Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

ভারতীয় অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির পথে – একটি পর্যালোচনা : দিলীপ রায়।

ভারতের অর্থনীতি বৈচিত্র্যময়। কৃষিকাজ, হস্তশিল্প, বস্ত্রশিল্প, উৎপাদন, এবং বিভিন্ন সেবা ভারতের অর্থনীতির অংশ । ভারতের শ্রমশক্তির দুই-তৃতীয়াংশ প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে কৃষি থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে । তবে সেবাখাত (Service Sector) ক্রমেই প্রসার লাভ করছে এবং ভারতের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ  হয়ে উঠছে । ডিজিটাল যুগের আবির্ভাবের পর ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারদর্শী তরুণ ও শিক্ষিত লোকের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে ভারত আউটসোর্সিং, ক্রেতা সেবা ও কারিগরি সহায়তা দানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে  । ভারত সফটওয়্যার ও আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে অতি-দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করে থাকে  । এছাড়া উৎপাদন, ওষুধ শিল্প, জীবপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, জাহাজ নির্মাণ, বিমানভ্রমণ এবং পর্যটন শিল্পগুলিতেও ভবিষ্যতে জোরালো প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা  ।
স্বাধীনতা লাভের পর ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে ভারত সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থনীতি চালানোর চেষ্টা চলে । তখন অর্থনীতিতে বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল । তবে ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে ভারত ক্রমে উদারপন্থী অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে তার বাজারগুলি উন্মুক্ত করতে শুরু করে । সরকারি  শিল্পগুলির বেসরকারীকরণ বেশ ধীরে ধীরে  রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে । দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা ভারতের একটি প্রধান সমস্যা এবং এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য একটি বড় বাধা ।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৯৯০ র দশক ভারতীয় অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসাবে চিহ্নিত । আশির দশকের শেষ এবং নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে দেশ যে ম্যাক্রো অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার মুখোমুখি হয়েছিল, তা সরকারকে ১৯৯১ সালে কাঠামোগত সংস্কার প্রবর্তনে তৎপর করে । কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির সম্মিলিত বিপুল ঘাটতি, অর্থপ্রদানের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় । এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশে ভারত, অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও সংস্কারের পথে যাত্রা শুরু করে ।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলতে নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার উৎপাদন বৃদ্ধি বোঝায় । সাধারণত কোনো দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির শতকরা  হারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় ।  প্রকৃত বৃদ্ধির হার ১৯৮০-এর দশকে গড়ে ৫.৫ শতাংশ,   আর্থিক বছর ১৯৯৩  ও ২০০০এর মধ্যে ৬.৩ শতাংশ উঠে আসে । বৈদেশিক বাণিজ্যে  উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, মোট পণ্য ও পরিষেবা,  বাণিজ্য-জিডিপি অনুপাত ১৯৯০ সালে ১৭.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০০০ সালে হয় ৩০.৬ শতাংশ ।
আমরা মাথা পিছু আয় বলতে কী বুঝি ? একটি দেশের মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথা পিছু আয়ের হিসাব করা হয় ।  মাথাপিছু আয় প্রায়শই একটি সেক্টরের গড় আয় পরিমাপ করতে এবং বিভিন্ন জনসংখ্যার সম্পদের তুলনা করতে ব্যবহৃত হয় । মাথাপিছু আয় প্রায়ই একটি দেশের জীবন যাত্রার মান পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয় । মাথাপিছু আয়কে গড় আয়ও বলা হয় ।   IMF ভারতের মাথা পিছু আয় সম্পর্কে আশাবাদী । তাদের মতে মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১.৪৩ লক্ষ টাকা যেটা ডলারে মূল্য দাঁড়ায় ১৮৯৫ ডলার ।  অন্য কথায় একটি দেশের অভ্যন্তরে এক বছরে চূড়ান্তভাবে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার বাজারে সামষ্টিক মূল্যই হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন । আগের বছরের তুলনায় পরের বছরে উৎপাদন যে হারে বাড়ে সেটি হচ্ছে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি । জিডিপি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক ।  ভারতের জিডিপি ২০১৭ সালে ছিল বিশ্বে ৬ নম্বরে, কিন্তু ২০১৮তে ভারত গেলো ৭ নম্বরে । বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক বিকাশের গতি শ্লথ হওয়ার কারণে এবং মার্কিন ডলারের তুলনায় বারবার ভারতীয় মুদ্রামানের অবনমনের জন্যই   ২০১৭’র   চেয়ে জিডিপি’র নিরিখে ভারত পিছিয়ে পড়েছে ।
জিএনপিঃ GDP & GNP, প্রায় সমার্থক । তবে সামান্য পার্থক্য  রয়েছে । কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত  এক বছরে কোনো দেশের জনগণ মোট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য বা সেবা উৎপাদন করে তার অর্থমূল্যকে মোট জাতীয় উৎপাদন  বা জিএনপি বলে । জাতীয় উৎপাদনের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ও কর্মরত বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থার উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভূক্ত হবে না । তবে বিদেশে বসবাসকারী বা কর্মরত দেশি নাগরিক, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও আয় অন্তর্ভূক্ত হবে । জাতীয় আয়ের হিসাব থেকে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় । যে দেশের জিএনপি যত বেশী সে দেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তত বেশী সমৃদ্ধ ।
এবার আসছি প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (FDI)  সংক্রান্তে । জানা যায় ২০১৮-১৯ সালে মোট প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪. ২ শতাংশ বেড়েছে ।   প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে পরিষেবা, মোটরগাড়ি ও রসায়ন ক্ষেত্রে । ভারতীয় ব্যঙ্কিং ক্ষেত্র দ্বিমুখী সমস্যার সম্মুখীন । কর্পোরেট ও ব্যাঙ্ক ব্যালান্স সীটে সমস্যার পাশাপাশি অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়েছে । অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ঋন সহায়তা ২০১৬-১৭তে ছিল নিম্নমুখী । কৃষি সহযোগী ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯এ  প্রকৃত বিকাশ হার কিছুটা কমলেও উৎপাদন ও নির্মাণ ক্ষেত্রে অগ্রগতির দরুন শিল্প বিকাশের হার তরান্বিত হয়েছে । এছাড়া ২০১৯ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল নবম ।  ভারত প্রায় ৫১০০ কোটি ডলার FDI পেয়েছে, খবরটা জানা গেছে জাতিসংঘের ব্যবসা বাণিজ্য বিভাগ থেকে । উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে FDI আকর্ষণকারী শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায়  রয়েছে ভারত । এখানে একটি কথা প্রনিধানযোগ্য, বৈদেশিক বাণিজ্যও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, মোট পণ্য ও পরিষেবা বাজ্য-জিডিপি অনুপাত ১৯৯০ সালের ১৭.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০০০ সালে হয় ৩০.৬ শতাংশ ।
পরিকাঠামোর নিরিখে দীর্ঘদিনের ঘাটতি এবং রসদ সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলায় ২০১৪ সাল থেকে বড় মাপের সরকারি ব্যয় হতে থাকে । ভারতের মতো বিশাল দেশে পরিকাঠামো উন্নয়নে ধারাবাহিক এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, সরকার ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইন (NIP) স্থাপন করেছে । এই দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গিতে ২০২৪-২৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রায় ১১১ কোটি  টাকার বিনিয়োগ করা হয়েছে পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য । এছাড়াও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে গত নয় বছরে অনেক সংস্কারমূলক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । “আত্মনির্ভর ভারত” এবং “মেক ইন ইন্ডিয়া” এর মতো কর্মসূচিগুলির লক্ষ্য ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো এবং বিভিন্ন  শিল্পে রপ্তানীর প্রসার ঘটানো ।
এবার আসছি বিশেষজ্ঞরা কী বলছে । বিশ্বব্যাঙ্ক ভারতীয় অর্থনীতির উপর পূর্বাভাসে বলেছে, ভারতীয় অর্থনীতির গতি বাড়বে । অন্যদিকে মুডিজ ইনভেস্টরস সার্ভিস, এস অ্যান্ড পি’র মতো আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলি জানিয়েছে,  ২০২২-এ ভারতের জিডিপি ৩.৫ ট্রিলিয়ন (৩.৫ লক্ষ কোটি) মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে এবং আগামী কয়েক বছরে জি-২০ সদস্য দেশগুলির মধ্যে দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হবে ভারতীয় অর্থনীতি ।
পরিশেষে বলা যায় ভারতীয় অর্থনীতিতে গৃহীত নতুন যুগের সংস্কারগুলি অমৃতকালের প্রাণবন্ত বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করেছে । বিগত কয়েক বছরে যে মজবুত আর্থিক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে, তা সুলভে ঋনদানের দক্ষ ব্যবস্থা করে উচ্চতর বিনিয়োগ ও ভোগের মাধ্যমে আগামী বছরগুলিতে শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিকাশে অবদান রাখবে । অন্যদিকে আমরা জানি, সমস্ত ক্ষেত্রের মধ্যে উৎপাদন  ক্ষেত্রের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতা সবথেকে বেশী ।  ২০৩০ সালের মধ্যে এই ক্ষেত্রে ৬ থেকে ৭ কোটি কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা  । উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রকৃত বিকাশ হার পৌঁছাতে পারে ৯-১০ শতাংশে । উল্লেখ থাকে যে, ২০২২ সালে যা ছিল ৭-৮ শতাংশ ।    অর্থনৈতিক প্রসারণের এই দ্রুত গতির ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতীয় GDP-এর আকার জাপানের GDP-কে ছাড়িয়ে যাবে, যা ভারতকে দ্বিতীয় বৃহত্তম করে তুলবে ৷  ২০২২ সালের মধ্যে, ভারতীয় জিডিপির আকার ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের জিডিপির চেয়েও বেশী । ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি জার্মানিকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে । সুতরাং ভারতীয় অর্থনীতি এখন প্রবৃদ্ধির পথে ।  (তথ্যসূত্রঃ সংগৃহীত ও যোজনা ৮/২৩) ।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *