Categories
গল্প প্রবন্ধ

কল্যাণীর সতীমার দোল মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় — একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

যতদূর জানা যায়, আনুমানিক দুশো বছর আগে আউলিয়া সম্প্রদায়ের সতীমা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী এই মেলার প্রবর্তন করেন । এপার বাংলা- ওপার বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষপাড়ার সতীমার দোল মেলা । খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষদয়ের নিয়ে গড়ে ওঠে আউলচাঁদ সমাজ । এই সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিলেন আউলচাঁদ । তাঁর মৃত্যুর পর আউল সমাজের কর্তাপদ লাভ করেন রামশরণ পাল । তাঁরই স্ত্রী ছিলেন সরস্বতী দেবী যিনি পরবর্তীকালে সতী মা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন ।
বাউল, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লীগীতির সুরে মেলা জমে ওঠে । আখড়ায় আখড়ায় সারা রাত ধরে বসে গানের আসর । শ্রোতারা অধিকাংশই গ্রাম ও মফঃস্বলের । বিভিন্ন জায়গায় তৈরী হয় লালন মঞ্চ । গানের পাশাপাশি বিশাল উনুন জ্বালিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হয় ঐ আখড়াগুলিতে । দূরদূরান্তের যাত্রীদের আশ্র্যস্থল এই আখড়াগুলি ।


এবার আসছি কর্তাভজা সম্প্রদায় প্রসঙ্গে ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফিবাদ থেকে বিকশিত একটি ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় । এই সম্প্রদায়ের মূল গুরু আউল চাঁদ ।
প্রথমেই বলি, আউল চাঁদ হলেন একজন বাঙালি ধর্ম প্রচারক ও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু । কিংবদন্তি বা লোকবিশ্বাস যে, গোরাচাঁদ অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যদেব আউল চাঁদ রূপে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন । গৃহী মানুষকে বৈরাগ্য ধর্ম শেখাতে শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হন আউল চাঁদ ফকির হয়ে । এখানে তাই কোনো জাতিভেদ নেই ।
আউল চাঁদের জন্ম খ্রিষ্টাব্দ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে । শোনা যায়, তিনি হিন্দু না মুসলমান সেটা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি । তবে প্রচলিত লোক কাহিনী অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার উলা গ্রামের ( অনেকের মতে, নদীয়া জেলার প্রাচীন জনপদ উলা বীরনগর ) পান ক্ষেত থেকে একটি নবজাতক শিশু পাওয়া যায় । ক্ষেতের মালিক মহাদের বারুই ভগবানের আশীর্বাদ ভেবে তাঁকে লালন-পালন শুরু করেন । বড় হয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেন । আউল চাঁদের পুরানো নাম পূর্ণচন্দ্র । সংস্কৃত ভাষা শেখানোর জন্য তাঁকে পাঠানো হয় সে সময়কার বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য হরিহরের কাছে । বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং নানাভাবে শিক্ষালাভ করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধিলাভ করেন । তাঁর নতুন নাম হয় ফকিরচাঁদ বা আউল চাঁদ । বহু দেশ ঘোরার পর নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় রামশরণ পাল নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি তাঁকে আশ্রয় দেন । আউল চাঁদের ২২জন শিষ্যের মধ্যে অন্যতম শিষ্য রামশরণ পাল । ২২জনের মধ্যে রামশরণ পাল আউল চাঁদের মৃত্যর পর গুরুপদ প্রাপ্ত হন । যারজন্য তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্তাভজা ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান, যা পরবর্তী সময়ে সতী মায়ের মন্দির নামে সবার কাছে পরিচিত । রামশরণ পালের স্ত্রীর নাম সরস্বতী, যার নামেই এই মন্দির—-সতী মায়ের মন্দির । কথিত আছে, সরস্বতীর প্রথম অক্ষর “স” আর শেষ অক্ষর “তী” অনুসারে সতী । আউল চাঁদের শিষ্য রামশরণ পাল গুরুর ভাবাদর্শকে ভিত্তি করে কর্তাভজা সম্প্রদায় গড়ে তোলেন । এইজন্য ভক্তের নিকট তিনি “কর্তা” এবং তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী “কর্তামা” নামে অভিহিত । রামশরণ পালের পর সরস্বতী দেবী এই সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেন । রামশরণ পালের স্ত্রী কর্তাভজা সম্প্রদায়কে দিশা দেখান । রামশরণের স্ত্রী সরস্বতী দেবী ছিলেন অতীব ধর্মপরায়ণা । শোনা যায়, আউল চাঁদ হিম সাগরের জল ও ডালিম গাছের তলার মাটির সাহয্যে সরস্বতী দেবীকে অলৌকিক উপায়ে মৃত্যের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন । আরও শোনা যায়, আউল চাঁদই রামশরণ পাল ও সরস্বতী দেবীর সন্তান হয়ে পরবর্তীতে জন্ম নেন দুলাল চাঁদ নামে । দুলাল চাঁদ (১৭৭৬-১৮৩৩) কর্তাভজা সম্প্রদায়কে সাংগঠনিক রূপ দেন । তিনি বহু পদ রচনা করে কর্তাভজা ধর্মমতকে একটা তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত করেন । পদগুলি ভাব-গীত-রূপে ভক্তদের নিকট সমাদৃত । কর্তাভজারা কোনো জাতিভেদ মানেন না । তাঁরা লোভ-মোহ-কাম-ক্রোধকে নৈতিক পাপ বলে মনে করেন । সৎ পথে থেকে এবং মিথ্যা কথা পরিহার করে নৈতিকভাবে ধর্মকর্ম করা তাঁদের প্রধান লক্ষ্য । তাঁর সময়ে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত গড়ায় । মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় । এরপর তাঁর মা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী কর্তা মা বা সতীমা নামে খ্যাতিলাভ করেন ।
নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ার রামশরণ পালের আদি ভিটেটুকু ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র । ভিটের পাশেই ডালিম গাছ । এই গাছের নীচেই যেহেতু সতীমা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেই হেতু ভক্তরা ডালিম গাছের ডালে ঢিল বেঁধে মানত করেন । বাতাসা, কদমা, চিড়ে, মুড়কি দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে ভক্তদের সতীমাকে পুজো দেওয়ার রীতি ।


জনশ্রুতি, শেষ বয়সে সরস্বতী দেবী সন্তানহারা হলে দোলপূর্ণিমার দিন গুরু পুজার আয়োজন করেন । সেই থেকে দোল পূর্ণিমার সূচনা । হাজার হাজার মানুষের সঙ্গেও বাউলেরা আসেন । তাই সতী মায়ের মেলাটা আউল-বাউলের মেলা বা আখড়া নামে পরিচিত ।
কর্তাভজা সম্প্রদায় মূর্তিপুজা এবং সকল প্রকার আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী । কর্তাভজা প্রচারক দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান, সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান ।“ উক্ত ভাবের গীত থেকে বোঝা যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজনে মানব সেবার প্রসঙ্গটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । এই প্রসঙ্গে ভাবের গীতে বলা হয়েছে—– “মানুষ ভজ, মানুষ চিন্ত, মানুষ কর সার, সকলি মানুষের খেলা মানুষ বই নাই আর” ।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য । এই সম্প্রদায়ে নারী পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয় না । এই কারণে গুরুদেবের ভূমিকায় নারী পুরুষ উভয়কেই দেখা যায় । একই ভাবে তাঁরা বাউল সম্প্রদায়ের মতো জাতিভেদ প্রথা মানেন না । দুলাল চাঁদের ভাবের গীতে তাই বলা হচ্ছে—- “ভেদ নাই মানুষে মানুষে, খেদ কেন ভাই এদেশে ।”
সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ে । এ বিষয়ে কবি নবীন চন্দ্র সেনের বক্তব্য অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য । তাঁর মতে, “কর্তাভজা সম্প্রদায়ে কোন জাতিভেদ নেই । সকলেই এক রন্ধনশালার পাক গ্রহণ করে । ছোঁয়াছুয়ির দোষ এদের কাছে মুখ্য নয় । মানুষ সেবা তাঁদের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় ।“
কর্তাভজাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গুরুদেবের পুত্র অযোগ্য হলে তাঁরা তাকে গুরু নির্বাচন করতে চান না । তাঁদের নিয়মাবলী নামক ভাবের গীতে এই প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করে বলা হয়েছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিই গুরুদেব হবার অধিকারী । এই জায়গায় কর্তাভজা সম্প্রদায় বর্ণবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন ।
আজও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীমায়ের কৃপা পাওয়ার নিরিখে যথেষ্ট উন্মাদনা । তাঁদের মধ্যে সরল বিশ্বাস ও ভক্তি আজও উজ্জীবিত । যার জন্য দোল পূর্ণিমার দিন সতী মায়ের মেলায় হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে । এদেশ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকেও মেলাপ্রাঙ্গনে অনেক মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো । বাউলদের সমারোহ আলাদা মাধুর্যে ভরপুর থাকে ঘোষপাড়ার এই মেলা । (তথ্যঃ সংগৃহীত) ।
—————-০———–
লেখক কথা সাহিত্যিক (ভারত) / +৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪
এ১০এক্স/৩৪, কল্যাণী-৭৪১২৩৫

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া ‘সরোজিনী নায়ডু’।

ভূমিকা—-

“মহাত্মা গান্ধীর “মিকি মাউস” সরোজিনি নাইডুর মৃত্যুদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।”

সরোজিনী নায়ডু (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯ – ২ মার্চ ১৯৪৯) ছিলেন স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি। তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে সরোজিনী নাইডু অনেকবার কারাবরণ করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পিছু হটেননি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি যোগ দেন ডান্ডি পদযাত্রায়। গান্ধী, আব্বাস তয়েব ও কস্তুরবা গান্ধী গ্রেফতার হলে তিনি ধারাসন সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাগ্মী এবং ইংরেজি ভাষার যশস্বী কবি।  তিনি ভারতীয় কোকিল (দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া) নামে পরিচিত। সরোজিনী নায়ডু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম (ভারতীয়) মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীন ভারতে তিনি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজ্যপালও হয়েছিলেন।

 

 

জন্ম ও পরিবার—

 

১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সরোজিনী চট্রোপাধ্যায় ভারতের হায়দরাবাদ শহরের একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি বরদাসুন্দরী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা।  অঘোরনাথ ছিলেন নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি ও তার বন্ধু মোল্লা আব্দুল কায়ুম ছিলেন হায়দরাবাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সদস্য। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে পদচ্যুত করে হয়। সরোজিনীর ভাই বীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী।

 

 

শিক্ষা—-

 

সরোজিনী নাইডু ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। ১২ বছর বয়সে, তিনি ১২ তম পরীক্ষায় ভাল নম্বর নিয়ে পাস করেছিলেন। তিনি ১৩ বছর বয়সে ‘লেডি অফ দ্য লেক’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যা তাকে বিখ্যাত করেছে। স্কুলে বসে অঙ্কের ১৩০০ লাইনে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এতে হায়দ্রাবাদের নিজাম এত খুশি হয়েছিলেন যে তাকে বিদেশে পড়ার জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজে এবং পরে কেমব্রিজের গ্রিটন কলেজে পড়াশোনা করতে যান। বারো বছর বয়সে সরোজিনী মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সমগ্র মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৯১ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা বন্ধ রেখে তিনি নানা বিষয় অধ্যয়ন করেন। ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজ ও পরে কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফার্সি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। তার প্রিয় কবি ছিলেন পি. বি. শেলি।

 

স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ—–

 

সরোজিনী নাইডু গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং গান্ধীজির চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সত্যাগ্রহ ও সংগঠনে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবেও তাঁর প্রতিভা দেখিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং জেলে যান।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরোজিনী যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, অ্যানি বেসান্ত, সি. পি. রামস্বামী আইয়ার, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন।
১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ভারতের নানা স্থানে যুবকল্যাণ, শ্রমের গৌরব, নারীমুক্তি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বক্তৃতাদান করেন। ১৯১৬ সালে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি চম্পারণে নীলচাষীদের হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৫ সালে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।

 

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন জারি করে সকল প্রকার রাজদ্রোহমূলক রচনা নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করলে সরোজিনী সর্বপ্রথমেই আন্দোলনে যোগ দেন। পরে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনের উপর ব্যাপক দমননীতি প্রয়োগ করে।
১৯১৯ সালের জুলাই মাসে সরোজিনী ইংল্যান্ডে হোমরুল লিগের দূত মনোনীত হন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসের তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পর ১ অগস্ট গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসের দুই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিনিধির অন্যতম রূপে নির্বাচিত হন।
১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি নিউ ইয়র্ক সফর করেন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকান ও আমেরিইন্ডিয়ানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা করেন তিনি। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

 

১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৫ মে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর অনতিকাল পরেই গ্রেফতার হন সরোজিনী। এই সময় কয়েক মাস তিনি কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি, গান্ধীজির সঙ্গে সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়। সেই বছরেই পরে আবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। স্বাস্থ্যহানির কারণে অল্পদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যান সরোজিনী। গান্ধীজি মুক্তি পান ১৯৩৩ সালে। ১৯৩১ সালে গান্ধীজি ও পণ্ডিত মালব্যের সঙ্গে তিনিও গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই সময় গান্ধীজির সঙ্গে ২১ মাস কারারুদ্ধ ছিলেন সরোজিনী।

মহাত্মা গান্ধী যখন স্বাধীনতা নিয়ে দেশে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল তা শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় সরোজিনী নাইডু তাকে ‘শান্তি দূত’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং সহিংসতা বন্ধ করার আবেদন করেছিলেন।

 

 

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সরোজিনী নায়ডুর সম্পর্ক এতটাই অন্তরঙ্গ ছিল গান্ধীজি তাঁকে ‘ভারত নাইটিঙ্গেল’ উপাধি দেন। কিন্তু চিঠিতে তিনি কখনো কখনো ‘প্রিয় বুলবুল’, ‘প্রিয় মীরাবাই’ এমনকি ‘আম্মাজান’, ‘মা’ও মজা করে লিখতেন। সরোজিনীও তাকে ‘তাঁতি’, ‘লিটল ম্যান’ এবং কখনো কখনো ‘মিকি মাউস’ বলে সম্বোধন করতেন।

 

ব্যক্তিগত জীবন—-

 

১৭ বছর বয়সে সরোজিনী ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নায়ডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। উল্লেখ্য, সেই যুগে অসবর্ণ বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। সরোজিনী ব্রাহ্মণ হলেও গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে ১৮৭২ সালের আইন অনুযায়ী তাদের বিবাহ হয়। তাদের চারটি সন্তান হয়েছিল: জয়সূর্য, পদ্মজা, রণধীর ও লীলামণি। কন্যা পদ্মজা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন।

 

কর্ম জীবন—-

 

১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এশীয় সম্পর্ক সম্মেলনের স্টিয়ারিং কমিটির পৌরোহিত্য করেন সরোজিনী নায়ডু।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার পর সরোজিনী নায়ডু যুক্তপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যপাল নিযুক্ত হন।

 

 

তাঁর রচনাবলি—-

 

লেখাপড়ার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। গোল্ডেন থ্রেশহোল্ড ছিল তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাব্য সংকলন ‘সময়ের পাখি’ এবং ‘ব্রোকেন উইং’ তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়কে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা কবিদের মধ্যে অন্যতম মনে করা হয়। বিশ্বনন্দিত অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সাহিত্যিক তার সাহিত্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। পোয়েট্রি সুপ নামের একটি ওয়েবসাইট তাকে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ১০০ জন কবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেখানে তার অবস্থান ছিল ১৯তম। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফারসি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। সরোজিনী নাইডু ইংরেজি ভাষায় কবিতাও লিখতেন।

উল্লেখযোগ্য  রচনাবলি—

The Golden Threshold (১৯০৫);  The Bird of Time: Songs of Life, Death & the Spring (১৯১২); The Broken Wing: Songs of Love, Death and the Spring (১৯১৭);
The Sceptred Flute: Songs of India (১৯৪৩); The Feather of the Dawn (১৯৬১);  The Gift of India;

 

মৃত্যু—-

 

স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি বিক্রমপুর কন্যা ভারতীয় কোকিলা সরোজিনি নাইডু ১৯৪৯ সালের আজকের দিনে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।  তার মৃত্যুর পর যুগ যুগ ধরে এই অতি অসামান্য বিদুষী নারী সমগ্র মহিলাজাতির পথপ্রদর্শিকা হিসেবে সম্মানিত হযে আসছেন।

 

।।ছবি ও তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
অনুগল্প প্রবন্ধ

সাহিত্যের ছোটো আকাশ, বড়ো আকাশ : শুভঙ্কর দাস।

এই সময়ের সাহিত্যের আকাশটা বড় থেকে
ছোটো হয়ে আসছে
তার প্রধান তিন কারণ

এক
এই সময়ের সাহিত্যচর্চায় সত্যিকারের সন্ধানীহাতের বড় অভাব।অর্থাৎ খুঁজে খুঁজে নবীন প্রতিভা বের করে প্রতিষ্ঠা দান।তার মারাত্মক অভাব।অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেই খুঁজে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিস্ময়কর আভিধানিক আবিষ্কার করেছিলেন।বুদ্ধদেব বসুর উদারতায় ও আহ্বানে জীবনানন্দের মতো বিরল প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছিল, আজকের জয় গোস্বামী, শ্রীজাত,বিনায়ক, মন্দাক্রান্তা, এমন কি মায়ে সুবোধ সরকার পর্যন্ত সকলেই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আনন্দময় সান্নিধ্যের পক্ষপাতপুষ্ট প্রতিভা।এই সূত্রে প্রবাদপ্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষের নাম স্মরণীয়। তাঁর গৃহের রবিবারের আড্ডা তো অসংখ্য সৃজনশীল হাওয়ার বাতাস হয়ে ওঠার সিঁড়ি ছিল।
এখানে উচ্চারিত নামগুলো শুধু উদাহরণ, কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য উল্লিখিত নয়, এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান এবং সাহিত্যে সৎ।
এই সময় প্রিয় ‘কবিসম্মেলন’ পত্রিকার দুই মহারথী কবি শ্যামলকান্তি দাশ ও শংকর চক্রবর্তী নীরবে ও নির্দ্বিধায় শস্যরোপনের কাজটি করে চলেছেন।এঁরা ব্যতিত নবীন প্রতিভার দাঁড়ানোর স্থান এতখানি অকুলান, তাতে যাকে অনুপ্রেরণা বলে,তা সত্যিকারের অণু হয়ে থেকে গেছে।
তাহলে
বল মা দাঁড়াই কোথা?

দুই
আপনার পাশের সাহিত্যরচনাকারীটি আপনার লেখা পড়েন না!
অর্থাৎ মহানগর তো দূরের নক্ষত্র, মফস্বলি কোনো সৃজনকর্মের পাঠক মফস্বলের পাওয়া দুষ্কর। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় কতজন সম্পাদক, সাহিত্যিক এবং সংগঠক আছেন,যাঁরা হাতে প্রাপ্ত কবিতা-গল্প-উপন্যাস যাই পান,তার এক পাতাও উলটে দেখেন কি না সন্দেহ!
ফলে তাঁর মুখে এই আফসোস প্রতিফলিত, আজকাল ভালো লেখার বড় অভাব! আসলে তিনিই যে সবচেয়ে অভাবী,দরিদ্র, একথা কাকে বোঝানো যাবে?
ঠিক একই কথা বাচিকশিল্পীদের ক্ষেত্রে খাটে,তাঁরা এখনও মান্ধাতার আমলে পড়ে আছেন,তিনি এখনও গলার শিরা ফুলিয়ে এবং হস্তসঞ্চালনপূর্বক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম এবং সুকান্তে আওড়ে চলেছেন।তাঁরা অবশ্য অনেক খুঁজে খুঁজে সুনীলের নির্বাসন,শক্তির অবনী বাড়ি আছো? জয় গোস্বামীর মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয় আর সুবোধের শাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছেন,তারপর? তারপর? তারপর সবই অঙ্কে যত শূন্য পেলে!
না, না, মোটেই আমরা বলছি না,যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত-সুকুমার পড়বেন না,আবৃত্তি করবেন না,বরং এঁদের সৃষ্টি না পড়লে,যেকোনো সাহিত্যের লাজ অসম্পূর্ণ, তা তো সত্য। কিন্তু তার পাশে নতুন জমিও সন্ধানের চোখ,কণ্ঠ এবং হস্তসঞ্চালন রাখুন,তাহলে আকাশটা বড় হবে,আপনিও…
কিন্তু তা হচ্ছে না!
ফলে নবীন প্রতিভা শেষ পর্যন্ত সেই এলেবেলে আস্তাকুঁড়ে ভবিষ্যতের বীজধান হয়ে শুয়ে থাকে!

তিন
এরপর প্রকাশক!
এঁরা এক আশ্চর্য আকাশ! বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান ধারার ধারক ও বাহক!
যাঁরা পড়েন কম, প্রকাশ করেন বেশি!তার থেকেও ব্যবসায় আবেগ খাটান আরও আরও বেশি!
আমি বই ব্যবসায়ে নেমেছি,ব্যবসাকেই প্রধান করে দেখব,একদম সঠিক।তাই তাঁদের বই প্রকাশ করে চলেন,যাঁদের বাজার তৈরি আছে।
এবং যাঁরা বাজার তৈরি করে দিতে পারবেন!
এবং তাঁদের, যাদের হাতে নিজস্ব বাজার আছে!
ফলে প্রকাশকগণ নিজে খেটে, নিজে হেঁটে প্রতিভার সন্ধান বন্ধ করে রেখেছেন!
কিন্তু এতে একদিন দেখা যাবে সাহিত্যের মৃত রথী-মহারথী ছাড়া কোনো জীবিত প্রতিভার বই প্রকাশের সুযোগ পাওয়া যাবে না!
চলুক,এইভাবে চলুক…
কিন্তু তাঁরা এটা কি বোঝেন,যদি সত্যিকারের সন্ধানী চোখ দিয়ে নবীন নবীন প্রতিভা তুলে ধরে বাজারে রাখার চেষ্টা করি,তাদের মধ্যে কেউ না কেউ পাঠকসমাজ পাবেন,ফলে আবার নতুন করে বাজার তৈরি হবে!
কিন্তু সেই ঝুঁকি নিতে এঁরা আগ্রহী নয়! ফলে সাহিত্যের আকাশ,শুধু লেখার নয়, প্রকাশেরও ছোট হতে হতে সমুদ্র থেকে গর্ত হয়ে যাবে!
এবং একদিন কলেজ স্ট্রিট না গিয়েও বলে দেওয়া যাবে,ওখানে কী বই বিকোয় এবং কী বই শুকোয়!

এই সবের ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
কিন্তু তা এতো যৎসামান্য যে,আকাশটাকে কিছুতেই বড় করতে পারছে না! বরং সেই সব ব্যতিক্রমীদের এমনভাবে বাধা-বিপত্তির বেড়াজালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের নাভিশ্বাস আকাশ পর্যন্ত ওঠে না!

সুপ্রিয় সচেতন পাঠক,
এই কথাগুলো চোখ চারিয়ে,হৃদয় মিশিয়ে এবং বোধ পিষিয়ে রচিত।এ-র সঙ্গে আপনি একমত হতে পারেন আবার নাও হতেন পারেন!
আপনি কমেন্ট করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন!
সেটা সম্পূর্ণ আপনার মনন এলাকা।
কিন্তু এই আলোচনা পাঠের পর কথককে অকারণে ও অযৌক্তিক নেতিবাচক এবং সূচীশিল্পে বিদ্ধ না করিয়া কীভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নস্যাত করা যায়,তাই লিখুন…
আপনার মতামতের জন্য তো ফেসবুকে পোস্ট করা…

ওহ্ হ্যাঁ,ফেসবুক।
জয় ফেসবুকস্বতী।

যার কেউ নেই, তার ফেসবুক আছে।
এবং তাই বোধহয় হলদিয়া টু হাওড়া,কলকাতা টু কাঠমান্ডু,ঢাকা টু কাশ্মীর,নিউইয়র্ক টু নদের গঞ্জ পর্যন্ত আকাশটা বেঁচেবর্তে আছে!

Share This
Categories
প্রবন্ধ

পল্লীপ্রেমী কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক।

ভূমিকা—-

বাংলার রবীন্দ্রযুগে স্বনামধন্য পল্লীপ্রেমী কবি ও শিক্ষাবিদ কবি ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক।গ্রাম বাংলার সহজ-সরল জীবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর কবিতায় প্রধান বিষয়। আজও তাঁর কবিতায় সৃষ্ট প্রাকৃতিক রূপ, রস, অনুভূতি, বাংলা সাহিত্যের পরোতে পরোতে তাকে চিরঞ্জীবী করে রেখেছে। অজয় নদ, কুনুর নদীর স্রোত তাঁর উপস্থিতি অনুভব করায়। তার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- “কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাংলার গ্রামের  তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।”  পেশায় তিনি ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অন্যতম ছাত্র। ‘উজানী’, ‘অজয়’, ‘তূণীর’, ‘স্বর্ণসন্ধ্যা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।

জন্ম ও বংশ পরিচয়—

১৮৮৩ সালের ১ লা মার্চ  অবিভক্ত বাংলার  পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামে (বর্তমানে কুমুদগ্রাম) মাতুলালয়ে  জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখন্ড গ্রামে৷ পিতা পূর্ণচন্দ্র মল্লিক ছিলেন কাশ্মীর রাজসরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মাতা ছিলেন সুরেশকুমারী দেবী। তাঁদের পূর্বপুরুষ বাংলার নবাবের থেকে মল্লিক উপাধি লাভ করেন। তাদের পদবী সেন শর্মা বা সেনগুপ্ত।

শিক্ষা জীবন—

ছাত্র হিসাবে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। কুমুদরঞ্জন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে এফ.এ. এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন ও বঙ্কিমচন্দ্র সুবর্ণপদক প্রাপ্ত হন।

কর্মজীবন—-

তিনি বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন।

কবি প্রতিভা—-

কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ বাল্যকাল থেকেই ঘটে।নদী ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন কবি কুমুদ রঞ্জন। কবির গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে অজয় ও কুনুর নদী। এই গ্রাম আর নদীই হল কবির মুখ্য প্রেরণা। কবিতায় নির্জন গ্রামজীবনের সহজ-সরল রূপ তথা নিঃস্বর্গ প্রেম চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লী-প্রিয়তার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবনা যুক্ত হয়ে তার কবিতার ভাব ও ভাষাকে স্নিগ্ধতা ও মাধুর্য দান করেছে। ধর্ম নিয়ে লিখলেও ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না।  ‘কপিঞ্জল’ ছদ্মনামে তিনি চুন ও কালি নামে ব্যঙ্গকাব্য রচনা করেন।

পল্লীকবির উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলঃ— পল্লীকবির রচিত একাধিক কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি ও গ্রাম্য পরিবেশে সৌন্দর্যের বর্ণনা। শিশু বয়সে বেশীরভাগ মানুষই পড়েছে কবি রচিত কবিতা-

চুন ও কালি (১৯১৬), বীণা (১৯১৬), বনমল্লিকা (১৯১৮), শতদল (১৯০৬ – ০৭), বনতুলসী (১৯১১), উজানী (১৯১১), একতারা (১৯১৪), বীথি (১৯১৫), কাব্যনাট্য  দ্বারাবতী (১৯২০), রজনীগন্ধা (১৯২১), নূপুর (১৯২২), অজয় (১৯২৭), তূণীর (১৯২৮), স্বর্ণসন্ধ্যা (১৯৪৮)। তার অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি হল ‘গরলের নৈবেদ্য’। এটি সোমনাথ মন্দির সম্পর্কিত ১০৮ টি কবিতার সংকলন হিসাবে প্রকাশ।

সম্মাননা—

কবি হিসেবে তিনি সম্মানিত হয়েছেন সর্বত্র। কুমুদরঞ্জন বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান সাহিত্যতীর্থের ‘তীর্থপতি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ দিয়ে সম্মান জানায়।১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ২১ এপ্রিল ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে।

মৃত্যু—-

১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সমস্ত সাহিত্য কবিতা অনুরাগী মানুষকে গভীর শোকের নিমজ্জিত করে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ও আমরা বাঙালী : প্রশান্ত কুমার দাস।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী –দিনটিকে আমরা বাঙালীরা ভুলতে পারিনা। বাঙালির কাছে এ এক স্মরণীয় দিন । ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিন বাংলাদেশে ‘শহীদ দিবস’ রূপে পালিত হয় আর ২০০০ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী “আর্ন্তজাতিক মাতৃদিবস” হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
আমাদের মাতৃভাষা- বাংলাভাষা-যে ভাষায় নিতাই- গোরা সারা দেশে ভক্তিস্তোত্র বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- যে ভাষাতে রবীন্দ্রনাথ,বঙ্কিমচন্দ্র,মধুসূদন,শরৎচন্দ্র বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন – এই ভাষাতেই বিদ্রোহি কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রক্ত-ঝরা কবিতা লিখে ব্রিটিশ শক্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন – এই ভাষাতেই ‘হরিবোল’ গাইতে গাইতে আমরা ভবসাগর পার হয়ে যায়।
এই ভাষাতেই আমরা বাঙালীরা বড় হয়েছি, কথা বলেছি, গান গেয়েছি এবং আজও বেঁচে আছি।
কিন্তু এই মাতৃভাষা দিবসটা সিক্ত হয়ে রয়েছে অনেক সন্তানহারা-মায়ের অশ্রুজলে- তাই ভুলতে পারছিনা ছেলে- হারা-মায়ের অশ্রুতে গড়া একুশে ফেব্রুয়ারীর কথা। কারন এই দিনটিতে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কয়েকশ বাঙালী ভাইয়ের রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছিল- এদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের নাম প্রকাশ্যে আসে-তারা হলেন আব্দুল সালাম, বরকত জব্বর,আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও শফিউর।
সেই রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি আজও মুছে যাইনি এবং শত শত বছর পরেও মুছে যাবেনা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো কিন্তু দ্বিখন্ডিত হয়ে – একটি ভারত যুক্তরাষ্ট্র অপরটি পাকিস্তান রাষ্ট্র ।তবে পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত রূপে- পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান । পাকিস্তানে যেমন উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলো তেমনি বাংলাদেশেও(পূর্ব পাকিস্তানে) ঊর্দুকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো। তারা ঊর্দূভাষার ডাকটিকিট প্রকাশ করলো, ফর্মে ও খামে এবং সমস্ত ধরনের সাইনবোর্ডে ঊর্দূকে স্থান দিল।
কিন্তু বাংলার জনৈক মুসলিম ভাই মহঃ শহীদুল্লা উচ্চকণ্ঠে জানালেন –“আমরা যেমন মুসলমান সত্য, তেমনি আমারা বাঙালী”। অতএব বাংলাকেই আমাদের দেশে মর্যাদা দিতে হবে।“১৯৪৮ সালে আলিজিন্না জানালেন – পাকিস্তানে উর্দূই হবে রাষ্ট্রভাষা“। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনও জানিয়ে দিলেন- এদেশে উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
কিন্তু বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা এই দাবীকে অগ্রাহ্য করলো এবং ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারে ঘোষিত ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে মিছিল নিয়ে এগিয়ে চললো বীর বিক্রমে।কিন্তু সরকার নৃশংসভাবে জনতার উপর গুলি চালালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে – যেখানে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো কতশত তরুন তরতাজা যুবক। কয়েক শত হতাহত তরুণ প্রান-রক্তে লাল হয়ে উঠলো ঢাকার রাজপথ । বেশির ভাগ শহীদ হওয়া রক্তাক্ত দেহকে হাপিস করে দেওয়া হলো।
কিন্তু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন থামলো না, বরং আরও তীব্রতর হলো পৃথিবীর ব্যাপী বিভিন্ন প্রান্তে । শেষকালে ১৯৯৮ সালে ২৯ শে মার্চ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কফি আন্নানের হাতে একটি আবেদন পত্র এসে পৌঁছালো।এই আবেদন পত্রে লেখা হয়েছিল – “পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে।“ সেই আবেদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের কথা এবং পাঁচ জন তরুনের শহীদ হওয়ার কথা। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে সকল রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখ মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। তারপরে২০০০সালের ২১শে ফ্রেবুয়ারী প্রথম আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালিত হয়।
আজও আমরা প্রতিবছর এই দিনটিকে স্মরণ করে সেই মৃত্যুহীন প্রাণ শহীদের প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই – কবিরা নতুন নতুন গান সৃষ্টি করেন, পত্রিকায়,ম্যাগাজিনে এই দিনের তাৎপর্য নিয়ে লেখা হয়, বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠান এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে।
দুই বাংলার বাঙালিরা ভাষার আকর্ষনে এক অভিনব মিলন সেতু তৈরী করে। কলকাতার বইমেলায় দেখা যায় বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকদের ,গড়ে ওঠে বাংলাভাষীদের মৈত্রী – হিন্দু মুসলিম পৃথক সত্ত্বা ভুলে যায় – বাঙালির ভাষার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে ঐক্যতান।
কিন্তু এত কিছুর পরেও একটা বেদনা মনের মধ্যে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে কি আর বাংলা ভাষার কদর থাকবে ? দেখা যাচ্ছে ,বাংলা ভাষা বাঙালিদের কাছে ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে। সম্পন্ন ঘরের ছেলে মেয়েরা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে যাচ্ছে, বাবা-মা ছেলে মেয়েদের ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে গর্ববোধ করছেন। অনেকে বলেন – আমার ছেলে বেশ ভাল ইংরাজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু বাংলাটা ঠিক আসে না তাই পড়তে চায় না। আবার কেউ কেউ বাংলা ভাষা না জানাটাই গর্বের বস্তু বলে মনে করেন। শহরে এমনকি গ্রামেগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠছে। সেখানে অনেক অনেক বেশি খরচ করে অভিভাবকগণ ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করছেন শুধুমাত্র ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবার জন্য।
আমি জানি ইংরাজি ভাষা একটা আর্ন্তজাতিক ভাষা এই ভাষাতে দক্ষতা অর্জন করা অতি অবশ্যই প্রয়োজন, এমনকি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতেও আমদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করা একদম উচিত নয়।
তাছাড়া আমাদের রাজ্যে এখনও ব্যাঙ্কে,পোষ্ট অফিসে বা সরকারী অফিসের সব ধরনের ফর্মগুলি ইংরাজি ভাষায় লিখিত। ইংরাজি নববর্ষে আমরা Happy New Year বলতে অভ্যস্ত । আমাদের কোনো অফিসে দরখাস্ত পাঠাতে হলে ইংরাজি ভাষায় লিখতে হবে। সুতরাং আমাদের বাংলার দৈন্যতার জন্য আমরাই দায়ী।
আজ আমরা যারা বাংলাকে ভালবাসি তাদের উচিত ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশের শহীদদের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানানো তেমনি আমাদের মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ বাংলাভাষাকে নতুন করে ভালোবাসা জানানো । আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে বাংলা কবিতার বই ,গল্পের বই, ঠাকুরমার ঝুলি প্রভৃতি উপহার হিসাবে তুলে দেব।কারন বাংলা ভাষাই হচ্ছে বাঙালির আশা ভরসা। বাংলা ভাষা যদি অবলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আর বাঙালির অস্ত্বিত্ব থাকবে না।
এজন্য আজ সমস্ত বাঙালিকেই সজাগ থাকতে হবে, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আর একটা কথা আমাদের জানা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির শহীদ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে- তবুও এই দিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সকল ভাষা ভাষীর মানুষ নিজ নিজ ভাষাকে ভালোবাসবে, নিজের নিজের ভাষার উন্নতির চেষ্টা করবে।সাঁওতালরা তাদের সাঁওতালী ভাষাকে প্রাধান্য দিবে, নেপালীরা তাদের নেপালী ভাষার জন্য গর্ববোধ করবে, উড়িয়ারা তাদের উড়িয়া ভাষাকে উন্নততর করার চেষ্টা করবে – এমনি করে প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজের ভাষাকে মাতৃদুগ্ধ মনে করবে। তবেই ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটি উদযাপন করা সার্থকমন্ডিত হয়ে উঠবে।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ভাষা দিবসের তাৎপর্য – একটি সমীক্ষা :: দিলীপ রায়।

মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বোধের উন্মেষ । মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে । শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমন গুরুত্ব । মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে । মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয় । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব । মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি । কারণ, এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না। মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ সম্ভব ।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে । নিজেদের ভাষাকে উন্নত ও কার্যকরী করেই বিশ্বের জাতিসমূহ উন্নত ও অগ্রসর হতে পেরেছে ।
উনিশ শতকের ভারতীয় চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় রাজনারায়ণ বসু (০৭.০৯.১৮২৬ — ১৮.০৯.১৮৯৯) বলেছেন “জননীর স্তনদুগ্ধ যদ্রুপ অন্য সকল দুগ্ধ অপেক্ষা বল বৃদ্ধি করে, তদ্রূপ জন্মভূমির ভাষা অন্য সকল ভাষা অপেক্ষা মনের বীর্য প্রকাশ করে ।”
মাতৃভাষা হল মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রকৃত প্রকাশ মাধ্যম । তার জিয়নকাঠির স্পর্শেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা তাঁর জীবনস্মৃতিতে লেখা ) হয়, বোধের গভীরে চিন্তার বুদবুদ কারার দ্বার ভেঙে বাইরে এসে বাক‌্মূর্তি ধারণ করে । আর অন্যদিকে শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ । মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না । তাই সেই অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তস্থলের আবেগের যোগ থাকা একান্ত আবশ্যক । সেকারণে শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের । প্রাণের ভাষা ও প্রাণের জ্ঞান একত্রিত হলে তবেই একজন সার্থক মানুষরূপে পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে । একটা শিশুর মাতৃভাষা হলো তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ । মাতৃভাষা ‘সফলভাবে কাজ ও কথা বলার সামাজিক ধরনকে’ প্রতিফলন ঘটাতে সাহাযা করে ।
তাই মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মুল তাৎপর্য হলো মাতৃভাষা নিয়ে সচেতন হওয়া ও বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা । বাঙালিদের মতে, মায়ের মুখের ভাষাই হলো জীবন, ভাষাই হলো স্বাধীনতা ।
আবার সংস্কৃতির একটি অংশ ভাষা । তবে এ ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক । ইউনেস্কোর সম্মেলনে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে বলা হয় – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার । মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে । সুতরাং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলো প্রতিটি মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনো ভাষার উপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা । এদিবসে প্রত্যেক ভাষাভাষি মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালবাসবে তেমনি অন্যজাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে । সুতরাং বলা যায়, একুশকে ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ ।
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন । একটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত । বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ।
এবারে আসছি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে । ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে । প্রথমে ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয় । ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানে উর্দু হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা (Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan) । এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেন নি । ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । এর প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল করে । মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে । মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন । ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সাথে সাথে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় । এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র যুব হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হস্টেলে সমবেত হন । নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে । ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর রাখার জন্য ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে উঠে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি । ১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলা ভাষা প্রচলণ বিল” পাশ হয় । যা কার্যকর হয় ৮ই মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় । এতে তরতাজা ছাত্র-যুবকেরা হতাহত হন । সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে । ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিলো ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ । লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ । তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে উঠে ঃ
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লেখেন । যেমন –
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি “একুশের গান” শিরোনামে প্রকাশিত হয় । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ যিনি সেসময়কার একজন নামকরা সুরকার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন । ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরিতে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিলো । পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে । ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরীতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।
এবার আসছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রসঙ্গে । কানাডার ভ্যাঙকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুল সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতি সংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আননের কাছে ১৯৯৮ সালে । সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসাবে কর্মরত হাসান ফিরদৌসের নজরে এই চিঠিটি আসে । তিনি ১৯৯৮ সালের ২০শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন । পরে রফিক আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান । এতে একজন ইংরেজভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন । তারা আবার কফি আননকে “এ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন । ১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সাথে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন । আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫টি দেশ — কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে । ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতি সংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে । ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশন মোতাবেক এখন থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ । সুতরাং ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন হয়ে আসছে ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক । ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের স্মরণে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের গণআন্দোলনের প্রতীক, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুমহানস্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতীর পিতা (বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্ত্বা থাকবে শহীদদের আমরা ভুলতে পারবো না । আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না । এ বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়” ।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাদিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন । এ সময় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।
পরিশেষে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো । মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা । বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারকে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো । সারা বিশ্বে বাঙালী জাতির কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন । তাই ২১ আমাদের গর্ব, ২১ আমাদের অহংকার । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই চেতনাকে সবার মধ্যে সঞ্জীবিত করার মধ্যেই নিহিত আছে এই মহান দিবসের সার্থকতা ।
প্রসঙ্গত, আমরা স্মরণ করতে পারি কবি অতুল প্রসাদ সেনের লেখা ঃ—-
মোদের গরব, মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা !
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা !
কি যাদু বাংলা গানে ! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো !
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা ।
আজ এই পুণ্যদিনে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
————————–0—————————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী (৭৪১২৩৫), ভারত

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

স্বামী বিবেকানন্দ — আজও প্রাসঙ্গিক ::: দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।।।

স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার । তিনি ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের একমাত্র শিষ্য । তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নত করে বিবেকানন্দ সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন । স্বামী বিবেকানন্দ জীবপ্রেমের দীক্ষা পান শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন ‘যত্র জীব, তত্র শিব’। জীবের সেবা করলে স্রষ্টারও সেবা করা হয় । স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ । সবার আগে মানব সেবা । সুতরাং মানুষের সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সেবা করা সম্ভব। জীবপ্রেমের দর্শন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর দুটি চমৎকার লাইনেঃ
“বহুরুপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবপ্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর ।“
তাই আমরা কেউ বিবেকানন্দকে পরিপূর্ণভাবে বুঝিনি । কারণ তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব । তিনি প্রচুর বই পড়তেন । দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, ইত্যাদি বিষয়ে । তা ছাড়া তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল বেদ, উপনিষদ, ভাগবতগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, প্রভূতি হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে । যার জন্য সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ব, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ছিলো গভীর ব্যুৎপত্তি । তাই তিনি নিজেই বলেছেন, “বিবেকানন্দকে বুঝতে হলে আরেক বিবেকানন্দকে দরকার” । কর্মী বিবেকানন্দ, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, গুরু বিবেকানন্দ, শিষ্য বিবেকানন্দ, জ্ঞানী বিবেকানন্দ, যোগী বিবেকানন্দ, কবি বিবেকানন্দ সবই বাহ্য । কারণ এই সমস্ত গুণেই তিনি শীর্ষস্থানের অধিকারী হলেও তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, ‘ভালোবাসায় ভরা হৃদয় বিবেকানন্দ’ ।
বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের “শিব জ্ঞানে জীব সেবা” মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন । তাই তিনি মানুষের কল্যাণ সাধনকেই প্রকৃত ঈশ্বর সাধনা বলে মনে করেছিলেন ।
বিবেকানন্দ ছিলেন মানব প্রেমিক সন্ন্যাসী । মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়কেই সমানভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন । তাঁর মতে “ধর্ম”” মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বকে ফোটাবে । বিজ্ঞান মানুষকে সুখ ও সমৃদ্ধি উপহার দেবে । শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ প্রথমে আত্মবিশ্বাসী হবে । আর আত্মবিশ্বাস থেকে আসবে আত্মনির্ভরশীলতা । বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষাই সমাজের সকল সমস্যা দূরীকরণের মূল চাবি কাঠি । শিক্ষার আলো মানুষের মনের অন্ধকারকে দূর করে এবং মানুষকে স্বনির্ভর করতে সাহায্য করে । বিবেকানন্দের শিক্ষা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যেই ছিল সমাজে যথার্থ “মানুষ” তৈরি করা –যাতে চরিত্র গঠিত হয়, মনের শক্তি বাড়ে । বুদ্ধি বিকশিত হয়, মানুষ নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে শেখে । উপরন্ত বিবেকানন্দের শিক্ষা ছিল সার্বজনীন । তিনি চেয়েছিলেন বিশেষভাবে যুব সমাজের নবচেতনার অভ্যুদয় । নিষ্ঠা, সততা ও আত্মনির্ভরতা ছিল তাঁর আরাধ্য । এসব গুণ জগতের সব সমাজের সব মানুষেরই সম্পদ ।
( ২ )
এখানে বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য – বিবেকানন্দ যেভাবে ভারতবর্ষকে চিনেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন, অন্য কোনো ব্যক্তি ঠিক সেভাবে ভারতবর্ষকে অনুভব করতে পারেননি । পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করে বিবেকানন্দ ধন্য মনে করেছিলেন । ভগিনী নিবেদিতার ভাষায়, “তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ – রক্তমাংসে গড়া ভারত প্রতিমা ।“ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রোমাঁ রোলাঁকে (ফরাসী সাহিত্যিক) বলেছিলেন, “যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও বিবেকানন্দকে জানো । বিবেকানন্দের লেখা আগে পড়ো । “
বিবেকানন্দ সহজে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবকে গুরু মানেননি । প্রথমদিকে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে গুরু বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন । এমনকি তাঁর চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন । অথচ উল্টে তিনি রামকৃষ্ণ দেবের ব্যক্তিত্বের কাছে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন । যার জন্য ঘনঘন তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন । ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য নরেন্দ্রনাথ সেইসময় মূর্তিপূজা, বহুদেববাদ, রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কালী পুজা সমর্থন করতেন না । এমনকি অদ্বৈত বেদান্তমতবাদকেও তিনি ঈশ্বরদ্রোহিতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিতেন । নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে পরীক্ষা করতেন । রামকৃষ্ণ দেবও শান্তভাবে তার যুক্তি শুনে বলতেন, “সত্যকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করবি ।“
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে । চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে প্রথমে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর ও পরে কাশীপুরের একটি বাগান বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয় । সেখানেই নরেন্দ্র নাথের ধর্ম শিক্ষা চলতে থাকে । কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন । তারপর রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে সন্ন্যাস ও গৈরিক বস্ত্র লাভ করেন । রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নরেন্দ্রনাথকে শিক্ষা দেন “মানব সেবাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সাধনা” । এরপর ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট শেষ রাত্রে কাশীপুরেই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব প্রয়াত হন । ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নরেন্দ্রনাথের গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুরে আমন্ত্রণ জানান । সেখানেই তাঁরা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতো জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেন । তখন নরেন্দ্রনাথ “স্বামী বিবেকানন্দ” নাম গ্রহণ করেন ।
এরপরে পরিব্রাজকরূপে তাঁকে আমরা কী দেখলাম । ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিব্রাজকরূপে মঠ ত্যাগ করেন বিবেকানন্দ । পরিব্রাজক হিন্দু সন্ন্যাসীর এক ধর্মীয় জীবন — এই জীবনে তিনি স্বাধীনভাবে পর্যটন করে বেড়ান কোনো স্থায়ী বাসস্থান ও বন্ধন ছাড়াই । পরিব্রাজক জীবনে বিবেকানন্দের সঙ্গী ছল একটি কমন্ডলু, লাঠি এবং তাঁর প্রিয় দুটি গ্রন্থ –ভাগবদ্গীতা ও ইশানুসরণ । বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত হন । এই সময় ভিক্ষোপজীবী হয়ে সারা ভারত পদব্রজেই পর্যটন করেন বিবেকানন্দ । সেইজন্য বিবেকানন্দকে সারা বিশ্বের মানুষ “পরিব্রাজক” হিসেবে জানে । ভারতবর্ষ পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন পণ্ডিত, দেওয়ান, রাজা এবং হিন্দু-মুসলমান, খ্রিষ্টান এমনকি নিম্নবর্গীয় ও সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গেও মেলামেশা ও একসঙ্গে বাস করেন ।
( ৩ )
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বারাণসী থেকে যাত্রা শুরু করেন । তখন সাক্ষাৎ হয় বিশিষ্ট বাঙালী লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও বিশিষ্ট সন্ত ত্রৈলঙ্গস্বামীর সাথে । বৃন্দাবন, হথরাস ও হৃষীকেশে ভ্রমণের সময় হথরাসে তাঁর সঙ্গে স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্তের সাক্ষাত হয় । তিনি পরে বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সদানন্দ নামে পরিচিত হন । তিনি ছিলেন বিবেকানন্দের প্রথম যুগের শিষ্য । ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে আবার নৈনিতাল, আলমোড়া, দেরাদুন, ঋষীকেশ, হরিদ্বার এবং হিমালয় ভ্রমণে যান । তারপর রওনা দেন দিল্লি । এইভাবে পশ্চিম ভারত, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ সারেন ।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩০শে জুন থেকে ১৪ই জুলাই শিকাগো যাওয়ার পথে বিবেকানন্দ জাপান ভ্রমণ করেন । তিনি ঘুরে দেখেছিলেন কোবে, ওসাকা, কিওটো, টোকিও আর য়োকোহামা শহর । ১০ই জুলাই ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে য়োকোহামার ওরিয়েন্টাল হোটেল থেকে তাঁর ভক্ত মাদ্রাজের আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দ জানিয়েছিলেন জাপান নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা । তিনি জাপানীদের “পৃথিবীর সবচেয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জনগণের অন্যতম” বলে অভিহিত করেছিলেন । তারপর চিন, কানাডা হয়ে তিনি শিকাগো শহরে পৌঁছান ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে । কিন্তু শিকাগো শহরে পৌঁছে মূলত দুটি সমস্যায় পড়েন । মহাসভা শুরু হতে দেড় মাস বাকী । অন্যটা কোনো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসাপত্র বা পরিচয়পত্র ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বধর্ম মহাসভায় গ্রহণ করা হবে না । তারপর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সংস্পর্শে এলেন । তাঁকে হার্ভার্ডে আমন্ত্রণ জানানোর পর এবং ধর্মসভায় বক্তব্যদানে বিবেকানন্দের প্রশংসাপত্র না থাকা প্রসঙ্গে রাইটের বক্তব্য, “আপনার কাছে প্রশংসাপত্র চাওয়াটা হচ্ছে স্বর্গে সূর্যের আলো দেওয়ার অধিকার চাওয়ার মতো অবস্থা ।“ রাইট তখন প্রতিনিধিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিকট এক চিঠিতে লিখলেন, “আমাদের সকল অধ্যাপক একত্রে যতটা শিক্ষিত ইনি তাঁদের থেকেও বেশী শিক্ষিত ।“
বিশ্বধর্ম মহাসভা ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হয় । তিনি ভারত এবং হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন । পাশ্চাত্যে অভিযানের নিরিখে যেসব অভিজ্ঞতা, তাতে শিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় সনাতন ও বেদান্তের উপর ভাষণ দেওয়া ভীষন তাৎপর্যপূর্ণ । তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন, “আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগিনীগণ …।“ — সম্ভাষন করে । তাঁর বক্তব্যে সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গ ওঠে । গীতা থেকে উদাহরণমূলক পংক্তি তুলে ধরেন । তাঁর বক্তব্যে বিশ্বজনীন চেতনা ধ্বনিত হয় ।
প্রেসের কাছে তিনি “ভারতের সাইক্লোন সন্ন্যাসী” হিসেবে অভিহিত হন । “নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক” লিখেছিল “ঐশ্বরিক অধিকারবলে তিনি একজন বক্তা এবং তাঁর শক্তিশালী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার চেয়ে বরং আগ্রহোদ্দিপক ছিল ঐ সকল ছন্দময়ভাবে উচ্চারিত শব্দসমূহ ।“ আমেরিকার পত্রিকাসমূহ বিবেকানন্দকে “ধর্মসভার সবচেয়ে মহান ব্যক্তিত্ব” হিসেবে প্রতিবেদন লিখেছিল । পরবর্তীতে শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত ভারতে ফিরে এসে লিখেছিলেন, “গেরুয়াধারী কম বয়স্ক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন মঞ্চে বিবেকানন্দ ছিলেন সূর্যের মতো তেজস্বী এক পুরুষ ।“
তারপর ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর আমেরিকা ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ শেষে ইংল্যান্ড থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । তারপর ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারী কলম্বো তিনি পৌঁছান ।
( ৪ )
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বিবেকানন্দের সদর্থক ভূমিকা । রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত সুভাষ চন্দ্র বসু । সেই বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ছিলেন “আধুনিক ভারতের স্রষ্টা ।“ জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনার প্রতি তিনি ছিলেন সতত সংবেদনশীল । সুতরাং বিবেকানন্দের স্বদেশমন্ত্র দেশ স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । বলা চলে বিবেকানন্দ স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন । যার জন্য মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “বিবেকানন্দের রচনা তাঁর “দেশপ্রেম হাজারগুণ” বৃদ্ধি করেছিল ।“ যখন পরাধীন ভারতবাসী আত্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, তখন বিবেকানন্দ চেয়েছেন মানুষের আত্মশক্তির বিকাশ । তাই তিনি বলেছেন, “তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারি, পবিত্র ও পূর্ণ । তুমি নিজেকে দুর্বল বলো কী করে ? ওঠো, সাহসী হও, বীর্যবান হও ।“
স্বদেশমন্ত্রে তিনি বলেছেন, হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা … এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করবে ? এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে ? হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী । ভুলিও না, তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর । ভুলিও না, তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের —নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে । ভুলিও না, তুমি জন্ম হতেই “মায়ের” জন্য বলিপ্রদত্ত । ভুলিও না, নীচজাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই । হে বীর, সাহস অবলম্বন করো, সদর্পে বলো —- আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই । বলো, মুর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই । সদর্পে বলো, ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী । বলো ভাই, ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ । ভারতের কল্যান, আমার কল্যান । “
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ই জুলায় রাত ৯.১০ মিনিটে ধ্যানরত অবস্থায় দেহত্যাগ করেন । তাঁকে বেলুড়ে গঙ্গা নদীর তীরে একটি চন্দন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতার উপর দাহ করা হয় । যার বিপরীত পাশে ষোলো বছর আগে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মরদেহ দাহ করা হয়েছিল ।
আজ তাঁর শুভ জন্মদিন (জন্মঃ ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩) । তাঁর শুভ জন্মদিনে আমার শতকোটি প্রণাম ।
———–০————–

Share This
Categories
উপন্যাস প্রবন্ধ

ভাষা দিবস নিয়ে কিছু কথা : দিলীপ রায় (+৯১৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বোধের উন্মেষ । মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে । শিশু যখন মাতৃভাষায় পড়া ও লেখা শুরু করে, তখন থেকে ভাষার মাধ্যমে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জানা ও বোঝার ক্ষমতার পাশাপাশি আরও অনেকগুলি সক্ষমতা বা দক্ষতা তৈরী হতে থাকে । বিশেষ করে, যুক্তি-বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা । যাকে বলে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ । শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার তেমন গুরুত্ব । মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে । মাতৃভূমির মতো মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয় । মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব । মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি । কারণ এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না । মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ সম্ভব ।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে । আমরা জানি, শিক্ষা হলো মানব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ । মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না । তাই শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের । একটা শিশুর মাতৃভাষা হলো তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ । মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য প্রসঙ্গে ইউনেস্কোর মতে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মুল তাৎপর্য হলো মাতৃভাষা নিয়ে সচেতন হওয়া ও বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বজায় রাখা । ইউনেস্কোর সম্মেলনে, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে বলা হয় – সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার । মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে ।
তাই ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সহ সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন । একটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সুপরিচিত । বাঙালী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন ।
( ২ )
এবারে আসছি ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে । ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে । প্রথমে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের কথায় আসা যাক । ভাষা আন্দোলনকারীর প্রবীণদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত । তিনি ছিলেন সেই সময়কার পাকিস্তান গণপরিষদয়ের সদস্য । ১৯৪৮ সালের ২৫শে আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে বাংলাকে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি উত্থাপন করেন । এখানে উল্লেখ থাকে যে, ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিটিং, মিছিল, পিকেটিং আন্দোলন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তরুন রাজনীতিবিদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তারপর ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত প্রসঙ্গে আরও জানা যায় — তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারী দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে ৫৬শতাংশের বেশী মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে । এমনকি শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানে ৯৫ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে । সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আপনারা উর্দু ভাষাকে অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দিতে পারেন না । আপনারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিন ।“ কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন । শুধু তাই নয়, ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের উপর “এডবো” (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়োগ করেন । যার জন্য তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন । ১৯৭১ সালে ২৯শে মার্চ রাতে ছেলে দিলীপ কুমার দত্ত সহ গ্রেপ্তার হন । ময়নামতি সেনানিবাসে থাকাকালীন তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন হয় এবং তারপরে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । তাই তাঁকে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত নামে সকলে চেনে । আর মাতৃভাষার প্রথম দাবিদার এই শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ।
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন সমগ্র পাকিস্তানে উর্দু হবে রাষ্ট্রীয় ভাষা (Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan) । এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেননি । ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । এর প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে । কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল করে । মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে । মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন । ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সাথে সাথে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় । এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম সহ কয়েকজন ছাত্র যুব হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্দ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হস্টেলে সমবেত হন । নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে । ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর রাখার জন্য ২৩শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গড়ে উঠে একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয় । ১৯৫২ সালে ভাষা অন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে । ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি । ১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে “বাংলা ভাষা প্রচলণ বিল” পাশ হয় । যা কার্যকর হয় ৮ই মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় । এতে তরতাজা ছাত্র-যুবকেরা হতাহত হন । সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে । ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিলো ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ । লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তার নিজের ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ । তৎক্ষণাত তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন
জেগে উঠেঃ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ।
( ৩ )
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতি সংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে । ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশন মোতাবেক এখন থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে জাতিসংঘ । সুতরাং ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন হয়ে আসছে ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক । ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের স্মরণে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের গণআন্দোলনের প্রতীক, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুমহানস্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতীর পিতা (বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙালির সত্ত্বা থাকবে শহীদদের আমরা ভুলতে পারবো না । আমরা কোনোক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না । এ বিজয় সাত কোটি বাঙালির বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়” ।
পরিশেষে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো । মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা । বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে দেশের সেবা করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো । সারা বিশ্বে বাঙালী জাতির কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন । তাই ২১ আমাদের গর্ব, ২১ আমাদের অহংকার ।
আজ এই পুণ্যদিনে মহান ভাষা শহীদদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
————————–0—————————
এ১০ক্স/৩৪, কল্যাণী / মো-৯৪৩৩৪৬২৮৫৪

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন , জগন্নাথের প্রসাদ আস্বাদন করার সময় মহাপ্রভুর কী হয়েছিল? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

একদিন মহাপ্রভু গেছেন শ্রীজগন্নাথ দর্শন করতে, সিংহদ্বারে দ্বারপাল তাঁকে দেখেই এগিয়ে এসে চরণবন্দনা করলেন । অমনই মহাপ্রভু , “কোথায় আমার কৃষ্ণ ? আমার প্রাণনাথ কোথায় গো? তুমি আমার সখা ; আমায় দেখাও সখা ,আমার প্রাণনাথকে ।”—-বলে অনুনয় করার মত দ্বারপালের হাতখানা জড়িয়ে ধরলেন। দ্বারপাল বললেন, “আমি দর্শন করাচ্ছি আপনাকে , চলুন ।” শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর হাত ধরে মন্দিরের জগমোহনে নিয়ে গেলেন দ্বারপাল। আর তারপর , শ্রীপুরুষোত্তমকে দেখিয়ে বললেন, “ঐ যে তিনি ! আপনার প্রাণনাথ।”

গরুর স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করতেন মহাপ্রভু । তিনি কখনোই গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে জগন্নাথ দর্শন করতেন না । প্রতিদিনের মত আজও দ্বারপাল নিয়ে তাঁকে গরুর স্তম্ভের পিছনে বাঁ দিকটায়(গরুড়ের বাম দিক) দাঁড় করালেন এবং সেখান থেকেই মহাপ্রভু দু’নয়ন মেলে জগন্নাথকে দর্শন করলেন । জগন্নাথ আজ এখন মুরলীবদন শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ধরা দিলেন মহাপ্রভুর নেত্রে । —-এই লীলার কথা রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাঁর ‘শ্রীচৈতন্যস্তবকল্পবৃক্ষ’ গ্রন্থের সপ্তম শ্লোকে প্রকাশ করেছেন।

“ক্ক মে কান্তঃ কৃষ্ণস্ত্বরিতমিহ তং লোকয়
সখে ! ত্বমবেতি দ্বারাধিপমভিবদন্নুন্মদ ইব।।
দ্রুতং গচ্ছ দ্রস্টুং প্রিয়মিতি তদুক্তেন
ধৃততদ্ভুতজান্তর্গৌরাঙ্গো হৃদয় উদয়ন্মাং মদয়তি ।।”

এমন সময় গোপালবল্লভ ভোগ লাগলো জগন্নাথের । ভোগের পর শঙ্খ , ঘন্টা আদি সহ আরতি হল । ভোগ সরলে জগন্নাথের সেবকগণ প্রসাদ নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে এলেন। তাঁকে প্রসাদী মালা পরিয়ে প্রসাদ হাতে দিলেন। সেই প্রসাদের আঘ্রাণ নিলেন মহাপ্রভু আর বললেন, “বহুমূল্য প্রসাদ ! এ যে সর্বোত্তম বস্তু !” এর অল্প নিয়ে তিনি জিহ্বায় দিলেন আর বাকিটা সেবক গোবিন্দ দাস আঁচলে বেঁধে নিলেন। সেই কণিকা মাত্র প্রসাদের অমৃতাস্বাদ করে প্রভুর মনে যেন চমৎকার হলো, সর্বাঙ্গে পুলক তাঁর । আর নেত্র থেকে অশ্রুধারা বইতে থাকলো। তিনি আপন মনে বিস্মিত হয়ে বললেন , “এই দ্রব্যে এত স্বাদ কোথা থেকে এলো ! ওহ্‌, এতে তো কৃষ্ণের অধরামৃত সঞ্চারিত হয়েছে ! তাই বুঝি এই বস্তু এত মধুময় হয়েছে স্বাদে !”—- এ কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মধ্যে প্রেমাবেশ হলো । কিন্তু পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সম্বরণ করে নিলেন জগন্নাথের সেবকরা তাঁর সামনে আসায় ।

মহাপ্রভু বারবার ‘সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত’ বলতে থাকলেন। জগন্নাথের সেবক মহাপ্রভুর মুখে এই শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রভু , সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে কি? অর্থ কি এর ?” তখন মহাপ্রভু বললেন , “এই যে তুমি আমায় কৃষ্ণের অধরামৃত দিলে ,এই বস্তু ব্রহ্মা আদি দেবতাদেরও দুর্লভ এবং অমৃতের স্বাদকেও নিন্দনীয় হতে হয় এর কাছে। শ্রীকৃষ্ণের ভুক্তাবশেষের নামই হল ফেলা । তিনি ভাগ্যবান যিনি ফেলামৃত লব মাত্র পান । সামান্য ভাগ্য যার সে এই বস্তু প্রাপ্ত হতে পারে না। যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ কৃপা তিনি তা পান। আর, তিনিই সুকৃতীবান যাঁর প্রতি শ্রীকৃষ্ণের কৃপা থাকে । অর্থাৎ সুকৃতিলভ্য ফেলামৃত মানে হল যাঁর সুকৃতি লাভ হয় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ হয় তিনিই ফেলা রূপ অমৃত লাভ করতে পারেন ; শ্রীকৃষ্ণের অধরামৃত আস্বাদনের অধিকারী হন।”— এই বলে মহাপ্রভু সকলকে বিদায় দিলেন । তারপর জগন্নাথের উপলভোগ দর্শন করে গম্ভীরায় ফিরে এলেন।

মধ্যাহ্নকালে ভিক্ষা নির্বাহণ করলেন মহাপ্রভু । কিন্তু অন্তরে কৃষ্ণ-অধরামৃতের স্বাদ সর্বদা স্মরণ হচ্ছে তাঁর। বাইরে কর্ম করছেন অথচ অন্তরে প্রেমে গরগর মন হয়ে আছে। সেই সঘন আবেশ অত্যন্ত কষ্ট করে সম্বরণ করছেন তিনি। সন্ধ্যা বেলায় যখন পুনরায় নিজের পার্ষদগণের সাথে বসে কৃষ্ণকথা রঙ্গে নিভৃতে কাল কাটাচ্ছেন , তখন সেবক গোবিন্দ দাসকে ইঙ্গিত দিলেন দুপুরের সেই আঁচলে বেঁধে রাখা প্রসাদ এখন আনার জন্য । পুরী-ভারতী তথা তাঁর গণের সন্ন্যাসীদের জন্য কিছুটা পাঠিয়ে দেওয়া হলো , আর সেখানে উপস্থিত রামানন্দ রায় , সার্বভৌম ভট্টাচার্য , স্বরূপ দামোদর ও অন্যান্যদের সেই প্রসাদ বিতরণ করা হলো। প্রসাদের সৌরভ-মাধুর্য আস্বাদন করেই সকলে বিস্মিত হলেন । যে প্রসাদ এমন দিব্য সৌরভ সম্পন্ন , সেই প্রসাদের স্বাদ না জানি কেমন অলৌকিক হবে ! তখন মহাপ্রভু বললেন , “দ্যাখো, প্রসাদে যা যা আছে যেমন ধরো আখের গুড় , কর্পূর, মরিচ, এলাচ , লবঙ্গ,কাবাবচিনি, দারুচিনি এইগুলো সব প্রাকৃত দ্রব্য। তোমরা সকলেই এই সব প্রাকৃত দ্রব্যগুলোর স্বাদ, সুগন্ধ কেমন জানো । কিন্তু এই প্রসাদে তাহলে এত আমোদ কোথা থেকে এলো? প্রসাদের এই সৌরভ —এতো লোকাতীত ! এর আস্বাদন তাহলে কত না দিব্য ! আস্বাদ করে দেখ সকলের মনে প্রতীত হবে তাহলে। আস্বাদন তো অনেক পরের কথা , কেবল গন্ধেই মন মাতিয়ে দেয়। তাই না ! প্রসাদের এমন মাধুর্য যে আস্বাদন সময়ে আস্বাদন ব্যতীত অন্য সকল কিছু বিস্মৃত করিয়ে দেয় । কেন? কারণ , শ্রীকৃষ্ণের অধর স্পর্শ করেছে এই প্রসাদ। তাঁর অধর রসের গুণ সব সঞ্চারিত হয়েছে প্রসাদে, তাইতো অলৌকিক সুগন্ধ মাধুর্য হয়েছে এমন ! মহাভক্তি করে সকলে প্রসাদ আস্বাদ করো।”
সকলে হরিধ্বনি দিয়ে প্রসাদ আস্বাদন করলেন এবং আস্বাদন মাত্রই সকলের মন প্রেমে মত্ত হল। মহাপ্রভুর মধ্যে প্রেমাবেশ সে সময় । তিনি আজ্ঞা দিলেন রামানন্দ রায় কে শ্লোক পাঠ করতে। রামানন্দ রায় শ্রীমদ্‌ ভাগবতের শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।

“সুরতবর্দ্ধনং শোক নাশনং , স্বরিতবেণুনা সুষ্ঠচুম্বিতম্ ।
ইতররাগবিস্মারণং নৃণাং, বিতর বীর নস্তেহধরামৃতম্ ।।”
(শ্রীমদ্ ভাগবত, ১০, ৩১, ১৪ শ্লোক)

—– শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসমন্ডল থেকে অকস্মাৎ অন্তর্ধান হয়ে যান, শোকাকুলা গোপীরা বিলাপ করে বলছেন তখন— হে বীর ! তোমার সেই সুরতবর্ধনকারী (সম্ভোগেচ্ছা ক্রমশঃ বর্ধনকারী) অধরের সুধা যা তোমার বিরহ জনিত শোক রাশিকে নাশ করে তা আমাদেরকে বিতরণ কর । তোমার অধরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বেণু পঞ্চম সুরে নাদিত হয়ে মানবের সকল আসক্তি ভুলিয়ে দেয় ; সেই অধরের অমৃত আমাদের দাও।

সেই শ্লোক শ্রবণ করে রসরাজ-মহাভাবের মিলিত স্বরূপ মহাপ্রভু তখন ভাবাবিষ্ট হয়ে রাধার উৎকণ্ঠা জনিত একটি শ্লোক উচ্চারণ করলেন ।

“ব্রজাতুলকুলাঙ্গনেতর রসালি তৃষ্ণাহরঃ ,
প্রদীব্যদধরামৃতঃ সুকৃতিলভ্য ফেললাবঃ।
সুধাজিদহিবল্লিকাসুদলবীটিকাচর্বিতঃ,
স মে মদনমোহনঃ সখি তনোতি জিহ্বাস্পৃহাম্।।”
(গোবিন্দলীলামৃত, ৮, ৮শ্লোক)

—- শ্রীমতী রাধিকা তাঁর সখী বিশাখাকে বলছেন, হে সখি ! অনন্যা ব্রজকুলবতী ললনাদের যিনি অধরামৃত দ্বারা আনন্দ দান করে তাঁদের অন্য সকল রস-তৃষ্ণাকে হরণ করেন , যাঁর চর্বিত তাম্বুলে অমৃতাপেক্ষা অধিক স্বাদ—-সেই শ্রীমদনমোহন আমার জিহ্বার স্পৃহাকে বিস্তৃতি দান করেছেন।

তারপর মহাপ্রভু নিজেই দুই শ্লোকের অর্থ প্রলাপের মত উচ্চারণ করে গেলেন । সকলে শ্রবণ করে ভাবের ভিয়ানে বিহ্বল হলেন। গ্রন্থ– মহাপ্রভুর মধুময় কথা , লেখিকা —- রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক, প্রকাশক–তথাগত।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

জানুন পীলু ফল নিয়ে মহাপ্রভুর আনন্দময় কাহিনী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীজগদানন্দ পন্ডিত বৃন্দাবন ভ্রমণ করে নীলাচলে মহাপ্রভুর কাছে ফিরে যাচ্ছেন । শ্রীসনাতন গোস্বামী তাই তাঁর হাত দিয়ে মহাপ্রভুর জন্য কিছু ভেট বস্তু অর্থাৎ উপহার সামগ্রী পাঠালেন । কী কী সেই উপহার ? — রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা , শুষ্ক পাকা পীলু ফল আর গুঞ্জামালা । জগদানন্দ পন্ডিত ফিরে যেতেই সনাতনের মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। এতদিন তো মহাপ্রভুর অতি কাছের একজন মানুষ, প্রিয় পরিকর বা দূত যাই বলি না কেন তিনি ছিলেন সনাতনের কাছে। জগদানন্দের সঙ্গ পেয়ে সনাতনের মনে হতো যেন মহাপ্রভুর আবেশ উপলব্ধি করছেন । যেমনটা হয় আর কী ! প্রিয়জনের কাছের কাউকে পেলেও মনে এক অদ্ভুত প্রেম ভাব জাগে , ভালো লাগে—তেমন আর কী ! আজ জগদানন্দ চলে যেতে সনাতনের মন তাই কেঁদে উঠলো মহাপ্রভুর জন্য। দ্বাদশ আদিত্য টিলার উপর একটি মঠ পেয়ে , সে স্থান সংস্কার করে চালা বেঁধে রেখে দিলেন তিনি, যাতে ব্রজে এসে মহাপ্রভু সেখানে বাস করতে পারেন নিরালায় ।

ওদিকে জগদানন্দ পথে একটুও দেরী না করে খুব শীঘ্র চলে এলেন নীলাচলে । তাঁর যে আর তর সইছে না মহাপ্রভুকে দু’চোখ ভরে দেখার জন্য। নীলাচলে মহাপ্রভু সহ আর সব ভক্তদের পেয়ে তাঁর মনে পরম আনন্দ হল । প্রভুর চরণ বন্দনা করে সকলের সাথে আলিঙ্গন করলেন। মহাপ্রভুও তাঁকে দৃঢ় আলিঙ্গন দিলেন । ব্রজ থেকে ফেরত এসেছে যে প্রাণপ্রিয় বাল্যবান্ধব জগদানন্দ ! তাই। এরপর জগদানন্দ সেই সমস্ত ভেট তথা উপহার সামগ্রী মহাপ্রভুর শ্রীহস্তে তুলে দিলেন, যা-যা সনাতন প্রেরণ করেছিলেন মহাপ্রভুর জন্য ।

রাসস্থলীর বালু , গোবর্দ্ধনের শিলা আর গুঞ্জামালা নিজের কাছে রেখে মহাপ্রভু পীলু ফলগুলি তখনই সকলের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বললেন । ভক্তরা বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফল দেখেননি। গৌড়দেশে পীলুফল হয়ও না। বৃন্দাবন থেকে এসেছে যে ফল সে ফল না জানি কত ভালো , কত সুস্বাদু, কত অমৃতসম মিষ্টি হয়তো বা ! তাই তো সনাতন পাঠিয়েছেন পীলু ফল ! তাই না ! একারণে সকলের মধ্যেই মহা আগ্রহ পীলু ফল খাবার । সকলে মহা আনন্দের সাথে পীলু ফল হাতে নিলেন খাবেন বলে।

যাঁরা জানেন তাঁরা পীলু ফল নিয়ে চুষতে থাকলেন আর যাঁরা জানেন না বিশেষতঃ গৌড়ীয়ারা পীলু ফলে কামড় বসিয়ে চিবোতে শুরু করে দিলেন। আর যে মুহূর্তে চিবোলেন অমনি তাঁদের মুখের ছাল উঠে গেল, জিহ্বা প্রচন্ড জ্বালা করতে থাকলো । আসলে পিলু ফল এমনই হয় ,চিবিয়ে খেতে নেই ,চুষে খেতে হয় । চিবোলেই মুখ জ্বলে যায় । স্বাভাবিক ভাবেই পীলু ফলকে কেন্দ্র করে তখন সেখানে এক মহা রগড় হলো মহাপ্রভু ও ভক্তদের মধ্যে।

“সনাতন প্রভুকে কিছু ভেট বস্তু দিলা ।।
রাসস্থলীর বালু আর গোবর্ধনের শিলা ।
শুষ্ক পক্ক পীলু ফল আর গুঞ্জামালা ।।
জগদানন্দ পণ্ডিত চলিলা সব লইয়া।
*************************************
*************************************
*************************************
সনাতনের নামে পন্ডিত দণ্ডবৎ কৈল।
রাসস্থলীর বালু আদি সব ভেট দিল ।।
সব দ্রব্য রাখি পীলু দিলেন বাঁটিয়া ।
বৃন্দাবনের ফল বলি খাইল হৃষ্ট হইয়া।।
যে কেহ জানে সে আঁটি চুষিতে লাগিল ।
যে না জানে গৌড়ীয়া পীলু চিবাইয়া খাইল।।
মুখে তার ছাল গেল জিহবা করে জ্বালা ।
বৃন্দাবনের পীলু খাইতে এই এক লীলা।।”
(চৈ।চ। অন্ত্য,১৩)

Share This