Categories
প্রবন্ধ

আফসোস কি আজ হয় আমেরিকার? : তন্ময় সিংহ রায়।

বেনারসের এক মন্দির থেকে বের হওয়ার পথে একবার স্বামী বিবেকানন্দকে ঘিরে ধরেছিল
বেশ কিছু বানর ,
এমত পরিস্থিতিতে স্বামীজি অপ্রস্তুতরূপে ছুটতে লাগলেন দিগভ্রান্ত হয়ে , কিন্তু তা হলে হবে আর কি?
বানর কি আর আধুনিক মানুষ?
স্বভাবতই বানরগুলো সে অবস্থাতে দাঁড়িয়েও অব্যাহত রেখেছে এঁদের বাঁদরামি কর্মকাণ্ড।
কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তা লক্ষ্য করে তাঁকে বলে বসলেন , ‘মশাই! থামুন এবং ওদের মুখোমুখি হোন।’
তা শুনে বিবেকানন্দ তৎক্ষণাৎ ঘুরে এগোতে লাগলেন বানরগুলোর দিকে ,
আর এই মনোভাবের কারণে সব বানর পালিয়েও গেল সেখান থেকে।

 

শেষে এই ঘটনা থেকে তিনি শিখলেন যে , ভয়ে পালিয়ে না গিয়ে তার মুখোমুখি হতে হবে , অর্থাৎ পিছনে না হটে , জয় করতে হবে ভয়কেই।
এর বহু বছর পর তিনি এক সম্বোধনের মাধ্যমে  বলেছিলেন , ‘যদি কোনও কিছু কারণ হয় তোমার ভয়ের , তবে তা থেকে পালিয়ে যেও না , ভয়ের মুখোমুখি হও আর জিতে নাও ভয়কে।’

বিদেশ যাওয়ার সময় স্বামী বিবেকানন্দকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে , ‘আপনার পরিধেয় বাকি জিনিসগুলো কোথায়?’
‘এইতো সব’ , তিনি উত্তর দিলেন।
কেউ কেউ তো আবার ব্যঙ্গ করে বসলেন বলেই , ‘আরে! আপনার সংস্কৃতি কেমন? শরীরে শুধু জাফরানের চাদর জড়ানো?’

 

এ নিয়ে তিনি হেসে বললেন , ‘আমাদের সংস্কৃতি তোমাদের সংস্কৃতি থেকে আলাদা।
আপনাদের সংস্কৃতি গড়ে তোলে আপনাদের
দর্জিরা , অন্যদিকে আমাদের সংস্কৃতি আমাদের চরিত্র দ্বারা তৈরি।
সংস্কৃতি পোশাকে গড়ে ওঠে না , গড়ে চরিত্রের বিকাশে।’
তো এমনই ছিল স্বামীজির জীবন দর্শন।

যাইহোক , জাহাজ ও খান দুয়েক ট্রেন পাল্টে অবশেষে ৩০ শে জুলাই রাত ১১ টায় তিনি উপস্থিত হলেন শিকাগোয়।
ক্লান্ত , অবসন্ন শরীরটা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে তাঁকে ফেলেছে এক চরম অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতে , এমনটাই যেন তাঁর মনে হচ্ছিল।
অবশেষে পরিস্থিতি ধারণ করলো আরো জটিল আকার যখন তিনি জানতে পারলেন যে , ধর্মমহাসভায় পরিচয়পত্র আবশ্যক ও  যোগদানের তারিখও গেছে রীতিমতন পেরিয়ে।
এ হেন সংবাদ কানে প্রবেশ করা মাত্রই মুহুর্তের মধ্যে তাঁর মনে হতে লাগলো যে , অতি যত্নে সাজানো সমস্ত রঙীন স্বপ্নগুলো তাঁর চোখের সামনেই হয়ে যাচ্ছে ভেঙে-চুরে , দুমড়ে-মুষড়ে!
একদিকে শিকাগোর মতন বড়লোকি শহরে থাকার খরচ ,
অন্যদিকে সামান্য পুঁজি , তাও আবার ফুরিয়ে আসার মুহুর্তে।
হঠাৎই তিনি আবিষ্কার করলেন বস্টন নামক এক শহর , যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ অনেকাংশে কম। অবশেষে বস্টন অভিমুখে রওনাকালীন ট্রেনে স্বামীজির পরিচয় হয় ক্যাথেরিন স্যানবর্ন নামক এক ধনী ও প্রভাবশালী মহিলার সাথে।

 

প্রতিভাদীপ্ত , সুদর্শন ও সুঠামদেহী এক পুরুষের সাথে তিনি নিজেই এসে পরিচয় করে দু-এক কথায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর বাড়িতে থাকার জন্যে সেই মহিলা স্বামীজিকে জানালেন হার্দিক আমন্ত্রণ।
এমনই এক সুযোগের একান্ত ইচ্ছায় যেন অপেক্ষা করছিলেন অধীর আগ্রহে তিনি , অতএব সেমত অবস্থায় স্বামীজি সাদরে গ্রহণ করলেন সে আমন্ত্রণ।
ক্যাথেরিন স্যানবর্নের বাড়িতে থাকাকালীন স্বামীজি তাঁর এক শিষ্যকে চিঠিতে জানালেন ,
‘এখানে থাকায় আমার প্রতিদিনের এক পাউন্ড করে বেঁচে যাচ্ছে , আর তাঁর (ক্যাথেরিন স্যানবর্ন) প্রাপ্তি হল এই যে , তিনি তাঁর বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে দেখাচ্ছেন আমি নামক ভারতের এক বিচিত্র জীবকে!’

বস্টনে থাকাকালীন ক্যাথেরিন স্যানবর্নের সূত্রে সেখানকার শিক্ষিত সমাজে স্বামীজি ক্রমশই হয়ে উঠেছিলেন ভীষণভাবে পরিচিত।
আর এভাবেই কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে অকস্মাৎ ক্যাথেরিনের মাধ্যমে স্বামীজির পরিচয় হয় হাভার্ড ইউনিভার্সিটির এমন একজন সুবিখ্যাত প্রফেসার জন হেনরি রাইটের সাথে , যাকে বলা হত ‘বিশ্বকোষতুল্য জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকারী।’

 

কিন্তু স্বামীজির তেজোদীপ্ত প্রতিভার আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি নিজেই। পরিচয়পত্র না থাকায় তিনি (স্বামীজি) মহাধর্মসম্মেলনে যোগ না দিতে পারার সংক্ষিপ্ত কারণ বিশ্লেষণে প্রফেসার প্রত্যুত্তর করলেন ,
‘মহাশয় , আপনার কাছে পরিচয়-পত্র চাওয়ার অর্থ এমন যে , সূর্যকে প্রশ্ন করা যে তাঁর কিরণ দেওয়ার অধিকার আছে কিনা?’
অতঃপর মহাধর্মসম্মেলনের এক কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে প্রফেসার রাইট লিখলেন :
‘ইনি (স্বামীজি) এমন একজন ব্যক্তি যে , আমেরিকার সমস্ত প্রফেসারের পান্ডিত্য এক করলেও এঁর পান্ডিত্যের সমান হবে না।’
অতঃপর বস্টনে সপ্তা তিনেক থাকার পর শেষে তিনি রওনা হলেন শিকাগো অভিমুখে।

১১ সেপ্টেম্বর  ১৮৯৩ , শিকাগোর কলম্বাস হলে সকাল ১০ টায় বিশ্ব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল যে আধিদৈবিক , সিংহপুরুষের দ্বিতীয় অধিবেশনের কালজয়ী ও ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে তিনি আর কেউ নন , স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।
“সিস্টার্স এন্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা”……
হাজার হাজার দর্শকমণ্ডলীর হর্ষধ্বনি ও করতালিতে ফেটে পড়েছিল সে মঞ্চ।
মনে হচ্ছিল এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু শক্তিশালী আঁধি সেই মুহুর্তে , সেই স্থানের উপস্থিতজনেদের উপর দিয়ে গেল বয়ে।
না , কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের জয়ঢাক তিনি বাজাননি। মহাধর্মসম্মেলনে যেখানে সবাই নিজ নিজ ধর্ম সম্বন্ধেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন , সেখানে স্বামীজি দেখিয়েছিলেন , সব ধর্মই সত্য , কারণ প্রতিটা ধর্মই মানুষকে পৌঁছে দেয় একই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে।

১৯৯২ সালে স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার একশত বছর পূর্তির আগে এলেনর স্টার্ক নামক এক আমেরিকান মহিলা স্বামীজিকে নিয়ে ‘দ্য গিফট্ আন-ওপেন্ড.. এ নিউ আমেরিকান রেভলিউশন’ নামক একটি বই লিখেছিলেন , যাতে লেখিকা স্বামীজির বাণীকে বর্ণনা করেছেন ‘উপহার’ বলে অর্থাৎ , ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকাকে দেওয়া উপহার।
তিনি বলেছেন , ‘সেই উপহারের প্যাকেট আমেরিকা খুলে পর্যন্ত দেখেনি , স্বামীজির বাণীকে তাঁরা জীবনে ব্যবহারও করেননি।

 

যদি তাঁরা তা করত , একটা নতুন ধরণের বিপ্লব ঘটে যেত সমগ্র আমেরিকাবাসীদের জীবনে।’
ঐ বইতেই তিনি উল্লেখ করেছেন এও যে ,
‘কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকা মহাদেশের ভূখন্ডটা , কিন্তু বিবেকানন্দ আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকার আত্মাকে।’

‘আমি মুসলমানের মসজিদে যাব , খৃষ্টানদের গির্জায় প্রবেশ করে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর সামনে হব নতজানু , বৌদ্ধদের বিহারে প্রবেশ করে আমি বুদ্ধের শরণাপন্ন হব , আবার অরণ্যে প্রবেশ করে হিন্দুদের পাশে বসে ধ্যানমগ্নও হব ,
শুধু তাই নয় , ভবিষ্যতে যে সব ধর্ম আসতে পারে ,
সেগুলোর জন্যেও আমার হৃদয় আমি উন্মুক্ত রাখবো  সর্বদাই।’

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজ ,
একবিংশ শতাব্দীতে এই প্রথম ভাগে দাঁড়িয়েও আমরা চুড়ান্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন , আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমজ্জিত ও চরম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা যেন বইছে আমাদের রক্তে।
রাজনীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
বইয়ের পাতা ও মূর্তিতেই অসহায়ভাবে যেন আটকে আছে তাঁর অমূল্য সব আদর্শগাথা।
তাঁর আদর্শের পরমানুটুকুও যেন ক্রমশঃ আমাদের শরীর থেকে হতে চলেছে নিশ্চিহ্ন!
শরীরের লজ্জা আমরা সহজেই ঢাকতে পারি পোষাক দিয়ে কিন্তু মনুষ্যত্বের এ লজ্জা আমরা ঢাকবো কোন পোষাকে??

 

এলেনর স্টার্ক চিনেছিলেন স্বামীজি নামক
কোহিনূরকে , প্রফেসর জন হেনরি রাইট জেনেছিলেন
বিবেকানন্দকে , চিনেছিলেন ক্যাথরিন স্যানবর্ণ ,
কিন্তু আমরা তাঁকে জেনেছি কি তাঁকে আজও?
তাঁর দেখানক পথ কি বাস্তবে আদৌ আমরা করি মিনিমাম অনুসরণ?
মহাসমাধী দিবসের এই পূণ্যলগ্নে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ও
সশ্রদ্ধ প্রণাম , পাশ্চাত্যে যোগ ও বেদান্ত দর্শনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *