Categories
গল্প প্রবন্ধ

নিত্যানন্দ এয়োদশী কেন এত মহিমাময় ? : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

বঙ্গদেশের বেশিরভাগ রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের দু’পাশে আমরা দু’বাহু উর্দ্ধে প্রসারিত করা নিতাই-গৌরের মূর্তি দেখতে পাই । প্রায় সকলেই জানি গৌর  অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব। কিন্তু নিতাই  বলতে বুঝি গৌরের দাদা বা ভাই স্থানীয় কোন বিশেষজন। কারণ, প্রচলিত প্রবাদ বাক্য প্রায় সকলেরই জানা– “নিতাই-গৌর দুই ভাই , হল এক ঠাঁই।”  যদি প্রশ্ন করা হয় , আচ্ছা তাঁদের মধ্যে গৌর কে আর কোনজনই বা নিতাই। তাহলে কয়জন যে সঠিক উত্তর দিতে পারব সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ।বলবো হয়ত, দু’জনেই তো একই রকম দেখতে,তাই ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক । হ্যাঁ ,খুবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক এ কারণে যে, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর এই প্রায় পাঁচশো বত্রিশ বছরের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যত চর্চা হয়েছে তার সিকি ভাগও নিতাই বা নিত্যানন্দকে নিয়ে হয়নি । যত গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে রচিত হয়েছে , পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বিশেষ চরিত্র নিয়ে এত গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। অথচ, যে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়ে এত লেখালিখি, যাঁর ভক্তি আন্দোলন সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে দূর মহাদেশে প্রভাব ফেলেছে—-সেই তিনি নিজমুখে শ্রীরাঘব পণ্ডিতের কাছে স্বীকার করেছেন , “এই নিত্যানন্দ যেই করায় আমারে।সেই করি আমি এই বলিল তোমারে।।”(চৈ.ভা.অন্ত্য,৫) নিত্যানন্দ যদি না থাকতেন তাহলে শ্রীচৈতন্যদেবকে জগত জানতে পারতো না। ভক্তি আন্দোলন হতই না । যখন মন্দিরে নিত্যানন্দ বিগ্রহ স্থান পেয়েছেন, পূজা পাচ্ছেন ,তখন তাঁর পূজিত হওয়ার কি কারণ হতে পারে সে সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ওঠাটা খুব যুক্তিসংগত। তবে তা কিন্তু অনেকাংশে হয়নি বললেই চলে। কারণ সেই একটাই—তাঁর সম্পর্কে আলোচনা কম। অথচ ,এই নিত্যানন্দই ছিলেন মধ্যযুগের বঙ্গদেশে সংঘটিত ধর্মবিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারী। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব প্রদর্শিত প্রেমভক্তি-ধারার ভগীরথ । মধ্যযুগীয় মানবমুক্তির অগ্রদূত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের  অভিন্ন আত্মা নিত্যানন্দ । চৈতন্যদেব ও  নিত্যানন্দের যৌথ সংকল্প ও প্রয়াসের সার্থক প্রতিচ্ছবি হল প্রেমভক্তি আন্দোলন। চৈতন্যের ইচ্ছার রূপকার হলেন নিত্যানন্দ।যা নিমাই চেয়েছেন, নিতাই  করেছেন তা বাস্তব। নিমাই নামপ্রেম  এনেছেন আর অকাতরে তা বিলিয়েছেন নিতাই।নিমাই-নিতাইয়ের লোকহিতৈষণা ব্রতেই  নবযুগের সূচনা সম্ভব হয়েছে । ভারতবর্ষের প্রথম সাম্যবাদী সমাজ স্থাপিত হয়েছে নিত্যানন্দরই পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতায় । ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গণ সংগঠন গড়ে উঠেছিল নিত্যানন্দেরই নেতৃত্বে। চন্দ্র প্রকাশ হতে যেমন , সূর্যের আলো লাগে , ঠিক তেমন গৌরচন্দ্র প্রকাশ হত না যদি না নিতাই সূর্য থাকতো । আর , একথা অত্যুক্তি বা অতিকথন ও অতিরঞ্জন নয় । কেন? তা আমরা আজ এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আলোচনা করার চেষ্টা  করবো।  ৩রা ফেব্রুয়ারি, মাঘী শুক্ল ত্রয়োদশী তিথিতে নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর। এই সুদীর্ঘ কালের ব্যবধানে আজও যে তিনি কতখানি প্রাসঙ্গিক তা জানবো ।

ইতিহাসের খাতে নিতাই-নিমাই দুটি হৃদয়ধারা গঙ্গা-যমুনার মত পারস্পরিক সৌহার্দ্য ,ভ্রাতৃত্ব ,সাহচর্য্যকে  সম্বল করে নিরবধি বয়ে গেছে নির্দন্ধ, নিঃস্বার্থ ভাবে ।একে অপরের প্রতি কী সুগভীর টান,ভালোবাসা,অন্তরঙ্গতা — যা ইতিহাসে বিরল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, “মুঞি নিত্যানন্দের দাস— একথা প্রতিদিন মুখে যে একবার বলে,আমি তার হয়ে যাই।” আবার, নিত্যানন্দ বলেছেন, “ যে দিনান্তে অন্তত একবার ‘হা গৌরাঙ্গ’ বলে ,আমি তার দাস হয়ে যাই।” নিতাই-নিমাই দু’জনারই জীবনের এক লক্ষ্য, এক অভীপ্সা— পতিত উদ্ধার করা ,দীন-দুঃখী- দরিদ্র-দুর্বলদের মুখে হাসি ফোটানো।

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল অদ্ভুত জনাকর্ষিণী ,লোকমোহিনী শক্তি। মানুষের মন যে কী ভাবে মমতাভরা ব্যবহার দিয়ে জয় করা যায়, তা যেমন তিনি জানতেন ,তেমনি নিজ ব্যক্তিত্বগুণে সংগঠন কার্য্য পরিচালন পদ্ধতিও তাঁর অজানা ছিল না ।আর ,সে কারণেই তাঁরই অনুপ্রেরণায় শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তনকে গণসঙ্গীতের রূপ দিয়ে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  নিত্যানন্দ নদীয়াতে আসার আগে পর্যন্ত কীর্তন ঘরের মধ্যে করা হত।নিত্যানন্দ পরামর্শ দিয়ে কীর্তনকে খোলা আকাশের নীচে পথে বের করে আনালেন ।আকাশে বাতাসে হিল্লোল তোলা কীর্তনের ভাব,আবেগ,ধ্বনি,সুর ,অনুরণন ক্রমে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করলো। সর্বস্তরের মানুষ সমবেতভাবে গলা মেলানোয় তা সংকীর্তনের রূপ নিল।  গণবিপ্লবের মাধ্যম  হয়ে উঠল ধীরে ধীরে এই সংকীর্তনরূপ গণসংগীত।  সকল শ্রেণীর মানুষ শামিল হতে থাকলেন সেই সংকীর্তনরত  গণজোয়ারে। ভেদ-ভাবের ভাবনা ভুলতে থাকলো মানুষ। জাতের বিচার করে নয় , ভক্তির গভীরতায় একে অপরকে প্রণাম করতো। ফলে দেখা গেল ব্রাহ্মণ হয়েও চন্ডাল ভক্তের পদধূলি নিয়ে মাথায় দিচ্ছে নিজে। অসাম্য দূর হল।অনাথ-আতুর-অবহেলিতরা সমাজে  হৃত সম্মান ফিরে পেতে থাকলেন। নিত্যানন্দ দেখালেন ধর্ম কখনো বিদ্বেষ তৈরি করে না , তৈরী করি আমরাই।ধর্ম তো আশ্রয় দেয় , ধারণ করে আমাদের। মানুষের সাথে মানুষের সম্মিলন করায়  ধর্ম।  এভাবেই সেদিন থেকে রক্ষণশীল সমাজের স্মার্ত-বিধি-বিড়ম্বনার অবসান সূচীত হয়েছিল। জাতিভেদের অবসান হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম সকলকে ধারণ করে সার্বজনীন মানব ধর্মে পরিণত হয়েছিল। “বৈষ্ণবের জাতি বুদ্ধি যেই জন করে। কোটি জন্ম অধম যোনিতে ডুবি মরে”।(চৈ.ভা.)

তবে পথে-ঘাটে এমন  সংকীর্তনের ফলও হয়েছিল মারাত্মক । কাজীর আদেশে পেয়াদারা কীর্তনের  বাদ্যযন্ত্রগুলো মাটিতে আছাড় দিয়ে ভাঙ্গতে থাকলো । সংকীর্তনকারীদের প্রহার করতে থাকলো। গৌরাঙ্গ সিদ্ধান্ত নিলেন কাজীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে নামবেন ।হাতে মশাল নিয়ে কীর্তন করতে করতে কাজীর বাসভবন ঘেরাও করা হল।  সেই ঘেরাও মিছিলের  নেতৃত্বে ছিলেন নিতাই। অস্ত্র একটাই—সংকীর্তন। নিজের ভুল বুঝে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন ভীত কাজী। তিনি গৌরাঙ্গের চরণে আত্মসমর্পণ করলেন ।এই আন্দোলনই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম অহিংস আন্দোলন। ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন তাঁর ‘History of Bengali Literature’ গ্রন্থে একথাই  লিখেছেন— “It was perhaps the first act of civil disobedience in the history of India.” এখনও পর্যন্ত নগর সঙ্কীর্তন করার সময় যে ‘খোন্তা’ ব্যবহার করা হয় , তা আসলে কাজীর থেকে আদায় করা কীর্তনের গেটপাস, যা সঙ্কীর্তন প্রচার-প্রসারের উদ্যোগে সেদিন নিত্যানন্দের জয়কে সূচীত করে।  সুবিশাল দেহী, অপূর্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্বানুভাবানন্দে বিভোর নিত্যানন্দ নবদ্বীপের ঘরে ঘরে পথে পথে নামপ্রেম বিতরণ করতে মত্ত সিংহের মত বিচরণ করেছেন। “নিত্যানন্দ মত্ত সিংহ সর্ব নদীয়ায় । ঘরে ঘরে বুলে প্রভু অনন্ত লীলায়”।(চৈ.ভা.মধ্য,২৪)

নিত্যানন্দের মধ্যে ছিল এক সুন্দর ক্ষমাশীল সর্বংসহ মানসিকতা। ঠিক সেকারণেই , নবদ্বীপে যখন দুর্বৃত্ত জগাই-মাধাই মদের কলসীর প্রহার করে কপাল ফাটিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করেন, তখনও নিত্যানন্দ নির্বিকার। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে , অথচ তাও যে রক্ত ঝরালো, চাইছেন তার উদ্ধার। এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু সমগ্র বিশ্বের ধর্মের ইতিহাসে বিরল। মহাপ্রভু, তাঁর প্রাণের নিতাইয়ের অমন করুণ পরিণতি দেখে‌ ক্রোধে আত্মহারা হয়েছেন সেসময়। কিন্তু, নিত্যানন্দ সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছেন জগাই-মাধাইকে । এমন অহিংস নীতির গুণেই জগাই-মাধাইয়ের মত নৃশংস , অত্যাচারী , কুখ্যাত মানুষের মন পরিবর্তিত হয়েছিল। সেদিন থেকে মানবিকতার মন্ত্র পেয়ে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নিত্যানন্দের আদেশে তাঁরা গঙ্গার ঘাটে আগত স্নানার্থীদের সেবার কাজে নিজেদের বাকী জীবন নিয়োজিত করেছিলেন।  কাটোয়ায় ‘জগাই-মাধাইয়ৈর ঘাট’ আজও সেই ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । সদা আনন্দে থাকা  নিত্যানন্দ এমন ক্রোধহীন,  অহংকারহীন ছিলেন বলেই পদকর্তা লোচন দাস ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অক্রোধ পরমানন্দ নিত্যানন্দ রায় । অভিমান শূন্য নিতাই নগরে বেড়ায়।।”

নিত্যানন্দ ছিলেন অদোষদর্শী , কখনো কারও দোষ দেখতেন না। সকলেই তাঁর কাছে বড় আপনারজন।  সর্বদা বালখিল্যভাবে তিনি মত্ত থাকতেন।  বালকের ন্যায় মুখে খলখল হাসি আর শ্রীনয়নে যেন আনন্দধারা বয়ে যেত। তাঁকে যে দেখত তার মনও আনন্দে ঝংকৃত হয়ে উঠতো। আর কেউ যদি চৈতন্যের ভক্ত হতেন তবে তো কথাই নেই । গৌরাঙ্গের নাম নিলেই তিনি নিজেকে তার চরণে বিকিয়ে দিতেন।  তাইতো কেবল বলতেন, “আমাকে কিনিয়া লহ বল গৌরহরি”।

মহাপ্রভু চেয়েছিলেন একটি সার্বজনীন মানবধর্ম প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে। জাতের দলাদলি, কৌলিন্যাচারের করাল থাবা  মুক্ত হোক মানুষের জীবন । যথাযোগ্য সম্মান পাক প্রতিটি মানবিক চেতনা । উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, সম্মানীয়-হীন সকলে সকলকে গ্রহণ করুক সমানভাবে , বিভেদের বেড়াজাল ভেঙ্গে।  কিন্তু ,এ কাজে তাঁকে চরম বাধা প্রাপ্ত হতে হয়েছিল যতটা না  মুসলমানদের থেকে , তার থেকে অনেক বেশী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের থেকে । তিনি চিন্তা করে দেখলেন, সন্ন্যাসী সকলের পূজ্য হন, এখন তিনি যদি নিজে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তবে উন্নাসিক ব্রাহ্মণদের থেকে সম্মান, প্রণাম ,অধীনতা আদায়ের মাধ্যমে সমাজের অসাম্য দূর করার প্রচেষ্টায় আরো একধাপ অগ্রসর হওয়া সহজ হবে। তিনি তাই সংসারের নিরাপদ, সুখময় জীবন বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসের কঠোর জীবন সংগ্রামের পথ অবলম্বন করেছিলেন । আর , মূলতঃ নিত্যানন্দই তাঁকে সম্মতি জানিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্তে।  পরিণামে ফলও  পাওয়া গিয়েছিল হিসেবমতই। মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে জননী ও যুবাস্ত্রীকে ত্যাগ করে, নবদ্বীপের নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্ডিতের গৌরবময় জীবনকে তুচ্ছ করে নিমাইয়ের  আকস্মিক সন্ন্যাস গ্রহণ সকলকে স্তম্ভিত করলো। অতি বড় পাষাণ হৃদয়ও গলিত হল, নরম হল।

এই মহাপ্রভুই যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর পাগলের মত বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রাঢ়দেশ দিয়ে ছুটছেন; তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কোন হুঁশ নেই তাঁর। তখন নিত্যানন্দের চতুরতাতেই তাঁকে শান্তিপুরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
“দেখি সব ভক্তগণ করে অনুতাপ।
গৌরাঙ্গ গোলক যায় কি হবে রে বাপ।।
তবে নিত্যানন্দ প্রভু বলে বীর দাপে।
রাখিব চৈতন্য আমি আপন প্রতাপে।।”
(লোচন দাসের চৈতন্য মঙ্গল,মধ্য, ১৪)

তাই তো সুবিখ্যাত ‘অমিয় নিমাই চরিত’গ্রন্থে শ্রীশিশির কুমার ঘোষ এপ্রসঙ্গে নিত্যানন্দের অবদান স্মরণ করে লিখেছেন ,”শ্রীনিত্যানন্দের কথা কি বলিব?  প্রভু নিতাই!  তোমাকে কি ধন্যবাদ দিব? আহা! ধন্যবাদ তো অনেককেই দিয়া  থাকি,  হৃদয়ে কি তোমার পাদপদ্মে প্রণাম করিব? তাহাও তো সকলে করিয়া থাকে। অতএব, হে নিত্যানন্দ! হে বিশ্বরূপের অভিন্ন কলেবর,হে জীবের বন্ধু! আমি তোমার ধার শুধিতে পারিলাম না, তোমার নিকট চিরঋণী রহিলাম।”

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব বুঝেছিলেন যে তেজস্বী ,আত্মবিশ্বাসী, অটুট ব্যক্তিত্বের অধিকারী উদ্যমী নিত্যানন্দই এমন একজন ব্যক্তিত্ব , যাঁকে  সেসময়ের সমাজের ভীষণ প্রয়োজন। জাত-পাত বিভেদের  বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের ক্ষুদ্র মানসিকতাকে , সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করতে চাই নিত্যানন্দের মতো বৃহদ্ মানবিকচেতনা সম্পন্ন একজন সংগঠকের। জনমানসচেতনার উদ্বোধন ঘটাতে একজন সুদক্ষ নেতার যা যা গুণ, সর্বংসহ উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তরে মানবপ্রেম থাকা প্রয়োজন — তা সব  নিত্যানন্দের মধ্যেই নিহিত আছে।  শ্রীগৌরাঙ্গ দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন যে ,নিত্যানন্দের হৃদয়ে সকল জাতের মানুষের প্রতি  যে সাম্যভাব আছে সেই ভাব, সেই নীতিকে যদি সমাজে প্রকাশিত করে দেওয়া যায় ,প্রবাহিত করে দেওয়া যায় তবে সমাজে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়ে যাবে। আর তাই তিনি যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করে পুরীতে বাস করছেন তখন এক বছর আদেশ করলেন নিত্যানন্দকে—-

“মূর্খ নীচজড়ান্ধাখ্যা যে চ পাতকিনোপরে।
তানেব সর্বথা সর্বান কুরু প্রেমাধিকারিণঃ।।”
(মুরারি গুপ্তের কড়চা-৪/২১/১০)

—-“নিত্যানন্দ তুমি এভাবে আর রথযাত্রায় প্রতিবছর এসো না। তুমিও যদি সন্ন্যাসী-মুনীদের মত করে সব ভুলে কেবল ধর্মাচরণ পালনে ব্যস্ত থাকো, তবে সমাজকে কে চালনা করবে ! সমাজের দুঃখী-দরিদ্র ,আর্ত-আতুরদের দুরাবস্থা কে ঘোচাবে!  না, না,, তোমাকে যে আরও বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে হবে ।”

নিজের গণসমেত অর্থাৎ অনুগত জনাদের নিয়ে ফিরে এসেছিলেন নিত্যানন্দ । পুরী থেকে ফেরার পথে যখন  পানিহাটিতে  শ্রীরাঘব পন্ডিতের ভবনে উঠলেন , তখন সেখানে গঙ্গাতীরে এক মহোৎসবের আয়োজন করালেন হুগলী জেলার সপ্তগ্রামের জমিদার পুত্র  রঘুনাথ দাসের  ব্যয়ভারে। সেই উৎসবে একসঙ্গে  ৩৬জাতির মানুষকে  এক পংক্তিতে (লাইনে) বসিয়ে ভোজন করালেন । পানিহাটীকে কেন্দ্র করেই নিত্যানন্দ তাঁর সমাজসংস্কারক অভিযান শুরু করলেন। সেখানেই  নিত্যানন্দ তাঁর পার্ষদদের মধ্য থেকে উপযুক্ত বারোজনকে নির্ধারণ করলেন। শ্রীঅভিরাম , সুন্দরানন্দ , ধনঞ্জয়, গৌরীদাস, কমলাকর পিপ্পলাই, উদ্ধারণ দত্ত, মহেশ পণ্ডিত, পুরুষোত্তম দাস, নাগর পুরুষোত্তম, পরমেশ্বর দাস, কালা কৃষ্ণদাস ও শ্রীধর পণ্ডিত—–  এঁদেরকে গৌড়মন্ডলের এক একটি নির্দিষ্টস্থানে নামপ্রেম প্রচারের দায়িত্ব দিলেন। আদেশ দিলেন উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র কোন বাছবিচার না করে প্রত্যেককে  কাছে টেনে নিতে।  নিত্যানন্দের নির্দেশে সেই বারোজন সেনানী আজীবন সেই কর্মই করে গেছেন।  ফলে সমাজে এক মানববন্ধন তথা প্রেমমন্ডল তৈরি হয়েছিল। ধর্মবিভেদ ভুলে ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয়’ নীতিতে মানুষ মানুষকে  তথা মানবাত্মাকে সম্মান করতে শিখেছিলো।

নিত্যানন্দ অনুভব করেছিলেন যে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের অর্থাৎ জল-অচল হিন্দু, বৌদ্ধ সহজিয়া , নেড়া-নেড়ী সম্প্রদায়ের সেই বিশাল সংখ্যক মানুষকে যদি সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যায় তবে হিন্দুসমাজ বলবতী হবে।  এই ভাবনা থেকেই তিনি সস্নেহে পূর্ববঙ্গের জল-অচল মানুষদের কৃষ্ণনাম প্রদান করে মূল হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনেন । বহিষ্কৃত সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়কেও সেসময় হিন্দু সমাজভুক্ত করেছিলেন তিনি। তারফলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণীয়তা আরো বেড়ে গিয়েছিল।শ্রীগৌরাঙ্গের আদর্শ–“কৃষ্ণ ভজনে নাহি জাতি-কুলাদি বিচার”— এই পন্থাকে অবলম্বন করে নিত্যানন্দ তাঁর পতিত উদ্ধারণ লীলা অব্যাহত রাখলেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বহারাদের নেতা, বঙ্গদেশের প্রথম সাম্যবাদী নেতা। তাঁর আবেদন ছিল অত্যন্ত জোরালো ও প্রভাবময়।

নিত্যানন্দ ছিলেন চরম বাস্তববাদী নেতা।  তাইতো তিনি বলেছিলেন, “কাঠিন্য কীর্তন কলিযুগ ধর্ম নয়”( জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল–উত্তরখন্ড)। আরও বলেছিলেন, “কূলবধূ নাচাইমু কীর্তনানন্দে”(ঐ)।  পুরুষদের মত নারী জাতিরও যে অধিকার আছে কীর্তনে অংশগ্রহণ করার,সেখানে নৃত্য করার—একথা প্রথম শোনা যায় নিত্যানন্দের নির্ভয় কন্ঠেই । তখন থেকেই পর্দানশীন বঙ্গবধূর বহির্জগৎ তৈরি হতে থাকে। অন্দরমহলের অন্তরায় ভেদ করে নারীরা সর্বসমক্ষে আসতে আরম্ভ করে। আর তারই চরম দৃষ্টান্ত হল  নিত্যানন্দের দ্বিতীয়া পত্নী জাহ্নবাদেবী। জাহ্নবাদেবী হয়েছিলেন সমুদয় বৈষ্ণবকুলের আচার্যানী, জননেত্রী। সমগ্র গৌরমন্ডলে পরিভ্রমণ করে, বিগ্রহ স্থাপন করে , মহোৎসব করে বৈষ্ণবদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন তিনি।

সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতিমূর্তি নিত্যানন্দে  শৈব ,শাক্ত ,বৈষ্ণব—এই ত্রিধারার মেলবন্ধন দেখতে পাই আমরা। কারণ, তাঁর মস্তকে থাকতো শাক্ত সম্প্রদায়ের ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র , সঙ্গে রাখতেন শৈব সম্প্রদায়ের নীলকন্ঠ মহাদেব ; আর ,কণ্ঠে ধারণ করতেন বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিভূ  অনন্তদেব শিলা ।  তাঁর মত হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব ছিল এমন বেপরোয়া আচরণ।  আবার , যে যুগে জাত বাঁচাতে ব্রাহ্মণরা অন্য জাতের জলটুকুও গ্রহণ করতেন না , সেযুগে  নিত্যানন্দ ছিলেন একেবারে ছুঁৎমার্গহীন।দিনের পর দিন বৈশ্য সম্প্রদায়ের উদ্ধারণ দত্তের  রন্ধন করা দ্রব্য  আহার করেছেন । প্রথম জীবনের সুদীর্ঘ কুড়িটা বছর ভারতবর্ষের নানা স্থানে পরিব্রাজক হয়ে ঘোরার ফলেই হয়তো বা ভারতমাতার উদার মানবিক ভাবটি আত্মস্থ হয়েছিল তাঁর।

নিত্যানন্দের আবির্ভাবের ৫৫০ বৎসর পরও তাঁর আদর্শ ও তিনি বড় বেশীরকম প্রাসঙ্গিক। তবে, গৌর আদর্শের সার্থক রূপকার নিত্যানন্দের সাংগঠনিকশক্তি ও উদার-ভাবনা সম্পর্কে গবেষণা সেই অর্থে হয় কী! বর্তমানের এই দাঙ্গা-হানাহানি, অভিযোগ-অশান্তির আবহে ভীষণ প্রয়োজন বৃহৎ আদর্শের , সাম্য মনোভাবের। মানবদরদী নিত্যানন্দ চরিত্রের আলোচনা, গবেষণা— তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ একান্ত ভাবে প্রয়োজন।

Share This
Categories
কবিতা

প্রেমিক : শীলা পাল।

আমার পছন্দ ছিল
হাল্কা সবুজ রঙ
তুমি দেয়ালে সেই রঙ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে পছন্দ ?
আমি হেসেছিলাম
আমার হাসিতে কী আছে জানি না
সে সবসময়ই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আগ্রহ ভরে
আমি কখন হেসে উঠব
এই আশায়
বিশাল শরীর তার
হাল্কা আমিকে নির্দ্বিধায়
বুকের ওপর তুলে নিয়ে
একতলা থেকে দোতলা তিনতলা পেরিয়ে ছাদে নিয়ে গিয়ে বলত এবার আকাশ দ্যাখো
আমি ভয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আকাশ দেখতাম
সেই আকাশের দুটো স্বপ্নময় চোখ দেখে আমার আঁখি আবেশে বুজে যেত
একটুও স্বপ্ন নয়
আমার হৃদয় দিয়ে দেখা একটি জীবন্ত প্রেম।
সদ্য যৌবনার এরকম
প্রস্ফুটিত ফুলের মতো
হাসি যে তার বড় প্রিয় ছিল
এখন এই দিনশেষে
তার আড়বাঁশি টি বাজবে কখন বসে আছি।

Share This
Categories
কবিতা

সীমাবদ্ধ : রাণু সরকার।

কতদিন দেখিনি দূরের আকাশ,
তুমি আমায় দেখতে বলছো?
হয়তো এই জীবনে হবেনা দেখা আর।

আমার কাছে সব কিছুই ছায়াময়-
আমার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ, পারেনা যেতে অতো দূরে-
একা ভয় পাই যদি হাত থেকে পিছলে পড়ে লাঠিটা।

দেখতে চাই নম্র আচরণ, এই সময়টা পার করা ভয়ঙ্কর,
রমণীয় সমুদ্রবাহু যেটা দেখালে-
বিশাল জলপ্রপাত তাই না বল।

মধ্যবর্তী স্থান দেখাবে হাত কিন্তু
ছেড়না!
এখন যষ্ঠি আছে পঙ্গু হলে এটাও
একা করে দেবে-
একে তো দৃষ্টি সীমাবদ্ধ কলাকৌশলে ও অনভিজ্ঞ
দেখতে চাই দূরের গুপ্তরহস্য!
যাবে নিয়ে ঐ যে- যেখানে কালো
মেঘের দল মাথায় কি যেন নিয়ে চলছে-
দৃষ্টি সীমাবদ্ধ কাছে গেলে হয় তো।

Share This