সর্বাবতারী নদিয়াবিহারী শ্রীশ্রীগৌরহরি নদীয়ার নবদ্বীপে সর্বদা কীর্তনবিলাস করে চলেছেন । নগরে, চত্বরে, জলে, বনে—-যেখানেই তিনি কৃষ্ণনাম শ্রবণ করেন অমনি নিরবধি তাঁর শ্রীনয়ন দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যায় । নবদ্বীপের ভক্তসমাজ তাঁর দশা দেখে বলেন, বিশ্বম্ভর রায় যে ভক্তিরসময় হয়ে গেছেন ! নিমাই পণ্ডিত কারোর মুখে ‘হরি’ শব্দ শ্রবণ করলেই নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না আর । অশ্রু-কম্প-পুলক-বৈবর্ণ্য আদি অষ্ট সাত্ত্বিক ভাবের প্রকাশ হয় সর্বাঙ্গে তাঁর । ধূলায় বিলুন্ঠিত হন, গড়াগড়ি যান । যে আবেশ দর্শন করলে ব্রহ্মাদি দেবতারা পর্যন্ত ধন্য হন —-সেই দেবদুর্লভ দর্শন সৌভাগ্যবান নদীয়াবাসী লাভ করেন ।
একদিন কীর্তনবিলাসী গৌরের ভাবেতে মূর্ছাগ্রস্ত অবস্থা এমন । পার্ষদরা তাঁকে নিয়ে চলে এলেন তাই গৃহে । দ্বার দিয়ে শুরু করলেন কীর্তন । অনন্ত ভাব প্রকট তখন তাঁর অন্তরে । নির্দিষ্ট কোন রসে, কোন ভাবে তিনি যে বিহ্বল হয়ে আছেন —-তা কেউ অনুধাবন করতে পারেন না । কখনও তিনি বলছেন —-“আমিই তো মদনগোপাল,” কখনও বলছেন—- “আমি সর্বকালের কৃষ্ণদাস,” আবার কখনও “গোপী !গোপী !গোপী!” বলে জপ করেন । কখনও কৃষ্ণের নাম শ্রবণ করে কেঁপে ওঠেন তেজে ; বলতে থাকেন—- “কোথাকার কৃষ্ণ তোর ! সে তো মহাদস্যু ! শঠ, ধৃষ্ট কৈতব একজন ! কে তাকে ভজনা করবে শুনি ! নারী মন জয় করে নারীদেরই নাক কান কেটে দেয় ! লোভীর মতো বালির প্রাণ কেড়ে নিল ! আমার কোন দরকার নেই চোরের কথায় !” এরপর যদি কারোর মুখে পুনরায় কৃষ্ণ শব্দ শোনেন তো ক্রোধে তাঁকে তিরস্কার করতে থাকেন । আবার “গোকুল গোকুল” বলতে থাকেন ক্ষণে ক্ষণে । কোনদিন বলেন “বৃন্দাবন, বৃন্দাবন” । কখনও বা আনন্দকন্ঠে “মথুরা মথুরা” বলেন । আবার মৃত্তিকায় শ্রীকৃষ্ণের ত্রিভঙ্গ আকৃতি এঁকে, সেদিকে চেয়ে রোদন করতে থাকেন । কখনো বলেন, “এ কী চারিদিকে যে অরণ্য ! এই দেখো অরণ্যে সিংহ, ব্যাঘ্র, ভাল্লুকের গণ সব ।” দিনের বেলাকে রাত্রি বলেন, আবার রাত্রিবেলাকে দিন । —-এমন আবেশ সর্বক্ষণ তাঁর শরীরে ; ভক্তিবশ হয়েছেন বিদ্যাহঙ্কারী নিমাই পণ্ডিত এখন । ভক্তরা তাঁর কৃষ্ণপ্রেমাবেশের এমন দশা দেখে ক্রন্দন করতে থাকেন গলা জড়াজড়ি করে । যে আবেশ দর্শন করা ব্রহ্মাদিদেবের অভিলাষ —-সে আবেশ দর্শন করেন নবদ্বীপের বৈষ্ণবের দাসেরা ।
গৌরহরি নিজগৃহে আর কতক্ষণই বা থাকেন ! তিনি দিনের বেশীরভাগ সময়ে ভক্তদের গৃহেই পড়ে থাকেন । গৃহে যেটুকু সময় ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন —-তা কেবল তাঁর জননীকে প্রবোধ দিতে চেয়ে, মাতৃসুখ প্রদানের কারণে । ওদিকে তাঁকে নিয়ে বৈষ্ণবদের আনন্দ আর ধরে না । এ কী অপরূপ কৃষ্ণপ্রেম ! অনির্বচনীয় ! অদ্বিতীয় ! অভাবনীয় ! এমন ভগবদ্ প্রেম কোন মানুষের মধ্যে হতে পারে তা জানা ছিল না কারোর । ঈশ্বরাংশ না হলে শরীরে এমন প্রেম প্রকট হওয়া তো অসম্ভব !
গৌরহরির অভিন্ন প্রাণ নিত্যানন্দ তো মত্ত সিংহ এক ! তিনি সর্বদা ছায়ার মত গৌরাঙ্গের পাশে থাকেন । তাঁকে নিয়ে গোরা রায় অনন্ত লীলায় ঘরে ঘরে মেতে থাকেন । আর থাকেন গদাধর পণ্ডিত, আচার্য অদ্বৈত ও অন্যান্য ভক্ত মহাজনেরাও ।
একদিনের ঘটনা । গোপীভাব নিয়ে অদ্বৈত নৃত্য করছেন শ্রীবাস প্রাঙ্গণে। আর, সকলে মহা অনুরাগের সঙ্গে কীর্তন করছেন । আহা ! অদ্বৈতের নৃত্যে সে কী ভাব ! কী আর্তি ! তিনি বারংবার দন্তে তৃণ ধরে দৈন্য করতে করতে বিবশ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন । আর তাঁর দশা দেখে ভক্তরা আরও আবেগসহ গীত গাইছেন । দুই প্রহরেও নৃত্যের বিরাম হচ্ছে না । অবশেষে ভক্তরা শ্রান্ত হলেন । সকলে মিলে আচার্যকে স্থির করলেন । নৃত্যের বিশ্রাম হল । অদ্বৈতের চারপাশে ভক্তগণ ঘিরে বসলেন । ধীরে ধীরে অদ্বৈত শান্ত হলেন । সবকিছু স্বাভাবিক হলে শ্রীবাস, রামাই আর সকলে গেলেন গঙ্গাস্নান করতে । একলা অদ্বৈত বসে রইলেন শ্রীবাস গৃহেই । কিন্তু, বাইরে তাঁকে স্থির মনে হলেও ভিতরে-ভিতরে, অন্তরে-অন্তরে তাঁর আর্তির এতটুকুও কম হয় নি, বরং বেড়ে চলেছে তা। সে সময় শ্রীগৌরহরি সেখানে ছিলেন না । তিনি ছিলেন নিজের গৃহে অথচ অন্তর্যামী গৌরহরি অন্তরে অনুভব করলেন অদ্বৈতের আর্তি । ভক্ত-আর্তি পূর্ণকারী সদানন্দ রায় চলে এলেন শ্রীবাস গৃহে যেখানে অদ্বৈত এতক্ষণ ধরে গড়াগড়ি দিয়ে এখন বসে আছেন খানিক শান্ত-ভাব দেখিয়ে । প্রাণনাথকে, ইপ্সিত ধনকে নয়ন সম্মুখে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না আচার্যের যেন । হৃদয়ের ভাবতরঙ্গ উথলে উঠলো । নয়ন আবেগে অশ্রুপূর্ণ হল । মহাপ্রভু অদ্বৈতের মন বুঝে তাঁকে নিয়ে এলেন শ্রীবাসের বিষ্ণুমন্দিরে । দ্বার ভেজিয়ে দিলেন । তারপর নিজপ্রিয় ভক্তের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন—- ”বলো গো আচার্য ঠাকুর ! কি তোমার ইচ্ছা ? কি তুমি চাইছো বলো তো ? আমার থেকে তোমার কি প্রত্যাশা ?”
অদ্বৈত বললেন, “আমি আর কী চাইবো প্রভু ! আমার সবই তো তুমি ! আমি শুধু তোমাকেই চাই । তুমিই তো সর্ব দেব-সার, সর্ব বেদ-সার ।”
মহাপ্রভু—- “আমি তো তোমার সম্মুখে সাক্ষাৎ আছি, এই দেখো । আর কি চাও, সত্য করে বলো তো !”
অদ্বৈত—- “হ্যাঁ, প্রভু ! তুমি ঠিকই ধরেছো ! আমার আরও কিছু অভিলাষ আছে । সুসত্য বচন তোমায় বলছি এবার শোনো । আমি জানি এ তত্ত্ব যে তুমিই সর্ব বেদ-বেদান্তের সার । তবু আমি তোমার কিছু বৈভব দর্শন করতে চাই ।”
মহাপ্রভু—- “কী চাইছো এবার খুলে বলো ।”
অদ্বৈত—- “প্রভু, তুমি অর্জুনকে পূর্বে যা দেখিয়েছিলে, আমি তা দেখতে চাই । তুমি নিশ্চয়ই এবার বুঝে গেছ আমার হৃদয়ের অভীপ্সা ! আমি তোমার বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাই । তুমি কী আমার এই বাসনা পূরণ করবে না প্রভু !”
অদ্বৈতের কথা শেষ হতে না হতে তিনি দেখলেন তাঁর সম্মুখে বিশাল এক রথ । চতুর্দিকে সৈন্যদল মহাযুদ্ধে রত হয়ে আছে — সমরক্ষেত্র। আর রথের উপর গৌরাঙ্গ রয়েছেন শ্যামল সুন্দররূপে । তাঁর চতুর্ভুজ । শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারণ করে আছেন চার ভুজে । মহাপ্রভুর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখতে পেলেন অদ্বৈত। চন্দ্র, সূর্য, সিন্ধু, গিরি, নদী, বন-উপবন দেখতে পেলেন তাঁর শরীরে । কোটি কোটি চক্ষু , বহু-বহু মুখ পুনরায় পুনরায় দেখছেন । দেখলেন শ্যামল সুন্দরের চরণের কাছে বসে তাঁকে দর্শন করছেন বিস্মিত নয়নে অর্জুন ও স্তুতি করছেন । প্রভুর মুখে মহা অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে রয়েছে । সেই অগ্নির তেজে সকল পাষণ্ড, দুষ্টগণ পতঙ্গের ন্যায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে । যে পাপীষ্ঠ অপরকে নিন্দা করে, অপরের প্রতি দ্রোহ আচরণ করে—-শ্যামল সুন্দর শ্রীচৈতন্যের মুখাগ্নিতে পুড়ে মরছে তারা সকলে ।
“বলিতে অদ্বৈত মাত্র দেখে এক রথ।
চতুর্দিকে সৈন্য দল মহাযুদ্ধ পথ।।
রথের উপরে দেখে শ্যামল সুন্দর।
চতুর্ভুজ শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধর।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দেখে সেই ক্ষণে।
চন্দ্র সূর্য সিন্ধু গিরি নদী উপবনে ।।
কোটি চক্ষু বহুমুখ দেখে পুনঃ পুনঃ ।
সম্মুখে দেখেন স্তুতি করয়ে অর্জুন।।
মহা অগ্নি যেন জ্বলে সকল বদন।
পোড়য় পাষণ্ড পতঙ্গ দুষ্টগণ।।
যে পাপিষ্ঠ পর নিন্দে পর দ্রোহ করে।
চৈতন্যের মুখাগ্নিতে সেই পুরি মরে।।
এই রূপ দেখিতে অন্যের শক্তি নাই ।
প্রভুর কৃপাতে দেখে আচার্য গোঁসাই।।”
(চৈতন্য ভাগবত , মধ্য, ২৪)
এমন দর্শন করার শক্তি কার আছে ! একমাত্র মহাপ্রভুর কৃপা শক্তিতেই আচার্য গোসাঞি দেখতে সমর্থ্য হয়েছিলেন । প্রেমসুখে, অচিন্ত্যনীয় দৃশ্য দর্শন করে অদ্বৈত তখন ক্রন্দন করছেন । তিনি দন্তে তৃণ ধারণ করে পুনরায় পুনরায় মহাপ্রভুর প্রতি দাস্য ভক্তি প্রার্থনা করতে থাকলেন ।
ওদিকে শ্রীনিত্যানন্দ সেসময় পর্য্যটন সুখে নদীয়ায় ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন । মহাপ্রভুর প্রকাশ তাঁর তো অজানা নয় । তিনি অনুভব করে ফেলেছেন যে, প্রাণগৌর তাঁর, বিশ্বরূপ ধারণ করেছেন । তিনি বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ হাজির হলেন শ্রীবাস গৃহের বিষ্ণুমন্দিরে । এসেই মত্ত হস্তীর ন্যায় দ্বারে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে থাকলেন । ভিতরে মহাপ্রভু অনুধাবন করে ফেললেন তাঁর অভিন্ন স্বরূপ, প্রাণের দোসর নিত্যানন্দ এসে দাঁড়িয়েছেন । তিনি সত্ত্বর দ্বার উন্মুক্ত করলেন । নিত্যানন্দ গৌরাঙ্গের অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রূপ দর্শন করেই দণ্ডবৎ হয়ে পড়ে গেলেন । আবেশে, আনন্দে তাঁর আঁখি বুজে গেছে । কম্পিত কলেবর । পুলকিত প্রাণ ।
মহাপ্রভু—- “ওঠ নিত্যানন্দ ! ওঠো ! আমার সকল আখ্যান তোমার তো অজানা নয় কিছুই । তুমি তো সবই জানো ! তবে কেন এমন দৈন্য করছো ! তুমি তো আমার প্রাণ ! যে ব্যক্তির তোমাতে প্রীতি—- সে আমায় পায় । তোমার থেকে প্রিয়তম আমার যে আর কিছুই নেই । যে তোমাতে আর অদ্বৈতে ভেদ বুদ্ধি করে —-তার অবতারবাদ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান নেই । সে মূর্খ ।”
নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতকে একসাথে পেয়ে বিশ্বম্ভর বিষ্ণু গৃহের অভ্যন্তরে আনন্দে নৃত্য করতে থাকলেন । হুঙ্কার গর্জন করছেন আর বলছেন—- “দেখ ! দেখ !” আর অদ্বৈত ও নিত্যানন্দও প্রভুর বিশ্বরূপ দর্শন করে বিহ্বল বদনে বলছেন, “প্রভু ! প্রভু গো !” এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল শ্রীবাস ভবনে অথচ শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈত ভিন্ন কেউ টেরও পেলেন না । কারণ, সে কৃপাশক্তি মহাপ্রভু কাউকে দেননি । ওঁনাদের দু’জনকেই শক্তি সঞ্চার করেছিলেন দর্শন করার ।
পরবর্তীতে এসব কথা আচার্য অদ্বৈত সকলকে জানিয়েছিলেন । মনে রাখতে হবে, যার এতে অবিশ্বাস আছে—- সে নিশ্চয়ই দুষ্কৃতি, অভক্ত । যে গৌরচন্দ্রকে সর্বমহেশ্বর রূপে না মানে —-সে সর্বকালের পাপী । বৈষ্ণবের অদৃশ্য সে ।
এরপর মহাপ্রভু নিজের বিশ্বরূপ সম্বরণ করে নিলেন । ততক্ষণে স্নান সেরে সকল ভক্তরা অঙ্গনে এসে হাজির । গৌরাঙ্গ তাঁদের নিয়ে নিজ বাসায় গেলেন । আর এদিকে বিশ্বরূপ দর্শনের আবেশ অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে তখনও মত্ত করে রেখেছে । বৈভব দর্শন সুখে দু’জনাই গরগর তনু তখনও । ধূলায় গড়াগড়ি যাচ্ছেন, কখনও করতালি দিয়ে হাসছেন, কখনও বা নাচছেন, গান করছেন । দুই মহাবলী মহাজন ঢুলে ঢুলে পড়ছেন একে অপরের শ্রীঅঙ্গে । তারপর শেষে একসময় দু’জন গালি দিয়ে কলহ শুরু করলেন । অদ্বৈত বললেন—- “এই অবধূত মাতালিয়া কোথাকার ! এখানে কে তোকে ডেকে এনেছে যে তুই এলি ! দুয়ার ভাঙ্গার অবস্থা করে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করলি কেন, শুনি ? কে তোকে বলে রে সন্ন্যাসী ! তুই কোথাকার সন্ন্যাসী ! এমন কোন জাতি আছে, যার ঘরে তুই আহার করিস নি ! তাহলে তুই কি করে সন্ন্যাসী হলি রে ! মাতোয়াল এক চলে এসেছে বৈষ্ণব সভায় ! চলে যা, বলে দিচ্ছে এখুনি । পালা এখান থেকে ।”
অদ্বৈতের গালমন্দ দেওয়া শেষ হলে এবার নিত্যানন্দ বলা শুরু করলেন । এতক্ষণ তিনি সব শুনছিলেন বড় বড় চোখ করে । এবার বললেন, “আরে নাড়া ! বসে থাকো চুপ করে । পড়ে কিলাবে । আগে তোমায় আমার প্রতাপ দেখাই ! বুড়ো বামনা ! ভয় করে না, না তোমার ! জানো ,আমি কে ? আমি ঠাকুরের ভাই, মত্ত অবধূত । আর তুমি হলে গিয়ে স্ত্রী-পুত্র সমেত সংসারী মানুষ । জানো, আমি পরমহংসের পথের অধিকারী জন । আমি তোমায় যদি মারিও তাও তোমার অধিকার নেই কিছু বলার । কেন অকারণে আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে এসেছো ? বৃথা গর্ব দেখাচ্ছো ! আস্ফালন করছো ! কী ক্ষমতা তোমার !”
নিত্যানন্দের কথা শুনেই অদ্বৈত যেন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন । বললেন, “দিগম্বর হয়ে থাকো ! মৎস খাও, মাংস খাও—- কোথাকার সন্ন্যাসী এমন করে শুনি ! কোথায় তোমার পিতা, কোথায় মাতা, কোন দেশেই বা তোমার বসতি ? কেউ কী জানে তোমার ব্যাপারে কিছু, কেউ জানে না ! কোথা থেকে এক চোর এসেছে ! —-সর্বক্ষণ খাব, গিলবো, সংহার করবো এসব বলে চলেছে ! আরে সন্ন্যাসী তো তাকে বলা হয় যে কিছু চায় না । আর তুমি তো এমন যে একবেলায় তিন-তিনবার খাও। শ্রীবাস পন্ডিতের জাতি-জ্ঞান সব গেছে, কোথাকার এক অবধূতকে ঠাঁই দিয়েছে নিজের গৃহে ! এই অবধূতই সকল জাতি নাশ করলো ওর । কোথা থেকে মদ্যপ এসে বসে পড়েছে !” —-এভাবে কৃষ্ণপ্রেম সুধারসে কলহমত্ত হলেন দু’জন ।
কলহ করেন সর্বক্ষণ দু’জন–নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত । অথচ এঁনাদের একজনের পক্ষ হয়ে কিছু বললে, অন্য জনের নিন্দা করলে তার ভক্তি ক্ষয় হয়—- পতন হয় তার । নিত্যানন্দ-অদ্বৈতের কলহ হচ্ছে প্রেমকলহ । এই প্রেমকলহের মর্ম না জেনে একজনের প্রশংসা, অপরজনের বন্দনা করলে—- সে পুড়ে মরে নরকে । আবার শুধু তাই নয়, যদি এমনও হয় যে, অদ্বৈতের পক্ষ হয়ে বললো আর গদাধরের নিন্দা করলো —-সেক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে । সে কখনও অদ্বৈত-কিঙ্কর হতে পারে না । ঈশ্বর ঈশ্বরেরই কলহের পাত্র —-এখানে । এসবই তো বিষ্ণু-বৈষ্ণবের বৈভবের লীলা । বিষ্ণু ও বৈষ্ণব সমান দুই । অথচ পাষণ্ডী নিন্দুক যারা, তারা এই বৈভবকে বিপর্যয় ভাবে । যাঁরা সকল বৈষ্ণবের প্রতি অভেদ দৃষ্টি দিয়ে শ্রদ্ধা করে তারাই তো ভবতরণী তরতে পারে ।
শ্রীমন্ মহাপ্রভুর এই বিশ্বরূপ দর্শন দান লীলা যাঁরা শোনেন, পাঠ করেন, বিশ্বাস করেন—- তাঁরা কৃষ্ণধন প্রাপ্ত হন ।
(সংকলিত)
গ্রন্থ – মহাপ্রভুর মধুময় কথা
প্রকাশক – তথাগত
প্রাপ্তি–8100673093 তে হোয়াটসঅ্যাপ