Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর মধুময় কথা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীগৌরাঙ্গের পতিত-পাবন নামের সার্থক প্রমাণ হল শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই উদ্ধার লীলা। ভক্ত শিরোমণি জগাই-মাধাইয়ের অবণীতে আবির্ভাব হয় প্রভুর ইচ্ছায় দুরাচারী, অত্যাচারী, মদ্যপ ও অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিরূপে। এমন কোন পাপকর্ম জগৎ-এ ছিল না, যা, তাঁরা করতেন না। চুরি-ডাকাতি, মদ্যপান, গোমাংস ভক্ষণ, পরের গৃহ অগ্নিদগ্ধ করা, স্ত্রী-হত্যা, ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি সব রকম অসৎকর্মই তাঁরা অবলীলায় করতেন। তবে হ্যাঁ, উল্লেখ্য যে, বৈষ্ণব অপরাধ তাঁরা কখনও করেননি। মদ্যপ সঙ্গীদের সঙ্গ সবসময় করতেন বলে বৈষ্ণব অপরাধ করার মতো পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনদিন হয়ে উঠেছিল না।
নবদ্বীপবাসী ব্রাহ্মণ শুভানন্দ রায়। নবদ্বীপের জমিদার বলেই তাঁর দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছিল। সুমিষ্ট, সৎ ব্যবহারের জন্য পাৎসাহ তাঁকে বিশেষ নজরে দেখতেন। তাঁর দুই পরম-সুন্দর পুত্র—–জ্যেষ্ঠ রঘুনাথ, কনিষ্ঠ জনার্দন দাস। রঘুনাথের পুত্রের নাম জগন্নাথ আর জনার্দনের পুত্র মাধব। এই জগন্নাথ ও মাধবই ওরফে ‘জগাই-মাধাই’ বলে পরিচিত ছিলেন। নবদ্বীপের কোটাল এই দুই ভাই। যদিও জগাই-মাধাইয়ের পূর্বপুরুষরা সকলেই সদাচারী ছিলেন, কিন্তু মদ্যপ-কুসঙ্গীদের পাল্লায় পরে জগাই-মাধাইয়ের চরিত্রের অবনমন ঘটে। আর সেজন্য স্বজনদের দ্বারা তাঁরা পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। ভক্তসঙ্গ কী জিনিষ তা তাঁরা জানতেনই না। মদ্যপান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি পর্যন্ত যেতেন, কখনো বা বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন, আবার কখনো অশ্রাব্য গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যেই কিল-চড়-লাথি দিতেন। লোকে তাঁদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন সব সময়। যে পথ দিয়ে জগাই-মাধাই যেতেন। দূর থেকে দেখতে পেলে সেই পথ এড়িয়ে অন্য পথ ধরতেন ভীত পথিকেরা।
এমনই একদিন প্রচুর মদ্যপান করে রাস্তায় ধুলোয় পড়ে ‘কিলাকিলি-লাথালাথি করছিলেন জগাই-মাধাই। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গের আদেশে প্রতিদিন নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের প্রতি ঘরে ঘরে গমন করে মানুষকে কৃষ্ণ বলাচ্ছেন সেসময়। সেদিন তাঁরা সম্মুখীন হলেন পথে জগাই-মাধাইয়ের। দেখলেন ওভাবে মদের নেশার বিক্ষেপে তাঁদের পশুবৎ দশা। তখন পরম করুণ নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন, “ইস্! কী করুণ দশা এদের! এমন পাতকী তো কোথাও দেখিনি। আমার প্রভু গৌরাঙ্গ পাতকীদের উদ্ধার করতেই এই কলিতে এসেছেন। যদি এদের মতো পাপীদের তিনি উদ্ধার করেন, তবেই তো তাঁর পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে, তবে তো জগৎবাসী জানবে যে আমার প্রভুর মহিমা কতখানি! যাঁর ভৃত্য বলে আমরা গর্ব বোধ করি, তিনি যে কতখানি ক্ষমতা ধরেন সে প্রমাণ পাবে মানুষ তখন। না, এদেরকে ভক্তিপথে আনতেই হবে। যাঁরা ভক্ত হয় তাঁরা অতি সহজেই নাম নেয়; কিন্তু যদি এদের মত দুরাচারীকেও নাম নেওয়ানো যায়, তবেই আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সফল হবে। না হলে তো বৃথা আষ্ফালন সব আমাদের ! না, হরিদাস, আমাদের এখন প্রথম কাজ হবে এদেরকে উদ্ধার করা। অন্য জায়গায় আমরা পরে যাব। গৌরীহরিকে এদের কথা জানাবো। হরিদাস, তোমাকে যবনরা অত্যাচার করেছিল। তুমি তো তাদেরও মঙ্গল কামনা করেছিলে। এবার এদের মঙ্গল চাও। কারণ, তোমার মত ভক্তের চাওয়া ভগবান পূরণ করবেনই। এরা উদ্ধার হবে এই পাপী জীবন থেকে তবে।”
হরিদাস বললেন, “সে কী কথা! তুমি চেয়েছো যখন তখনই তো তা পূরণ হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। তোমার ইচ্ছাই যে প্রভুর ইচ্ছা। আবার আমাকে টানছো কেন!” নিত্যানন্দ একথায় হেসে প্রেমালিঙ্গন দিলেন হরিদাসকে। তারপর একটু দূর থেকে উপদেশের সুরে জগাই-মাধাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বল কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, লহ কৃষ্ণনাম। কৃষ্ণ মাতা, কৃষ্ণ পিতা, কৃষ্ণধন প্রাণ।। তোমা সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার। হেন কৃষ্ণ ভজ, সব ছাড় অনাচার।।”
কিন্তু উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হল । জগাই এমন কথা শুনে একটু মাথা তুলে প্রথমে দেখলেন, তারপরই মহাক্রোধে “ধরতো! ধরতো!” বলে ধাওয়া করলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে। “রক্ষ কৃষ্ণ, রক্ষ কৃষ্ণ” বলে নিতাই-হরিদাস কোনক্রমে জগাইয়ের প্রহারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। সে কী অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য! গর্জন করতে করতে দুই দস্যু ধাওয়া করছেন আর সামনে প্রেমে বিহ্বল দুই মহাভক্ত হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছেন।
শ্রীবাস গৃহে ভক্ত সমেত বসে আছেন বিশ্বম্ভর। নিতাই-হরিদাস হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সব বললেন তাঁকে। শ্রীবাস পন্ডিত ও গঙ্গাদাস জগাই-মাধাইয়ের বংশ পরিচয় দিলেন এবং তাঁদের দুষ্কর্মের আদ্যোপান্ত বর্ণনাও দিলেন। নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু, আগে তোমায় এদেরকে উদ্ধার করতেই হবে। তারপর অন্য কথা। তোমার পতিত-পাবন নাম সার্থক হবে এদের পাপমোচনের দ্বারা। বিশ্ববাসী তোমার মহিমা দেখুক।” গৌরাঙ্গ হেসে বললেন, “যে মুহুর্তে তোমার দর্শন ওরা পেয়েছে, তুমি চেয়েছো ওদের উদ্ধার, সেই মুহূর্তেই ওদের সব পাপ মোচন হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু তুমি ওদের মঙ্গল চিন্তা করো, দেখবে অচিরেই কৃষ্ণ ওদের মঙ্গল সাধন করে দিয়েছেন। তোমার ইচ্ছাই ফলপ্রসূ হবে।”
রাত্রিবেলায় একদিন নগর ভ্রমণ করে নিত্যানন্দ যাচ্ছেন পথ দিয়ে হেঁটে, এমন সময় জগাই-মাধাই তাঁর পথ অবরোধ করলেন। বললেন, “কে রে? কে তুই?” নিত্যানন্দ বললেন, “আমি অবধূত, গৌরগুণ গাই। এখন বাড়ি যাচ্ছি।” অবধূত শব্দ শোনা মাত্র মাধাই করলেন কী, পথের পাশে পড়ে থাকা এক ভাঙা কলসী উঠিয়ে নিয়ে আছাড় মারলেন নিত্যানন্দের মস্তকে। সজোরে আঘাত করায় মাথা ফেটে গেল নিতাইয়ের। আর অবিরল ধারায় রক্ত ঝরতে লাগলো। অক্রোধ পরমানন্দ, অভিমান শূন্য নিতাই গৌরস্মরণ করে নির্বিকার চিত্তে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর নির্লিপ্ততা দেখে মদ্যপ মাধাই আবার মারতে উদ্যত হলেন। কিন্তু রক্তধারা আর নিতাইয়ের নিশ্চুপতা দেখে জগাইয়ের মন দৈবেচ্ছায় মাখনের মত গলে গেল। তিনি মাধাই কে বললেন, “না, না, আর মেরো না। ও তো অবধূত, তা আবার দেশান্তরী ! ওকে মেরে লাভ কী তোমার! এত নির্দয় হয়ো না।” এই বলে তিনি মাধাইয়ের হাত ধরে ফেললেন। এদিকে অন্যান্য পথচারীদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে এ দুঃসংবাদ দিলেন গৌরাঙ্গকে।

শোনামাত্র গৌরাঙ্গ সপরিকর ছুটতে ছুটতে এলেন সেই মুহুর্তেই। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইয়ের অঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! এ কী সহ্য করা সম্ভব! প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন গৌরাঙ্গ। স্বয়ং তাঁকে প্রহার করে রক্ত ঝরিয়ে দিলেও এতখানি ক্রোধিত হতেন না, যতখানি নিতাইয়ের ক্ষেত্রে হলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি “চক্র, চক্র” বলে সুদর্শন চক্রকে আহ্বান জানিয়ে নিজের হাত উপরে তুললেন। সুদর্শন চলে এলেন তাঁর হাতে। ভক্তরা সকলে প্রমাদ গুনলেন। এবার তো আর নিস্তার নেই জগাই-মাধাইয়ের! চক্র দ্বারা প্রভু তাঁদের সংহার করবেনই করবেন। কিন্তু, কলিতে এই অবতারে তো তাঁর অস্ত্র ধরার কথা নয়। তাঁর অঙ্গ-উপাঙ্গ স্বরূপ পার্ষদরাই তাঁর অস্ত্র। পার্ষদদের দ্বারা নাম-প্রেম বিতরণ করিয়ে তিনি পতিতদের উদ্ধার করবেন। তাঁর রূপ মাধুর্য্যের দ্বারা অসুরের আসুরিক স্বভাবের পরিবর্তন করবেন। তাঁকে দর্শন করেই দুরাচারীদের মন পরিবর্তিত হবে। এযুগে তো তিনি কাউকে সংহার করবেন না। বরং মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রেমভক্তিতে মনকে জারিত করবেন, ভক্ত বানাবেন অভক্তদের। মহাভাগবত হবেন তাঁরা এক-একজন সব।
নিত্যানন্দ করলেন কৌশলতা এক। তিনি মহাপ্রভুর মন ঘোরাবার চেষ্টা করলেন, বললেন- “প্রভু, দেখ, দেখ, এই যে জগাইকে দেখছো , এ আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছে। মাধাই মারতে গেলেও তাঁকে বাঁধা দিয়ে রক্ষা করেছে আমায়।” একথা শুনেই গৌরাঙ্গের মনসংযোগ চক্রের প্রতি থেকে সরলো। বললেন- “তাই নাকি! তুমি আমার নিতাইকে রক্ষা করেছো জগাই ! প্রভু তোমার অনেক মঙ্গল করুক। নিত্যানন্দকে বাঁচিয়ে তুমি আমায় কিনে নিলে আজ।” এই বলেই তিনি জগাইকে জড়িয়ে ধরলেন। জগাইকে রেখে পাছে মাধাইকে মারেন, তাই নিত্যানন্দ বলে চললেন- প্রভু, এই দু’জনার শরীরই আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি। তুমি তো এযুগে প্রতিজ্ঞা করেছো যে অস্ত্র না ধরেও জীবতারণ করবে। তবে কেন তার ব্যাতিক্রম করবে! এই দুইজনকেই তুমি কৃপা কর।”
এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেমালিঙ্গন দেওয়ায় প্রেমভার বইতে না পেরে জগাই মূর্ছিত হয়ে গেছেন। গৌরাঙ্গ বললেন- “ওঠো জগাই। তোমার যা বর লাগে, তুমি চেয়ে নাও আজ। আমি আজ সত্য সত্যই তোমায় প্রেমভক্তি প্রদান করলাম। আমার দেহ থেকেও নিত্যানন্দের দেহ বড় আমার কাছে জেনো। তুমি তাঁকে রক্ষা করেছো যখন, শ্রীকৃষ্ণ তোমায় অনেক কৃপা করবেন এই আমি বললাম।” জগাই দেখলেন গৌরহরি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রেমানন্দে করজোড়ে তখন প্রাণের আকুতিভরা প্রণাম জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গকে জগাই। তাঁর নয়নের জল সর্বাঙ্গ বয়ে নীচে পড়ছে। তিনি আবার জ্ঞান হারালেন। তখন গৌরহরি নিজের শ্রীচরণখানি তাঁর বক্ষের ওপর স্থাপন করলেন। যাঁর অভয়পদ স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীর জীবন, সেই পদ হৃদয়ে ধরে জগাই সদৈন্যে তখন কেঁদেই চলেছেন। সেই দুরাচারী জগাই কই আর! ইনি যে এখন মহাভক্ত এক। জগাইয়ের ওপর গৌরহরির এমন করুণা দেখে উপস্থিত ভক্তবৃন্দরা হরিধ্বনি দিতে থাকলেন উচ্চৈঃস্বরে। আকাশ ভেদ করে সে দিব্যধ্বনি যেন গোলকে পৌঁছে যাচ্ছিল।

এতক্ষণ ধরে এতসবের সাক্ষী মৌন মাধাই। তাঁর ভাবান্তর ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী জগাই এমন কৃপা পেয় গেল, পরিবর্তিত হয়ে গেল, উদ্ধার হয়ে গেল, অথচ, তিনি তিমিরেই পড়ে রইলেন !—– একথা ভেবে মাধাই তখন পাগলপ্রায় হয়ে গৌরাঙ্গের পাদপদ্মে পড়ে গেলেন ছিন্নমূল বৃক্ষের মত। তাঁর দুর্বুদ্ধির বিনাশ হয়ে গেছে। তিনিও এখন দুষ্কর্ম ছেড়ে জগাইয়ের মত ভক্ত হতে চান। তাই বিনয় বচনে বললেন- “আমরা দুই ভাই জগাই-মাধাই সর্বক্ষণ একসাথে থাকি। একই কুকর্ম করি, তবে কেন একজনকে কৃপা করে অন্যজনকে বঞ্চিত করবে প্রভু? আমাকেও উদ্ধার কর। ক্ষমা করে দাও আমায়। অনুগ্রহ করে আমাকেও তোমার নাম-গান প্রচারে সামিল কর। আমার মত দুর্জনকে তুমি উদ্ধার না করলে, আর কী গতি হবে আমার! কৃপা কর দয়াময়। কৃপা কর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “না, তোমার ত্রাণ কোনমতে হবে না। তুমি নিত্যানন্দের দেহে আঘাত করেছো।” মাধাই—-“প্রভু, তোমার অন্যান্য অবতারে কত অসুর তো তোমায় বাণেতে বিদ্ধ করেছে। তুমি তো তাঁদের সকলকেই উদ্ধার করেছো। তোমার অভয়পদে স্থান দিয়েছো। তবে আমার বেলায় কেন তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করবে তোমার! গৌরাঙ্গ, “তুমি তো আমায় নির্য্যাতন করোনি। করেছো আমার প্রাণাধিক প্রিয় নিতাইকে। যদি আমায় করতে, তাহলে ক্ষমা আমি অনেক আগেই করে দিতাম। কিন্তু, আমার দেহের থেকেও নিত্যানন্দের দেহ যে অনেক প্রিয় , অনেক বড় আমার কাছে। তাঁকে দুঃখ দিয়ে আমার কৃপা কোনমতেই পাবে না আমার থেকে।” মাধাই, “প্রভু, তুমি তো সর্ব রোগহর বৈদ্য চূড়ামণি। তবে আমার এই কঠিন রোগ কেমন করে দূর হবে বলো! বলে দাও কী করলে আমার পরিত্রাণ হবে এ ঘৃণ্য অপরাধের থেকে। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।” তখন গৌরসুন্দর বললেন- “যদি নিজের পাপমোচন করতে চাও, তবে যাঁর চরণে অপরাধ হয়েছে, তাঁর শরণ নাও। নিতাইয়ের অপরাধী তুমি, তাই নিতাইয়ের কাছেই তোমার ক্ষমাভিক্ষা করতে হবে। সে যতক্ষণ না কৃপা করবে, তোমার প্রেমভক্তি ততক্ষণ বাদ।”
মাধাই নিত্যানন্দের শ্রীচরণে পড়লেন। যে পদ দেব ঋষিগণ প্রার্থনা করেন, রেবতী যে পদযুগলকে সেবা করেন সেই পদে মাথা কুটতে থাকলেন মাধাই। গৌরহরি বললেন, “নিতাই তুমি ওকে ক্ষমা না করলে যে ও উদ্ধার হবে না ! তোমার কৃপা বিনা তো কেউ প্রেমভিক্ষা পায় না। তাই, এবার দেখো তুমি ওকে কী করবে!” নিত্যানন্দ হেসে বললেন, “আমার জীবনে যদি কিছু সুকৃতী থেকে থাকে, আমি তার সমস্তটা আজ মাধাইকে দান করলাম।” এই বলে মাধাইকে নিজের চরণ থেকে তুলে কৃপালিঙ্গন দিলেন তিনি। মাধাইয়ের শরীরে নিজ শক্তি সঞ্চার করে দিলেন। সকল বন্ধনের বিমোচন হয়ে গেল মাধাইয়ের। মহাভাগবত হলেন মাধাই সে মুহুর্তেই। গৌরাঙ্গ বললেন, “জগাই-মাধাই, তোমাদের কোটি জন্মের সব পাপের ভার আমার হল। আর কিন্তু নতুন কোন পাপ কার্য করো না, আজ থেকে। তোমাদের পূর্বের কর্মের সবদায় আমার হল।“ জগাই-মাধাই সমস্বরে বলে উঠলেন- “না, না, বাবা, আর নয়। আমরা আর কোনদিন, কোন কুকর্ম করবো না। এমনকী করার কথা ভাববোও না।” গৌরাঙ্গ, “বেশ, তবে তোমাদের দেহ আমার অবতার হবে। তোমাদের দুজনার মুখ দ্বারা আহার হবে আমার।” এমন কৃপাশীর্বাদ পেয়ে দু’ভাই বাহ্য হারালেন। গৌরাঙ্গ তাঁর পরিকরদের বললেন, “এদের দুজনকে আমার ঘরে নিয়ে চল। ব্রহ্মার দুর্লভ যে ধন, আজ সেই ধন আমি এদেরকে দেব। সকলের থেকে উত্তম বানাবো। এদেরকে স্পর্শ করলে গঙ্গাস্নানের সমান ফল প্রাপ্ত হওয়া যাবে এমন পূণ্যবান ভক্ত বানাবো এদের।”
জগাই-মাধাই দু-ভাইকে নিয়ে গেলেন ভক্তরা প্রভুর ঘরে। তাঁদের দুজনকে ঘিরে সংকীর্তন শুরু হল। কীর্তনের রোল শ্রবণ করে প্রেমানন্দে উঠে বসে দু’বাহু তুলে অপার নৃত্য করতে থাকলেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দেহে বাহ্যস্মৃতি লোপ পেল। প্রেমে বিভোর দুই তনু তখন ঢলঢল, গড়গড়। অশ্রুনীরে সর্বাঙ্গ সিক্ত। সাত্ত্বিকভাবের প্রকাশ দেহে। দৈন্য, স্তুতি করে চলেছেন তাঁরা। তাঁদের সেই দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়। তাঁদের দৈন্য দেখে বুক ফাটে এমন দশা তখন ভক্তদের। গৌরাঙ্গ বললেন, “আজ থেকে এরা আর মদ্যপ হবে না। এরা আমার সেবক। সকলে প্রাণঢেলে আশীর্বাদ কর এদেরকে যেন জন্মে-জন্মে আমায় না ভোলে আর। কারোর চরণে যদি কিছু অপরাধ থেকে থাকে এদের, তাহলে তোমরা নিজগুণে সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিও। কৃপা কর সকলে জগাই-মাধাইকে।” তখন দু’ভাই জগাই-মাধাই চোখের জলে ভেসে সকলের চরণ ধরে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকলেন । সকলে ক্ষমাসুন্দর চোখে তাঁদেরকে আপন করে নিয়ে আশীর্বাদ করলেন। সেদিন থেকে তাঁরা অনুগত সেবক হলেন গৌর-নিতাইয়ের। এরপর সকলে মিলে কীর্তন করতে করতে গঙ্গাস্নান করতে গেলেন। অনেক জলকেলি হল। জগাই-মাধাইয়ের সব পাপ নিজে ধারণ করে নিলেন প্রভু। প্রমাণ দিতে ‘কালিয়া-আকার’ ধারণ করেছিলেন সেদিন। স্নান সেরে তীরে উঠে, নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ প্রভুদ্বয় আপন আপন কন্ঠের মালা জগাই-মাধাইকে পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে মহাভাগবত হলেন দু-ভাই জগাই ও মাধাই।
“মহাপ্রভু দুঁহে করিয়া আলিঙ্গন।
বোলে আজি হৈতে মোর সেবক দুইজন।। নিতাই আলিঙ্গিয়া দুঁহে বলয়ে বচন।
প্রিয় শিষ্য হৈলে মোর তোমরা দুইজন।। জগাই মাধাই হৈলা ভক্ত অতিশয়।
দুই প্রভুর দুই শাখা মধ্যে গণনা যে হয়।।”
(প্রেমবিলাস, ২১)

“এতেক যতেক কৈল এই দুইজনে।
করিলাম আমি ঘুচাইলাম আপনে।।
ইহা জানি এ দুইয়ে সকল বৈষ্ণব।
দেখিয়া অভেদ দৃষ্ট্যে যেন তুমি সব।।
শুন এই আজ্ঞা মোর যে হও আমার।
এ দুইয়ে শ্রদ্ধা করি যে দিব আহার।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যত মধু আছে।
সে হয় কৃষ্ণের মুখে দিলে প্রেমরসে।।
এ দুইরে বট মাত্র দিবে যেই জন।
তার সে কৃষ্ণের মুখে মধু সমর্পণ।।
এ দুই জনেরে যে করিবে উপহাস।
এ দুইর অপরাধে তার সর্বনাশ।।
তবে গলার মালা দোঁহার গলে দিল।
প্রভু কৃপা পাই দোঁহে প্রেমেতে ভাসিল।।”
(চৈ.ভা-১৩)
পরম প্রেমিক, মহাভক্ত জগাই-মাধাই দু’ভাই এখন দিবানিশি কৃষ্ণপ্রেমে ডুবে আঁখি নীরে ভাসেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে এসে তাঁরা দুই লক্ষ নাম নেন। কৃষ্ণ বলে নিরবধি হা-হুতাশ করেন। কৃষ্ণময় জগৎ এখন তাঁদের। কিন্তু, এত সবের সঙ্গে নিজেদের অতীতের কীর্তিকলাপের কথা ভেবে ধিক্কার দেন নিজেদেরকেই তাঁরা। নিজেদের জীবহিংসার কথা ভেবে মরমে মরে যায়। ভূমিতে পড়ে আকুলি-বিকুলি করেন অনুশোচনায়। পতিত পাবন গৌরসুন্দর কত দয়াময় আর নিত্যানন্দ এত করুণাময়(!), তাঁদের এত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন এত অবলীলায়, এত কৃপা করলেন!—–এসব ভেবে কেঁদে আকুল হন তাঁরা। বিহ্বল হয়ে যান প্রভুদের কৃপালীলার কথা ভেবে। কখনো কৃষ্ণপ্রেমানন্দে, কখনো নিজেদের কর্মের কথা ভেবে প্রায়ই আহার করেন না। তখন নিতাই-গৌরসুন্দর অনেক বুঝিয়ে আহার তুলে দেন মুখে তাঁদের।
মাধাই আরও বেশী অনুশোচনায় ভোগেন জগাইয়ের থেকে। তিনি নিতাইকে প্রহার করেছেন, রক্ত বের করে দিয়েছেন মাথা থেকে; কত না পাপীষ্ঠ তিনি! —-একথা ভেবে বক্ষ ভাসান নয়ন জলে। যদিও নিতাই তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তবুও একদিন দন্তে তৃণ ধরে আবার নিত্যানন্দের চরণে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলেন তিনি। চোখের জলে নিত্যানন্দের চরণ ধুয়ে দিলেন, স্তব করলেন কত না। সন্তুষ্ট নিত্যানন্দ বুকে টেনে নিলেন তাঁর প্রিয় মাধাইকে। বললেন- “মাধাই, তুমি এখনো এতদিন পরেও কেন এমন করো। শোক পরিহার কর। তুমি তো এখন আমার দাস। তোমার শরীর এখন আমার সম্পদ। তুমি এভাবে দৈন্যক্রন্দন করে আমাকে কেন কষ্ট দাও। শিশুপুত্র যদি পিতাকে মারে, পিতার কী কিছু যায় আসে তাতে! পুত্রের অপরাধ দেখে না পিতা। তেমন তুমিও তখন অজ্ঞানী ছিলে শিশুপুত্রের ন্যায়। তোমার কোন অপরাধ আমি দেখিনি। তার ওপর আমার প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ তোমায় আপন করেছেন। যাকে তিনি কৃপা করেন, সে আমার জন্মে জন্মে প্রিয়পাত্র হয়। আর যে জন তাঁকে লঙ্ঘন করে আমায় পূজা দেয়, সেই মূঢ় কখনো আমার কৃপার প্রাপ্ত হয় না, প্রিয়পাত্র হওয়া তো অনেক দূরের কথা। তোমায় তিনি কৃপা করেছেন যখন, তখন তুমি আমার যে কত প্রিয় হয়েছো, তা আমি বোঝাতে পারবো না।” এইবলে নিত্যানন্দ মাধাইকে প্রেমালিঙ্গন দিলেন। তখন মাধাইয়ের অন্তর শান্ত হলেন। মাধাই বললেন, কিন্তু, প্রভু আমার যে অনেকের কাছে অনেক অপরাধ জমা আছে। তার কি হবে? আমি তো তাদের সকলকে চিনিও না। ভুলে গেছি কারা তারা। কি করে তাদের কাছে আমি ক্ষমা চাইবো? আমি বহু বহু পাপ করেছি এতদিন ধরে। কি করে সেই অপরাধবোধ যাবে আমার?”
তখন নিত্যানন্দ বললেন, বেশ, তবে এক কাজ করো। তুমি প্রতিদিন গঙ্গারঘাটে গিয়ে মার্জন করবে ঘাঁট। যারা স্নান করতে আসবে তাদের যতটা সম্ভব সেবা করবে। তারা স্নান করে উঠলে তাদের প্রণাম জানিয়ে ক্ষমা চাইবে। প্রসন্ন হয়ে তারা তোমায় আশীর্বাদ করবে কল্যাণ হোক বলে, তাতেই তোমার পাপস্খলন হবে, অপরাধবোধ চলে যাবে। হৃদয় প্রশান্ত হবে। এই আকুলতা দূর হবে।
নিত্যানন্দের দেখানো পথেই এখন জগাই-মাধাই আচরণ করেন। সকলের চরণ ধরে প্রার্থনা করেন- “জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যত পাপ করেছি আপনার প্রতি, ক্ষমা চাইছি সবের জন্য। আপনি ক্ষমা করুন এই জীবাধমকে, এই পতিতকে। এ নরাধম ভিক্ষা মার্জনা চাইছে আপনার থেকে।” তাঁদের ক্রন্দন দেখে আর অনুরোধ শুনে ঘাটে আগত স্নানার্থীদের চোখেও জল এসে যেত। তাঁরাও নয়নাশ্রু ফেলে ক্ষমা করে দিতেন। আবেগে তাঁদের কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যেত জগাই-মাধাইয়ের বিনয় দেখে।
প্রেমিক সুজন জগাই-মাধাই কঠোর থেকে কঠোরতম ভজনে মগ্ন হলেন। ব্রহ্মচারী বলে তাঁরা খ্যাত হলেন। তাঁরা কোদাল চালিয়ে মাটি কেটে গঙ্গার ঘাট বানালেন। এখনও সে স্থান দর্শন হয়। ‘মাধাইয়ের ঘাট’ নামে প্রসিদ্ধ সে ঘাট, নিত্যানন্দের করুণাগুণে তাঁরা চৈতন্যচরণ পেয়েছেন। গৌরাঙ্গের পতিত পাবন লীলার মহাপ্রমাণ হলেন তাঁরা। নিতাইয়ের কৃপাপাত্র এই দুই ভাগ্যবান ভ্রাতারা আসলে শ্রীনারায়ণের ধাম বৈকুন্ঠের দুই দ্বারপাল ‘জয়’ ও ‘বিজয়’। সনকাদি মুনির অভিশাপে দুর্বৃত্ত হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরণীতে। “বৈকুন্ঠে দ্বারপালৌ যৌ জয়াদ্য বিজয়ান্তকৌ। তাবাদ্য জাতৌ স্বেচ্ছাতঃ শ্রীজগন্নাথ-মাধবৌ।” (গৌ.গ.দি.-১১৫)
নিত্যানন্দ চেয়েছিলেন প্রাকৃত মদ্যপান করে যেমন অস্পৃশ্যরা উন্মত্ত হয়, তেমন মদ্যপ জগাই-মাধাই প্রেমভক্তিসুধা পান করে পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হোক, কীর্তন করুক, নৃত্য করুক আবেশে, ভজন পরায়ণ হোক,সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হোক গৌরকৃপাপাত্র হবার——সে ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রকৃত অর্থেই। মহা ভাগবত, ভজনানন্দী হয়েই সারাটা জীবন কাটালেন জগাই-মাধাই। তাঁদের দর্শনেই মানব পাপমুক্ত হত, কৃপা প্রাপ্ত হত।
ওহে প্রেমিকসুজন দুই ভ্রাতা ‘শ্রীশ্রীজগাই-মাধাই’ , কৃপা করুন যাতে নিরবধি নিতাইচরণ চিন্তা করতে পারি, চৈতন্য কৃপার যোগ্য পাত্রী যেন হতে পারি। আপনাদের শ্রীচরণে অনন্ত অর্বুদ কোটি প্রণাম এ জীবাধমার।
—– (সংকলিত), গ্রন্থ — ‘মহাপ্রভুর মধুময় কথা’, লেখিকা–রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক,

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *