগন্নাথের সেবক মহাপ্রভুর মুখে এই শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রভু , সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে কি? অর্থ কি এর ?” তখন মহাপ্রভু বললেন , “এই যে তুমি আমায় কৃষ্ণের অধরামৃত দিলে ,এই বস্তু ব্রহ্মা আদি দেবতাদেরও দুর্লভ এবং অমৃতের স্বাদকেও নিন্দনীয় হতে হয় এর কাছে। শ্রীকৃষ্ণের ভুক্তাবশেষের নামই হল ফেলা । তিনি ভাগ্যবান যিনি ফেলামৃত লব মাত্র পান । সামান্য ভাগ্য যার সে এই বস্তু প্রাপ্ত হতে পারে না। যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ কৃপা তিনি তা পান। আর, তিনিই সুকৃতীবান যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের কৃপা থাকে । অর্থাৎ সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে হল যাঁর সুকৃতি লাভ হয় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ হয় তিনিই ফেলা রূপ অমৃত লাভ করতে পারেন ; শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত আস্বাদনের অধিকারী হন।”— এই বলে মহাপ্রভু সকলকে বিদায় দিলেন । তারপর জগন্নাথের উপলভোগ দর্শন করে গম্ভীরায় ফিরে এলেন।

মধ্যাহ্নকালে ভিক্ষা নির্বাহণ করলেন মহাপ্রভু । কিন্তু অন্তরে কৃষ্ণ-অধরামৃতের স্বাদ সর্বদা স্মরণ হচ্ছে তাঁর। বাইরে কর্ম করছেন অথচ অন্তরে প্রেমে গরগর মন হয়ে আছে। সেই সঘন আবেশ অত্যন্ত কষ্ট করে সম্বরণ করছেন তিনি। সন্ধ্যা বেলায় যখন পুনরায় নিজের পার্ষদগণের সাথে বসে কৃষ্ণকথা রঙ্গে নিভৃতে কাল কাটাচ্ছেন , তখন সেবক গোবিন্দ দাসকে ইঙ্গিত দিলেন দুপুরের সেই আঁচলে বেঁধে রাখা প্রসাদ এখন আনার জন্য । পুরী-ভারতী তথা তাঁর গণের সন্ন্যাসীদের জন্য কিছুটা পাঠিয়ে দেওয়া হলো , আর সেখানে উপস্থিত রামানন্দ রায় , সার্বভৌম ভট্টাচার্য , স্বরূপ দামোদর ও অন্যান্যদের সেই প্রসাদ বিতরণ করা হলো। প্রসাদের সৌরভ-মাধুর্য আস্বাদন করেই সকলে বিস্মিত হলেন । যে প্রসাদ এমন দিব্য সৌরভ সম্পন্ন , সেই প্রসাদের স্বাদ না জানি কেমন অলৌকিক হবে ! তখন মহাপ্রভু বললেন , “দ্যাখো, প্রসাদে যা যা আছে যেমন ধরো আখের গুড় , কর্পূর, মরিচ, এলাচ , লবঙ্গ,কাবাবচিনি, দারুচিনি এইগুলো সব প্রাকৃত দ্রব্য। তোমরা সকলেই এই সব প্রাকৃত দ্রব্যগুলোর স্বাদ, সুগন্ধ কেমন জানো । কিন্তু এই প্রসাদে তাহলে এত আমোদ কোথা থেকে এলো? প্রসাদের এই সৌরভ —এতো লোকাতীত ! এর আস্বাদন তাহলে কত না দিব্য ! আস্বাদ করে দেখ সকলের মনে প্রতীত হবে তাহলে। আস্বাদন তো অনেক পরের কথা , কেবল গন্ধেই মন মাতিয়ে দেয়। তাই না ! প্রসাদের এমন মাধুর্য যে আস্বাদন সময়ে আস্বাদন ব্যতীত অন্য সকল কিছু বিস্মৃত করিয়ে দেয় । কেন? কারণ , শ্রীকৃষ্ণের অধর স্পর্শ করেছে এই প্রসাদ। তাঁর অধর রসের গুণ সব সঞ্চারিত হয়েছে প্রসাদে, তাইতো অলৌকিক সুগন্ধ মাধুর্য হয়েছে এমন ! মহাভক্তি করে সকলে প্রসাদ আস্বাদ করো।”
সকলে হরিধ্বনি দিয়ে প্রসাদ আস্বাদন করলেন এবং আস্বাদন মাত্রই সকলের মন প্রেমে মত্ত হল। মহাপ্রভুর মধ্যে প্রেমাবেশ সে সময় । তিনি আজ্ঞা দিলেন রামানন্দ রায় কে শ্লোক পাঠ করতে। রামানন্দ রায় শ্রীমদ্‌ ভাগবতের শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।

“সুরতবর্দ্ধনং শোক নাশনং , স্বরিতবেণুনা সুষ্ঠচুম্বিতম্ ।
ইতররাগবিস্মারণং নৃণাং, বিতর বীর নস্তেহধরামৃতম্ ।।”
(শ্রীমদ্ ভাগবত, ১০, ৩১, ১৪ শ্লোক)

—– শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসমন্ডল থেকে অকস্মাৎ অন্তর্ধান হয়ে যান, শোকাকুলা গোপীরা বিলাপ করে বলছেন তখন— হে বীর ! তোমার সেই সুরতবর্ধনকারী (সম্ভোগেচ্ছা ক্রমশঃ বর্ধনকারী) অধরের সুধা যা তোমার বিরহ জনিত শোক রাশিকে নাশ করে তা আমাদেরকে বিতরণ কর । তোমার অধরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বেণু পঞ্চম সুরে নাদিত হয়ে মানবের সকল আসক্তি ভুলিয়ে দেয় ; সেই অধরের অমৃত আমাদের দাও।

সেই শ্লোক শ্রবণ করে রসরাজ-মহাভাবের মিলিত স্বরূপ মহাপ্রভু তখন ভাবাবিষ্ট হয়ে রাধার উৎকণ্ঠা জনিত একটি শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।

“ব্রজাতুলকুলাঙ্গনেতর রসালি তৃষ্ণাহরঃ ,
প্রদীব্যদধরামৃতঃ সুকৃতিলভ্য ফেললাবঃ।
সুধাজিদহিবল্লিকাসুদলবীটিকাচর্বিতঃ,
স মে মদনমোহনঃ সখি তনোতি জিহ্বাস্পৃহাম্।।”
(গোবিন্দলীলামৃত, ৮, ৮শ্লোক)

—- শ্রীমতী রাধিকা তাঁর সখী বিশাখাকে বলছেন, হে সখি ! অনন্যা ব্রজকুলবতী ললনাদের যিনি অধরামৃত দ্বারা আনন্দ দান করে তাঁদের অন্য সকল রস-তৃষ্ণাকে হরণ করেন , যাঁর চর্বিত তাম্বুলে অমৃতাপেক্ষা অধিক স্বাদ—-সেই শ্রীমদনমোহন আমার জিহ্বার স্পৃহাকে বিস্তৃতি দান করেছেন।

তারপর মহাপ্রভু নিজেই দুই শ্লোকের অর্থ প্রলাপের মত উচ্চারণ করে গেলেন । সকলে শ্রবণ করে ভাবের ভিয়ানে বিহ্বল হলেন। গ্রন্থ– মহাপ্রভুর মধুময় কথা , লেখিকা —- রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক, প্রকাশক–তথাগত।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন পীলু ফল নিয়ে মহাপ্রভুর আনন্দময় কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীজগদানন্দ পন্ডিত বৃন্দাবন ভ্রমণ করে নীলাচলে মহাপ্রভুর কাছে ফিরে যাচ্ছেন । শ্রীসনাতন গোস্বামী তাই তাঁর হাত দিয়ে মহাপ্রভুর জন্য কিছু ভেট বস্তু অর্থাৎ উপহার সামগ্রী পাঠালেন । কী কী সেই উপহার ? — রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা , শুষ্ক পাকা পীলু ফল আর গুঞ্জামালা । জগদানন্দ পন্ডিত ফিরে যেতেই সনাতনের মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। এতদিন তো মহাপ্রভুর অতি কাছের একজন মানুষ, প্রিয় পরিকর বা দূত যাই বলি না কেন তিনি ছিলেন সনাতনের কাছে। জগদানন্দের সঙ্গ পেয়ে সনাতনের মনে হতো যেন মহাপ্রভুর আবেশ উপলব্ধি করছেন । যেমনটা হয় আর কী ! প্রিয়জনের কাছের কাউকে পেলেও মনে এক অদ্ভুত প্রেম ভাব জাগে , ভালো লাগে—তেমন আর কী ! আজ জগদানন্দ চলে যেতে সনাতনের মন তাই কেঁদে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। দ্বাদশ আদিত্য টিলার উপর একটি মঠ পেয়ে , সে স্থান সংস্কার করে চালা বেঁধে রেখে দিলেন তিনি, যাতে ব্রজে এসে মহাপ্রভু সেখানে বাস করতে পারেন নিরালায় ।

ওদিকে জগদানন্দ পথে একটুও দেরী না করে খুব শীঘ্র চলে এলেন নীলাচলে । তাঁর যে আর তর সইছে না মহাপ্রভুকে দু’চোখ ভরে দেখার জন্য। নীলাচলে মহাপ্রভু সহ আর সব ভক্তদের পেয়ে তাঁর মনে পরম আনন্দ হল । প্রভুর চরণ বন্দনা করে সকলের সাথে আলিঙ্গন করলেন। মহাপ্রভুও তাঁকে দৃঢ় আলিঙ্গন দিলেন । ব্রজ থেকে ফেরত এসেছে যে প্রাণপ্রিয় বাল্যবান্ধব জগদানন্দ ! তাই। এরপর জগদানন্দ সেই সমস্ত ভেট তথা উপহার সামগ্রী মহাপ্রভুর শ্রীহস্তে তুলে দিলেন, যা-যা সনাতন প্রেরণ করেছিলেন মহাপ্রভুর জন্য ।

রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা আর গুঞ্জামালা নিজের কাছে রেখে মহাপ্রভু পীলু ফলগুলি তখনই সকলের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বললেন । ভক্তরা বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফল দেখেননি। গৌড়দেশে পীলুফল হয়ও না। বৃন্দাবন থেকে এসেছে যে ফল সে ফল না জানি কত ভালো , কত সুস্বাদু, কত অমৃতসম মিষ্টি হয়তো বা ! তাই তো সনাতন পাঠিয়েছেন পীলু ফল ! তাই না ! একারণে সকলের মধ্যেই মহা আগ্রহ পীলু ফল খাবার । সকলে মহা আনন্দের সাথে পীলু ফল হাতে নিলেন খাবেন বলে।

যাঁরা জানেন তাঁরা পীলু ফল নিয়ে চুষতে থাকলেন আর যাঁরা জানেন না বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফলে কামড় বসিয়ে চিবোতে শুরু করে দিলেন। আর যে মুহূর্তে চিবোলেন অমনি তাঁদের মুখের ছাল উঠে গেল, জিহ্বা প্রচন্ড জ্বালা করতে থাকলো । আসলে পিলু ফল এমনই হয় ,চিবিয়ে খেতে নেই ,চুষে খেতে হয় । চিবোলেই মুখ জ্বলে যায় । স্বাভাবিক ভাবেই পীলু ফলকে কেন্দ্র করে তখন সেখানে এক মহা রগড় হলো মহাপ্রভু ও ভক্তদের মধ্যে।

“সনাতন প্রভুকে কিছু ভেট বস্তু দিলা ।।
রাসস্থলীর বালু আর গোবর্ধনের শিলা ।
শুষ্ক পক্ক পীলু ফল আর গুঞ্জামালা ।।
জগদানন্দ পণ্ডিত চলিলা সব লইয়া।
*************************************
*************************************
*************************************
সনাতনের নামে পন্ডিত দণ্ডবৎ কৈল।
রাসস্থলীর বালু আদি সব ভেট দিল ।।
সব দ্রব্য রাখি পীলু দিলেন বাঁটিয়া ।
বৃন্দাবনের ফল বলি খাইল হৃষ্ট হইয়া।।
যে কেহ জানে সে আঁটি চুষিতে লাগিল ।
যে না জানে গৌড়ীয়া পীলু চিবাইয়া খাইল।।
মুখে তার ছাল গেল জিহবা করে জ্বালা ।
বৃন্দাবনের পীলু খাইতে এই এক লীলা।।”
(চৈ।চ। অন্ত্য,১৩)

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর মধুময় কথা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীগৌরাঙ্গের পতিত-পাবন নামের সার্থক প্রমাণ হল শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই উদ্ধার লীলা। ভক্ত শিরোমণি জগাই-মাধাইয়ের অবণীতে আবির্ভাব হয় প্রভুর ইচ্ছায় দুরাচারী, অত্যাচারী, মদ্যপ ও অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরূপে। এমন কোন পাপকর্ম জগৎ-এ ছিল না, যা, তাঁরা করতেন না। চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, গোমাংস ভক্ষণ, পরের গৃহ অগ্নিদগ্ধ করা, স্ত্রী-হত্যা, ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি সব রকম অসৎকর্মই তাঁরা অবলীলায় করতেন। তবে হ্যাঁ, উল্লেখ্য যে, বৈষ্ণব অপরাধ তাঁরা কখনও করেননি। মদ্যপ সঙ্গীদের সঙ্গ সবসময় করতেন বলে বৈষ্ণব অপরাধ করার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনদিন হয়ে উঠেছিল না।
নবদ্বীপবাসী ব্রাহ্মণ শুভানন্দ রায়। নবদ্বীপের জমিদার বলেই তাঁর দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছিল। সুমিষ্ট, সৎ ব্যবহারের জন্য পাৎসাহ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তাঁর দুই পরম-সুন্দর পুত্র—–জ্যেষ্ঠ রঘুনাথ, কনিষ্ঠ জনার্দন দাস। রঘুনাথের পুত্রের নাম জগন্নাথ আর জনার্দনের পুত্র মাধব। এই জগন্নাথ ও মাধবই ওরফে ‘জগাই-মাধাই’ বলে পরিচিত ছিলেন। নবদ্বীপের কোটাল এই দুই ভাই। যদিও জগাই-মাধাইয়ের পূর্বপুরুষরা সকলেই সদাচারী ছিলেন, কিন্তু মদ্যপ-কুসঙ্গীদের পাল্লায় পরে জগাই-মাধাইয়ের চরিত্রের অবনমন ঘটে। আর সেজন্য স্বজনদের দ্বারা তাঁরা পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। ভক্তসঙ্গ কী জিনিষ তা তাঁরা জানতেনই না। মদ্যপান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি পর্যন্ত যেতেন, কখনো বা বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন, আবার কখনো অশ্রাব্য গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যেই কিল-চড়-লাথি দিতেন। লোকে তাঁদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন সব সময়। যে পথ দিয়ে জগাই-মাধাই যেতেন। দূর থেকে দেখতে পেলে সেই পথ এড়িয়ে অন্য পথ ধরতেন ভীত পথিকেরা।
এমনই একদিন প্রচুর মদ্যপান করে রাস্তায় ধুলোয় পড়ে ‘কিলাকিলি-লাথালাথি করছিলেন জগাই-মাধাই। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশে প্রতিদিন নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের প্রতি ঘরে ঘরে গমন করে মানুষকে কৃষ্ণ বলাচ্ছেন সেসময়। সেদিন তাঁরা সম্মুখীন হলেন পথে জগাই-মাধাইয়ের। দেখলেন ওভাবে মদের নেশার বিক্ষেপে তাঁদের পশুবৎ দশা। তখন পরম করুণ নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন, “ইস্! কী করুণ দশা এদের! এমন পাতকী তো কোথাও দেখিনি। আমার প্রভু গৌরাঙ্গ পাতকীদের উদ্ধার করতেই এই কলিতে এসেছেন। যদি এদের মতো পাপীদের তিনি উদ্ধার করেন, তবেই তো তাঁর পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে, তবে তো জগৎবাসী জানবে যে আমার প্রভুর মহিমা কতখানি! যাঁর ভৃত্য বলে আমরা গর্ব বোধ করি, তিনি যে কতখানি ক্ষমতা ধরেন সে প্রমাণ পাবে মানুষ তখন। না, এদেরকে ভক্তিপথে আনতেই হবে। যাঁরা ভক্ত হয় তাঁরা অতি সহজেই নাম নেয়; কিন্তু যদি এদের মত দুরাচারীকেও নাম নেওয়ানো যায়, তবেই আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সফল হবে। না হলে তো বৃথা আষ্ফালন সব আমাদের ! না, হরিদাস, আমাদের এখন প্রথম কাজ হবে এদেরকে উদ্ধার করা। অন্য জায়গায় আমরা পরে যাব। গৌরীহরিকে এদের কথা জানাবো। হরিদাস, তোমাকে যবনরা অত্যাচার করেছিল। তুমি তো তাদেরও মঙ্গল কামনা করেছিলে। এবার এদের মঙ্গল চাও। কারণ, তোমার মত ভক্তের চাওয়া ভগবান পূরণ করবেনই। এরা উদ্ধার হবে এই পাপী জীবন থেকে তবে।”
হরিদাস বললেন, “সে কী কথা! তুমি চেয়েছো যখন তখনই তো তা পূরণ হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। তোমার ইচ্ছাই যে প্রভুর ইচ্ছা। আবার আমাকে টানছো কেন!” নিত্যানন্দ একথায় হেসে প্রেমালিঙ্গন দিলেন হরিদাসকে। তারপর একটু দূর থেকে উপদেশের সুরে জগাই-মাধাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, লহ কৃষ্ণনাম। কৃষ্ণ মাতা, কৃষ্ণ পিতা, কৃষ্ণধন প্রাণ।। তোমা সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার। হেন কৃষ্ণ ভজ, সব ছাড় অনাচার।।”
কিন্তু উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হল । জগাই এমন কথা শুনে একটু মাথা তুলে প্রথমে দেখলেন, তারপরই মহাক্রোধে “ধরতো! ধরতো!” বলে ধাওয়া করলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে। “রক্ষ কৃষ্ণ, রক্ষ কৃষ্ণ” বলে নিতাই-হরিদাস কোনক্রমে জগাইয়ের প্রহারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। সে কী অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য! গর্জন করতে করতে দুই দস্যু ধাওয়া করছেন আর সামনে প্রেমে বিহ্বল দুই মহাভক্ত হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছেন।
শ্রীবাস গৃহে ভক্ত সমেত বসে আছেন বিশ্বম্ভর। নিতাই-হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সব বললেন তাঁকে। শ্রীবাস পন্ডিত ও গঙ্গাদাস জগাই-মাধাইয়ের বংশ পরিচয় দিলেন এবং তাঁদের দুষ্কর্মের আদ্যোপান্ত বর্ণনাও দিলেন। নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু, আগে তোমায় এদেরকে উদ্ধার করতেই হবে। তারপর অন্য কথা। তোমার পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে এদের পাপমোচনের দ্বারা। বিশ্ববাসী তোমার মহিমা দেখুক।” গৌরাঙ্গ হেসে বললেন, “যে মুহুর্তে তোমার দর্শন ওরা পেয়েছে, তুমি চেয়েছো ওদের উদ্ধার, সেই মুহূর্তেই ওদের সব পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু তুমি ওদের মঙ্গল চিন্তা করো, দেখবে অচিরেই কৃষ্ণ ওদের মঙ্গল সাধন করে দিয়েছেন। তোমার ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হবে।”
রাত্রিবেলায় একদিন নগর ভ্রমণ করে নিত্যানন্দ যাচ্ছেন পথ দিয়ে হেঁটে, এমন সময় জগাই-মাধাই তাঁর পথ অবরোধ করলেন। বললেন, “কে রে? কে তুই?” নিত্যানন্দ বললেন, “আমি অবধূত, গৌরগুণ গাই। এখন বাড়ি যাচ্ছি।” অবধূত শব্দ শোনা মাত্র মাধাই করলেন কী, পথের পাশে পড়ে থাকা এক ভাঙা কলসী উঠিয়ে নিয়ে আছাড় মারলেন নিত্যানন্দের মস্তকে। সজোরে আঘাত করায় মাথা ফেটে গেল নিতাইয়ের। আর অবিরল ধারায় রক্ত ঝরতে লাগলো। অক্রোধ পরমানন্দ, অভিমান শূন্য নিতাই গৌরস্মরণ করে নির্বিকার চিত্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর নির্লিপ্ততা দেখে মদ্যপ মাধাই আবার মারতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রক্তধারা আর নিতাইয়ের নিশ্চুপতা দেখে জগাইয়ের মন দৈবেচ্ছায় মাখনের মত গলে গেল। তিনি মাধাই কে বললেন, “না, না, আর মেরো না। ও তো অবধূত, তা আবার দেশান্তরী ! ওকে মেরে লাভ কী তোমার! এত নির্দয় হয়ো না।” এই বলে তিনি মাধাইয়ের হাত ধরে ফেললেন। এদিকে অন্যান্য পথচারীদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে এ দুঃসংবাদ দিলেন গৌরাঙ্গকে।

শোনামাত্র গৌরাঙ্গ সপরিকর ছুটতে ছুটতে এলেন সেই মুহুর্তেই। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইয়ের অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! এ কী সহ্য করা সম্ভব! প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন গৌরাঙ্গ। স্বয়ং তাঁকে প্রহার করে রক্ত ঝরিয়ে দিলেও এতখানি ক্রোধিত হতেন না, যতখানি নিতাইয়ের ক্ষেত্রে হলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি “চক্র, চক্র” বলে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান জানিয়ে নিজের হাত উপরে তুললেন। সুদর্শন চলে এলেন তাঁর হাতে। ভক্তরা সকলে প্রমাদ গুনলেন। এবার তো আর নিস্তার নেই জগাই-মাধাইয়ের! চক্র দ্বারা প্রভু তাঁদের সংহার করবেনই করবেন। কিন্তু, কলিতে এই অবতারে তো তাঁর অস্ত্র ধরার কথা নয়। তাঁর অঙ্গ-উপাঙ্গ স্বরূপ পার্ষদরাই তাঁর অস্ত্র। পার্ষদদের দ্বারা নাম-প্রেম বিতরণ করিয়ে তিনি পতিতদের উদ্ধার করবেন। তাঁর রূপ মাধুর্য্যের দ্বারা অসুরের আসুরিক স্বভাবের পরিবর্তন করবেন। তাঁকে দর্শন করেই দুরাচারীদের মন পরিবর্তিত হবে। এযুগে তো তিনি কাউকে সংহার করবেন না। বরং মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রেমভক্তিতে মনকে জারিত করবেন, ভক্ত বানাবেন অভক্তদের। মহাভাগবত হবেন তাঁরা এক-একজন সব।
নিত্যানন্দ করলেন কৌশলতা এক। তিনি মহাপ্রভুর মন ঘোরাবার চেষ্টা করলেন, বললেন- “প্রভু, দেখ, দেখ, এই যে জগাইকে দেখছো , এ আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছে। মাধাই মারতে গেলেও তাঁকে বাঁধা দিয়ে রক্ষা করেছে আমায়।” একথা শুনেই গৌরাঙ্গের মনসংযোগ চক্রের প্রতি থেকে সরলো। বললেন- “তাই নাকি! তুমি আমার নিতাইকে রক্ষা করেছো জগাই ! প্রভু তোমার অনেক মঙ্গল করুক। নিত্যানন্দকে বাঁচিয়ে তুমি আমায় কিনে নিলে আজ।” এই বলেই তিনি জগাইকে জড়িয়ে ধরলেন। জগাইকে রেখে পাছে মাধাইকে মারেন, তাই নিত্যানন্দ বলে চললেন- প্রভু, এই দু’জনার শরীরই আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি। তুমি তো এযুগে প্রতিজ্ঞা করেছো যে অস্ত্র না ধরেও জীবতারণ করবে। তবে কেন তার ব্যাতিক্রম করবে! এই দুইজনকেই তুমি কৃপা কর।”
এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেমালিঙ্গন দেওয়ায় প্রেমভার বইতে না পেরে জগাই মূর্ছিত হয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ বললেন- “ওঠো জগাই। তোমার যা বর লাগে, তুমি চেয়ে নাও আজ। আমি আজ সত্য সত্যই তোমায় প্রেমভক্তি প্রদান করলাম। আমার দেহ থেকেও নিত্যানন্দের দেহ বড় আমার কাছে জেনো। তুমি তাঁকে রক্ষা করেছো যখন, শ্রীকৃষ্ণ তোমায় অনেক কৃপা করবেন এই আমি বললাম।” জগাই দেখলেন গৌরহরি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রেমানন্দে করজোড়ে তখন প্রাণের আকুতিভরা প্রণাম জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গকে জগাই। তাঁর নয়নের জল সর্বাঙ্গ বয়ে নীচে পড়ছে। তিনি আবার জ্ঞান হারালেন। তখন গৌরহরি নিজের শ্রীচরণখানি তাঁর বক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। যাঁর অভয়পদ স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর জীবন, সেই পদ হৃদয়ে ধরে জগাই সদৈন্যে তখন কেঁদেই চলেছেন। সেই দুরাচারী জগাই কই আর! ইনি যে এখন মহাভক্ত এক। জগাইয়ের ওপর গৌরহরির এমন করুণা দেখে উপস্থিত ভক্তবৃন্দরা হরিধ্বনি দিতে থাকলেন উচ্চৈঃস্বরে। আকাশ ভেদ করে সে দিব্যধ্বনি যেন গোলকে পৌঁছে যাচ্ছিল।

এতক্ষণ ধরে এতসবের সাক্ষী মৌন মাধাই। তাঁর ভাবান্তর ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী জগাই এমন কৃপা পেয় গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্ধার হয়ে গেল, অথচ, তিনি তিমিরেই পড়ে রইলেন !—– একথা ভেবে মাধাই তখন পাগলপ্রায় হয়ে গৌরাঙ্গের পাদপদ্মে পড়ে গেলেন ছিন্নমূল বৃক্ষের মত। তাঁর দুর্বুদ্ধির বিনাশ হয়ে গেছে। তিনিও এখন দুষ্কর্ম ছেড়ে জগাইয়ের মত ভক্ত হতে চান। তাই বিনয় বচনে বললেন- “আমরা দুই ভাই জগাই-মাধাই সর্বক্ষণ একসাথে থাকি। একই কুকর্ম করি, তবে কেন একজনকে কৃপা করে অন্যজনকে বঞ্চিত করবে প্রভু? আমাকেও উদ্ধার কর। ক্ষমা করে দাও আমায়। অনুগ্রহ করে আমাকেও তোমার নাম-গান প্রচারে সামিল কর। আমার মত দুর্জনকে তুমি উদ্ধার না করলে, আর কী গতি হবে আমার! কৃপা কর দয়াময়। কৃপা কর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “না, তোমার ত্রাণ কোনমতে হবে না। তুমি নিত্যানন্দের দেহে আঘাত করেছো।” মাধাই—-“প্রভু, তোমার অন্যান্য অবতারে কত অসুর তো তোমায় বাণেতে বিদ্ধ করেছে। তুমি তো তাঁদের সকলকেই উদ্ধার করেছো। তোমার অভয়পদে স্থান দিয়েছো। তবে আমার বেলায় কেন তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করবে তোমার! গৌরাঙ্গ, “তুমি তো আমায় নির্য্যাতন করোনি। করেছো আমার প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইকে। যদি আমায় করতে, তাহলে ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিতাম। কিন্তু, আমার দেহের থেকেও নিত্যানন্দের দেহ যে অনেক প্রিয় , অনেক বড় আমার কাছে। তাঁকে দুঃখ দিয়ে আমার কৃপা কোনমতেই পাবে না আমার থেকে।” মাধাই, “প্রভু, তুমি তো সর্ব রোগহর বৈদ্য চূড়ামণি। তবে আমার এই কঠিন রোগ কেমন করে দূর হবে বলো! বলে দাও কী করলে আমার পরিত্রাণ হবে এ ঘৃণ্য অপরাধের থেকে। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।” তখন গৌরসুন্দর বললেন- “যদি নিজের পাপমোচন করতে চাও, তবে যাঁর চরণে অপরাধ হয়েছে, তাঁর শরণ নাও। নিতাইয়ের অপরাধী তুমি, তাই নিতাইয়ের কাছেই তোমার ক্ষমাভিক্ষা করতে হবে। সে যতক্ষণ না কৃপা করবে, তোমার প্রেমভক্তি ততক্ষণ বাদ।”
মাধাই নিত্যানন্দের শ্রীচরণে পড়লেন। যে পদ দেব ঋষিগণ প্রার্থনা করেন, রেবতী যে পদযুগলকে সেবা করেন সেই পদে মাথা কুটতে থাকলেন মাধাই। গৌরহরি বললেন, “নিতাই তুমি ওকে ক্ষমা না করলে যে ও উদ্ধার হবে না ! তোমার কৃপা বিনা তো কেউ প্রেমভিক্ষা পায় না। তাই, এবার দেখো তুমি ওকে কী করবে!” নিত্যানন্দ হেসে বললেন, “আমার জীবনে যদি কিছু সুকৃতী থেকে থাকে, আমি তার সমস্তটা আজ মাধাইকে দান করলাম।” এই বলে মাধাইকে নিজের চরণ থেকে তুলে কৃপালিঙ্গন দিলেন তিনি। মাধাইয়ের শরীরে নিজ শক্তি সঞ্চার করে দিলেন। সকল বন্ধনের বিমোচন হয়ে গেল মাধাইয়ের। মহাভাগবত হলেন মাধাই সে মুহুর্তেই। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই-মাধাই, তোমাদের কোটি জন্মের সব পাপের ভার আমার হল। আর কিন্তু নতুন কোন পাপ কার্য করো না, আজ থেকে। তোমাদের পূর্বের কর্মের সবদায় আমার হল।“ জগাই-মাধাই সমস্বরে বলে উঠলেন- “না, না, বাবা, আর নয়। আমরা আর কোনদিন, কোন কুকর্ম করবো না। এমনকী করার কথা ভাববোও না।” গৌরাঙ্গ, “বেশ, তবে তোমাদের দেহ আমার অবতার হবে। তোমাদের দুজনার মুখ দ্বারা আহার হবে আমার।” এমন কৃপাশীর্বাদ পেয়ে দু’ভাই বাহ্য হারালেন। গৌরাঙ্গ তাঁর পরিকরদের বললেন, “এদের দুজনকে আমার ঘরে নিয়ে চল। ব্রহ্মার দুর্লভ যে ধন, আজ সেই ধন আমি এদেরকে দেব। সকলের থেকে উত্তম বানাবো। এদেরকে স্পর্শ করলে গঙ্গাস্নানের সমান ফল প্রাপ্ত হওয়া যাবে এমন পূণ্যবান ভক্ত বানাবো এদের।”
জগাই-মাধাই দু-ভাইকে নিয়ে গেলেন ভক্তরা প্রভুর ঘরে। তাঁদের দুজনকে ঘিরে সংকীর্তন শুরু হল। কীর্তনের রোল শ্রবণ করে প্রেমানন্দে উঠে বসে দু’বাহু তুলে অপার নৃত্য করতে থাকলেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দেহে বাহ্যস্মৃতি লোপ পেল। প্রেমে বিভোর দুই তনু তখন ঢলঢল, গড়গড়। অশ্রুনীরে সর্বাঙ্গ সিক্ত। সাত্ত্বিকভাবের প্রকাশ দেহে। দৈন্য, স্তুতি করে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের সেই দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়। তাঁদের দৈন্য দেখে বুক ফাটে এমন দশা তখন ভক্তদের। গৌরাঙ্গ বললেন, “আজ থেকে এরা আর মদ্যপ হবে না। এরা আমার সেবক। সকলে প্রাণঢেলে আশীর্বাদ কর এদেরকে যেন জন্মে-জন্মে আমায় না ভোলে আর। কারোর চরণে যদি কিছু অপরাধ থেকে থাকে এদের, তাহলে তোমরা নিজগুণে সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিও। কৃপা কর সকলে জগাই-মাধাইকে।” তখন দু’ভাই জগাই-মাধাই চোখের জলে ভেসে সকলের চরণ ধরে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকলেন । সকলে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাঁদেরকে আপন করে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেদিন থেকে তাঁরা অনুগত সেবক হলেন গৌর-নিতাইয়ের। এরপর সকলে মিলে কীর্তন করতে করতে গঙ্গাস্নান করতে গেলেন। অনেক জলকেলি হল। জগাই-মাধাইয়ের সব পাপ নিজে ধারণ করে নিলেন প্রভু। প্রমাণ দিতে ‘কালিয়া-আকার’ ধারণ করেছিলেন সেদিন। স্নান সেরে তীরে উঠে, নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ প্রভুদ্বয় আপন আপন কন্ঠের মালা জগাই-মাধাইকে পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে মহাভাগবত হলেন দু-ভাই জগাই ও মাধাই।
“মহাপ্রভু দুঁহে করিয়া আলিঙ্গন।
বোলে আজি হৈতে মোর সেবক দুইজন।। নিতাই আলিঙ্গিয়া দুঁহে বলয়ে বচন।
প্রিয় শিষ্য হৈলে মোর তোমরা দুইজন।। জগাই মাধাই হৈলা ভক্ত অতিশয়।
দুই প্রভুর দুই শাখা মধ্যে গণনা যে হয়।।”
(প্রেমবিলাস, ২১)

“এতেক যতেক কৈল এই দুইজনে।
করিলাম আমি ঘুচাইলাম আপনে।।
ইহা জানি এ দুইয়ে সকল বৈষ্ণব।
দেখিয়া অভেদ দৃষ্ট্যে যেন তুমি সব।।
শুন এই আজ্ঞা মোর যে হও আমার।
এ দুইয়ে শ্রদ্ধা করি যে দিব আহার।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যত মধু আছে।
সে হয় কৃষ্ণের মুখে দিলে প্রেমরসে।।
এ দুইরে বট মাত্র দিবে যেই জন।
তার সে কৃষ্ণের মুখে মধু সমর্পণ।।
এ দুই জনেরে যে করিবে উপহাস।
এ দুইর অপরাধে তার সর্বনাশ।।
তবে গলার মালা দোঁহার গলে দিল।
প্রভু কৃপা পাই দোঁহে প্রেমেতে ভাসিল।।”
(চৈ.ভা-১৩)
পরম প্রেমিক, মহাভক্ত জগাই-মাধাই দু’ভাই এখন দিবানিশি কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে আঁখি নীরে ভাসেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে এসে তাঁরা দুই লক্ষ নাম নেন। কৃষ্ণ বলে নিরবধি হা-হুতাশ করেন। কৃষ্ণময় জগৎ এখন তাঁদের। কিন্তু, এত সবের সঙ্গে নিজেদের অতীতের কীর্তিকলাপের কথা ভেবে ধিক্কার দেন নিজেদেরকেই তাঁরা। নিজেদের জীবহিংসার কথা ভেবে মরমে মরে যায়। ভূমিতে পড়ে আকুলি-বিকুলি করেন অনুশোচনায়। পতিত পাবন গৌরসুন্দর কত দয়াময় আর নিত্যানন্দ এত করুণাময়(!), তাঁদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন এত অবলীলায়, এত কৃপা করলেন!—–এসব ভেবে কেঁদে আকুল হন তাঁরা। বিহ্বল হয়ে যান প্রভুদের কৃপালীলার কথা ভেবে। কখনো কৃষ্ণপ্রেমানন্দে, কখনো নিজেদের কর্মের কথা ভেবে প্রায়ই আহার করেন না। তখন নিতাই-গৌরসুন্দর অনেক বুঝিয়ে আহার তুলে দেন মুখে তাঁদের।
মাধাই আরও বেশী অনুশোচনায় ভোগেন জগাইয়ের থেকে। তিনি নিতাইকে প্রহার করেছেন, রক্ত বের করে দিয়েছেন মাথা থেকে; কত না পাপীষ্ঠ তিনি! —-একথা ভেবে বক্ষ ভাসান নয়ন জলে। যদিও নিতাই তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও একদিন দন্তে তৃণ ধরে আবার নিত্যানন্দের চরণে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন তিনি। চোখের জলে নিত্যানন্দের চরণ ধুয়ে দিলেন, স্তব করলেন কত না। সন্তুষ্ট নিত্যানন্দ বুকে টেনে নিলেন তাঁর প্রিয় মাধাইকে। বললেন- “মাধাই, তুমি এখনো এতদিন পরেও কেন এমন করো। শোক পরিহার কর। তুমি তো এখন আমার দাস। তোমার শরীর এখন আমার সম্পদ। তুমি এভাবে দৈন্যক্রন্দন করে আমাকে কেন কষ্ট দাও। শিশুপুত্র যদি পিতাকে মারে, পিতার কী কিছু যায় আসে তাতে! পুত্রের অপরাধ দেখে না পিতা। তেমন তুমিও তখন অজ্ঞানী ছিলে শিশুপুত্রের ন্যায়। তোমার কোন অপরাধ আমি দেখিনি। তার ওপর আমার প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ তোমায় আপন করেছেন। যাকে তিনি কৃপা করেন, সে আমার জন্মে জন্মে প্রিয়পাত্র হয়। আর যে জন তাঁকে লঙ্ঘন করে আমায় পূজা দেয়, সেই মূঢ় কখনো আমার কৃপার প্রাপ্ত হয় না, প্রিয়পাত্র হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তোমায় তিনি কৃপা করেছেন যখন, তখন তুমি আমার যে কত প্রিয় হয়েছো, তা আমি বোঝাতে পারবো না।” এইবলে নিত্যানন্দ মাধাইকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। তখন মাধাইয়ের অন্তর শান্ত হলেন। মাধাই বললেন, কিন্তু, প্রভু আমার যে অনেকের কাছে অনেক অপরাধ জমা আছে। তার কি হবে? আমি তো তাদের সকলকে চিনিও না। ভুলে গেছি কারা তারা। কি করে তাদের কাছে আমি ক্ষমা চাইবো? আমি বহু বহু পাপ করেছি এতদিন ধরে। কি করে সেই অপরাধবোধ যাবে আমার?”
তখন নিত্যানন্দ বললেন, বেশ, তবে এক কাজ করো। তুমি প্রতিদিন গঙ্গারঘাটে গিয়ে মার্জন করবে ঘাঁট। যারা স্নান করতে আসবে তাদের যতটা সম্ভব সেবা করবে। তারা স্নান করে উঠলে তাদের প্রণাম জানিয়ে ক্ষমা চাইবে। প্রসন্ন হয়ে তারা তোমায় আশীর্বাদ করবে কল্যাণ হোক বলে, তাতেই তোমার পাপস্খলন হবে, অপরাধবোধ চলে যাবে। হৃদয় প্রশান্ত হবে। এই আকুলতা দূর হবে।
নিত্যানন্দের দেখানো পথেই এখন জগাই-মাধাই আচরণ করেন। সকলের চরণ ধরে প্রার্থনা করেন- “জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যত পাপ করেছি আপনার প্রতি, ক্ষমা চাইছি সবের জন্য। আপনি ক্ষমা করুন এই জীবাধমকে, এই পতিতকে। এ নরাধম ভিক্ষা মার্জনা চাইছে আপনার থেকে।” তাঁদের ক্রন্দন দেখে আর অনুরোধ শুনে ঘাটে আগত স্নানার্থীদের চোখেও জল এসে যেত। তাঁরাও নয়নাশ্রু ফেলে ক্ষমা করে দিতেন। আবেগে তাঁদের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যেত জগাই-মাধাইয়ের বিনয় দেখে।
প্রেমিক সুজন জগাই-মাধাই কঠোর থেকে কঠোরতম ভজনে মগ্ন হলেন। ব্রহ্মচারী বলে তাঁরা খ্যাত হলেন। তাঁরা কোদাল চালিয়ে মাটি কেটে গঙ্গার ঘাট বানালেন। এখনও সে স্থান দর্শন হয়। ‘মাধাইয়ের ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ সে ঘাট, নিত্যানন্দের করুণাগুণে তাঁরা চৈতন্যচরণ পেয়েছেন। গৌরাঙ্গের পতিত পাবন লীলার মহাপ্রমাণ হলেন তাঁরা। নিতাইয়ের কৃপাপাত্র এই দুই ভাগ্যবান ভ্রাতারা আসলে শ্রীনারায়ণের ধাম বৈকুন্ঠের দুই দ্বারপাল ‘জয়’ ও ‘বিজয়’। সনকাদি মুনির অভিশাপে দুর্বৃত্ত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরণীতে। “বৈকুন্ঠে দ্বারপালৌ যৌ জয়াদ্য বিজয়ান্তকৌ। তাবাদ্য জাতৌ স্বেচ্ছাতঃ শ্রীজগন্নাথ-মাধবৌ।” (গৌ.গ.দি.-১১৫)
নিত্যানন্দ চেয়েছিলেন প্রাকৃত মদ্যপান করে যেমন অস্পৃশ্যরা উন্মত্ত হয়, তেমন মদ্যপ জগাই-মাধাই প্রেমভক্তিসুধা পান করে পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হোক, কীর্তন করুক, নৃত্য করুক আবেশে, ভজন পরায়ণ হোক,সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হোক গৌরকৃপাপাত্র হবার——সে ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রকৃত অর্থেই। মহা ভাগবত, ভজনানন্দী হয়েই সারাটা জীবন কাটালেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দর্শনেই মানব পাপমুক্ত হত, কৃপা প্রাপ্ত হত।
ওহে প্রেমিকসুজন দুই ভ্রাতা ‘শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই’ , কৃপা করুন যাতে নিরবধি নিতাইচরণ চিন্তা করতে পারি, চৈতন্য কৃপার যোগ্য পাত্রী যেন হতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণে অনন্ত অর্বুদ কোটি প্রণাম এ জীবাধমার।
—– (সংকলিত), গ্রন্থ — ‘মহাপ্রভুর মধুময় কথা’, লেখিকা–রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক,

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

এক বিতর্কিত-বিগ্রহ কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

উত্তর ভারত থেকে পুরী যাওয়ার পথে প্রধান সড়কের ধারেই বিষ্ণুপুর অবস্থিত।ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকে এখানে মন্দিরের সংখ্যা ছিল ৩৬০টি।ফলে পুরী যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা এখানে আসতেন আর দেববিগ্রহের পূজা দিয়ে দক্ষিণা-প্রণামীও দিতেন। স্বভাবতঃই মন্দির গুলো থেকে আয় হত প্রচুর।বিষ্ণুপুরের আয়ের এক অন্যতম উৎস ছিল মন্দির। আর, দেববিগ্রহদের মধ্যে সবথেকে বেশী আকর্ষনীয় বিগ্রহ ছিল   শ্রীমদনমোহনদেব। মদনমোহন মন্দিরের  আয় ছিল বিষ্ণুপুরের সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এ তথ্য পাওয়া যায় ১৭৮৯সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা একটি চিঠিতে। চিঠিটি লিখেছিলেন  বীরভূমের সেইসময়ের কালেক্টর জী. কীটিংসয়ে’র এ্যাসিস্ট্যান্ট অন ডেপুটেশন–  এ. হেসিলরীজ। সেসময় বিষ্ণুপুরে অর্থাভাব চলছিল আর মদনমোহনদেব কলকাতার বাগবাজারে ছিলেন। হেসিলরীজ লিখেছিলেন–‘এই বিগ্রহকে যদি বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় , তবেই  সেখানকার সম্পদবৃদ্ধির সম্ভবনা আছে।’  অতএব, মদনমোহনদেবের নাম প্রাচীন বিষ্ণুপুরের অর্থনৈতিক  ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। আবার,  এক দেববিগ্রহকে নিয়ে রাজপরিবারে মামলা , বন্ধকী, ডিক্রী— এ ঘটনা ইতিহাসে আর নেই। তাই মদনমোহন বিগ্রহ বিষ্ণুপুরের রাজপ্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক দলিল স্বরূপ। বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে(?)—তাঁর বর্তমান অবস্থানকে কেন্দ্র করে বিতর্ক বা ধোঁয়াশা এখনও পর্যন্ত  মেটেনি বললেই চলে। সেইসাথে তাঁর নানান অবিশ্বাস্য অলৌকিক লীলা— সমস্তটা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় শ্রীমদনমোহনদেবের কাহিনী ভীষণ আকর্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর। আসুন, মদনমোহনকে নিয়ে ইতিহাসের সেই টানা-পোড়েন দৃশ্য একটু দেখার চেষ্টা করি।
ষোড়শ শতকে  বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের ৪৯তম রাজা ছিলেন বীর হাম্বীর বা হাম্বীর মল্ল । ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজত্ব শুরু করেন।তাঁর অধীনে ডাকাত বাহিনী থাকতো।পথচারীরা বিষ্ণুপুরের জঙ্গল পার করতে গেলেই এই সব ডাকাতরা দস্যুতা করে সব ছিনিয়ে নিত। তারপর সব সম্পদ বীর হাম্বীরকে দিয়ে দিত ।বদলে এদের ভরণপোষণের  ভার রাজা বহন করতেন। সেসময় এই ডাকাতদের জন্য পথচারীদের পক্ষে বনবিষ্ণুপুর পেরোনো রীতিমত ত্রাসের ব্যাপার ছিল।
“ঐছে দুষ্ট রাজা নাই ভারতভূমিতে ।
কেহ না পারয়ে এ পাপীরে দন্ড দিতে।।”
(ভক্তিরত্নাকর,৭/৭১)
বৃন্দাবন থেকে শ্রীরূপ-সনাতন,কবিরাজ গোস্বামী ও অন্যান্য গোস্বামীদের লিখিত গ্রন্থ নিয়ে গৌড় দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন শ্রীনিবাস , নরোত্তম ও শ্যামানন্দ প্রভু। উদ্দেশ্য গৌড়দেশে ভক্তি গ্রন্থ প্রচার করবেন। সকল গ্রন্থ পেটিকায়(বাক্স বা সিন্দুক) ভরে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ;সাথে দুজন পাহারাদারও রয়েছে।  জঙ্গলপথে বিষ্ণুপুরের ডাকাতদের নজরে পড়লো গো-শকট  আর তাতে যত্ন করে রাখা  পেটিকা। তারা পিছু নিল। রাতের বেলায় বিশ্রাম নিতে গাড়ি থামিয়ে যখন সকলে ঘুমোচ্ছে তখন  পেটিকা ডাকাতি করে পালিয়ে গেল ডাকাতরা। জমা দিল রাজকোষাগারে।পরদিন সকালে ডাকাতির দ্রব্য দেখতে রাজা এলেন।পেটিকা খোলা হল। সে কি !সোনা, রূপা, হীরে , জহরত কিছুই তো নেই ভেতরে। কেবল পুঁথি আর পুঁথি!  কিন্তু সোনা-রূপো না থাকলেও যা ছিল তা সোনার থেকেও মহিমায় অমূল্য রতন। রাধা-কৃষ্ণতত্ত্ব ,ভক্তিতত্ত্ব ,ভক্তিসিদ্ধান্ত সমৃদ্ধ মহাজন লিখিত গ্রন্থগুলো স্পর্শ  করা মাত্র লেখনীর দিব্য প্রভাবে যেন পরিবর্তিত হয়ে গেল দস্যুরাজা বীর হাম্বীরের হৃদয় ।
এদিকে সকালে শ্রীনিবাস আচার্যদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।সংবাদ গেল বৃন্দাবনে। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে লেখা মহাগ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’র পান্ডুলিপিও ছিল পেটিকায়। লেখক অশীতিপর বৃদ্ধ শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন যে তিনি জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করলেন । বিষ্ণুপুরে অনেক অন্বেষণ করেও যখন গ্রন্থপেটিকা পাওয়া গেল না তখন শ্রীনিবাস হতাশ শ্যামানন্দ ঠাকুর ও নরোত্তম ঠাকুরকে‌ তাঁদের নিজেদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন আর নিজে রয়ে গেলেন বিষ্ণুপুরে । মনে মনে ভাবলেন এক না একদিন কোন না কোনভাবে গ্রন্থের সুলুক সন্ধান তিনি পাবেনই পাবেন ।
দশ দিন কেটে গেল , অনেক অনুসন্ধান করেও কোন কিনারা করতে পারলেন না শ্রীনিবাস।  একটি গাছের তলায় ক্লান্ত,শ্রান্ত  হয়ে মলিন মনে বসে আছেন আর দুঃশ্চিন্তা করছেন। এমন সময় কৃষ্ণবল্লভ নামে এক ব্রাক্ষ্মণ কিশোর হাজির হল সেখানে। তার সঙ্গে আলাপ করে কথা প্রসঙ্গে বনবিষ্ণুপুরের রাজার আচরণ জানতে পারলেন শ্রীনিবাস। রাজা  রাতে দস্যুবৃত্তি করান আর দিনের বেলায় রাজসভায় শাস্ত্র আলোচনা করান — একথা জেনেই সেই কিশোরকে  তিনি বললেন, ” আমায় একদিন নিয়ে যেতে পারবে সেই সভায়?” কিশোর সানন্দে রাজী হয়ে মাথা নাড়ল। শ্রীনিবাস এলেন রাজসভায় শাস্ত্র ব্যাখ্যা শুনতে। ব্যাস চক্রবর্তী পুরাণ ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছিলেন।মনে মনে শ্রীনিবাস যা ভেবেছিলেন তাই হল। পন্ডিত এর ব্যাখ্যায় ভুল ছিল। শ্রীনিবাস ভুল ধরলেন  ।রাজা বীর হাম্বীর বলে বসলেন , “এত যখন সাহস দেখালেন , তাহলে এবার আপনিই ব্যাখ্যা করুন। শুনি সকলে।”  শ্রীনিবাস এটাই চাইছিলেন ,কারণ ,তিনি জানতেন কোনভাবে যদি রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে পারেন তবে রাজার হস্তক্ষেপে  গ্রন্থপেটিকা প্রাপ্তিতে সুবিধা হতে পারে। হলও তাই ।তিনি ভ্রমর গীতা শ্রবণ করালেন। তাঁর প্রেমভক্তি সমন্বিত অসাধারণ শাস্ত্র ব্যাখ্যায় , নিখুঁত বিশ্লেষণে সভায় উপস্থিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্রত্যেকের চোখে জল এল আবেগে, ভক্তিতে ।খুশি হয়ে পুরষ্কার ঘোষণা করতে চাইলেন রাজা, বললেন, ” আপনার যা চাই আমি তাই দেব , আর এবার থেকে আপনাকে  রোজ ভাগবত প্রবচন করতে হবে সভায়।” শ্রীনিবাস বললেন,” রাজামশাই আমার কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। আপনি যদি পারেন আমার অপহৃত  ধনের প্রাপ্তিতে একটু সাহায্য করুন ।” এই বলে সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাজা  বললেন ,”আপনি আসুন আমার সঙ্গে।” রাজকোষাগারে নিয়ে গেলেন  তাঁকে। বিস্মিত শ্রীনিবাস দেখলেন, যে গ্রন্থপেটিকার জন্য তিনি এতো অনুসন্ধান চালিয়ে চলেছেন হন্যে হয়ে,  তা সব রাজার কাছেই গচ্ছিত রয়েছে।  শ্রীনিবাস আচার্যকে গ্রন্থপেটিকা ফিরিয়ে  তো দিলেনই রাজা ,পরবর্তীতে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন তাঁর থেকে। বীর হাম্বীরের পত্নীর নাম  ‘সুলক্ষণা’  ও পুত্রের  নাম ছিল ‘ধাড়ীহাম্বীর’ ।পরম বৈষ্ণব হলেন সপরিবারে তাঁরা। বীর হাম্বীরের  সময় থেকেই বংশপরম্পরায় মল্ল রাজারা  বৈষ্ণব ভক্ত হলেন । তার আগে তো তাঁরা শাক্ত ছিলেন।বিষ্ণুপুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী  মৃন্ময়ীর যে মন্দির আমরা দেখতে পাই তা   ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজা জগৎমল্লই  নির্মাণ করে  দিয়েছিলেন ।  বীর হাম্বীর সমস্ত অসাধু কর্ম ত্যাগ করলেন । তিনি শ্রীকালাচাঁদ বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠা করালেন শ্রীনিবাস আচার্যের দ্বারা।
“হৈল বীর হাম্বীরের পরম উল্লাস।
শ্রীকালাচাঁদের সেবা করিলা প্রকাশ।।
রাজা বীর হাম্বিরের রাণী সুলক্ষণা।
আচার্য্য প্রভুরে কত করিলা প্রার্থনা।।
আচার্য্য প্রসন্ন হইয়া দীক্ষামন্ত্র দিলা।
পাইয়া যুগল মন্ত্র রাণী হর্ষ হৈলা।।”
(ভক্তিরত্নাকর, ৯/২৭০)
পরবর্তীতে রাজা বীর হাম্বীর বৈষ্ণব ধর্মের একজন পরম পৃষ্ঠপোষক হলেন। তিনি কালাচাঁদকে নিয়ে অপূর্ব পদ রচনা করেন, যেগুলি পদকল্পতরু’তে স্থান পেয়েছে। যখন নিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী শ্রীমতী জাহ্নবা ঠাকুরাণী বৃন্দাবনে কাম্যবনের গোপীনাথের জন্য রাধিকা মূর্তি নির্মাণ করিয়ে গৌড়দেশ থেকে বৃন্দাবনে পাঠান ,তখন সেই বিগ্রহের জন্য মূল্যবান অলংকার সামগ্রী, বস্ত্র, বাসনপত্র ও যাবতীয় উপঢৌকন সব এই বৈষ্ণব রাজা বীর হাম্বীরই  প্রদান করেছিলেন। বৃন্দাবনের আচার্য শ্রীল জীব গোস্বামীজী প্রসন্ন হয়ে তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন ‘চৈতন্য দাস’ ।
“শ্রীজীব গোস্বামী হইলা প্রসন্ন তোমারে ।
শ্রীচৈতন্য দাস নাম থুইল তোমার ।।”
( ভক্তিরত্নাকর, ৯,২০৫)
এই  বীর হাম্বীর রাজা একবার বৃষভানুপুরের বনে পথ হারিয়ে  ক্লান্ত ,অবসন্ন হয়ে সন্ধ্যাবেলায়  উপস্থিত হলেন এক কুটীরে। সে কুটীরে সাধনা করতেন এক তান্ত্রিক। তান্ত্রিকের কাছে পূজিত হতেন অপূর্ব দর্শন শ্রীমদনমোহন বিগ্রহ। বিগ্রহের   রূপমাধুরী দর্শন করা মাত্র রাজার  ইচ্ছা হলো সে বিগ্রহ নিজের কাছে রাখার । তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তান্ত্রিক ওই বিগ্রহ কোথায় পেয়েছেন। তান্ত্রিক জানালেন যে  ,বনবিষ্ণুপুরের বিল থেকে এক জেলেনীর জালে উঠেছিলেন বিগ্রহ । জেলেনী নিজে পূজার্চনার কিছু জানতেন না বলে তান্ত্রিককে সেটি দিয়ে দিয়েছিলেন পূজা করার জন্য।
বৃষভানুপুর থেকে কোন উপায়ে বীর হাম্বীর  সে বিগ্রহ রাজপ্রাসাদে উঠিয়ে আনলেন ।  এদিকে বিগ্রহ-হারা  তান্ত্রিক  লোক মারফৎ জানতে পারলেন যে, মদনমোহন রাজার কাছে আছে। তিনি বিগ্রহ ফেরত চাইতে রাজদরবারে আসলেন। কিন্তু, রাজা বললেন, “তোমার যত ধন সম্পত্তি  লাগে নিয়ে যাও,  ওই বিগ্রহ আমাকে দিয়ে দাও তুমি।” তান্ত্রিক রাজী  নন। তাঁর অন্য কিছু নয় , বিগ্রহই  লাগবে। কয়েকদিন পর ফেরৎ দেবেন এই বলে শেষে রাজা সময় চাইলেন। এক নকল বিগ্রহ গড়ালেন আর তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে বললেন তান্ত্রিককে।কিন্তু বিগ্রহকে বুকে লাগিয়ে তাঁর অঙ্গগন্ধ নিতেই তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন যে, সেই বিগ্রহ তাঁর নয়, নকল বিগ্রহ সেটি।  তিনি নিজের বিগ্রহ চাইলেন। রাজা বললেন, নিতে হলে ওই বিগ্রহই নিতে হবে, ওটিই আসল । শেষে অশ্রুপাত করতে করতে তান্ত্রিক বললেন ,”আজ আপনার দিন ভালো যাচ্ছে তাই আমায় এমন করে ফেরাতে পারলেন। একদিন এমন আসবে যখন আপনাদেরও এই বিগ্রহের জন্য কাঁদতে হবে, বলে গেলাম আমি।”
“মল্ল রাজাদের সময় ভালো হইতে সদয় ।
সময় গেলে কবে তারে দেখ কাঁদিতে হয়।।”
(মদনমোহন বন্দনা, অভয়পদ মল্লিক)
মদনমোহন রয়ে গেলেন রাজার কাছে। ভালোই থাকেন। ভক্ত রাজা  যত্ন করেন ,মন প্রাণ ঢেলে সেবার ব্যবস্থা করেছেন। রাজপুরোহিত  ধরণী মহাপাত্রকে   নিযুক্ত করলেন সেবার্চনার জন্য। মদনমোহনের জন্য  রাসমঞ্চ  নির্মাণ করিয়ে দিলেন । সেটা তখন ১৬০০খ্রিষ্টাব্দ।রাসমঞ্চের বিশাল বেদী।বেদীর ওপর মঞ্চ, চূড়া ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। চূড়ার শৈলী পিরামিডের মত।  ৩৫ফুট উঁচু ও ৮০ফুট চওড়া টেরাকোটার কারুকার্যে খোদিত এই অসামান্য রাসমঞ্চ পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। মূলতঃ বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার স্থাপত্য  বীর হাম্বীরের আমল থেকেই প্রসার লাভ করে । তাঁর অপর এক কীর্তি হল দলমাদল কামান স্থাপন।এই কামানও অতীব আশ্চর্য  দর্শণীয় বস্তু। কারণ, মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথর গলানো ,লোহা দিয়ে তৈরী  ২৯৬মণ ওজনের এই কামানে এখনো একবিন্দুও মরচে ধরেনি। কামানের নাম সম্ভবতঃ প্রথমে ছিল দোলমর্দন ( মর্দন অর্থাৎ দলন, শত্রু পীড়ন)  ।কালের অপভ্রংশে নাম হয় দলমাদল। তবে জনশ্রুতি বলে যে ,বীর হাম্বীর দল ও মাদল নামে দুটি কামান বসিয়েছিলেন। মাদল কামনটি বর্তমানে লালবাঁধে  জলের মধ্যে পড়ে আছে ,দেখতে পাওয়া যায় না। আর ,  যে কামানটি দেখা যায় সেটি হল  ‘দল’ কামান। যদিও সম্প্রতি কালে লালবাঁধ সংস্কার হলেও কোন কামান কিন্তু সেখানে দেখা যায় নি। এখন, এত বছরে জলকাদায় মাটির তলায় চাপা পড়ে গেছে কিনা সেটাই বা কে বলতে পারে। বিষ্ণুপুর মিউজিয়ামের  তত্ত্বাবধায়ক ঐতিহাসিক শ্রী তুষার সরকার জানালেন যে, ট্রেজারি বিল্ডিং-এ একটি কামান ছিল এতদিন ধরে , বর্তমানে বিষ্ণুপুর প্রশাসনিক ভবনের সামনে সেটি স্থাপন করা হয়েছে। এই কামানটির কোন ইতিহাস জানা যায় না । এই কামানটি ‘মাদল’ কামান হলেও হতে পারতো। কিন্তু, এটি আকারে অন্য কামানটির থেকে এতটাই ছোট যে সেটিও নিশ্চিত রূপে বলা সম্ভব নয়। অতএব, আলাদা করে মাদল কামান ছিল কিনা তা প্রশ্নবোধক।এই দলমাদল কামানের সঙ্গে মদনমোহনের এক অবিশ্বাস্য অলৌকিক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বীরহাম্বীর। বীর হাম্বীরের পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে  রাজা হন  ধাড়ী হাম্বীর, রঘুনাথ মল্লদেব,বীর সিংহদেবের পর দুর্জন সিংহদেব। এই রাজা দুর্জন সিংহদেব মদনমোহনদেবের জন্য  নির্মাণ করে দেন মন্দির। বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার   শ্রেষ্ঠ মন্দির এটিই। দৈর্ঘ্য ১২.২মিটার ও প্রস্থ ১০.৭মিটার।  মন্দিরের টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকার্যময় খিলান, দেওয়াল আজও বিস্ময়ান্বিত করে  দেশ-বিদেশের পর্যটক ও গবেষকদের। Archeological Survey of India (Kolkata circle)মন্দিরের বাইরে প্রশস্তিতে লিখেছে –‘এই মন্দিরটি ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ তৈরি করেন। বাংলা চালার ছাদে একটি শিখর বিশিষ্ট ইটের একরত্ন মন্দিরগুলির মধ্যে এটিই শ্রেষ্ঠ। মন্দির দেওয়ালের পোড়ামাটির অলঙ্করণও দেখার মত।’
প্রসঙ্গত, বীর হাম্বীরের পৌত্র রঘুনাথ মল্লদেবের  সময়  মল্লরাজারা মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে ‘সিংহ’ উপাধি পেয়েছিলেন।আর তাই, রঘুনাথের  পরবর্তী রাজাদের নামের পরে মল্লের পরিবর্তে ‘সিংহদেব’ যুক্ত হয়।

দুর্জন সিংহের পর দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহদেব , আর তারপর গোপাল সিংহদেব রাজা হন। গোপাল সিংহ ছিলেন কট্টর বৈষ্ণব। বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক রাজ্যবাসীকে সন্ধ্যেবেলায় হরি নামের মালা জপ করার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।এমনকি প্রজারা ঠিকঠাক মালা জপ করছে  কিনা ,তা পরীক্ষার জন্য গুপ্তচরও নিয়োগ করেছিলেন।  এদিকে বর্ধমানের বর্গী রাজা ভাস্কর রাও আক্রমণ চালাবার প্রস্তুতি শুরু করে দেন বৈষ্ণবরাজা গোপাল সিংহের নিরীহতার সুযোগ নিয়ে।
একদিন আচমকাই মধ্যরাতে মারাঠা বর্গীরা অতর্কিত হামলা করল বিষ্ণুপুরের ওপর। খবর আগে থাকতেই পেয়েছিলেন গোপাল সিংহ ।কিন্তু মদনমোহনের চরণে একান্ত শরণাগত ,আত্মনিবেদিত রাজা একটুও বিচলিত হলেন না‌। তিনি রাজ্যবাসীদের আদেশ দিলেন সকলে যেন সারা রাত ধরে হরিনাম করতে থাকে। কোন অস্ত্র কেউ ধরল না । প্রত্যেক সৈনিক পর্যন্ত হরিনাম নিতে থাকলেন আর রাজার নিজের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ , সারা রাত ধরে রাজ্যবাসী কামানের  গোলাবর্ষণের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শুনলেন। অনেকে তো ভয়ে মূর্ছিত হলেন কামানের ভীষণ শব্দে। পরে দেখা গেল যে  ৫২ হাজার বর্গী সেনার একজনও আর নেই । তাহলে গোলা বর্ষণ করল কে? কামান চালাল কে?
সকালে পুরোহিত গর্ভগৃহের দ্বার খুলে দেখেন বিগ্রহের  সারা গায়ে বারুদের দাগ আর পোড়া বারুদের গন্ধে ভরে মন্দির। এদিকে এক গোয়ালা এসে ধরলো রাজাকে ;নিবেদন করলো, ” রাজামশাই ,আপনার ছেলে দই খাওয়ার টাকা শোধ করুন ।সে বলেছে আপনার থেকে চেয়ে নিতে।” রাজা বললেন–“আমার ছেলে আবার কখন দই খেল, তা আবার তোমার থেকে?”  গোয়ালা বললো–‘আপনারই ছেলে তো! সিপাহির বেশ পরা, সারা গায়ে-মুখে কালি ঝুলি মাখা ।বারুদপোড়া গন্ধ কী তাঁর শরীর থেকে! নাম বলল বোধহয় মদনমোহন।” রাজার মূর্ছা যাবার উপক্রম হল শুনতেই।বললেন , “গোয়ালা তোমার যে কত সৌভাগ্য কী বলবো। তুমি সাক্ষাৎ বিষ্ণুপুরের ভগবানকে দর্শন করেছ আজ। তাঁকে দই খাইয়েছ! তুমি ধন্য।” আনন্দের আতিশয্যে পাগলপ্রায় দশা  তখন গোয়ালার।  ভগবানকে দেখেছে সে —- এ সৌভাগ্যের কথা  কাকে বলবে, কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ দেখা গেল তার দইয়ের হাঁড়িগুলো চকচক করে উঠলো , সোনার হয়ে গেল।রাজা গোপাল সিংহ আর ঠিক থাকতে পারলেন না ।তাঁর মদনমোহনের এতসব অলৌকিক কীর্তিকলাপ দেখে তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে গেলেন। আসলে, যাঁর চরণে সব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা , দায় তো সব, তাঁর ওপরই বর্তায় তখন ।তাই মদনমোহন নিজেই কামাল দেগে বর্গী তাড়িয়েছেন সারারাত ধরে। আর তখনই নাকি  যুদ্ধ শেষে মাদল কামানটি  জলে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
” লালবাঁধে দল-মাদল  দুটি কামান ছিল।
তার মধ্যে ৮০মণ বারুদ ভরিল।।
দুইটি কামান প্রভু লইলো দুই বগলে।
দুই হাতে দু-কামানে দিল পলতে জ্বেলে।।
এক কোপে বহু বর্গী  হইল নিধন‌।
কামানের শব্দে মূর্চ্ছা  গেল বহুজন।।”
(মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য, গাইড বুক)

ভক্তের বিপদের সময় ভগবান যে বিপদভঞ্জন হন, সে প্রমাণ দিলেন মদনমোহন। আর , তা জানাবার জন্যই মদনমোহন করেছিলেন দই খেয়ে পয়সা না দেবার লীলা। সেই গোয়ালার নাম ছিলো গোপাম মূরতি।
এখন, সময়টা ১৭৪৮ সাল। বিষ্ণুপুরের রাজসিংহাসনে রাজা গোপাল সিংহদেবের পর রাজা  চৈতন্য সিংহদেব বসেছেন। তিনিও ভক্তিমান  রাজা । এদিকে রাজপরিবারের অপর  সদস্য দামোদর সিংহদেব  সিংহাসন দখল করার  জন্য মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে হাত মেলালেন ।নবাব সাহায্য করলেন ।বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করলেন বাঁকুড়া ।কিন্তু ,লক্ষ্য পূরণ হলো না। জিততে পারলেন না ।  এরপর নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ১৭৫৬ সালে  পলাশীর যুদ্ধে হেরে প্রাণ হারান  ইংরেজদের হাতে। তিনিই ছিলেন   বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব।  সেসময় বাংলার প্রত্যেকটি রাজ্য ইংরেজের করদ্ রাজ্যে পরিণত হল। অর্থাৎ , রাজাদের সকলকেই ইংরেজদেরকে  খাজনা বা কর  দিতে হত। সামন্তরা ইংরেজের তোষামোদকারী  জমিদারে পরিণত হয়েছেন। আবার ইংরেজদের ছত্রছায়ায় সেসময়  উত্থান ঘটলো আরেক  নতুন গোষ্ঠীর….. তাঁরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ।

হাওড়া জেলার কোন্নগরে  বাস করতেন শ্রী সীতারাম মিত্র মহাশয়।  বর্গীদের প্রচণ্ড উৎপাত ,অত্যাচার মাঝেমধ্যেই হয় সেখানে । তাই সেখান থেকে মিত্র মহাশয়  চলে এলেন সুতানটি গ্রামে বা এখনকার কলকাতার বাগবাজারে । এখানে তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য। রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা।ফলে বর্গীদের উৎপাত ছিল না বললেই চলে । সীতারাম মিত্রের পুত্র  শ্রী গোকুলচন্দ্র মিত্রের ছিল লবণের ব্যবসা। বড় ব্যবসায়ী তিনি ,সেইসাথে অত্যন্ত দয়ালুও ছিলেন । তাঁর আমলে প্রত্যেকদিন হাজার জন অনাথ-আতুড় খাবার পেত। ব্যবসার সূত্রে গোকুল মিত্র কোন ভাবে পরিচিত ছিলেন রাজা চৈতন্য সিংহের সঙ্গে‌। চৈতন্য সিংহদেবের আমন্ত্রণে তিনি বেশ কয়েকবার বিষ্ণুপুর এসেছিলেন। যেবার তিনি  প্রথম দর্শন করেন মদনমোহনদেবকে , সেবারই দর্শন মাত্র মদনমোহনের প্রতি এক অপার্থিব টান অনুভব করেন। মন যেন চাইতে থাকল  মদনমোহনের সান্নিধ্য, তাঁকে সেবা করার সৌভাগ্য। হয়তো বা সে কারণেই গোকুল মিত্র একাধিকবার বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন ।
এক সময় চৈতন্য সিংহদেবের কিছু অর্থাভাব হয় ।গোকুলচন্দ্র বাড়িয়ে দেন  চৈতন্য সিংহদেবের দিকে সাহায্যের হাত। তিনি তিন লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন চৈতন্য সিংহকে‌। তবে গোকুল মিত্র শর্ত একটা রাখলেন যে যতদিন না টাকা ফেরৎ দিতে পারবেন চৈতন্য সিংহ ,ততদিন মদনমোহনদেবকে তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখতে হবে। অর্থাৎ কিনা বন্ধক রাখতে হবে । আসলে সেই যে মিত্র মহাশয়ের  মন বিকিয়ে গেছে  মদনমোহনের পদপঙ্কজে ,এখন এসুযোগে তিনি  নিজের কাছে মদনমোহনকে রেখে দিতে চান ,প্রাণভরে সেবা করতে চান কিছুদিন । আবার,ভক্তবৎসল ভগবান তো প্রেমের কাঙ্গাল চিরকালই। তাঁরও মন হয়েছিল  গোকুল মিত্রের প্রেমসেবা গ্রহণ করে তাঁকে সুখী করতে। ভক্ত যেমন  ভগবানকে সুখ দিতে চায় , ভগবানও তো তেমন তাঁর ভক্তকে সুখী দেখতে ভালোবাসেন। তাই হয়তো বা এমন পরিস্থিতি তৈরী হল।মন  একবিন্দুও না চাইলেও ভাগ্যের পরিহাসে চৈতন্য সিংহদেবকে  বাধ্য হয়ে কুলদেবতা মদনমোহনকে বন্ধক রাখতে হল গোকুল মিত্রের কাছে। রাজা আকুল হয়ে অশ্রু বিসর্জন করছেন দেখে ,  মদনমোহনদেব  সান্ত্বনার পরশ  দিলেন তাঁর প্রিয় চৈতন্য সিংহকে । তিনি পূর্ণ সায় জানালেন  তাঁকে বন্ধক রাখার জন্য।তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে  বন্ধক হয়ে গেলেন বাগবাজারে মদনমোহনদেব ।বাগবাজারে গোকুলধামের মন্দিরের ফলকে লেখা ১৭৬১ সালে শ্রীমদনমোহন জীউ স্থাপিত হয়েছেন। সম্ভবত, ঐ বছরেই বিষ্ণুপুর থেকে এখানে মদনমোহনদেবকে আনা হয়েছিল।
এদিকে এসময় থেকে মল্লরাজাদের সম্পদ ক্ষয় হতে শুরু করে দেয়, পতনের সূচনা হয় রাজত্বের।অভয়পদ মল্লিকের লেখা ‘History of Bishnupur Raj’-এ পাওয়া যায়– ‘ Thus  according to Babu Balindra Nath Singha of Indus , a scion of immediate cause of the decay and downfall were :–1) The Mahratta raids,
2) The famine of 1770,
3) The imposition of crusing land Tax by the     British Government and
4) Family dissensions
He also enumerated some indirect causes such as 5) the adoption of the Vaishnavas and 6) its corollary the construction of costly temples etc.অর্থাৎ, বর্গী বা  মারাঠাদের ক্রমাগত হানা, ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ, ব্রিটিশদের খাজনা আদায়, রাজবংশের অন্দরে কোন্দল, বৈষ্ণব ধর্মমত গ্রহণ করায় রাজার আচরণে নীরিহতা আর মন্দির নির্মাণে বহুব্যায় —- এসব কারণের দরুণ মল্ল রাজত্ব ক্ষয় এবং পতনের দিকে যেতে থাকে।
সেসময়  বর্গীরা যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে যেত সেখানকার সব শস্য তছনছ করে দিয়ে , ধানক্ষেত পুড়িয়ে দিয়ে প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে যেত নগর-গ্রাম।  ওদিকে চৈতন্য সিংহদেব আর দামোদর সিংহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল,যুদ্ধ।আবার দুর্ভিক্ষের সময়  অনাহারে ক্লীষ্ট প্রজাদের বাঁচাতে ধর্মপ্রাণ চৈতন্য সিংহদেব দু’হাতে শস্য ,সম্পদ বিলোতে থাকেন। ফলে রাজকোষাগার আকস্মিক ভাবে প্রায় খালি হয়ে যায়। ইংরেজদের কাছে খাজনা বাকী পড়তে থাকে। রাজ্য নিলামে ওঠার পরিস্থিতি তৈরী হয়।এই ভীষণ সংকট কালে অর্থ জোগাড় করে  মদনমোহন বিগ্রহ ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে চৈতন্য সিংহদেবের পক্ষে।

বাগবাজারে গোকুল মিত্র  প্রাণঢালা সেবাপূজা করেন বিগ্রহের।  আদরে-সোহাগে সুখেই আছেন মদনমোহন। গোকুলের বাল্যবিধবা কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়া নিজের পতিরূপে ভজনা করেন মদনমোহনকে।আর মদনমোহনও তাঁর প্রেমে বাঁধা পড়লেন ।একদিন রাত্রে লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে মদনমোহন নিজের চূড়া, বাঁশী খুলে রেখে গেলেন শয্যায় । পরদিন প্রভাতে পুজারীজী মদনমোহনের চূড়া -বাঁশী খুঁজে পাচ্ছেন না। চারদিকে খোঁজ খোঁজ রব। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে লক্ষ্মীপ্রিয়া দেখেন তাঁর শয্যায় তাঁর মাথার বালিশের ওপরে রাখা ওগুলো । এ লীলা দ্বারা মদনমোহন যেন বার্তা দিলেন যে তিনিও লক্ষ্মীপ্রিয়াকে নিজের পত্নীরূপে দেখেন , আর তাই রাত্রে শয়ণে যান লক্ষ্মীপ্রিয়ার কাছে।
আর একবার তো ভগবান নিজে সেবক ভৃত্য সেজে তাঁর ভক্তের সেবা করলেন ।গোকুল মিত্র  ভৃত্য মদনাকে ডেকে তামাক সাজিয়ে দিতে বললেন ।ঘটনাক্রমে মদনা সে সময় বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। আর গোকুল মিত্রের তামাক সেবনের সময় পেরিয়ে যেতে থাকলো। মদনমোহন করলেন কী, নিজে তামাক সাজিয়ে নিয়ে এসে গড়গড়ার নল এগিয়ে দিলেন গোকুল মিত্রের কাছে। গোকুল মিত্র মনের সুখে তামাক টানলেন। পরে মন্দিরের পূজারী দেখলেন মদনমোহন বিগ্রহের হাতে তামাক ও টীকার দাগ। আশ্চর্য হয়ে জানাতে গেলেন মিত্র মহাশয়কে। গোকুল মিত্র নিজে ছুটে এলেন সত্য কিনা পরীক্ষা করতে। সত্যিই তো! পরক্ষণেই মনে পড়লো তিনি তো তামাক দিতে বলেছিলেন ভৃত্য মদনা কে। খোঁজ নিয়ে জানলেন , মদনা তো তখন ভবনে ছিলেনই না, বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন কোন কাজে। বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে , সে তামাক কে সেজে এনেছিল আর কেনই বা ঠাকুরের হাতে অমন দাগ।মিত্র মহাশয় আদেশ দিলেন , আর কেউ যেন ভবনে তামাক সেবন না করে এবার থেকে।ভগবানকে ভৃত্য হতে হয়েছে যে কারণের জন্য, সেই কারণটাই তিনি নির্মূল করে দিতে চাইলেন।এভাবে  একের পর এক মধুর লীলা করতে থাকলেন মদনমোহনদেব বাগবাজারে গোকুল ভবনে।

এরপর একদিন চৈতন্য সিংহদেব এলেন তাঁর প্রাণের  বিগ্রহ ফেরৎ নিতে।  তখন সম্ভবত ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ । তিনি পরিবারের সকলের অলংকারের বদলে  টাকা জোগাড় করে বিগ্রহ নিতে এলেন। এদিকে গোকুল মিত্র এতদিনে ভীষণ ভাবে  মদনমোহনের প্রেমে পড়ে গেছেন। বিগ্রহ ছাড়া থাকতে পারবেন না তিনি। তাই ,তিনি টাকার বদলে বিগ্রহ দান করে দিতে  অনেক অনুরোধ-উপরোধ করলেন রাজাকে। কিন্তু, রাজী নন রাজা। শেষে গোকুল  ,ছলে-বলে-কৌশলে বিগ্রহ পাবার জন্য   ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হেস্টিংস সাহেবের কাছে চৈতন্য সিংহের বিরুদ্ধে সময়মত টাকা ফেরৎ না দেবার নালিশ জানিয়ে আরও অনেক টাকা দাবী করে বিগ্রহের নামে  ডিক্রী আদায় করলেন । অত  টাকা দিতে  অসমর্থ রাজা । আলিপুর  আদালতের একতরফা রায় গেল গোকুল মিত্রের দিকে। ব্যাস,  ডিক্রী হয়ে গেলেন বিগ্রহ । তবে থেকে গোকুল মিত্রের বরাবরের সম্পদ হলেন মদনমোহনদেব। তখন মদনমোহনদেব  রাজাকে আশ্বাস  দেন যে প্রতিদিন আরতি ও ভোগের সময় তিনি বিষ্ণুপুরে প্রকট থাকবেন। প্রথম বিষ্ণুপুরের ইতিহাস লেখক শ্রী  ফকির নারায়ণ কর্মকার  তাঁর ‘বিষ্ণুপুরের অমরকাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন , ‘ তাই নিজের ভাগ্যকে নিজে ধিক্কার দিয়ে সেই অপকৌশলের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁর প্রাণের ঠাকুরকে কলকাতার বাগবাজারে রেখে আসতে বাধ্য হন তিনি। শেষ হয়ে যায় চৈতন্য সিংহদেবের সব আশা ভরসা।বিবাদ বিসম্বাদের মধ্যেই তিনি যে মদনমহনকে ওখানে রেখে এসেছিলেন সেই কথাই সত্য।’  শ্রীমতী বন্দনা বিশ্বাস তাঁর ‘কথা ও কাহিনীতে বিষ্ণুপুর ‘- বইয়ে লিখেছেন—‘বিগ্রহ ফেরতের ব্যাপারে গোকুল মিত্র মোটা টাকা দাবী করলে রাজা অপারগ হন—ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়, অবশেষে আদালতে গোকুল মিত্রের এক তরফা ডিক্রীলাভ হয়। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় ৬০জন রাজা বিষ্ণুপুরে রাজত্ব করেছেন, কিন্তু এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি কখনো।’ ‘সাধু গোকুল মিত্রের জীবনী’-তেও  বলা হয়েছে মামলায় জিতেছিলেন গোকুল আর তাই আসল মদনমোহনদেব তাঁর কাছে থেকে যায় কোর্টের আদেশে ডিক্রি হয়ে। “বিচার মতে রাজার ঠাকুর গোকুল ডঙ্কা মেরে নিলা।” আবার এই জীবনী বইয়ে  বলা হয়েছে যে, গোকুল মিত্রই নাকি পূর্ব জন্মে ছিলেন সেই দইওয়ালা,যিনি সিপাহী মদনমোহনকে দই খাইয়েছিলেন। মদনমোহন যখন দইয়ের হাঁড়ি সোনার করে দিয়েছিলেন তখন দইওয়ালা বলেছিলেন, সেসবে তিনি ভুলবেন না, মরণকালে তাঁর মদনমোহনের অভয়চরণ প্রাপ্তি চাই।

“রাজা বলে ভয় নাই জমি দিব আমি।
কোনখানে খেলেন দৈ দেখাও দেখি তুমি।।
বকুলতলায় দৈ খেলেন গোয়ালা দেখাইলো।
গোয়ালার হাড়ি যত সোনা হয়ে গেল।
পায়ে ধরে গোয়ালা কান্দিতে লাগিল।
ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন দেখিতে পাইল।।
গোয়ালা বলে ভুলাও কি হে মদনমোহন ।
মরণকালে দিও প্রভু অভয়চরণ।।”

তবে কোন কোন বইয়ে কিন্তু গোকুল মিত্রের জিতে যাবার কথা লেখা নেই। হেরে যাবার কথা লেখা আছে।মদনমোহন বিগ্রহ  বাগবাজারে রয়েছেন এ কথা  বিষ্ণুপুরবাসীরা অনেকেই মানতে নারাজ। বিষ্ণুপুরে পাঁচালীর আকারে লেখা যেসব ভ্রমণ গাইড পুস্তিকা গুলো বিক্রী হয় , সেগুলোতে ঘটনা অন্য রকম লেখা।’মদনমোহন মাহাত্ম্য’ বইতে লেখা চৈতন্য সিংহ যখন তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে  কুলদেবতা মদনমোহনকে বাগবাজার থেকে আবার  বিষ্ণুপুরে ফিরিয়ে আনতে যান, তখন গোকুল মিত্র  বিগ্রহ ছাড়তে নারাজ। তিনি মিথ্যা দলিল দেখিয়ে জানালেন যে, মদনমোহন তো রাজা বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁর কাছে আগেই ।  রাজা মনের দুঃখে চোখের জল ফেলে ফিরে যাচ্ছিলেন , সেসময় তাঁকে স্বয়ং মদনমোহন আদেশ দেন ,”হতাশ না হয়ে বরং আলিপুর কোর্টে গোকুল মিত্রের বিরুদ্ধে মামলা করো। তোমার হয়ে আমি পাগড়ী পরা উকিল সেজে সওয়াল-জবাব করবো।”  মদনমোহনের পরামর্শ মতো রাজা আপিল করলেন আদালতে ।বিচারের দিন মদনমোহন এসে দাঁড়ালেন উকিলের বেশে ।ম্যাজিস্ট্রেট নাম জিজ্ঞাসা করলে উকিল বলেন যে , তাঁর নাম মদন আর বিষ্ণুপুরের রাজার অধীনে তিনি বেতনভুক কর্মচারী। উকিল মদনের ক্ষুরধার প্রশ্নের সামনে অপ্রস্তুত , অপারগ গোকুল মিত্র হেরে গেলেন। কোর্ট আদেশ দিল বিগ্রহ ফিরিয়ে দিতে ।
গোকুল মিত্র একই রকম দেখতে একটি নকল বিগ্রহ তুলে দিলেন রাজার হাতে। চিনতে না পেরে নকল বিগ্রহ নিয়েই ফিরলেন রাজা। কিন্তু নদীর ধার থেকে এক বালক জোরে হেঁকে বলে যে , ” রাজা , তুমি তো নকল বিগ্রহ নিয়ে ফিরে যাচ্ছো।” সে বালক নাকি  স্বয়ং মদনমোহনই ছিলেন। রাজার টনক নড়লো। আসল মদনমোহন ফেরত নিতে আবার এলেন বাগবাজার।অভিযোগ জানালেন । গোকুল মিত্র বললেন,” আপনি বরং এক কাজ করুন। পাশাপাশি তিনটি বিগ্রহ রাখা হবে। চিনে নিয়ে আপনারটি আপনি নিয়ে যান।  আমার কোন আপত্তি নেই ,সবেতেই রাজী।” তিনটিই এক রকম দেখতে।’মদনমোহন মাহাত্ম্য কথা’-য় বলা হয়েছে এসময় মদনমোহনই নাকি  উপদেশ করেন, “যে বিগ্রহের বামাঙ্গ ভিজে থাকবে ও নাকের ওপর সাদা মাছি বসে থাকবে সেটি আমি ।” ঘটলও তাই। রাজা আসল বিগ্রহকে তুলে নিলেন। মদনমোহনদেব  ফিরে এলেন বিষ্ণুপুর। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে সেবাপূজা শুরু হল মদনমোহনের আবার‌। বিষ্ণুপুরের মত অনুযায়ী, যখন মদনমোহন চলে আসেন কলকাতা ছেড়ে, তখন তিনি গোকুল মিত্রকে  কথা দিয়েছিলেন এই বলে ,”ওহে গোকুল,  তুমি কেঁদো না। প্রতিবছর অন্নকূট উৎসবের সময় আমি তোমার কাছে বারো দন্ড থাকবো কথা দিচ্ছি ।”
কুলদেবতাকে কেন্দ্র করে বিষ্ণুপুরে মহোৎসাহে শুরু হল দোলযাত্রা, ঝুলন উৎসব ,রাসউৎসব ইত্যাদি।বিষ্ণুপুর পূর্ণ হল হর্ষে-আনন্দে।  ১৮০২খ্রিষ্টাব্দে চৈতন্য সিংহদেবের মৃত্যু হয় ।  তার আগের বছর অর্থাৎ ১৮০১-এ তিনি পৌত্র মাধব সিংহকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন।বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা তথা  মল্লরাজাদের রাজপুরোহিত বংশের বিশিষ্টজন শ্রী মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র জানালেন, বিতর্ক এড়াতে অনেক লেখকই আসল ঘটনা না জেনে , অনুমান ভিত্তিক লিখেছেন। ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। তিনি বলেন , তাঁদের পূর্বপুরুষরা বলতেন যে আসল মদনমোহন বিষ্ণুপুরে ফেরৎ আসেন। বিষ্ণুপুরেই নাকি  বিরাজ করছেন তিনি। (এ প্রবন্ধ লেখায়  অনেক তথ্য ও  ছবি দিয়ে সাহায্য করেছেন  মৃত্যুঞ্জয় মহাশয়। )

বাগবাজারে গোকুল মিত্র  মদনমোহনদেবের পাশে রাধিকার এবং ললিতা-বিশাখার বিগ্রহদের স্থাপন করলেন রাস উৎসবের সময় । সেরাত্রে আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার  জীবনাবসান হল। বলা হয় যে , শ্রীরাধা বিগ্রহের মধ্যেই নাকি গোকুল মিত্রের কন্যার আত্মা বিরাজিত রয়েছে।
মদনমোহনদেবের  জন্য বড় মন্দির ,  রাসমঞ্চ,ঝুলনমঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন গোকুল মিত্র।  সমস্ত সম্পত্তি তিনি  তাঁর জামাই শ্রীমদনমোহনদেবের নামে করে দিয়েছেন ,যাতে তাঁর অবর্তমানে মদনমোহনের সেবা পূজায় কোন বিঘ্ন না ঘটে। এখনও পর্যন্ত উত্তর কলকাতা চিৎপুর রোডে রাজবল্লভ পাড়ায় গোকুল মিত্র লেনে মদনমোহন তলা নামে সুপ্রসিদ্ধ মদনমোহন মন্দির এলাকা ।গোকুলধাম নামে বিখ্যাত সেই সুবিশাল মন্দির। রাজবল্লভ পাড়ার মোড়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী বাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ডানদিকে মন্দির পরে ।মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেই বাঁ দিকে বিশাল চওড়া শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে  দোতলায় উঠে যেতে হয়। সেটি দর্শনার্থীদের ব্যবহারের জন্য সিঁড়ি। উপরে দোতালাতে অবস্থান করেন শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব। আর যদি সিঁড়িতে  না উঠে প্রবেশদ্বার দিয়ে সোজা এগিয়ে আসা হয় , তবে নাটমন্দির চোখে পড়ে। এখানে মদনমোহনদেবের জন্য নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। এই  চত্বরেই প্রতিদিন আগে অনাথ-আতুরদের প্রসাদ ভোজন করানো হত।নাটমন্দিরকে ঘিরে আঙ্গিনার ওপারে তিনদিকে ঠাকুর বাড়ীর দালান।একদিকে ভোগের রন্ধনশালা ,আর একদিকে মন্দিরের অফিসঘর ,এসব । আর নাটমন্দিরের ডানদিকটার পুরোটা জুড়ে বিশাল  ঝুলনমন্দির। মার্বেল বাঁধানো ঝুলন মঞ্চ।  মঞ্চের মধ্যে  দোলনা সিংহাসন।ঝুলনের সময় এখানেই ঝুলন উৎসব হয় বড় করে।
উপরে  দোতলায় মদনমোহনদেবের রাজত্ব । সিঁড়ি দিয়ে উঠেই  ডানদিকে দরবার হল তাঁর। দরবার হলের শেষপ্রান্তে সিংহাসনে শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন বিরাজ করছেন । সাথে আছেন ললিতা-বিশাখা সখীর বিগ্রহ, শালগ্রাম শিলা আর ছোট্ট গোপালসোনা। নিরাপত্তার কারণে  ব্যবধান দেওয়া লোহার গ্রিলের । সব মন্দিরে যেখানে বিগ্রহ অবস্থান করেন সেখানে সামনেই ভোগ লাগানো হয় , মদনমোহনের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয় । তাঁর ভোগের ঘর আলাদা, বিশ্রামের ঘরও আলাদা।ভোগের সময় সিংহাসন থেকে নেমে যান ভোগমন্দিরে। সেখানে ভোজন করে আসেন বিশ্রাম কক্ষে। বারান্দা পার করে বিশ্রাম ঘর। বিশ্রাম করার পর এখানেই তাঁকে শৃঙ্গার করানো হয় ।নতুন সাজে সজ্জিত  হলে আবার প্রবেশ করেন দরবার হলে। সিংহাসনে আরোহন করেন এরপর।আর, তিনি কখনও ফেরৎ যাত্রা করেন না অর্থাৎ একমুখী হয়ে গমন করেন সবসময়,একই পথে উল্টো দিকে হাঁটেন  না।
দোতালায় অপরদিকে  ভাঁড়ার-ঘর(স্টোর রুম)। এত বড়  ভাঁড়ার ঘর সমগ্র কলকাতায় আর নাকি নেই। তারপাশে অতিথিদের  থাকার ঘর । এরপরে আবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামা। সেই সিঁড়ি দিয়ে মদনমোহন নামেন ঝুলনের সময় , রাসের সময়।  মন্দির থেকে  বেড়িয়ে বাঁ দিকে আরো একটু এগিয়ে গেলেই রাস্তার ওপরে পাকা রাসমঞ্চ তৈরী আছে। ।রাসের সময় উৎসব হয় । বিগ্রহদের নিয়ে যাওয়া হয় তখন সেখানে। এছাড়া  সারা বছরই উৎসব হয় গোকুলধামে। বড় করে পালিত হয়  অন্নকূট উৎসব। অন্নকূটে নীচে একতলায় ভক্তরা কাপড় পেতে ধরেন আর ওপরের দোতলার বারান্দা থেকে মদনমোহনদেবের অমৃতপ্রসাদ ফেলা হয় ।ভক্তরা আকুলতাসহ হুড়োহুড়ি করে সংগ্রহ করেন প্রতিটি কণা প্রসাদের।
বর্তমানে বাগবাজারে মদনমোহনদেবের পালাদার সেবাইত হলেন শ্রী মাধবমিত্র। ১৫ই এপ্রিল ,২০১৯ থেকে ১৩ই এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত মদনমোহনের সেবার ভার তাঁর। আর , বিগ্রহ অর্চন-বন্দন-পূজার ভার শ্রী সুব্রত পূজারী মহাশয়ের ওপর। তিনি হলেন ধরণী মহাপাত্রের সপ্তম অধস্তন পুরুষ। মল্লরাজারা ‘পূজারী’ উপাধি দিয়েছিলেন তাঁদের।  পূজারী মহাশয়  জানালেন , যখন মদনমোহন বাগবাজারে চলে আসেন, তখন তাঁর পূর্বপুরুষরাও  বিষ্ণুপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন মদনমোহনদেবের সেবা করবেন বলে। সেই প্রথম দিন থেকে তাঁদের বংশের পূজারীরাই মদনমোহনদেবের পূজার্চনার দায়িত্বে। মদনমোহনই নাকি স্বয়ং গোকুল  মিত্র কে আদেশ দিয়েছিলেন কেবল এই বংশের হাতেই তিনি পূজা নেবেন। ফকির নারায়ণের লেখাতেও একই কথা পেলাম–‘ মিত্র মহাশয়ের প্রতি স্বপ্নাদেশ হয়। স্বপ্নে  মদনমোহন তাঁকে বলেন ,”আমার সেবাইত, পুরোহিত ব্যতীত অপরের হাতে সেবা-পূজা নিয়ে আমার তৃপ্তি হয় না ।তাদের অভাবে আমি উপবাসী আছি। আমার স্বপ্নাদেশের কথা রাজাকে জানিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আয়‌। নইলে এইরকম উপবাসী অবস্থাতেই আমাকে দিন কাটাতে হবে।”…. সবকিছু শুনে রাজা কাঁদতে থাকেন। দ্বিরুক্তি করেন না ।সেবাইত, পুরোহিতকে পাঠিয়ে দেন তাঁদের সঙ্গে‌।’
সুব্রত পূজারী মহাশয় জানালেন, বাগবাজারের বিগ্রহই আসল মদনমোহন। তিনটি বিগ্রহের অবশিষ্ট বিগ্রহটি বর্তমানে তাঁদের ব়ংশে রয়েছেন। এখনও নানান অলৌকিক লীলা করেন মদনমোহন। দিনে-দুপুরে-রাত্রে মদনমোহনের  চলার নূপুরের ধ্বনি শোনা যায় , হঠাৎ  ম-ম করে ওঠে তাঁর অঙ্গগন্ধ  নির্জন বারান্দায়।
শ্রীমদনমোহনের অলৌকিক লীলা নিয়ে প্রচুর বই প্রকাশ হয়েছে । সেগুলির কোন কোনটি বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা বা বিষ্ণুপুর রাজবংশের ঘনিষ্ঠ কবিরা লিখেছেন , আবার কোনটা রচনা করেছেন গোকুল মিত্রের দিকের কবিরা। তাই সেসব লেখাতে পক্ষপাতিত্বের একটা ব্যাপার  লক্ষ্য করা যায় । মূল বিগ্রহ যে প্রকৃত কোথায় অবস্থিত, বাগবাজারে নাকি বিষ্ণুপুরে এটা নিয়ে একটা চোরা দ্বন্দ এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে।বিষ্ণুপুর থেকে বলা হয় মদনমোহনদেব বিরাজ করছেন বিষ্ণুপুরেই। আর,বাগবাজার থেকে বলা হয় মূলবিগ্রহ রয়েছেন বাগবাজারে। তবে হ্যাঁ , বর্তমানে মদনমোহন যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, তিনি যে দল-মাদল কামান দেগেছেন আর গোকুল মিত্রের কাছে তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে বন্ধক ছিলেন এ কথা কিন্তু সত্য—–প্রতিটি গ্রন্থেই স্বীকৃত হয়েছে । ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’গ্রন্থে ড. সুকুমার সেন লিখেছেন –“অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় দেবদেবী ,ব্যক্তি বা ঘটনা বিশেষ ও দৈব-দুর্বিপাক লইয়া ছড়া গান রচিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি আমাদের হস্তগত হইবার পূর্বেই লুপ্ত হইয়াগিয়াছে ।…..একাধিক কবি রচিত মদনমোহন বন্দনা  পাওয়া গিয়াছে। ইহার বর্ণনীয় বিষয় হইতেছে  মদনমোহন কর্তৃক দল-মাদল কামান দাগিয়া বিষ্ণুপুর হইতে বর্গী বিতরণ এবং চৈতন্য সিংহ কর্তৃক কলিকাতায় গোকুল মিত্রের  নিকট মদনমোহন বিগ্রহ বন্ধক রাখা।”
মদনমোহন সর্বদা তাঁর ভক্তের সঙ্গে থেকেছেন সেবক রূপে, ভৃত্য রূপে, বন্ধু রূপে ।তা সে বিষ্ণুপুরের ভক্তিমান রাজা গোপাল সিংহ ,চৈতন্য সিংহই হন বা বাগবাজারের ধনাঢ্য ,দানবীর ,ভক্তমহাজন গোকুল মিত্রই হন না কেন। ভগবান যে তাঁর ভক্তের পরম সুহৃদ, পরম বান্ধব, পরম হিতৈষীজন এই সত্য সংস্থাপিত হয়েছে বারে বারে ,নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ মদনমোহনদেবের নানান অলৌকিক লীলায়।
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলতেন , কিছু চাইতে হলে তিন জনার কাছে চাইতে হয়–দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী, খড়দহের শ্যামসুন্দর আর বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের কাছে।
মদনমোহনদেবের অলৌকিক কাহিনী শুনে, তাঁর মনোলোভা চিতচোর সৌন্দর্যের কথা জেনে এখনও পর্যন্ত ভক্তরা তাঁকে দর্শন করতে ছুটে যান কলকাতার বাগবাজারে আর  বিষ্ণুপুরের মন্দিরে। আসল বিগ্রহ যেখানেই থাকুন না কেন , উভয় স্থানে গিয়েই ভক্তরা অনুভব করতে পারেন শ্রীশ্রীমদনমোহনদেবের উপস্থিতির  আবেশ ও  তাঁর লীলার দিব্য অনুভূতি। আসলে, ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে ভগবান যে সকল স্থানেই প্রকট হতে একান্ত ভাবে ভালোবাসেন….. তাঁর অবস্থিতি তো সর্বস্থানে!
জয় শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনদেব।

সমাপ্ত

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

শান্তিপুরের শ্রীশ্যামসুন্দরের অলৌকিক লীলামাধুরী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

আহা ! শান্তিপুরের আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির শ্রীশ্যামসুন্দরের যেমন চিত্তাকর্ষক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য তেমনই তাঁর অপূর্ব সব লীলা । পুত্র যেমন পিতার কাছে আবদার করে, বায়না করে তেমনভাবেই শ্যামসুন্দর নিত্য জাগ্রত বিগ্রহ রূপে করেছেন এটা-সেটার দাবি। কখনো শ্রীআনন্দকিশোর গোস্বামীর কাছে কখনও বা শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের কাছে। প্রসঙ্গতঃ জানাই , আনন্দকিশোর গোস্বামী ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীপাদের পিতাপ্রভু ।

অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র শ্রীদেবকীনন্দন ছিলেন আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরজীউ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হন স্বয়ং অদ্বৈত, তাঁর পুত্র বলরাম এবং পৌত্র দেবকীনন্দন— তিনজনের দ্বারা মিলিত ভাবে। দেবকীনন্দন নির্দেশিত নিয়ম মেনেই এখনও সেবাপূজা চলে। বিশ্ববিশ্রুত সিদ্ধ মহাপুরুষ ,প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই বংশেই জন্মগ্রহণ করেন‌ বলে এই বাটীকে ‘বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাটী’-ও বলা হয়।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তখনও ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করেননি। মনে-প্রাণে তিনি ভীষণ ভাবে ব্রাহ্মধর্মে বুঁদ হয়ে আছেন । কলকাতাতে থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার চালাচ্ছেন জোরকদমে । মাঝে মধ্যে শান্তিপুরে যান । আর যখনই শান্তিপুরে যান তখনই শ্যামসুন্দর তাঁর সম্মুখে প্রকট হন। প্রেমচাহিদার যেন শেষ নেই বিজয়কৃষ্ণের কাছে শ্যামসুন্দরের । ওদিকে ব্রাহ্ম বিজয়কৃষ্ণ নীতিগতভাবে মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী থাকলেও , কোন অজ্ঞাত কারণে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ , টান অনুভব করেন শ্যামসুন্দরের প্রতি। আর , তাই শ্যামসুন্দরের আবদারও মিটিয়ে চলেন একের পর এক।

একবার নটখট্ শ্যামসুন্দর বললেন , “শোন বিজয় ! আমার দেখ না বাঁশি নেই ! একটা বাঁশী বানিয়ে দে না !” এমন ভাবে শ্যামসুন্দর বললেন, যে বুকে গিয়ে বাজলো বিজয়কৃষ্ণের সে কথা । তিনি বাংলাদেশের ঢাকাতে অর্ডার দিয়ে খুব সুন্দর একটি বাঁশি প্রস্তুত করিয়ে দিলেন। বাঁশি পেয়ে বড় আনন্দ পেলেন বিগ্রহ শ্যাম।

আবার একবার শ্যামসুন্দর বললেন , “বাঁশী তো দিলি , এবার চূড়াটাও গড়িয়ে দে। বাঁশি-চূড়া না থাকলে কী সাজ সম্পূর্ণ হয়, বল !” শ্যামসুন্দরের বলার ঢঙে হেসে ফেললেন বিজয়কৃষ্ণ । মনটা কোমল হয়ে গেল যেন । স্নেহব্যথা পেলেন চিনচিনে এক । তিনি পরদিনই ঢাকায় সংবাদ পাঠিয়ে চূড়ার অর্ডার দিলেন । বেশকিছুদিন পর ঢাকা থেকে এল চূড়া । বাঁশি আর চূড়ার সাজে শ্যামসুন্দরের সুন্দর সাজ এমন সুন্দর হল যে নয়ন ফেরানো যায় না । কিন্তু, না , শ্যামসুন্দরের মনের ইচ্ছা অন্য । তিনি বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ নিয়ে হাজির । অনুযোগের সুরে বললেন , “চূড়া তো দিলি , ভালো হয়েছে। কিন্তু , আমার মনোমতো হয়নি।” বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “কেন , কি রকম হলে তোমার মনোমতো হবে শুনি !” শ্যামসুন্দর বায়নার মত করে বললেন , “আমার সোনার চূড়া চাই। রূপার চূড়া নেব না ।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন অবাক হয়ে, “সে কী কথা ! আমি সোনার চূড়া কোথায় পাবো ! অত টাকা আছে নাকি আমার !কোথায় পাব টাকা !” শ্যামসুন্দর বললেন, “রাঙ্গা ঠাকুরাণীর অনেক টাকা আছে, জানিস তো ! তুই আমার নাম করে বল , দেখবি টাকা দেবে ।”

রাঙ্গা ঠাকুরাণী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাকিমা ছিলেন । তাঁকে বিজয়কৃষ্ণ সব জানালেন । তিনি শুনেই আনন্দে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না । শ্যামসুন্দরের মুখে তাঁর নাম ! শ্যামসুন্দর নিজে যেচে তাঁর থেকে সেবা নিতে চেয়েছেন । এমন সৌভাগ্যও তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো, আহা ! পুলকিত , রোমাঞ্চিত হলেন তিনি । অতি শীঘ্র টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন বিজয়কৃষ্ণকে । সে টাকা থেকে রূপোর চূড়ায় সোনার পাত বসিয়ে সোনার চূড়া বানানো হল। অপূর্ব দর্শন রূপোর বাঁশি আর সোনার চূড়ায় সেজে শ্যামসুন্দরের যে মনোহারী, মনাকর্ষক , মুগ্ধকর সাজ হল তা ভাষায় বর্ণনার অতীত । তিনি নিজেও অনুধাবন করলেন যে , এরূপ দেখলে বিজয়কৃষ্ণও তাঁর প্রেমে পরে যাবেন । তাইতো বিজয়কৃষ্ণের কাছে এবার বললেন, “হ্যাঁ রে, দিলি তো চূড়া-বাঁশী । এবার একটু দেখবি না আমায় এসব পরে কেমন লাগছে ! যা, মন্দিরে যা, দেখ আমায়।”

বিজয়কৃষ্ণ বললেন, “বা-রে ! আমি না ব্রাহ্ম! মন্দির-টন্দিরে আমায় যেতে নেই জানো না ! ওসব দেখতে নেই।”

শ্যামসুন্দর—”তাতে কী ! ব্রাহ্ম না হয় হলিই। দেখতে দোষ কী । আর ব্রাহ্ম তো তুই আমার ইচ্ছেতেই হয়েছিস । আমিই বানিয়েছি ব্রাহ্ম তোকে।”

শ্যামসুন্দরের কথা শুনে বিজয়কৃষ্ণ চুপ করে রইলেন । পরে একসময় মন্দিরে গিয়ে দর্শন করে এলেন শ্যামসুন্দরকে। সত্যিই শ্যামসুন্দরের সৌন্দর্য দর্শনে মন যেন কেমন করে উঠল তাঁর।বোধহয় ইচ্ছে হল একবারটি নিজের কোলে করার, বক্ষে ধরে নেওয়ার ; শ্যামসুন্দরের ওই রাতুল চরণে মস্তক স্পর্শ করাতে ইচ্ছে হল আত্মনিবেদনের ভাব নিয়ে।

ঠিক এমনই ঘটনা আবারও একদিন হল। বিজয়কৃষ্ণের মনে হল যেন কেউ নূপুর পরে হাঁটছে। তিনি বেরিয়ে এলেন । নূপুরের ধ্বনি যেদিকে, সেদিকে এগিয়ে গেলেন। মনে তাঁর দোলা দিয়েছে, এ ধ্বনি শ্যামসুন্দরের চরণের নূপুরের না তো ! কারণ, মাঝেমধ্যেই তিনি শ্যামসুন্দরের নিক্কণের ধ্বনি পান। তাঁর পিতা-মাতা বা পরিবারের অনেকেই পান । শ্যামসুন্দর নিজের উপস্থিতি জানান দেন এভাবে। তাই আজ বিজয়কৃষ্ণ নূপুরের ধ্বনি শুনেই কোন যেন অমোঘ টানে চলে গেলেন শ্যামসুন্দরকে দেখবেন বলে বা ধরবেন বলেই হয়তো বা ।

হ্যাঁ , শ্যামসুন্দরও আজ যেন বিজয়কৃষ্ণের জন্যই রূপের ফাঁদ পেতেছেন । বিজয়কৃষ্ণ দেখলেন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে শ্যামসুন্দর । দুষ্টুমির ঝলক তাঁর আখির প্রান্তে । তাঁর রূপ দেখে বিজয়কৃষ্ণ ক্ষণিকের জন্য বিহবল হয়ে গেলেন। আর অন্তর্যামীর দেরী হল না অন্তর পড়তে বিজয়কৃষ্ণের । বিদ্যুতের ঝলকের থেকেও তাঁর অনুধাবন ক্ষমতা অতি তীব্র, অতি দ্রুত যে। তখন শ্যামসুন্দরের মনের ভাবখানা এমন যে কেমন ফাঁদ পেতেছি আমি, দেখলি তো ! কেমন ধরা পড়লি সে ফাঁদে, বল ! আর সেকারণেই ছিল দুষ্টুমির ঝলক নট্‌খট্‌ নওলকিশোর শ্যামসুন্দরের নয়নের কোনায়। কন্ঠে তিনি দুষ্টুমির সুর করে বললেন, “ বল তো , এবার আমায় কেমন দেখছিস ?” স্বগোতক্তির ন্যায় বিজয়কৃষ্ণের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “অতি সুন্দর তুমি।” পরক্ষণেই বিজয়কৃষ্ণের একটা কথা মনে এল, তিনি বলে ফেললেন তা আপনমনে —-”আচ্ছা, একটা কথা বলো তো ! আমায় দর্শন দিয়ে এত কৃপা করার ইচ্ছে যখন তোমার , তাহলে কেন এমন করে ব্রাহ্ম করলে আমায়?”

শ্যামসুন্দর আকর্ণ-বিস্তৃত মধুময় হাসি হেসে বললেন, “জানিস, অলংকার ভেঙ্গে আবার গড়ালে আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয় তা।” বিজয়কৃষ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেলেন এ উত্তর পেয়ে । শ্যামসুন্দরও অন্তর্ধান করলেন সেই মুহূর্তেই , আসল কাজ করা হয়ে গেছে এই মন নিয়ে।

শ্যামসুন্দর নিজের প্রিয় পাত্র বিজয়কৃষ্ণের কাছে অভিযোগও করতেন । একবার পূজারী ভোগের সময় জল দিতে ভুলে গেলেন। শ্যামসুন্দর বাচ্চা ছেলেদের মতো এসে বিজয়কৃষ্ণকে বললেন, “দেখ বিজয়, তোদের পূজারী কেমন ! মধ্যাহ্নভোগে পারস করেছে আর জল দিতে ভুলে গেছে । বলতো খেতে বসে জল না দিলে হয় !” তখন বিজয়কৃষ্ণ পূজারীকে খানিকটা তিরস্কার করেই ঘটনা জানালেন সব। আর যেন এমন ভুল না হয় সাবধান করলেন।

আবার অন্য একটা দিনের কথাও জানাই । মন্দিরে চুরি করল এক চোর । শ্রীরাধারাণীর মুকুটটি বড় ভালো লাগায় হয়তো বা লোভ সামলাতে না পেরে সেটি নিয়ে গেল। তবে পরে নিজের ভুল বুঝে অনুতাপানলে জ্বলে ফেরত দিতে চাইলো । কিন্তু, আর তো উপায় নেই গর্ভমন্দিরে ঢুকে রাধারাণীর মস্তকে মুকুট পরিয়ে দেবার । ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে । তাই করলো কী , মুকুটটি মন্দির চত্বরেই একটু আড়াল করা স্থানে ফেলে গেল। মুকুটের খোঁজ চলছে এদিকে । পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই । তখন শ্যামসুন্দরের শ্রীরাধিকা বিজয়কৃষ্ণের কাছে প্রকাশিত হলেন । সে সময় আসনে বসে ধ্যান করছেন বিজয়কৃষ্ণ। শ্রীরাধিকা মুকুটের অবস্থান বলে দিলেন । বিজয়কৃষ্ণ তা সকলকে জানালেন। সত্যিই সে স্থানে পাওয়া গেল মুকুট।

ভক্তিপূর্ণ প্রণাম পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করি এহেনো সুন্দরের সুন্দর শ্যামসুন্দর বিগ্রহকে ও যাঁর সঙ্গে তিনি এমন মধুময় লীলা করেছেন সেই শ্রদ্ধেয় প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

নিত্যানন্দ এয়োদশী কেন এত মহিমাময় ? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

বঙ্গদেশের বেশিরভাগ রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের দু’পাশে আমরা দু’বাহু উর্দ্ধে প্রসারিত করা নিতাই-গৌরের মূর্তি দেখতে পাই । প্রায় সকলেই জানি গৌর  অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব। কিন্তু নিতাই  বলতে বুঝি গৌরের দাদা বা ভাই স্থানীয় কোন বিশেষজন। কারণ, প্রচলিত প্রবাদ বাক্য প্রায় সকলেরই জানা– “নিতাই-গৌর দুই ভাই , হল এক ঠাঁই।”  যদি প্রশ্ন করা হয় , আচ্ছা তাঁদের মধ্যে গৌর কে আর কোনজনই বা নিতাই। তাহলে কয়জন যে সঠিক উত্তর দিতে পারব সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ।বলবো হয়ত, দু’জনেই তো একই রকম দেখতে,তাই ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক । হ্যাঁ ,খুবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এ কারণে যে, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর এই প্রায় পাঁচশো বত্রিশ বছরের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যত চর্চা হয়েছে তার সিকি ভাগও নিতাই বা নিত্যানন্দকে নিয়ে হয়নি । যত গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে রচিত হয়েছে , পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বিশেষ চরিত্র নিয়ে এত গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। অথচ, যে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে এত লেখালিখি, যাঁর ভক্তি আন্দোলন সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে দূর মহাদেশে প্রভাব ফেলেছে—-সেই তিনি নিজমুখে শ্রীরাঘব পণ্ডিতের কাছে স্বীকার করেছেন , “এই নিত্যানন্দ যেই করায় আমারে।সেই করি আমি এই বলিল তোমারে।।”(চৈ.ভা.অন্ত্য,৫) নিত্যানন্দ যদি না থাকতেন তাহলে শ্রীচৈতন্যদেবকে জগত জানতে পারতো না। ভক্তি আন্দোলন হতই না । যখন মন্দিরে নিত্যানন্দ বিগ্রহ স্থান পেয়েছেন, পূজা পাচ্ছেন ,তখন তাঁর পূজিত হওয়ার কি কারণ হতে পারে সে সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ওঠাটা খুব যুক্তিসংগত। তবে তা কিন্তু অনেকাংশে হয়নি বললেই চলে। কারণ সেই একটাই—তাঁর সম্পর্কে আলোচনা কম। অথচ ,এই নিত্যানন্দই ছিলেন মধ্যযুগের বঙ্গদেশে সংঘটিত ধর্মবিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারী। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব প্রদর্শিত প্রেমভক্তি-ধারার ভগীরথ । মধ্যযুগীয় মানবমুক্তির অগ্রদূত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের  অভিন্ন আত্মা নিত্যানন্দ । চৈতন্যদেব ও  নিত্যানন্দের যৌথ সংকল্প ও প্রয়াসের সার্থক প্রতিচ্ছবি হল প্রেমভক্তি আন্দোলন। চৈতন্যের ইচ্ছার রূপকার হলেন নিত্যানন্দ।যা নিমাই চেয়েছেন, নিতাই  করেছেন তা বাস্তব। নিমাই নামপ্রেম  এনেছেন আর অকাতরে তা বিলিয়েছেন নিতাই।নিমাই-নিতাইয়ের লোকহিতৈষণা ব্রতেই  নবযুগের সূচনা সম্ভব হয়েছে । ভারতবর্ষের প্রথম সাম্যবাদী সমাজ স্থাপিত হয়েছে নিত্যানন্দরই পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতায় । ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গণ সংগঠন গড়ে উঠেছিল নিত্যানন্দেরই নেতৃত্বে। চন্দ্র প্রকাশ হতে যেমন , সূর্যের আলো লাগে , ঠিক তেমন গৌরচন্দ্র প্রকাশ হত না যদি না নিতাই সূর্য থাকতো । আর , একথা অত্যুক্তি বা অতিকথন ও অতিরঞ্জন নয় । কেন? তা আমরা আজ এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আলোচনা করার চেষ্টা  করবো।  ৩রা ফেব্রুয়ারি, মাঘী শুক্ল ত্রয়োদশী তিথিতে নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর। এই সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে আজও যে তিনি কতখানি প্রাসঙ্গিক তা জানবো ।

ইতিহাসের খাতে নিতাই-নিমাই দুটি হৃদয়ধারা গঙ্গা-যমুনার মত পারস্পরিক সৌহার্দ্য ,ভ্রাতৃত্ব ,সাহচর্য্যকে  সম্বল করে নিরবধি বয়ে গেছে নির্দন্ধ, নিঃস্বার্থ ভাবে ।একে অপরের প্রতি কী সুগভীর টান,ভালোবাসা,অন্তরঙ্গতা — যা ইতিহাসে বিরল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, “মুঞি নিত্যানন্দের দাস— একথা প্রতিদিন মুখে যে একবার বলে,আমি তার হয়ে যাই।” আবার, নিত্যানন্দ বলেছেন, “ যে দিনান্তে অন্তত একবার ‘হা গৌরাঙ্গ’ বলে ,আমি তার দাস হয়ে যাই।” নিতাই-নিমাই দু’জনারই জীবনের এক লক্ষ্য, এক অভীপ্সা— পতিত উদ্ধার করা ,দীন-দুঃখী- দরিদ্র-দুর্বলদের মুখে হাসি ফোটানো।

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল অদ্ভুত জনাকর্ষিণী ,লোকমোহিনী শক্তি। মানুষের মন যে কী ভাবে মমতাভরা ব্যবহার দিয়ে জয় করা যায়, তা যেমন তিনি জানতেন ,তেমনি নিজ ব্যক্তিত্বগুণে সংগঠন কার্য্য পরিচালন পদ্ধতিও তাঁর অজানা ছিল না ।আর ,সে কারণেই তাঁরই অনুপ্রেরণায় শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তনকে গণসঙ্গীতের রূপ দিয়ে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  নিত্যানন্দ নদীয়াতে আসার আগে পর্যন্ত কীর্তন ঘরের মধ্যে করা হত।নিত্যানন্দ পরামর্শ দিয়ে কীর্তনকে খোলা আকাশের নীচে পথে বের করে আনালেন ।আকাশে বাতাসে হিল্লোল তোলা কীর্তনের ভাব,আবেগ,ধ্বনি,সুর ,অনুরণন ক্রমে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করলো। সর্বস্তরের মানুষ সমবেতভাবে গলা মেলানোয় তা সংকীর্তনের রূপ নিল।  গণবিপ্লবের মাধ্যম  হয়ে উঠল ধীরে ধীরে এই সংকীর্তনরূপ গণসংগীত।  সকল শ্রেণীর মানুষ শামিল হতে থাকলেন সেই সংকীর্তনরত  গণজোয়ারে। ভেদ-ভাবের ভাবনা ভুলতে থাকলো মানুষ। জাতের বিচার করে নয় , ভক্তির গভীরতায় একে অপরকে প্রণাম করতো। ফলে দেখা গেল ব্রাহ্মণ হয়েও চন্ডাল ভক্তের পদধূলি নিয়ে মাথায় দিচ্ছে নিজে। অসাম্য দূর হল।অনাথ-আতুর-অবহেলিতরা সমাজে  হৃত সম্মান ফিরে পেতে থাকলেন। নিত্যানন্দ দেখালেন ধর্ম কখনো বিদ্বেষ তৈরি করে না , তৈরী করি আমরাই।ধর্ম তো আশ্রয় দেয় , ধারণ করে আমাদের। মানুষের সাথে মানুষের সম্মিলন করায়  ধর্ম।  এভাবেই সেদিন থেকে রক্ষণশীল সমাজের স্মার্ত-বিধি-বিড়ম্বনার অবসান সূচীত হয়েছিল। জাতিভেদের অবসান হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম সকলকে ধারণ করে সার্বজনীন মানব ধর্মে পরিণত হয়েছিল। “বৈষ্ণবের জাতি বুদ্ধি যেই জন করে। কোটি জন্ম অধম যোনিতে ডুবি মরে”।(চৈ.ভা.)

তবে পথে-ঘাটে এমন  সংকীর্তনের ফলও হয়েছিল মারাত্মক । কাজীর আদেশে পেয়াদারা কীর্তনের  বাদ্যযন্ত্রগুলো মাটিতে আছাড় দিয়ে ভাঙ্গতে থাকলো । সংকীর্তনকারীদের প্রহার করতে থাকলো। গৌরাঙ্গ সিদ্ধান্ত নিলেন কাজীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে নামবেন ।হাতে মশাল নিয়ে কীর্তন করতে করতে কাজীর বাসভবন ঘেরাও করা হল।  সেই ঘেরাও মিছিলের  নেতৃত্বে ছিলেন নিতাই। অস্ত্র একটাই—সংকীর্তন। নিজের ভুল বুঝে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন ভীত কাজী। তিনি গৌরাঙ্গের চরণে আত্মসমর্পণ করলেন ।এই আন্দোলনই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম অহিংস আন্দোলন। ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘History of Bengali Literature’ গ্রন্থে একথাই  লিখেছেন— “It was perhaps the first act of civil disobedience in the history of India.” এখনও পর্যন্ত নগর সঙ্কীর্তন করার সময় যে ‘খোন্তা’ ব্যবহার করা হয় , তা আসলে কাজীর থেকে আদায় করা কীর্তনের গেটপাস, যা সঙ্কীর্তন প্রচার-প্রসারের উদ্যোগে সেদিন নিত্যানন্দের জয়কে সূচীত করে।  সুবিশাল দেহী, অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্বানুভাবানন্দে বিভোর নিত্যানন্দ নবদ্বীপের ঘরে ঘরে পথে পথে নামপ্রেম বিতরণ করতে মত্ত সিংহের মত বিচরণ করেছেন। “নিত্যানন্দ মত্ত সিংহ সর্ব নদীয়ায় । ঘরে ঘরে বুলে প্রভু অনন্ত লীলায়”।(চৈ.ভা.মধ্য,২৪)

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল এক সুন্দর ক্ষমাশীল সর্বংসহ মানসিকতা। ঠিক সেকারণেই , নবদ্বীপে যখন দুর্বৃত্ত জগাই-মাধাই মদের কলসীর প্রহার করে কপাল ফাটিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করেন, তখনও নিত্যানন্দ নির্বিকার। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে , অথচ তাও যে রক্ত ঝরালো, চাইছেন তার উদ্ধার। এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু সমগ্র বিশ্বের ধর্মের ইতিহাসে বিরল। মহাপ্রভু, তাঁর প্রাণের নিতাইয়ের অমন করুণ পরিণতি দেখে‌ ক্রোধে আত্মহারা হয়েছেন সেসময়। কিন্তু, নিত্যানন্দ সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছেন জগাই-মাধাইকে । এমন অহিংস নীতির গুণেই জগাই-মাধাইয়ের মত নৃশংস , অত্যাচারী , কুখ্যাত মানুষের মন পরিবর্তিত হয়েছিল। সেদিন থেকে মানবিকতার মন্ত্র পেয়ে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নিত্যানন্দের আদেশে তাঁরা গঙ্গার ঘাটে আগত স্নানার্থীদের সেবার কাজে নিজেদের বাকী জীবন নিয়োজিত করেছিলেন।  কাটোয়ায় ‘জগাই-মাধাইয়ৈর ঘাট’ আজও সেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । সদা আনন্দে থাকা  নিত্যানন্দ এমন ক্রোধহীন,  অহংকারহীন ছিলেন বলেই পদকর্তা লোচন দাস ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অক্রোধ পরমানন্দ নিত্যানন্দ রায় । অভিমান শূন্য নিতাই নগরে বেড়ায়।।”

নিত্যানন্দ ছিলেন অদোষদর্শী , কখনো কারও দোষ দেখতেন না। সকলেই তাঁর কাছে বড় আপনারজন।  সর্বদা বালখিল্যভাবে তিনি মত্ত থাকতেন।  বালকের ন্যায় মুখে খলখল হাসি আর শ্রীনয়নে যেন আনন্দধারা বয়ে যেত। তাঁকে যে দেখত তার মনও আনন্দে ঝংকৃত হয়ে উঠতো। আর কেউ যদি চৈতন্যের ভক্ত হতেন তবে তো কথাই নেই । গৌরাঙ্গের নাম নিলেই তিনি নিজেকে তার চরণে বিকিয়ে দিতেন।  তাইতো কেবল বলতেন, “আমাকে কিনিয়া লহ বল গৌরহরি”।

মহাপ্রভু চেয়েছিলেন একটি সার্বজনীন মানবধর্ম প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে। জাতের দলাদলি, কৌলিন্যাচারের করাল থাবা  মুক্ত হোক মানুষের জীবন । যথাযোগ্য সম্মান পাক প্রতিটি মানবিক চেতনা । উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, সম্মানীয়-হীন সকলে সকলকে গ্রহণ করুক সমানভাবে , বিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে।  কিন্তু ,এ কাজে তাঁকে চরম বাধা প্রাপ্ত হতে হয়েছিল যতটা না  মুসলমানদের থেকে , তার থেকে অনেক বেশী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে । তিনি চিন্তা করে দেখলেন, সন্ন্যাসী সকলের পূজ্য হন, এখন তিনি যদি নিজে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তবে উন্নাসিক ব্রাহ্মণদের থেকে সম্মান, প্রণাম ,অধীনতা আদায়ের মাধ্যমে সমাজের অসাম্য দূর করার প্রচেষ্টায় আরো একধাপ অগ্রসর হওয়া সহজ হবে। তিনি তাই সংসারের নিরাপদ, সুখময় জীবন বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসের কঠোর জীবন সংগ্রামের পথ অবলম্বন করেছিলেন । আর , মূলতঃ নিত্যানন্দই তাঁকে সম্মতি জানিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্তে।  পরিণামে ফলও  পাওয়া গিয়েছিল হিসেবমতই। মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে জননী ও যুবাস্ত্রীকে ত্যাগ করে, নবদ্বীপের নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিতের গৌরবময় জীবনকে তুচ্ছ করে নিমাইয়ের  আকস্মিক সন্ন্যাস গ্রহণ সকলকে স্তম্ভিত করলো। অতি বড় পাষাণ হৃদয়ও গলিত হল, নরম হল।

এই মহাপ্রভুই যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর পাগলের মত বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রাঢ়দেশ দিয়ে ছুটছেন; তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কোন হুঁশ নেই তাঁর। তখন নিত্যানন্দের চতুরতাতেই তাঁকে শান্তিপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
“দেখি সব ভক্তগণ করে অনুতাপ।
গৌরাঙ্গ গোলক যায় কি হবে রে বাপ।।
তবে নিত্যানন্দ প্রভু বলে বীর দাপে।
রাখিব চৈতন্য আমি আপন প্রতাপে।।”
(লোচন দাসের চৈতন্য মঙ্গল,মধ্য, ১৪)

তাই তো সুবিখ্যাত ‘অমিয় নিমাই চরিত’গ্রন্থে শ্রীশিশির কুমার ঘোষ এপ্রসঙ্গে নিত্যানন্দের অবদান স্মরণ করে লিখেছেন ,”শ্রীনিত্যানন্দের কথা কি বলিব?  প্রভু নিতাই!  তোমাকে কি ধন্যবাদ দিব? আহা! ধন্যবাদ তো অনেককেই দিয়া  থাকি,  হৃদয়ে কি তোমার পাদপদ্মে প্রণাম করিব? তাহাও তো সকলে করিয়া থাকে। অতএব, হে নিত্যানন্দ! হে বিশ্বরূপের অভিন্ন কলেবর,হে জীবের বন্ধু! আমি তোমার ধার শুধিতে পারিলাম না, তোমার নিকট চিরঋণী রহিলাম।”

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব বুঝেছিলেন যে তেজস্বী ,আত্মবিশ্বাসী, অটুট ব্যক্তিত্বের অধিকারী উদ্যমী নিত্যানন্দই এমন একজন ব্যক্তিত্ব , যাঁকে  সেসময়ের সমাজের ভীষণ প্রয়োজন। জাত-পাত বিভেদের  বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের ক্ষুদ্র মানসিকতাকে , সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করতে চাই নিত্যানন্দের মতো বৃহদ্ মানবিকচেতনা সম্পন্ন একজন সংগঠকের। জনমানসচেতনার উদ্বোধন ঘটাতে একজন সুদক্ষ নেতার যা যা গুণ, সর্বংসহ উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তরে মানবপ্রেম থাকা প্রয়োজন — তা সব  নিত্যানন্দের মধ্যেই নিহিত আছে।  শ্রীগৌরাঙ্গ দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন যে ,নিত্যানন্দের হৃদয়ে সকল জাতের মানুষের প্রতি  যে সাম্যভাব আছে সেই ভাব, সেই নীতিকে যদি সমাজে প্রকাশিত করে দেওয়া যায় ,প্রবাহিত করে দেওয়া যায় তবে সমাজে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়ে যাবে। আর তাই তিনি যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করে পুরীতে বাস করছেন তখন এক বছর আদেশ করলেন নিত্যানন্দকে—-

“মূর্খ নীচজড়ান্ধাখ্যা যে চ পাতকিনোপরে।
তানেব সর্বথা সর্বান কুরু প্রেমাধিকারিণঃ।।”
(মুরারি গুপ্তের কড়চা-৪/২১/১০)

—-“নিত্যানন্দ তুমি এভাবে আর রথযাত্রায় প্রতিবছর এসো না। তুমিও যদি সন্ন্যাসী-মুনীদের মত করে সব ভুলে কেবল ধর্মাচরণ পালনে ব্যস্ত থাকো, তবে সমাজকে কে চালনা করবে ! সমাজের দুঃখী-দরিদ্র ,আর্ত-আতুরদের দুরাবস্থা কে ঘোচাবে!  না, না,, তোমাকে যে আরও বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে হবে ।”

নিজের গণসমেত অর্থাৎ অনুগত জনাদের নিয়ে ফিরে এসেছিলেন নিত্যানন্দ । পুরী থেকে ফেরার পথে যখন  পানিহাটিতে  শ্রীরাঘব পন্ডিতের ভবনে উঠলেন , তখন সেখানে গঙ্গাতীরে এক মহোৎসবের আয়োজন করালেন হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের জমিদার পুত্র  রঘুনাথ দাসের  ব্যয়ভারে। সেই উৎসবে একসঙ্গে  ৩৬জাতির মানুষকে  এক পংক্তিতে (লাইনে) বসিয়ে ভোজন করালেন । পানিহাটীকে কেন্দ্র করেই নিত্যানন্দ তাঁর সমাজসংস্কারক অভিযান শুরু করলেন। সেখানেই  নিত্যানন্দ তাঁর পার্ষদদের মধ্য থেকে উপযুক্ত বারোজনকে নির্ধারণ করলেন। শ্রীঅভিরাম , সুন্দরানন্দ , ধনঞ্জয়, গৌরীদাস, কমলাকর পিপ্পলাই, উদ্ধারণ দত্ত, মহেশ পণ্ডিত, পুরুষোত্তম দাস, নাগর পুরুষোত্তম, পরমেশ্বর দাস, কালা কৃষ্ণদাস ও শ্রীধর পণ্ডিত—–  এঁদেরকে গৌড়মন্ডলের এক একটি নির্দিষ্টস্থানে নামপ্রেম প্রচারের দায়িত্ব দিলেন। আদেশ দিলেন উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র কোন বাছবিচার না করে প্রত্যেককে  কাছে টেনে নিতে।  নিত্যানন্দের নির্দেশে সেই বারোজন সেনানী আজীবন সেই কর্মই করে গেছেন।  ফলে সমাজে এক মানববন্ধন তথা প্রেমমন্ডল তৈরি হয়েছিল। ধর্মবিভেদ ভুলে ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ নীতিতে মানুষ মানুষকে  তথা মানবাত্মাকে সম্মান করতে শিখেছিলো।

নিত্যানন্দ অনুভব করেছিলেন যে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের অর্থাৎ জল-অচল হিন্দু, বৌদ্ধ সহজিয়া , নেড়া-নেড়ী সম্প্রদায়ের সেই বিশাল সংখ্যক মানুষকে যদি সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায় তবে হিন্দুসমাজ বলবতী হবে।  এই ভাবনা থেকেই তিনি সস্নেহে পূর্ববঙ্গের জল-অচল মানুষদের কৃষ্ণনাম প্রদান করে মূল হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন । বহিষ্কৃত সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়কেও সেসময় হিন্দু সমাজভুক্ত করেছিলেন তিনি। তারফলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণীয়তা আরো বেড়ে গিয়েছিল।শ্রীগৌরাঙ্গের আদর্শ–“কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার”— এই পন্থাকে অবলম্বন করে নিত্যানন্দ তাঁর পতিত উদ্ধারণ লীলা অব্যাহত রাখলেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বহারাদের নেতা, বঙ্গদেশের প্রথম সাম্যবাদী নেতা। তাঁর আবেদন ছিল অত্যন্ত জোরালো ও প্রভাবময়।

নিত্যানন্দ ছিলেন চরম বাস্তববাদী নেতা।  তাইতো তিনি বলেছিলেন, “কাঠিন্য কীর্তন কলিযুগ ধর্ম নয়”( জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল–উত্তরখন্ড)। আরও বলেছিলেন, “কূলবধূ নাচাইমু কীর্তনানন্দে”(ঐ)।  পুরুষদের মত নারী জাতিরও যে অধিকার আছে কীর্তনে অংশগ্রহণ করার,সেখানে নৃত্য করার—একথা প্রথম শোনা যায় নিত্যানন্দের নির্ভয় কন্ঠেই । তখন থেকেই পর্দানশীন বঙ্গবধূর বহির্জগৎ তৈরি হতে থাকে। অন্দরমহলের অন্তরায় ভেদ করে নারীরা সর্বসমক্ষে আসতে আরম্ভ করে। আর তারই চরম দৃষ্টান্ত হল  নিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী জাহ্নবাদেবী। জাহ্নবাদেবী হয়েছিলেন সমুদয় বৈষ্ণবকুলের আচার্যানী, জননেত্রী। সমগ্র গৌরমন্ডলে পরিভ্রমণ করে, বিগ্রহ স্থাপন করে , মহোৎসব করে বৈষ্ণবদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন তিনি।

সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতিমূর্তি নিত্যানন্দে  শৈব ,শাক্ত ,বৈষ্ণব—এই ত্রিধারার মেলবন্ধন দেখতে পাই আমরা। কারণ, তাঁর মস্তকে থাকতো শাক্ত সম্প্রদায়ের ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র , সঙ্গে রাখতেন শৈব সম্প্রদায়ের নীলকন্ঠ মহাদেব ; আর ,কণ্ঠে ধারণ করতেন বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিভূ  অনন্তদেব শিলা ।  তাঁর মত হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব ছিল এমন বেপরোয়া আচরণ।  আবার , যে যুগে জাত বাঁচাতে ব্রাহ্মণরা অন্য জাতের জলটুকুও গ্রহণ করতেন না , সেযুগে  নিত্যানন্দ ছিলেন একেবারে ছুঁৎমার্গহীন।দিনের পর দিন বৈশ্য সম্প্রদায়ের উদ্ধারণ দত্তের  রন্ধন করা দ্রব্য  আহার করেছেন । প্রথম জীবনের সুদীর্ঘ কুড়িটা বছর ভারতবর্ষের নানা স্থানে পরিব্রাজক হয়ে ঘোরার ফলেই হয়তো বা ভারতমাতার উদার মানবিক ভাবটি আত্মস্থ হয়েছিল তাঁর।

নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর পরও তাঁর আদর্শ ও তিনি বড় বেশীরকম প্রাসঙ্গিক। তবে, গৌর আদর্শের সার্থক রূপকার নিত্যানন্দের সাংগঠনিকশক্তি ও উদার-ভাবনা সম্পর্কে গবেষণা সেই অর্থে হয় কী! বর্তমানের এই দাঙ্গা-হানাহানি, অভিযোগ-অশান্তির আবহে ভীষণ প্রয়োজন বৃহৎ আদর্শের , সাম্য মনোভাবের। মানবদরদী নিত্যানন্দ চরিত্রের আলোচনা, গবেষণা— তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

Share This
Categories
অনুগল্প গল্প

টুকাই : রাণু সরকার।

পতিত বস্তু পথ থেকে তুলে তুলে জড়ো করে বস্তায় নানান জায়গা থেকে, কখনো ডাস্টবিন ঘেঁটে।
ছোটবেলা থেকে বঞ্চিত মাবাবার ভালোবাসা থেকে। এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা মা বাবার সাথেই কুড়িয়ে বেরায় জঞ্জাল।
এই আবর্জনা কুড়িয়ে বিক্রি করে যা টাকা পায় কোনরকমে পেট চলে, ওদের ঘর নেই, রাস্তার ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।
মেয়েদের সমস্যা বেশিরভাগ,অন্ধকার নেমে আসলেই ভয়ে ভয়ে রাত কাটে- কখন কি অঘটন ঘটিয়ে দেয় হিংস্রের দল। একদিন এক ঝুপড়ির দুহিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র জন্তু, মনে হয় তার খাদ্যের অনটন দেখা দিয়েছিল, আসলে বিনামূল্যে গায়ের জোরে খাবার মেলে যে ঝুপড়িতে। সেই দুহিতা কিছুদিনের মধ্যেই হয় অন্তঃসত্ত্বা, আর কি করা ওদের সাথে তো কেউ নেই ঘৃণার চোখে দেখি তাই অস্বাভাবিক ভাবেই হলো গর্ভমোচন। এরাতো টুকাই- তাই না?ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো কিছুদিন লালনপালনও করলো। কি জানি কে চুরিও করে নিলো শিশুটিকে সন্তান হারা মা এখন পাগল।কে করবে ওর চিকিৎসা?

পাশের এক ঝুপড়ির টুকাই সব দেখে ভয় পেলো – ওরকম যদি ওর হয়।
এই টুকাই একটু বুদ্ধিমতী ছিলো তাই সে একদিন জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবহৃত আবরক কিনে রাখলো তার আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এক ওষুধের দোকান থেকে-দোকানী টুকাইয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে-ভাবতে থাকে যে কি করবে-হয়তো পরে ভাবনার উত্তর ঠিক খুঁজে পেয়েছে।
কোন হিংস্র আসলে অনিচ্ছাকৃত এই অস্ত্রটি হাতে তুলে দিয়ে বলবে, এই নে– আমার অস্ত্র দিয়ে আমাকে খুন কর—

ভাবা যায় না সচরাচর এইরকম ঘটেই চলছে- এই টুকাই দের কথা ভাবি না, নিজেকে নিয়েই থাকি ব্যস্ত।

Share This
Categories
গল্প

পরিবর্তন : দিলীপ রায়।

তপা পরীক্ষার মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরল । অভিভাবকের স্বাক্ষর করিয়ে পরের দিন অবশ্যই জমা দিতে হবে । পরেরদিন মার্কশীট জমা দেওয়ার শেষ দিন । তপা মায়ের কাছে গিয়ে মার্কশীট দেখিয়ে বলল, কীভাবে বাবার স্বাক্ষর নেওয়া যায় ? বাবা মার্কশীট দেখলে আমাকে ভীষণ বকাবকি করবে ।
নম্বরের যা বহর, তাতে তুই কোন্‌ মুখে বাবার কাছে গিয়ে স্বাক্ষর চাইবি !
তপার বাবা পশুপতি খাঁ । পূর্বস্থলি স্টেশনের কাছে সোনাঝরা গ্রামে তাঁর মুদিখানার দোকান । দোকানে অনেক ধার-বাকী । খরিদ্দারের কাছ থেকে ধারের টাকা আদায় হচ্ছে না । চাইতে গেলে সকলের মুখে এককথা, “মাঠের ধান উঠুক, ধারের সমস্ত টাকা শোধ করে দেবো ।“ পশুপতির আবার ধার দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ । অথচ ধার না দিলে খরিদ্দার ধরে রাখা কষ্ট । সদলবলে গাজি মিয়ার মুদির দোকানে হত্যে দেবে । তাতে আখেরে তাঁর লোকসান ।
তখন সন্ধ্যা আঁটটা ! খরিদ্দারের আনাগোনা নেই বললেই চলে । তাই ভাবল পশুপতি, এবার দোকান বন্ধ করা যাক । মন-মেজাজ তাঁর ভাল নেই । কিছুক্ষণ আগে খাতা খুলে পশুপতির মাথায় হাত ! প্রায় আঠারো হাজার টাকা ধার । এইটুকু দোকানে এতগুলি টাকা ধার ! লোকে ধার খেয়ে শোধ করার নাম করছে না । অথচ অনেকগুলি টাকা । সংসারে অনেক খরচ । অভাব অনটনের বহর বেড়েই চলেছে । তাঁর বৌটা তেমনি ! একটু রেখে ঢেকে খরচা বাঁচিয়ে সংসার চালাবে সেদিকে তাঁর নজর নেই । শুধু বায়নাক্কা । এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে । দেখা যাবে আজ গৃহের আসবাবপত্র কেনা, কাল দেখা যাবে ঘরের থালা বাসন কেনা ! আজকাল আবার অনলাইনে কেনাকাটা শিখেছে । কেনার শেষ নেই । তাঁর বৌয়ের খরচার হাত ষোলোআনা । এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি এসে পৌঁছালো পশুপতি খাঁ ।
গামছা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁর বৌ বলল, “হাত মুখ ধুয়ে এসো চা বানিয়ে দিচ্ছি । ঐদিকে খাবার রেডি । যখন বলবে তখনই রাতের খাবার দিয়ে দেবো ।“
পশুপতি বৌয়ের দিকে কট্মট করে তাকিয়ে বৌকে ঝাঁঝালো সুরে বলল, “কষ্ট করে আর চা বানাতে হবে না । ক্ষিদে পেয়েছে, সুতরাং একটু পরে রাতের খাবার খেতে দিলেই চলবে । যতোসব আদিখ্যেতা !”
পশুপতি হাত মুখ ধুতে যাবে এমন সময় তপা কাচুমাচু হয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো । মেয়েকে দেখে মুখ ভেঙ্‌চি দিয়ে পশুপতি জিজ্ঞাসা করল, “সাঝ-সন্ধ্যাবেলায় তোমার আবার কী দরকার ?”
“বাবা, আমার স্কুলের মার্কশীটে তোমার স্বাক্ষর চাই”, তপা আমতা আমতা করে বাবাকে বলল ।
মার্কশিট নিয়ে ঐরকম হতচ্ছাড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? নিশ্চয়ই পরীক্ষায় ডাহা ফেল ! দেখি তো মার্কশীট, বলেই পশুপতি মেয়ের হাত থেকে টান দিয়ে মার্কশীট নিজের হাতে নিলো ।
এক ঝলক মার্কশীটের নম্বর দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো পশুপতি । তারপর রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে কষে মেয়ের গালে এক চড় । চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে তপা ঘরের মেঝেতে সটান্‌ পড়ে গেল । যন্ত্রণায় তপা কাঁদছে । তপার মা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলতে গেলে পশুপতি এক ধ্মকে বৌকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো । আর কট্মট করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “তোমার লায় পেয়ে মেয়েটা উচ্ছন্নে গেছে” ।
তপা কাঁদছে ।
পশুপতি মার্কশীট ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলো ।
“বাবা, মার্কশীট আগামীকাল স্কুলে জমা দিতে হবে”, ভীত ও ত্রস্ত অবস্থায় তপা বাবাকে বলল ।
আগে নাচ বন্ধ করো তারপর স্বাক্ষর । নাচ বন্ধ না করলে আমি আর স্বাক্ষর করবো না । ধাই ধাই করে এখানে সেখানে নেচে বেড়ানো । যার জন্য ১০০ নম্বরের মধ্যে অঙ্কে ২৫ নম্বর । ইংরেজিতে ২২ নম্বর । আহারে ! নম্বরের কী ছিরি !
তারপর আবার মেয়ের উপরে রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে নাচের সরঞ্জাম দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসে মেয়েকে ধমকিয়ে বলল, “আবার কখনও নাচে তোকে দেখেছি, তাহলে তোকে আস্ত পুড়িয়ে মারবো । তোর মা এসেও বাচাঁতে পারবে না । বলেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গজরাতে গজরাতে খাওয়ার ঘরে ঢুকলো ।“
( ২ )
পরের দিন রাজ্যস্তরে নাচের প্রতিযোগিতা । কলকাতার নজরুল মঞ্চে । স্কুল ফাঁকি দিয়ে কলকাতা ছুটলো নাচের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে । এই ঘটনা একমাত্র তপার মা জানে । কেননা একমাত্র মা তপাকে নাচে ভীষণ উৎসাহ দেয় । সত্যি কথা বলতে, তপার পড়াশুনা ভাল লাগে না । পড়তে বসলেই পড়া থেকে উঠে নাচের অনুশীলন । নাচের অনুশীলনে তার পরিশ্রম নেই, বরং ভীষণ স্বচ্ছন্দ । কিন্তু তার বাবা উল্টো, পড়াশুনা ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না । অথচ তপার নাচই জীবন । নাচটা তার রক্তে । মনপ্রাণ দিয়ে নাচ শেখে । লুকিয়ে লুকিয়ে নাচের ক্লাস করে । নাচে ভীষণ দক্ষ । মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলকাতার নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিলো তপা । তার সঙ্গে রয়েছে সহপাঠী অনুপম । তপাকে নাচের ব্যাপারে সবরকম সহযোগিতা করে অনুপম ।
বিশাল বড় হল । রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম । প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে একজন অথবা দুইজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে । টান টান উত্তেজনা । বিচারকের আসনে স্বনামধন্য পাঁচজন । সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু । কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হল বেলা ১১টায় । বিচারকেরা নাচের নিয়মাবলী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন । বিচারকদের নির্দেশমতো প্রতিযোগীদের একটা মাত্র নৃত্য পরিবেশন । শুরু হল নৃত্যানুষ্ঠান ।
তপার পালা ঠিক বেলা দুটোর সময় । তাকে কত্থকের উপর নৃত্য পরিবেশনের জন্য বিচারকমণ্ডলী নির্দেশ দিলেন । তপার নৃত্যের তাল,ছন্দ ও লয় অতীব সুন্দর । তালে তালে এত সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করলো তপা, যার জন্য হলের সমস্ত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূতো । প্রচণ্ড হাততালি । বিচারকগণ পুনরায় তপাকে নির্দেশ দিলেন আধুনিক লোকগীতির সঙ্গে আরও একটি নৃত্য পরিবেশন করতে । তপাও তেমনি ! নৃত্যের তাল সম্পর্কে তপার প্রচণ্ড দখল । এটা তার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা । মন খুলে মনের আনন্দে নৃত্য পরিবেশন করলো তপা । নৃত্যে তার অফুরন্ত আনন্দ । অনুপম অবাক ! অনুপম লক্ষ করল, তপার নাচের পরিবেশনের সময় তার সাথে সাথে অর্ধেকের বেশি শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগলেন । অনুপম আরও লক্ষ করল, মাননীয় বিচারকেরা একে অপরের প্রতি হাসিমুখে তাকালেন ।
তারপর দুজনে ছুটলো হাওড়া স্টেশন । ট্রেন ধরতে । পূর্বস্থলি স্টেশনে যখন পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ৭টা । অনুপমের সঙ্গে তপা বাড়ি ফিরছে । তপা ভাবছে এই সময়ে বাড়িতে বাবা নেই, সুতরাং বাবার বকা বা তাঁর হাতে মার খাওয়া থেকে মুক্তি । কিন্তু গাঁয়ের ভাওয়াল মাস্টার মশাই অনুপমের সঙ্গে তপার বাড়ি ফেরা দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন । সরাসরি পশুপতির দোকানে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, “ছ্যাঃ ! শেষে কিনা আপনার মেয়ে একটা আদিবাসী ছেলের সাথে মিশছে ? ভর সন্ধেবেলায় আপনার মেয়ে কিনা নীচু জাতের আদিবাসী ছেলেটার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ! স্কুলের ড্রেস পরা । পিঠে স্কুলের বইয়ের ব্যাগ । নির্ঘাত স্কুল থেকে আলো-আধারি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে ।“ কথাগুলি বলে ভাওয়াল মাস্টার অন্যত্র ছুটলেন ।
পশুপতি রাগে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য । দোকান খোলা রেখেই ছুটলো বাড়ির দিকে । বাড়ি পৌঁছেই চিৎকার, “তপা কোথায় ?”
স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে ।
তপা বাথরুম থেকে বের হতেই হাতের বেতের লাঠি দিয়ে তপার পিঠে বেদম মার ! তপার মা থামাতে গেলে তাকেও ঐ বেতের লাঠি দিয়ে চপেটাঘাত । মেয়েকে শাসিয়ে পশুপতি বলল, “নাচ বন্ধ । এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা । এর বাইরে কোথাও দেখতে পেলে তোর ঠ্যাং খোড়া করে দেবো । স্ত্রীর দিকে ক্রূদ্ধভাবে শাসিয়ে বলল, “মেয়েকে না সামলাতে পারলে আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দেবো ।“
তারপর হন্‌হন্‌ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো পশুপতি ।
মা ও মেয়ে দুইজনেই কাঁদছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে তপা কেদেই যাচ্ছে । কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না ! কলকাতায় ছোটাছুটিতে সারাদিনের ধকলের পর বাবার হাতের বেদম প্রহারে তপা যতো না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছে বাবার হাতে মা নিগৃহীত হওয়ার জন্য !
( ৩ )
তারপর, নাচের প্রতিযোগিতার ফলাফল । সেটা ঘোষণা হবে কলকাতায় শনিবারদিন । বাড়ি থেকে কীভাবে বের হবে সেই চিন্তায় তপা অস্থির ।
মা মেয়েকে বলল, কাল অর্থাৎ শনিবার তুই ঠিক সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্রেন ধরে কলকাতা যাবি । সঙ্গে অনুপম যাবে ।
“তুমি যাবে না মা ? তুমি আমার সঙ্গে চলো মা”, বায়না ধরলো তপা ।
যাওয়ার ইচ্ছা আমার ষোলোআনা, কিন্তু তোর বদরাগী বাবাকে নিয়ে ভয় ?
তপা মনকে শক্ত করে মাকে বলল, “আমার নাচে কোনো পুরস্কার পেলে আমি বাবাকে আর ছেড়ে কথা বলবো না । বাবার জন্য তোমার যেমনি অশান্তি তেমনি আমার ভীতি । দরকার হলে থানায় নালিশ জানাবো । বাবার অভব্যতার একটা বিহীত হওয়া দরকার, নতুবা বাবা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে” ।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা শান্তভাবে তপাকে বলল, “বাবাকে নিয়ে ওসব আজেবাজে কথা বলতে নেই মা । তোর নাচের স্বীকৃতি স্বরূপ কোনো পুরস্কার পেলে তোর বাবার লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর মনে পরিবর্তন আসতে বাধ্য । আমার কথাটা মিলিয়ে নিস ।“
পরের দিন মা ও মেয়ে দুইজনেই পশুপতি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরলো । কলকাতায় রাজ ভবনের প্রেস কর্ণার হলে ফলাফল ঘোষণা । মাননীয় রাজ্যপাল বিজেতাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন । পুরো অনুষ্ঠান টিভিতে লাইফ দেখানো হবে । তপা ও মা এবং অনুপম রাজভবনে গিয়ে আসন নিয়ে বসে পড়লো । অনুপমকে রাজভবনে ঢোকার গেটে সিকিউরিটি ধরেছিল । কিন্তু তপা অনুপমকে তার জেঠতুতো দাদা বানিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করল । যার ফলে অনুপম ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলো ।
এবার নাম ঘোষণার পালা ।
তপা ভীষণ টেনশনে আনচান । কোনো পুরস্কার না পেলে আজ তার বাবার কাছে রক্ষে নেই । বাড়ি থেকে মা ও মেয়েকে তাড়িয়ে দেবে । পুরস্কারের ব্যাপারে তপা যেটা বুঝেছে সেটা হচ্ছে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছাড়া আরও জেলা ভিত্তিক একটি করে পুরস্কার । জেলা ভিত্তিক দশ জনের পুরস্কার । পুরস্কারে নগদ ৫০,০০০/- টাকা এবং মানপত্র । প্রথম পুরস্কার ৫ লাখ, দ্বিতীয় পুরস্কার ৩ লাখ এবং তৃতীয় পুরস্কার ২ লাখ টাকা এবং সঙ্গে মানপত্র ।
নাম ঘোষণার জন্য মঞ্চে উঠে এলেন মাননীয় ঘোষকঃ-
হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ । রাজ্যের মন্ত্রী ও উচ্চ পদাধীকারি আধিকারিকগণ । নাম ঘোষণা করলেন —- প্রথম, পূর্বস্থলির তপতি বেরা ।
তারপর হাততালি । প্রচুর হাততালি । ঘোষক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “তপতিকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি ।“
মঞ্চে তপতির ওঠবার পর ঘোষক তাঁর হাতের মাইকটি তপতির হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলো ।“
এদিকে ভাওয়াল মাস্টার পশুপতিকে আবার খবর দিয়ে বলল, “টিভিতে তোমার মেয়েকে দেখাচ্ছে । এখন টিভি খুললেই তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে ।“
সঙ্গে সঙ্গে পাশের দোকানে টিভির সম্মুখে এসে পশুপতি অবাক ! তাঁর মেয়ে প্রেস, মিডিয়া্‌ ও অনেক শ্রোতামণ্ডলির সামনে নির্দ্বিধায় বলছে, “নৃত্য শিক্ষায় আমার অনুপ্রেরণা আমার মা । মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতে আমার নৃত্য শিক্ষার বাস্তবায়ন ।“
পশুপতির চোখ ছলছল । সে আপন মনেই ফিসফিস করে বলে উঠলো, ফিরে এলে মেয়েকে আর বকবে না । মেয়ে যেটা চায় সেটাই করবে । মেয়ের ক্যারিয়ারে কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না । সে এখন পরিষ্কার বুঝেছে, “যার যেদিকে ঝোঁক তাকে সেদিকেই এগিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয় ।“ রুমাল দিয়ে চোখ মুছলো পশুপতি ।
( ৪ )
তারপর স্কুল, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সকলে তপার নাচের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । নাচের প্রতিযোগিতায় তপা রাজ্যে প্রথম হওয়ায় সকলেই গর্বিত ।
পশুপতি কাচুমাচু হয়ে মেয়ের কাছে নত হয়ে ছলছল চোখে বলল, “মা আমাকে ক্ষমা করিস্‌ ।“
তপা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ।
———০———

Share This