উত্তম কুমার ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাংলা সিনেমার একজন কিংবদন্তী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক রূপে পূজিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলার প্রথম সুপারস্টার হলেন উত্তম কুমার। তার সময়ে তাকে ম্যাটিনি আইডল বলা হত।উত্তম কুমার, যিনি মহানায়ক নামে পরিচিত, ছিলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সুরকার এবং গায়ক যিনি মূলত বাংলা সিনেমায় কাজ করতেন। কুমার অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (১৯৬৭), এবং চিরিয়াখানা (১৯৬৭) ছবিতে কাজের জন্য সেরা অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। কুমার ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সফল এবং প্রভাবশালী অভিনেতা। কুমারের কর্মজীবন ১৯৪০-এর দশকের শেষ থেকে ১৯৮০ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিন দশক ধরে বিস্তৃত ছিল।
তিনি ২০০ টিরও বেশি চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, এবং তার কিছু বিখ্যাত কাজ হল অগ্নি পরীক্ষা, হারানো সুর, বিচারক, সপ্তপদী, ঝিন্দর বান্দি, দেয়া নেয়া, লাল পাথর, জতুগৃহ, থানা থেকে আসছি।
জন্ম ও পরিবার—
অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায় মাতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মা চপলা দেবী। তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার দুই ভাই ছিল, বরুণ কুমার ও তরুণ কুমার। তার ছোট ভাই তরুণ কুমারও একজন অভিনেতা ছিলেন। “উত্তম” ডাকনাম তাকে তার মাতামহ দিয়েছিলেন।
ছেলেবেলা—-
উত্তম কুমারকে চক্রবেরিয়া হাই স্কুলে ভর্তি করা হয় এবং পরে সাউথ সাবারবান স্কুলে ভর্তি হন যেখানে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি “লুনার ক্লাব” নামে একটি নাট্যদলের নেতৃত্ব দেন। কুমারের প্রথম ভূমিকা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুকুটে। দশ বছর বয়সে, তিনি নাটকে তার ভূমিকার জন্য একটি ট্রফি জিতেছিলেন। তিনি তার উচ্চ শিক্ষার জন্য গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে যোগদান করেছিলেন, কিন্তু তার পরিবারের আর্থিক অসুবিধার কারণে এই শিক্ষাটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তারপর তিনি কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট কে ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন, যেখানে তিনি প্রতি মাসে ৭৫ টাকা বেতন পেতেন। নিদানবন্ধু ব্যানার্জির কাছে গান শেখেন। তিনি লাঠি খেলা শিখেছিলেন এবং কুস্তি অনুশীলন করতেন। তিনি পরপর তিন বছর ভবানীপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনে সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হন। তার পরিবার সুহৃদ সমাজ নামে একটি অপেশাদার নাট্যদলে যুক্ত হন।
কর্মজীবন—-
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিলেন। তাই পারিবারিক আর্থিক অনটনের জন্য চলচ্চিত্র জগতে আসা সহজ ছিলো না। তাই এক সাধারণ পরিবারের বড়োছেলে হিসেবে সংসারের হাল ধরতে চাকরির খোঁজ শুরু করেন তিনি। অনেক খুঁজে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বন্দরে কেরানির চাকরি নেন উত্তম কুমার। চাকরি করার জন্য কলেজ শেষ করতে পারেননি তিনি। যখন তিনি শেষ বর্ষের ছাত্র তখন তাঁকে কলেজ ছাড়তে হয় কাজের চাপে। পড়াশোনা খুব বেশি দূর করতে না পারার আক্ষেপ ছিলো তাঁর বরাবর। কলকাতা বন্দরে কেরানির চাকরিতে মাসিক ২৭৫ টাকা মাইনে দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। তবে চাকরি করলেও অভিনয় থেকে বিরত থাকতে পারেননি।
চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার—
শুরুতে অরুণ কুমার নামে কিছু বানিজ্যিক ভাবে অসফল সিনেমা দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করলেও কিছু সময় পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার সব থেকে জনপ্রিয় নায়ক। কুমার ১৯৪৭ সালে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করেন, হিন্দি ফিল্ম মায়াডোরে অতিরিক্ত হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন, যেটি কখনও মুক্তি পায়নি। তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ছিল ১৯৪৮ সালের চলচ্চিত্র দৃষ্টিদান, যা নিতিন বোস পরিচালিত এবং অসিত বারান অভিনীত। পরের বছর, তিনি কামোনা ছবিতে নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন, আবার তার নাম পরিবর্তন করে উত্তম চ্যাটার্জি রাখা হয়। পরে তিনি আবার নিজের নাম পরিবর্তন করে অরুণ কুমার রাখেন। পাহাড়ী সান্যালের পরামর্শে ১৯৫১ সালের ছবি সহযাত্রী প্রথম যেখানে তিনি উত্তম কুমার নামটি ব্যবহার করেছিলেন। কুমারের প্রথম দিকের অনেক ছবিই ফ্লপ ছিল এবং তাকে ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল “ফ্লপ মাস্টার জেনারেল”।
১৯৫২ সালে, নির্মল দে পরিচালিত বাসু পরীবারে কুমারের একটি সহায়ক ভূমিকা ছিল, যেটি ছিল তার প্রথম ভূমিকা যা প্রশংসা লাভ করে। পরের বছর, তিনি একই স্টুডিও এবং পরিচালকের সাথে শেরে চুয়াত্তর চলচ্চিত্রে কাজ করেন, যেটি তার প্রথমবার সুচিত্রা সেনের সাথে জুটি বেঁধেছিল। তার প্রথম যুগান্তকারী ভূমিকা ছিল ১৯৫৪ সালে অগ্রদূতের চলচ্চিত্র অগ্নিপরীক্ষাতে।
উত্তম কুমার ১৯৬৬ সালে নায়ক ছবিতে প্রথমবার সত্যজিৎ-এর সাথে কাজ করেন। নায়ক-এ কুমারকে দেখার পর, অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং কাজ করতে চেয়েছিলেন এবং তার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন।
১৯৬৭ সালে, উত্তম কুমার রায়ের সাথে চিরিয়াখানায় কাজ করেন। ভারত সরকার যখন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করে, তখন উত্তম কুমার ছিলেন প্রথম অভিনেতা যিনি চিরিয়াখানা এবং অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৬৮ সালে ১৫তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন।
উত্তম কুমার প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সিনেমায় কাজ করেছেন, ১৯৪৮ সালে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দৃষ্টিদান থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা মোট ২০২টি, যার মধ্যে ১৫টি হিন্দি ছবিও আছে। তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলির মধ্যে অগ্নিপরীক্ষা, হারানো সুর, সপ্তপদী, ঝিন্দের বন্দী, জতুগৃহ, লাল পাথর, থানা থেকে আসছি, রাজদ্রোহী, নায়ক, এন্টনী ফিরিঙ্গি, চৌরঙ্গী, এখানে পিঞ্জর, স্ত্রী, অমানুষ, অগ্নীশ্বর, সন্ন্যাসী রাজা ইত্যাদি অন্যতম। উত্তম কুমার ভারতের প্রথম অভিনেতা যিনি ১৯৬৮ সালে জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পান। ১৯৬৭ সালের চলচ্চিত্র চিড়িয়াখানা ও এন্টনী ফিরিঙ্গির জন্য, তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচাইতে জনপ্রিয় ও সফল অভিনেতা হিসেবে ধরা হয়।
উত্তম কুমারের সাথে জুটি—
উত্তম-সুচিত্রা—
সুচিত্রা সেন উত্তম কুমার – এই জুটি বাংলা সিনেমার অমর জুটি নামে খ্যাত। তারা দুজন এক সাথে প্রায় ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং সবক’টি ছবি চুড়ান্ত সাফল্যলাভ করেছে। তাদের অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হল – হারানো সুর, অগ্নী পরীক্ষা, প্রিয় বান্ধবী, শাপমোচন, ইন্দ্রাণী, সপ্তপদী ইত্যাদি।
উত্তম-সুপ্রিয়া—
সোনার হরিণ থেকে তাদের জুটির জয়যাত্রা শুরু। এরপর তারা একে একে উত্তরায়ণ, কাল তুমি আলেয়া, সন্যাসী রাজা, বন পলাশীর পদাবলী, বাঘ বন্দীর খেলা ইত্যাদি জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেন।
উত্তম-সাবিত্রী—
শেষ দিকে উত্তম কুমারের সাথে সাবিত্রী চ্যাটার্জীর জুটি খুবই জনপ্রিয় হয়। তাদের করা উল্লেখ যোগ্য কিছু ছবি হল হাত বাড়ালেই বন্ধু, দুই ভাই, নিশি পদ্ম, মমের আলো ইত্যাদি। ধন্যি মেয়ে বা মৌচাকের মত কমেডি ছবিতে সাবিত্রীর সাথে জুটি বেঁধে উত্তম কুমারের হাসির অভিনয় আজও সকল দর্শকের মন জয় করে।
ব্যক্তিগত জীবন—
তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত গৌরী দেবীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। এবং গৌতম চট্টোপাধ্যায় নামে এক সন্তান ছিল। তবে গৌতম চট্টোপাধ্যায় পরবর্তীকালে ক্যান্সারে মারা যান। ১৯৬৩ সালে তিনি পরিবার ছেড়ে চলে যান এবং জীবনের শেষ ১৭ বছর তিনি অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর সাথেই ছিলেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে সুপ্রিয়া দেবীর গভীর সম্পর্কে ছিল। শোনা যায় তিনি সুপ্রিয়া দেবীকে বিয়েও করেছিলেন।
পুরস্কার এবং স্বীকৃতি—
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার—
১৯৬১: বাংলায় দ্বিতীয় সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য সার্টিফিকেট অফ মেরিট – সপ্তপদী (প্রযোজক হিসেবে)
১৯৬৩: বাংলায় সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – উত্তর ফাল্গুনী (প্রযোজক হিসেবে)
১৯৬৭: সেরা অভিনেতার জন্য জাতীয় পুরস্কার – অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, চিরিয়াখানা।
প্রয়াণ—-
বাংলা সিনেমার মহানায়ক উত্তম কুমার টলিউডকে কার্যত খ্যাতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই। অথচ মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই আচমকা কাউকে কিছু টের পেতে না দিয়েই খাতির মধ্য গগনে থাকতে থাকতেই প্রয়াত হন তিনি। সেই সময় ওগো বঁধু সুন্দরী সিনেমার শুটিং করছিলেন। শেষ দিনের শুটিং চলাকালীন হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। তারকার মতই নিঃশব্দে মৃত্যু হয়েছিল তার। ১৯৮০ সালের ২৪শে জুলাই, তারিখটা টলিউডের এর জন্য একটা কালো দিন। কারণ এই দিনেই প্রয়াত উত্তম কুমার। তার মৃত্যু বাংলা সিনেমা জগতে নেমে আসে এক গভীর শোকের ছায়া। তার অন্তিম যাত্রায় সারা কলকাতা রাজ পথে বেরিয়ে আসে। তার অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে কলকাতার বহু মানুষ শোক প্রকাশ করেন। বাংলা সিনেমা যতদিন থাকবে উত্তম কুমার মহানায়ক হয়েই রয়ে যাবেন সকল বাঙালীর মনে।
।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।