Categories
প্রবন্ধ

বাংলার নক্সীকাঁথা..শিল্পের গায়ে মমতার স্পর্শ : বানীব্রত।

“আজও এই গাঁও অঝরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নিরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানেকানে।”
কবি জসিমউদ্দীনের “নক্সীকাথার মাঠ” কবিতার দুটো লাইন দিয়ে শুরু করলাম। এখানে কবি রুপাই আর সাজুর প্রেমগাঁথাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর এই প্রেম কাহিনির নেপথ্যে ছিলো নক্সীকাঁথা। রুপাই তার প্রেমিক সাজুর জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় তার মনের অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছিল নক্সীকাঁথায়। যার শেষ পরিনিতিতে কবরের উপরে বিছানো ছিলো ওই নক্সীকাঁথাটা। আর এই নক্সীকাঁথার ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
পুরাতন পাতলা সুতির কাপড়ের উপর বিভিন্ন রঙের সুতোয় ছোট ছোট ফোঁড়ের সেলাইয়ের ছোঁয়ায় তৈরী করা হতো কাঁথা। কাঁথাশিল্পীদের হাতের সুঁচসুতোর ছোঁয়ায় বিভিন্ন নক্সায় সেজে উঠেছিল সেই নক্সীকাঁথা। পাখি,  ফুল, গাছপালার চিত্রও দেখা দিত এই কাঁথায়। শিল্পীরা মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজের মনের ভাবকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতো কাঁথার উপর। এই নক্সীকাঁথা ভারত ও বাংলাদেশের বাজারে সমাদৃত ছিলো।  এই নক্সীকাঁথা ছিল দুইদেশের লোকশিল্পের অন্তর্গত। শতশত বছর পুর্বে এই কাঁথার বুৎপত্তি হয়েছিল। শোনা যায় পাঁচশবছর আগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত বইয়ে সর্বপ্রথম কাঁথার কথা পাওয়া যায়।
পুরোনো বা  ছেঁড়া কাপড়ের পাড় থেকে লাল নীল সবুজ হলুদ নানা রঙের সুতো বের করতেন এই শিল্পীরা। পায়ের বৃধাঙ্গুলিতে পাড়কে জড়িয়ে  নিয়ে আলাদা আলাদা রঙের সুতো বের করে কাগজের গোলা বা কাঠের টুকরোর মধ্যে সেই সুতো গুলোকে এক জায়গায় রাখা হতো। পরবর্তীতে সেই সুতোতেই সেজে উঠতো নকশি কাঁথা।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর, যশোর জেলায় ছিল নকশী কাঁথার জন্য বিখ্যাত। তাছাড়া সমস্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এই কাঁথা তৈরি হতো। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ ২০০৮ সালে নকশি কাঁথার জন্য ভৌগোলিক স্বীকৃতি পায়।
কাঁথা শব্দটির উৎস সঠিকভাবে জানা না গেলেও মনে করা হয় এই শব্দটি “খেতা” থেকে এসেছে। নিয়াজ জামানের মতে সংস্কৃতি শব্দ “কথা” হতে কাঁথা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, “কথা” শব্দটির বাংলা শব্দ তেনা বা কাপড়ের টুকরো আর এই তেনা বা কাপড়ের টুকরোর উপরে অলস দুপুরে বাড়ির দাওয়ায় বা গাছের তলার ছাওয়াতে বসে মহিলারা তাদের মনের ভাবকে তুলে ধরতেন। সূক্ষাতিসূক্ষ কাজের এই কাঁথা বানাতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যেত। এই কাঁথার বৈশিষ্ট হলো, এতে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কোন নকশা করা হয় না। যিনি এই কাঁথাটি তৈরি করেন তিনি তার মত করে মনের মাধুরী মিশিয়ে নকশা আঁকেন। এই কাঁথার মধ্যে চলমান সেলাই দিয়ে মূলত দেশীয় কাঁথা বানানো হলেও নকশি বা পায়ের তোলা এই দুই নামের সেলাই ও ব্যবহৃত হয় এই কাঁথাতে। তাছাড়া ঢেউ খেলানো সেলাইয়ে তৈরি কাঁথাকে লহরী কাঁথা বলা হয়। যা রাজশাহীতে খুবই জনপ্রিয়। বর্তমানে জামালপুরের সদর শহর পুরো জেলায় প্রায় ২৫ হাজার দরিদ্র নারী ও ৫০ হাজার পুরুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত আছেন। এই শিল্পে স্বাবলম্বি হয়েছেন অনেক দরিদ্র নারী। সংসারের অন্যান্য কাজের সাথে এই নারীরা নকশি কাঁথা সহ নক্সি সামগ্রী বানান শুরু করেন। জামালপুরের নকশি কাঁথা দেশে বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। সমস্যা উজির অভাবে ন্যায্য শ্রমের মূল্য থেকে বঞ্চিত এই শিল্পীরা। এখানকার শিল্পীদের খুব সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এখানকার সহনীয় উদ্যোগতারা যারা এই শিল্পের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছেন তাদের থেকে জানা যায় একটি নকশি কাঁথা তৈরি করতে খরচ হয় ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নেন ২ হাজার টাকায়। বড় বড় বিপনিতে এইগুলো বিক্রি হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। এই ব্যাবসার সাথে যারা যুক্ত আছেন এর থেকেই বোঝা যায় তারা একটি কাঁথা বিক্রি করে কত টাকা মুনাফা পান। ভাবলে কষ্ট লাগে যারা তাদের শ্রম দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে এই সুক্ষাতিসূক্ষ কাজ গুলি করছেন তারা হচ্ছেন বঞ্চিত। শিল্পীরা তাদের দাম পাচ্ছেন না আর তাদের নিষ্ঠার সৃস্টি দিকে দিকে কত সন্মানের সাথে শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করছে।

কলমে – বানীব্রত।

তথ্যসূত্র – গুগল

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *