Categories
উপন্যাস

কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ, তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ রায়।

কঙ্কাবতীর মাথায় হাত ! বৃহস্পতিবারদিন সাধারণত বিক্রিবাট্টা কম । গেরস্তের বাড়ি থেকে নগদ টাকা বের করা নাকি সংসারের অমঙ্গল । চিরাচরিত ধ্যানধারণার সংস্কার এখনও  গাঁয়ের দিকে বিদ্যমান । গাঁয়ের মানুষের কথা ভেবে কঙ্গাবতী যদিও বৃহস্পতিবার বাজার থেকে সব্জীও কম তোলে । সকাল আটটায় বেরিয়ে তিনটি গ্রাম ঘোরা হয়ে গেলো । কিন্তু বিক্রির  হালহকিকৎ দেখে কঙ্কাবতী হতাশ ! অগত্যা ভর দুপুরে বিরক্তমুখে বাড়ি ফিরলো । বাড়ি ফিরে দেখে, বড় মেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে । তার চোখ দুটি ছলছল !
তানিশাকে তানিশার নিজের ইচ্ছামতো অনেক আগেই বিয়ে দিতে হয়েছিল কঙ্কাবতীকে । তানিশা তখন সাগরের প্রেমে বিহ্বল । তাই তাকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না কঙ্কাবতীর । ফলে নিজের মতের বিরূদ্ধে গিয়ে সাগরের সাথে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ।  এই মুহুর্তে তানিশাকে দেখে কঙ্কাবতী রীতিমতো উদ্বিগ্ন।   
মাকে দেখে তানিশার কান্না  শুরু হলো । তার কী কান্না ! তানিশার কান্না থামানো দায় হয়ে দাঁড়ালো ! কঙ্কাবতী যতবার কান্না থামিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইছে, ততবার তানিশার কান্নার ঊর্ধ্বগতি বাড়ছে । 

শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকে কান্না থামানোর জন্য ধমক দিলো কঙ্কাবতী ।  
শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছলো তানিশা । তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল ।  তাকে দেখেই কঙ্কাবতীর মনে হচ্ছে, তার বড় মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । মুখটা শুকনো । মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন খায়নি । মাথার চুল উসকো-খুসকো । চেহারার করুণ দশা । অবিন্যস্ত বেশভূষা । এত সুন্দর দেখতে তার মেয়েগুলি, অথচ তানিশাকে দেখলে মনে হবে সে কঙ্কাবতীর পেটের মেয়ে নয় । অনেক কষ্টে তার কান্না থেমেছে বটে, কিন্তু তখনও তানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । মুখ দিয়ে তার কথা বের হচ্ছে না । কঙ্কাবতীর চোখ গরমের জন্য তানিশা  সোজা হয়ে দাঁড়ালো । পিঠের কাপড় সরিয়ে মাকে দেখতে ইশারা করল । কঙ্কাবতী তানিশার পেছনের  পিঠ দেখে বিস্ময়ে হতবাক ! সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কাবতীর মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, “তোকে এভাবে কে পেটালো ?”
   এতক্ষণ পর তানিশার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে কথা বের হলো, “তোমার গুণধর জামাই !”    
   কঙ্কাবতী ভীষণ রেগে গিয়ে উল্টে তানিশার উপর চোটপাট ! বুদ্ধুর মতো লাঠির ঠ্যাঙানি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে  বাপের  বাড়ি ফিরে এলি । একবারও ভাবলি না, তোকে শ্বশুর বাড়ির লোক অন্যায়ভাবে মেরেছে । সুতরাং এর একটা বিহিত হওয়া দরকার । তুই স্পটে যতটা মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারতিস, এখন সেটা অনেক কমে যাবে । কিছু করতে না পারলে অন্তত ফোঁস করতে পারতিস । তা না করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এলি । এটা একটা মুর্খতার পরিচয়  ! তোর হারাবার কিছু ছিল না । সব হারিয়ে তুই বাড়ির দিকে পা রাখছিস, সুতরাং তোকে অন্তত তাদের বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হত “তোর একটা আত্মসম্মান আছে” । সেই আত্মসম্মানে তারা আঘাত করেছে । সুতরাং  শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সহজে ছেড়ে দেবে না । আহাম্মকের মতো লাঠির প্রহার খেয়ে পালিয়ে এলি । তারা তোকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল  । দুটো লাঠির ঘা’য়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল । আমার পেটের মেয়ে হয়ে এই শিক্ষা মায়ের কাছ থেকে কী পেয়েছিস ? দেশে কী আইন-প্রশাসন নেই । থানায় গিয়ে নালিশ জানাতে তোকে কে বাধা দিয়েছিল ? সেগুলি না করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোজা পলায়ন ! এটা তোমার একদম ঠিক হয়নি । বিয়েটা করেছিলে নিজের পছন্দ মতো । বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ঐ পাষণ্ড ছেলেটার সুমিষ্ট কথা শুনে গলে গিয়িছিলি । খোঁজ খবর নিয়ে আমি এমনও বলেছিলাম, ছেলেটা  বখাটে ! কিচ্ছু কাজকর্ম করে না । তা ছাড়া ছেলেটার স্বভাব চরিত্র ভাল না । বিয়ের পরে ছেলেটাকে তার বাবা-মায়ের  উপর  নির্ভর করতে হবে ।“ তুই আমার কথা শুনলি না । উল্টে মাকে সন্দেহ করলি, “আমি নাকি তোদের সম্পর্কটাকে সন্দেহ করছি ?”
 তখন তোর বিয়ের জন্য তর সইছিল না । আমি ঢিলা দিয়ে তোর বাবাকে ফাগুনডাঙায় পাঠিয়েছিলাম, সাগরদের বাড়ির খোঁজখবর নিতে । তোর বাবা ফাগুনডাঙা গাঁয়ের আশেপাশের মানুষের সঙ্গে খোঁজখবর নিয়ে বলেছিল, “সাগর ছেলেটার সাথে  বিয়ে হলে মেয়েটা সুখী হতে পারবে না ।“  সাগরের নৈতিক চরিত্র নাকি খুব খারাপ । তা ছাড়া উপার্জনের জায়গাটা নেই । কাজকর্ম কিচ্ছু করে না । সাগরদের পরিবারের ব্যাপারে  তোর বাবার উষ্মার কথা তোকে জানাতে পারিনি,  পাছে তুই অসন্তুষ্ট হস্‌ ।  বিয়ের সময় দাবী-দাওয়ার লম্বা লিষ্ট, যেটা  কোনোরকমে ম্যানেজ করেছিলাম । বিয়ের পরেও সাগরের দাবীমতো পঞ্চাশ হাজার টাকা গোপনে পৌঁছে দিয়েছিলাম তোর সুখের কথা ভেবে । 
   প্রিয় ভালবাসার মানুষটি লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো । অথচ তার বিরূদ্ধে একটা কথাও বললি না । সুতরাং এই অবস্থায় আমার বাড়িতে বসে অসহায়ের মতো কাঁদলে হবে না । এক্ষুণি আমার সাথে তোকে যেতে হবে !
 কোথায় যাবো ? আমি কিন্তু ঐ লম্পটদের বাড়ি আর যেতে চাই না ।
  সেকথা বললে হবে না মা । সমস্যা সৃষ্টির মূলে তুমি । সুতরাং  সমস্যা মোকাবিলা তোমাকেই করতে হবে । আমি কিন্তু সাগরকে অত সহজে  ছেড়ে দেবো না । আমার মেয়েকে যে বা যারা তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের আমি যতক্ষণ উচিত শিক্ষা দিতে না পারছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই । আমার নাম কঙ্কাবতী । কঙ্কাবতী কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না । অন্যায়ের সঙ্গে আপোশ করা আমার ধাতে নেই । আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সুতরাং তাদের সারাজীবন মেয়েকে  ভরণপোষন দিতে হবে । নতুবা আমি আইনের দ্বারস্থ হব । দেশ থেকে এখনও আইন শৃঙ্খলা উঠে যায়নি । প্রয়োজন হলে আমি আইনি সাহায্য নেবো ।  
  সাগরদের বাড়ি পড়েছে  বলরামপুর থানার অধীনে । থানায় ছুটলো কঙ্কাবতী ।  সঙ্গে অনিন্দ । বড়বাবু  থানায় উপস্থিত ছিলেন । কঙ্কাবতী বড়বাবুর চেম্বারে সোজা ঢুকে গেলো  ।
 “স্যার, আমার মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি থেকে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে ।“  কঙ্কাবতী কথাগুলি বলেই মেয়ের পিঠের কাপড় সরিয়ে এবং ব্লাউজের হুক খুলে বড়বাবুকে মারের  আঘাতের চিহ্নগুলো দেখালো । আঘাতের চিহ্নগুলি দেখিয়ে চোখ লাল করে বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, এটা কী সুস্থ মানবিকতার লক্ষণ ?”
  বড়বাবু ঐ দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না । তাই অস্বস্তিবোধ করছিলেন । তিনি  মৃদু স্বরে কঙ্কাবতীকে আপত্তি করে বললেন, “প্লীজ আপনারা বসুন । আমাদের মহিলা পুলিশ আধিকারিক চেম্বারে ঢুকলে তাঁর সামনে ক্ষত চিহ্নগুলি দেখাবেন ।“ বড়বাবু উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে মহিলা পুলিশ চেম্বারে ঢুকলেন । তাঁকে ইঙ্গিত করে বললেন, “ম্যাডামের ঘটনাটা নোট করুন ।“
  “উঁহু স্যার ! ঘটনাটা নোট করলে হবে না । এফ-আই-আর নিতে হবে ।“ কঙ্কাবতী বড়বাবুকে অনুরোধ করলো ।
  “আপনি কাদের বিরুদ্ধে এফ-আই-আর করতে চান ?”  মহিলা পুলিশ আধিকারিক জানতে চাইলেন ।
   “মেয়ের স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ।“ 
    গৃহবধূ নিগ্রহের ঘটনাটা শুনে বড়বাবু দৃশ্যত ক্ষুব্ধ । যার জন্য তিনি মহিলা পুলিশ আধিকারিককে নির্দেশ দিলেন, “এফ-আই-আর হয়ে গেলে আপনি ও মেজবাবু আমার সঙ্গে মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি চলুন । এই জাতীয় ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা সত্বর করা আশুকর্তব্য । অমানবিক কী ভয়ঙ্কর নিগ্রহ, দেখলেন ম্যাডাম ! অল্প বয়সের বৌকে কীভাবে মেরেছে । পিঠের দাগগুলি দেখে মনে হচ্ছে বাঁশ দিয়ে বলদ গরুকে ঠাঙাবার মতো ।“ মহিলা পুলিশ আধিকারিক মাথা নেড়ে বড়বাবুর কথার সম্মতি জানালেন ।
  “সাগরবাবু, বাড়ি আছেন ?” বড়বাবু কঙ্কাবতীর জামাইকে ডাকলেন । 
  বাড়িতে পুলিশ দেখে সাগর ভয় পেয়ে গেলো । বিপদ আসন্ন ভেবে  পুলিশ দেখা মাত্র সাগর বাড়ির পেছন দিয়ে উধাও । শ্বশুর মশাই পুলিশের হ্যাপার খপ্পড় থেকে দূরে থাকতে তিনিও বাড়ি থেকে উধাও । শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বড়বাবু নিশ্চিত, শ্বশুর বাড়ির লোকজন তানিশাকে অমানুষিকভাবে মেরে তাড়িয়েছে  । সাগর ও তানিশার শ্বশুরকে সত্বর থানায় দেখা করতে শাশুড়িকে নির্দেশ দিয়ে  বড়বাবু থানায় ফিরে গেলেন । 
  কঙ্কাবতী মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ।  
  বড়বাবু রাতে হঠাৎ হানা দিয়ে সাগরকে না পেয়ে তার বাবাকে বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করলেন । তারপর সোজা থানার লক আপে । থানার বড়বাবুর ধারণা, বাবাকে ধরলেই ছেলে ধরা দিতে বাধ্য । পালিয়ে বেশীদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে না । পুলিশের বক্তব্য, “কান টানলে মাথা আসবেই ।“ 
 অ্যারেস্ট করার আগে সাগরের বাবা থানার বড়বাবুকে চেপে ধরলেন, “আমাকে অ্যারেস্ট করার অপরাধ ?”
  “ছেলের বৌকে নিগ্রহ এবং তাকে ‘অ্যাটেম্প টু মার্ডার’ করার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল ।“     
    এর প্রমাণ কী ?
   অভিযোগকারী আপনার বৌমা, তানিশা । সাক্ষী দিয়েছেন কঙ্কাবতী ও আপনাদের গাঁয়ের মাতবর সুফল তরফদার । 
   মায়ের কাছে সমস্ত ঘটনা  শোনার পর ঘোতন রেগে আগুন ! তার বড় বোন তানিশাকে মেরে পিঠে রক্ত বের করে দিয়ে কিনা প্রমাণ চাইছে ? নিজের মনে স্বগতোক্তি করে ক্রদ্ধ স্বরে বলল, “এবার সাগরকে গণধোলাই না দিতে পারলে তার শান্তি নেই ।“ ঘোতন সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে সাগরের ঠিক হদিস পেলো  । তাকে খুঁজে বার করলো । কলার চেপে ঘর থেকে বের করে রাতের অন্ধকারে বেদম প্রহার । রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ঘোতন বলল, “তানিশাকে মেরেছিস, এবার তোকে কে বাঁচাবে  ?” তারপর ভ্যানে চাপিয়ে তার হাত পা বেঁধে থানায় পৌঁছে বড়বাবুর চেম্বারের সামনে রেখে ঘোতন উধাও । সাগরকে কে মেরেছে তার কোনো প্রমাণ রইল না ।  ঘোতন এইভাবে বড় বোনের মার খাওয়ার বদলা নিলো ।   
 জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাগর অল্প বয়সের একটি মেয়েকে আবার বিয়ে করলো । 
   বড় মেয়েটা বাড়িতে থাকার কারণে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, সব জায়গায় কঙ্কাবতী উত্তর দেয় তার চারটি মেয়ে । চারটি মেয়েই বড়, ডাগর-ডোগর ।     
  অন্যদিকে তানিশার কঙ্কাবতীর বাড়িতে স্বাভাবিক জীবন যাপন । কঙ্কাবতীর নির্দেশমতো  টেলারিং শিখতে লাগল তানিশা । এইজন্য সপ্তাহে তিনদিন বহরমপুরে যেতে হচ্ছে তানিশাকে । এক বছরের কোর্স ।  তবে একবছরের মধ্যে কোনো বড় টেলারিং দোকানে তাকে হাতে কলমে এক মাস শিখতে হবে । টেলারিং কাজটা তানিশার খুব মনে ধরেছে । কাজটা তার ভাল লাগে । তাই খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটা শিখছে তানিশা ।  কঙ্কাবতীর বক্তব্য, কাজটা শিখলে তানিশা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে । বাবা-মা  সারাজীবন বাঁচবে না । সুতরাং জীবনে চলার পথে অসুবিধা ঘটলে উপার্জনের জন্য চিন্তা থাকবে না । এক মুঠো ভাতের ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবে । 
  মিঁয়া হল্ট স্টেশন বাজারে একটা ঘরের সন্ধান পেলো কঙ্কাবতী । ছোট্ট একফালি জায়গার উপরে ছোট্ট একটি ঘর । যার পান-বিড়ির দোকান ছিল, তিনি তার একমাত্র  মেয়ের কাছে জলপাইগুড়ি চলে গেছে ।  স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন  । যার জন্য জায়গাটা খুব অল্প দামে পাওয়া গেলো ।     গুমটি কুঠুরি বটে, কিন্তু বাজারের মাঝখানে । যারজন্য তানিশার টেলারিং সকলের নজরে পড়বে এবং তার টেলারিং ব্যবসা ভাল চলবে । কঙ্কাবতীর দূরদর্শিতা ভীষণ গঠনমূলক । যার জন্য  মেয়েদের স্বাবলম্বী করার দিকে কঙ্কাবতীর ঝোঁক  । 
   তানিশার  বহরমপুরের টেলারিং কোর্স শেষ । সেই কারণে তানিশার টেলারিং ব্যবসা খোলার উদ্যোগ নিলো কঙ্কাবতী । সত্বর দোকানটা খোলার একটাই কারণ, সামনে দুর্গা পুজা । দুর্গা পুজার মার্কেট ধরতে মরিয়া কঙ্কাবতী । ধার-দেনা করে একটা সেলাই মেশিন কিনলো । শুভ জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার দিন দোকান উদ্বোধন করার মনস্থির করলো । সেই মতো গুমটি ঘরটি সাজালো । উদ্বোধনের দিন নিয়ামতপুর ব্লকের বি-ডি-ও ম্যাডামকে উপস্থিত থাকতে নিমন্ত্রণ জানালো কঙ্কাবতী । ম্যাডাম কথা দিলেন, রথের দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন । 
    কঙ্কাবতীর বিপদ পদে পদে । রথের আগের রাত্রিতে দোকান ঘর সাজানো শেষ । তানিশা ও কঙ্কাবতী দোকানের সাটার বন্ধ করে বাইরেটা ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজালো । বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা দোকান ঘর সাজানোর তারিফ করলেন । তারপর তারা বাড়ি ফিরে খেতে বসেছে, এমন সময় তাদের দোকানের উল্টোদিকে মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের  ভম্বলের টেলিফোন, “তোমাদের দোকানের বাইরের সাজানো ফুল ছিঁড়ে ফেলছে । শিগ্‌গির না এলে সাটার ভাঙতে পারে ।“ 
  “কারা ফুল ছিঁড়ছে, তাদের চিনতে পারলি ?” জানতে চাইল কঙ্কাবতী । 
  “না । গামছা দিয়ে তাদের মুখ ঢাকা ।“ মনু ময়রার মিষ্টির দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারী ভম্বল জানালো । 
   ঘোতন শুনতে পেয়ে খাওয়া ফেলে ছুটলো দুর্বৃত্তদের ধরতে । ঘোতন পৌঁছানোর আগে তারা পালিয়েছে । কিন্তু ঘোতন হাল ছাড়বার পাত্র নয় । ভম্বলের কাছে জানতে পারলো তারা সংখ্যায় তিনজন এবং সাইকেলে তারা পূর্ব দিক দিয়ে পালিয়েছে । ঘোতনের অনুমান তারা বেশীদূরে পালাতে পারেনি । যেদিক দিয়ে পালিয়েছে সেইদিকে মনু ময়রার মোটর বাইক নিয়ে ছুটলো ঘোতন । বাবলা নদীর কিনারের রাস্তা দিয়ে তারা তখন প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল ছোটাচ্ছে ! ঘোতন মোটর বাইক নিয়ে তিনজনের সামনে দাঁড়ালো । দুর্বৃত্তরা তখন মারমুখী । প্রচণ্ড আক্রোশে ঘোতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । ঘোতন তেজী জওয়ান । নিমেষের মধ্যে তিনজনকে ঘায়েল করে ফেললো । তিনটিই তখন রাস্তার উপর গড়াগড়ি ।  তারপর দুর্বৃত্তদের কাছে  ঘোতনের প্রশ্ন, “দোকান ঘর কেন ভাঙলি ?” কিন্তু কিছুতেই উত্তর দিতে চাইছে না । তাদের মুখে কুলুপ আঁটা ।  ঘোতন জানে, কীভাবে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে হয় । একজন দুর্বৃত্তের বুকের পা রেখে বলল, এবার না বললে একে একে তিনটিকেই জাহান্নামে পাঠাবো । ততক্ষণে ভম্বল ও তানিশার মেজ বোন মনীষা স্পটে হাজির । অবস্থা বেগতিক বুঝে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হল, “তাদের পাঠিয়েছিল সাগর !”  ঘোতনের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার । রাগ মেটাতে তানিশার টেলারিং  দোকান খোলা বানচাল করার ধান্দা  !  
  ঘোতন এবার দুর্বৃত্তদের কড়া ভাষায় বলল,”ভাল চাস্‌ তো দোকান ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনি করে সাজিয়ে আয় । নতুবা তোদের সাগরের মৃত্যু আমার হাতে !”
  পরেরদিন সকাল দশটায় ব্লক আধিকারিকের উপস্থিতিতে তানিশার টেলারিংয়ের দোকান উদ্বোধন হয়ে গেলো ।  মিঁয়াগ্রাম বাজারে এই প্রথম মেয়েদের টেলারিং দোকান । যার জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো  । কঙ্কাবতী খুশী, কেননা বড় মেয়ের অন্তত নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা হিল্লে হল । 
                 ************************ 
    গাঁয়ের কাকু ষষ্টীকমলকে নিয়ে কঙ্কাবতী পড়েছে মহা ফাঁপরে । মনীষা জানিয়েছিল, বিপাশা নাকি রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় ষষ্টীকমলকাকুর বাসায় যায় এবং সেখানে কিছু সময় দাদুর সাথে কাটায় ।  বিপাশার দাদু অর্থাৎ ষষ্টীকমল বিপাশাকে খুব ভালবাসে । গেলেই লজেন্স, চকলেট এবং আরও ভাল ভাল লোভনীয় খাবার খাওয়ায় । দশ মিনিট মতো দাদুর সঙ্গে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে । এটা নাকি এখন বিপাশার নিত্য রুটিন । কঙ্কাবতীর এতে কোনো আপত্তি ছিল না । ষষ্টীকমলকে  কঙ্কাবতী অনেক আগে থেকেই কাকু সম্বোধনে ডাকে । তেমনি কাকু কঙ্কাবতীর  পারিবারের এবং  ব্যবসার খোঁজখবর নেয় । গাঁয়ের একজন বয়স্ক মানুষ তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছে,  এতে কঙ্কাবতী খুশী । কেননা গাঁয়ে অনেক মানুষের বসবাস, অথচ  ঘুণাক্ষরেও তাঁরা কঙ্কাবতীদের দিকে ফিরেও তাকায় না । সেই নিরিখে ষষ্টীকমলকাকা তাদের পরিবারের একজন হিতাকাক্ষী মানুষ । তাই তাঁকে কঙ্কাবতী শ্রদ্ধা করে । তা ছাড়া তাঁর একমাত্র ছেলে ও বৌ দুইজনেই খুব শিক্ষিত । ছেলেটা সরকারি উচ্চপদে চাকুরিরত  এবং বৌমা রেলওয়েতে কর্মরত । দুইজনেরই শহরে পোস্টিং । খুব সকালে তারা অফিসে বেরিয়ে যায়, আর ফেরে রাত্রিতে । ষষ্টীকমলকাকুর একটাই মেয়ে । তার বিয়ে হয়ে গেছে । মেয়ে জামাই থাকে বেনারসে । ষষ্টীকমলকাকুর গিন্নি আবার বছরের বেশীর ভাগ সময় মেয়ের কাছে থাকে । কারণ মেয়ের সন্তানকে  দেখাশোনা করতে হয় । জামাই বড় মাপের ডাক্তার । মেয়ে সরকারি দপ্তরে আধিকারিক । দায়িত্বপূর্ণ কাজ । ফলে সেখানে কাকীমাকে বাচ্চা আগলাবার জন্য থাকতে হচ্ছে । তাই ছোট মেয়ের কাকুর বাড়ি যাওয়া-আসায় কঙ্কাবতীর  আপত্তি নেই  । 

 কিন্তু মনীষা খবর দিলো, বিপাশা আজকাল ষষ্টীকমলকাকুর বাড়ি বেশী সময় কাটাচ্ছে । এটা চোখে লাগছে । দাদুর সাথে এমন কী কথা,  যার জন্য বিপাশাকে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট কাটাতে হচ্ছে । এটা মনীষার ভাল লাগছে না । তাই মনীষা মাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলেছে ছোট বোনটার দাদু-প্রীতি কমাতে ।
 ষষ্টীকমলকাকু ভাল সরকারি চাকরি করতেন । শোনা গেছে তিনি প্রচণ্ড ঘুষ খেতেন । সেটা দপ্তরের কয়েকজনের চোখে ভাল লাগে না । তাঁরা ফঁন্দি পেতে ঘুষের টাকা নেওয়াটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে দেন । এমনকি কেন্দ্রিয় গোয়েন্দা সংস্থা ষষ্টীকমলকাকুকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেন । তারপর যা হওয়ার সেটাই হয়েছে । প্রথমে বিভাগীয় তদন্ত । তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত ! সেই কারণে অবসরের ষাট বছর হওয়ার আগে চাকরি জীবন থেকে তাঁর ছুটি  । এখন তাঁর অবসরকালী জীবন । কিন্তু তিনি যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ । যার জন্য চেহারা ধরে রেখেছেন । কেউ তাঁকে দেখলে বলবে না, তিনি রিটায়ার্ড । 
   স্কুল ছুটি হলে বিপাশা পা টিপে টিপে চুপি চুপি দাদুর ঘরে ঢোকে । দাদু আগেভাগেই বাড়ির সদর দরজা খোলা রাখেন  । বিপাশার স্কুল শুরু হয় সকাল  সাতটায় এবং শেষ হয় বেলা সাড়ে-এগারোটায় । স্কুল থেকে হাঁটা পথে দাদুর বাড়ি পনের মিনিট । তাই বিপাশা সাধারণত দুপুর বারোটা নাগাদ দাদুর বাড়িতে ঢোকে । দাদু তখন সেজেগুজে ফিটফাট । নাতনীর জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন । বিপাশার জন্য নিত্যদিন চকলেট বাধা । এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল রেডি রাখে । ঠিক ঐ সময় দাদুর বাড়ি ফাঁকা । ছেলে-বৌমা তখন অফিসে । সকাল দশটার মধ্যে কাজের মাসি কাজ সেরে চলে যায় । কাকীমা দীর্ঘদিন মেয়ের বাড়ি বেনারসে ।  বাড়িতে তখন দাদু ছাড়া কেউ থাকে না । ফাঁকা বাড়ি পেয়ে বিপাশা মহা আনন্দে সারা বাড়ি ধেইধেই ঘুরে বেড়ায় । 
    ষষ্টীকমলকাকু তখন বিপাশার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন । বিপাশা সদ্য মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে পাঠরত । হাপালো মেয়ে । ডাগর-ডোগর । বিপাশাকে দেখলে মনে হবে সে কলেজে ফাইনাল ইয়ার । সুতরাং বিপাশা যখন এঘর-সেঘর দৌড়-ঝাঁপ করে, তখন তার পুরো শরীরটা নড়াচড়া করে । সেটা দেখতে ষষ্টীকমলকাকুর খুব ভাল লাগে । বিপাশা দাদুর ঐরকম তাকানোতে খুব মজা পায় । এইজন্য অনেক সময় দাদুর ঠিক সামনে স্কিপিং করার মতো লাফায়, আর হাসে । তখন দাদুরও চোখে-মুখে  প্রশান্তির হাসি । 
    বেলা বারোটা পার হয়ে গেলে ষষ্টীকমলবাবু উতলা হয়ে উঠেন । যতক্ষণ বিপাশা ঘরে না ঢুকছে ততক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন । ষষ্টীকমলবাবু নিজেও জানেন না, বিপাশার জন্য  তাঁর মন কেন আনচান করে ?
      মায়ের নীরবতা লক্ষ্য করে মানষী ভাবলো, সে একদিন সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে বিপাশা দাদুর বাড়িতে ঢুকে ঠিক  কী কিরে ? তার এত সময় কাটানোর কারণ কী ? মানষীর ধন্দে কিছুতেই কাটছে না,  দাদুর বাড়িতে যাওয়ার বিপাশার এত উৎসাহ  কেন ? মানষী  সুযোগ বুঝে ষষ্টীকমলদাদুর বাড়ি হানা দেওয়ার অপেক্ষায় রইল । 
                        ******************** 
    এদিকে কঙ্কাবতীর তৃতীয় মেয়ে অনীশা ও অনিন্দ ঠিক করলো, মিঁয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে তারা চায়ের দোকান খুলবে । অনীশা খুব পরিশ্রমী । পড়াশুনায় বেশীদূর এগোতে পারেনি, কিন্তু পরিশ্রম করার ক্ষেত্রে তার কোনো অলসতা নেই । অনিন্দ অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তারা বাপ-বেটী চায়ের দোকান খুলবে । মিঁয়াগ্রামের নাসিরুদ্দিনের দু-কাঠার জমির উপর একটা ভাঙাচোরা ঘর স্টেশনে যাওয়ার রাস্তার উপরেই পড়ে রয়েছে, খানিকটা পরিত্যক্তভাবে ।  নাসিরুদ্দিন সাম্প্রতিককালে তার একমাত্র ছেলের কাছে নিমতিতাতে (মুর্শিদাবাদ জেলা) বাস করছে । ছেলে নিমতিতার একটি নামজাদা হাই স্কুলের শিক্ষক ।  ছেলে একরকম জোর করে নাসিরুদ্দিনকে নিমতিতায় তাদের কাছে নিয়ে  রেখেছে । ফলে ঐ জায়গাটায় তাঁর প্রস্তাবিত দোকান ঘর আর খোলা হয়নি । নাসিরুদ্দিনের ইচ্ছা ছিল ঐ জায়াগায় খাওয়ার রেঁস্তরা খোলার । তবে এই মুহূর্তে জমি সমেত  ভাঙা বাড়িটা নাসিরুদ্দিনের বেচার ইচ্ছা ছিল না । কঙ্কাবতী তাঁকে চেপে ধরায় নাসিরুদ্দিন অমত করতে পারেনি । একরকম জলের দামে জায়গাটা কঙ্কাবতী কিনেছে । এটা কেনার ক্ষেত্রে অনিন্দ মধ্যস্থতা করলে জায়গাটা হাত ছাড়া হয়ে যেতো । জমিটা কেনার প্রতি দৃষ্টি  মিঁয়ার অনেক ব্যবসায়ীর ছিল । তাই অতি সন্তর্পণে সুযোগ বুঝে কঙ্কাবতী সোজা নিমতিতায় হাজির । ট্রেনে পৌঁছে গিয়েছিল কঙ্কাবতী এবং সে একা গিয়েছিল । পাছে জানাজানি হয়ে যায়, এইজন্য বাড়ির কাউকে সঙ্গে নেয়নি । নিমতিতা স্টেশনের কাছাকাছি ভাগীরথী গঙ্গা । সবাই জানে, ভাগীরথী গঙ্গা হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে এসেছে । আরও একটা মজার ব্যাপার, নিমতিতার উল্টোদিকে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা । ভাগীরথী গঙ্গা রাজশাহী জেলা দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশে পদ্মা নামে খ্যাত । সেই হিসাবে পদ্মা নদী ভাগীরথীর প্রধান শাখা নদী । সেই নিমতিতায় নাসিরুদ্দিনের ছেলের বাড়িতে বসে জায়াগাটা কেনাবেচা এবং চুক্তিপত্রের কাগজপত্রের কাজকর্ম সম্পন্ন হয় । নাসিরুদ্দিনের সেই জায়গার উপর অনিন্দ ও অনীশা চায়ের দোকান খোলার মনস্থির করলো ।   
                                                              ( ক্রমশ )
Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *