Categories
রিভিউ

আজ ২৮ জুলাই, ইতিহাসের আজকের এই দিনে যা ঘটেছিল।

আজ ২৮ জুলাই। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বছরের প্রতিটি দিনে ঘটেছে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আসুন আজকের দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় একনজরে দেখে নিই।  ইতিহাসের আজকের এই দিনে কী কী ঘটেছিল, কে কে জন্ম নিয়েছিলেন ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন——-

 

দিবস—–

 

(ক)  বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস

 

আজ যাদের জন্মদিন—-

২০০০ – ইরিনা তিথী, উদ্যোক্তা।

১৯০১ – বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতিবিদ কমরেড মণি সিং।

১৯০৪ – নোবেলজয়ী সোভিয়েত পদার্থবিদ পাভেল আ. চেরেনকভ।

১৯১২ -কমল দাশগুপ্ত, আধুনিক সহজ সরল মেলোডি প্রধান বাংলা গানের সেরা সুরকার।

১৯৩০ – ফিরোজা বেগম, বাঙালি নজরুলসঙ্গীত শিল্পী।

১৯৩৫ – অশোক শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, ভারতের প্রখ্যাত শিপ্প বিশেষজ্ঞ ও সাবেক রাজ্যসভা সদস্য।

১৯৩৮ – সুখেন দাস, ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের একজন বিখ্যাত অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র পরিচালক।

১৯৫৪ – হুগো চাভেজ, ভেনেজুয়েলার রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপতি।

১৯৫৬ – অশোক সেন, ভারতীয় বাঙালি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ।

১৯৮১ – মাইকেল ক্যারিক, ইংরেজ ফুটবলার।

১৯৮৭ – পেদ্রো রোদ্রিগেজ, স্পেনীয় ফুটবলার।

১৯৯৩ – হ্যারি কেন, ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক।

১৮০৪ – লুডউইগ ফয়েরবাক, জার্মানীর একজন বস্তুবাদী দার্শনিক।

১৮৭৪ – প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসক বিমলচন্দ্র ঘোষ।

১৬৩৫ – রবার্ট হুক, ইংরেজ চিকিৎসাবিদ ও রসায়নবিদ।

১১৬৫ -মহীউদ্দীন ইবনে আরাবী, একজন আরব সুফি সাধক লেখক ও দার্শনিক।

 

ইতিহাসের পাতায় আজকের দিনের ঘটনাবলী—-

১৯৭৪ – যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিঙ্নের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।

১৯৭৬ – চীনের টাংশানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে আট লাখ লোকের প্রাণহানি।

১৯৮৮ – চীনে টক্কর খেয়ে একশো জাহাজডুবি।

১৯১৩ – বঙ্গীয় কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠা।

১৯১৪ – অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু।

১৯৫০ – তাইওয়ানকে সাহায্য করার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান।

১৯৬৩ – জেনারেল আমিন আল হাফিজ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন।

১৯৬৭ -পূর্ব চীনের তাঙ্ক শান শহরে সাত দশমিক নয় মাত্রার ভয়াবহ ভুমিকম্প হয়েছিল।

১৮২১ – স্পেনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে পেরু স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

 

এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন যারা—-

২০০১ – আহমদ ছফা, বাংলাদেশী লেখক, কবি ও সমালোচক।

২০০৪ – ফ্রান্সিস ক্রিক, ইংরেজ পদার্থবিদ, আণবিক জীববিজ্ঞানী এবং স্নায়ুবিজ্ঞানী।

২০১০ – শ্যামল গুপ্ত, আধুনিক বাংলা রোমান্টিক গানের গীতিকার।

২০১৬ – মহাশ্বেতা দেবী, ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী।

২০১৭- ৯নং সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমদ।

১৯৩৪ – মারি ড্রেসলার, কানাডীয়-মার্কিন নির্বাক চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও কৌতুকাভিনেতা।

১৯৬৮ – অটো হান, জার্মান ভৌত রসায়নিবিদ।

১৯৭২ – চারু মজুমদার, বাঙালি মার্কসবাদী বিপ্লবী।

১৯৮০ – মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি।

১৯৯৭ – সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

১৭৫০ – জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ, জার্মান সুরকার।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
কবিতা

একা বেদনা নিয়ে এক : রাণু সরকার।

একা একা দুজন দু’টি পাড়ে ছিলো-
একদিন তারা গভীর প্রেমরসে আবদ্ধ হলো!
একের গায়ে এক লেগে যখন হয়েছিলো দুই-
দু’টি হৃদয় মিলেমিশে একদিন এলো মধুকাল!
ভালোই চলছিলো প্রমোদবিহার,
আহ্লাদে বাহ্যজ্ঞানহীন,
এ’টাই প্রকৃতির নিয়ম-
চিরন্তন সত্য!

মন্থর গতিতে একদিন ধেয়ে এলো ব্যাধি, ঘটলো একের অবসান,
একের পাস থেকে চলে গেলো এক
নিঃস্ব কাঙাল করে,
হারিয়ে গেলো ভালোবাসা,
পড়ে রইল এক, একা- বেদনা নিয়ে।

Share This
Categories
অনুগল্প প্রবন্ধ

আদি শঙ্করাচার্য সম্পর্কে কিছু কথা : রাণু সরকার।

যেকোনো ভ্রান্ত মতবাদকে তথা দোষযুক্ত মতবাদকে খণ্ডন করতে অদ্বৈতবাদ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আদি শঙ্করাচার্য হলেন সেই অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু তিনি যে শুধুমাত্র অদ্বৈতবাদী তেমনটাও না, বরং তিনি অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এবং দ্বৈতবাদের মিলন। ভারতে বৌদ্ধদর্শনের শূন্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় সনাতন সংস্কৃতি যখন লোপ পেতে থাকল, তখন তাঁর আবির্ভাবে এবং তাঁর কঠোর পরিশ্রমে পুনরায় দৃঢ়মূলে সনাতন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেল। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের বেদান্তের সর্বোচ্চ তত্ত্ব অদ্বৈতবাদ প্রচারের জন্য তিনি ভারতের সমস্ত সনাতনী সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে দশনামধারী দশটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে যথা : তীর্থ, আশ্রম, বন, অরণ্য, গিরি, পর্বত, সাগর, সরস্বতী, ভারতী এবং পুরীকে বাছাই করে তারপর ভারতের চারপ্রান্তে চারটি মঠ যথা : পূর্বে ওড়িশার পুরীতে গোবর্ধনমঠ, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকায় সারদামঠ, উত্তরে উত্তরখন্ডের বদ্রিকাশ্রমে জ্যোতির্মঠ এবং দক্ষিণে কর্ণাটকের শৃঙ্গেরীতে শৃঙ্গেরীমঠ স্থাপন করে উক্ত দশনামধারী সম্প্রদায়কে একত্রিত করে কার্যভার প্রদান করেন এবং উক্ত মঠে মহন্তরূপে চারজন শঙ্করাচার্যের পরম্পরা শুরু করেন। ভারতের ৪২ সাধকদের মধ্যে অন্যতম হলেন আদি শঙ্করাচার্য, তিনি জাগ্রত চৈতন্য। হিন্দু সম্প্রদায় এবং সনাতন ধর্ম অর্থাৎ আত্মধর্ম অর্থাৎ স্বধর্ম এখনও পর্যন্ত ভারতে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার নেপথ্যে আদি শঙ্করাচার্যের যে বহু অবদান আছে তা অনস্বীকার্য। অদ্বৈত উপলব্ধি সাধনার সর্বোচ্চ উপলব্ধি, কিন্তু তা উপলব্ধি করতে বহু প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে হয়, আদি শঙ্করাচার্যও তা অতিক্রম করেন। তাঁর শুদ্ধ ভক্তি ও সাধনা সমস্ত সনাতনীদের জন্য প্রবল উৎসাহ বহন করে। আদি শঙ্করাচার্য হলেন ব্রহ্মবিদ্বরিষ্ঠ, তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা (ভ্রম), জগত-ব্রহ্ম এক। তাঁর মতবাদ গুরুসহায়ে শুদ্ধচিত্তে মনন করলে ব্রহ্ম উপলব্ধির পথ অর্থাৎ পরম সত্য উপলব্ধির পথ অর্থাৎ জীবদ্দশায় জীবন্মুক্তির পথ সরল হয়।

Share This
Categories
গল্প

অভিমান : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

ব্যস্তভাবে চ্যানেল বদলাচ্ছিল সুব্রত। আজ আইপিএলের একটা ভালো ম্যাচ আছে। সুব্রত ক্রিকেটের অন্ধ ভক্ত। বলা যায় ক্রিকেট পাগল। আজ এমনিতে অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছিল তখনই টিভিটা খুলে বসে। কিন্তু অর্পিতা বাড়ি থাকলে সেটা সম্ভব নয়। অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে আগে ফ্রেশ হওয়া চাই। তারপর অন্য কাজ। আর তা করতে গিয়ে ইতিমধ্যে খেলা শুরু হয়ে গেছে।
চ্যানেল বদলাতে বদলাতে সহসা একটা খবরে থমকে যায় সুব্রত। ব্যাক করে আগের চ্যানেলটায় ফিরে আসে। সেখানে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেখাচ্ছে মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর খবর। খবরটা দেখে অর্পিতাকে হাঁক দেয় সুব্রত, ‘অর্পিতা একবার এঘরে এসো।’
রান্নাঘর থেকে অর্পিতা বলে, ‘আমার এখন অনেক কাজ। যাওয়া সম্ভব নয়। যা বলার ওখান থেকে বলো।’
‘আরে এস না।’
‘কেন?’
‘টিভিতে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে।’
কথাটা শেষ হয়েছে কী হয়নি, অর্পিতা ছুটে এ-ঘরে চলে আসে। শোফায় বসে চোখ রাখে খবরে। একই লেখা বার বার করে পর্দায় দেখাচ্ছিল। তবুও চোখ সরায় না অর্পিতা। একটু পরে বিজ্ঞাপন শুরু হতেই সুব্রত টিভিটা বন্ধ করে দেয়। খেলা দেখার আর তেমন আগ্রহ পায় না।
‘চারদিন পর মাধ্যমিকের রেজাল্ট। শুনেই তো আমার বুক কাঁপছে।’ উত্তেজনামাখা সুরে বলে অর্পিতা।
‘তোমার বুক কাঁপার কী হল! এত টেনশন করো না। দেখো, সায়ন ভালো রেজাল্টই করবে।’
‘সে আমি জানি। তবুও…।’
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুব্রত বলে, ‘টেনশন করো না। বরং এক কাজ করো। সায়নকে একবার ফোন করো। ও হয়তো খবরটা জানে না। ওকে বলো কাল বা পরশুর যেন মাসিবাড়ি থেকে ফিরে আসে।’
‘ঠিক বলেছ।’ অর্পিতা যাবে বলে সবে ঘুরেছে এমন সময় তার মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘মনে হয় সায়নের ফোন। ও বোধহয় খবরটা জেনে গেছে।’
কিন্তু মোবাইলটা হাতে নিয়ে অর্পিতা একটু হতাশ হয়। দেখে অজানা নম্বর। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে এক বয়স্কা মহিলার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘অপু বলছিস?’
চমকে ওঠে অর্পিতা। ‘অপু…! এ নামে তো…!’ ভাবনাগুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। কিছু জবাব দিতে পারে না। ওপাশ থেকে আবারও কাঁপা কাঁপা সুর ভেসে আসে, ‘অপু, আমি তোর মা বলছিরে।’
‘মা!’ আবারও একবার জোর চমক খায় অর্পিতা। মা তাকে ফোন করেছে, যেন বিশ্বাস হয় না। দীর্ঘ্য প্রায় কুড়ি বছর পর মা তাকে ফোন করেছে। ব্যাপারটা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করে। মনটা আবেগে ভেসে যেতে চায়। কিন্তু সেই আবেগে ভাগ বসায় পুঞ্জীভূত অভিমান। নিজেকে সামলে নেয় সে। একবার ভাবে কোনো কথা বলবে না। ফোনটা কেটে দেবে। পরমুহূর্তে ভাবে, মায়ের তো কোনো দোষ নেই। মা তো অসহায়। একজন মানুষের অন্ধ বিশ্বাস আর জেদের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে। তাই সিদ্ধান্ত বদলায়। তবে আবেগ দমন করে, সংযত গলায় বলে, ‘তুমি আমার নম্বর পেলে কী করে?’
‘সে কথা পরে বলব। তোকে একটা কথা বলব।’ বলেও কিন্তু সহসা কিছু বলতে পারেন না। আমতা আমতা করতে থাকেন। অর্পিতার কিছুটা হতভম্ভ অবস্থা। পাশাপাশি অদ্ভুত কিছু শব্দ তাকে কৌতূহলী করে তোলে। নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? তোমার আশেপাশে কীসব শব্দ শোনা যাচ্ছে! তুমি এখন কোথায়?’
‘নার্সিংহোমে।’
‘নার্সিংহোমে!’ চমকে ওঠে অর্পিতা। উদ্বেগমাখা সুরে বলে, ‘তুমি নার্সিংহোমে কেন? কী হয়েছে তোমার?’
ইতস্তত করে মহিলা জবাব দেন, ‘আমার কিছু হয়নি। তোর বাবা খুব অসুস্থ।’
কথাটা শুনে সহসা বুকে একটা ধাক্কা অনুভব করে অর্পিতা। কিন্তু পরমুহূর্তে সে গম্ভীর হয়ে যায়। কোনো জবাব দেয় না সে। এদিকে তাকে একবারে চুপ করে যেতে দেখে তার মা উদ্বেগ আর উত্তেজনামাখা সুরে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করতে থাকে। অর্পিতা গম্ভীর সুরে বলে, ‘শুনছি, বলো।’
‘শোন না, তোর বাবা খুব অসুস্থ।’
‘তা আমি কী করব?’
অর্পিতার কঠোর জবাবে তার মা একটু যেন হতচকিত হয়ে যান। একটু থেমে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে চলেন, ‘আজ বিকেলে তোর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পাড়ার কয়েকজন গাড়ি করে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়ে গেছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না। তোর দাদারা কেউ এখানে নেই। এদিকে ডাক্তার বলেছে ভালোই টাকা-পয়সা লাগবে। আমার কাছে বিশেষ কিছু নেই। আমি একা মেয়েমানুষ, কী করব ভেবে পাচ্ছি না। অপু, একটিবার আসবিরে মা?’
মায়ের কথার সহসা কোনো জবাব দিতে পারে না অর্পিতা। বাবার অসুস্থতা তার মনেক একটু নাড়িয়ে দেয় ঠিকই, তবে তা সাময়িক। মনকে শক্ত করে ফেলতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু মায়ের করুণ আর্তি আর কান্না তার বুকে আলোড়ন তোলে। পরমুহূর্তে তার অভিমানী মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে, সে কেন ওদের কথা ভাবতে যাবে! সে তো ওদের কেউ নয়! কিছুই জবাব দেয় না অর্পিতা। বৃদ্ধা বেশ কয়েকবার একই আর্জি জানানোর পর কোনো জবাব না পেয়ে হতাশায় ফোনটা কেটে দেন! শোফায় ধপাস করে বসে পড়ে অর্পিতা।
মোবাইলের কথোপকথন শুনে সুব্রত আন্দাজ করতে পেরেছিল খারাপ কিছু একটু ঘটেছে। অর্পিতা ফোনটা কাটতেই সুব্রত জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে? কে অসুস্থ?’
অর্পিতা সুব্রতকে বলে কী ঘটেছে। সব শুনে সুব্রত বলে, ‘তোমার এক্ষুনি নার্সিংহোমে যাওয়া উচিৎ।’
সুব্রতর দিকে অবাক চোখে তাকায় অর্পিতা। অবিশ্বাসমাখা সুরে বলে, ‘তুমি বলছ এ-কথা! আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। তোমার নিজের কথা কি তুমি ভুলে গেছ? রাস্তার কুকুরের চেয়েও তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল! মনে নেই?’
প্রসঙ্গটা গায়ে না মেখে সুব্রত বলে, ‘শোনো, একটা লোক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। এখন ওসব কথা ভাবতে আছে! হাজার হোক উনি তোমার বাবা।’
‘বাবা!’ সুব্রতর কথাটা শেষ হওয়ামাত্র ফুঁসে ওঠে অর্পিতা, ‘কে বাবা? উনি আমার বাবা নন। সেই সম্পর্ক উনি অনেক আগে মুছে দিয়েছেন।’
শান্ত সুরে সুব্রত বলে, ‘উনি যাই বলে থাকুন বা করে থাকুন, এটা তো অস্বীকার করতে পারো না যে উনি তোমার বাবা, তোমার জন্মদাতা?’
‘যে বাবার কাছে তার কন্যা মৃত, যে বাবা গত কুড়ি বছরে আমার সঙ্গে দেখা করা দূরে থাক, কথাও বলেনি, তাকে আমি কী করে বাবা বলে স্বীকার করে নেব!’
‘এসব তোমার রাগের কথা।’
‘না, রাগের কথা নয়। আমি যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করে কথাগুলো বলছি। আমি কিছু ভুলে যাইনি। কুড়িটা বছর ধরে আমি যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। অতীতটা আমি ভুলব কী করে!’
‘আমি সব জানি। কিন্তু মেয়ে হিসেবে তোমার ওনার পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
‘মেয়ে হলে নিশ্চয়ই পাশে দাঁড়াতাম। কিন্তু ওর কাছে আমি মৃত।’
‘শোনো…।’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আগের সুরেই অর্পিতা বলে চলে, ‘কোনো দোষ না করেও একটা লোকের মিথ্যা জাতপাতের অহংকার আর জেদের জন্য এত বছর আমি যন্ত্রণার জীবন কাটাচ্ছি। এতদিনে উনি তো আমাদের ওপর কোনো কর্তব্য করেননি। আজ তুমি আমাকে কর্তব্য পালন করতে বলছ?’
জেগে ওঠা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো লাভা উদগীরন করতে থাকে অর্পিতা। তাকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে সুব্রত বলে, ‘তোমার বাবার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের কথা ভাবো। উনি তো কোনো দোষ করেননি? অন্তত তোমার মায়ের কথাটা একটু গভীরভাবে ভাবো। কতটা অসহায় উনি। তোমার বিপর্যস্ত অবস্থায় অন্তত আমি তোমার পাশে ছিলাম। কিন্তু আজ তোমার মায়ের পাশে কেউ নেই। ভাবো, এই বৃদ্ধ বয়সে কতটা বিপর্যস্ত অবস্থা তার! এই সময় তুমি-আমি যদি ওর পাশে না দাঁড়াই তাহলে উনি আর কার কাছে যাবেন?’
মায়ের কথায় মনটা কিছুটা নরম হয় অর্পিতার। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে মায়ের অসহায় কান্না আর করুণ আর্তি। বুকের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয় তার। কর্তব্য সম্পাদন আর আত্মমর্যাদার দ্বন্দ্বে একটা টানাপোড়েন শুরু হয় অর্পিতার মধ্যে। সে ভেবে পায় না কী করবে।

২.
কলেজে পড়ার সময় থেকেই একে-অপরকে ভালোবাসত অর্পিতা আর সুব্রত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বাড়িতে তাদের সম্পর্কের কথা বলতে পারেনি অর্পিতা। এদিকে বাড়িতে তার বিয়ের আলোচনা চলতে থাকে। চাকুরির দোহাই দিয়ে সে আটকে রাখে। অর্পিতা অপেক্ষা করছিল তাদের দুজনের কেউ একজন চাকুরি পেলে সে বাড়িতে তাদের কথা জানাবে। তার রেজাল্ট ভালো কিন্তু কিছুতেই চাকুরি জুটছিল না। ফলে বিয়ের চাপ বাড়ছিল। অবস্থা যখন প্রায় হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সুব্রত একটা ভালো চাকুরি পেয়ে যায়। তখন অর্পিতা বাড়িতে জানায় তাদের সম্পর্কের কথা। কিন্তু বাড়িতে কেউ তাদের সম্পর্ক মেনে নেয় না। কারণটা তেমন কিছু না। অর্পিতারা ব্রাহ্মণ আর সুব্রত সিডিউল কাস্ট। অর্পিতার বাবা শিক্ষিত হলেও প্রাচীনপন্থী। তিনি কোনোমতেই এ-সম্পর্ক মেনে নেন না। অর্পিতা আশা করছিল তার দাদারা অন্তত ব্যাপারটা বুঝবে। কিন্তু সে অবাক হয়ে যায় দেখে যে, উচ্চ-শিক্ষায় শিক্ষিত দুই দাদাও বাবার সুরে সুর মেলায়। একমাত্র তার মা কিছুটা তার পক্ষে ছিল। কিন্তু বাবার প্রতাপের কাছে মা কোনোদিনই মুখ ফুটে নিজের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারেনি। বললেও বাবার না কে কখনও হ্যাঁ করতে পারেনি।
অর্পিতা বোঝায়, আজকালকার দিনে জাত-পাত নিয়ে ভাবনাটাই অবান্তর। সুব্রত সবদিক দিয়ে একজন আদর্শ পুরুষ। যেমন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তেমনি মানুষ হিসেবেও সে উন্নত মনের। তার থেকেও বড়ো কথা, তারা একে আপরকে ভালোবাসে। কিন্তু অনেক বুঝিয়েও সে বাবা-দাদাদের রাজি করাতে পারে না। বাবা সরাসরি বলে দেয়, ওই ছেলেকে বিয়ে করলে তিনি তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।
ছোটোবেলা থেকে বাবার কখনও অবাধ্য হয়নি অর্পিতা। কিন্তু সেদিন বাবার অন্যায় জেদকে মেনে নিতে পারেনি। সে শিক্ষিতা। নিজের জীবন নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তা আছে। সে যদি খারাপ কিছু করত, বাড়ির লোকেদের সম্মান হানিকর কিছু করত, তাহলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু মিথ্যা জাতপাতের অহংকারের আর অন্ধবিশ্বাসের কাছে নিজের ভালোবাসা আর আত্মমর্যাদাকে বলি দিতে চায়নি। বাধ্য হয়ে বাড়ির অমতে তারা রেজিস্ট্রি করে।
রেজিস্ট্রি করার পর বাড়িতে গিয়েছিল অর্পিতা। সুব্রতকে নিয়েই। কিন্তু বাবা তার মুখ দর্শন করেনি। পিছু ফিরে কঠোর কন্ঠে বলে দিয়েছিল, ‘আজ থেকে আর কোনোদিন এ-বাড়িতে পা রাখেব না তুমি। আমি তোমায় ত্যাজ্য করলাম। আজ থেকে মনে করব, আমার মেয়ে মরে গেছে।’
সেদিন অনেক কান্নাকাটি করেছিল অর্পিতা, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। কষ্ট, যন্ত্রণা আর একরাশ অপমান নিয়ে ফিরে এসেছিল সে। কিন্তু মন মানেনি। হাজার হোক তার বাবা। বার বার ফোন করলেও বাবা ফোন কেটে দিত। তবে একদিন কথা বলেছিল। কিন্তু তা সুখকর ছিল না। বাবা বলেছিল, ‘ঠিক আছে, আমি সব ভুলে যেতে পারি। তোমাকেও স্বীকার করতে পারি। তবে তোমাকে ওই ছেলেকে ছেড়ে ফিরে আসতে হবে।’
বাবার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিল অর্পিতা। মনের ঝড় সামলে অনেক কষ্টে বলেছিল, ‘সরি বাবা, তোমার শর্ত মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন তোমায় বিরক্ত করব না। তোমার মনে আমি মৃত হয়েই বেঁচে থাকব।’
সুব্রত বুঝত অর্পিতার যন্ত্রণার কথা। তাকে না জানিয়ে একিদন সে তার বাবার সঙ্গে দেখা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। চরম অপমান করে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল অর্পিতার বাবা।
তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। অনেক কিছু ঘটে গেছে এই কয়েক বছরে। অর্পিতা এসএসসি দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে। একসময় সংসারে আসে সায়ন। দেখতে দেখতে সে এবার মাধ্যমিক দিয়ে দিয়েছে। সামনে তার রেজাল্ট। এখন তাদের যতকিছু স্বপ্ন ছেলেকে ঘিরে।
যোগাযোগ না থাকলেও বাবারবাড়ির বেশ কিছু খবর তার কানে আসে। অর্পিতার বড়দা বিদেশে পাকাপাকি আস্তানা গেড়েছে। ছোড়দা মুম্বইতে। প্রথম প্রথম তারা বাড়ি আসত। এখন আর আসে না। বাবা-মায়ের তেমন করে খোঁজখবরও নেয় না। সবথেকে আশ্চর্যের অর্পিতার সঙ্গেও তারা একবারও যোগাযোগ করেনি। অর্পিতার বাবা বেশ কয়েক বছর আগে রিটায়ার্ড করেছেন। প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। যা উপার্জন করেছেন সংসার চালাতে আর ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে খরচ করেছেন। সঞ্চয় দূরে থাক, উল্টে ধারও করতে হয়েছে তাকে। এখন সেই ছেলেরাই পর হয়ে গেছে। নিজের সামান্য পেনশনই ভরসা। বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রী এটা-ওটা অসুস্থতা নিত্যসঙ্গী। কোনোরকমে জীবন কাটছিল তাদের। কিন্তু এতসবের মাঝেও নিজের জেদ আর মিথ্যা জাতপাতের দম্ভ থেকে একচুলও নড়েননি অর্পিতার বাবা।

৩.
তিনদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর জ্ঞান ফেরে অর্পিতার বাবার। তবে ডান হাত প্যারালাইজড হয়ে গেছে, সঙ্গে মুখের ডানদিকটাও বেঁকে গেছে। দিন সাতেক নার্সিংহোমে কাটানোর পর তিনি বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে শরীর খুব দুর্বল। নিজে থেকে চলাফেরার ক্ষমতা নেই। নিয়মিত ঔষধ ছাড়া ফিজিওথেরাপি চলছে। ডাক্তার বলেছে প্যারালাইজড অংশের কিছুটা উন্নতি হলেও হতে পারে। মায়ের বয়স হয়েছে। বাড়িতে বাবার দেখাশোনো করার জন্য একজন নার্স ঠিক করে দিয়েছে অর্পিতা।
এই কদিনে বিস্তর টাকা খরচ হয়েছে এবং সেটা করেছে অর্পিতা আর সুব্রত। সুব্রতর বোঝানোয় অর্পিতা শেষমেষ বোঝে, নার্সিংহোমে আসে। অর্থের কথা ভাবেনি। বাবাকে সারানোর জন্য যা যা করা দরকার বাকি রাখেনি। তার গুণী দাদারা কেউ আসেনি। না, অর্পিতা তাদের ফোন করেনি। মা যোগাযোগ করেছিল। বড়ছেলে জানিয়ে দিয়েছে তার পক্ষে বিদেশ থেকে আসা এখনই সম্ভব নয়। ছোটছেলে বাবার অ্যাকাউন্টে হাজার পঁচিশ টাকা পাঠিয়ে দায় সেরেছে। তারও নাকি আসার সময় নেই। ছোড়দার টাকা অবশ্য তোলেনি অর্পিতা। যা খরচ হয়েছে সে আর সুব্রত মিলে করেছে। তবে এতকিছু করলেও মন থেকে ক্ষতের চিহ্নটা মুছে ফেলতে পারেনি।
হাসপাতালে পৌঁছে মাকে দিয়ে সে একটা শর্ত করিয়ে নিয়েছিল, তারা যে বাবাকে সারিয়ে তোলার জন্য এই খরচাপত্র করেছে তা যেন বাবাকে কোনোদিন না বলে। এমনকি তারা যে হাসপাতালে এসেছিল এই ব্যাপারটাও বাবার কাছে গোপন রাখতে বলে। তা না করলে সে আসবে না বলে জানায়। মন না চাইলেও অর্পিতার মা সে শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়।

৪.
কীভাবে অনুষ্ঠানটা করবে তা নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারছিল না সুব্রত আর অর্পিতা। সুব্রত চায় বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে। ওদিকে অর্পিতার একদমই ইচ্ছা নয় বাড়িতে ঝামেলা বাড়াতে। আর সেটা নিয়েই দুজনের মধ্যে মতিবিরোধ হচ্ছিল।
পার্টিটা সায়নের রেজাল্ট উপলক্ষ্যে। মাধ্যমিকে অসাধারণ রেজাল্ট করেছে সে। জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। বাবার অসুস্থতার সময়েই রেজাল্ট বেরিয়েছিল। বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ছেলের রেজাল্টের আনন্দটা উপভোগ করার সুযোগ ছিল না। এদিকে সুব্রতর অফিসের কলিগ, অর্পিতার স্কুলের কলিগরা ধরেছিল ছেলের এতো ভালো রেজাল্টের পর একটা পার্টি দিতে। ব্যাপারটা তাদেরও মাথায় ছিল। ছেলের রেজাল্ট সেলিব্রেট করার ইচ্ছে ছিল তাদের। কিন্তু সেসব নিয়ে তখন ভাবার সময় পায়নি। আজ রবিবার। দুজনের ছুটি। সায়নও পড়তে গেছে। ওদিকে বাবার অসুস্থতার ঝামেলাটাও কমেছে। তাই দুজনে বসেছে পার্টিটা কীভাবে করা যায় সেই আলোচনায়।
অর্পিতার বাবার আসুস্থতার পর প্রায় দিন কুড়ি কেটে গেছে। তার বাবা এখন আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ। একটু-আধটু চলাফেরাও করতে পারে। তবে ডান হাত আর মুখের ব্যাপারটার কোনো উন্নতি হয়নি প্রায়। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চলছে। এসব খবর তার মা ফোন করে জানিয়েছে। তবে বাবার ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামায়নি অর্পিতা। সে নিয়ে মাথাব্যাথাও আর নেই। কেবলমাত্র মায়ের কথা ভেবে সে এতকিছু করেছে। এ নিয়ে আর বেশি ভাবতেও চায় না।
সহসা তাদের কথাবার্তার মাঝে অর্পিতার মোবাইল বেজে ওঠে। এসময় ফোন আসায় একটু বিরক্ত হয় অর্পিতা। তবুও কলটা ধরতে হয়। সবুজ বাটন টিপে ‘হ্যালো’ বলে ফোনটা কানে চেপে ধরে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব নেই। আরও দুবার ‘হ্যালো’ বলার পরও যখন ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না তখন অর্পিতা বেশ বিরক্তির সুরে বলে, ‘কে বলছেন? কথা বলছেন না কেন? কিছু বলার থাকলে বলুন না হলে ফোনটা কেটে দিন।’
তবুও কোনো জবাব আসে না। মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে অর্পিতা প্রায় লাইনটা কেটে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় ওপাশ থেকে একটা ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘অপু…!’
একটু চমকে ওঠে অর্পিতা। তার সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। কন্ঠস্বর মহিলার নয়। তাহলে…! কিন্তু আবেগ সংযত করতে বেশি সময় লাগে না তার। তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে সে।
ওপাশ থেকে ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসে। ‘অপু, আমি বাবা বলছি।’
অর্পিতা কোনো জবাব দেয় না। তার চোখ-মুখ আরও দৃঢ় হয়। অর্পিতার বাবা ক্ষীণ কন্ঠে বলে চলেন, ‘অপু, আমি সব জেনে গেছি। তোর মা তোকে কথা দিয়েছিল। কিন্তু ওর কোনো দোষ নেই। আমার জেদে বাধ্য হয়েছে সত্যিটা বলতে।’
অর্পিতা কঠিন সুরে বলে, ‘এসব কথা ছেড়ে কীজন্য ফোন করেছ সেটা তাড়াতাড়ি বলো। আমার অনেক কাজ আছে।’
‘জানি, তুই আমার ওপর রেগে আছিস। সেটা স্বাভাবিকও। তবুও না ফোন করে পারলাম না।’
‘না করলেই পারতে। তাহলে আমি বেশি খুশি হতাম। তুমি যদি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাও, তাহলে ভুল করছ। ওসব কথা আমি শুনতে চাই না।’
‘না না, সেজন্য ফোন করিনি।’
‘তাহলে…!’
‘একটা অনুরোধ ছিল। রাখবি?’
‘অনুরোধ! কী অনুরোধ?’
‘একবার তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।’
‘আমাকে দেখতে চাও!’ অর্পিতার গলায় কিছুটা ব্যঙ্গের সুর! ‘তুমি কী করে ভাবলে তুমি ডাকলেই আমি চলে যাবো’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘না না, তোকে আসতে বলছি না। আমি একবার তোর বাড়ি যেতে চাই।’
‘অসম্ভব।’ প্রতিবাদের সুরে বলে ওঠে অর্পিতা। ‘সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার বাড়িতে তুমি আসতে চাইছো কেন? কী দরকার তোমার আমার কাছে?’
‘তোদের প্রতি অনেক অন্যায় করেছি, অবিচার করেছি। একবার তোর মুখোমুখি হয়ে মাফ চাইতে চাই।’
‘আজ এত বছর পর তোমার মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর আন্যায় করেছ, অবিচার করেছ! হঠাৎ তোমার এমন মনে হল কেন? মনে রেখ তোমার চোখে আমি মৃত। আর যে কারণে আজ বেঁচে থেকেও আমি তোমার চোখে মৃত, সেই অবস্থার কোনো হেরফের ঘটনি। তাহলে তোমার এমন মনে হওয়ার তো কারণ নেই।’
অর্পিতার বাবা কোনো জবাব দিতে পারেন না। অর্পিতা কঠিন সুরে বলে চলে, ‘এই দীর্ঘ্য কুড়ি বছরে কিন্তু তোমার মনে হয়নি তুমি অন্যায় করেছ। আমিও বলছি না তুমি অন্যায় করেছো। তোমার দৃষ্টিভঙ্গীতে তুমি ঠিক। আমার ভাবনায় আমি। আর আমাদের মতবিরোধের কারণের কোনো পরিবর্তন যখন ঘটেনি তখন আর ভুল বোঝাবুঝির প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?’
একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যায় অর্পিতা। বৃদ্ধ ক্ষীণ সুরে আমতা আমতা করে বলেন, ‘তোর কথার কোনো জবাব নেই আমার কাছে। আমি যে ব্যবহার করেছি তাতে এসব কথা বলা তোর ন্যায়সঙ্গত। তোর রাগ করাটা স্বাভাবিক।’
‘রাগ!’ ফুঁসে ওঠে অর্পিতা, ‘আমি রাগের কথা বলছি না। রাগ-আবেগ সরিয়ে আমি যুক্তিপূর্ণভাবে কথা বলছি। বলতে পারো কোন যুক্তিতে একটা মরা মানুষ তোমার সামনে জীবন্ত হয়ে ফিরে আসবে!’
বৃদ্ধ কোনো জবাব দেয় না। অর্পিতা বলে চলে, ‘এতিদন তোমার মনে হয়নি তুমি ভুল করেছ। এতদিনে তুমি আমাদের কোনো খোঁজখবর নাওনি। আজ আমার জন্য হঠাৎ আবেগে তোমার প্রাণ কেঁদে উঠছে কেন? আমি টাকা খরচ করে তোমাকে সারিয়ে তুলেছি বলে? তুমি কি ভাবো আমি অর্থ দিয়ে সম্পর্ক কিনতে গিয়েছিলাম?’
এত কঠিন কথা অর্পিতা বলবে বৃদ্ধ ভাবতে পারেননি। কিছু বলতে পারেন না তিনি। অর্পিতা বলে চলে, ‘তুমি যদি তাই ভাবো, তাহলে ভুল করছ। আমি অর্থের বিনিময়ে সম্পর্ক গড়তে যাইনি। অর্থের দম্ভও দেখাতে চাইনি, তোমার ওপর করুণা দেখানোরও কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আরও স্পষ্ট করে বলি তোমার প্রতি কর্তব্যবোধেও আমি এসব করিনি।’
একটু থামে অর্পিতা। নিজের মধ্যেকার যন্ত্রণার ঝঞ্ঝাটাকে একটু সামলে নিয়ে বলে, ‘সত্যি বলতে কী কর্তব্যবোধের প্রশ্নই আসে না। যে মরে গেছে সে কী করে কর্তব্য করবে? আমি তা করতেও চাইনি। আমি যা করেছি তা শুধু একটা অসহায় নারীর কথা ভেবে। মায়ের চোখের জল, মাথার সিঁদূর আর ভালোবাসার কাছে নিজেকে পাষাণ রাখতে পারিনি।’
একটু থামে অর্পিতা। ফোনের ওপাশে কোনো কথা নেই। তবে নীরব অশ্রুপাতের শব্দ শুনেত পায় অর্পিতা। তাতে তার মন গলে না। আগের মেজাজে বলে চলে, ‘একটা কথা ভেবে দেখো, জীবনের প্রায় সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া এক মহিলা সিথির সিঁদূর আর ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে সেদিন পাগলের মতো কান্নাকাটি করেছিল। আর সদ্য বিয়ে করা আমাকে তুমি বলেছিলে সেই সিঁদূর আর ভালোবাসাকে বলি দিতে। ভালোবাসা কী তা তুমি কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করো না, আজও বোঝো না।’
আর বৃদ্ধ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কান্নাভেজা সুরে বলেন, ‘আমি বিরাট ভুল করেছি মা। আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি অনুতপ্ত। আমাকে একটিবার তোর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দে।’
‘না, আমি তা মোটেও চাই না। ভুল যদি তুমি সত্যি বুঝতে পারতে সেটা তোমার অনেক আগে বোঝা উচিত ছিল। তা তুমি পারোনি। এখন যেটাকে তুমি ভুল বুঝতে পারা বলছে, সেটা আসলে তোমার অসহায়ত্ব, একাকীত্ব আর দুর্বলতা। তোমার ছেলেরা এখন যদি তোমার পাশে থাকত তাহলে হয়ত এই ভুল বোঝার উপলব্ধি তোমার মধ্যে আসত না। আমার কথা খারাপ লাগতে পারে, তবে এটাই সত্যি।’
অর্পিতা চুপ করে। বৃদ্ধ ক্ষীণ সুরে বলেন, ‘একটিবার কি মুখোমুখি হতে পারি না?’
‘না। যেমন আছি সেটাই ভালো। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে শিখে গেছি। আর, এতিদন তোমার চোখে মৃত হয়ে যখন বেঁচে থাকতে পেরেছি, ভবিষ্যতেও তা পারব। তাই বলছি, মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা মন থেকে সরিয়ে দাও। তাতে তোমারও জেদ বজায় থাকবে। আমাকেও হেরে যেতে হবে না।’
ওপাশের কন্ঠস্বর চূপ। শুধু নীরব কান্নার সুর ভেসে আসে। অর্পিতা নিজেকে সংযত করে শান্ত কন্ঠে বলে, ‘নিজের শরীরের খেয়াল রেখো। আর কোনোদিন আমাকে ফোন করো না। তাহলে আমিও ভালো থাকব।’
লাইনটা কেটে দেয় অর্পিতা। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার দুচোখ দিয়ে বন্যার স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়ে। হতবাক সুব্রত কী বলবে ভেবে পায় না।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

ভারতের মিসাইল ম্যান, এপিজে আবদুল কালাম : প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

আব্দুল কালাম ছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি একজন বিজ্ঞানীও ছিলেন। তিনি স্বাধীন ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি যিনি ধর্মনিপেক্ষভাবে নির্বাচিত হন। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরমে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ভারতীয় বিজ্ঞান সংস্থা ইসরো তে তিনি একজন বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করেন। মহাকাশযানবাহী রকেট এবং বালিস্টিক মিসাইলের উপর অবদানের জন্য তাঁকে ভারতের Missile Man বলা হয়।

 

আব্দুল পাকির জয়নুলাবদিন আব্দুল কালাম ছিলেন একজন ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রনায়ক যিনি ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ১১ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের সাধারণ এক পরিবারে ১৯৩১ সালের ১৫ই অক্টোবর  জন্ম হয় এপিজে আব্দুল কালামের। তখন রামেশ্বরম বৃটিশ ভারতের  মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ছিল। তাঁর বাবার নাম জয়নুল আবেদীন এবং মায়ের নাম আশিয়াম্মা। তাঁর জীবনে তাঁর বড় বোন জোহরা এবং ভগ্নিপতি আহামাদ জালালুদ্দীনেরও অনেক প্রভাব ছিল। রামেশ্বরম এবং তাম্রেশ্বরম এবং রমেশ্বরম এবং স্টান্ট ইঞ্জিনে জন্ম ও বেড়ে ওঠেন।

 

তিনি পরবর্তী চার দশক একজন বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে কাটিয়েছেন, প্রধানত ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (DRDO) এবং ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO) এ এবং ভারতের বেসামরিক মহাকাশ কর্মসূচি এবং সামরিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন প্রচেষ্টার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।  এইভাবে তিনি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং উৎক্ষেপণ যান প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করার জন্য ভারতের মিসাইল ম্যান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।  এছাড়াও তিনি ১৯৯৮ সালে ভারতের পোখরান-II পারমাণবিক পরীক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা ১৯৭৪ সালে ভারতের মূল পারমাণবিক পরীক্ষার পর প্রথম।

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তৎকালীন বিরোধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উভয়ের সমর্থনে কালাম ২০০২ সালে ভারতের ১১ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।  ব্যাপকভাবে “জনগণের রাষ্ট্রপতি” হিসাবে উল্লেখ করা হয়, তিনি একটি একক মেয়াদের পরে তার শিক্ষা, লেখালেখি এবং জনসেবার নাগরিক জীবনে ফিরে আসেন।  তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান, ভারতরত্ন সহ বেশ কয়েকটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের প্রাপক ছিলেন।

 

তিনি মানুষের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করতেন। ভালবাসতেন নিজের জীবনের শিক্ষা তরুণ পজন্মের মাঝে পৌঁছে দিতে । তেমনই  ২০১৫ সালে ২৭শে জুলাই মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানে বসবাসযোগ্য পৃথিবী বিষয়ে বক্তব্য রাখছিলেন । ভারতীয় সময় ৬টা ৩০ মিনিটে বক্তব্য রাখা অবস্থায় তাঁর হার্ট এ্যটাক হয় এবং তাকে বেথানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ৭টা ৪৫ মিনিট নাগাদ তাঁর মৃত্যু ঘটে ।

৮৪ বছর বয়সে দেশের জন্য নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে যাওয়া এ মহাপুরুষ পরলোক গমন করেন। ২৯শে জুলাই তাঁর জন্মস্থান রামেশ্বরমেই তাকে দাফন করা হয়।

 

কালামের লেখা—

 

এ পি জে আব্দুল কালাম এবং রোদ্দাম নরসিমহা দ্বারা তরল মেকানিক্স এবং স্পেস টেকনোলজির উন্নয়ন;  ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেস, ১৯৮৮।

ভারত ২০২০: এ পি জে আবদুল কালাম, ওয়াই এস রাজন-এর নতুন সহস্রাব্দের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি;  নিউ ইয়র্ক, ১৯৯৮।

উইংস অফ ফায়ার: এ পি জে আবদুল কালাম, অরুণ তিওয়ারির একটি আত্মজীবনী;  বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৯৯।

ইগনিটেড মাইন্ডস: এ পি জে আবদুল কালামের দ্বারা ভারতের মধ্যে শক্তি উন্মোচন করা;  ভাইকিং, ২০০২।

দ্য লাউমিনাস স্পার্কস এ পি জে আবদুল কালাম, দ্বারা;  পুণ্য পাবলিশিং প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৪।

এ পি জে আবদুল কালামের মিশন ইন্ডিয়া, মানব গুপ্তের আঁকা ছবি;  পেঙ্গুইন বই, ২০০৫।

এ পি জে আবদুল কালামের অনুপ্রেরণামূলক চিন্তা;  রাজপাল অ্যান্ড সন্স, ২০০৭।

এ পি জে আবদুল কালামের অদম্য আত্মা;  রাজপাল অ্যান্ড সন্স প্রকাশনা

শিবথানু পিল্লাইয়ের সাথে এ পি জে আব্দুল কালামের দ্বারা একটি ক্ষমতাপ্রাপ্ত জাতির কল্পনা করা;  টাটা ম্যাকগ্রা-হিল, নয়াদিল্লি

ইউ আর বর্ন টু ব্লসম: টেক মাই জার্নি বিয়ন্ড এ পি জে আবদুল কালাম এবং অরুণ তিওয়ারি;  ওশান বুকস, ২০১১।

টার্নিং পয়েন্টস: এ পি জে আব্দুল কালামের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে একটি যাত্রা;  হার্পারকলিন্স ইন্ডিয়া, ২০১২।

এ পি জে আবদুল কালাম এবং সৃজন পাল সিং-এর লক্ষ্য ৩ বিলিয়ন;  ডিসেম্বর ২০১১ (প্রকাশক: পেঙ্গুইন বই)।

মাই জার্নি: এ পি জে আবদুল কালাম দ্বারা স্বপ্নকে কর্মে রূপান্তর করা;  রূপা পাবলিকেশন দ্বারা ২০১৪।

পরিবর্তনের জন্য একটি ইশতেহার: এ পি জে আব্দুল কালাম এবং ভি পোনরাজের ভারত ২০২০ এর সিক্যুয়েল;  হার্পারকলিন্স দ্বারা জুলাই ২০১৪।

আপনার ভবিষ্যত তৈরি করুন: এ পি জে আবদুল কালামের দ্বারা স্পষ্ট, স্পষ্ট, অনুপ্রেরণামূলক;  রাজপাল অ্যান্ড সন্স দ্বারা, ২৯ অক্টোবর ২০১৪।

পুনরুজ্জীবিত: এ পি জে আব্দুল কালাম এবং সৃজন পাল সিং দ্বারা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক পথ;  পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া দ্বারা, ১৪ মে ২০১৫।

অরুণ তিওয়ারির সঙ্গে এ পি জে আবদুল কালামের প্রমুখ স্বামীজির সঙ্গে আমার আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা;  হার্পারকলিন্স পাবলিশার্স, জুন ২০১৫।

অ্যাডভান্টেজ ইন্ডিয়া: ফ্রম চ্যালেঞ্জ টু অপারচুনিটি এ পি জে আবদুল কালাম এবং সৃজন পাল সিং দ্বারা;  হার্পারকলিন্স পাবলিশার্স, ১৫ অক্টোবর ২০১৫।

 

তার জীবদ্দশায় ৮৪ বছরের দীর্ঘ ও সফল কর্মজীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও দর্শন থেকে আমাদের জন্য রেখে গেছেন অসংখ্য মহামূল্যবান বাণী। তার মধ্যে কিছু সংকলন করা হলো-

 

(ক) স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যাও। স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন হলো সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না।

(খ) মানুষ তার ভবিষ্যত পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে। অভ্যাসই মানুষের ভবিষ্যত পরিবর্তন করে দেয়।

(গ) তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো।

(ঘ) একটি ভালো বই একশ ভালো বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভালো বন্ধু একটি লাইব্রেরির সমান।

(ঙ) সফলতার গল্প পড়ো না, কারণ তা থেকে তুমি শুধু গল্পটাই পাবে। ব্যর্থতার গল্প পড়ো, তাহলে সফল হওয়ার কিছু উপায় পাবে।

(চ) উদার ব্যক্তিরা ধর্মকে ব্যবহার করে বন্ধুত্বের হাত বাড়ান। কিন্তু সংকীর্ণমনস্করা ধর্মকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

(ছ) ছাত্রজীবনে আমি বিমানের পাইলট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েছি, হয়ে গেছি রকেট বিজ্ঞানী।

(জ) জীবন ও সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবন শেখায় সময়কে ভালোভাবে ব্যবহার করতে আর সময় শেখায় জীবনের মূল্য দিতে।

(ঝ) যারা মন থেকে কাজ করে না, তারা আসলে কিছুই পায় না। আর পেলেও সেটা হয় অর্ধেক হৃদয়ের সফলতা। তাতে সব সময়ই একরকম তিক্ততা থেকে যায়।

(ঞ) কঠিন কাজে আনন্দ বেশি পাওয়া যায়। তাই সফলতার আনন্দ পাওয়ার জন্য মানুষের কাজ কঠিন হওয়া উচিত।

(ট) প্রথম সাফল্যের পর বসে থেকো না। কারণ দ্বিতীয়বার যখন তুমি ব্যর্থ হবে তখন অনেকেই বলবে প্রথমটিতে শুধু ভাগ্যের জোরে সফল হয়েছিলে।

(ঠ) বৃষ্টি শুরু হলে সব পাখিই কোথাও না কোথাও আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু ঈগল মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে বৃষ্টিকে এড়িয়ে যায়।

(ড) নেতা সমস্যায় ভয় পান না। বরং সমস্যার মোকাবিলা করতে জানবেন। তাকে কাজ করতে হবে সততার সঙ্গে।

(ঢ) জাতির সবচেয়ে ভালো মেধা ক্লাসরুমের শেষ বেঞ্চ থেকে পাওয়া যেতে পারে।(ণ) আমি সুপুরুষ নই। কিন্তু যখন কেউ বিপদে পড়েন আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। সৌন্দর্য থাকে মানুষের মনে, চেহারায় নয়।

(ত) তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার বার্তা হলো- তাদের ভিন্নভাবে চিন্তা করবার সাহস থাকতে হবে। মনের ভেতর আবিষ্কারের তাড়না থাকতে হবে। নিজের সমস্যা নিজে মেটাবার মানসিকতা থাকতে হবে।

(থ) কাউকে হারিয়ে দেয়াটা খুব সহজ, কিন্তু কঠিন হলো কারো মন জয় করা।

(দ) জীবনে সমস্যার প্রয়োজন আছে। সমস্যা আছে বলেই সাফল্যে এতো আনন্দ।

(ধ) যে হৃদয় দিয়ে কাজ করে না, শূন্যতা ছাড়া সে কিছুই অর্জন করতে পারে না।

(ন) সেই ভালো শিক্ষার্থী যে প্রশ্ন করে। প্রশ্ন না করলে কেউ শিখতে পারে না। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে।

(প) সমাপ্তি মানেই শেষ নয়। ‘END’ শব্দটির মানে হচ্ছে ‘Effort Never Dies’ অর্থাৎ ‘প্রচেষ্টার মৃত্যু নেই’।

(ফ) উপরে তাকিয়ে আকাশটাকে দেখো। তুমি একা নও, এই মহাবিশ্ব তোমার বন্ধুর মতোই।

(ব) স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখে যেতে হবে। স্বপ্ন না দেখলে কাজ করা যায় না।

(ভ) ফেল করে হতাশ হয়ো না। ইংরেজি শব্দ ফেল ‘Fail’ মানে ‘First Attempt in Learning’ অর্থাৎ ‘শেখার প্রথম ধাপ’। বিফলতাই তোমাকে সফল হবার রাস্তা দেখিয়ে দেবে।

(ম) কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছো না! চিন্তিত করো না- ‘NO’ শব্দের মানে হচ্ছে ‘Next Opportunity’ অর্থাৎ ‘পরবর্তী সুযোগ’।

(য) আমরা শুধু সাফল্যের উপরেই গড়ি না, ব্যর্থতার উপরেও গড়ি।

(র) একজন খারাপ ছাত্র একজন দক্ষ শিক্ষকের কাছ থেকে যা শিখতে পারে তার চেয়ে একজন ভালো ছাত্র একজন খারাপ শিক্ষকের কাছ থেকে অনেক বেশি শিখতে পারে।

(ল) তুমি যদি তোমার কাজকে স্যালুট করো, দেখো তোমাকে আর কাউকে স্যালুট করতে হবে না। কিন্তু তুমি যদি তোমার কাজকে অসম্মান করো, অমর্যাদা কর, ফাঁকি দাও, তাহলে তোমার সবাইকে স্যালুট করতে হবে।

(ব)  প্রতিদিন সকালে এই পাঁচটা লাইন বলো:

১) আমি সেরা

২) আমি করতে পারি

৩) সৃষ্টিকর্তা সব সময় আমার সঙ্গে আছে

৪) আমি জয়ী

৫) আজ দিনটা আমার

(শ)  তিনজনই পারেন একটি দেশ বা জাতিকে বদলাতে। তাঁরা হলেন, বাবা, মা ও শিক্ষক।

Share This
Categories
রিভিউ

আজ ২৭ জুলাই, ইতিহাসের আজকের এই দিনে যা ঘটেছিল।

আজ ২৭ জুলাই। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বছরের প্রতিটি দিনে ঘটেছে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আসুন আজকের দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় একনজরে দেখে নিই।  ইতিহাসের আজকের এই দিনে কী কী ঘটেছিল, কে কে জন্ম নিয়েছিলেন ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন——-

 

আজ যাদের জন্মদিন—-

১৯০৯ – মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম, (বিশ্ববিখ্যাত অনুজীব বিজ্ঞানী ও গবেষক)।

১৯০৯ – কানাইলাল ভট্টাচার্য (ভারতের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী)।

১৯১৩ – কল্পনা দত্ত, (ভারতীয় বিপ্লবী এবং রাজনীতিবিদ)।

১৯২২ – নির্মলেন্দু চৌধুরী, (ভারতের বাঙালি লোকসঙ্গীত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার – বাংলার লোকসঙ্গীতের প্রসারে ও প্রচারে যাঁর অবদান অসীম)।

১৯৩১ – আব্দুল আলীম, (বাংলা লোক সঙ্গীতের কণ্ঠশিল্পী)।

১৯৫৫ – অ্যালান বর্ডার, (সাবেক অস্ট্রেলিয়ার প্রথিতযশা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার)।

১৯৬০ – এমিলি থর্নবেরি, (ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ)।

১৯৬৩ – কে. এস. চিত্রা, (ভারতীয় নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী এবং কর্ণাটকী সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ)।

১৯৬৩ – ডনি ইয়েন, (হংকং অভিনেতা, মার্শাল আর্টিস্ট, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক)।

১৯৬৭ – রাহুল বসু, (খ্যাতনাম ভারতীয় অভিনেতা, চিত্রনাট্যলেখক, পরিচালক এবং সমাজকর্মী)।

১৯৬৭ – নীল স্মিথ, (সাবেক ইংরেজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন)।

১৯৭১ – সজীব ওয়াজেদ, (বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র)।

১৯৮১ – কলিন্স ওবুয়া, (কেনীয় ক্রিকেটার)।

১৯৮৯ – মায়া আলী, (পাকিস্তানি অভিনেত্রী)।

১৯৯০ – কৃতি স্যানন, (ভারতীয় অভিনেত্রী)।

১৯৯৩ – জর্ডান স্পাইয়েথ, (আমেরিকান গলফার)।

১৮৩৫ – জোযুয়ে কার্দুচ্চি, (নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইতালীয় কবি এবং শিক্ষক)।

১৮৫৭ – আর্নেস্ট টমসন ওয়ালিস, (প্রাচ্যবিদ ও জাদুঘর বিশেষজ্ঞ)।

১৮৮১ – হান্স ফিশার (নোবেলবিজয়ী জার্মান জৈবরসায়ন বিজ্ঞানী)।

১৮৯৯ – পার্সি হর্নিব্রুক, (অস্ট্রেলীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন)।

১৬১২ – চতুর্থ মুরাদ, (উসমানীয় সুলতান)।

১৬৬৭ – ইয়োহান বার্নুয়ি, (সুইস গণিতবিদ)।

 

ইতিহাসের পাতায় আজকের দিনের ঘটনাবলী—-

২০০৫ – আরব সাগরে ভারতের একটি তেল ও গ্যাস উত্তোলন মঞ্চ অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়ে।

২০০৭ – ঢাকা-মিয়ানমার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চুক্তি স্বাক্ষর।

১৯০৮ – লন্ডনে চতুর্থ অলিম্পিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

১৯২০ – বিমান চালনার জন্য প্রথম রেডিও কম্পাস ব্যবহার শুরু।

১৯২১ – টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলের প্রধান বায়োকেমিস্ট ফ্রেডরিখ বেন্টিং হরমোন ইনসুলিন আবিষ্কারের ঘোষণা দেন।

১৯৪১ – জার্মান বাহিনী ইউক্রেনে প্রবেশ করে।

১৯৫৩ – কোরিয়া যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল এই দিন। আমেরিকা, চীন, উত্তর কোরিয়ার সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে।

১৯৫৫ – অস্ট্রিয়া পুনরায় স্বাধীনতা লাভ করে।

১৯৭১ – প্রশাসনের সুবিধার্থে মুজিবনগর সরকার সমগ্র দেশকে ৯টি অঞ্চলে ভাগ করে।

১৯৮৭ – ভারত-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর।

১৮৬৮ – আটলান্টিক টেলিগ্রাফ কেবল স্থাপনের কাজ শেষ করে।

১৮৮৯ – ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ব্রিটিশ ইন্ডিয়া শাখা গঠিত হয়।

১৭৬১ – পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

১৭৭২ – পোল্যান্ডকে বিভক্ত করার জন্য ইউরোপের তিনটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ।

১৭৯৪ – ফ্রান্সে ম্যাক্সিমিলিয়োন রোবিস পিয়ের ও তার সমর্থকদের ফাঁসি দেয়ার পর দেশটির উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান ঘটে ।

১৬৫৬ – ওয়ারশ যুদ্ধ শুরু এবং সুইডেনের পোল্যান্ড দখল।

১৬৯৪ – ব্যাংক অব ইংল্যান্ড অনুমোদন লাভ করে ।

 

এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন যারা—-

২০০৩ – বব হোপ, (মার্কিন কৌতুকাভিনেতা, অভিনেতা, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, মল্লক্রীড়াবিদ ও লেখক)।

২০১৫ – এপিজে আবদুল কালাম, (ভারতীয় বিজ্ঞানী, ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি)।

২০২০ – ইসরাফিল আলম, (বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য)।

২০২১ – (ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সাবেক পেসার) মাইক হেনড্রিক।

১৯১৭ – এমিল টেওডোর কখার, (সুইস চিকিৎসক ও চিকিৎসা গবেষক)।

১৯৩১ – কানাইলাল ভট্টাচার্য (ভারতের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী)।

১৯৪৬ – গারট্রুড স্টেইন, (মার্কিন ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার ও শিল্প সংগ্রাহক)।

১৯৭০ – অ্যান্টনিও ডি অলিভিয়ার সালাজার, (পর্তুগিজ রাজনীতিবিদ এবং ১০০তম প্রধানমন্ত্রী)।

১৯৮০ – মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, (ইরানের শেষ রাজা)।

১৯৮১ – উইলিয়াম ওয়াইলার, (একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক)।

১৯৮৪ – জেমস মেসান, (ইংরেজ অভিনেতা)।

১৯৮৭ – সালিম আলী, (বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমী)।

১৯৯২ – আমজাদ খান, (জনপ্রিয় ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং পরিচালক)।

১৯৯৪ – কেভিন কার্টার, (দক্ষিণ আফ্রিকান পুরস্কার-বিজয়ী ফটোসাংবাদিক)।

১৮৪১ – মিখাইল লেরমন্তফ, (রুশ কবি ও ঔপন্যাসিক)।

১৮৪৪ – জন ডাল্টন , (ইংরেজ রসায়নবিদ, আবহাওয়াবিজ্ঞানী ও পদার্থবিদ)।

১২৭৬ – আরাগনের প্রথম জেমস, (আরাগণের রাজা)।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
রিভিউ

আজ ২৬ জুলাই, ইতিহাসের আজকের এই দিনে যা ঘটেছিল।

আজ ২৬ জুলাই। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বছরের প্রতিটি দিনে ঘটেছে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আসুন আজকের দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় একনজরে দেখে নিই।  ইতিহাসের আজকের এই দিনে কী কী ঘটেছিল, কে কে জন্ম নিয়েছিলেন ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন——-

 

দিবস—–

(ক)  মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী

(খ) আন্তর্জাতিক দিবস৷

(গ) কিউবার জাতীয় বিপ্লব দিবস।

(ঘ) লাইবেরিয়ার স্বাধীনতা দিবস।

(ঙ) মালদ্বীপের স্বাধীনতা দিবস।

(চ) ভারতে কার্গিল যুদ্ধে বিজয় দিবস।

 

আজ যাদের জন্মদিন—-

১৯০৪ – মালতী চৌধুরী, (ভারতের বিশিষ্ট সর্বোদয় নেত্রী ও সমাজকর্মী)।

১৯০৮ – সালবাদোর আইয়েন্দে, (চিলির রাষ্ট্রপতি)।

১৯২২ – জেসন রবার্ডস, (মার্কিন মঞ্চ, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অভিনেতা)।

১৯২৭ – গুলাবরায় রামচাঁদ, (ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার)।

১৯২৮ – স্ট্যানলি কুবরিক, (মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক)।

১৯২৮ – বার্নিস রুবেনস, (ওয়েল্‌স বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা)।

১৯৪২ – আলফ্রেড মার্শাল, (ইংল্যান্ডের উনবিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী অর্থনিতীবিদ)।

১৯৪৫ – হেলেন মিরেন, (ব্রিটিশ অভিনেত্রী)।

১৯৪৯ – থাকসিন সিনাওয়াত্রা, (থাইল্যান্ডের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ)।

১৯৫০ – পল সিমর, (মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী)।

১৯৫৫ – আসিফ আলি জারদারি, (পাকিস্তানের ১৪তম রাষ্ট্রপতি)।

১৯৬৪ – সান্ড্রা বুলক, (জার্মান-আমেরিকান অভিনেত্রী, প্রযোজক এবং মানবপ্রেমিক)।

১৯৬৫ – জেরেমি পিভেন, (মার্কিন অভিনেতা ও প্রযোজক)।

১৯৬৭ – জেসন স্টেথাম, (ইংরেজ অভিনেতা)।

১৯৭১ – খালেদ মাহমুদ সুজন, (বাংলাদেশী সাবেক ক্রিকেটার এবং কোচ)।

১৯৭৩ – কেট বেকিনসেল, (ব্রিটিশ অভিনেত্রী)।

১৯৮০ – জাসিন্ডা আরডার্ন, (নিউজিল্যান্ডীয় রাজনীতিক)।

১৯৮৫ – গেল ক্লিশি, (ফরাসি ফুটবলার)।

১৯৮৯ – আইভিয়ান সার্কোজ, (মিস ওয়ার্ল্ড সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ২০১১-এর বিশ্বসুন্দরী)।

১৮৪২ – বের্টোল্ড ডেলব্রুক, (জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী)।

১৮৫৬ – জর্জ বার্নার্ড শ, আইরিশ সাহিত্যিক।

১৮৫৮ – টম গারেট, (অস্ট্রেলীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার)।

১৮৬৫ – রজনীকান্ত সেন, (বাঙালি কবি এবং সুরকার)।

১৮৮৮ – রেজিনাল্ড হ্যান্ডস, (দক্ষিণ আফ্রিকান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার)।

১৮৯৪ – অ্যালডাস হাক্সলি, (ইংরেজি উপন্যাসিক ও দার্শনিক)।

 

ইতিহাসের পাতায় আজকের দিনের ঘটনাবলী—-

২০০৩ – ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফুটবলে আন্তর্জাতিক ট্রফি আশিয়ান কাপ বিজয় করে ।

১৯০৮ – যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই গঠিত হয়।

১৯৫৩ – ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।

১৯৫৬ – মিশর সরকার সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে।

১৯৬৫ – যুক্তরাজ্য হতে মালদ্বীপ স্বাধীনতা লাভ করে।

১৯৯১ – সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদ-লেলিনবাদের পথ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৯৯ – ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত কার্গিল যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়।

১৮৪৭ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে লাইবেরিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে।

১৮৫৬ – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে ভারতবর্ষের সকল বিচারব্যবস্থায় হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ ‘দ্য হিন্দু উইডো’স রিম্যারেজ অ্যাক্ট,১৮৫৬ অনুসারে বৈধতা পায়।

১৮৭৬ – কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তার বন্ধু আনন্দমোহন বসু ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারতসভা প্রতিষ্ঠা করেন।

 

এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন যারা—-

২০০০ – জন টুকি, (মার্কিন পরিসংখ্যানবিদ)।

২০১৩ – সুং জেগি, (দক্ষিণ কোরীয় নারীবাদ-বিরোধী ও উদারনীতিবাদী ব্যক্তি)।

২০২০ – (ভারতীয় বাঙালি কবি) বিজয়া মুখোপাধ্যায়।

কম্পিউটার মাউসের সহ-উদ্ভাবক উইলিয়াম ইংলিশ।

২০২২ – পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত এক টাকার ডাক্তার (সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়)।

১৯১৫ – ইংরেজ অভিধানকার (জেমস হেনরি মারি)।

১৯২৫ – গট্‌লব ফ্রেগে, (জার্মান গণিতবিদ)।

১৯৩৪ – উইনসর ম্যাকে, (আমেরিকান কার্টুনিস্ট এবং অ্যানিমেশন তৈরিকারক)।

১৯৪১ – বেনজামিন হোর্ফ, (মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী)।

১৯৫২ – ইভা পেরন, (আর্জেন্টিনার স্বৈরশাসক জুয়ান পেরনের দ্বিতীয়া স্ত্রী)।

১৯৫৬ – মোহিতলাল মজুমদার, (বাঙালি কবি)।

১৯৫৭ – কার্লস কাস্তিলো আর্মস, (গুয়েতেমালান সামরিক কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদ)।

১৯৮০ – মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, (ইরানের শেষ রাজা)।

১৯৮৭ – চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, (ভারতীয় বাঙালি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী)।

১৯৮৮ – ফজলুর রহমান মালিক, (ইসলামের অন্যতম পরিচিত বিদ্বান ব্যক্তি)।

১৯৯৯ – আজাদ আজাদ হিন্দ ফৌজের রানী ঝাঁসি রেজিমেন্টের সৈনিক নীরা আর্য।

১৫৩৩ – আটাওয়ালপা, (ইনকা সাম্রাজ্যের ১৩তম ও শেষ স্বাধীন সম্রাট)।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

আজাদ আজাদ হিন্দ ফৌজের রানী ঝাঁসি রেজিমেন্টের সৈনিক ও প্রথম গুপ্তচর : নীরা আর্য।

ভূমিকা:-

 

তিনি ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম মহিলা গুপ্তচর, আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষী সেহেগল। দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভুত মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ১৯৪৩ সালে গড়ে উঠেছিল এই রেজিমেন্ট। ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল ব্যাংকক, রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর।

 

 নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন বাঁচাতে নিজের স্বামীকে হত্যা —

 

নীরা আর্য আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের সৈনিক ছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন বাঁচাতে তিনি নিজের স্বামীকে হত্যা করেন। নেতাজী তাঁকে নীরা নাগিনী বলে অভিহিত করলে তিনি নীরা নাগিনী নামে পরিচিতি লাভ করেন। বৃটিশ সরকার তাঁকে একজন গুপ্তচর হিসাবে গণ্য করেছিল। তার ভাই বসন্ত কুমারও আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন।

 

প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সাহসী ও আত্মসম্মান বোধ–

 

অনেক লোকশিল্পী নীরা নাগিন ও তার ভাই বসন্ত কুমারের জীবন নিয়ে কবিতা ও ভজন রচনা করেছেন। নীরা নাগিনী নামে তার জীবনের একটি মহাকাব্যও রয়েছে। তার জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত দেশপ্রেমিক, সাহসী ও আত্মসম্মান বোধে গর্বিত মহিলা। তার শেষ জীবন কাটে হায়দ্রাবাদে। সেখানকার মহিলারা তাকে গর্বের সাথে ‘পদ্মমা’ বলে সম্বোধন করতেন।

 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন—-

 

নীরা আর্য ১৯০২ সালের ৫ মার্চ ভারতের তৎকালীন যুক্তপ্রদেশের অধুনা উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বাগপত জেলার খেকড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা শেঠ ছজুমল ছিলেন সে সময়ের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার ব্যবসা-বাণিজ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার পিতার ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। তাই কলকাতাতে তার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। নীরা আর্য হিন্দি, ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি আরও অনেক ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের সিআইডি ইন্সপেক্টর শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে বিবাহ করেন। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস ছিলেন ইংরেজপ্রভু ভক্ত অফিসার। মূলতঃ শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে গুপ্তচরবৃত্তি করে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

 

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ—–

 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন বাঁচাতে তিনি ইংরেজ সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে হত্যা করেছিলেন। একসময় সুযোগ পেয়ে শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস নেতাজিকে হত্যার জন্য গুলি চালিয়েছিলেন, কিন্তু সেই গুলি নেতাজির গাড়ীর চালককে বিদ্ধ করে । কিন্তু এরই মধ্যে নীরা আর্য শ্রীকান্ত জয়রঞ্জনের পেটে বেয়নেট চালিয়ে হত্যা করে। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস নীরা আর্যের স্বামী ছিলেন, তাই স্বামী হত্যার কারণে নেতাজি তাঁকে নাগিনী বলে অভিহিত করেছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণের পরে, সমস্ত বন্দী সৈন্যকে দিল্লির লাল কেল্লায় বিচারে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নীরাকে স্বামী হত্যার কারণে দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। জেলে বন্দীদশায় সেখানে তাঁকে কঠোর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।

 

আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর—–

নীরা আর্য আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। পবিত্র মোহন রায় আজাদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মহিলা এবং পুরুষ উভয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন।   নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নিজেই নীরাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তার সঙ্গী মনবতী আর্য, সরস্বতী রাজামণি এবং দুর্গা মল্লা গোর্খা এবং যুবক ড্যানিয়েল কালে তার সামরিক গোয়েন্দা শাখার সাথে যুক্ত ছিল। তারা নেতাজির জন্য গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করত। তারা বিভিন্ন কাজের অছিলায় ব্রিটিশ অফিসারদের বাড়ি ও সেনাশিবিরে প্রবেশ করতেন তথ্য সংগ্রহের জন্য, তারপর তা নেতাজীর কাছে পাঠাতেন। এই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে প্রথমে নথিগুলি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া ও পরে পিস্তল চালিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে, এই নিয়ম তারা কঠোর ভাবে মেনে চলতেন।

 

 রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে নীরাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড–

 

দক্ষিণ এশিয়ার অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। ধরা পড়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের হাজার হাজার সেনানী। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে লালকেল্লায় তাদের বিচার শুরু হয়, বেশির ভাগ সেনানী ছাড়া পেলেও নীরাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, জাহাজে করে পাঠানো হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে। সেখানে তার ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আন্দামানে নীরাকে রাখা হয়েছিল একটি ছোট কুঠরিতে, সেখানে বাকি বন্দিরা ছিল মুক্ত, কিন্তু নীরাকে বন্য জন্তুর মত প্রথমদিন বেঁধে রাখা হয়েছিল। গলায় বাঁধা ছিল চেন ও হাতে-পায়ে ছিল শেকল লাগানো বেড়ি। নীরাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি প্রথম দিন। শোয়ার জন্য মাদুর কিংবা কম্বল কিছুই দেওয়া হয়নি প্রথমে। কুঠরির কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলেন পরিশ্রান্ত নীরা। মাঝরাতে এক প্রহরী কুঠরিতে ঢুকে গায়ের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল দুটো কম্বল। সকাল বেলায় প্রথম জুটেছিল খাবার, খেতে দেওয়া হয়েছিল ফুটন্ত খিচুড়ি।

এরপরেও আরও অনেক পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে নীরাকে। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। তবুও মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন ভারতে সূর্যোদয় দেখবেন। এই মহান ত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। নীরা আন্দামানে আসার একবছর পর স্বাধীন হয়েছিল দেশ। মুক্তি পেয়েছিলেন নীরা। এই আত্মত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। অভিমানে সাধারণের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন অসাধারণ নীরা।

 

স্বাধীনতা পরবর্তী জীবন–

 

স্বাধীনতার পরে, তিনি ফুল বিক্রি করে জীবনযাপন করেছিলেন, তবে কোনও সরকারী সহায়তা বা পেনশন গ্রহণ করেননি। তার ভাই বসন্ত কুমারও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পর সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। নীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা নিয়ে আত্মজীবনীও লিখেছেন। উর্দু লেখক ফারহানা তাজ’কে তিনি তার জীবনের অনেক ঘটনা শুনিয়েছিলেন। তিনি তার জীবন নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে একটি উপন্যাসও রচনা করেন।

 

সম্মাননা—

 

নীরা আর্য নামে একটি জাতীয় পুরষ্কারও চালু করা হয়েছে। ছত্তিশগড়ের অভিনেতা অখিলেশ পান্ডে প্রথম নীরা আর্য পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং তাঁকে নীরা আর্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

 

জীবনাবসান—

 

শেষ জীবনে তিনি  তিনি দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব হয়ে পরেছিলেন।  হায়দরাবাদের ফালকনুমার একটি কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন। নীরা আর্য জীবনের শেষ দিনগুলিতে ফুল বিক্রি করে কাটিয়েছেন এবং সরকারি জমিতে থাকার কারণে তার কুঁড়েঘরটিও শেষ মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সকলের অলক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুলাই উসমানিয়া হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছিলেন ৯৬ বছরের বীরাঙ্গনা এক অগ্নিকন্যা নীরা আর্য্য।

 

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

আজ ২৬ জুলাই, কার্গিল বিজয় দিবস, জানুন দিনটির ইতিহাস ও গুরুত্ব।

কার্গিল বিজয় দিবস ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ভারতীয় বীরদের স্মরণে সারা দেশে কার্গিল বিজয় দিবস উদযাপিত হয়।প্রতি বছর ২৬ জুলাই কার্গিল যুদ্ধের বীরদের সম্মানে দিনটি পালিত হয়। এই দিনটি সারা ভারতে এবং জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লিতে পালিত হয়, যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রতি বছর ইন্ডিয়া গেটে অমর জওয়ান জ্যোতিতে সৈন্যদের শ্রদ্ধা জানান।  ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অবদানকে স্মরণ করার জন্য সারা দেশে অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।

১৯৯৯ সালে লাদাখের উত্তর কারগিল জেলার পাহাড়ের চূড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীকে তাদের দখলকৃত অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয়কে পালন করতে প্রতি ২৬ জুলাই ভারতে পালিত হয় কার্গিল বিজয় দিবস  ।

 

প্রাথমিকভাবে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যুদ্ধে তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে, দাবি করে যে এটি কাশ্মীরি সামরিক বাহিনী দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। তবে হতাহতদের রেখে যাওয়া নথি, যুদ্ধবন্দিদের সাক্ষ্য এবং পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফের বিবৃতিতে জেনারেল আশরাফ রশিদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি আধা-সামরিক বাহিনী জড়িত ছিল।

 

 

১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে, সিয়াচেন হিমবাহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ রয়েছে। ১৯৯৯ সালের মে মাসে, পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী কাশ্মীর এবং লাদাখের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করতে নিয়ন্ত্রণ রেখায় (LOC) প্রবেশ করে। এইভাবে, তারা ভারতীয় সৈন্যদের লক্ষ্য করার জন্য ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে এবং পর্বতশ্রেণী দখল করে। ভারত সরকার শীঘ্রই কাজ শুরু করে এবং ‘অপারেশন বিজয়’ দিয়ে জবাব দেয়।

১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে, দুই প্রতিবেশীর সামরিক বাহিনীকে জড়িত তুলনামূলকভাবে কয়েকটি প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংঘাতের দীর্ঘ সময়কাল ছিল – পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে সামরিক ফাঁড়ি স্থাপন করে সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উভয় দেশের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করেনি।  শৈলশিরা এবং ১৯৮০ এর দশকে এর ফলে সামরিক সংঘর্ষ।  1990-এর দশকে, তবে, কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের কারণে উত্তেজনা ও সংঘাত বৃদ্ধি পায়, সেইসাথে 1998 সালে উভয় দেশের পারমাণবিক পরীক্ষা পরিচালনার ফলে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়।
পরিস্থিতি প্রশমিত করার প্রয়াসে, উভয় দেশই ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোর ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে, কাশ্মীর সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ ও দ্বিপাক্ষিক সমাধান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে।  ১৯৯৮-১৯৯৯ সালের শীতকালে, পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর কিছু উপাদান গোপনে পাকিস্তানি সৈন্য এবং আধাসামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ রেখার (LOC) ভারতের দিকে ভূখণ্ডে পাঠাচ্ছিল।  অনুপ্রবেশের কোড-নাম ছিল ‘অপারেশন বদ্রি’।  পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের লক্ষ্য ছিল কাশ্মীর ও লাদাখের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং ভারতীয় বাহিনীকে সিয়াচেন হিমবাহ থেকে প্রত্যাহার করা, এইভাবে ভারতকে বৃহত্তর কাশ্মীর বিরোধের নিষ্পত্তিতে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা।  পাকিস্তানও বিশ্বাস করেছিল যে এই অঞ্চলে যে কোনও উত্তেজনা কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করবে, এটি একটি দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।  তবুও আরেকটি লক্ষ্য হতে পারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে ভারতের কাশ্মীর রাজ্যে দশকব্যাপী বিদ্রোহের মনোবল বাড়ানো।

প্রাথমিকভাবে, অনুপ্রবেশের প্রকৃতি এবং ব্যাপ্তি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞানের সাথে, এলাকার ভারতীয় সৈন্যরা অনুপ্রবেশকারীরা জিহাদি বলে ধরে নিয়েছিল এবং ঘোষণা করেছিল যে তারা কয়েক দিনের মধ্যে তাদের উচ্ছেদ করবে।  অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা নিযুক্ত কৌশলের পার্থক্য সহ LOC বরাবর অন্যত্র অনুপ্রবেশের পরবর্তী আবিষ্কার, ভারতীয় সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছিল যে আক্রমণের পরিকল্পনাটি অনেক বড় পরিসরে ছিল।  প্রবেশের দ্বারা জব্দ করা মোট এলাকা সাধারণত  ১৩০ কিমি ২ – ২০০ কিমি ২ এর মধ্যে গ্রহণ করা হয়।  ভারত সরকার ২০০০০০ ভারতীয় সৈন্যদের একত্রিত করা অপারেশন বিজয়ের সাথে প্রতিক্রিয়া জানায়।  ২৬ জুলাই, ১৯৯৯ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের তাদের দখলকৃত অবস্থান থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে, এইভাবে এটিকে কার্গিল বিজয় দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

 

 

ভারতীয় সৈন্যরা ধাপে ধাপে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করেছিল।প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে দুই মাসব্যাপী যুদ্ধটি তিনটি পর্বে হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে, পাকিস্তানি বাহিনী টাইগার হিল এবং অন্যান্য পোস্টে নিজেদের অবস্থান করে ভারতীয় ভূখণ্ডে আক্রমণ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, ভারতীয় সেনাবাহিনী পরিবহন রুট দখল করে এবং পাকিস্তানি আক্রমণাত্মক লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে প্রতিক্রিয়া জানায়। কার্গিল যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতীয় বিমান বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাদের সরিয়ে দেওয়ার মিশন সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

 

২৬ শে জুলাই, ১৯৯৯-এ যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের তাদের দখলকৃত অবস্থান থেকে উচ্ছেদের মাধ্যমে, এইভাবে এটিকে কার্গিল বিজয় দিবস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যুদ্ধের সময় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ৫২৭ জন সেনা প্রাণ হারিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা সেই সাহসী সৈনিকদের একজন যারা দেশের জন্য লড়াই করে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বীরত্ব পুরস্কার পরম বীর চক্রে ভূষিত হন।

 

এই দিনে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ডিয়া গেটে অমর জওয়ান জ্যোতিতে সৈন্যদের শ্রদ্ধা জানান। বাইরের শক্তির হাত থেকে দেশকে সুরক্ষিত রাখতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান উদযাপনের জন্য দেশজুড়ে উদযাপনেরও আয়োজন করা হয়। স্মৃতিসৌধে শহিদদের পরিবারকেও স্বাগত জানানো হয়।

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

অরোভিলের জননী – মীরা আলফাসা ::: সৌরভকুমার ভূঞ্যা।।।।

অরোভিল কিংবা ‘ভোরের শহর’। তামিলনাড়ুর ভিল্লুপুরম জেলায় অবস্থিত ছোট্ট সুন্দর শহর অরোভিল। যার কিছুটা অংশ রয়েছে পণ্ডেচেরিতেও। যে পণ্ডেচেরি শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুজন বিখ্যাত মানুষের নাম, ঋষি অরবিন্দ এবং তাঁর শিষ্যা ও সহযোগী মীরা আলফাসা। গুরুদেব অরবিন্দের আদর্শ মাথায় নিয়ে পরীক্ষামূলক এই শহরটি স্থাপন করেছিলেন মীরা আলফাসা। অরোভিল একটি ফরাসী শব্দ। ফরাসীতে ‘auro’ শব্দের অর্থ ভোর আর ‘ville’ শব্দের অর্থ শহর। এককথায় ভোরের শহর। তবে অনেকের মতে মিরা আলফাসা গুরুদেব অরবিন্দের নামে এই শহরের নামকরণ করেছিলেন। নামকরণের নেপথ্য কাহিনি যাই থাক, মীরার এই শহর পত্তনের উদ্দেশ্য ছিল অরবিন্দের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা। তার আদর্শ ও ভাবনাচিন্তাকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
ভারতবর্ষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতির টানে যুগের পর যুগ ধরে বহু মানুষ সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে ছুটে এসেছেন, এখনও আসেন। তাদের অনেকে এই দেশকে ভালোবেসে এখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে গেছেন। এখানকার সভ্যতা, সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। এরকম অনেক মানুষ আছেন যাদের কথা আমরা জানতে পারি না। আবার এমন কেউ কেউ আছেন যারা তাদের কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাসের পাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছেন। ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম অনেক খ্যাতনামা মানুষের কথা আমরা জানতে পারি। তেমনই একজন মহিলা হলেন মীরা আলফাসা। আধ্যাত্মিকতার টানে সুদূর ফ্রান্স থেকে তিনি ভারতবর্ষে ছুটে এসেছিলেন এবং আমৃত্যু এখানেই কাটিয়েছেন।
* * * * *
মীরা আলফাসার পুরো নাম ব্লাঞ্চে রেচেল মীরা আলফাসা। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে জন্ম হয় তার। বাবা মরিস আলফাসা ও মা মাথিলদে ইসমালুন। ছোটোবেলা থেকে মীরা ছিলেন আলাদা প্রকৃতির। যখন তাঁর বয়স চার বছর তখন থেকেই তিনি ধ্যান করতেন। নিজের মধ্যে একাত্ম হয়ে যেতেন। ঘরে তার জন্য থাকা একটি ছোট্ট চেয়ারের ওপর বসে তিনি ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। তিনি বুঝতে পারতেন তার মনের মধ্যে আলাদা কিছু ঘটে চলেছে। তাঁর কথায়, ‘চার বছর বয়স থেকে আমি যোগা বা ধ্যান করতে শুরু করেছিলাম। আমার জন্য একটা ছোট্ট চেয়ার ছিল। আমি তার ওপর চুপ করে বসতাম আর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতাম। একটা উজ্জ্বল আলো আমার মাথার ওপর নেমে আসত এবং আমার মাথায় তুমুল আলোড়ন সৃষ্ট করত। আমি কিছু বুঝতে পারতাম না। কেননা বয়সটা বোঝার মতো ছিল না। তবে ধীরে ধীরে আমি অনুভব করতে পারি আমি হয়তো এমন কোনো মহান কাজ করার জন্য এসেছি যার কথা কেউ জানে না।’ সেই ছোট্টবেলা থেকেই তিনি জগতের দূর্দশা, মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা বুঝতে পারতেন। যখন তাঁর বয়স এগারো বারো বছর, তখন থেকে তিনি প্যারিসের কাছাকাছি একটি বনে একাকী ঘুরে বেড়াতেন। বনটি বেশ পুরোনো। এখানে এমনকি দুহাজার বছরের পুরোনো গাছ ছিল। সেখানে কোনো গাছের নীচে বসে তিনি গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। বনের গাছপালা, পশু পাখিদের সঙ্গে তিনি অদ্ভুত একাত্মতা অনুভব করতে পারতেন। সেই বয়স থেকে তার মধ্যে গুপ্তবিদ্যার প্রতি আগ্রহ জন্মতে শুরু করে। নানারকম মানসিক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকেন। তিনি স্পষ্টই অনুভব করেন ঈশ্বর আছেন এবং মানুষ চেষ্টা করলে সেই ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে। তাঁর ঘুমন্ত সত্ত্বায় কেউ যেন এসে তাঁকে এই শিক্ষা দিয়ে যেত। যে সত্ত্বাকে তিনি ঈশ্বর বলে মানতেন, যাকে পরবর্তীকালে তিনি কৃষ্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন তিনি সেই ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাবেন।
এরকম এক ঐশ্বরিক কিংবা স্বর্গীয় ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। রাত্রে শুতে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হত তার। কোনো কোনোদিন শুয়ে পড়ার পর অনুভব করতে পারতেন তার মধ্যেকার সত্ত্বা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। তারপর তা ক্রমশ উপরে উঠত থাকে। দেখতেন তার সেই শরীরে একটা সোনালী পোশাক। নারী পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ, অসুস্থ দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষ তার পোশাকের নীচে হাজির হয়েছে। তারা নিজেদের দুঃখ দূর্দশার কথা তার কাছে ব্যক্ত করছে। তার কাছে সাহায্যের আবেদন করছে। যেইমাত্র না তারা তার সোনালী পোশাক স্পর্শ করত সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, দূর্দশা চলে যেত। এই ব্যাপারটা তাঁকে নাড়িয়ে দিত। তার মনে হত সাধারণের মতো জীবন তার নয়। আলাদা কিছু কাজের জন্য তার এই পৃথিবীতে আসা।
সেই ছোটোবেলা থেকে নানান অদ্ভুত, অতিপ্রাকৃত ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটত। মীরার মায়ের চোখেও মেয়ের ব্যতিক্রমী স্বভাব ও আচরণ নজর এড়ায় না। তিনি মনে করতেন মেয়ের মানসিক সমস্যা রয়েছে।
নয় বছর বয়সে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। স্কুলজীবন শেষ করে পনের বছর বয়সে তিনি আর্ট সেন্টারে আকাদেমি জুলিয়ানে ভর্তি হয়েছিলেন চিত্রকলা শেখার জন্য। এখানে তিনি চার বছর পড়াশোনা করেন। তার চিত্রকলার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীও হয়। যাই হোক, এখানে পড়াশোনা করার সময় তার পরিচয় হয় হেনরি মারসেটের সঙ্গে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। পরের বছর তাঁদের একমাত্র সন্তান আন্দ্রের জন্ম হয়।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মীরা একটি ছোটো দল গঠন করেন। নাম দেন আইডিয়া। প্রত্যেক বুধবার সন্ধ্যায় দলের সদস্যেদর নিয়ে নিজের বাড়িতে বসতেন। আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে তাদের আলোচনা হত। পাশাপাশি গুপ্তবিদ্যা নিয়েও তাঁরা আলোচনা করতেন। তিনি মনে করতেন গুপ্তবিদ্যার জ্ঞান থাকার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক জ্ঞান থাকাও দরকার। যার মধ্যে এই দুটি বিদ্যা থাকবে তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবেন। আধ্যাত্মকি জ্ঞান না থাকলে গুপ্তবিদ্যার খারাপ প্রয়োগ হতে পারে। এই বিষয়ে তিনি অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। তাই নিজেকে নিমগ্ন করেছিলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনে।
এই সময় প্যারিসে তাঁর পরিচয় হয় ম্যাক্স থিওনের সঙ্গে। গুপ্তবিদ্যা বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। দক্ষিণ আলজেরিয়ার টেলিমেসন-এ তাঁর বাড়ি। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই মীরা একাকী আলজেরিয়া যান। ম্যাক্স থিওন ও তাঁর স্ত্রী আলমা থিওনের সঙ্গে দেখা করেন। ম্যাক্স থিওনের কাছ থেকে গুপ্তবিদ্যার বিষয়ে শিক্ষা নেন। শুধু সেই বছর নয়, পরের বছরও তিনি আলজেরিয়া যান। দুবছর টেলিমেশনে নিজের শিক্ষা শেষ করেন তিনি।
ম্যাক্স থিওন এই সময় ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। তিনি মীরাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যান। মীরা এই সময়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন যা ভয়ংকর সুন্দর। সমুদ্রপথে ইউরোপ ভ্রমণে যাওয়ার সময় তাঁদের জাহাজ ভূমধ্যসাগরে ভয়ংকর সামুদ্রিক ঝড়ের শিকার হয়। সবাই বুঝতে পারেন বড়ো বিপর্যয় ঘটতে চলেছে। এই সময় ম্যাক্স থিওন মীরাকে আদেশ দেন তাঁর অর্জিত গুপ্তবিদ্যা কাজে লাগিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবিলা করার। গুরুর আদেশ পেয়ে মীরা নিজের দেহ থেকে বেরিয়ে মাঝ সমুদ্রে যান। খোলা সমুদ্রে কিছু ছোটো ছোটো সজীব প্রাণসত্ত্বা দেখেন যা এই সমস্যা সৃষ্টির কারণ। তিনি তাদের সঙ্গে আধ ঘন্টা কথা বলেন। তাদের বোঝান এবং এই জায়গা থেকে ছেড়ে যেতে বলেন। তারা তার কথা মেনে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। যখন তিনি জাহাজে নিজের শরীরে ফিরে আসেন দেখেন ঝড় থেমে গেছে।
এদিকে স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে হেনরির সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের পর তিনি রু দ্য লেভিসে একটি ছোট্ট ঘরে একাকী থাকতে শুরু করেন। তিন বছর পর, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিয়ে করেন পল রিচার্ডকে। পল ছিলেন একজন খ্যাতনামা দার্শনিক। পাশাপাশি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিকতা, যোগা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন।
পল রাজনীতিতেও আগ্রহী ছিলেন। ভারতবর্ষের পণ্ডেচেরি তখন ফ্রান্সের অধিকারে ছিল। পলের উদ্দেশ্য ছিল এখান থেকে ফ্রান্স সিনেটে জয়লাভ করা। সেই কারণে তিনি পণ্ডেচেরি আসেন।
* * * * *
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট কলকাতায় জন্ম হয় অরবিন্দের। তাঁর বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন তৎকালীন বাংলার রংপুর জেলার জেলা সার্জেন। মা স্বর্ণলতাদেবী ছিলেন রাজ নারায়ন বসুর কন্যা।
অরবিন্দের যখন সাত বছর বয়স তখন তার বাবা কৃষ্ণধন বসু তাকে ইউরোপে পাঠান পড়াশোনা করার জন্য। এখানে চোদ্দ বছর ছিলেন তিনি। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। আইসিএস পরীক্ষায় তিনি সফল হয়েছিলেন। কিশোর বয়স থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতেন ভারতবর্ষকে পরীধনতার অক্টোপাশ থেকে মুক্ত করার। দেশের স্বাধীনতার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার। তিনি স্থির করেন ইংরেজদের অধীনে কাজ করবেন না। তাই আইসিএস-এর ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহন করেন না। ফলে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যান।
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন। রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে বরোদা কলেজের প্রফেসর হন। পরবর্তীকালে এখানকার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি তিনি দেশের কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বরোদায় থাকার সময় তার পরিচয় হয় মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী নেতা ঠাকুর সাহেবের সঙ্গে। তার কাছ থেকে তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা নেন। তরুণ সমাজকে বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ কাজ করে যাচ্ছিলেন। তার ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষকেও তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন।
অরবিন্দ ঘোষ তখন বরোদা কলেজের অধ্যক্ষ। এই সময় ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। নিবেদিতা তখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দালনে নিজিকে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন দেশের স্বাধীনতা আন্দালনে অরবিন্দের মতো মানুষকে দরকার। তিনি তাঁকে কলকাতায় এসে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। কলকাতায় তখন জাতীয় মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অরবিন্দকে সেই মহাবিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বরোদা কলেজের লোভনীয় পদের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আসেন অরবিন্দ। ১৯০৬ ক্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার জাতীয় মহাবিদ্যালয় যা বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে খ্যাত, তাতে যোগ দেন। শুরু হয় তার বিপ্লবী জীবনের আর এক অধ্যায়। তিনি ছিলেন চরমপন্থী আন্দোলনে বিশ্বাসী। দেশের যুব সমাজকে তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। যুগান্তর নামে গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির সঙ্গে তিনি জড়িয়ে ছিলেন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিপিন চন্দ্র পালের ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তিনি দেশের বিপ্লবী ও তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতেন দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী লেখার জন্য ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার বিপিনচন্দ্র পাল ও তাকে গ্রেপ্তার করে। বিপিন চন্দ্র পালের ছয় মাস জেল হয়। অরবিন্দ পত্রিকায় সরাসরি নিজের নামে লিখতেন না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় ইংরেজরা। ফলে সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারেন অরবিন্দকে এভাবে ছেড়ে রাখা তাদের পক্ষে বিপজ্জনক। তারা সুযোগ খুঁজছিলেন কোনো অজুহাতে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য। সেই সুযোগও তাঁরা পেয়ে যান। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল অত্যাচারী মেজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী মুজফফরপুরে তার গাড়ির ওপর বোমা ছোঁড়েন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান কিন্তু দুজন ইউরোপীয় মহিলা মারা যান। তারপর পর সারা দেশ জুড়ে ইংরেজ সরকার বোমার সন্ধানে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। মানিকতলার মুরারী পুকুর বাগানবাড়িতে বোমের কারখানা খুঁজে পায় তারা। মোট সাঁইত্রিশ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। শুরু হয় আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা। তার হয়ে মামলা লড়েন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আদালতে তিনি নির্দোষ প্রমাণতি হন। ফলে বেকসুর খালাস পান।
জেলে থাকাকালীন সময়ে অরবিন্দের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। এক অন্য জীবনের সন্ধান পান তিনি। জেল থেকে মুক্ত পাওয়ার পর সমস্তরকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। বৃটিশ সরকার যাতে তার কাজে কোনো ঝমেলা করতে না পারে তার জন্য প্রথমে যান ফরাসী অধিকৃত চন্দননগের। সেখান থেকে চলে যান পণ্ডেচেরি যেটিও ছিল ফরাসী অধিকৃত। পণ্ডেচেরি আসার পর এক নতুন জীবন শুরু হয় তার। নিজেকে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় ডুবিয়ে দেন। বিপ্লবী অরবিন্দ থেকে ক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন ঋষি অরবিন্দ।
* * * * *
নির্বাচনী কাজে পণ্ডেচেরিতে বেশ কিছুদিন ছিলেন পল রিচার্ড। এখানে থাকার সময় তিনি জানতে পারেন অরবিন্দের কথা, তার আধ্যাত্মিক সাধনার কথা। পল নিজেও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন। তাই বেশ কয়েকবার তিনি অরবিন্দের সঙ্গে দেখা করেন। অরবিন্দের জীবন দর্শন, ভাবধারায় মুগ্ধ হন তিনি। প্যারিসে ফিরে মীরাকে তিনি অরবিন্দের কথা বলেন। অরবিন্দের কথা শুনে মীরা উৎসাহী হয়ে পড়েন। তার যেন মনে হয় এই সেই মানুষ যাঁকে তিনি স্বপ্নে দেখেন। তাঁর মধ্যে আগ্রহ বাড়ে ভারতবর্ষে আসার জন্য।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ পল রিচার্ড দ্বিতীয়বার ভারতে আসেন। এবার মীরাও তার সঙ্গে আসেন। যেদিন তারা এই দেশের মাটিতে পা দেন, সেদিনই তারা সাক্ষাৎ করেন অরবিন্দের সঙ্গে। অরবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ মীরার মনে আলোড়ন তোলে। মুগ্ধ হন তিনি। তার মনে হয় এই সেই মানুষ যাকে তিনি খুঁজে চলেছেন এতদিন। যাকে তিনি স্বপ্নে দেখেছেন বারবার। ইনিই সেই ‘ঈশ্বর পুরুষ’ যাকে তিনি কৃষ্ণ বলে মনে করতেন। প্রথম সাক্ষাতে মীরা অনুভব করেন এই ভারতবর্ষ তার কর্মক্ষেত্র। অরবিন্দের সাক্ষাতে আসার পর তিনি নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন উপলব্ধি করেন। সেই সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মনে হল, যেন নতুন জন্ম হল আমার। অতীতের সব রীতি, অভ্যাস মনে হল অপ্রয়োজনীয়। আর মনে হল, একসময় যাকে আমি ফল বলে মনে করতাম, এখন মনে হল তা আসলে প্রস্তুতি মাত্র … আমার হৃদয়ের মধ্যে থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা জাগরিত হল। আমার মনে হল এতদিন ধরে আমি যা খুঁজছি অবশেষে তার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁচেছি।’
স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে নিয়মিত অরবিন্দের কাছে যেতেন। তার কথা শুনতেন। অরবিন্দের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের। পল আর মীরা স্থির করেন ‘আর্য’ নামে একটি ফিলজফিক্যাল জার্নাল প্রকাশ করার। অরবিন্দ তাদের এই ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট অরবিন্দের জন্মদিনে ‘আর্য’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
ইতিমধ্যে দেশ থেকে ডাক আসে পলের। তাকে ফ্রেঞ্চ রিজার্ভ আর্মিতে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে তিনি বাধ্য হন ভারতবর্য ত্যাগ করতে। মীরার একদমই ইচ্ছে ছিল না ভারতবর্ষ ত্যাগ করে যাওয়ার। কিন্তু থাকতে পারেন না তিনি। প্রথমত স্বামী ফিরে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত অরবিন্দও তাকে থাকার জন্য বলেন না। এই নিয়ে মীরার অভিযোগ এবং অভিমানও ছিল। যা তিনি নিজের লেখায় প্রকাশ করেছেন। আসলে অরবিন্দ মনে করেছিলেন মীরার এখনই এখানে থাকার সময় হয়ে ওঠেনি। সেই কারণে স্বামীর সঙ্গে ফিরে যেতে বাধ্য হন মীরা। ১৯১৫-এর ২২ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরার পথ ধরেন তিনি। পণ্ডেচেরি ত্যাগ করে যাওয়াটা মীরার মনে গভীর আঘাত দিয়েছিল। এর জন্য তিনি অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “He (Sri Aurobindo) did not keep me, what could I do? I had to go. But I left my psychic being with him, and in France I was once on the point of death: the doctors had given me Up.”
ফ্রান্সে এক বছর থাকেন পল। এক বছর পর তাকে সেনাবাহিনী থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাপান যান। মীরাও তার সঙ্গে যান। এখানে চার বছর কাটান তারা। ১৯১৯-এ জাপানে এক মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় মীরাও সেই রোগে আক্রান্ত হন তিনি। কিন্তু তিনি কোনো ডাক্তার দেখান না, ঔষধও খান না। তিনি বোঝার চেষ্টা করেন এই মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী। অসুস্থ অবস্থায় একদিন যখন শুয়েছিলেন তখন তিনি মানস চোখে দেখতে পান সৈনিকের পোশাক পরা একজন যার মাথা নেই। সেই মুণ্ডুহীন শরীর এগিয়ে এসে তার বুকের ওপর চেপে বসে। তার শরীরের শক্তি যেন শুশে নিতে থাকে। অবস্থা এমন হয় যে মীরার মনে হয় তিনি বোধহয় আর বাঁচবেন না। সহসা তিনি তার গুপ্তবিদ্যা কাজে লাগান এবং সেই মুণ্ডুহীন সত্ত্বাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। তারপর তিনি সেরে উঠেছিলেন। মীরা বুঝতে পারেন এই মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অসংখ্য তরুন সৈন্যের অকাল মৃত্যু হয়েছিল। তারাই চেষ্টা করছিল অন্যের শরীরে প্রবেশ করে নিজেদের ফিরে পাওয়ার। আর সেটাই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণ।
১৯২০-এর এপ্রিল মাসে মীরা স্বামীর সঙ্গে পণ্ডেচেরি আসেন। মিস ডরোথি হজসন নামে এক ইংরেজ মহিলাও তাদের সঙ্গে আসেন। এরপর তিনি আর ভারতবর্ষ ত্যাগ করে যাননি। ঋষি অরবিন্দের সংস্পর্শে এসে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় ডুবিয়ে দেন। স্ত্রীর এই ব্যাপারটা পছন্দ হয় না পলের। মীরাকে তিনি অরবিন্দের কাছ থেকে নিয়ে চলে যেতে চান। কিন্তু মীরা ততদিনে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। স্বামীর কথায় রাজি হন না তিনি। ফলে তাদের সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরে। শেষমেষ মীরাকে ছাড়া তিনি পণ্ডেচেরি ত্যাগ করেন।
মীরা ও হজসন বেয়ন্ড হাউসে থাকতেন। ১৯২০-এর ২৪ নভেম্বরের এক ভয়ংকর ঝড়ে তাদের বাড়িটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একথা জানতে পেরে অরবিন্দ তাদের নিজের বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। তারপর থেকে মীরা ও হজসন অরবিন্দের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন।
অরবিন্দের সংস্পর্শে আসার পর মীরা আরও বেশি করে সাধনায় ডুবে যান। অরবিন্দের বাড়িতে তারা দুজন ছাড়া আরও কয়েকজন থাকতেন। আগামীর কথা ভেবে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মীরা একটি আশ্রম স্থাপন করেন। প্রথমে আশ্রমটি পরিকল্পিত ছিল না। একটু একটু করে আশ্রমে শিষ্যের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তথাকথিত আশ্রম বলতে আমাদের চোখের সামনে যে ছবি ফুটে ওঠে, এই আশ্রম তেমন ছিল না। ১৯২৬-এ আশ্রমে শিষ্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪ জন। মাত্র তিন বছরে সংখ্যাটি একশোতে পৌঁছে যায়। অরবিন্দ একটু একটু করে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছিলেন নিজের সাধনার আরও বেশি করে ডুবে যাওয়ার জন্য। আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর অরবিন্দ মীরার হাতে আশ্রমের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি বাইরের জগৎ থেকে সরিয়ে নেন। এই সময় থেকে অরবিন্দ মীরাকে ‘The Mother’ (শ্রীমা) নামে ডাকতে শুরু করেন।
সময় এগিয়ে চলে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত হন অরবিন্দ। প্রথমটা সমস্যা তেমন গুরুতর ছিল না। সবাই আশা করেছিল তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু অসুস্থতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। অবশেষে ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। অরবিন্দের মৃত্যু মায়ের কাছে ছিল বড়ো আঘাত। তাঁর মৃত্যু নিয়ে পরের দিন ড. সান্যালকে তিনি বলেছিলেন, “People do not know what a tremendous sacrifice He has made for the world.”
অরবিন্দের মৃত্যুর পর আশ্রমের সমস্ত কাজের ভার নেন শ্রীমা। প্রসঙ্গত বলার, ১৯৪৩ সাল থেকে ছোটোদের জন্য আশ্রমের মধ্যে ছোটো আকারে একটি স্কুল শুরু হয়। শ্রীমা নিজে ক্লাস নিতেন ছোটোদের। অরবিন্দের মৃত্যুর পরের বছর থেকে তিনি ছোটোদের জন্য বিশেষ ক্লাস নিতে শুরু করেন। ওই বছর তিনি একটি ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি সেন্টার স্থাপন করার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি এর উদবোধন হয়। নাম দেওয়া হয় শ্রী অরবিন্দ ইন্যারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি সেন্টার। ১৯৫৯-এ এর নাম বদলে রাখা হয় শ্রী অরবিন্দ ইন্টারন্যাশন্যাল সেন্টার অব এডুকেশন। এরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবনা ছিল অরবিন্দের।
শ্রীমায়ের জীবনের অন্যতম কীর্তি হল অরোভিল স্থাপন। শ্রীমা স্থির করেন পরীক্ষামূলকভাবে একটি শহর স্থাপন করার। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়। স্থির হয় হিন্দি হবে ভারতের সরকারি ভাষা। প্রথম পনেরো বছর ইংরেজির পাশাপাশি সেটি সহযোগী ভাষা হিসেবে থাকবে। ১৯৬৫ এর ২৬ জানুয়ারি থেকে ইংরেজির বদলে হিন্দি হবে সরকারি ভাষা। কিন্তু অনেক অ-হিন্দিভাষী রাজ্য এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ছিল না। এই নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছিল। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা মাদ্রাজ জুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা লুঠপাঠ চালায়। আশ্রমগুলিতেও তারা আক্রমণ চালায়। সেই দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পায় না মায়ের আশ্রমও। এই ব্যাপারটা শ্রীমা-এর মনকে নাড়া দেয়। অনেক দিন মনের মধ্যে লালিত করা একটি স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ভাবনা জেগে ওঠে। তিনি চান এমন একটি জায়গা তৈরি করতে যেখানে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ সত্যের সাধনায় প্রগতিশীল জীবন কাটাতে পারবে। সেখান থেকে তার মাথায় আসে একটি শহর তৈরির পরিকল্পনা। সেই শহর হল অরোভিল।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমা শ্রীঅরবিন্দ সোসাইটি স্থাপন করেছিলেন। ১৯৬৪-তে এই সোসাইটির বিশ্ব সম্মেলনে অরোভিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাশ হয়। এটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রীমা বলেছেন, “Auroville wants to be a universal town where men and women of all countries are able to live in peace and progressive harmony above all creeds, all policies and all nationalities.” মানুষের মধ্যে একতা ও একাত্মতা গড়ে তোলাই ছিল এই শহর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য
১৯৬৮-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে দশটায় এর উদবোধন হয়। এটির নক্সা করেন স্থাপতি রোজার অ্যাঙ্গার। পঞ্চাশ হাজার লোকের থাকার মতো এই শহর। উদবোধন অনুষ্ঠানে ১২৪ টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ভারতবর্ষের ২৩ টি রাজ্যের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিল। প্রায় সকল দেশের শিশু প্রতিনিধিরা এখানে রাখা একটি পাত্রে একমুঠো করে নিজের নিজের দেশের মাটি প্রদান করে।
অরোভিলে কারা থাকতে পারবে সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শ্রীমা বলেন, “Auroville belongs to nobody in particular. Auroville belongs to humanity as a whole. But to live in Auroville one must be the willing servitor of the divine Consciousness.” পনেরো বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই শহর। শহরের চারটি বিভাগ – আবাসিক, শিল্প, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক।
শহরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে মাতৃমন্দির। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এর ভিত্তিপ্রস্তর দেওয়া হয়। এটি দেখতে একটি সোনালী গোলকের মতো। চারটি স্তম্ভের ওপর এই গোলকটি রয়েছে। এই চারটি স্তম্বকে মায়ের চারটি শক্তির রূপক হিসেবে ধরা হয়। যে শক্তির কথা ঋষি অরবিন্দ উল্লেখ করেছিলেন তাঁর বইতে। অরবিন্দ তার ‘The Mother’ বইতে মীরার চারটি দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল জ্ঞান, শক্তি, সম্প্রীতি ও পরিপূর্ণতা। এই চারটি সত্ত্বার মধ্য দিয়ে মায়ের চারটি রূপ তুলে ধরেছেন তিনি – মহেশ্বরী, মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী। যাই হোক, মাতৃ মন্দিরের মধ্যে রয়েছে ধ্যান কক্ষ। এর ভেতরের পরিবেশ একেবারে শান্ত। মন্দিরের চারদিকে সুন্দর বাগান। এর মধ্যে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে। যখন আকাশে সূর্য থাকে না তখন এই সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে আলো গোলকের ওপর পড়ে প্রতিফলিত হয়। শুরুর দুই দশকে এখানে কুড়িটি দেশের প্রায় চারশ জন বাস করতেন। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে, অরোভিলের রজতজয়ন্তী বর্ষে এখানকার লোকসংখ্যা ছিল ৫৪ টি দেশের ২৮১৪ জন। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ ভারতীয়।
এই শহরটির তৈরি করার পেছনে শ্রীমায়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সর্বজনীন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ জাতি ধর্ম বর্ণ দেশ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা। এর থেকে মহান উদ্দেশ্য আর কী হতে পারে? মীরা আলফাসা ছিলেন অরবিন্দ আশ্রমের জননী। অরবিন্দও তাকে ‘The Mother’ সম্বোধেন সম্বোধন করতেন। আর বিশ্ব ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ নিয়ে এমন একটি মডেল শহরের জন্ম দেওয়া মহিলাকে তার জননী বললে বোধহয় খুব একটা ভুল বলা হবে না।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন শ্রীমা। মানুষের সঙ্গে দেক্ষাসাক্ষাৎ, ভক্তদের দর্শন দেওয়া প্রভৃতি বন্ধ করে দেন। কেবল ১৫ আগস্ট, গুরুদেব অরবিন্দের জন্মদিনের দিন শেষবার তাঁর ভক্তদের দর্শন দেন তিনি। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর মারা যান তিনি। আশ্রম ভবনের সামনের চত্ত্বরে অরবিন্দের সমাধির পাশে তাকে সমাধিস্ত করা হয়।

সৌরভকুমার ভূঞ্যা
তেরপেখ্যা, মহিষাদল
পূর্ব মেদিনীপুর, ৭২১৬২৮
৯৪৭৬৩৩০৫৩৩, ৭৪৩১৯৮৫৪৮৫

Share This