Categories
প্রবন্ধ

গুরুতত্ত্বে-র গূঢ় রহস্য : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীমন্ মহাপ্রভু রায় রামানন্দের কাছে জানতে চেয়েছিলেন — “বিদ্যার মধ্যে কোন্ বিদ্যা জীবের হয় সার ?” বিদ্যা শব্দটি “বিদ্‌’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘জানা’। আর সার অর্থে শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ তিনি জানতে চাইলেন কী বা কাকে জানা শ্রেষ্ঠ? তখন ‘রায় কহে, ভক্তি বিনা বিদ্যা নাহি আর। ভক্তি বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ।” ভক্তিকে জানাই সর্বোত্তম বিদ্যা। ভক্তি কি? ভক্তি অর্থাৎ ভজনা। অতএব, ভগবানকে ভজনা করতে জানাই হল শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। এ পৃথিবীতে যে কোন ধরণের শিক্ষার জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। এমনকি যা আমরা প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে বা অনুভবের দ্বারা শিখি তাও এ সংসারে কারো না কারো প্রেরণা বা অবদান। তাহলে জাগতিক বিদ্যা শিক্ষা করতে যখন শিক্ষকের প্রয়োজন তখন ভক্তিবিদ্যা বা পরাবিদ্যার মতো গম্ভীর বিষয়কে জানার জন্য, শেখার জন্যও একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। এই শিক্ষকই হলেন ‘গুরু’। গুরু শব্দটি ‘গুড়’ ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘রক্ষা করা’। যিনি সংসার মহাদাবাগ্নি থেকে রক্ষা করেন তিনিই গুরু। ‘গু’অর্থ ‘অন্ধকার’, ‘রু’ অর্থ ‘দূর করা’। যিনি অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে দেন তিনিই গুরু। গুরু অর্থে ‘হিতকারী’। গুরু অর্থে ‘উপদেষ্টা’। কথিত আছে— “এক অক্ষর শিখায় যে, জন্মে জন্মে গুরু সে।” আবার গুরু অর্থ ভারীও হয়। অতএব এই যে, ‘গুরুতত্ত্ব’ তা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, গূঢ়, ও রহস্যময় বিষয়ও।

আমাদের জীবনে গুরুর প্রয়োজন কতটা? গুরু বিনা কি গতি নেই? ভগবানকে মন থেকে ডাকলে, ভক্তি করলেই তো চলে, তার জন্য আবার গুরুর কি দরকার—এ প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনেই। তাহলে সেই উত্তর স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকেই আমরা শুনি। তিনি বলেছেন – ভবসমুদ্র পাড় করতে মানব- শরীর হল এক সুদৃঢ় নৌকা। যা প্রাপ্ত হওয়া দুর্লভ। সেই দুর্লভ বস্তু সুলভ হয়ে যখন কেউ মনুষ্য যোনিতে জন্মগ্রহণ করে; গুরু-কে তার জীবন সমুদ্র পথের কাণ্ডারী নিযুক্ত করে; তখন শুধুমাত্র স্মরণ করা মাত্রই আমি অনুকুল বায়ু হয়ে তাকে লক্ষ্যপথে নিয়ে যাই। আর যে তা করে না, সে নিজের আত্মহননের পথ প্রশস্ত করে। তার অধঃপতনের জন্য সে নিজেই দায়ী হয়।’ (শ্রীমদ্ ভা.-১১/১০/১৭)।

অতএব ভগবানের কথা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ভবসমুদ্র পার করতে গুরুর চরণাশ্রয় করলেই ভগবান ভক্তের উদ্ধারের জন্য নিজের হাতখানা বাড়িয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে, শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলেন বালক ‘ধ্রুব’ মহারাজ। তপঃকর্মের শেষ সীমায় পৌঁছালেও বালক ধ্রুব-কে দর্শন দিতে পারছিলেন না শ্রীনারায়ণ। তখন শ্রীভগবানের আদেশে নারদ মুনি ধ্রুবকে দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্রে দীক্ষা দান করলেন। দীক্ষিত হাবর পর ধ্রুব শ্রীনারায়ণের সাক্ষাৎ দর্শনের কৃপালাভ করলেন। তাই গুরুর যে কী গুরুত্ব তা সহজেই অনুমেয়। কলিযুগ পাবনাবতার শ্রীমন্ মহাপ্রভু নিজে পরতত্ত্বের শেষ সীমা হয়েও শ্রীঈশ্বরপুরীপাদের কাছে দীক্ষা নিয়ে গুরুকরণ করে দেখিয়েছেন গুরুর প্রয়োজনীয়তা। দীক্ষা কি? জীব গোস্বামীপাদ তাঁর ‘ভক্তিসন্দর্ভ’ গ্রন্থে বলেছেন—‘যা থেকে দিব্যজ্ঞান লাভ হয় ও পাপসমূহ সম্যকরূপে নষ্ট হয় তাই দীক্ষা।’ (২৮৩ অনুঃ)। এখন এই দিব্যজ্ঞান হাটে-বাজারে বিকোবার বস্তু নয় যে গিয়ে ক্রয় করবো । বা, গ্রন্থ পড়ে জ্ঞানার্জনের দ্বারাও শুধু লাভ হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে একমাত্র উপায়—‘শ্রীগুরুদেব’। শ্রীগুরুদেব ভিন্ন অন্য কেউ দীক্ষাদান করতে পারেন না। বা ঘুরিয়ে বললে, যিনি দীক্ষা দান করেন তিনিই শ্রীগুরুদেব। “অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকায়। চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।” অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে দীক্ষা নামক দিব্যজ্ঞানের অঞ্জনশলাকা দ্বারা যিনি জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন করেন, তিনিই শ্রীগুরুদেব, তাঁকে প্রণাম করি।

শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ তাঁর ‘শ্রীভক্তিরসামৃত সিন্ধু’ গ্রন্থে যে চৌষট্টি প্রকার ভজন অঙ্গের নির্দেশ করেছেন তার প্রারম্ভেই ভক্তি মন্দিরে প্রবেশের দ্বারস্বরূপ তিনটি বিশেষ অঙ্গের কথা লিখেছেন—১) গুরুপদাশ্রয়, ২) শ্রীকৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে ভাগবত ধর্ম শিক্ষা, ও ৩) বিশ্বাসের সঙ্গে শ্রীগুরুসেবা। শ্রীগুরুপদাশ্রয় বলতে দীক্ষাগ্রহণের পূর্বে কিছুকাল শ্রীগুরুদেবের কাছে বাস করে তাঁর আনুগত্যে থেকে নিষ্কপট সেবা পরিচর্যা দ্বারা গুরুদেবকে প্রসন্ন করা-কে বোঝানো হয়েছে। এর ফলে গুরু ও শিষ্য একে অপরকে অনুধাবন করতে পারেন। শিষ্য দীক্ষাগ্রহণের যোগ্যতা ও ভজনযোগ্যতা লাভ করে। আবার শিষ্যের সেবার আন্তরিকতা দেখে গুরুদেবের চিত্ত করুণার্দ্র হয়ে ওঠে। আর তার ফলে করুণা বিগলিত ও সন্তুষ্ট শ্রীগুরুদেবের কাছ থেকে পাওয়া দীক্ষামন্ত্র পরম পুরুষার্থ ও সৌভাগ্যজনক হয় শিষ্যের কাছে। এ প্রসঙ্গে ঠাকুর নরোত্তমের দৃষ্টান্ত প্রাতঃস্মরণীয় আমাদের কাছে। শ্রীল লোকনাথ গোস্বামী সংকল্প করেছিলেন যে তিনি জীবনে কোন শিষ্য গ্রহণ করবেন না। আর ঠাকুর নরোত্তম তাঁকেই মনে মনে গুরুরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। তাই তাঁর থেকে দীক্ষাগ্রহণ করাটাই ছিল নরোত্তম ঠাকুরের অভীষ্ট। তিনি প্রতিদিন লোকনাথ প্রভুর প্রাতঃকৃত্য করার স্থানটি সূর্যোদয়ের আগেই মার্জন করে পরিস্কার করে রাখতেন। আর তারপর “বৈষ্ণবের দেহ প্রাকৃত কভু নয়। অপ্রাকৃত দেহ ভক্তের চিদানন্দময় ।।” এই জ্ঞানে লোকনাথ প্রভুর বিষ্ঠাকেও অপ্রাকৃত বস্তু হিসেবে মেনে সেই বিষ্ঠালাগানো সম্মার্জনীটি (ঝাঁটাটি) নিজের বুকে চেপে ধরে ‘হা গুরুদেব’ বলে ক্রন্দন করতেন। এদিকে লোকনাথ গোস্বামী মনে মনে সংকুচিত হন, এই ভেবে যে— কোন ব্রজবাসী এমন সেবা করে প্রতিদিন তার জন্য ! এতে যে তার পাপ হচ্ছে !

