Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস, দশম পর্ব) :  দিলীপ রায়।

কাঞ্চন নগরের ঢোকার আগে রাস্তার বাঁকে পৌঁছে কুহেলি ভয়ে, আতঙ্কে দিশাহারা । চারিদিকে অন্ধকার । রাস্তা সুনসান । জনমানব শূন্য । অন্ধকারে জোনাকি পোকার আনাগোনা । তাদের জ্যোৎস্নার মতো আলোর ঝিকিমিকি । হঠাৎ ! হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে সম্ভবত বাদুড় উড়ে গেলো । বাদুড়ের কালো পাখনা মাথা ছুঁয়ে যাওয়ায় অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো কুহেলি । দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে । আবার সেই মৃদুমন্দ স্বরে ডাক ভেসে আসলো, “কুহেলি !”
এবার সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলো কুহেলি । এই রকম গা-ছমছম পরিস্থিতিতে কুহেলি প্রথম । ইতিপূর্বে এর চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতি সামলেছে কুহেলি । শুধু তাই নয়, একাই সামলেছে । তখন একটিবারের জন্য নিজেকে দুর্বল মনে হতো না । কুহেলি বরাবর একটু অতিরিক্ত সাহসী । শরীরের জোরও তেমনি শক্তিশালী । চেহারাটা বলা চলে মারকুটে চেহারা । ভয়ডর কম । কুহেলির চেহারায় তারুণ্যের ছাপ স্পষ্ট । তার যৌবনকালের চেহারার গঠন এতটাই সুন্দর যেটা দেখে পথচলতি পুরুষেরা কুহেলির দিকে একবার হলেও তাকাবে । কোনো পথচলতি ছেলে-ছোকরা কুহেলিকে অবাঞ্ছিত শব্দ প্রয়োগ করলে, তাকে কুহেলির কাছে উচিত শিক্ষা পেতেই হবে । উচিত শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কুহেলির ভয়ডর কম । কেউ তাকে তার অসতর্ক মুহূর্তে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে সেই বান্দা কুহেলির হাত থেকে রেহাই পাবে না । কয়েক ঘা না দিলে কুহেলির মনে শান্তি আসে না । এহেন কুহেলি এই মুহূর্তে ভয়ে ভীতিতে শঙ্কিত !
ভয় পাওয়ার আরও একটা কারণ সেটা হচ্ছে থানার বড়বাবু তাকে সতর্ক করে বলেছেন, কটা দিন সাবধানে চলাফেরা করতে । রাতে বাড়ির বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন । এমনকি বলেছেন, নারী পাচারকারীর টার্গেট সে নিজে । তাই বড়বাবুর কথা যতো ভাবছে, ততোই কুহেলি ভয়ে কাতর, আতঙ্কগ্রস্ত ।
কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না । রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে নির্ঘাত গাড়ির খপ্পরে পড়তে হবে । গাড়িতে কারা ওত পেতে বসে আছে সেটা কুহেলির কাছে অজানা । তাই রাস্তার উপরে রাত্রির অন্ধকারে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করার চেষ্টা করতে লাগলো । গাঁয়ের মানুষ জমি জায়গায় সারাদিন খাটাখাটুনির পর অল্প রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়েন । যার জন্য রাস্তায় লোক চলাচল নেই । রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল করলে তাদের পেছন পেছন কুহেলি ঠিক বাড়ি পৌঁছে যেতে পারতো । কিন্তু সেটাও হবার নয় । কুহেলি আতঙ্কে দিশাহারা । আজ নির্ঘাত নারীপাচার চক্রের শিকার সে হবেই । কীভাবে নিজেকে বাঁচাবে, সেই চিন্তায় অস্থির !
হঠাৎ !
হঠাৎ দূরে পায়ের শব্দ ! মনে হচ্ছে বেশ কিছু মানুষ ছুটছে ! আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে । আওয়াজটা তার দিকেই ধেয়ে আসছে । বুটজুতোর শব্দ ! চমকে গেলো কুহেলি ! কুহেলি ভাবছে, লোকগুলি কী তাকে ধরার জন্য ধেয়ে আসছে ! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো কুহেলি । কী করবে বুঝতে পারছে না । নিজেকে কীভাবে বাঁচাবে তার কূল-কিনারা পাচ্ছে না । অথচ অন্ধকারে মনে হচ্ছে দুর্বৃত্তগুলি প্রায় তার কাছাকাছি এসে গেছে । উপায়ান্তর না দেখে কুহেলি রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকালো । এমনভাবে লুকালো, তাকে অন্তত রাস্তা থেকে কেউ দেখতে পাবে না ।
কুহেলির দৃষ্টি রাস্তার দিকে । ঘনকালো অন্ধকারে যেটা বুঝতে পারলো, সামনে চারজন নারী পাচারকারী দুর্বৃত্ত প্রচণ্ড গতিবেগে ছুটছে, আর পেছনে তিনজন পুলিশ রাইফেল হাতে দুর্বৃত্তদের ধরার জন্য মরিয়া । কুহেলি চোখ দুটি মুছে ভাল করে তাকিয়ে দেখে থানার বড়বাবু সঙ্গে আছেন । দুর্বৃত্তদের খবর পেয়ে তিনি চটজলদি পুলিশ নিয়ে জোর তল্লাশিতে নেমে পড়েছেন । বড় রাস্তার দিকে ঠিক যেখানে তার চায়ের দোকান, সেদিকে ছুটছেন ।
ইতিমধ্যে কুহেলি যেখানে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই সোজা বরাবর আরও দুইজন পুলিশ এসে দাঁড়ালেন । দাঁড়িয়ে কুহেলিকে ডাকছেন, “কুহেলি ম্যাডাম ! শিগ্‌গির আমাদের গাড়িতে উঠুন ।“
কুহেলি থানার পুলিশ দেখে আশ্বস্ত হলো । তাঁদের কথা মতো বিনা বাক্যে গাড়িতে গিয়ে উঠলো ।
থানার পুলিশ কুহেলিকে বললেন, “আপাতত আপনার দোকানের কাছে আমরা যাচ্ছি । পরিস্থিতি বুঝে সময় মতো আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো । আপনি ঘাবড়াবেন না । স্বয়ং বড়বাবু আমাদের পুলিশ টীমকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ।“
কুহেলি ভয়ে ভয়ে পুলিশের কাছে জানতে চাইলো, “ঐ দুর্বৃত্তেরা এতক্ষণ কোথায় ছিল ?”
উত্তরে পুলিশ জানালেন, তাহলে শুনুন ঘটনাটা ।
“আপনি যখন ভরতপুর ছাড়লেন, ঠিক সেই সময় আমাদের গোপন-সংবাদদাতা (ইনফর্মার) খবর দিলো নারী পাচারকারী দুর্বৃত্তেরা দলে চার জন এবং তারা কাঞ্চন নগরে ঢোকার মুখে ঘোরাঘুরি করছে । একজনের মুখে অনেক দাড়ি । সম্ভবত তাদের টার্গেট কুহেলি । সঙ্গে সঙ্গে আমরা বড়বাবুকে জানাই । বড়বাবু তখন মহাকুমা আধিকারিকের সঙ্গে মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন । খবর পাওয়া মাত্র তিনি ছুটে এলেন । আমরা পাঁচজনের টীম বেরিয়ে পড়ি । বড়বাবু আসতে একটু সময় লাগার কারণে আমাদের পৌঁছাতে রাত্রি হয়ে গেলো । মোড়ে এসে দেখি আপনি তখনও দোকানে কাজকর্ম সারছেন । আমরা আপনাকে বিরক্ত করিনি, এমনকি জানাইনি !”
এইটুকু শোনার পর কুহেলি পুলিশকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “স্যার, আমাকে জানালেন না কেন ?”
বলছি, সব বলছি । গাড়িতে রাখা জলের বোতল থেকে জল খেয়ে বললেন, “আমরা আপনাকে খবর দিইনি তার একটাই কারণ আপনি আমাদের সাথে থাকলে এবং সেটা দুর্বৃত্তরা জেনে গেলে তাদের ধরা বা তাদের ধাওয়া করা সম্ভব হতো না । কেননা দুর্বৃত্তদের টার্গেট ছিলেন আপনি । আমাদের কাছে খবর ছিল, আপনাকে তুলে পাচার করার সমস্তরকম ব্যবস্থা তাদের পাকা ! তা ছাড়া আমাদের বিশ্বাস ছিল, আপনি বাড়ির দিকে রওনা দিলে দুর্বৃত্তরা আপনাকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে । সেই সময় আমাদের অভিযান চালানো সহজ হবে এবং দুর্বৃত্তদের অবস্থান ও মুভমেন্ট সম্বন্ধে আমরা ওয়াকিবহাল হয়ে যাবো । সেইজন্য আমরা আপনার পাহাড়ায় ছিলাম । যাতে তারা আপনাকে কোনোভাবেই তুলে নিয়ে পালাতে না পারে । আর বড়বাবু সহ আরও দুইজন গিয়েছিলেন আপনাদের কাঞ্চন নগরে ঢোকার বাদিকের জলাশয়ের দিকে । বিশেষ একটি সূত্রে বড়বাবু জানতে পেরেছিলেন, দুর্বৃত্তরা নির্ঘাত জলাশয়ের আশেপাশে লুকিয়ে রয়েছে ।“
“জলাশয়ের আশেপাশে নারী পাচারকারী দুর্বৃত্তেরা লুকিয়ে রয়েছে, বড়বাবু কীভাবে টের পেলেন ? তাঁর টের পাওয়ার সূত্রটা কী ?” আবার কুহেলি প্রশ্ন করলো ?
অন্ধকারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে বিড়ি খাওয়ার ধোঁয়া উড়ছিল । সেইটাই দুর্বৃত্তদের কাল হলো । ধোঁয়া নিশানা করে বড়বাবু দুর্বৃত্তদের হদিশ পেয়ে গেলেন । বড়বাবু খুব সন্তর্পণে এগোচ্ছিলেন । তারপর দুর্বৃত্তরা যেভাবে হোক টের পায়, পুলিশ তাদের ধাওয়া করছে । তাদের ধরার জন্য পুলিশি অভিযান বুঝতে পেরে, তখন তারা বেপরোয়া । বাঁচার জন্য মরিয়া । পালাবার জন্য প্রচণ্ড গতিতে দুর্বৃত্তরা ছুটছিল । ইতিমধ্যে আমরা খবর পেয়েছি, দুর্বৃত্তদের গাড়ি নোনাই নদীর ব্রিজ পার হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে । সেখানে নিকটবর্তী থানা থেকে আরও পুলিশ এসে হাজির । তাঁরা দুর্বৃত্তদের গাড়ি ঘিড়ে মোতায়েন রয়েছেন । আজ বাছাধনদের রেহাই নেই, ধরা পড়তেই হবে । আমাদের ফাঁদ পাতা থেকে কিছুতেই নারীপাচার চক্রের দুর্বৃত্তরা পালাতে পারবে না ।“
ইতিমধ্যে কুহেলিদের গাড়ি বড় রাস্তার উপরে পৌঁছালো ।
বন্দুকের গুলির জোরালো শব্দে কুহেলির কান ঝালাপালা !
গুলি চলছে । পুলিশ ও দুর্বৃত্তদের মধ্যে বন্দুকের গোলাগুলি । ভীষণ আওয়াজ ! নারী পাচারকারী দুর্বৃত্তরা সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ !
গোলাগুলির সময় দুইজন দুর্বৃত্ত বাবলা নদীর দিকে পালিয়ে বাঁচে । তাদের ধরতে পারেননি থানার বড়বাবুরা । দুজনকে ধরে গাড়িতে তুললো। তবে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ! অন্যদিকে থানার নির্মলবাবু দুর্বৃত্তদের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তির জন্য পায়ে ভীষণ চোট পেয়েছেন । যার জন্য যন্ত্রণায় ছটফট । বড়বাবু থানার নির্মলবাবুর জন্য উদ্বিগ্ন । আর একজন পুলিশের মুখ থেকে যেটুকু জানতে পেরেছে, নারী পাচারের দলটা ভিন্‌ রাজ্য থেকে এসেছে । তারা টীম ভাগ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের পাচার করার জন্য অল্প বয়সী মেয়েদের বেছে বেছে ধরছে । এটা নাকি শক্তিশালী নারী পাচারকারী দল । শোনা যায়, এই দলের সাথে দেশের প্রভাবশালী মানুষের যোগাযোগ । যার জন্য পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে নারী পাচারের মতো জঘন্য কাজ তারা নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছে । কিন্তু প্রশাসনিক তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন অশ্বস্তিতে ।
পরক্ষণেই খবর এলো, বড়বাবু দুজন দুর্বৃত্তকে থানার লক্‌ আপে ঢুকিয়ে দিয়ে ছুটেছেন হাসপাতালে । হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে ঘুম থেকে তুলে নির্মলবাবুর পায়ের চিকিৎসা করালেন । তিনি হাসপাতাল থেকে নির্দেশ দিলেন, “কুহেলিকে স-সম্মানে বাড়িতে পৌঁছে দিতে ।“ সেই মোতাবেক পুলিশ দুইজন গাড়ি ঘুরিয়ে ঐ রাত্রিতে সোজা কুহেলিদের বাড়ি । রাত্রিবেলায় পুলিশের গাড়িতে কুহেলিকে দেখে কানাই কাকা ঘাবড়ে গেলো । চোখ মুখে আতঙ্কের ছাপ ! তার ভাইঝির কী হলো । তার সঙ্গে পুলিশ কেন ? কৌতুহলি দৃষ্টিতে একজন পুলিশকে কানাই কাকা জিজ্ঞাসা করলো, “তার ভাইঝির কী হয়েছে ?”
“আপনার ভাইঝি নারীপাচারকারী দলের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছিলো । আমাদের থানার পুলিশের সক্রিয় তৎপরতার জন্য এই যাত্রায় কুহেলি দেবী বেঁচে গেলেন । তবে বিপদ এখনও কাটেনি । পুরো দলটি যতক্ষণ ধরা না পড়ছে ততক্ষণ বিপদ কাটছে না, বরং বিপদ থেকেই যাচ্ছে । সুতরাং আপনার ভাইঝিকে একটু সাবধানে রাখবেন । বেগতিক ওলট-পালট কিছু বুঝলে আমাদের খবর দিতে ভুলবেন না । আপনার অবগতির জন্য জানাই, আমাদের তৎপরতার জন্য এখানকার দুই জন দুর্বৃত্ত ধরা পড়েছে । তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যাবে ।“ তারপর পুলিশ হাত জোড় করে কানাই কাকাকে বললেন, “আমরা এবার চলি ।“
কানাই কাকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ।
পরেদিন খবরের কাগজে কুহেলির ছবিসহ খবর হেডলাইন !
বেশী বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো কুহেলি । খবরের কাগজ হাতে নিয়ে গাঁয়ের গোলাপী এসে হাজির । গোলাপী ও কুহেলি প্রায় সমবয়সী । পেপার দেখে কুহেলি তাজ্জব !
খবরের কাগজে খবর হওয়ায় কুহেলির বাড়িতে নানান জায়গার মানুষের ঢল । সকলের চোখে উদ্বিগ্নতার ছাপ । গাঁয়ের বয়স্ক মানুষেরা কুহেলির কাছে তার শারীরিক অবস্থার খুঁটিনাটীর খোঁজখবর নিচ্ছেন । উপযাজক হয়ে গাঁয়ের মাসি, কাকি, জেঠিমা কুহেলির খোঁজ খবর নিচ্ছেন । সকলকে কুহেলির একটাই কথা, “থানার পুলিশের আন্তরিক প্রয়াসের জন্য আমি বেঁচে বাড়ি ফিরেছি । তাই আমি থানার পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ !”
 (চলবে)

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *