Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

একটি শিশুর বেড়ে ওঠা থেকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

আজ ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৯৪ সালকে আন্তর্জাতিক পরিবার বর্ষ ঘোষণা করেছিল। সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে একটি পরিবারের ভূমিকা কি তা আমরা সকালেই জানি। একটি শিশুর বেড়ে ওঠা থেকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবার এমন একটি সমাজিক বন্ধন যা একটি ব্যক্তিকে জীবনের চলার পথে সমূহ ঝড় ঝঞ্ঝা প্রতিহত করতে সহযোগিতা করে। তাই এ ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের ভূমিকা আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারন সুখে দুঃখে সকলকে একসঙ্গে না হোক কাউকে না কাউকে পাশে পাওয়া যায়। নিজেদের সুখ দুঃক্ষ গুলো ভাগ করে নেওয়া যায়। কিন্তু দুক্ষের বিষয় হলো এই যে  যতো দিন যাচ্ছে ততই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হচ্ছে পরিবার। কর্মের আর ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে আমরা নিজেদের ক্রমেই ভাগে ভাগে ভাগ করে নিচ্ছি। বঞ্চিত হচ্ছি, পরিবারের ছোটদের কিংবা নব প্রজন্ম কে বঞ্চিত করছি যৌথ পরিবারের আসল সুখ থেকে।

 

কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে  মনে হচ্ছে একান্নবর্তী কিংবা যৌথ পরিবারের ধারণা যেন এখন ‘সেকেলে’ হয়ে গেছে। বিশেষ করে, শহুরে জীবন ব্যবস্থায় এই ব্যাপারটি চরম আকার ধারণ করেছে। আমরা যেন ছুটে চলেছি  সুখ নামক এক অসুখের পেছনে। একা থাকব একা পরব, আমি আমার সন্তান আমার বৌ এই যেন একটা গন্ডি তৈরি করছি সকলে। কিন্তু ভুলে যাচ্ছি প্রকৃত সুখ কি সেটা ভাবতে বা বুঝতে। যৌথ পরিবারে হয়তো মতগত বিভিন্ন পার্থক্য থাকে, আর এটাই সভাবিক। কিন্তু যৌথ বা একান্নবর্তি পরিবারের মধ্যে যে সুযোগ সুবিধা গুলো থাকে সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। কিন্তু দিন দিন জেনে আমরা সেই ভাবনা থেকে সরে আসছি। এর ফলও ভুক্তে হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিবার গুলোকে। হঠাৎ অসুখ বিসুখ,  বিপদে আপদে বা বিপর্যয়ে সেই সমস্যা গুলো প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা বুঝি না প্রতিটা অনু পরিবারও একদিন বড় হবে। সন্তান বড় হবে, তার বিয়ে হবে, তার সন্তান হবে এই ভাবেই। আর, আমরা কেবল ভাংতেই আছি!!

 

আমরা জানি পরিবার মানেই হচ্ছে মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দিদি, দাদু, দিদা, কাকা, কাকি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসবাস।  আমাদের সমাজব্যবস্থায় পরিবারের এই ধারণা প্রচলিত অতীত থেকেই। কিন্তু দিন যতোই যাচ্ছে, আমরা যেন ততোই এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছি। যেন ক্রমেই ‘স্বামী-স্ত্রী-সন্তানে’ই সীমাবদ্ধ করে ফেলছি আমরা পরিবারকে। সেখানে মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদীর কোন স্থান নেই। মা-বাবাকে হয়তো গ্রামের বাড়িতে কাটাতে হচ্ছে নিঃসঙ্গ-অসহায় জীবন। আবার অনেক মা-বাবার ঠিকানা হচ্ছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’। এর থেকে বড় যান্ত্রনার অর কি হতে পারে ! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একান্নবর্তী কিংবা যৌথ পরিবারের ধারণা যেন এখন ‘সেকেলে’ হয়ে গেছে। বিশেষ করে, শহুরে জীবন ব্যবস্থায় এই ব্যাপারটি চরম আকার ধারণ করেছে।  রক্তের বন্ধন মানেই পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে অকৃত্রিম সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তা অটুট রাখা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থায় সুন্দর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, সুন্দর পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুর মতো হলে পারিবারিক নানা জটিল সমস্যা ও মোকাবেলা করা যায়। সকলের এগিয়ে চলার পথ হয় মসৃণ।  তাই যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

 

তবে সুপ্রাচীন কাল থেকে যে যৌথ পরিবারে চিত্র সারাবাংলা জুড়ে ছিল এখন তা অনেকটাই ম্লান। শহুরে জীবনে অনেক আগেই বিলীন হয়েছে যৌথ পরিবারের চিত্র। আগে গ্রামে কিছু যৌথ পরিবার দেখা গেলেও এখন তাও নেই। কেউ ইচ্ছে করে কিংবা কেউ কর্মের তাগিদে ভেঙে দিচ্ছে যৌথ পরিবারের ধারনা গুলো। বংশ মর্যাদা এমনকি ঐতিহ্যের পরিবারেও বিলীন একত্রে বাস করার ইতিহাস। যা দেখতে এক সময় মনুষ অভ্যস্থ ছিল তা এখন স্বপনের মতন। হয়তো সিনেমার পর্দায় কেবল ভেসে ওঠবে গল্পের মতো অতিতের ইতিহাস।

নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কির মতে – “পরিবার হল একটি গোষ্ঠী বা সংগঠন আর বিবাহ হল সন্তান উৎপাদন ও পালনের একটি চুক্তি মাত্র”। সামনার ও কেলারের মতে- ‘পরিবার হল ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠন, যা কমপক্ষে দু’ পুরুষকাল পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে”- এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে বোঝা যায়, বিবাহপ্রথার আগেও সমাজে পরিবারের সৃষ্টি হয়েছিল- কারণ এ সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই মানুষ দলবদ্ধ জীবনযাত্রা করত যা পারিবারিক জীবনযাপনের স্বাক্ষরবহ। তবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতির পরিবারের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পরিলক্ষিত হয়। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ নানামুখী ধারা যে কারণে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে এর গঠন ও অন্যান্য অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। যে শিশুটি ভবিষ্যতের নাগরিক, তার মনোজগত প্রস্তুত হয় পরিবারে। পরিবারের ধারা কেমন, কী ধরনের প্রথা-রীতিনীতি, এ সবের উপর ভিত্তি করে তার জীবনভঙ্গি গড়ে ওঠে। তাই শিশুর সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষা শৈশব তথা শিশুর মন তথা সাদা কাগজের পাতায় যে ছাপ রাখে, তা ওর পরবর্তী জীবনে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু সংবিধান আছে তেমনি পারিবারিক সংবিধানও থাকা দরকার। যেমন পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যে না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা, মিথ্যেকে ঘৃণা করা এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোর চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সমাজে প্রচলিত যৌথ পরিবারে পারস্পরিক সম্প্রীতি গভীর হয়, অটুট থাকে। অসুখ বিসুখসহ নানা সমস্যায় একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এতে অনেক বড় সমস্যাও সমাধান হয়ে যায় অতি সহজে। সময়ের তাগিদে যৌথ পরিবার কিংবা পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখার বিষয়টি যখন এই সমাজে ক্রমান্বয়ে গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আজকের এই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। আসুন আমরা সেই ভাবনাকে বুকে নিয়ে আবার একি সূত্রে আবদ্ধ হই ।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

 

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *