বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে ছিলেন সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট হিসেবে নিয়োগপত্র পান রোকসানা। তবে আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি তাঁর। নিয়োগের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান রোকসানা। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি ভয়ংকর বিমান দুর্ঘটনা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি ভয়ংকর বিমান দুর্ঘটনা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
পুরো নাম সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। ডাক নাম তিতলী আর প্রিয়জনদের কাছে ‘লিটল আপা’। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর প্রথম নারী বৈমানিক। তিনি ক্যাপ্টেন পদাধিকারী ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার সনদ লাভ করেন।
তার জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে। তার ডাক নাম ছিলো ‘তিতলী’, যার অর্থ ‘প্রজাপতি’। নামের প্রভাব যেন তার উপর ষোলো আনা পড়েছিল। তখনকার সমাজব্যবস্থা নারীর জন্য ছিল খুবই রক্ষণশীল। কিন্তু সেই রক্ষণশীল সমাজে থেকেও প্রজাপতির মতো ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকেননি, স্বপ্ন সত্যি করে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। হয়েছেন দেশের প্রথম নারী পাইলট। তবে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে হুঁট করেই ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে পারেননি তিনি। এর জন্য সমাজ ও নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই চালাতে হয়েছে তাকে।
রোকসানা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং নানান গুণে পারদর্শী একজন নারী। ছিলেন রেডিও-টেলিভিশনের নামকরা একজন সংগীতশিল্পীও। তত্কালীন সময়ে জার্মান ভাষার ডিপ্লোমাধারী। যা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। হাতের সামনে ছিল জার্মানির মেডিক্যালের স্কলারশিপ। চোখের সামনে উঁকি দিচ্ছিল উজ্জ্বল এক ভবিষ্যত্। তবে তিনি অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতো নিচে থেকে নয়, জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছেন নীল আকাশে উড়তে উড়তে। তাইতো অনায়াসে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জার্মানির মেডিক্যালের স্কলারশিপ। তারপর বিএসসিতে ভর্তি হন ঢাকার অন্যতম প্রসিদ্ধ উচ্চ শিক্ষালয় ইডেন কলেজে। কিন্তু অন্তরে তার অন্য বাসনা।
পাইলট হওয়ার স্বপ্ন কখনোই তার পিছু ছাড়েনি। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব খুঁজে বের করে সেখানে যোগ দেন। এর ঠিক দুই বছরের মাথায় ১৯৭৮ সালে পেয়ে যান কমার্শিয়াল বিমান চালানোর লাইসেন্স। শুধু তাই নয়, সঙ্গে পেয়ে যান সহ-প্রশিক্ষকের লাইসেন্স। যার মাধ্যমে বহু শিক্ষানবীশকে ‘সেসনা’ ও ‘উইজিয়ন’ প্লেন চালানো শেখালেন। আর এভাবেই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বপ্ন-পূরণের লক্ষ্যে তার এগিয়ে চলা শুরু।
তাকে দমিয়ে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় সব মহল থেকে। কিন্তু কোনোভাবেই থেমে থাকেননি এই নারী। সমস্ত বাধা পেরিয়ে এরপর ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের প্রথম মহিলা পাইলট হিসেবে নিয়োগপত্র পান এই নারী। দেশের সামরিক ইতিহাসে প্রশিক্ষণকালে সার্বিক বিষয়ে শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের জন্য ‘সোর্ড অব অনার’ লাভ করা তিনিই প্রথম নারী পাইলট। এরপরের ইতিহাস কেবলই গৌরবের। পরবর্তী বছরগুলোতে প্রায় ৬ হাজার ঘণ্টা বিমান পরিচালনার কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি।
তবে তার আকাশে ডানা মেলে ওড়ার পালা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নিয়োগের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালের ৪ আগস্ট এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু বরণ করেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টা ভয়ঙ্কর বিমান দুর্ঘটনা রয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ফকার এফ-২৭ বিমানে করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বৃষ্টিবিঘ্নিত আবহাওয়ার দরুন বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হন। প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিল সেদিন। একই বিমান দুর্ঘটনায় ৪৫ জন যাত্রীসহ ৪জন ক্রু সদস্য নিহত হন। নিহতদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ নাগরিক, একজন জাপানী এবং ৩৩জন মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত বাংলাদেশী ছিলেন।কেউ বাঁচেনি অভিশপ্ত বিমানের।চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আগত অভ্যন্তরীণ এই ফ্লাইটটি অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে দুইবার অবতরণের চেষ্টা করেও রানওয়ে খুজে পেতে ব্যার্থ হয়, তৃতীয়বার অবতরণের চেষ্টার সময় বিমানটি রানওয়ে থেকে ৫০০ মিটার আগেই এক জলাভূমিতে পতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়।
পরে তদন্তে প্রমাণ মেলে ওই বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল।
সৈয়দা কানিজ ফাতেমার আয়ূষ্কাল মাত্র সাড়ে আটাশ বছরের হলেও তিনি সেই অল্প সময়টাতেই রচনা করেছেন নতুন ইতিহাস, যা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ‘লিটল আপা’ উড়তে শিখিয়ে গেছেন পরের প্রজন্মের নারীদের। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ‘রোকসানা ফাউন্ডেশন’ এর উদ্যোগে ১৯৮৫ সালের জুলাই থেকে ‘মাসিক রোকসানা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে।
।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।