ভূমিকা—-
“মহাত্মা গান্ধীর “মিকি মাউস” সরোজিনি নাইডুর মৃত্যুদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।”
সরোজিনী নায়ডু (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯ – ২ মার্চ ১৯৪৯) ছিলেন স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি। তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে সরোজিনী নাইডু অনেকবার কারাবরণ করেছেন, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পিছু হটেননি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি যোগ দেন ডান্ডি পদযাত্রায়। গান্ধী, আব্বাস তয়েব ও কস্তুরবা গান্ধী গ্রেফতার হলে তিনি ধারাসন সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাগ্মী এবং ইংরেজি ভাষার যশস্বী কবি। তিনি ভারতীয় কোকিল (দ্য নাইটেঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া) নামে পরিচিত। সরোজিনী নায়ডু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম (ভারতীয়) মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীন ভারতে তিনি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজ্যপালও হয়েছিলেন।
জন্ম ও পরিবার—
১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সরোজিনী চট্রোপাধ্যায় ভারতের হায়দরাবাদ শহরের একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি বরদাসুন্দরী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। অঘোরনাথ ছিলেন নিজাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি ও তার বন্ধু মোল্লা আব্দুল কায়ুম ছিলেন হায়দরাবাদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সদস্য। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে পদচ্যুত করে হয়। সরোজিনীর ভাই বীরেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবী।
শিক্ষা—-
সরোজিনী নাইডু ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। ১২ বছর বয়সে, তিনি ১২ তম পরীক্ষায় ভাল নম্বর নিয়ে পাস করেছিলেন। তিনি ১৩ বছর বয়সে ‘লেডি অফ দ্য লেক’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যা তাকে বিখ্যাত করেছে। স্কুলে বসে অঙ্কের ১৩০০ লাইনে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এতে হায়দ্রাবাদের নিজাম এত খুশি হয়েছিলেন যে তাকে বিদেশে পড়ার জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজে এবং পরে কেমব্রিজের গ্রিটন কলেজে পড়াশোনা করতে যান। বারো বছর বয়সে সরোজিনী মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সমগ্র মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৯১ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা বন্ধ রেখে তিনি নানা বিষয় অধ্যয়ন করেন। ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমে লন্ডনের কিংস কলেজ ও পরে কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফার্সি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। তার প্রিয় কবি ছিলেন পি. বি. শেলি।
স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ—–
সরোজিনী নাইডু গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং গান্ধীজির চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সত্যাগ্রহ ও সংগঠনে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবেও তাঁর প্রতিভা দেখিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং জেলে যান।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরোজিনী যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি গোপালকৃষ্ণ গোখলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, অ্যানি বেসান্ত, সি. পি. রামস্বামী আইয়ার, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন।
১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ভারতের নানা স্থানে যুবকল্যাণ, শ্রমের গৌরব, নারীমুক্তি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বক্তৃতাদান করেন। ১৯১৬ সালে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি চম্পারণে নীলচাষীদের হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৫ সালে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।
১৯১৯ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন জারি করে সকল প্রকার রাজদ্রোহমূলক রচনা নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করলে সরোজিনী সর্বপ্রথমেই আন্দোলনে যোগ দেন। পরে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনের উপর ব্যাপক দমননীতি প্রয়োগ করে।
১৯১৯ সালের জুলাই মাসে সরোজিনী ইংল্যান্ডে হোমরুল লিগের দূত মনোনীত হন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসের তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পর ১ অগস্ট গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করেন। ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় কংগ্রেসের দুই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিনিধির অন্যতম রূপে নির্বাচিত হন।
১৯২৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি নিউ ইয়র্ক সফর করেন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকান ও আমেরিইন্ডিয়ানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নিন্দা করেন তিনি। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৫ মে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর অনতিকাল পরেই গ্রেফতার হন সরোজিনী। এই সময় কয়েক মাস তিনি কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি, গান্ধীজির সঙ্গে সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়। সেই বছরেই পরে আবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। স্বাস্থ্যহানির কারণে অল্পদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যান সরোজিনী। গান্ধীজি মুক্তি পান ১৯৩৩ সালে। ১৯৩১ সালে গান্ধীজি ও পণ্ডিত মালব্যের সঙ্গে তিনিও গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। ১৯৪২ সালের ২ অক্টোবর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই সময় গান্ধীজির সঙ্গে ২১ মাস কারারুদ্ধ ছিলেন সরোজিনী।
মহাত্মা গান্ধী যখন স্বাধীনতা নিয়ে দেশে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল তা শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন, সেই সময় সরোজিনী নাইডু তাকে ‘শান্তি দূত’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং সহিংসতা বন্ধ করার আবেদন করেছিলেন।
মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সরোজিনী নায়ডুর সম্পর্ক এতটাই অন্তরঙ্গ ছিল গান্ধীজি তাঁকে ‘ভারত নাইটিঙ্গেল’ উপাধি দেন। কিন্তু চিঠিতে তিনি কখনো কখনো ‘প্রিয় বুলবুল’, ‘প্রিয় মীরাবাই’ এমনকি ‘আম্মাজান’, ‘মা’ও মজা করে লিখতেন। সরোজিনীও তাকে ‘তাঁতি’, ‘লিটল ম্যান’ এবং কখনো কখনো ‘মিকি মাউস’ বলে সম্বোধন করতেন।
ব্যক্তিগত জীবন—-
১৭ বছর বয়সে সরোজিনী ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নায়ডুর প্রেমে পড়েন। ১৯ বছর বয়সে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। উল্লেখ্য, সেই যুগে অসবর্ণ বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। সরোজিনী ব্রাহ্মণ হলেও গোবিন্দরাজুলু ছিলেন অব্রাহ্মণ। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে ১৮৭২ সালের আইন অনুযায়ী তাদের বিবাহ হয়। তাদের চারটি সন্তান হয়েছিল: জয়সূর্য, পদ্মজা, রণধীর ও লীলামণি। কন্যা পদ্মজা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হন।
কর্ম জীবন—-
১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে এশীয় সম্পর্ক সম্মেলনের স্টিয়ারিং কমিটির পৌরোহিত্য করেন সরোজিনী নায়ডু।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার পর সরোজিনী নায়ডু যুক্তপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যপাল নিযুক্ত হন।
তাঁর রচনাবলি—-
লেখাপড়ার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। গোল্ডেন থ্রেশহোল্ড ছিল তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাব্য সংকলন ‘সময়ের পাখি’ এবং ‘ব্রোকেন উইং’ তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়কে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা কবিদের মধ্যে অন্যতম মনে করা হয়। বিশ্বনন্দিত অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সাহিত্যিক তার সাহিত্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। পোয়েট্রি সুপ নামের একটি ওয়েবসাইট তাকে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ১০০ জন কবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেখানে তার অবস্থান ছিল ১৯তম। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফারসি ও বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। সরোজিনী নাইডু ইংরেজি ভাষায় কবিতাও লিখতেন।
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি—
The Golden Threshold (১৯০৫); The Bird of Time: Songs of Life, Death & the Spring (১৯১২); The Broken Wing: Songs of Love, Death and the Spring (১৯১৭);
The Sceptred Flute: Songs of India (১৯৪৩); The Feather of the Dawn (১৯৬১); The Gift of India;
মৃত্যু—-
স্বনামধন্য ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা, বিশিষ্ট বাগ্মী ও ইন্দো-অ্যাংলিয়ান কবি বিক্রমপুর কন্যা ভারতীয় কোকিলা সরোজিনি নাইডু ১৯৪৯ সালের আজকের দিনে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর যুগ যুগ ধরে এই অতি অসামান্য বিদুষী নারী সমগ্র মহিলাজাতির পথপ্রদর্শিকা হিসেবে সম্মানিত হযে আসছেন।
।।ছবি ও তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।