Categories
নারী কথা প্রবন্ধ

জানুন, ভগবান যখন ভক্তের সেবা করলো তখন কি হলো : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

শ্রীকৃষ্ণদাস সোণার নামক এক কৃষ্ণভক্ত ছিলেন । তিনি অত্যন্ত সেবাপরায়ণ ছিলেন।  সারা দিনের সমস্ত কর্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিবেদিত ছিল তাঁর। সকল কাজের মধ্যেই তিনি এমন মনোভাব রাখতেন যে, এই কর্ম তো শ্রীকৃষ্ণের জন্য করা ! এ কাজ করলে আমার শ্রীকৃষ্ণের এ জাতীয় সেবা হবে। আর তাতে আমার প্রাণগোবিন্দ অত্যন্ত প্রীত হবেন, সুখী হবেন ।—–  ঠিক যেমন ব্রজগোপিনীদের কথা আমরা জানি , তেমন । একটা উদাহরণ দেই। যেমন,  —গোপিনীরা নিজেদেরকে খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখতেন সবসময়।  তাঁরা ভাবতেন আমি যদি সুন্দর করে সেজে থাকি আর আমাকে সুন্দর লাগে দেখতে তবে শ্রীকৃষ্ণ আমায় দেখে খুব আনন্দ পাবেন। অর্থাৎ নিজেদের আনন্দের জন্য নয়। বা নিজে সুন্দরী হব এই ভাব তাদের থাকতোই না । বরং শ্রীকৃষ্ণকে সুখ দেবার জন্য ব্রজগোপিনীরা পরিপাটী করে সেজে থাকতেন। তাঁদের প্রতিটি কাজেই এ জাতীয় বোধ কাজ করতো । আবার যেমন বলা যায়,  রামায়ণের সেই বৃদ্ধা শবরী মায়ের কথা । দক্ষিণ ভারতের সেই বৃদ্ধাকে তাঁর গুরুদেব মাতঙ্গ বলেছিলেন , একদিন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রূপে তোমার কাছে সাক্ষাৎ দর্শন দিতে তোমার কুটীরে আসবেন। শবরী এতটাই ভালোবাসতেন রামচন্দ্রকে যে, রামচন্দ্র যাতে কুল খেয়ে আনন্দ পান তাই তিনি বনের কুলগাছ থেকে রামচন্দ্রের জন্য সংগ্রহ করা প্রতিটি কুল নিজে আগে একটু খেয়ে দেখতেন । মিষ্টি হলে তবেই তা তাঁর প্রভু রামচন্দ্রের সেবার জন্য রাখতেন। এভাবে তিনি বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করেছেন রামচন্দ্রের আগমনের জন্য । গুরুর কথা সত্য হয়েছিল । বাস্তবিক একদিন রামচন্দ্র হাজির হয়েছিলেন বনের মধ্যে বৃদ্ধা শবরী মায়ের কুটীরে । অতএব , নিজে খেয়ে দেখব বলে বা নিজের জিহ্বাকে আস্বাদন-আনন্দ দিতে , শবরী মে কুলগুলো খেয়ে রাখতেন তা নয় । রামচন্দ্রকে আনন্দ দেবেন বলে বাছাই করে কুল নিজে খেয়ে আগে দেখে নিতেন।  কৃষ্ণদাস সোণারও এমনই ছিলেন । তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন , ভাবতেন তা সব গোবিন্দের। আমার তো কিছু নয় । অর্থ দ্বারা গোবিন্দের সেবা করবো। এ সংসার তো তাঁর । এভাবে গঙ্গার স্রোত যেমন অবিচ্ছিন্নভাবে নিরবধি বয়ে যায় তেমন করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কৃষ্ণদাস প্রতিটি কাজ কৃষ্ণকে স্মরণ করে , কৃষ্ণের প্রীত্যর্থে করতেন।
একদিনের ঘটনা ।  কৃষ্ণদাস ভাবে বিভোর হয়ে মুখে গীত গাইছেন আর নৃত্য করছেন তাঁর ইষ্ট কৃষ্ণবিগ্রহের সামনে। মনের ভাবখানা এমন যে—- আমার নৃত্য দেখে, সংগীত শুনে আমার প্রাণনাথ, প্রাণারাম শ্রীশ্যামসুন্দর অত্যন্ত আনন্দ পাচ্ছেন তো ! আর তাই আরও দরদ ভরে গীত গাইছেন ,  আরও সুন্দর করে নৃত্যটি করার চেষ্টা করছেন তিনি ।‌ এমন সময় হলো কি চরণের নূপুরখানি খুলে পড়ে গেল তালঠোকার সময় ভুমিতে। কৃষ্ণদাস ভাবলেন , “ইস্ , নৃত্যরসের ব্যাঘাত ঘটলো !” অর্থাৎ,  যেভাবে নৃত্যটি হচ্ছিল সেই পর্যায় থেকে চ্যূত হল নৃত্যটি।  আর তাই তিনি নৃত্যের বিরাম দিয়ে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন পুনরায় নূপুরটি চরণে পড়ে নেবেন বলে । হঠাৎ এক বালক  বলে বসলো,  “দাঁড়াও , দাঁড়াও। তোমায় কষ্ট করতে হবে না। আমি পড়িয়ে দিচ্ছি। তুমি যে ভঙ্গীমায় ছিলে সেই ভঙ্গীমাতেই স্থির হয়ে দাঁড়াও।” বলতে বলতেই অপূর্ব দর্শন  বালকটি নূপুরটি চোখের নিমেষে কুড়িয়ে নিয়ে কৃষ্ণদাসের চরণে পড়িয়ে দিল। বালকের তৎপরতা দেখে কৃষ্ণদাসের ভারী ভালো লাগলো ;  বলে বসলেন, “কে গো বাছা ? কে তুমি? নাম কি তোমার ? দেখিনি তো আগে । এখানে কোথায় থাকো?” কিন্তু জিজ্ঞাসাই সার হলো। প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই বালকটি চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল।  মিলিয়ে গেল  জলছবির বা মরীচিকার মতন বাতাসে। বালক নেই , অথচ চরণে নূপুর তো রয়ে গেছে। অর্থাৎ এ তো চোখের বা মনের ভ্রম নয় । বালকটি যে সত্যই এসেছিল তার প্রমাণ খুলে যাওয়া , ছিটকে পড়া নূপুরের পুনরায় চরণে উঠে আসা। তবে কে সে বালক ? কে প্রভু ? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহের দিকে তাকাতেই যেন সব উত্তর ঠোঁটে নিয়ে হাসির মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিলেন শ্রীকৃষ্ণ— তিনিই তো সে-ই । কৃষ্ণদাস যখন বুঝলেন বালকবেশে এসে আসলে শ্রীকৃষ্ণই তাঁকে চরণের নূপুরটি পরিয়ে দিয়ে গেছেন,   তখন চোখের জল  যেন আর তাঁর বাঁধ মানে না । বক্ষ ভেসে গেল আনন্দে আবেগে। “আমার জীবন ধন্য আজ তোমার দর্শন পেয়ে প্রভু । আমি ধন্য সত্যই। আমি এ আনন্দ কাকে বোঝাবো !”— এসব বলে কৃষ্ণদাস আবেগে আপ্লুত হচ্ছেন।
কিন্তু পরক্ষণেই কৃষ্ণদাস সোণারের বড় রাগ হলো শ্রীকৃষ্ণের উপর। “এলে তো এলে,  শেষে আমার পায়ে হাত দিলে ! ছিঃ, ছিঃ।  ধিক্ আমায় ! কেন তুমি আমার পায়ে হাত দিতে গেলে বলতো, প্রভু ? কে বলেছিল, তোমায় নূপুরটা পরিয়ে দিতে ?  আমি কি নূপুরটা নিজে নিয়ে পড়তে পারতাম না ! আমার পায়ে হাত দিয়ে এভাবে আমাকে অপরাধী করলে ! দোষী বানালে ! এখন তো আমার ইচ্ছে করছে এই পা-টাকেই কেটে বাদ দিয়ে দেই।……..” —এভাবে কত না অনুযোগ করলেন সাধু কৃষ্ণদাস স্নেহাবেশে তাঁর শ্রীকৃষ্ণকে । কত না  প্রণয়কলহ চললো। কত না  ধিক্কার দিলেন । “ভৃত্যের চরণে নুপুর পড়াতে গেলে  প্রভু হয়ে ? ছিঃ, ছিঃ !  তোমার কি লজ্জাও করলো না একবারের জন্য !……” ইত্যাদি , ইত্যাদি বলেই চলেছেন কৃষ্ণদাস।
আজ শ্রীকৃষ্ণ সত্যিই বড় আনন্দ পেয়েছেন। একে তো  নিজের প্রিয় ভক্তের চরণে নূপুর পরিয়ে দিয়ে সেবা করেছেন ভক্তের।  আর তার উপর রোজ আদর খান,  আজ এত তিরস্কার পাচ্ছেন সেই ভক্তের থেকে ‌ । ভক্তের প্রণয়ভরা তিরস্কার যে তাঁর কাছে বেদ-স্তুতি মন্ত্রের চেয়েও অনেক বেশি প্রিয় ! অনেক বেশি আনন্দদায়ক ! তাঁর ঠোঁটের কোণের হাসি তাই থামছেই না যেন আজ….।

—-ভক্তকৃপাভিখারিণী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

Share This

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *