Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ইতিহাস গর্ভে ফিরে দেখা! : তন্ময় সিংহ রায়।।।

”ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা!”

 

এই রাখি’র বন্ধনে কিভাবে মানুষ বাঁধা পড়ল? পুরাণ থেকে ইতিহাস গর্ভে এ নিয়ে
রয়ে গেছে বেশ কিছু রহস্যময় ও উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ!
এবারে উঁকি মারা যাক পৌরাণিক সেই কাহিনীগুলি’র দরজায়!
প্রথমত, হিন্দু ধর্মের মহাকাব্যদ্বয়ের মধ্যে মহাভারতে লুকিয়ে থাকা রাখি বন্ধনের যে ঘটনা আমরা দেখতে পাই তা হল,
কথিত আছে রাজসূয় যজ্ঞের সময় শিশুপালকে হত্যার পরে স্বয়ং শ্রী-কৃষ্ণের একটি আঙুল কেটে ঝরতে থাকে রক্ত!
এমতবস্থায়, পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী দ্রৌপদী
তখন তাঁর শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের আঙুলে বেঁধে দেন ও অভিভূত কৃষ্ণ তাঁর অনাত্মীয়া, কিন্তু বোন হিসাবে মেনে নেওয়া দ্রৌপদীকে পরিবর্তে
প্রতিশ্রুতি দেন যে, ভবিষ্যতে সর্বরকম বিপদে তিনি রক্ষা করবেন তাঁকে।
এই ঘটনার বহু বছর পর, পাশাখেলায় হারের মাধ্যমে কৌরবরা যখন দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে উদ্যত হন, সে মুহুর্তে  কৃষ্ণ অসমাপ্ত বস্ত্র সরবরাহের দ্বারা দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে বজায় রাখেন সেই প্রতিদান।

দ্বিতীয়ত, যমুনা তাঁর ভাই স্বয়ং যমের হাতে  বেঁধে দিয়েছিলেন রাখি।

তৃতিয়ত, শুভ ও লাভ নামে গণেশের পুত্রদ্বয়
এক সময় বায়না ধরে যে, নিজেদের বোনের হাতে তারা পরাতে চায় রাখি!
এ পরিস্থিতিতে উপায়ান্তর না দেখে গণেশ তাঁর দুই স্ত্রী ঋদ্ধি ও সিদ্ধি’র অন্তর থেকে নির্গত অগ্নি থেকে সৃষ্টি করেন বোনরূপি সন্তোষী মা-কে, যিনি সন্তোষের অধিষ্ঠাত্রী দেবী নামে অভিহিত হিন্দুধর্মের একজন অ-শাস্ত্রীয় ও লৌকিক নবীন দেবী।

এবারে আলোকপাত করা যাক কিংবদন্তী’র ইতিহাস কি বলছে সে বিষয়ে,
প্রথমত, শত্রুর হাত থেকে নিজের রাজ্যের মান-মর্যাদা রক্ষা করার একান্ত উদ্দ্যেশ্যে,
মুঘল সম্রাট বাবর পুত্র সম্রাট হুমায়ুনের কাছে একবার সাহায্যপ্রার্থী হন চিতোরের বিধবা রানি কর্ণবতী এবং সেই সময়ে তিনি একটি রাখিও পাঠান হুমায়ুনকে। এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে এই ঘটনা পরিনত হয় উৎসবে এবং এর জনপ্রিয়তা হতে থাকে ক্রমবর্ধমান!

দ্বিতীয়ত, গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বিশেষত এই কারণে বলে আমার মনে হয় যে, এর ফলে গ্রিকদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার একটি সুযোগ আমরা পাই।
যাইহোক, বর্তমান ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ঝিলাম নদী (ঋগ্বেদে বিতস্তা নদী) সংলগ্ন উপকূলে গ্রিকদের বশ্যতা স্বীকার না করা ঝিলাম রাজ পুরুর সাথে ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের তুমুল যুদ্ধের ফলে সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন পুরু।
কিন্তু ইতিহাস বলছে, তাঁর স্বামীর প্রাণ সংশয় হতে পারে, এই আশঙ্কা করে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোক্সানা পুরুর কাছে যান এবং তাঁর হাতে বেঁধে দেন একটি পবিত্র সুতো ও পরিবর্তে পুরু
আলেকজান্ডারের কোনও ক্ষতি করবেন না বলে কথাও দেন।

এদিকে আধুনিক ইতিহাসে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই,
১৯ শতকে বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে থাকাটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে হয়ে উঠেছিল অপরিমিত ভয়ের একটি বিশেষ কারণ, আর যে কোনো উপায়ে এই  আন্দোলনকে দমন করার বিভিন্ন পথ খুঁজতে গিয়েই ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করে ঐক্য শক্তিকে হ্রাস করবে। এ হেন জটিল ও মর্মান্তিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ সহ গোটা ভারতের বিভিন্ন বিশিষ্টজন ও নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করেছিলেন এবং শুরু করেছিলেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক সংঘবদ্ধ প্রতিবাদী আন্দোলন!
অতএব ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের উদ্দ্যেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতা, সিলেট
ও ঢাকা ইত্যাদি থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই-বোনকে আহ্বান করেছিলেন ঐক্যতার প্রতীক হিসাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার জন্যে!
বলাবাহুল্য সে সময় দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাও যেন পৌঁছেছিল একেবারে চরম পর্যায়ে!
বলার আর কোনো অপেক্ষা রাখে না যে,
ধর্মীয় অরাজকতা সে সময়েও ছিল, আজও বজায় আছে তা বহাল তবিয়তে!

ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একবিংশের ঠিক যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে এই উৎসব তা এরূপ,
শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হিন্দু ভাই-বোনদের মধ্যে অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে পালন করা হয় এই রাখী বন্ধন নামক উৎসবটি!
উৎসবের ধরণ হিসাবে উল্লেখ্য, সেই বিশেষ দিনে দিদি বা বোনেরা তাঁদের ভাই বা দাদা’র আ-জীবন মঙ্গল কামনা’র উদ্দ্যেশ্যে হাতের কব্জিতে বেঁধে দেয় রাখী নামক একটি পবিত্র সুতোর বন্ধন! পরিবর্তে ভাই বোনকে দেয় কিছু উপহার ও শপথগ্রহণ করে বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সারাজীবন বোনকে রক্ষা করায়!
এখানে একটি বিষয় জানানো ভালো, সেই ভাই-বোন যে একই মায়ের গর্ভের হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
হিন্দু ছাড়াও জৈন ও শিখ প্রভৃতিরা পালন করে থাকেন এই উৎসব!
সর্বশেষ এই যুক্তি পরিলক্ষিত যে, রাখিকে ভাই-বোনের উত্‍সব হিসাবে মনে করা হলেও ইতিহাসে কিন্তু, পুরুষকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করার শুভ প্রতীক হিসাবে তাঁদের কব্জিতে মহিলাদের সুতো বেঁধে দেওয়ার একটি যোগসূত্র থেকেই যাচ্ছে।
আর হয়তো এগুলিই পরে রূপ নেয় রাখি বন্ধন উত্‍সবের!!

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *