Categories
প্রবন্ধ

সুরের জাদুকর সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেববর্মণ এর জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

শচীন দেববর্মণ (১ অক্টোবর, ১৯০৬ – ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫) বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক , সুরকার , গায়ক ও লোকসঙ্গীত শিল্পী । কিছুটা অনুনাসিক কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি তার শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রায় একশো বছর পার করেও বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তার কালোত্তীর্ণ গানের আবেদন কিছুমাত্র লঘু হয়নি। কেবল সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে নয়, গীতিকার হিসাবেও তিনি সার্থক। তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পুত্র রাহুল দেববর্মণ ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতপরিচালক এবং সুরকার ছিলেন। তার ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেববর্মণ গীতিকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।

 

তার জন্ম কুমিল্লার ত্রিপুরা রাজবাড়িতে৷ তবে আদিবাস বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে৷ তিনি ছিলেন ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজপরিবারের সন্তান। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত কুমিল্লার রাজপরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মা মণিপুর রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী। ত্রিপুরার আগরতলায় কুমার বোর্ডিং স্কুলে শচীন দেবের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়।

 

ছোটবেলা থেকেই একটি সংগীতময় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন শচীন দেব বর্মন। বাবা ছিলেন একজন সেতারবাদক ও ধ্রুপদী সংগীত শিল্পী। বাবার কাছেই গ্রহণ করেন সংগীতের প্রথম তালিম।১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে হতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে সঙ্গীতচর্চা করেন। এরপর তার সঙ্গীত শিক্ষা চলে উস্তাদ বাদল খান এবং বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। ধ্রূপদী সঙ্গীতের এই শিক্ষা তার মধ্যে সঙ্গীতের মৌলিক জ্ঞান সঞ্চারে গভীর ভূমিকা পালন করে। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনের সুর-সাধনায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তীতে তিনি উস্তাদ আফতাবউদ্দিন খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

 

শচীন দেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে ত্রিপুরার রাজদরবারে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে চাকরি ছেড়ে কলকাতায় যান এবং ওস্তাদ বাদল খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, আবদুল করিম খাঁ প্রমুখের কাছে তালিম নেন। ১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে শচীন দেব প্রথম গান করেন এবং ১৯৩২ সালে তার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ হয়। এর পর তার বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড বের হয়।তিনি  নজরুল সঙ্গীতও রেকর্ড করেন। এরপর তাঁর বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ডকৃত তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো: ‘যদি দখিনা পবন’ (রাগপ্রধান), ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ (কাব্যগীতি), ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ (পল্লিগীতি), ‘বধুঁগো এই মধুমাস’ (পল্লিগীতি), ‘ওরে সুজন নাইয়া’ (পল্লিগীতি) প্রভৃতি।
শচীন দেব অনেক বাংলা গানে সুর দিয়েছেন। ১৯৩৪ সালে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মিলনে গান গেয়ে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি হলো: রাজগী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গিনী, মাটির ঘর ইত্যাদি।
শচীন দেব ১৯৪৪ সাল থেকে মুম্বাই-এ বসবাস করেন এবং আশিটির মতো হিন্দি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে চিত্রজগতে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। সেখানে তিনি শিকারী, দেবদাস, সুজাতা, বন্দিনী, গাইড, আরাধনা, বাজি, শবনম, দো ভাই প্রভৃতি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

 

অসংখ্য কালজয়ী গান যেমন তার হাত ধরে এসেছে। ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি?’ কিংবা ‘আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ অথবা ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ আরও আছে ‘শোনো গো দখিন হাওয়া’, ‘নিশিতে যাইও ফুল বনে’, ‘কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া’! এখানেই শেষ নয়! ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল-বিছানো পথে’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে’, ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা’।

তেমনি তিনি গড়ে তুলেছেন এই উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালককেও। ভারতীয় সংগীতে তিনি স্রষ্টার মতো। গানের আঙিনায় তাকে সম্মান করে ডাকা হয় ‘কর্তা’ বলে। লোকজ ও রাগ সংগীতের সংমিশ্রণে সংগীত ভুবনে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তিনি।

শচীন দেববর্মণ তার সংগীত জীবনে অসংখ্য গানের সুর করেছেন, যার অধিকাংশ গানই লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, কিশোর কুমার, মো. রফি ও আশা ভোসলের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের গাওয়া। তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাও করেছেন।
শচীন দেববর্মণের পুত্র রাহুল দেববর্মণও ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতপরিচালক এবং সুরকার ছিলেন। তার ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেববর্মণ গীতিকার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শচীন দেব বর্মন জয় করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পদ্মশ্রী, ফিল্মফেয়ার এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, সহ  বহু সন্মাননা। শচীন দেব বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে উচ্চ পদ অলঙ্কৃত করেন এবং বহু সংগঠন কর্তৃক সম্মানিত হন। ১৯৫৮ সালে সঙ্গীত-নাটক আকাদেমি ও এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি (লন্ডন) এবং ১৯৬৩ সালে ত্রিপুরা ললিতকলা কেন্দ্র তাঁকে অভিনন্দিত করে।
আজ সেই কিংবদন্তি শচীন দেববর্মণের জন্মদিন।

১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সংগীতের এই কিংবদন্তি। তাকে এস ডি বর্মণ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।

Share This
Categories
প্রবন্ধ

নিকুঞ্জ সেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একজন বাঙালি বিপ্লবী ও লেখক, জন্মদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের অব্যর্থ পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের থেকে ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পেয়েছে। ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয় এবং যার ধারাবাহিকতায় ভারত স্বাধীন হয়, তার মূলে যে সকল বিপ্লবীর নাম সর্বজন স্বীকৃত তাঁদের মধ্যে নিকুঞ্জ সেন প্রথমসারির একজন অন্যতম বিপ্লবী ছিলেন। নিকুঞ্জ সেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যিনি দেশমতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ রূপে।

 

বাংলা বহু প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধার জন্মভূমি।  তবুও, নায়কদের কথা কম বলা হয়, নামগুলি বিস্মৃতিতে ঝাপসা।  নিকুঞ্জ সেন তেমনই একটি নাম। ১ অক্টোবর ১৯০৬ সালে অবিভক্ত বাংলার ঢাকার খামারপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন, তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন প্রবল সমর্থক ছিলেন।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য কলকাতায় এসে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন।  তিনি হেমচন্দ্র ঘোষ প্রতিষ্ঠিত যুগান্তর দলের মুক্তি সংঘের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং পরে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য হন।  কুমিল্লার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ স্টিভেনসকে হত্যার পরিকল্পনা করেন শান্তি ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরী ললিত বর্মনের নেতৃত্বে।  সেন ঢাকার বিক্রমপুরের বানারীপাড়া স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে বিপ্লবী সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য যোগ দেন।  এখানে তাঁর ছাত্র হিসাবে, তিনি করিডোর যুদ্ধের নায়ক বাদল গুপ্তকে পেয়েছিলেন যার মধ্যে তিনি দেশাত্মবোধক মূল্যবোধ গেঁথেছিলেন।
অত্যাচারী কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করার জন্য রাইটার্স বিল্ডিং-এ করিডোর যুদ্ধের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।  মিশনের জন্য ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর নির্ধারিত ছিল।  একটি অ্যাকশন স্কোয়াড গঠন করা হয়েছিল যার মধ্যে নিকুঞ্জ সেন, হরিদাদ দত্ত, রাসময় সুর, প্রফুল্ল দত্ত এবং সুপতি রায় ছিলেন।  বিনয় বসুকে মিশনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল যখন বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত তাকে সহায়তা করবেন।  মিশনের দুই দিন আগে, নিকুঞ্জ সেন বাদল ও দীনেশকে ভবনের চারপাশে নিয়ে যান যাতে মিশনের সময়ই ঘরগুলো সহজেই চিনতে পারে।
প্রফুল্ল দত্তের তৈরি রাইটার্স বিল্ডিংয়ের একটি নকশা বিনয় বসুর কাছে পাঠানো হয়েছিল যিনি লেম্যান এবং হাডসনকে হত্যার অভিযোগের কারণে একটি আস্তানায় ছিলেন।  পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বরে নিকুঞ্জ সেন বাদল এবং দীনেশের সাথে পাইপ রোড, কিদারপুরে পৌঁছান।  বিনয়ের সাথে রসময় স্যার।  ত্রয়ী একটি ট্যাক্সিতে চড়ে যখন নিকুঞ্জ সেন এবং রাসময় সুর চিড়িয়াখানায় পৌঁছে যেখানে সুপতি রায় অপেক্ষা করছিলেন।  জিতেন সেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কাছে লালদিঘিতে অপেক্ষা করছিলেন চিড়িয়াখানায় অপেক্ষারত দুজনকে খবরটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে মুহূর্তে তিনি লেখকদের কাছ থেকে ‘বন্দেমাতরম’ শুনতে পাবেন।

নিকুঞ্জ সেন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং পুরো পরিকল্পনাটির মাস্টারমাইন্ড করেন।  সেন ও তার কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতার করতে না পেরে তারা বাগুতে লুকিয়ে ছিলেন।  তিনি ১৯৩১ সালে গ্রেফতার হন এবং সাত বছরের জন্য জেলে ছিলেন।  আবার, তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কারাবরণ করেন। পরে তিনি শরৎ বসুর গঠিত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন এবং পার্টি বুলেটিন ‘মহাজাতি’-এর সম্পাদক ছিলেন।  তিনি আরও কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  এরপর তিনি বাগুর সপ্তগ্রাম সর্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  তিনি স্থানীয়দের কল্যাণে সমাজকল্যাণ সংস্থা ‘পল্লীনিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেন।

 

তিনি ‘জেলখানা কারাগার’ (জেল জেল), ‘বক্সার পোর দেউলিয়া’ (বক্সার পরে দেউলিয়া), ‘ইতিহাশে আর্তনোইটিক ব্যাক্ষা’ (ইতিহাসে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা), ‘নেতাজি ও মার্কসবাদ’ (নেতাজি ও মার্কসবাদ) ইত্যাদি বই লিখেছেন।  রাজারহাটের এলাকার নামকরণ করা হয়েছে ‘বিপ্লবী নিকুঞ্জ সেন পল্লী’।

বিপ্লবী নিকুঞ্জ সেন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২ রা জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

 

।। তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
প্রবন্ধ রিভিউ

জানুন আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস কি, কবে পালিত হয় এবং দিনটি পালনের গুরুত্ব।

ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ ওল্ডার পারসন / আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস (IDOP) হল একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা ইভেন্ট যা প্রতি বছর ১লা অক্টোবর উদযাপিত হয় যেটি বার্ধক্যজনিত চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলির বিষয়ে জনসচেতনতার উপর জোর দেয় এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য সম্প্রদায়ের সংগঠন, পরিবার এবং স্টেকহোল্ডারদের সংগঠিত করে।  চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।এই বছর ২০২৩, আন্তর্জাতিক বয়স্ক ব্যক্তি দিবসের থিম হল “বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা: প্রজন্ম জুড়ে”, বিশ্বব্যাপী বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের অধিকারের ক্ষেত্রে অনন্য চাহিদার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার আহ্বান এবং  প্রতিপালন ছাড়াও লঙ্ঘনের প্রতিবেদন করা

এই দিনে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় সংস্থাগুলি বয়স্ক ব্যক্তিদের মঙ্গল এবং মর্যাদা নির্বিশেষে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ইভেন্ট, জাতীয় জরিপ, সামাজিক প্রচারণা এবং অন্যান্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং কর্মশালা পরিচালনা করতে একত্রিত হয়।

 

আন্তর্জাতিক বয়স্ক ব্যক্তি দিবসের ইতিহাস (IDOP)—

 

১৪ ই ডিসেম্বর, ১৯৯০ তারিখে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (UNGA) ১ অক্টোবরকে প্রবীণ ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস (IDOP) হিসাবে ঘোষণা করে।  এটি ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান অফ অ্যাকশন অন এজিং (ভিআইপিএএ) এর সূচনার আগে ছিল, যা ১৯৮২ সালে ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলি অন এজিং (WAA) দ্বারা গৃহীত হয়েছিল এবং একই বছরের পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল।

 

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বয়স্ক ব্যক্তি দিবস (UNIDOP) ২০২৩ এর উদ্দেশ্য–

 

সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (UDHR) সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণামূলক অঙ্গীকারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রবীণ নাগরিকদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের মানবাধিকারের সুরক্ষা বৃদ্ধি করা।

সর্বত্র মানবাধিকার রক্ষার জন্য আন্তঃপ্রজন্মীয় মডেলগুলি থেকে আলোচনা করা এবং জ্ঞান অর্জন করা

সরকার এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলিকে তাদের কাজের মধ্যে মানবাধিকারের জীবনধারার পদ্ধতিকে একীভূত করার জন্য তাদের বর্তমান অনুশীলনগুলি পুনর্বিবেচনা করতে উত্সাহিত করা এবং চেষ্টায় সুশীল সমাজ, জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের সহ সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

 

 আন্তঃপ্রজন্মীয় সংহতি এবং অংশীদারিত্ব জোরদার করতে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য স্বাস্থ্যকর টিপস—

 

বয়স্ক ব্যক্তিদের অর্থ, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের সহায়তা এবং আত্ম-সহায়তার ব্যবস্থার মাধ্যমে পর্যাপ্ত খাবার, জল, বাসস্থান, বস্ত্র এবং স্বাস্থ্যসেবা থাকা উচিত।

বয়স্ক ব্যক্তিদের কাজ করতে সক্ষম হওয়া উচিত বা বিকল্প আয়-উৎপাদনের বিকল্পগুলিতে অ্যাক্সেস থাকতে হবে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অ্যাক্সেস থাকা উচিত।

বয়স্ক ব্যক্তিদের এমন পরিস্থিতিতে থাকতে দেওয়া উচিত যা তাদের পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং ক্ষমতার জন্য নিরাপদ এবং নমনীয়।

 

আন্তর্জাতিক বয়স্ক ব্যক্তি দিবস ২০২৩ থিম—

 

এই বছর ২০২৩, আন্তর্জাতিক বয়স্ক ব্যক্তি দিবসের থিম হল “বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা: প্রজন্ম জুড়ে”, বিশ্বব্যাপী বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের অধিকারের ক্ষেত্রে অনন্য চাহিদার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার আহ্বান এবং  লঙ্ঘনের প্রতিবেদন করা, প্রজন্মের মধ্যে ইক্যুইটি এবং পারস্পরিকতার মাধ্যমে সংহতি গড়ে তোলার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলির (SDG) প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সরবরাহ করে।

বছরের পর বছর, আন্তর্জাতিক বয়স্ক ব্যক্তি দিবসের (আইডিওপি) থিমগুলি হল:

 

বয়স্ক ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস ২০২২ থিম: পরিবর্তনশীল বিশ্বে বয়স্ক ব্যক্তিদের স্থিতিস্থাপকতা

 

বয়স্ক ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস ২০২১-এর থিম: সকল বয়সের জন্য ডিজিটাল ইক্যুইটি

 

বয়স্ক ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস ২০২০ থিম: মহামারী: তারা কি পরিবর্তন করে যে আমরা বয়স এবং বার্ধক্যকে সম্বোধন করি?

 

বয়স্ক ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস ২০১৯-এর থিম: বয়সের সমতার দিকে যাত্রা

 

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।

Share This
Categories
উপন্যাস

দামাল মেয়ে কুহেলি (ধারাবাহিক উপন্যাস ,ষোড়শ পর্ব) : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)

কোচবিহার মদনমোহন মন্দিরের অন্যতম কর্মকর্তা সুরেশবাবুর কাছে পুলিশি অভিযান ও শহরের যত্রতত্র পাচারকারীদের ঘোরাঘুরির খবর পেয়ে কুহেলি যারপরনাই চিন্তিত হয়ে উঠলো । মন্দিরে থাকাটা তাদের কাছে আর নিরাপদ হবে না ভেবে কুহেলি প্রমাদ গুণতে লাগলো, অতঃপর কী করা যায় ? আর এখানে থাকা খুব ঝুঁকিবহুল । সুতরাং অন্যত্র চলে যাওয়াই শ্রেয় !
পুবালী এই ফাঁকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলো কুহেলিকে । কুহেলি বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিপক্ষে । কেননা তার মতে, নারী পাচার চক্র এখনও ধরা পড়েনি । তারা বহাল তবিয়তে উত্তরবঙ্গ সহ নানান জায়গায় অবাধে ঘোরাফেরা করছে । এখনও তাদের শকুনের দৃষ্টি । মেয়েদের ফুসলিয়ে বা যেভাবে হোক কব্জায় এনে ভিন্ন জায়গায় পাচার করা । পাচারের গ্যাং ধরা পড়লে তাদের বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ হতো । যেহেতু তারা পাচার চক্রের হাত থেকে পালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেহেতু তারা এখন পাচার চক্রের চক্ষুশূল । যেকোনো মুহূর্তে তারা পাচারকারীদের হাতে ধরা পড়তে পারে । তাই কুহেলি ঠিক করলো, মন্দির থেকে পালাতে । কিন্তু বাড়িতে নয় ! কোথায় যাবে সেই চিন্তায় কুহেলি ও পুবালী অস্থির ?
ইতিমধ্যে কোচবিহার শহরে শুরু হয়েছে শক্তপোক্ত পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা । জোর কদমে চলছে পুলিশি টহল । তা ছাড়া থানা থেকে এলাকার বিশেষ বিশেষ মানুষকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছে, শহরে নারী পাচাকারী চক্র ঘোরাফেরা করছে । যেকোনো মুহূর্তে তারা অঘটন ঘটাতে পারে । তাই নাগরিকদের সচেতনার নিরিখে থানার বড়বাবুর পরামর্শ, শহরে কোনো মেয়ে যেনো একা একা ঘোরাফেরা না করে বা অবাঞ্ছিত কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশকে সত্বর জানায় ।
কোচবিহার শহরে সন্ধ্যাবেলায় থমথমে পরিবেশ । কুহেলিরা খুব সাবধান মতো মন্দিরের ভিতরে কাজকর্ম সারছে । সুরেশবাবু পুনরায় কুহেলি ও পুবালীকে ডাকলেন এবং জানতে চাইলেন, তাদের পরবর্তী কী চিন্তাভাবনা ? কুহেলি আমতা আমতা করে সুরেশবাবুকে বোঝালো, “আমাদের কয়েকটা দিন সময় দিন । আমরা মন্দির ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবো । এই মুহূর্তে চারদিকে পাচারকারীদের আনাগোনা । সুতরাং এইরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে বের হলে আমরা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে যাবো । তাতে আখেরে আমাদের বিপদ !“
সুরেশবাবু তাদের অভয় দিয়ে বললেন, “এখানে থাকায় আমার আপত্তি নেই । মন্দিরে অনেক ভক্তের আগমন । বিভিন্ন জায়গার ভক্তদের আনাগোনা । সবাইকে আমরা চিনিও না বা জানিনা । কখন কে কী মতলব নিয়ে মন্দিরে আসে এবং বেরিয়ে যায় আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন ! মন্দিরে প্রবেশ অবাধ । সুতরাং মন্দিরের দরজা বন্ধ রাখতে পারবো না । মন্দির যতক্ষণ খোলা থাকবে মানুষের আনাগোনা থাকবেই । এর মধ্যে পাচারকারী-দুর্বৃত্তরা মন্দিরে ঢুকে তোমাদের উপর নজর রাখলে, সেই ক্ষেত্রে বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে ! তাতে তোমাদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না । তাই তোমাদের হিতার্থে আমি একটা পরামর্শ দিচ্ছি ।
পুবালী নড়েচড়ে বসে বেশ আগ্রহ দেখিয়ে সুরেশবাবুকে বলল, “আপনি বলুন । আপনার পরামর্শ কী ?”
“এই জেলার মাথাভাঙায় আমার পরিচিত খুব সুন্দর একটি আশ্রম আছে । তোমরা কিছুদিনের জন্য সেখানে গিয়ে গা-ঢাকা দিতে পারো । থাকার ব্যবস্থা খুব ভাল । আর তা ছাড়া তাদের আটোসাটো নিরাপত্তা ব্যবস্থা । তোমরা থাকতে চাইলে আমি সেই আশ্রমের মহারাজকে বলে দিচ্ছি । সুতরাং তোমাদের থাকার কোনো অসুবিধা হবে না । যে কদিন থাকতে চাও, থাকতে পারবে । সেখানে আশ্রমে প্রবেশ অবাধ নয়, অনুমতি সাপেক্ষে আশ্রমে ঢোকা যায় । অনেক টাইট নিরাপত্তা ব্যবস্থা । এইবার তোমরা ভেবে দ্যাখো, কী করবে । এখানে থাকাটা তোমাদের ক্ষেত্রে টেনশনের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ! সুতরাং আমার পরামর্শ ভেবে দেখতে পারো ।“ সুরেশবাবু সবিস্তারে জানালেন ।
কিন্তু মাথাভাঙা যাওয়ার সময় আমরা অতি সহজে দুর্বৃত্তদের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি ।
সেই ব্যবস্থা আমি করছি । যাতে তোমারা নিরাপদে মাথাভাঙার আশ্রমে পৌঁছাতে পারো, সুরেশবাবু আশ্বস্ত করলেন ।
কুহেলি ভেবে দেখলো মাথাভাঙা যাওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায়ও নেই, যার উপর ভিত্তি করে কোচবিহার শহরে থেকে যাবে । তাই সুরেশবাবুর প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত ভেবে কুহেলি সুরেশবাবুকে বলল, “আপনি আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করুন । আমরা মাথাভাঙার আশ্রমে পরের কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে চাই ।“
পুবালীর মুখটা ব্যাজার ! তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা । বাড়ির কারও সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই । বাবা-মা ছাড়া আত্মীয় স্বজন কারও সঙ্গে দেখা হচ্ছে না । বন্ধু-বান্ধবীরা নিশ্চয় খোঁজ খবর নিচ্ছে । পুবালীর বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ছে । ছোট ভাইয়ের দুষ্টুমীর ভাগিদার হতে পারছে না । বাবার আহ্লাদ ও মায়ের বকুনি থেকে সে বঞ্চিত । এইসব ভেবে পুবালীর মনটা দুঃখে ভরপুর । কোনোকিছুতেই তার মন নেই । মাথাভাঙার আশ্রমে যেতে তার ভীষণ আপত্তি । কুহেলি তাকে বোঝাচ্ছে, এই মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেওয়া সেটা হবে বোকামী । তাদের কাছে ‘নদীর তীরে এসে নৌকা ডোবার’ ন্যায় । কেননা পাচারকারীদের শ্যেনদৃষ্টি চতুর্দিকে । পুনরায় তাদের গোচরে পড়লে বিপদের শেষ থাকবে না । নির্ঘাত ভিনদেশে চালান হতে হবে । ফলে বাকী জীবন অন্ধকার জগতে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় থাকবে না । সেই অন্ধকার জগতে ঢোকার চেয়ে আর কয়েকটা দিন মাথাভাঙার আশ্রমে কাটিয়ে দেওয়াটা তাদের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ । কুহেলি পুনরায় পুবালীর দিকে তাকিয়ে জোর দিয়ে বলল, এবার পুলিশের জালে পাচারকারীরা পড়তে বাধ্য । একবার এই দলটা ধরা পড়লে তাদের মুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে । তখন লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফেরায় এতটুকু টেনশন থাকবে না । সুতরাং আর কটাদিন এদিক-ওদিক কাটিয়ে দিতে পারলে স্থায়ীভাবে এবং নির্ভয়ে এলাকায় বাস করতে কোনো বাধা থাকবে না ।
এক চিলতে হাসি দিয়ে পুবালী বলল, “ঠিক আছে ।“
পরেরদিন খুব ভোরে কাঁচ লাগানো এসি গাড়িতে পুবালী ও কুহেলি গিয়ে উঠলো মাথাভাঙার আশ্রমে । সেখানে পৌঁছে দেখে আশ্রমবাসীর তখনও ঘুম ভাঙ্গেনি । তখনও আশ্রমের সকলে ঘুমাচ্ছে । সূর্য পূর্ব আকাশে উদয়ের পথে । চারিদিকে পাখির কলরব । দূরে মুরগীর ডাক । কৃষি প্রধান এলাকা । চারিদিকে চাষের জমি । মাথাভাঙা একটি ছোট্ট শহর । কিন্তু আশ্রমটি মাথাভাঙা শহর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে । জায়গাটা খুব নিরিবিলি । আশেপাশে চাষের জমি ছাড়া যদিও কিছু বসত বাড়ি রয়েছে । সেখানকার মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল নয়, বাড়িঘর ও লোকজনের হাঁটাচলাতে সেটা পরিষ্কার । চারিদকটা দেখার মাঝখানে একজন বয়স্ক মহিলা চোখ রগড়াতে রগড়াতে কুহেলির কাছে এসে বললেন, “তোমরা কী কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির থেকে এসেছো বাছা ?”
“হ্যাঁ ।“ পুবালী প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো ।
ঘরে এসে বসো মা । আশ্রমের মহারাজ প্রাতঃকালীন ভ্রমণে বেরিয়েছেন । তিনি একটু পরে এসে পৌঁছাবেন । ততক্ষণে আমি চা করে আনছি । তোমরা চা খেয়ে একটু জিড়িয়ে নাও ।
কুহেলি লক্ষ করলো, ভদ্রমহিলা বয়স্ক হলেও যথেষ্ট মার্জিত । তাঁর ব্যবহারও অমায়িক । তাঁর কথাবার্তায়, কোথায় যেনো মায়া জড়ানো । বয়স্ক মহিলাকে দেখার পর কুহেলির বারংবার মনে হচ্ছে, “তিনি অনেকদিনের পরিচিত আপনজন ।“ কুহেলি আর দেরী না করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো ।
বয়স্ক মহিলা আর কেউ নন, তিনি শ্রাবন্তী মাসি । আশ্রমে সকলের মায়ের মতো । কুহেলিকে প্রণাম করা দেখে শ্রাবন্তী মাসি বললেন, “থাক্‌ মা । প্রণাম করতে হবে না । তোমরা একটু বসো । আমি চা করে আনছি । ততক্ষণে আশ্রমের মহারাজ এসে যাবেন ।“
বসার ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । অনেকটা বড় । চারিদিকে মহাপুরুষদের ছবিতে ভরা । টেবিল চেয়ারের পেছনে বইয়ের আলমারী । খোলা আলমারী । বইগুলি পরিপাটিভাবে সাজানো । বইয়ের ভাণ্ডার দেখে বোঝা যাচ্ছে, মহারাজ পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । কুহেলি বইয়ের আলমারীর পাশে গিয়ে দেখলো, তাতে সব ধরনের বই সাজানো । পাঠ্য বই ছাড়া বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস, ধর্মের বই, বেদ এমনকি উপনিষদ, ভ্রমণের বই, প্রবন্ধের বই, ইত্যাদি । বইয়ের ভাণ্ডার দেখে মহারাজের রুচিবোধের একটা ধারণা কুহেলির মধ্যে জন্মালো ।
শ্রাবন্তী মাসি চা নিয়ে হাজির । সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট । চা খাওয়ার সময় কুহেলি শ্রাবন্তী মাসির সাথে দু-চারটে কথা বলার সুযোগ পেলো ।
কুহেলি প্রথমেই প্রশ্ন করলো, “মাসি, আশ্রম চলে কী করে ? অর্থাৎ আশ্রম চালাতে খরচ কোথা থেকে আসে ?”
আমি তো সব জানি না বাপু । তবে আশ্রমের নামে কয়েক বিঘা জমি আছে । সেই জমিতে ধান চাষ হয় । সেই ধানের চালে আশ্রমের লোকেদের সারা বছরের খাবার জোটে । আশ্রমে কিছু দুস্থ ছেলে-মেয়ে থাকে । তারা পড়াশুনা করে । আগে যারা পাশ করে বেরিয়ে গেছে, তারা মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠায় । সেই টাকায় নুন-তেল-হলুদের মতো দৈনন্দিন খরচা উঠে আসে । এছাড়া ভক্তরা তাঁদের সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা করে । সেই আর্থিক সহায়তায় অন্যান্য খরচ মিটে যায় । এইটুকু মোটামুটি আমি জানি ।
আচ্ছা মাসি, আশ্রমের উদ্দেশ্য কী ? অন্যভাবে বলতে গেলে আশ্রমের ভাবনা কী ? কী প্রয়োজনে আশ্রমের প্রতিষ্ঠা ?
উত্তরে শ্রাবন্তী মাসি বললেন, “আমাদের মহারাজ বলেন, মানুষের সেবা করা আমাদের ব্রত । মানুষের হিতার্থে আশ্রমের কাজকর্ম ।“
এইসব অগোছালো কথাবার্তার মাঝে আশ্রমের মহারাজ এসে উপস্থিত । তিনি সোজা স্নানে ঢুকলেন । দূর থেকে বোঝা গেলো, লম্বা-চওড়া একজন সুপুরুষ ! তবে বয়সটা মনে হলো, হাল্কা বয়স । মহারাজ আসার সাথে সাথে মাসি উঠে চলে গেলেন । তিনি বললেন, “ছেলেটা এসেছে । তার কিছু দরকার হলে আমাকে ডাকবে । তোমরা বরং একটু বসো । আমি মহারাজের সঙ্গে দেখা করে আসি ।“
কুহেলি ও পুবালী বসে রইলো । উত্তরবঙ্গের খবরের কাগজ আশ্রমে পৌঁছে গেলো । খবরের কাগজের হেড লাইনের খবরগুলিতে চোখ গেলো কুহেলির । “গভীর রাত্রিতে পাচারকারীদের সাথে পুলিশির খণ্ডযুদ্ধ । কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ না থাকায় পুলিশি অভিযান ভেস্তে গেলো ।“ ভিতরে আরও লেখা, পুলিশ নাকি পাচারকারীদের ডেরা ধরতে পেরেছে । খুব শীঘ্র পাচারকারীর দল পুলিশের জালে ধরা পড়তে বাধ্য । পাচারকারীদের ডেরার চারিপাশে পুলিশি তল্লাশি অব্যাহত । প্রয়োজনে আধা সামরিক বাহিনী নামার সম্ভাবনা ।
শ্রাবন্তী মাসি কুহেলি ও পুবালীকে ডাকলো, “চায়ের টেবিলে আশ্রমের আবাসিকরা আসছে । তাদের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মহারাজ বললেন । সুতরাং তোমরা আমার সঙ্গে এসো । আগে সকলের সঙ্গে আলাপ হোক । তারপর হাত মুখ ধুয়ে সকালের জলখবার খাওয়া ।“
চায়ের টেবিলে বারোজন ছাত্র এবং চারজন ছাত্রী । পাঁচজন আবাসিক সর্বক্ষণ মাঠের জমি দেখাশোনা করে । দুজন মহিলা । আশ্রমের অন্যান্য কাজকর্মে তারা নিয়োজিত । আশ্রমে বলদ গরু নেই, কিন্তু দুগ্ধবতী গরু চারটি । বাছুর আপাতত তিনটি । অর্থাৎ তিনটি গরু এখন দুধ দিচ্ছে । একটি গাই-গরু সম্ভবত বাচ্চা দেবে । মহারাজকে সহযোগিতা করার জন্য সর্বক্ষণের কুমারদা । তার কাজ হচ্ছে আশ্রমের ভালমন্দ দেখাশোনা করা । ছেলে-মেয়েদের স্কুলের/কলেজের সাথে যোগাযোগ রাখা । তাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়া । ছাত্রদের কোনো গৃহশিক্ষক নেই । কুমারদা তাদের গৃহশিক্ষক । সকলের সাথে আলাপ করে কুহেলি উৎফুল্ল । সে অন্তত এখানে একটা ঘরোয়া পরিবেশ পেলো । তার ভিতর থেকে ভয়টা ক্রমশ বিদায়ের পথে । সকলে যথেষ্ট আন্তরিক । একে অপরের সুবিধা-অসুবিধায় প্রত্যেকে সজাগ । তাই কুহেলির মনে হচ্ছে, সে এখন ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে । আর দমবন্ধ জীবন নেই । দমবন্ধ জীবন থেকে সাময়িক মুক্তি । আশ্রমের আবাসিকরা সকলেই হাসিখুশী ও কর্মঠ ।
জলখাবার রেডি । দুটো করে আটার রুটি, সবজির তরকারি । ঝাল ঝাল করে ধনে পাতা দিয়ে আলু ও কুমড়োর তরকারি । খাবার ঘরে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার রেওয়াজ । কারও কলেজ/স্কুল থাকলে আলাদা কথা । মাঠের জমিতে যারা কাজে যান, তাদের জলখাবার কেউ না কেউ জমিতে পৌঁছে দিয়ে আসে । শ্রাবন্তী মাসি মহারাজকে ডাকলেন । তার কথাবার্তায় কুহেলি বুঝতে পারলো, মহারাজ শ্রাবন্তী মাসিকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন ।
পুবালী বাইরের কলে হাত ধুতে গেলো । এমন সময় মহারাজ সকালের জলখাবার টেবিলে হাজির । সোজা কুহেলি চোখে চোখ পড়তেই কুহেলির মনে হলো, ভদ্রলোকটি তার অনেকদিনের চেনা ।
কুহেলি হাত জোড় করে মহারাজকে নমস্কার জানালো
মহারাজ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোন্‌ ভোরে বের হয়েছেন । টিফিন খেয়ে আপনারা একটু বিশ্রাম নিন ।“
তার দরকার হবে না স্যার । এখানে সকল আবাসিকের সাথে আলাপ হয়ে মনে হচ্ছে, নিজের বাড়িতে আছি । সুতরাং আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে আপনি অযথা উতলা হবেন না । আমরা খুব ভাল জায়গায় এসেছি এবং নিরাপদ বোধ করছি ।
সুরেশবাবুর কাছে আপনাদের সম্বন্ধে কিছুটা শুনেছি । বাকীটা আপনাদের মুখ থেকে শুনবো । নিশ্চিন্তে ও সাবধানে থাকুন । আশা করি আপনাদের আর কোনো বিপদ হবে না । তবে সাবধানে থাকাটা যুক্তিযুক্ত ।
কুহেলির হঠাৎ প্রশ্ন, “স্যার, আপনার মতো শিক্ষিত ও গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি । কিন্তু আমার মনে একটা খটকা, “আপনি গার্হস্থ্য জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে কেন আশ্রমবাসী হলেন, এটা খুব জানতে ইচ্ছা করছে ?“
আপনার প্রশ্নটা অমূলক নয় ! এই প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ আগেও বহুবার হয়েছি । আপনি বলতে পারেন, আমি মানুষের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছি । এটা আমার জীবনের ব্রত ।
কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকায় মাথাভাঙার মতো জায়গায় আশ্রম খুঁজে পেলেন কী করে ?
সেটাও একটা ইতিহাস । ঘটনাচক্রে আমার জীবনে একটা দূঃসময় আসে । সেই সময় আমি এলোপাথারি ঘোরাঘুরি করি । “সংসার জীবনে ঢুকবো না” স্থির সিদ্ধান্ত নিই । তখন আমার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী এই আশ্রমের হদিস দিলো । তাঁর বন্ধু মাথাভাঙা হাইস্কুলে চাকরি করার সুবাদে তিনি এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন । হাইস্কুলের মাস্টার মশাই আবার এই আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা । তিনি আমাকে পেয়ে আশ্রমের দায়িত্বে বসিয়ে দিলেন । আগের মহারাজ বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন । বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার তাঁর তাগাদা ছিল । মাস্টার মশাই আমাকে পেয়ে আগের মহারাজকে বাকী জীবনের জন্য ছুটি দিয়ে দিলেন । তিনি এখন বাংলাদেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন । আর আমি এখন আশ্রম সামলাচ্ছি । আশ্রমে যারা রয়েছেন, প্রত্যেকে খুব ভাল মানুষ । শ্রাবন্তি মাসি সকলের কাছে মায়ের মতো । ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রাবন্তী মাসিকে খুব ভালবাসে । যার জন্য তাদের যতো আবদার, সবটাই শ্রাবন্তি মাসির কাছে ।
তারপর মহারাজ কুহেলির দিকে তাকালো, “আপনার আর কী প্রশ্ন ?”
প্রশ্ন অনেক । তবে একসঙ্গে নয় । পরে অবসর সময়ে আশ্রম নিয়ে কথা বলা যাবে । ঠিক সেই মুহূর্তে পুবালী হাত ধুইয়ে খাওয়ার টেবিলে হাজির । শ্রাবন্তি মাসি দুখানা রুটি ও আলু-কুমড়োর তরকারি এগিয়ে দিলেন । রুটি দেখে পুবালীর মাথা গরম । মুখে বলতে পারছে না, অথচ খেতেও চাইছে না ।
মহারাজের ঠিক উল্টোদিকে পুবালী বসলো । যার জন্য মহারাজের মুখ পুবালী দেখতে পেলো না । তাই পুবালী জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা কুহেলি !”
“কী ?” কুহেলি জানতে চাইলো ।
আশ্রমের মহারাজকে দেখতে পেলাম না ?
এবার মহারাজ পুবালীর উদ্দেশে বলল, “মহারাজ তো আপনার পাশেই !”
মহারাজ পুবালীর দিকে তাকাতেই, পুবালী চমকে গেলো ! সে কাকে দেখছে ?
( চলবে )

Share This