Categories
প্রবন্ধ

ভারতের রসায়ন শিল্পের প্রথম পথিকৃত আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় :: প্রশান্ত কুমার দাস।।।।

বাংলার মাটিতে যে কজন বিজ্ঞানী জন্ম গ্রহণ করে তাদের গবেষণা ও কর্মধারায় উজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় । তিনি শুধু বিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদ ছিলেন না, তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষক, দার্শনিক, শিল্পপতি, কবি, এবং লোকহিতৈষী।

তার জন্ম অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলায় রারুলী নামক (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত) স্থানে ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট । পিতা হরিশচন্দ্র রায় এবং মাতা ভুবনমোহন দেবী। বাবা স্থানীয় জমিদার ছিলেন। বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্ল চন্দ্রের ছোটবেলা থেকেই সব বিষয়ে তুখোড় বুদ্ধি ছিলো। ১৮৭২ সালে বাবা কলকাতায় এনে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করান । কিন্তু রক্ত আমাশায় রোগে ভুগতে থাকেন, তাই আবার গ্রামে ফিরে যান । সেখানে বাবার নিজস্ব গ্রন্থাগারে বিভিন্ন বই পাঠ করতে থাকেন। এতে তার আলাদা জ্ঞান-চক্ষু খুলে যায়। এরপর ১৮৭৪সালে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। এবার তিনি অ্যালবাট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি এই আলবার্ট স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এরপরে মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হয়ে এফ এ পাশ করেন । এরপর প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হয়ে বি.এ পাশ করে গিলক্রিষ্ট বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যন্ডে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যান। এবং সেখান থেকেই B.Sc (1887) পাশ করেন। পরে সেখানে ডি.এস.সি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল-কপার ম্যাগনিসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি গবেষনা সমাপ্ত করেন এবং পি.এইচ.ডি ও ডি.এস.সি ডিগ্রী একসাথে লাভ করেন। তার এই গবেষনাপত্রটি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হওয়ায় তাঁকে “হোপ” প্রাইজে ভূষিত করা হয়।ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন এবং প্রায় ২৪ বছর এই কলেজে অধ্যাপনা করেন। এখানে তিনি রসায়ন নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা শুরু করেন। তাঁর উদ্দ্যোগে তাঁর নিজস্ব গবেষণা থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা তৈরী করেন ।পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে এই কারখানা স্থানান্তরিত করেন। এর নতুন নামকরণ হয় বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড।
শুধু তাই নয়, প্রফুল্লচন্দ্র রায় নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষনার কর্ম শুরু করেন। এই গবেষণাস্থল থেকেই পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সৃষ্টি হয় যা ভারতের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা গ্রহণ করে। তাই বলা যায় , বিংশ শতকের গোড়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য । ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস (HgNo2) নাইট্রেট আবিষ্কার করেন,
যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি সারাজীবনে ১২ টি যৌগিক লবন ,৫টি থায়োএষ্টার আবিষ্কার করেন।
অন্যদিকে সমবায়ের পুরোধা প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে একটি কো-অপারেটিভ ব্যঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৩ সালে তিনি পিতার নামে হরিশচন্দ্র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ।এছাড়া বাগেরহাট জেলায় ১৯১৮ সালে পি.সি.কলেজ নামে একটি কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন।
শিক্ষক হিসাবেও তিনি আচার্য নামে পরিচিত ছিলেন । তিনি ইংল্যণ্ড থেকে সি.আই.ই উপাধি লাভ করেন। ১৯১১ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট উপাধি দেয়। পরে মহীশূর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট হন। তিনি ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নাইট উপাধি লাভ করেন।
তিনি লেখক হিসাবেও সুপরিচিত ছিলেন-
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল –
১। ভারতঃ-সিপাহী বিদ্রোহের আগে এবং পরে ।
২. সরল প্রাণীবিজ্ঞান,বাঙ্গালী মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার।
৩. হিন্দু রসায়নী বিদ্যা ইত্যাদি ।মোট ১৪৫টি গবেষণাপত্র করেছিলেন।
তাঁর দেশের প্রতি এবং বাংলার ভাষার প্রতি অগাধ প্রেম ও ভক্তির পরিচয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। তিনি ক্লাসে পড়ানোর সময়ে বাংলায় লেকচার দিতেন। বাংলা ভাষা তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে ছিল। তার বাচনভঙ্গি এতো অপূর্ব ও প্রাণচাঞ্চল্য ছিলো যে সকল ছাত্র মনোমুগ্ধ হয়ে শুনতো। তার দুই উল্লেখযোগ্য ছাত্র হলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা। তিনি ছিলেন এক উদারপন্থী এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার আদর্শে বিশ্বাসী । ১৯৪৪সালে ১৬জুন কলকাতায় এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী পরলোক গমন করেন। বাংলায় বিজ্ঞানের প্রসারে, শিল্পায়নে, শিক্ষাক্ষেত্রে যে সব মহান বিজ্ঞানী চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এক উল্লেখযোগ্য নক্ষত্র এবং ভবিষ্যতেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *