Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস কেন পালিত হয় এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানুন।

জৈবিক বৈচিত্র্যের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস প্রতি বছর 22শে মে পালিত হয়। আজ (সোমবার) আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। প্রকৃতিতে, পাখি ও জন্তু থেকে শুরু করে ফুল, পাখি, মাছ ও কীটপতঙ্গ, রঙিন গাছপালা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র জীবাণু পর্যন্ত সবকিছু নিয়েই আমাদের এই রঙিন এবং সুন্দর পৃথিবী। জীববৈচিত্র্য বিষয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য এটি পালন করা হয়। এই তারিখটি ২২শে মে ১৯৯২ সালে নাইরোবিতে জৈবিক বৈচিত্র্য সংক্রান্ত সম্মেলনের সম্মত পাঠ গ্রহণের তারিখকে স্মরণ করে।

 

বন্যপ্রাণীর পরিবেশে দারুন প্রভাব রয়েছে। বাস্তুতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এদেরকে বাদ দিয়ে জীবণ সম্পূর্ন্য হয় না। আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে একে অপরের ওপরে নির্ভরশীল। এদের ছাড়া জীবন বৃত্ত যে অসম্পূরান তা আজ আমরা ওনেকটাই উপলব্ধি করতে পারছি। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কোটি কোটি মানুষ খাদ্য, শক্তি, উপকরণ, ওষুধ, চিত্তবিনোদন, অনুপ্রেরণা এবং মানুষের কল্যাণে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বন্য প্রজাতির ব্যবহার থেকে প্রতিদিন উপকৃত হয়। ত্বরান্বিত বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য সংকট, এক মিলিয়ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিলুপ্তির মুখোমুখি। এর ফলে প্রকৃতি তার বৈষম্য হারিয়ে ফেলছে।

 

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ডে (ডব্লিউডব্লিউডি) হল অনেক সুন্দর এবং বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ উদযাপনের একটি সুযোগ এবং তাদের সংরক্ষণ মানুষের জন্য যে উপকারিতা প্রদান করে সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে।  একই সময়ে, দিবসটি আমাদেরকে বন্যপ্রাণী অপরাধ এবং মানব-প্ররোচিত প্রজাতির হ্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করার জরুরি প্রয়োজনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার ব্যাপক অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব রয়েছে। মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সেবার উৎস হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জীবের জীন, প্রজাতি ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা তথা ইকোসিস্টেম সমূহের প্রকারভেদ। পৃথিবীর জৈব-বৈচিত্র্য জেনেটিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক, বিনোদনগত ও সৌন্দৰ্য্যগত বিভিন্ন দিক থেকে অতি মূল্যবান। প্রাণের ক্রম বিবর্তন এবং পৃথিবীতে জীবের বিকাশ লাভের ক্ষেত্রে জৈব-বৈচিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য, ঔষধ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার অতি গুরুত্বপূর্ণ অথচ জীববৈচিত্রের প্রতি মানুষেরই বিরূপ কর্মকাণ্ড যেভাবে অবাধে চলছে তাতে আশংকা হচ্ছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে ২০-২৫% প্রাণী ও উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। তাই জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ও যথার্থ ব্যবহারে তৎপর হওয়ার আহবানেই হচ্ছে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস পালন। বিশ শতকের ৭০-এর দশক থেকে খাদ্য-বস্ত্রসহ মানুষের নানান ধারার চাহিদার পরিসর বিস্তৃত হওয়ার কারণে লাখ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ১৫ হাজার তথ্য সূত্র নিয়ে ৩ বছরের গবেষণা শেষে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ‘সামারি ফর দ্য পলিসিমেকার’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনের সারমর্ম। ৪০ পৃষ্ঠার সেই সংক্ষেপ হাজির করতে গিয়ে বলা হয়েছে, মানবজাতি কীভাবে নিজেদের ‘একমাত্র বাড়ি’-কে ধ্বংস করছে; এটাই তার সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল।
প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, স্থল, জল কিংবা আকাশ; সবখানেই মানুষের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে বিভিন্ন প্রজাতি। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসের ১৮০০ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০ লাখ প্রাণী বিলুপ্তির হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়, প্রাণী জগতের ২৫ ভাগ প্রজাতিই মানুষের কারণে বিপন্নতার মধ্যে রয়েছে।

 

তাই জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে  ১৯৯৩ সালের শেষদিকে দিবসটি পালনের জন্য ২৯ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশ এ দিবস পালন বন্ধ করে দিলে ২০০২ সালের ২২ মে দিবসটি পুনর্নির্ধারণ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। তখন থেকে প্রতিবছর ২২ শে মে এ দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে।

মূলত ১৯৯২ সালের ২২ মে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কনভেনশনে দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

মানুষের অপরিণামদশী কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্য হারে অবাধে সংকুচিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাসীর উদ্বেগের প্রেক্ষিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং তার টেকসই ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে ১৯৯২ সালে জীববৈচিত্র্য কনভেনশন নামে একটি আন্তর্জাতিক দলিল চূড়ান্ত করা হয়। বর্তমানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৯৫ টি।

 

দিন দিন রুক্ষ হচ্ছে প্রকৃতি। সময় ও সময়ের গতি ক্রমশ ভিন্ন খাতে বহিছে। আগের সেই প্রকৃতির ধারা সম ভাবে প্রবাহমান নয়। চারদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নদীভাঙন, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, বহু বন্য প্রাণীর সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাওয়া—সব মিলিয়ে এবার দিবসটি বাড়তি গুরুত্ব বহন করছে। সেই শূন্যতা যাতে ভবিষ্যতে আর বৃদ্ধি না ঘটিয়ে বিপর্যয় না ডেকে আনে তার গুরুত্ব তুলে ধরতে দিনটি পালিত হচ্ছে এই লক্ষে।জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ২২ মে দিনটি বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে।

।।তাত্থ্য ও ছবি : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
গল্প প্রবন্ধ

মহাপ্রভুর বিশ্বরূপ দর্শন দান : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

সর্বাবতারী নদিয়াবিহারী শ্রীশ্রীগৌরহরি নদীয়ার নবদ্বীপে সর্বদা কীর্তনবিলাস করে চলেছেন । নগরে, চত্বরে, জলে, বনে—-যেখানেই তিনি কৃষ্ণনাম শ্রবণ করেন অমনি নিরবধি তাঁর শ্রীনয়ন দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যায় । নবদ্বীপের ভক্তসমাজ তাঁর দশা দেখে বলেন, বিশ্বম্ভর রায় যে ভক্তিরসময় হয়ে গেছেন ! নিমাই পণ্ডিত কারোর মুখে ‘হরি’ শব্দ শ্রবণ করলেই নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না আর । অশ্রু-কম্প-পুলক-বৈবর্ণ‍্য আদি অষ্ট সাত্ত্বিক ভাবের প্রকাশ হয় সর্বাঙ্গে তাঁর । ধূলায় বিলুন্ঠিত হন, গড়াগড়ি যান । যে আবেশ দর্শন করলে ব্রহ্মাদি দেবতারা পর্যন্ত ধন্য হন —-সেই দেবদুর্লভ দর্শন সৌভাগ্যবান নদীয়াবাসী লাভ করেন ।
একদিন কীর্তনবিলাসী গৌরের ভাবেতে মূর্ছাগ্রস্ত অবস্থা এমন । পার্ষদরা তাঁকে নিয়ে চলে এলেন তাই গৃহে । দ্বার দিয়ে শুরু করলেন কীর্তন । অনন্ত ভাব প্রকট তখন তাঁর অন্তরে । নির্দিষ্ট কোন রসে, কোন ভাবে তিনি যে বিহ্বল হয়ে আছেন —-তা কেউ অনুধাবন করতে পারেন না । কখনও তিনি বলছেন —-“আমিই তো মদনগোপাল,” কখনও বলছেন—- “আমি সর্বকালের কৃষ্ণদাস,” আবার কখনও “গোপী !গোপী !গোপী!” বলে জপ করেন । কখনও কৃষ্ণের নাম শ্রবণ করে কেঁপে ওঠেন তেজে ; বলতে থাকেন—- “কোথাকার কৃষ্ণ তোর ! সে তো মহাদস্যু ! শঠ, ধৃষ্ট কৈতব একজন ! কে তাকে ভজনা করবে শুনি ! নারী মন জয় করে নারীদেরই নাক কান কেটে দেয় ! লোভীর মতো বালির প্রাণ কেড়ে নিল ! আমার কোন দরকার নেই চোরের কথায় !” এরপর যদি কারোর মুখে পুনরায় কৃষ্ণ শব্দ শোনেন তো ক্রোধে তাঁকে তিরস্কার করতে থাকেন । আবার “গোকুল গোকুল” বলতে থাকেন ক্ষণে ক্ষণে । কোনদিন বলেন “বৃন্দাবন, বৃন্দাবন” । কখনও বা আনন্দকন্ঠে “মথুরা মথুরা” বলেন । আবার মৃত্তিকায় শ্রীকৃষ্ণের ত্রিভঙ্গ আকৃতি এঁকে, সেদিকে চেয়ে রোদন করতে থাকেন । কখনো বলেন, “এ কী চারিদিকে যে অরণ্য ! এই দেখো অরণ্যে সিংহ, ব্যাঘ্র, ভাল্লুকের গণ সব ।” দিনের বেলাকে রাত্রি বলেন, আবার রাত্রিবেলাকে দিন । —-এমন আবেশ সর্বক্ষণ তাঁর শরীরে ; ভক্তিবশ হয়েছেন বিদ্যাহঙ্কারী নিমাই পণ্ডিত এখন । ভক্তরা তাঁর কৃষ্ণপ্রেমাবেশের এমন দশা দেখে ক্রন্দন করতে থাকেন গলা জড়াজড়ি করে । যে আবেশ দর্শন করা ব্রহ্মাদিদেবের অভিলাষ —-সে আবেশ দর্শন করেন নবদ্বীপের বৈষ্ণবের দাসেরা ।
গৌরহরি নিজগৃহে আর কতক্ষণই বা থাকেন ! তিনি দিনের বেশীরভাগ সময়ে ভক্তদের গৃহেই পড়ে থাকেন । গৃহে যেটুকু সময় ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন —-তা কেবল তাঁর জননীকে প্রবোধ দিতে চেয়ে, মাতৃসুখ প্রদানের কারণে । ওদিকে তাঁকে নিয়ে বৈষ্ণবদের আনন্দ আর ধরে না । এ কী অপরূপ কৃষ্ণপ্রেম ! অনির্বচনীয় ! অদ্বিতীয় ! অভাবনীয় ! এমন ভগবদ্ প্রেম কোন মানুষের মধ্যে হতে পারে তা জানা ছিল না কারোর । ঈশ্বরাংশ না হলে শরীরে এমন প্রেম প্রকট হওয়া তো অসম্ভব !
গৌরহরির অভিন্ন প্রাণ নিত‍্যানন্দ তো মত্ত সিংহ এক ! তিনি সর্বদা ছায়ার মত গৌরাঙ্গের পাশে থাকেন । তাঁকে নিয়ে গোরা রায় অনন্ত লীলায় ঘরে ঘরে মেতে থাকেন । আর থাকেন গদাধর পণ্ডিত, আচার্য অদ্বৈত ও অন‍্যান‍্য ভক্ত মহাজনেরাও ।
একদিনের ঘটনা । গোপীভাব নিয়ে অদ্বৈত নৃত‍্য করছেন শ্রীবাস প্রাঙ্গণে। আর, সকলে মহা অনুরাগের সঙ্গে কীর্তন করছেন । আহা ! অদ্বৈতের নৃত‍্যে সে কী ভাব ! কী আর্তি ! তিনি বারংবার দন্তে তৃণ ধরে দৈন্য করতে করতে বিবশ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন । আর তাঁর দশা দেখে ভক্তরা আরও আবেগসহ গীত গাইছেন । দুই প্রহরেও নৃত‍্যের বিরাম হচ্ছে না । অবশেষে ভক্তরা শ্রান্ত হলেন । সকলে মিলে আচার্যকে স্থির করলেন । নৃত্যের বিশ্রাম হল । অদ্বৈতের চারপাশে ভক্তগণ ঘিরে বসলেন । ধীরে ধীরে অদ্বৈত শান্ত হলেন । সবকিছু স্বাভাবিক হলে শ্রীবাস, রামাই আর সকলে গেলেন গঙ্গাস্নান করতে । একলা অদ্বৈত বসে রইলেন শ্রীবাস গৃহেই । কিন্তু, বাইরে তাঁকে স্থির মনে হলেও ভিতরে-ভিতরে, অন্তরে-অন্তরে তাঁর আর্তির এতটুকুও কম হয় নি, বরং বেড়ে চলেছে তা। সে সময় শ্রীগৌরহরি সেখানে ছিলেন না । তিনি ছিলেন নিজের গৃহে অথচ অন্তর্য‍ামী গৌরহরি অন্তরে অনুভব করলেন অদ্বৈতের আর্তি । ভক্ত-আর্তি পূর্ণকারী সদানন্দ রায় চলে এলেন শ্রীবাস গৃহে যেখানে অদ্বৈত এতক্ষণ ধরে গড়াগড়ি দিয়ে এখন বসে আছেন খানিক শান্ত-ভাব দেখিয়ে । প্রাণনাথকে, ইপ্সিত ধনকে নয়ন সম্মুখে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না আচার্য‍ের যেন । হৃদয়ের ভাবতরঙ্গ উথলে উঠলো । নয়ন আবেগে অশ্রুপূর্ণ হল । মহাপ্রভু অদ্বৈতের মন বুঝে তাঁকে নিয়ে এলেন শ্রীবাসের বিষ্ণুমন্দিরে । দ্বার ভেজিয়ে দিলেন । তারপর নিজপ্রিয় ভক্তের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন—- ”বলো গো আচার্য‍ ঠাকুর ! কি তোমার ইচ্ছা ? কি তুমি চাইছো বলো তো ? আমার থেকে তোমার কি প্রত্যাশা ?”
অদ্বৈত বললেন, “আমি আর কী চাইবো প্রভু ! আমার সবই তো তুমি ! আমি শুধু তোমাকেই চাই । তুমিই তো সর্ব দেব-সার, সর্ব বেদ-সার ।”
মহাপ্রভু—- “আমি তো তোমার সম্মুখে সাক্ষাৎ আছি, এই দেখো । আর কি চাও, সত্য করে বলো তো !”
অদ্বৈত—- “হ্যাঁ, প্রভু ! তুমি ঠিকই ধরেছো ! আমার আরও কিছু অভিলাষ আছে । সুসত‍্য বচন তোমায় বলছি এবার শোনো । আমি জানি এ তত্ত্ব যে তুমিই সর্ব বেদ-বেদান্তের সার । তবু আমি তোমার কিছু বৈভব দর্শন করতে চাই ।”
মহাপ্রভু—- “কী চাইছো এবার খুলে বলো ।”
অদ্বৈত—- “প্রভু, তুমি অর্জুনকে পূর্বে যা দেখিয়েছিলে, আমি তা দেখতে চাই । তুমি নিশ্চয়ই এবার বুঝে গেছ আমার হৃদয়ের অভীপ্সা ! আমি তোমার বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাই । তুমি কী আমার এই বাসনা পূরণ করবে না প্রভু !”
অদ্বৈতের কথা শেষ হতে না হতে তিনি দেখলেন তাঁর সম্মুখে বিশাল এক রথ । চতুর্দিকে সৈন্যদল মহাযুদ্ধে রত হয়ে আছে — সমরক্ষেত্র। আর রথের উপর গৌরাঙ্গ র‍য়েছেন শ্যামল সুন্দররূপে । তাঁর চতুর্ভুজ । শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারণ করে আছেন চার ভুজে । মহাপ্রভুর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখতে পেলেন অদ্বৈত। চন্দ্র, সূর্য, সিন্ধু, গিরি, নদী, বন-উপবন দেখতে পেলেন তাঁর শরীরে । কোটি কোটি চক্ষু , বহু-বহু মুখ পুনরায় পুনরায় দেখছেন । দেখলেন শ্যামল সুন্দরের চরণের কাছে বসে তাঁকে দর্শন করছেন বিস্মিত নয়নে অর্জুন ও স্তুতি করছেন । প্রভুর মুখে মহা অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে রয়েছে । সেই অগ্নির তেজে সকল পাষণ্ড, দুষ্টগণ পতঙ্গের ন্যায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে । যে পাপীষ্ঠ অপরকে নিন্দা করে, অপরের প্রতি দ্রোহ আচরণ করে—-শ্যামল সুন্দর শ্রীচৈতন্যের মুখাগ্নিতে পুড়ে মরছে তারা সকলে ।
“বলিতে অদ্বৈত মাত্র দেখে এক রথ।
চতুর্দিকে সৈন্য দল মহাযুদ্ধ পথ।।
রথের উপরে দেখে শ্যামল সুন্দর।
চতুর্ভুজ শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধর।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখে সেই ক্ষণে।
চন্দ্র সূর্য সিন্ধু গিরি নদী উপবনে ।।
কোটি চক্ষু বহুমুখ দেখে পুনঃ পুনঃ ।
সম্মুখে দেখেন স্তুতি করয়ে অর্জুন।।
মহা অগ্নি যেন জ্বলে সকল বদন।
পোড়য় পাষণ্ড পতঙ্গ দুষ্টগণ।।
যে পাপিষ্ঠ পর নিন্দে পর দ্রোহ করে।
চৈতন্যের মুখাগ্নিতে সেই পুরি মরে।।
এই রূপ দেখিতে অন্যের শক্তি নাই ।
প্রভুর কৃপাতে দেখে আচার্য গোঁসাই।।”
(চৈতন্য ভাগবত , মধ্য, ২৪)
এমন দর্শন করার শক্তি কার আছে ! একমাত্র মহাপ্রভুর কৃপা শক্তিতেই আচার্য গোসাঞি দেখতে সমর্থ‍্য হয়েছিলেন । প্রেমসুখে, অচিন্ত‍্যনীয় দৃশ্য দর্শন করে অদ্বৈত তখন ক্রন্দন করছেন । তিনি দন্তে তৃণ ধারণ করে পুনরায় পুনরায় মহাপ্রভুর প্রতি দাস‍্য ভক্তি প্রার্থনা করতে থাকলেন ।
ওদিকে শ্রীনিত্যানন্দ সেসময় পর্য‍্যটন সুখে নদীয়ায় ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন । মহাপ্রভুর প্রকাশ তাঁর তো অজানা নয় । তিনি অনুভব করে ফেলেছেন যে, প্রাণগৌর তাঁর, বিশ্বরূপ ধারণ করেছেন । তিনি বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ হাজির হলেন শ্রীবাস গৃহের বিষ্ণুমন্দিরে । এসেই মত্ত হস্তীর ন্যায় দ্বারে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে থাকলেন । ভিতরে মহাপ্রভু অনুধাবন করে ফেললেন তাঁর অভিন্ন স্বরূপ, প্রাণের দোসর নিত‍্যানন্দ এসে দাঁড়িয়েছেন । তিনি সত্ত্বর দ্বার উন্মুক্ত করলেন । নিত‍্যানন্দ গৌরাঙ্গের অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দর্শন করেই দণ্ডবৎ হয়ে পড়ে গেলেন । আবেশে, আনন্দে তাঁর আঁখি বুজে গেছে । কম্পিত কলেবর । পুলকিত প্রাণ ।
মহাপ্রভু—- “ওঠ নিত‍্যানন্দ ! ওঠো ! আমার সকল আখ্যান তোমার তো অজানা নয় কিছুই । তুমি তো সবই জানো ! তবে কেন এমন দৈন্য করছো ! তুমি তো আমার প্রাণ ! যে ব‍্যক্তির তোমাতে প্রীতি—- সে আমায় পায় । তোমার থেকে প্রিয়তম আমার যে আর কিছুই নেই । যে তোমাতে আর অদ্বৈতে ভেদ বুদ্ধি করে —-তার অবতারবাদ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান নেই । সে মূর্খ ।”
নিত‍্যানন্দ ও অদ্বৈতকে একসাথে পেয়ে বিশ্বম্ভর বিষ্ণু গৃহের অভ‍্যন্তরে আনন্দে নৃত‍্য করতে থাকলেন । হুঙ্কার গর্জন করছেন আর বলছেন—- “দেখ ! দেখ !” আর অদ্বৈত ও নিত‍্যানন্দও প্রভুর বিশ্বরূপ দর্শন করে বিহ্বল বদনে বলছেন, “প্রভু ! প্রভু গো !” এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল শ্রীবাস ভবনে অথচ শ্রীনিত‍্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈত ভিন্ন কেউ টেরও পেলেন না । কারণ, সে কৃপাশক্তি মহাপ্রভু কাউকে দেননি । ওঁনাদের দু’জনকেই শক্তি সঞ্চার করেছিলেন দর্শন করার ।
পরবর্তীতে এসব কথা আচার্য‍ অদ্বৈত সকলকে জানিয়েছিলেন । মনে রাখতে হবে, যার এতে অবিশ্বাস আছে—- সে নিশ্চয়ই দুষ্কৃতি, অভক্ত । যে গৌরচন্দ্রকে সর্বমহেশ্বর রূপে না মানে —-সে সর্বকালের পাপী । বৈষ্ণবের অদৃশ‍্য সে ।
এরপর মহাপ্রভু নিজের বিশ্বরূপ সম্বরণ করে নিলেন । ততক্ষণে স্নান সেরে সকল ভক্তরা অঙ্গনে এসে হাজির । গৌরাঙ্গ তাঁদের নিয়ে নিজ বাসায় গেলেন । আর এদিকে বিশ্বরূপ দর্শনের আবেশ অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে তখনও মত্ত করে রেখেছে । বৈভব দর্শন সুখে দু’জনাই গরগর তনু তখনও । ধূলায় গড়াগড়ি যাচ্ছেন, কখনও করতালি দিয়ে হাসছেন, কখনও বা নাচছেন, গান করছেন । দুই মহাবলী মহাজন ঢুলে ঢুলে পড়ছেন একে অপরের শ্রীঅঙ্গে । তারপর শেষে একসময় দু’জন গালি দিয়ে কলহ শুরু করলেন । অদ্বৈত বললেন—- “এই অবধূত মাতালিয়া কোথাকার ! এখানে কে তোকে ডেকে এনেছে যে তুই এলি ! দুয়ার ভাঙ্গার অবস্থা করে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করলি কেন, শুনি ? কে তোকে বলে রে সন্ন্যাসী ! তুই কোথাকার সন্ন্যাসী ! এমন কোন জাতি আছে, যার ঘরে তুই আহার করিস নি ! তাহলে তুই কি করে সন্ন্যাসী হলি রে ! মাতোয়াল এক চলে এসেছে বৈষ্ণব সভায় ! চলে যা, বলে দিচ্ছে এখুনি । পালা এখান থেকে ।”
অদ্বৈতের গালমন্দ দেওয়া শেষ হলে এবার নিত্যানন্দ বলা শুরু করলেন । এতক্ষণ তিনি সব শুনছিলেন বড় বড় চোখ করে । এবার বললেন, “আরে নাড়া ! বসে থাকো চুপ করে । পড়ে কিলাবে । আগে তোমায় আমার প্রতাপ দেখাই ! বুড়ো বামনা ! ভয় করে না, না তোমার ! জানো ,আমি কে ? আমি ঠাকুরের ভাই, মত্ত অবধূত । আর তুমি হলে গিয়ে স্ত্রী-পুত্র সমেত সংসারী মানুষ । জানো, আমি পরমহংসের পথের অধিকারী জন । আমি তোমায় যদি মারিও তাও তোমার অধিকার নেই কিছু বলার । কেন অকারণে আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে এসেছো ? বৃথা গর্ব দেখাচ্ছো ! আস্ফালন করছো ! কী ক্ষমতা তোমার !”
নিত্যানন্দের কথা শুনেই অদ্বৈত যেন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন । বললেন, “দিগম্বর হয়ে থাকো ! মৎস খাও, মাংস খাও—- কোথাকার সন্ন্যাসী এমন করে শুনি ! কোথায় তোমার পিতা, কোথায় মাতা, কোন দেশেই বা তোমার বসতি ? কেউ কী জানে তোমার ব্যাপারে কিছু, কেউ জানে না ! কোথা থেকে এক চোর এসেছে ! —-সর্বক্ষণ খাব, গিলবো, সংহার করবো এসব বলে চলেছে ! আরে সন্ন্যাসী তো তাকে বলা হয় যে কিছু চায় না । আর তুমি তো এমন যে একবেলায় তিন-তিনবার খাও। শ্রীবাস পন্ডিতের জাতি-জ্ঞান সব গেছে, কোথাকার এক অবধূতকে ঠাঁই দিয়েছে নিজের গৃহে ! এই অবধূতই সকল জাতি নাশ করলো ওর । কোথা থেকে মদ‍্যপ এসে বসে পড়েছে !” —-এভাবে কৃষ্ণপ্রেম সুধারসে কলহমত্ত হলেন দু’জন ।
কলহ করেন সর্বক্ষণ দু’জন–নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত । অথচ এঁনাদের একজনের পক্ষ হয়ে কিছু বললে, অন্য জনের নিন্দা করলে তার ভক্তি ক্ষয় হয়—- পতন হয় তার । নিত্যানন্দ-অদ্বৈতের কলহ হচ্ছে প্রেমকলহ । এই প্রেমকলহের মর্ম না জেনে একজনের প্রশংসা, অপরজনের বন্দনা করলে—- সে পুড়ে মরে নরকে । আবার শুধু তাই নয়, যদি এমনও হয় যে, অদ্বৈতের পক্ষ হয়ে বললো আর গদাধরের নিন্দা করলো —-সেক্ষেত্রেও একই ব‍্যাপার ঘটে । সে কখনও অদ্বৈত-কিঙ্কর হতে পারে না । ঈশ্বর ঈশ্বরেরই কলহের পাত্র —-এখানে । এসবই তো বিষ্ণু-বৈষ্ণবের বৈভবের লীলা । বিষ্ণু ও বৈষ্ণব সমান দুই । অথচ পাষণ্ডী নিন্দুক যারা, তারা এই বৈভবকে বিপর্য‍য় ভাবে । যাঁরা সকল বৈষ্ণবের প্রতি অভেদ দৃষ্টি দিয়ে শ্রদ্ধা করে তারাই তো ভবতরণী তরতে পারে ।
শ্রীমন্ মহাপ্রভুর এই বিশ্বরূপ দর্শন দান লীলা যাঁরা শোনেন, পাঠ করেন, বিশ্বাস করেন—- তাঁরা কৃষ্ণধন প্রাপ্ত হন ।
(সংকলিত)
গ্রন্থ – মহাপ্রভুর মধুময় কথা
প্রকাশক – তথাগত
প্রাপ্তি–8100673093 তে হোয়াটসঅ্যাপ

Share This
Categories
কবিতা

দুর্যোগের রাত (2) : রাণু সরকার।

এক বর্ষার বিকেলে হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় উঠলো,ধুলো উড়ছে, লোকজন ছুটছে, কালপুরষ ও ছুটতে ছুটতে এসে আশ্রয় নিলো এক বাড়ির বারান্দায়।

নির্জন এই গলির আসপাশ সব বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ। ঘন ঘন মেঘ ডাকছে, বজ্রপাত হচ্ছে,
জ্বলসে উঠছে আলো, আকাশে আঁকাবাঁকা বিদ্যুতের নীল রেখা টানছে মশালের মতো।

মূলধারায় বৃষ্টি নামলো,বৃষ্টির ঝাপটায় কালপুরষ ভিজে যাচ্ছে,বৃষ্টির জলে একেবারে নেয়ে ঠান্ডায় থর থর করে কাঁপছে।
ভীষণ অসহায় সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে,বৃষ্টিতে কোথাও যেতে পারছে না,কালপুরুষ ডাক দিলো শুনছেন- অনেক বার ডাকার পর নারীর সুমিষ্ট কন্ঠ ভেসে এলো কানে।
ডাক শুনে খোলা জানালার দিকে তাকালো কালপুরুষ
এক সুন্দর অপরূপ নারী চোখে পড়ল তার।

প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, ভাবল, এই আমি
কাকে দেখছি এ তো অরুন্ধতী, এটা তোমার বাড়ি?
হ্যাঁ আমার বাড়ি,
ভাবতেই পারছি না তোমার সাথে দেখা হবে,কেমন দেখো আকস্মিক ভাবে সব ঘটে গেলো।
অরুন্ধতী’ তোমার চোখ রহস্যময় একটুও বদলাওনি তুমি আগের মতই দেখছি তোমার চোখ বিদ্যুত হানে মৃদু হেসে অরুন্ধতী বললো তুমি তো বৃদ্ধ হয়েগিছো সেও মৃদু হেসে বললো বয়স বাড়াছে বৃদ্ধ তো হবই।

তুমি ছাড়া আর এখানে কে আছে?
কোন উত্তর দিলো না অরুন্ধতী মাথা নিচু করে আছে
দু’চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে।
অনেকক্ষণ বাদে উত্তর দিলো সেই কলেজ লাইফের কথা তোমার মনে আছে? মনে নেই আবার খুব আছে।
তুমি মেরুদণ্ডহীন পুরুষ তা না হলে সেই রাতে তোমার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো তোমার মা,কিছু বলতে ও করতে পারলে না।

ভাইয়েরা সব আলাদা হলো, আমার এই অবস্থা মা সহ্য করতে পারেনি স্টোকে আগে মা মারা গেলো বাবা নয় মাস পর সহ্য করতে পারেননি মায়ের মৃত্যু
কিছু টাকা আর এই বাড়িটা রেখে গেছেন ভারা আছে নিচের ঘর গুলো চলছে একা মানুষ আর কি।
দরজা খুলে দিলো বললো ভেতরে এসো-
ফ্রেশ হও খাওয়াদাওয়া করে যাবে,তুমি তাড়িয়ে দিয়েছো বলে তো আমি তা করতে পারি না।
এভাবে বলছো?হ্যাঁ বলছি আজ তোমার জন্য আমার সব হারিগেছে। আচ্ছা বলতো তুমি বিয়ে করছো?
না গো করিনি,কেনো?কি করে করবো তোমাকে ভুলতে পারিনি।এখন কি এক হতে পারি আমরা?
তা আর সম্ভব না নতুন করে যন্ত্রণার জন্ম দিতে চাই না
আমি বেশ আছি। তুমি আর এসো না,
তাহলে যে যন্ত্রণার উপদ্রব আরো বাড়বে।
ভীষণ কষ্ট করে যন্ত্রণা সেলাই করেছি ফোঁড় গুলো খুলে যাবে,এই বয়সে সুচের ফোঁড় সহ্য করতে পারবো না।

Share This
Categories
কবিতা

কেউ আসে না ::: রাণু সরকার।।।

আজকাল তেমন একটা কেউ আসে না,
আসলে তাদের আসার অপেক্ষাতে তো আজ আর নেই,
কী আর থাকবো- ঝুড়িঝুড়ি প্রশ্ন নিয়ে আসে আমার কাছে।

আসলে এতো প্রশ্নের উত্তর রাখার মতো টুকরি নেই আমার-
আমি আবার এতো ভার বহন করতে পারিনা, কষ্ট হয় ভীষণ।

প্রাপ্তবয়স্ক হলে কি হবে- বহন করার ক্ষমতা আছে বেশ,এতোটুকুও ক্লান্তি নেই ওদের-
সেবার এসে অনেক প্রশ্ন রেখে গেলো, ভালোবেসে না রাগ করে জানিনা বাপু।

আলগোছে রেখেছি তুলে নাড়াচাড়া দেইনি-
আমি একটু আটপৌরে জীবন যাপন করে থাকি, জগৎ সম্পর্কে তেমন কোন কৌতুহল দেখাই না- যখন যা হবার হবে।
জীবন কী বুঝতে ঋতু লাগেনা।

Share This
Categories
কবিতা

সাজো ঘটনা ::: রাণু সরকার।।

এক নারী, রোজ সকাল হলে চলে আসে একই জায়গায়, বসে কী যেন ভাবে অস্পষ্ট ও মৃদুস্বরে
কথা বলে।

একদিন স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তার কথা,
সে- উচ্চস্বরে বললো কত গুলো বছর ধরে ভেবেই যাচ্ছি
কোথায় যে রেখেছি পাচ্ছি না খুঁজে-আমার বাড়ি কোথায়?

ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে মরে যাবি তবুও খুঁজে পাবি না তোর বাড়ি,
হা হা হা, হায়রে- নারীর আবার আছে নাকি বাড়ি?

যখন সুস্থ ছিলি একবারও ভেবে দেখার সময়
পাসনি,
মেয়েবেলা আর কৈশোর কাটে বাবার বাড়িতে,
এটাও জানিস না-
যৌবনকাল কাটে স্বামীর বাড়িতে,
যতদিন স্বামী আছে যৌবন আছে রান্না ঘরে কাটাতে হবে,
যে চাকুরি করে তার টাকা আছে তো সব আছে তার ব্যপার আলাদা। সব নারী যদি চাকুরি করতো হতো না আর তোর মতো।
তারপর তোর ছেলের ঘর- যদি ছেলে ও ছেলের বৌ ভালো হয় তবে থাকতে পারবি ও বলবি আমাদের বাড়ি, তোর বলা যাবে না।
ছেলে-বৌ না দেখলে তবে তোকে থাকতে হবে পথে-ঘাটে ,তুই তো চাকুরি করিস না, তোর টাকাও নেই-
পথে-ঘাটেও এখন আর থাকা যায় না রে নারী, দুরবস্থা, বৃদ্ধ হলেও ছাড় নেই।

এবার বল- তোর বাড়ি কোথায়?
বাড়ি খুঁজে খুঁজে শেষে তুই পাগোল হলি।
এই বয়সে স্বামীকে হারালি তারপর গর্ভের
প্রিয়জনের থেকে পেলি না আদরযত্ন শ্রদ্ধা-
নেই তোর প্রতি মনোযোগ তাই তো মানসিক
ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিস-
এখন সবাই তোকে বলে পাগোল—-

Share This
Categories
কবিতা

ভাবনা ::: রাণু সরকার।।।

একদিন সে- ডেকেছিলো-
করেছি অবজ্ঞা!
তার সোহাগ কে দেইনি সময়–
ভাবার অবসর পাইনি
তার অন্তরে এতো ব্যথা-
অন্যমনস্ক ছিলাম হয়তো!

বর্তমানে- তাকানোর স্মৃতি মনকে
পঙ্গু করে!
ঈষৎ ঝাঁকুনি দেয় শরীরে ও প্রশমিত করে পত্রশিরা!
বর্তমানে তার তাকানো কে প্রশ্রয় দেওয়া অলীক দুরাশা!

Share This
Categories
কবিতা

প্রতিবিম্ব : রাণু সরকার।।।

সবসময় আমাকে আগলে রাখে,
আমার সাথে নীরবে কথা হয়-
সুখ দুঃখের-
আমাকে ও খুব ভালোবাসে!

আমার চলার পথ ও নিজেই ঠিক
করে দেয়-
অন্ধকারে যদি ভয় পাই-
তাই তো বুকে জড়িয়ে রেখে কত
স্নেহ কোরে!

আমি আনন্দে দিশাহারা
চোখ বন্ধ করে ওর বুকে
মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি–

ও আমার প্রতিবিম্ব!

Share This
Categories
কবিতা

ব্যথা : রাণু সরকার।

ব্যথা বলছে, আমারও তো ব্যথা আছে- কেউ কি তা বোঝে?

হ্যাঁ, বোঝে তো–
কেনো স্পর্শেন্দ্রিয় তো বোঝে।

তবে ভাগিদার কে ?
যে ভাগ বা অংশ পায় সে-
সে কে?
সে হচ্ছে অনুভূতি,
তোমার দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে
রক্ষা করছে ব্যথা।
ব্যথার উৎস থেকে ব্যথা দূরে সরে যাবার সময় আরো যে ব্যথারা আছে তাদেরকে সাথে করে নিয়ে যায়,
ব্যথা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে না, সে ভীষণই ব্যস্ত
তাই তো তার এতো কষ্ট।

ব্যথার সৃষ্টি কেমন তুমি কি কখনো বুঝেছো?
ব্যথা আসে ধীরে ধীরে- তারপর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তখন সে আহত ক্ষুধিত হিংস্রের মতো হয়ে যায়।

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, ষষ্ঠ পর্ব) : দিলীপ রায়।

কুহেলির বাড়ি থেকে চলে গেলো শীতল । কুহেলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো । সাংঘাতিক নাছোড়বান্দা শীতল । টাকা সে দেবেই । অনেক কষ্টে শীতলকে থামানো গেছে । এটাই তার শান্তি ।
কুহেলি মনের দিক থেকে স্থির প্রতিজ্ঞ, সে নিজের চেষ্টায় বড় হবে । তাতে তার খাবার জুটুক বা না-জুটুক ! তবু কারো সাহায্য বা দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে বাঁচতে চায় না । কুহেলির বাবা তাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে, সেটা হচ্ছে নিজের পায়ে দাঁড়ানো । তাই বাবার কথাটার মর্যাদা দিতে মানসিকভাবে ষোলোআনা প্রস্তুত । যতো ঝড় ঝঞ্ছাট আসুক, তাতে সে কিছুতেই হেলবে না । তার সিদ্ধান্তের একচুল নড়চড় হবে না । নিজের পায়ে দাঁড়াতে কুহেলি বদ্ধপরিকর !
রাত্রিতে মুড়ি-খই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কুহেলি ।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আদাজল খেয়ে লাগলো । বাড়ির কাজ নিজের হাতেই সামলাতে হচ্ছে । গ্রামে বাড়ি । গাছ-গাছলায় ভর্তি । আম, কাঠাল, পেয়ারা, লেবু, ইত্যাদি । যার জন্য গাছের পাতায় উঠোন ভর্তি থাকে । অন্যদিকে মাটির উঠোন । যার জন্য উঠোন ঝাঁট দেওয়া একটা ঝকমারি । বাড়ির টুকিটাকি কাজকর্মে অনেক সময় নষ্ট । আগে এইসব টুকিটাকি কাজ নিয়ে ভাবতে হতো না । বাবা সামলাতো । বাবা তাকে কুটোটি নাড়তে দিতো না । তাই প্রতিটা মুহূর্তে কুহেলি বাবাকে মিস করে । কিন্তু সেই বাবা কী করে তাকে ফেলে রেখে অন্যত্র ঘর বাঁধতে ছুটলো, সেটা কুহেলির মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না । এই মুহূর্তে কুহেলি অতীতের সব কিছু ভুলে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ধ্যান দিলো ।
অঙ্কের ও ইংরেজি বিষয়ের উপর আলাদা টিউশনি মাস্টার ছিল । কুহেলি টিউশনি মাস্টার ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো । তবে মাস্টার মশাইয়েরা কুহেলিকে পইপই করে বলে দিয়েছেন, সমস্যা হলে অবশ্যই পড়তে আসবে । কুহেলির জন্য টিউশনি মাস্টারের দরজা খোলা । দুজন মাস্টার মশাই খুব ব্যস্ত মানুষ । একজন কান্দী কলেজে এবং অন্যজন সালার কলেজে পড়ান । দুই জন মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি ভরতপুরে । তাঁরা বাড়িতে সকালে পড়ান । যাই হোক কুহেলি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করলো । ক্লাসের অঙ্কের মাস্টার মশাই বললেন, “পড়াশোনায় ঢিলে দেবে না । অঙ্কের বিষয়ে তোমার উপর আমাদের অগাধ ভরসা । আমার বিশ্বাস, এবারের পরীক্ষায় তুমি আমাদের স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে ।“ অঙ্কের মাস্টার মশাইয়ের এতটা ভরসা পাওয়ার কারণ, কুহেলি টেস্ট পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে । যার জন্য মাস্টার মশাইদের তাক লেগে গেছে । তাই মাস্টার মশাইরা কুহেলির উপর একটু বেশী আস্থা রেখে ফেলছেন । তবুও কুহেলি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু পড়াশুনা নিয়ে ডুবে রইলো । এমনকি শীতলের সঙ্গে ফোনেও যোগাযোগ রাখলো না পাছে পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে । কুহেলির ইংরেজিতে অতোটা চাপ নেই । সমস্যা দেখা দেয় অঙ্ক কষা নিয়ে । অনেক সময় আটকে যায় । অঙ্ক আটকে গেলে কুহেলি অঙ্কের টিউশনি স্যারের কাছে গিয়ে বুঝে আসে । অঙ্কের স্যার কুহেলিকে খুব ভালবাসেন । তাঁর বিশ্বাস, কুহেলি অঙ্কে খুব ভাল রেজাল্ট করবে ।
পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে । অন্যদিকে তার জমানো পয়সা শেষ হওয়ার পথে । অহেতুক চিন্তা থেকে নিবৃত্তি পেতে অতি সাবধানে খরচ করছে কুহেলি । যাতে পরীক্ষা পর্যন্ত সংসার চালিয়ে যেতে পারে । বাইরের খরচা তেমন নেই । ইলেক্ট্রিক বিল পেমেন্ট হয়ে গেছে । গাঁয়ের হরির মুদিখানার দোকান থেকে বাকীতে এক কেজি সঃ তৈল এনেছিল তারও পেমেন্ট হয়ে গেছে । এখন বাইরে ধার-বাকী নেই । কুহেলি মনেপ্রাণে চাইছে, পরীক্ষা পর্যন্ত জমানো পয়সায় চলুক । পরীক্ষার পর উপায়ের একটা চিন্তা করা যাবে । পরীক্ষার আগে উপায়ের চিন্তা করলে তার রেজাল্ট খারাপ হতে বাধ্য । তাই কুহেলি সাতপাঁচ না ভেবে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করলো ।
গ্রামের কিছু ছেলের উৎপাত সারাক্ষণ । তার মধ্যে ক্যাবলা কিরণের উৎপাত অভিনব । তা ছাড়া কিরণের তাকানোর মধ্যে জটিলতার আভাস কুহেলির কাছে বিরক্তিকর । কুহেলি পাত্তা দিচ্ছে না অবলোকন করে কিরণ সকালে সন্ধ্যায় উপযাচক হয়ে খোঁজ নিচ্ছে, সংসারের জন্য কুহেলির কী কী বাজার লাগবে । কিরণের অভব্য আচরণের জন্য কুহেলি বলতে বাধ্য হলো তার কোনো বাজার লাগবে না । ঘরে পয়সা নেই তার খোঁজ কেউ নিচ্ছে না । অথচ বাজার করে দেওয়ার জন্য উতলা ! কিরণের অতি উৎসাহ দেখে কুহেলি হাসবে না কাদবে, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না । তাই ঠাণ্ডা মাথায় কিরণকে এটা-সেটা বুঝিয়ে কুহেলি তাকে এড়িয়ে যেতে লাগলো ।
আবার অঙ্ক আটকালো । স্যারকে মোবাইলে পাওয়া গেলো না । পরেরদিন ভোরবেলায় ফোন করলো কুহেলি । স্যার ফোনে জানালেন, “কয়েকদিন কলেজে জরুরি কাজ থাকার জন্য সকালবেলায় তাঁকে কলেজে ঢুকতে হচ্ছিল । আজ ফাঁকা আছি । সুতরাং বিকেলে এসো । এর পরের দুদিন থাকবো না । ব্যক্তিগত কাজে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট যাবো ।“
কুহেলি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিলো, “স্যার, আমি আজ বিকেলেই যাচ্ছি ।“
“ঠিক আছে কুহেলি । তুমি পাঁচটার সময় চলে এসো । একটু আগে আসাটা তোমার পক্ষে ভাল । কেননা তোমাকে আবার অনেকখানি রাস্তা ডিঙিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে ।“ মাস্টার মশাই বললেন ।
তারপর ফোনের লাইন কেটে গেলো ।
কুহেলি দুদিন ধরে ভাবছে, অঙ্কের স্যারের কাছে যাওয়ার কথা । কেননা পরীক্ষা আসন্ন । কয়েকটা অঙ্কের সমাধান কিছুতেই হচ্ছে না । কুহেলির ধারণা, পরীক্ষায় ঐ জাতীয় অঙ্ক দিলে মুশকিলে পড়বে । তার জন্য আগেভাগে মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে জেনে রাখা ভাল । পরীক্ষায় এলে অন্তত ১০ থেকে ১৫ নম্বরের অঙ্ক থাকবে । সেক্ষেত্রে তাকে ঐ নম্বরের অঙ্কের সমাধান না করেই খাতা জমা দিতে হবে । তাই কোনো কিছু চিন্তা না করে বিকেল চারটার সময় ভরতপুরে অঙ্কের স্যারের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলো । অনেকটা রাস্তা । তাই হাতে সময় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো ।
সাইকেলের চাকায় হাওয়া কম । কাঞ্চন নগরে কোনো সাইকেল সারানোর দোকান নেই । তাই তাকে সাইকেলে হাওয়া দিতে হলে অন্তত সিস্‌গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে । চাকায় হাওয়া কম থাকায় রাস্তা দিয়ে দ্রুত সাইকেল চলছে না । ধীরে ধীরে সাইকেল নিয়ে যখন সিস্‌গ্রামে কুহেলি পৌঁছালো, তখন বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে । চাকায় লিক্‌ । লিক্‌ সারাতে সময় নিলো । তারপর সিস্‌গ্রামে সাইকেলের লিক্‌ সারিয়ে চাকায় হাওয়া দেওয়ার পর যখন জোরে সাইকেল চালিয়ে কুহেলি ভরতপুর পৌঁছালো তখন স্যারের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী টিউশনিতে ঢুকে গেছে । স্যার চেয়েছিলেন, পাঁচটার সময় কুহেলি পৌঁছালে তাকে একান্ত আলাদাভাবে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে ব্যাচের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসবেন । কিন্তু দেরী করার জন্য সকল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মাস্টার মশাইয়ের পক্ষে আলাদাভাবে কুহেলিকে বোঝানো কঠিন হয়ে দাড়ালো । তাই কুহেলি পুরো অঙ্ক স্যারকে বোঝাতে অনেকটা রাত্রি । ঘড়ির কাটায় তখন রাত্রি ৯টা ।
স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কুহেলি হাই রোডে এসে দাঁড়ালো । এই হাই রোডটি সালার থেকে ভরতপুর হয়ে কান্দি হয়ে বহরমপুর যাচ্ছে । যদিও রোডটির সাথে অনেকদূর পর্যন্ত যোগাযোগ । বহরমপুর থেকে ফরাক্কা, মালদহ হয়ে সোজা উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই যোগাযোগ । অন্যদিকে কলকাতা থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেস দিয়ে ঈশ্বরগুপ্ত সেতু পার হয়ে আসাম রোড ধরে কাটোয়া হয়ে সালার, তারপর ভরতপুর । সুতরাং রাস্তাটির গুরুত্ব অপরিসীম । সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছে । ভরতপুরে লোডশেডিং । চারিদিকে অন্ধকার । কুহেলি ভাবলো, কাকাকে একবার বাড়ি ফেরার কথা জানিয়ে রাখা দরকার । তাই কাকাকে (ছোট কাকা, কানাই) ফোন করে বলল, “রাত হয়ে গেছে । সম্ভব হলে তুমি ভরতপুরের দিকে সাইকেলে এগিয়ে এসো । আমি ভরতপুর থেকে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছি ।“ ফোন করে কুহেলি আর সময় নষ্ট করলো না । সাইকেল চালিয়ে সিস্‌গ্রাম পার হয়ে কাঞ্চন নগরের রাস্তা ধরলো । ভরতপুর ছাড়ার পর গোটা রাস্তা অন্ধকার । মাঝে মাঝে মোটর বাইকের আলোয় অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তা দেখতে পাচ্ছিলো । রাস্তায় লোকজন কম । রাত্রি আটটার পর স্থানীয় মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হন না । ফাঁকা রাস্তা দেখে কুহেলির আতঙ্ক ! সিস্‌গ্রাম পার হওয়ার পর কুহেলির মনের ভিতর অজানা আশঙ্কা, “এত রাত্রিতে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে একা একা সাইকেল চালিয়ে যেতে পারবে কিনা ?” তার মাথায় অজানা বিপদের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে । কী জানি কী বিপদ আসন্ন ?
বিকেল বেলায় বাড়ি থেকে কুহেলি যখন ভরতপুরে যাচ্ছিলো, গাঁয়ের ক্যাবলা কিরণ তাকে দেখতে পায় । কিরণকে ইদানীং কুহেলি ক্যাবলা কিরণ নামেই ডাকে । তখন থেকেই কিরণ প্রমাদ গুনছে, কুহেলিকে কীভাবে জব্দ করা যায় ! অনুমানের ভিত্তিতে কিরণের ধারণা, কুহেলির বাড়ি ফিরতে আজ নির্ঘাত রাত হবে । সুতরাং কুহেলিকে কাছে পাওয়ার একটা মওকা । সে এই সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজি না । সঙ্গে কাউকে রাখেনি । একাই কুহেলিকে পাকড়াও করতে চায় । সন্ধ্যা থেকে পাকুড় গাছটার নীচে তার অপেক্ষা । চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ! তার উপর মশার কামড় । তবুও সে নাছোড়বান্দা । যেভাবে হোক কুহেলিকে তার পাকড়ানো চাই । কুহেলির তেজ ভাঙ্গতে কিরণ মরিয়া ।
স্থানীয় মানুষদের কাছে পাকুড় গাছের পাশ দিয়ে চলাটা ভীষণ ভীতির কারণ । অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা রাত্রিবেলায় ঐ পাকুড় গাছ দেখলেই শঙ্কিত হয়ে পড়ে । নীচ দিয়ে যাওয়ায় সময় অতঙ্কে থাকে । দুই একবার ভৌতিক কাণ্ডও ঘটেছে । তা ছাড়া ইতিপূর্বে বিপজ্জনক ঘটনাও ঘটেছে । সেসব ঘটনার কথা কুহেলি জানে । জানলে কীহবে ? আজ উপায় নেই । ঐ রাস্তা ধরে তাকে ফিরতে হবে । কুহেলির সাইকেল ছুটছে । পাকুড় গাছ পার হওয়ার পর প্রায় আধা কিলোমিটার সাইকেল চালালে কাঞ্চন নগরে ঢোকার মোড় পড়বে । কাঞ্চন নগরের মোড় থেকে গ্রামের দিকে ঢুকলে বিপদের সম্ভাবনা কম । সুতরাং কাঞ্চন নগরের মোড় পর্যন্ত বিপদের ঝুঁকি ষোলোআনা । সেটা কুহেলি বিলক্ষণ জানে । রাস্তা সুনসান । লোকজন নেই । ভয়ে আতঙ্কে কুহেলি জেরবার । তার উপর সাইকেল জোরে চালানোর জন্য কায়িক পরিশ্রম যথেষ্ট । যার জন্য কপালে ঘাম । বারংবার ভাবছে, বাবা থাকলে তাকে এই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো না । বাবা নিশ্চয় কুহেলিকে নিতে ভরতপুরে হাজির থাকতো ।
কিছুটা দূর থেকে কালো অন্ধকারের ভিতর কুহেলি টের পেলো পাকুড় গাছ তলায় কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে । তার হাঁটাহাঁটির জন্য পাকুড় গাছের পাতার মচমচ শব্দ । পাকুড় গাছের নীচে পৌঁছানো মাত্র কিরণ কুহেলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো । অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য, সাইকেল থেকে কুহেলি পড়ে গিয়ে রাস্তার উপরে গড়াগড়ি । সেই অবস্থায় কিরণ কুহেলিকে জাপটে ধরলো । কোনোরকমে কুহেলি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিরণের গালে জোরে এক থাপ্পড় ! চোখ গরম করে কুহেলি বলল, “বাঁচতে চাইলে রাস্তা ছাড় ! নতুবা তোকে আজ নোনাই নদীর জলে চুবিয়ে মারবো । তুই আমার এখনও রণমূর্তি দেখিস্‌নি । অন্ধকারে ধাওয়া করার মজা টের পাইয়ে ছাড়বো !” রীতিমতো কুহেলি হাঁপাচ্ছে ।
কুহেলি কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে পুনরায় সাইকেলে উঠলো । পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে ক্যাবলাটা থাপ্পড় খেয়ে ভাবলেশহীনভাবে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে । কিছুটা যাওয়ার পর পেছনে তাকিয়ে দেখে ক্যাবলাটা দ্রুত গতিতে বাইক নিয়ে ছুটছে । কুহেলির সাইকেলও খুব জোরে ছুটছে । কিরণ খুব জোরে বাইক চালিয়ে কুহেলিকে টপকে গেলো । কুহেলিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “নোনাই নদীতে কে কাকে চোবায় আমিও দেখবো ।“
চিৎকার করে কুহেলি বলল, “যা, এখান থেকে পালা ! তোদের হিম্মত আমার জানা আছে । তোরা হচ্ছিস লেজকাটা কুকুর । তোদের লজ্জা-স্মরণ বলে কিচ্ছু নেই । সুযোগ পেলেই গাঁয়ের নিরীহ মেয়েদের নিয়ে টানাটানি । আরে, সাহস থাকলে বে-পাড়ার মেয়ের পেছনে লেগে দেখ্‌ । মেরে গায়ের ছাল-চামড়া তুলে দেবে। নেমকহারাম কোথাকার !”
কিরণ রেগে গিয়ে বাইক থেকে নেমে কুহেলিকে পুনরায় রাস্তায় দাঁড় করালো । কুহেলি এবার প্রচণ্ড মারমুখি । সে সাইকেল দুই হাতে তুলে নিয়ে মাথার উপর ঘোরাতে শুরু করলো । কিরণের দিকে তাকিয়ে কুহেলি বলল, “এগিয়ে আয়, তোকে আমি এখানেই শেষ করবো ।“ তারপর কিরণের দিকে ধেয়ে গেলো । ইত্যবসরে কানাই কাকা এসে হাজির । কাকার দিকে তাকাতেই কিরণ চোখের পলকে সেখান থেকে বাইকে উধাও ।
( চলবে )

Share This
Categories
কবিতা

আত্মম্ভরি :: রাণু সরকার।।

দৃষ্টিকোণের বোবা জলটা পীড়নকর,
উপলব্ধি করলে বৃহৎ এক কাব্য,
ঠোঁট জুড়ে অকথিত ভাষা,
অথচ নাচ ঘরে শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী,
কিন্তু শরীর জুড়ে অঙ্কিত দাম্ভিকতা
সোহাগে বাড়ে আত্মম্ভরি!

Share This