দীর্ঘ এক বৎসর পর বহু চেষ্টা করে লোকনাথ গোস্বামী একদিন হাতে-নাতে ধরলেন নরোত্তম ঠাকুরকে, অমন হীনসেবা দানের সময়। বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন নরোত্তম ঠাকুরের গুরুভক্তি দেখে। সেই দিনই নিজের সংকল্প ত্যাগ করে দীক্ষা দিলেন নরোত্তম ঠাকুরকে।

“গুরুকৃপা হি কেবলম্”—গুরুকৃপাই শিষ্যকে নিতাই-গৌর-গোবিন্দের প্রতি একনিষ্ঠ প্রেমসেবায় ব্রতী করেন। শ্রীললিতা সখী মাতা ঠাকুরাণী বলেছেন— “শ্রীগুরুকৃপাই সাধনভক্তি, ভাবভক্তি ও প্রেমভক্তির মূল।” তাই গুরুসেবা দ্বারা গুরুপ্রসন্নতা অর্জন করা একান্তরূপে বাঞ্ছনীয় এবং চরম ও পরম কর্তব্য শিষ্যের কাছে। গুরুসেবা দুই প্রকার—১) পরিচর্যারূপ সেবা ও ২) প্রসঙ্গরূপ সেবা। শ্রীগুরুদেবকে জলপ্রসাদ বা ভোজ্যপ্রসাদ নিবেদন, স্নানাদির জন্য জল আহরণ, তাঁর শ্রীঅঙ্গমার্জন, বস্ত্রধৌতাদি, অথবা অসুস্থ থাকাকালীন পথ্যাদি দান, শ্রীঅঙ্গের সেবা ইত্যাদি হল পরিচর্যারূপ সেবা তাঁর। আর, ভাগবতী কথা পাঠ করে , কৃষ্ণনামগান কীৰ্ত্তন করে শ্রবণ করানো—- ইত্যাদি হল প্রসঙ্গরূপ সেবা। শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী যখন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন তখন শ্রীঈশ্বরপুরী তাঁর কতই না সেবা করেছেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে পাই—“ঈশ্বরপুরী গোসাঞি করে শ্রীপাদ সেবন। স্বহস্তে করেন মল-মূত্ৰাদি মার্জন।।’ অতএব নিষ্ঠসহ পরিচর্যারূপ সেবা করেছেন। আবার “কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণলীলা শুনায় অনুক্ষণ।” কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণকথা শ্রবণ করিয়ে প্রসঙ্গরূপ সেবাও করেছেন। সেবায় সন্তুষ্ট গুরু শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী আশীর্বাদ করলেন শিষ্য ঈশ্বরপুরীকে “তোমার হোক কৃষ্ণের প্রসাদ।” সেই আশীর্বাদের গুণেই প্রেমের সাগর হলেন তিনি আর পরিণামে স্বয়ং ভগবান শ্রীমন্ মহাপ্রভুকে শিষ্যরূপে পেলেন। অতএব, দীক্ষাগ্রহণান্তে শ্রীগুরুসেবার বিশেষ প্রয়োজন। সেবা দ্বারা সাধকের সকল অনর্থ নষ্ট হয়ে যায়। সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্তশুদ্ধির উপায় ‘শ্রীগুরুদেব’। সকল অভাব পূরণের উপায় ‘শ্রীগুরুদেব’। সিদ্ধ জগন্নাথ দাস বাবার শিষ্য তথা শ্রীঅঙ্গসেবক বিহারীজী গুরুচরণ-ছাড়া-না হবার আদর্শ। জগন্নাথ দাস বাবা বলেছিলেন— “হ্যাঁ রে বিহারী ! তুই আমায় চাস, নাকি টাকা চাস? ভেবে বল। ভাবছি তোকে একগাড়ী টাকা পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করে যাব আমার মৃত্যুর পরে।” বিহারী হাসতে হাসতে বললেন- “বাবা। তোমার আবার টাকা কই গো ! থাকো তো লোকের দয়া করে তৈরী করে দেওয়া কুটীরে, আর ভিক্ষা করে আনা চালে ঠাকুরের প্রসাদান্ন পাও। তুমি কোথায় টাকা পাবে, বল?” সিদ্ধ বাবা বললেন, “আমায় কয়েকদিন পরই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিতে আসবেন। তখন আমি বলবো তাঁকে— বিহারী তো আমার অনেক সেবা করেছে, ওকে এক গাড়ী টাকা পাইয়ে দাও। গৌরাঙ্গ প্রভু তোর টাকার ব্যবস্থা করে দেবেন।” এইবার বিহারী সঙ্গে সঙ্গে বললেন- “না, না বাবা ! টাকা আমার চাই না, আমার শুধু তোমার শ্রীচরণ চাই।” তৃপ্ত হয়ে বাবা তখন আশীর্বাদ করে বললেন, “বেশ। তোর কোনদিন কোন অভাব হবে না। তুই শুধু শ্রীনাম করে যাস, বাকী সব শ্রীনামের প্রভাবে ঠিক হয়ে যাবে।” এই ঘটনার চারদিন পরই সিদ্ধ বাবা দেহ রাখলেন। তিনি ১৪০ বৎসর ধরাধামে ছিলেন। তাঁর নিত্যলীলায় গমনের পর বিহারীই তাঁর যাবতীয় ক্রিয়া-কর্ম করলেন। সুতরাং, শ্রীগুরুচরণ প্রাপ্তিই একমাত্র লক্ষ্য হয় যথার্থ সাধকের।

“দাস বংশী কহে, ভজিলে ভজন নহে, গুরকৃপা ভজনের মূল।” শ্রীগুরুস্বরূপের চিন্তনই হল ধ্যানের মূল, পূজার মূল শ্রীগুরুচরণ পূজা, মন্ত্রের মূল শ্রীগুরুবাক্য আর ভক্তির মূল হল শ্রীগুরুভক্তি। যার প্রতি গুরুদেব তুষ্ট হন, স্বয়ং শ্রীহরিও তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। কৃষ্ণ অপ্রসন্ন হলে গুরুদেব তাঁর ভজন দ্বারা কৃষ্ণের মন ফেরাতে পারেন সেই শিষ্যের প্রতি। কিন্তু গুরু অসন্তুষ্ট হলে, কৃষ্ণ গুরুকে প্রসন্ন করতে কোন চেষ্টা করেন না। তাই তো বলা হয়েছে, “কৃষ্ণ রুষ্ট হলে গুরু রাখিবারে পারে। গুরু রুষ্ট হলে কৃষ্ণ রাখিবারে নারে।।’
তাহলে এমন মহিমাময় গুরুদেবকে কী ভগবৎস্বরূপ জ্ঞান করে গঙ্গাজল-তুলসী দিয়ে পূজা করা উচিৎ? কারণ বলা হয়েছে— “গুরু কৃষ্ণরূপ হন শাস্ত্রের প্রমাণে । গুরুরূপে কৃপা করেন শিষ্যগণে।।” তবে তার উত্তর হল, গুরু কেবল শিষ্যের কাছে আরাধ্যস্বরূপ, সমগ্র জগৎ-এর কাছে নন। তিনি শিষ্যের কাছে প্রিয়তমাংশে ও পূজাতমাংশে কৃষ্ণের সাথে অভিন্ন কিন্তু স্বরূপাংশে ভিন্ন। অর্থাৎ শিষ্যের কাছে গুরুদেব কৃষ্ণের মতই প্রিয় ও পূজনীয়, কিন্তু ভগবানের ষড়শ্বৈর্যশালী যে স্বরূপ তা গুরুতে নেই। গুরুর ভিতর সাধক-ভক্ত ভবন প্রকাশিত হয়। তিনি নিজেকে একজন সাধক ভিন্ন অন্য কিছু ভাবেন না। তাই তাঁর শ্রীচরণে তুলসী-গঙ্গাজল নিবেদন করে কৃষ্ণজ্ঞানে পূজা করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন। এ প্রসঙ্গে, উৎকলে ‘বড়বাবাজী’ নামে খ্যাত শ্রীরাধারমণচরণদাস বাবা অপূর্ব সিদ্ধান্ত করে গেছেন।
একবার শ্রীগুরুপূর্ণিমায় পুরীর ঝাঁজপিটা মঠে উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে সংশয় দেখা দেয় যে, শ্রীগুরুদেব কে কী পৃথক দ্রব্য দিয়ে পূজা করা উচিৎ নাকি প্রসাদী দ্রব্যে পূজা করা সঙ্গত? কারণ শাস্ত্রে গুরু-কৃষ্ণের অভিন্নতার প্রমাণ আছে বিস্তর। তাই সর্বাগ্রে গুরুপূজা করা উচিৎ। এমনকি কোথাও বলাও নেই যে কৃষ্ণের প্রসাদী দ্রব্যে তাঁকে ভোগ লাগানো বা পূজা করা বিধেয়। তাহলে উপায়? তখন বড়বাবাজী মহাশয় বললেন— “শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রদর্শিত উপাসনা প্রণালীর নাম রাগানুগা পন্থা। এই উপাসনার মূল ভিত্তিই ‘আনুগত্য’ অর্থাৎ গুরুর অনুগত হয়ে ভজন। এমন গুরুকে সাক্ষাৎ ভগবদ্‌-বুদ্ধিতে পূজা করলে উনি যতটা সুখী হন তার থেকে বেশী সুখ পান অনুগত ভাবের আরাধনায়। অর্থাৎ কৃষ্ণের প্রাসদী থালায় তাঁকে বরণ করলে। কারণ তিনি তো নিজেও সাধক। আর তাই শিষ্যের কাছে ‘সকল ছাড়িয়া আজ্ঞা বলবান’ অর্থাৎ গুরুর আজ্ঞানুসারে কর্ম করাই শিষ্যের কর্ত্তব্য । সেবার অর্থ তো সুখ দেওয়া। আমি হয়তো সাক্ষাৎ কৃষ্ণ ভেবে গুরুকে সেবা-পূজা করলাম অনেক কিন্তু তাতে তিনি সুখী হলেন না। তাহলে সেই সেবা করে আমি নিজেও সুখলাভ করতে পারবো কী? শাস্ত্রে প্রমাণ ও যুক্তি যাই থাক শিষ্যের কাছে গুরু আজ্ঞাই সর্বথা পালনীয়। তাই গুরুসেবা করে গুরুকে সুখ দিতে কৃষ্ণের মালা, প্রসাদে গুরুপূজা করাটাই বিধেয়, সমুচিত।”

শ্রীপাদ রামদাস বাবাজী মহাশয় বলেছেন যে— “শ্রীগুরু পাদপদ্মই হলেন শেষ প্রাপ্তি। নিতাই-গৌর বা অন্য যা কিছুর সেবা সকলই তাঁর (গুরুদেবের) সুখের জন্য। শ্রীগুরদেবকে সুখ দিতে হলে তিনি যা পেলে সুখ পাবেন তাই দিতে হবে। সেবা মানে নিজে সুখ পাওয়া নয়। সেব্যকে সুখ দিয়ে, তাঁরই সুখে নিজে সুখ পাওয়া। এ সুখ পাওয়া নিজের সুখ পাওয়ার চেয়ে কোটিগুণ বেশি …. সেবকের তো ওই ভজন-সাধন, সর্বদা শ্রীগুরুদেবের সুখের পানে ও মুখের পানে চেয়ে থাকা।”

শ্রীরাধারমণদেবের অশেষ কৃপাস্নাত সবিশেষ গুরুগতপ্রাণ শিষ্য শ্রীশীতলচরণ দাস বাবাজী মহাশয় সিদ্ধ মহাত্মা ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে সাক্ষাৎকালে একবার প্রশ্ন করেছিলেন—‘ঈশ্বর দর্শন করতে শ্রীগুরুর কৃপালাভ কতটা অপরিহার্য?’ ত্রৈলঙ্গ স্বামীজী হিন্দীতে যে উত্তর দিয়েছিলেন তার বাংলা অনুবাদ করলে হয়— “জগতে শ্রীগুরু হতে আর কোন বস্তুই বড় অর্থাৎ গুরু নয়। শ্রীগুরু ব্যতীত আর সকলই লঘু। জপ-তপ-আরাধনা, পুত্র-পরিবার- সংসার—-এ সবই শ্রীগুরুচরণলাভের চেয়ে বড় নয়। সাধারণভাবে শ্রীগুরুদেব দুইভাবে পাওয়া যায়—দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু। আবার বিশেষভাবে গুরুকে তিনভাবে দর্শনলাভ হয়—জগৎগুরু, দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু। চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রাদি যে শক্তির ইঙ্গিতে নিরন্তর আপন কার্য সমাধা করে চলেছে নিয়মের গণ্ডীতে থেকে—– সে শক্তিকে জগদগুরু বলা যায়।
যখন কোন শক্তি জীবের হৃদয়ে জগদ্‌গুরুকে জানবার বা বোঝার জন্য প্রেরণা জাগিয়ে জগৎগুরুর পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তখন সেই শক্তিকে দীক্ষাগুরুর শক্তি বলা হয়। এই বিশ্বচরাচর হচ্ছে জগদ্গুরুর মায়াজাল। ব্রহ্মাণ্ডের পরমানু থেকে ব্রহ্মা পর্যন্ত পশুপাথী, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতা, গ্রহনক্ষত্র প্রভৃতি মনুষ্য ও মনুষ্যেতর জীবজগত থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করার প্রয়োজন পরে। যার কাছ হতে সেই শিক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে পাওয়া যায়, তখন তাঁকে বা সেই শক্তিকে শিক্ষাগুরুর শক্তির প্রভাব বলা যায়। জগদ্গুরুকে জানতে শিক্ষাগুরুর প্রয়োজন অপরিহার্য।”

অতএব, ‘গুরুকৃপা হি মূলম্’ গুরুকৃপাই মূল, গুরুকৃপাই একমাত্র সহায়, একমাত্র অবলম্বন । শ্রীগুরুদেব নির্দেশিত পথে নববিধা ভক্তি (শ্রবণ, কীৰ্ত্তন, স্মরণাদি …) যাজন করে আমরা নিতাই-গৌর-গোবিন্দের প্রেমসেবা করার যোগ্যতা অর্জন করবো। ভজনরাজ্যে প্রবেশ করিয়ে দেন ভক্ত-কে তাঁর গুরুদেব আপন ভজনানুভূতির শিক্ষা ও সকরুণ কৃপা দ্বারা। গুরুকৃপাতেই ভজনপথ হয় সুসংহত, শাস্ত্রানুযায়ী সঠিক ও প্রেমপূর্ণ।

কলিযুগে আমাদের জগদ্গুরু হলেন পতিত উদ্ধারণ শ্রীমন্ নিত্যানন্দ প্রভু। তাইতো শ্রীরামদাস বাবাজী মহাশয় বলেছেন , “যত দেখ শ্রীগুরুরূপ, নিত্যানন্দ প্রকাশ-স্বরূপ।… দেখে গুরু স্বরূপ নানা, যেন ভিনু ভিনু মনে করো – না ! অনুকূলে বা প্রতিকূলে নিতাই অনন্ত গুরুরূপে।…নিতাই যেখানে যেমন সেখানে তেমন, যে যেমন তার কাছে তেমন।…যেদিন শ্রীগুরুরূপে হাত ধরেছে, সেদিন সাধন শেষ হয়েছে। গুরুরূপে দেছে পদছায়া, শেষ হয়েছে সব চাওয়া পাওয়া । …. কাজ কি অন্য উপাসনা, আমার কাজ তাঁর পদে বিকানা।”

তাই একান্ত নিবেদন, শ্রীগুরুতত্ত্বের’র মতো গূঢ় গম্ভীর গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব নিয়ে লেখার চেষ্টা আমার মত ভজনহীনা, অধমার ধৃষ্টতা—বই আর কিছু নয়। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো! “বিধি কী এ সাধ পূরাবে আমার।” সাধ্যের বাইরে গিয়ে সাধপূরণ করার আস্ফালন শুধু। সকল গুরুজন তথা গুণীজন, সাধু-গুরু-বৈষ্ণবের কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থিনী, এ হেন ধৃষ্টতার জন্য। আর সেই সাথে সকলের শ্রীচরণে অনন্তকোটি প্রণাম নিবেদন করে আশীর্বাদ ভিক্ষা করি যেন গুরু-গোবিন্দের চরণারবিন্দে সেবা করাই জন্মজন্মান্তরের একমাত্র অভীষ্ট হয় আমার।

জয় শ্রীগুরুদেব। জয় শ্রীশ্রীনিতাই। জয় শ্রীশ্রীগৌরসুন্দর ।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *