Categories
নারী কথা

কবিতা পরমেশ্বরী : শুভ্রাশ্রী মাইতি।

দুপুরের ঘুঘুডাকা নির্জনতা। পাতা পড়লেও বোধহয় শব্দ শোনা যাবে পুকুরে–টুপ্। মামার বাড়ির লাইব্রেরির চৌদ্দো হাজার বইয়ের আলমারির পাশে বইপাঠে নিমগ্ন একাকী বালিকা।
অক্ষর, অক্ষর পেরিয়ে শব্দ, ছন্দ, উপমা, যতি, ব্যঞ্জনা, অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি আর বোধির এক আশ্চর্য আলোকিত রূপকথা জগত। পা ফেলে মেয়েটি, সন্তপর্ণে। মাকে দেখেছে তো সে ছোট থেকে, এই অজানা জগতটি থেকে ঘুরেফিরে বেরোতে। জাবদা খাতায় মুক্তোর মতন অক্ষর সাজিয়ে লিখে ফেলতে মনের কথা। কেমন যেন আলো আলো হয়ে ওঠে মায়ের মুখটা তখন। মাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, একে বলে কবিতা। অবাক হয়েছে খুব। কি আশ্চর্য, একেবারে তারই নামটি কেটে বসানো যে। লেখাগুলোকে বড় আপন মনে হয় তার। মায়ের পেটের বোনটি যেন।
সে ও লিখতে শুরু করে খাতায়। ছোট মনের ছোট, ছোট কথা। দুঃখ-ব্যথা। বয়স মোটে ছয় কি সাত। এতটুকু মেয়ে হলে হবে কি, হৃদয় আর বোধ যেন তার কত বড়। শুধু ফুল, পাখি, গাছ, নদী নয়, তাকে টানত জীবন। মানুষের জীবন। চারপাশ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া ছোট, বড় অভিজ্ঞতা। কৃত্রিম বা বানানো কোন কিছুতে তার বিশ্বাস নেই মোটে। জীবনে যা নেই, তাকে কলমে এনে কি এমন রাজ্যোদ্ধার হবে—এমনই ছিল ভাবখানি তার।
কৈশোরে কবিতার জগতে নতুন ভুবনের দরজা খুলে দিল তার কাছে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকা এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতাবলী। মেয়েটি বুঝল, তার অনেক কিছু বলার আছে। আর এই বলার একটা মাধ্যম হল তার লেখালিখি। লেখা হয়ে উঠল তার নিয়তি।
যৌবনে পা দিয়ে সে দেখল মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সামাজিক বঞ্চনা, নারী-পুরুষের বৈষম্য, ক্ষমতার রাজনীতি, পুরুষের আধিপত্যবাদী অনুশাসন। অথচ কত শান্ত, নিশ্চুপ সকলে। সমস্ত অসমতার বিরূদ্ধে গর্জে উঠল তার প্রতিবাদী কলম, সহজ, প্রত্যয়ী উচ্চারণে—
‘ না, আমি হবো না মোম
আমাকে জ্বালিয়ে ঘরে তুমি লিখবে না।

কবিতা লেখার পর বুকে শুয়ে ঘুমোতে দেব না।’

লোনাজলের ঝাপসা হয়ে যাওয়া নারীর ভেতর এই যে আরেক নারী, তার ক্ষোভ, ক্রোধ, অভিমান নিয়ে যে ‘বাসন্তী অসুখ’ তাকে তিনি চোখের ঝিনুকে নয়, ধরলেন কলমের শাণিত তরবারিতে, জলের অক্ষরে—
‘ কি নেবে দেহের থেকে? মাংস মেদ বসা?
প্রাগৈতিহাসিক অগ্নি? পোড়া মাংসের ঘ্রাণ, রক্ত-পানীয়
নখ দাঁত চুল কিংবা অন্নপাত্র দিব্য করোটি?
অথবা কি নিষ্কাশন করে নেবে প্রতিভা ও মেশিনের মিশ্র কুশলতা?

দেহের থেকে চাড় দিয়ে ক্রমাগত খুলে নেবে শিশু।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মিত আশ্রয় দাত্রী, রহস্যময়ী, পেলব নারীর সাজানো মিথকে ভেঙে বিশ শতকের আধুনিক নারীসত্তার দৃপ্ত উচ্চারণে নারীকে প্রথম প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি কলমের জোরে।
‘কবিতা পরমেশ্বরী’, কবি, সেই কবিতা সিংহকে আজ এই নারীদিবসে জানাই অন্তরের অক্ষরফুলে সশ্রদ্ধ প্রণাম। তাঁর ‘সহজসুন্দরী’- হয়ে যেন বলে উঠতে পারি আমরা একদিন—-
‘ আমি
মৃত্যুর মতন নগ্ন, অশ্বারোহিণী এক
নিজ অশ্বে একা
অহংকার ছুঁড়ে দেওয়া আরো বড় অহংকারে ধনী।'( ‘অহংকার’)

‘আমিই প্রথম বিদ্রোহিণী ‘। ( ঈশ্বরকে ইভ)

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *