Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের এক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান তুরতুক — এক ভ্রমণ কাহিনী।

ঘুরতে কে না ভালোবাসে। বিশেষ করে বাঙালিরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমনের নেশায়। কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র আবার কেউ প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান ভালোবাসে ভ্রমণ করতে। প্রকৃতি কত কিছুই না আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে। কতটুকুই বা আমরা দেখেছি। এ বিশাল পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই দেখিনি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আজ গোটা পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়় এলেও প্রকৃতিকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করা এ এক আলাদা রোমাঞ্চ, আলাদা অনুভূতি যার রেষ হৃদয়ের মনিকোঠায় থেকে যায় চিরকাল।। তাইতো আজও মানুষ বেরিয়ে পড়়ে প্রকৃতির কে গায়ে মেখে  রোমাঞ্চিত হওয়ার নেশায়।  আসুন ঘুরে আসি ভারতের ই জম্মু ও কাশ্মীরের এক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান তুরতুক।

 

তুর্তুক বাল্টিস্তান অঞ্চলে অবস্থিত, একটি অঞ্চল প্রায় সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।  তুর্তুক হল ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন পাঁচটি বাল্টি-জনবহুল গ্রামের মধ্যে একটি, বাকি চারটি হল বোগদাং, ত্যাক্ষী, চালুনখা এবং ধোথাং।  এটি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং এটির দাবি রয়েছে শ্যাওক উপত্যকার দক্ষিণ চোরবাট অংশের ঐতিহাসিক রাজধানী।  যদিও বোগডাং ১৯৪৮ সাল থেকে ভারত-শাসিত লাদাখের অংশ ছিল, অন্য চারটি গ্রাম ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী দখল করে নেয়।

 

তুর্তুক হল একটি গ্রাম এবং লাদাখের ভারতীয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে একটি নামী সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লকের সদর দফতর।  এটি কারাকোরাম রেঞ্জ এবং হিমালয়ের মধ্যে স্যান্ডউইচ করা একটি ছোট গ্রাম এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি ভারতের উত্তরের গ্রামগুলির মধ্যে একটি।  তুর্তুক লেহ জেলার নুব্রা তহসিলে, শেওক নদীর তীরে অবস্থিত।  ভৌগোলিকভাবে, গ্রামটি বালতিস্তান অঞ্চলে, যেটি পাকিস্তানি প্রশাসনের অধীনে ছিল, তুরতুক ব্লকের পাঁচটি গ্রাম ছাড়া যা ভারতের অংশ।  এই গ্রামগুলিই ভারতের একমাত্র অঞ্চল যেখানে বাল্টি জনগোষ্ঠী রয়েছে।  Turtuk তার ফলের জন্য পরিচিত, বিশেষ করে এপ্রিকট। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ পর্যন্ত তুর্তুক পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী গ্রামটি দখল করে নেয়।  এটি সিয়াচেন হিমবাহের প্রবেশদ্বারগুলির মধ্যে একটি।

 

“তুরতুক (Turtuk) বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত ভারতের সীমানার শেষ গ্রাম যা সমুদ্র সীমা থেকে ৯৮৪৬ ফিট (৩০০১ মিটার) উচুতে অবস্থিত। অদ্ভুত সুন্দর তুরতুক গ্রামটি সায়ক ভ্যালীতে অবস্থিত যা নুব্রা ভ্যালী এর অংশ বিশেষ। লেহ শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ২০৫ কিলোমিটার এবং নুব্রা ভ্যালীর ডিস্কিট শহর থেকে ৮৮ কিলোমিটার। ৩০০০ এর চেয়ে কিছু বেশি লোকের বসবাস আছে এই গ্রামে। ২০১০ সালে ট্যুরিস্টদের জন্যে এই গ্রামকে খুলে দেয়া হয়।

 

তুর্তুকের আশেপাশে পর্যটন—-

 

২০১০ সালে তুর্তুক পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। গ্রামটি শ্যাওক উপত্যকার দৃশ্য দেখায়।
শ্যাওক নদীর উপরে মালভূমিতে অবস্থিত কয়েকটি গোম্পা রয়েছে এবং গ্রামে একটি পুরানো রাজকীয় বাড়ি রয়েছে।  তুর্তুক ভারতের কয়েকটি স্থানের মধ্যে একটি যেখানে কেউ বাল্টি সংস্কৃতির সাক্ষী হতে পারে এবং গ্রামে কয়েকটি হোমস্টে এবং গেস্ট হাউস পাওয়া যায়।  এটিই শেষ বড় গ্রাম যেখানে নিয়ন্ত্রণ রেখার আগে পর্যটন কার্যকলাপের অনুমতি দেওয়া হয়

 

 

এই গ্রামের চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এই গ্রামের সবটুকু সবুজে মোড়ানো। এখানে ধান থেকে শুরু করে গম, জব, আলু, কপিসহ অন্যান্য তরকারি, আপেলসহ নানা রকম ফলমূল হয় নিয়মিত। নানা রকম ফুল, পাথুরে বাড়ি, ঝরনার বিশুদ্ধ পানি সবই আছে এখানে। গায়ে গায়ে লেপটে থাকা পাহাড়ের সারি, পাহাড় থেকে বয়ে চলা ঝরনা, ঝিরি ও নদী। এই গ্রামের বাইরের পাহাড়গুলো যখন বরফে বরফে মোড়ানো থাকে, তখনো এখানে বরফ পড়লেও সেটা খুব বেশি নয়, যাতে করে জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। বরফ পড়ে ঠিকই, কিন্তু একটু রোদের পরশ পেলেই সেই বরফ দ্রুত গলে গিয়ে পাশের সায়ক নদীতে গিয়ে পতিত হয়।”

 


সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ—-

 

“তুরতুক এর সব ঘর বাড়িই একদম নিখাদ পাথরের তৈরি। শুধু পার্থক্য এই যে, যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো, তারা পাথর সাইজ মতো করে কেটে নিয়ে কিছু সিমেন্টের ব্যবহার করে সাজানো বাড়ি বানাতে পারে। আর যাদের সেই অবস্থা নেই তারা নিজেদের মতো করে পাথর সংগ্রহ করে একটার পর একটা বসিয়ে দেয়, কখনো নদীর কাদার সাহায্যে বা শুধু পাথরের স্তূপ সাজিয়েই বানিয়ে ফেলে বসবাসের জন্য আস্ত ঘর বা বাড়ি। এখানে আছে বিদ্যুৎ, টিভি, ডিশের সংযোগসহ আর নানা রকম সুযোগ সুবিধা। এমনকি আছে মোবাইলও। এই গ্রামের যারা একটু অবস্থা সম্পন্ন বা যাদের নিজেদের থাকার ঘর ছাড়াও আছে দু-একটি বেশি বা তার চেয়ে বেশি রুম, সেগুলো ওরা টুরিস্টদের জন্য ভাড়া দিয়ে থাকে। যেখানে একদম কোলাহলমুক্ত একটি দিন বা রাত কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে নিশ্চিন্তে।

 

কিভাবে যাবেন—-

তুরতুক এ যেতে হলে আপনাকে বেশ রোমাঞ্চপ্রিয় হতে হবে। কলকাতা থেকে ট্রেনে দিল্লি, দিল্লি থেকে শ্রীনগর বা মানালি হয়ে বাসে বা রিজার্ভ জিপে করে লেহ শহরে। দিল্লি থেকে বাই রোডে লেহ যেতে সময় লাগবে অন্তত তিনদিন। দুই জায়গায় রাতে থাকতে হবে, শ্রীনগর বা মানালিতে এক রাত আর লেহ যেতে পথে আর এক রাত। রাতের থাকার খরচ নির্ভর করবে রুচি আর মানসিকতার ওপরে ৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত পাবেন, মানালি বা শ্রীনগর থাকতে। তবে এই রাস্তায় যেতে হলে বেশ কিছু ঝুকির ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে।”
খাওয়া দাওয়া—–

 

তুরতুকে থাকার পাশাপাশি টুরিস্টদের জন্য আছে কিছু খাবার হোটেলও, যেখানে বেশ সহনীয় মূল্যে পাবেন নানা রকম পছন্দের খাবার।

 

ইতিহাস—

 

ব্রগপা যুগ—-

 

তুর্তুকে বসবাসকারী প্রাচীনতম পরিচিত উপজাতি ছিল একটি দারদিক উপজাতি, স্থানীয়ভাবে ব্রোগপা নামে পরিচিত, যারা এখন পাকিস্তানের চিলাস থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।  তারা তুর্তুকে একটি অজানা সময় থেকে, বেশিরভাগ সম্ভবত, খ্রিস্টীয় ১৩ শতক পর্যন্ত বাস করত।  খ্রিস্টীয় ১৩ শতকের দিকে কোন এক সময়ে, চুলি এবং ইয়াংদ্রুং নামে দুই যোদ্ধা তুর্তুকে আসেন।  তারা রাজাকে হত্যা করে এবং অবশেষে স্থানীয়দের বেশিরভাগই তুর্তুককে স্রোতের ধারে এবং পাহাড়ের ওপারে, এখন হানু, দাহ এবং ডোমখার নামক গ্রামে পালিয়ে যায়।  এই মুহূর্তে, তুর্তুকের জনসংখ্যার অধিকাংশই চুলি এবং ইয়াংড্রং-এর সরাসরি বংশধর।  সময়ের সাথে সাথে, বাইরে থেকে লোকেরা কাজের সন্ধানে তুর্তুকে আসে, আরও বৈচিত্র্য আনে।  শিখ সাম্রাজ্য কর্তৃক বাল্টিস্তান জয়ের আগ পর্যন্ত তুর্তুক একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল বলে মনে করা হয়।
তুর্তুকের লোকেরা ইসলামের আগে বন ধর্মের অনুসারী ছিল।  বনের আচারগুলি ঐতিহ্যের পাশাপাশি স্থাপত্য উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায়।  বিখ্যাত পারস্যের সুফি কবি ও ধর্ম প্রচারক সৈয়দ আলী শাহ হামদানির কারণে তুর্তুকে ইসলাম এসেছে।  বাল্টিস্তানের অন্যান্য জায়গার মতো তুর্তুকের লোকেরাও শাহ হামদানির একজন শিষ্য সৈয়দ মোহাম্মদ নূরবকশের নামানুসারে সুফি সম্প্রদায়ের সুফি নূরবকশিয়া অনুশীলন করে।  কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে, শিয়া, হানাফী এবং পরবর্তীতে ওহাবিদের মত বাইরের প্রভাবশালী সম্প্রদায় বাল্টিস্তানের সুফি নূরবকশিয়া এবং তুরতুকের নূরবকশিয়াকেও ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে।  অতি সম্প্রতি, তুরতুকের হানাফীরাও সুন্নিদের আরও চরম উপসেটে রূপান্তরিত হয়েছে।  এই মুহুর্তে, জনসংখ্যার মাত্র অর্ধেকই নূরবকশিয়াদের চর্চা করে আর বাকিরা হয় সুন্নি বা ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের।

 

ইয়াবগো রাজবংশ—-

 

তুর্তুক সহ বাল্টিস্তানের চোরবাত-খাপলু অঞ্চলটি এক হাজার বছর ধরে তুর্কিস্তানি ইয়াবগো রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছিল।  তাদের শাসন শুরু হয়েছিল যখন বেগ মানথাল ৯ম শতাব্দীতে ইয়ারকান্দ থেকে এই অঞ্চলে আসেন এবং খাপলু জয় করেন।  ১৩শ শতাব্দীতে ইসলামী পণ্ডিত ও কবি মীর সাইয়্যেদ আলী হামাদানির আগমনের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের আধিপত্য ছিল।

 

ডোগরা রাজবংশ—

 

হাজার বছরের ইয়াবগো শাসন ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, যখন শিখ সাম্রাজ্যের একজন ভাসাল জম্মুর রাজা গুলাব সিং এই অঞ্চলটি জয় করেছিলেন।  রাজত্ব হারানোর পর, ইয়াবগো আবদুল্লাহ খান পরিবারের নাম পরিবর্তন করে কাচো (“হালকা ওজনের জন্য বাল্টি) রেখেছিলেন, যদিও পরিবারটি একটি ধনী, শক্তিশালী পরিবার ছিল।
প্রথম অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধের পর, ব্রিটিশরা গুলাব সিং-এর অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।  গুলাব সিংয়ের ডোগরা রাজবংশ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজের অধীনে এই অঞ্চল শাসন করেছিল।

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

 

 

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *